কাব্যগ্রন্থ কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কাব্যগ্রন্থ কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
দীর্ঘ কবিতা • পানিকাউর • হাসান রোবায়েত

দীর্ঘ কবিতা • পানিকাউর • হাসান রোবায়েত






কোথাও অন্ধকার ছুড়ে দেয়
আলকাতরার বহু লীন স্মৃতি, দূরে চিমনির পোড়া নীল, ক্রমার্দ্র ধোঁয়া
ঘুমন্ত বয়লার ঘিরে কালো পোকা
বয়ে যাচ্ছে শরীর, রাত্রির লাশ—বাষ্পের মিথ
তার তামাটে চোখের ভেতর জ্বালায় হু হু গরাদের ফাঁকা সুর

এমন সময়, হে পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
বৃষ্টির রাতে
ছায়া-বিদ্যুতে, ঘনলীন তির, শীর্ষে ইলেকট্রনে
বসে থাকো—যেন ইয়াজুজ-মাজুজের সুষুম্না চিরে
এই নদী, খাল, স্ফটিক পানির যত উন্মূল চক্রাবর্ত
ফিরে ফিরে আসে
অনন্ত হাওয়া-বিচ্ছুরিত যে স্বেদ
পাক খায়, দোলে
সেখানে গভীর তারাম-লি আলোর অশ্রু ধরে থাক থাক
রাতের-সোপান পেরিয়ে নামছে এই চরাচরে, তারই তীক্ষ্ণ চূড়াটিতে তুমি
দৈবনখরে ধরে আছো আলো—
দেখছো, পাশার সারি সারি খেত
মানুষের ঘুমে ঢুকে মহিষেরা উড়িয়েছে ধুলা
গানের লুপ্ত সুর তারা খুঁজে খুঁজে হয়রান—
নম্র পাথর ও পাখি, তোমার কালো হর্মের ভেতর বাজছে
অনাদিকালের উনুনের বীথি
ডুবোনৌকার মোনামুনিবন
এমন গভীর তামাটে রাতের সৌর-অন্ধকারে
শুনেছো পানোখি—
শুয়োর...মাদার চোদ বলে বলে কয়েকটা চোর
উন্মাদ খোর
যাচ্ছে কোথায়
ক্রুর শঠতায়
বিস্মরণের এই ফোঁটা ফোঁটা ভিজে বৃষ্টিতে—

নোনতা দুপুর, গাধার সঙ্গে ফিরে আসা তারা
বাস ড্রাইভার—
শনি-রবি-সোম
ভেসে যায় মল, ফাঁপা কন্ডোম
ফিরে ফিরে আসে, পাক খায় আর
এই কানা বুধ, শুক্রের বার—
এমন সময়, ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
ভিজে ভিজে একা
দাঁড়িয়ে থেকেছো নদীখালবিলে
সূর্যের শত রশ্মি বিফলে
উরু ফাঁক করে ঢুকিয়ে নিয়েছে
শ্রান্ত সন্ধ্যা যেন কবেকার
ঢেকে দিছে গেছে গোধূলির হেম
সব ডুবে যাবে—
শীলিভূত হয়ে জীবাশ্মে, গানে
ওই দূর দূর
চক্রাবর্তে যেখানে বসন্তেরা শুয়ে আছে
নৌকায় খাঁড়িপাড়ে
বিকালের পুঁজ, ঝকঝকে খুঁত, মায়া-শ্লেষ-হাহাকার
আব্বার ভাঙা সাইকেলে বসা পেছনের ক্যারিয়ার—
তবু হে পানোখি
তোমার রয়েছে দিগন্ত উড়বার—
এখানে পচন, কূট মিথ্যা ও বীজানুর অধিকারে
রাত্রি ফুরিয়ে যাচ্ছে বাদামী ভেড়াদের অধিকারে
ফোঁপা কান্নায়, তামাকারবারি, জাতিয়তাবাদী এবং অশোক
গাছটার ডালে
বেওয়ারিশ কেউ, কয়েকটা চোর, লাশ-ব্যবসায়ী
প্রত্যেকে একা
করছিল পান তারার আরক
ছোট ছোট ঢেউ
ঢেউয়ের উপর আলোছায়াময় রাত
মাদী কুকুরের যৌন সে ঘ্রাণ
অন্ধকারের ডাক—
‘এই শাউয়ার চাঁদে এত ফাঁক!’

