‘পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের বাঁধনে বন্দী মানুষের জানাটা অত্যন্ত সীমিত এবং অজ্ঞ ও অন্ধের জানা। এই বৃত্ত থেকে একবার মুক্ত হতে পারলে তবেই মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয় বহির্ভূত অজানা, অচেনা, অসীম, অনন্ত আরো একটি জগৎকে জানতে পারবে এবং তখন সে নিজেই উপলব্ধি করবে যে- সে অসীম, অনন্ত ও প্রচণ্ড অলৌকিক সত্তায় শক্তিমান আর তখনই সে ছুঁতে পারবে, অনন্ত-অসীম, বিশাল ও ব্যাপক অন্য আরো একটি জগৎ ও সত্তাকে।’
- জ্যঁ নিকোলাস আর্তুর র্যাবো
ব্যাবোর কথাই বলছিলাম। পুরো নাম জ্যঁ নিকোলাস আর্তুর র্যাবো । ফরাসি কবি। মাত্র ৩৭ বছর বেঁচেছিলেন। জীবনকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে বেহিসাবি জীবন লালন করতেন। এই অল্প বয়স নিয়ে সাহিত্যের এক বিশাল জায়গা দখল করে নিয়েছেন এই মহানায়ক। অনেক বাঘা-বাঘা সাহ্যিত্যের উজ্জ্বল লেখক পাত্তা না দিলেও একটা সময় অল্প লিখেও সাহিত্যের উঁচু স্থানটি দখল করে নিয়েছেন র্যাবো। জীবনের নানা বাঁকে নানা চড়াই-উৎরাই লেগেই ছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেন নি কেউ। এমনকি তার পরিবারও ব্যর্থ। এই মহানায়ককে নিয়ে বাংলা ভাষায় তেমন একটা লেখা নেই এবং কম লেখকই ওনাকে নিয়ে লিখেছেন। কিংবদন্তি এই ব্যাক্তিকে নিয়ে লিখেছেন মঈন ফারুক। যে বইয়ের নাম দিয়েছে- ‘ক্ষণজন্মা কিংবদন্তী’। লেখক যথার্থ নাম দিয়েই ওনাকে স্মরণ করেছেন। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে আগস্ট-২০১৯ এ প্রকাশিত হয় এই অনুবাদ গ্রন্থ। যা ইতোমধ্যে সাড়া ফেলেছেন অনুবাদপ্রেমী পাঠকদের হৃদয়ে। এই কাজ নিঃসন্দেহে বিশাল কেননা ব্যাবোকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখ্যযোগ্য তেমন কোন কাজ নেই। কবি মঈন ফারুক সে কাজটি করেছেন। ভিতরের কোন এক তাড়না থেকে তিনি র্যাবোকে উন্মোচন করেছেন পাঠকদের সামনে।
বইটিতে র্যাবোর জন্ম থেকে মৃত্যু অবদি লেখক জীবনই স্থান পেয়েছে, বলা যায় পূর্ণাঙ্গ র্যাবোকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন লেখক। বইটিতে র্যাবোর কিছু কবিতা অনুবাদ থাকলে ষোলকলা পূর্ণ হতো। হয়তো লেখক র্যাবোকে নিয়ে আরও কাজ করবেন বলে কবিতা অনুবাদ এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেননি। বইয়ের শুরুতে প্রাককথাতে মঈন ফারুক বলে দিয়েছেন, আশি পৃষ্ঠার এই বইয়ের ভিতরে পাঠকদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। তিনি বলেছেন- ‘র্যাবোর চিন্তা কী ছিলো? কী করতে চাইতেন? কী খুঁজতেন? এমন বহুবিধ প্রশ্ন অজানা মনে প্রশ্ন আশ্রয় নেয়।’
এই আশ্রয়ের উত্তর পাওয়া যাবে এই বইয়ে। আরেকটু বলি, ১৮৫৪ সালে ২০ অক্টোবর তিনি ফ্রান্সের শার্লভিল-মেজিয়ের শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার অধিকাংশ কবিতাই লিখেছিলেন কিশোর বয়সে।
র্যাবোর পরিবারটি ছিল মধ্যবিত্ত। বাবা সৈন্য, মা গৃহিনী। ইসাবেল নামে এক বোন ছিল র্যাবোর। বড় এক ভাইও ছিল। র্যাবোর বয়স তখন দু’বছর- তখনই তার মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। বাবা নয়, র্যাবোর ছেলেবেলা জুড়ে ছিল মায়ের কঠোর শাসন। মায়ের শাস্তিও ছিল অদ্ভুত রকমের, পড়া না পারলেই ১০০ লাইন লাতিন কবিতা মুখস্থ করতে হত। এরপরও আবৃত্তি ভুল হলে খাবার জুটত না। ৯ বছর বয়েসেই তাই ৭০০ লাইন লাতিন কবিতা ঠোটস্থ হয়ে গেছিল র্যাবোর। তাদের বাড়ির নিচেই ছিল বিরাট এক লাইব্রেরি। খুব অল্প বয়সেই সেখানে বসে তিনি ফেনিমোর কুপার, গুস্তাভ আইমোর, জুল ভের্ন থেকে শুরু করে হেগেল ও সোয়েডনবর্গের দর্শন, প্রুদম, ফ্রান্সের লোককাহিনী এবং ইতিহাস ও সাহিত্য, এমনকী প্রাচ্য তথা ভারতীয় ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ, দর্শন, ধর্ম প্রচারক এবং দেব-দেবী ও দেবালয় সম্বন্ধেও পড়াশুনো করেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই অত্যন্ত আলোড়ন উদ্রেককারী কবিতার মাধ্যমে তিনি প্যারিসের কবিসমাজকে উদ্বেলিত করে তুলেছিলেন। তার মাতাল তরণী কবিতাটি পড়ে সেযুগের ফ্রান্সের অন্যতম সেরা ও জনপ্রিয় প্রতীকবাদী কবি পল ভর্লেন তার প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়েও উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি সব ধরনের সৃষ্টিশীল লেখালেখি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি আরব এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৮৯১ সালের ১০ নভেম্বর মৃত্যুকে বরণ করেন। তার বিখ্যাত লেখার মধ্যে নরকে এক ঋতু, মাতাল তরণী এবং গদ্য কবিতা ইলুমিনাসিও অন্যতম।
র্যাবোর জীবন ছিলো অন্য দশটি জীবনের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন। তার জীবনের সমস্ত কিছু এই বইতে পাবেন। বইয়ের দাম রাখা হয়েছে- ২০০। প্রচ্ছদ করেছেন- আল নোমান। বইয়ের প্রচার ও প্রসার কামনা করছি। বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে এ রকম আরো লেখা যোগ হোক।
র্যাবোর একটি কবিতা দিয়ে লেখা শেষ করব- ‘মরুভূমি প্রান্তর ভালোবাসি আমি, শুকনো ফলাদির বাগান, ফ্যাকাশে ম্রিয়মান পরিত্যক্ত আলয়, শীতল পানীয় জলের স্পর্শের ধারা। নিজেকে টেনে নিয়ে যাবো পচা দুর্গন্ধের অলিগলি দিয়ে বন্ধ চোথের কাছে, সোপর্দ করবো তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মির দিকে, আগুনের স্রষ্টা যিনি।’