কী যেন বলছে গভীর আয়েশে বাতাসের দিকে চেয়ে

এমন সময়, ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
জানো, এ রাতের অবিশ্রান্ত করোটিতে
আমাদের দেখা হবে না কখনো—

সেই বিস্কুট ফ্যাক্টিরি থেকে বৃষ্টির দিনে আসতেছে ঘ্রাণ
অথবা জোছনা পিছে পিছে রাতে
হয়েছে সঙ্গী, কুশারের বন
আব্বা রয়েছে
আর ছোট বোন
আমরা নৌকা তুলেছি ডুবানো
আমাদের ছিল ভুখা পেট, গানও
গেয়েছি সে রাতে, ওপারে মাঝির ডাক নাম গেছি ভুলে
‘আর কতদূর’ বলে ছোট বোন
আব্বা তখন
নৌকার ঘ্রাণ
ছোট সে বোনটি ভাটিয়ালি গান
বহুদূর পথ হেঁটে গেছি ঝরা ধানখেত দিয়ে দূরে
আমাকে ডাকছে মাটিডালিপথ
সাবানের কারখানা—
তুমি হে পানোখি রাতের ডিভানে
আর ফিরে আনিয়ো না
সেইসব নাচ, ডুমুরের সারি, আপাত বিষাদ

ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—

ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
উড়ে যাও দূরে
যেখানে চাকা হিংসা-বলয়ে ঘুরতেছে ক্রমাগত

নশ্বর, শ্মশান, তৃণ, নক্ষত্র ও শেষ ট্রেন • মণিশংকর বিশ্বাস

নশ্বর, শ্মশান, তৃণ, নক্ষত্র ও শেষ ট্রেন • মণিশংকর বিশ্বাস






নশ্বর

কোথাও যেও না তুমি
আমার হৃদয়ে থাকো।

চার্চদিনে ভোরবেলা যে-রকম ঘণ্টা পড়ে
সেই মত কাঁপা কাঁপা জল, জলের ও-পারে
নীল, নীলাভ জঙ্গল, আর বাঁশির সুরের মত
একটানা পথ; কতদূর যাওয়া যাবে এই পথে ?
প্রশ্ন করি আর দেখি, রেশম চাষির পাগড়ির মত
আকাশে উজ্জ্বল মেঘ, দুটি মেঘের মধ্যবর্তী সেতু—
একটি পাখির ঝাঁক…

এই ধর্মবোধ।

শ্মশান

ভালোবাসি— এই স্বতঃপ্রণোদনা যেরকম
তার চেয়ে কিছু কম গভীরতাময় ইঁদারার জলে
ঝুঁকে দেখা গেল চাঁদ, থমকে রয়েছে
যেন অদূরে বিজয় দেখে ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে
রোমাঞ্চবিহীন গৌড়-বাংলার শেষ ঘোড়সওয়ার,
আর কুয়াশায় কেঁপে কেঁপে ওঠে চন্দ্রমল্লিকা
যেন আমাদের বোনের হৃদয়—
চাঁদের আলোর মত কাছেই দূরের পাহাড় দেখে
বিহ্বল লাগে—‘দেবতার মল্লযুদ্ধ’, এই নামে
ছোট কোন হাওয়া এসে দোলা দেয় করবীর শাখা।
কোন এক সরল ঐকিক নিয়মের বশে
ফুলে ফুলে ভরে গেছে শালের জঙ্গল।
এইখানে রাত্রি এক মাকড়সা, আর তার আঁধারের
জালখানি ন্যস্ত রয়েছে সর্বত্র, সকল নশ্বর ফুল ঘিরে…

অনেক তারার নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছি

শাদা মেঘের মত ফাঁকা করতল।

জানি অদূরেই তুমি আছ।

তৃণ

মৃত্যুর পরেও আরো ক’টা দিন আমি
আমি বেঁচে থাকবো।
সন্ধ্যাতারা ভোরের শেফালী হ’য়ে
যে-রকম ছুঁয়ে থাকে মাটি।

দূর হতে আমাকেও ডাকে, ওই পারে…

প্রতিটি শেফালীর পাশে...

মরণ রে, তুঁহু মম…

তুমি ঘন নীল অথবা সোনালী
অলৌকিকতা
এখনো শুয়ে আছো
ধাবমান কার্তুজের খোলে

পাখির ঝাঁকের প্রতি—

একটি পাখির টানে…

নক্ষত্র

যাকে এতক্ষণ গুপ্ত-ঘাতক মনে হ’য়েছিল
কাহিনীর শেষে বোঝা যায় সে আসলে
ভালো মানুষের পো

অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে, সরলাবালা বালিকা বিদ্যালয়ের মত

ভিজে আকাশের নীচে খুব আস্তে
ফুটে উঠছে এক দুঃখী রাজপুত্র, একা, অবুঝ…

শেষ ট্রেন

শালবন আর সূর্যাস্তের কাছে তোমাদের হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি।

তোমার মনের কাছে এখন-কি অন্য কেউ বসে আছে?
এসব লেখার অর্থ কী তবে?
কাচফুল— রক্তমাখা তারকাটা— অতিদূর শ্রাবণের মত নীল
তোমার দুচোখে একটি বা দুটি তারা ফুটে ওঠে।
তাদের ভিতর জেগে উঠছে রাত্রির অসামান্য আয়োজন—
এর কিছুটা আমার নিজস্ব।

প্রতিদিন তোমাকে হাতের মুঠো থেকে বের করে দিই
অন্য অনেক তারার মত আমিও জেনেছি
এ-পথ আমার, একার—

একা একাই বাড়ি ফিরে যাব রাত বারোটা পাঁচের বনগাঁ লোকাল ধরে…


মণিশংকর বিশ্বাস
জন্ম: ১৯৭২, ৩-রা ডিসেম্বর (ঠাকুরনগর, উত্তর ২৪ পরগনা)। ১৯৯৬-৯৭ সাল থেকে গান্ধার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। পত্রিকা বলতে মূলত কফিহাউস-কেন্দ্রিক আড্ডা। ১৯৯৮ সালে গান্ধার থেকেই প্রথম সংকলন (ফোল্ডার), "নম্র বৈশাখী ও নীলিমার অন্যান্য আয়োজন"। স্বল্পকালের জন্য সম্পাদনা করেছেন "জড়ভরত", মূলত গান্ধারেরই উদ্যোগে।

প্রকাশিত বইঃ "চন্দনপিঁড়ি" (কবিতা, ২০১৪) "অশ্রুতরবার" (কবিতা, প্রকাশিতব্য)

বর্তমানে সিডনি, অস্ট্রেলিয়াতে বাস করেন।

সুবর্ণ আদিত্যের নির্বাচিত | ২০ কবিতা

সুবর্ণ আদিত্যের নির্বাচিত | ২০ কবিতা






আয়না

মেয়েটি এগারো বছর বয়সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝে গেল যে, সে সুন্দরী—
পরবর্তী এগারো বছরে সে তীব্র রুপসী হলো
তার পরবর্তী আট বছরে সে বুঝে গেল তার সুন্দরী
হওয়াটা ভুল ছিল—

সে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো...
আয়না কখনো মিথ্যে বলে না

প্রেমিকার মৃত্যু

আপনি এখনো স্বপ্নের মধ্যে এলে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই—
অমন করে পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে কে বলেছিলো?
পাদদেশ আর কতটা নাগাল পেয়েছিলো বলুন!
রঙ মাখানো সবুজ শরীর তো ছড়িয়ে গেল লাল
আপনি টিয়া হয়ে টিমটাম নেমে এলেন
মনের খোঁজ পেয়েছিলেন?

একটা হাসপাতাল, তেরোজন ডাক্তার- নার্স
এ্যাম্বুলেন্স নাকি আমি, কে বয়ে বয়ে নিয়েছিলো আপনাকে?
আজও বুক টানটান করে দাঁড়াতে পারি না, জানেন?

শরীর যেখানে যায়, ছুঁয়ে যায়—
মন থাকে আরো গভীরে
কেবিন থেকে শশ্মান
আপনার অবকাশ যাপন শেষ হয় না

এমন উচ্চতর মৃত্যুকাঙ্খা নিয়েও আকাশী শাড়ীতে নিজেকে জড়ায় কেউ!
কোমর থেকে সরে যাওয়া ভাজ
ভরাট নাভী খুলে রাখে আহ্বান—

আপনি এখনো স্বপ্নের মধ্যে এলে আমি
অন্যমনস্ক হয়ে যাই...

মানবিক সিঁড়িপথ ধরে আমরা ছটফট করি
আপনাকে পোড়াবো বলে পুকুরর্ভতি তল সাজিয়ে রাখি

লম্বা চুরুটে ঠোঁট নিয়ে—
শেষবার আমাদের দেখা হলো চেক প্রজাতন্ত্রে
এইসব আর্তনাদ সাদারঙ না পেয়ে কুঁকড়ে গেলো

আপনাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি—
আমার নামজুড়ে মৃত্যুর গন্ধমাখা ধবধবে স্তন

আপনি এখনো স্বপ্নের মধ্যে এলে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই...

এক্যুরিয়াম

এইবার চলুন হেঁটে আসি আমাদের যুগল কবর থেকে
নুহামি, তিনশো বছর কি খুব বেশি সময়?

আপনি আড়ালে রাখলেন নোটবুক
সিলিকন সমুদ্র
পেয়ালায় থোকা থোকা মদ
হাসিটা দীর্ঘ হতে হতে ছোট করে কাশলেন—

গত তেরোযুগ—
পানাহার ফেলে আপনি এঞ্জেলোর নখ নিয়ে চুষলেন
ঘষলেন
কামড়ালেন
ছুঁড়ে মারলেন

আপনার বৈঠকখানায় তুলে রাখা বাইবেল
লাল কাপড়ে মোড়ানো আসমানি ভাষা
ছড়ানো দৃশ্যের ভেতর ঘাপটি কথা
সব, সব চেনাজানা পাপ
প্লেটে সাজিয়ে পরিবেশন করলো আরব্য সুন্দরী

আপনি ডানহাতে লিথুনিয়াম বামহাতে ডানহিল ঠোঁট করে
দুই আলট্রা রুপশীর কাঁধ নিয়ে
স্নানে গেলেন—

আপনি যে এতকাল এ্যাকুরিয়ামে বন্দি
ভুলে গেছিলাম...

নিরানব্বই নম্বর প্রেমিকা 

নিরানব্বই নম্বর প্রেমিকা হারিয়ে গেলে একশ তিন দিন শোক পালন করুন—
কিংবা সৎকারে অংশ নিয়ে আপনি চলে যেতে পারেন স্পেনে। হ্যাঁ, আপনার খানিকটা আফসোস থাকতেই পারে বরং এভাবেই ভাবুন- আপনি শতকের দিকেই এগিয়ে গেলেন! জানেন তো, ঋতু সংহারে নতুন কলিও ডানা মেলে।

আপনাকে চরিত্রহীন বলছিনা, বলছিনা আপনার চরিত্রে দোষ আছে। বিশ্বাস করুন!
আমরা জানি, রুপন্তি আপনার আবেগ-ভালবাসায় আছে। হ্যামিলটনের রাস্তায় ডানহিল টানতে-টানতে আপনি আবার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন, নাটাইয়ের সুতো ছাড়তে-ছাড়তে আপনি গোত্তা খেতে-খেতে নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন গন্তব্য।

বান্ধবী হারানোর শোকে আপনি পানশালায় চলে আসুন—বেঢপ মদ্যপবস্থায় আড়ালে খুঁজুন শততম লাবণ্য। যে মেয়ে চলে যায়, ছেড়ে যায়- তাকে চলে যেতে দিন। প্রেমিকা চলে গেলেই কেবল প্রেমিকের মুক্তি।

সমুদ্রে লবন চাষে নামতা জানতে হয়—দশের অংকে কয়টা ঘর ফাঁকা রাখলেন তার হিসেবও মানুষ রাখে

লাইফটা এনড্রয়েড হলেও বকুলের গন্ধ কিন্তু মলিন হয়না, সার্কাস মডেলের সন্ধাগুলি বোতলজাত থাকুক নেলপলিসে। ঝাঁ চিকচিক সী-বীচ হোক আপনার উদোম যাদুঘর।

আপনার তেরাশি নম্বর প্রেমিকা-প্রিয়ন্তী, দাঁতের বর্ণনায় ডায়েরীর পাতায়-পাতায় সেকি ঈঙ্গিত! পাতাগুলি পুড়িয়ে কালি না করে কয়লার গ্যারেজে চালান করে দিন। আড়াআড়ি তাকানো জেরিনের চোখের পাঁপড়ি মানিব্যাগ থেকে বের করে দান করুন কোনো মাকড়শার খামারে- রয়্যালটি পাবেন।

আপনাকে কেউ উন্মাদ বললে অট্টহাসি দিন- জানেন তো! আপনার প্রাপ্তির মতো তারও কিছু প্রত্যাশা থাকে।
মিস রহমানের কোকড়ানো চুল দেখে যতবার পরদেহী বাতাসে গা-ভাসিয়েছেন -তাকে বলে দিন—হোমারও এত ভালোবাসেনি তার প্রেমিকাকে।

নিরানব্বইতম প্রেমিকা চলে গেলে বরং উল্লাস করুন। ভাবুন—আপনি একধাপ এগিয়ে গেলেন।

অস্তিত্ব

যে কোনো দূর্দাশায় আমাকে স্মরণ কোরো—আমি ঈশ্বর নই যে সাড়া দেব না

যে স্বপ্ন বাবা দ্যাখেননি 

আমি বড় হচ্ছিলাম বাবার অগোচরে
সন্ধার বৈঠকখানায় নিয়মিত চা নিয়ে যাই
কোন ক্লাসে পড়ছি, বাবার বন্ধুরা বাবাকে জিজ্ঞেস করলে
আমার নাম ধরে বাবা বলতেন...
—বর্ণ, তুই কোন ক্লাস রে?
আর হো হো করে হেসে উঠতেন বাবার বন্ধুরা
ঠিক ততটাই নিচুস্বরে উত্তর দিয়ে আমি বেরিয়ে আসতাম

দিনদিন বাবা আমার কাছে আকাশ হয়ে উঠতেন

বাবার মুখস্থ থাকতো বাড়ির দুটো ল্যান্ড ফোনের নাম্বার, কোন গাড়ির চাবি রাখা থাকে কোথায়
আর কতগুলি ফ্যাক্টরি
এমনকি—সুদর্শন বড়ভাইয়ের প্রেমে পড়েছে কতগুলি মেয়ে
বাগানে হাঁটতে এসে কোন ললনা গোপনে রেখে যাচ্ছে চিঠি—তাও

সেই সাতাশি সালের দিন—কত কত ঋণ
আমি পুষে রাখি খুব

নরম কোরে সন্ধ্যা আসার মত আমি পালটে যেতে থাকি
বাড়ির দেয়াল ঘেষা ঝংকার ক্লাবের নাট্যদৃশ্যে
মাস্টার মশাইয়ের চরিত্রে তুখোড় মেজভাই—নায়ক বনে গেলেন
সেই থেকে রাত ফাঁকি দিয়ে নাটক দেখা
সিলেবাস ছেড়ে জীবনানন্দ-সুনীল পড়া
স্কুলের লাল কাগজের সাথে আসে বাবার নোটিশ
আমি 'দেবতা নাকি পশু'—এমন প্রজ্ঞাপন

আমি তো হতে চেয়েছিলাম স্বপ্ন—
ঘুমঘুমপ্রজাপতি-নিত্যবকুল, মায়ের গলার মিহিমিহি সুর...

বাবা চাইতেন আমি ধম্ম-কম্ম করি; করেছিও
ছোটবেলার ভোরগুলোতে-'আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম'
আর পাখি নীড়ে ফেরার আগেই বাড়ী
ফেরা—দেবলীনাও থামাতে পারেনি আমায়
আমার মা—তাকে দেখতাম, রাজত্ব সামলাতে প্রতিদিন দেড়মন চালের ভাত রাঁধতেন
এছাড়া শৈশব স্মৃতির মা'কে আমার খুব বেশি মনে পড়েনা

আজ আমার মা, চিরদুঃখী মা—বেদনা আমার,
এতদিন পর বুকের ভেতর দহন দারুন

মা'কে মনে করিনা ভয়ে, নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা
মা আমার কষ্ট পান, আবারো কষ্ট পান—আমি সইতে পারিনা
পৃথিবীর স-ব মা-ই সন্তানের দূর্বল স্থান
মাকে নিয়ে লেখার আছে ঢের—
আমি নিজেই বাবার মত দূর্বোধ্য পাঠ

এখন কেউ বাবার কথা বললে- আমি আকাশ দেখিয়ে দিই

বিজ্ঞাপন

এমনভাবে হারাবো—
খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হবে কয়েকটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র

ঈশ্বর

আমার কোনো শাখা নেই

চুরুটে বারুদ থাকুক

তুমি শিলং-গোয়াহাটি আর দার্জিলিং ঘুরে আমার জন্য চুরুট আনলে
সেইবার যুদ্ধের ময়দান খাঁচায় পুরে
রাজস্থান উলুধ্বনি দিলে
নারীরা আবার বন্দী হয়ে গেল

আমার দাদার দাদা কেরালার শাসক হিসাবে সিংহাসনচ্যুত হলেন
এখন বুঝতে পারি—
তিনি শাসক না হয়ে অবতার হলে আসনচ্যুত হতেন না

চুরুটে শ্বাস নিয়ে ভাবি—রেডিসন স্কয়ারের রাস্তায় একটা বিরতি নিয়ে
ফুল হাতে দাঁড়িয়ে যেতে পারতাম
তাতে আর যাইহোক—
তোমার দাদার সাথে আমার কাকার বিরোধ হত না

পাখির জন্য পালক
নারীর জন্য পোষাক
বাগানের জন্য বন্ধুর আগমনে কয়েকদিন আগের
ঝলমলে সন্ধায় আমি খুন হলাম—

চুরুলিয়ার রাস্তায় রাস্তায় আমার নাম হবে খুব—
এমন করে বলে তুমিও ধ্যানরত
ঘুটঘুটে কালো নিয়ে বসে থাকি স্থির

আমাদের আর কোনো রাজপ্রাসাদতুল্য ভবন নেই ভেবেই
তোমার প্রেমিক আমাকে পাহাড় কিনে দিল

সেই থেকে তোমাকে চুরুট আর নারীকে পাহাড় নামে জানি

বায়োস্কোপের জবানবন্দি

তুমি মরে যাবার বছর দেড়েক পর খবর পেয়েছিলাম—
যদিও কথা ছিল এমন যে,
যেদিন জানবো তুমি আর আমার নেই, সেদিন সারা পৃথিবী জানবে- তুমি আমার ছিলে
গির্জা নিয়ে আলাপের শেষে আমাদের চা ফুরিয়ে এলো—

২৬ ডিসেম্বর একটি দগদগে তারিখ লালশাড়িতে
ঝুলে ঝুলে চোখ নাচিয়ে চলে গেল
সেই শুরুটা সিনেমার পর্দায় বড় হলঘরের নিচের সিড়িতে
আমরা পপকর্ণ খেতে খেতে ধর্ম নিয়ে বিভক্ত হয়ে গেলাম
তোমার ইস্যুটা মারাত্মক দাপট নিয়ে সংসদে উঠে গেল

আবারো বছর দেড়েক পর—তুমি নিজের মরে যাবার খবর দিলে
আমরা মূলত মৃত্যুর খবর জেনে বারবার মরে যাই

যেহেতু শহরে স্টেশন জুড়ে কথার চাষ ভাল
সুতরাং আমরা নিরব থাকলাম
আমরা ভুলে গেলাম আমাদের কাতর হৃদপিন্ডের কথা
আমরা ভুলে গেলাম হাসপাতালের রোগীদের কথা
আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির কথা

এভাবে ভুলে থাকতে থাকতে হারিয়ে ফেলেছি
নবজাতকের মুখ
প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হলে শোক থাকতে নেই—

অথচ
কি মনে করে বহুবছর পরে ডাকহরকরার মত ছুটে আসে তীর তীর চোখ
সাদাকালো শহরের মানচিত্রে দুলে যায় জ্বলজ্বলে
টিপ

দেবযানী একটি দাউ দাউ নাম

ঠিক কতদিন পর আপনার সাথে দ্যাখা?
—নয় মাস
—একটা দেশ এই সময়ে স্বাধীন হতে পারে
মাত্র এক আঙ্গুলে, আঠারো মিনিটেই দাঁড়িয়ে যায় বাংলা

সেই যে অধিকার নিয়ে বলেছিলেন—
সমুদ্রের বাগান হবে- আপনার প্রেমিকের চোখ
দারুণ ফায়ারপ্লেস দাউ দাউ নিয়ে
ঝলসে দিবে চুমু চুমু আহার

ব্যাংকে দুই হাজার বছর গচ্ছিত রেখে
আপনার উরু নিয়ে দুমদাম ঘুমে-ঘুরে জাগলাম
তেষট্টি দিন গ্রামোফোন বাজিয়ে
মাছরাঙা নিখোঁজ মর্মে বিজ্ঞাপন ছাপলেন
আরো কতদিন পরে- ঠিক কতদিন?

পরবর্তী প্রশ্ন আসার আগেই সংবিধান সংশোধনে পার্লামেন্ট বসালাম
চুমুর উপর কোন ট্যাক্স বসানো হবেনা;
প্রেমিকার হাত ধরে হাটতে পারা আর
শিউলির ঘ্রাণ নিতে নিতে তৃতীয় সংখ্যার জীবন

মাত্র তেইশ টাকায় পাওয়া দাপ্তরিক খাদ্য
ষোল টাকায় এসি কামড়া
সারা পৃথিবী বিনামূল্যে ভ্রমণ
—মশাই, প্রেমিকার আবদার
এসব মন্ত্রীরাই কেবল রাখতে পারে

দেবযানীর কথা মনে পড়ে আপনার?
জলপাই জলপাই চোখ, মৌসুমি লিচুর মত মেয়েটা!
ভেতর-বাহির অঙ্গার—
ছেচল্লিশ বছর ধরে খুঁজছি, জারুলে-পারুলেও শোক
তবু সমুদ্র পুষছি

ফুলেদের আয়ু থাকে না

সমস্ত দুপুর খুলে তোমার কোলের বারান্দায় শুয়ে থাকি। মৃত্যুর গরিমায় টালমাটাল ঘ্রাণ ময়দানে ছায়া টেনে তারস্বরে চেঁচায় অবনত বৃক্ষ। ফলের শ্বাস ও ফুলের পতনে হুক খুলে দারস্থ হয় মধ্যরাতের বিস্তারিত গল্প।

লাল লাল কোয়া নিয়ে নরম ডালে ডালিম প্রার্থনা করে শীত। যেভাবে জেগে থাকে নাগলিঙ্গম, প্রতি ভোরে। আমাকে ভালোবেসে নাকফুল পরা মেয়েটা দিন দিন যোগ্য হয়ে ওঠে, ধ্যানে। মগজের মনন থাকে, ফুলেদের আফসোস থাকে; আয়ু থাকে না।

ফারদুন—তোমাকে গোলাপ নামে ডাকা হয়ে উঠবে না?

ফারদুন, হেমন্ত আমার

ফারদুন—
ডেনমার্ক এক শীতের দেশ। আমি বাংলাদেশ থেকেও অনুভব করি—তুমি মেয়ের আঙুল ছুঁয়ে হেঁটে যাচ্ছো বরফের পাহাড়।

হেমন্ত, প্রিয় ঋতু আমার। তুমি চলে যাবার পর, ভরা ডিসেম্বরেও এখানে শীত নেই—সবটাই নিয়ে গেছো?
অবশ্য অতিথি পাখি দেখলে আদর করি
তুমিও তো কোনো দেশে অতিথি হয়ে আছো!

জুলাই মাসে মাঝে-মধ্যে বৃষ্টি হয়
রঙিন ছাতা নিয়ে তুমি ভিজে যাচ্ছো শাহবাগে—এখনো দুপুর ঘোলা করে হেঁটে যাও নূপুরের পথ
এতো নরম করে হাঁটো—তোমার তুষার শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে ঝকঝকে রোদ্দুরে

ডাচ ভাষায় ‘ভাল আছি’—শিখিয়েছিলে
এক কেজি ডেনিস বেগুন বাংলাদেশী মুদ্রায় কত—তার হিসেবও দিয়েছিলে
ট্রেনে চেপে দু’শো কিলো পথ
নির্বিঘ্নে কুড়ি মিনিটে চলে যেতে পারো
আমি সাধারণ বাঙালী—আফসোস করি

দূর থেকে বুঝি—আরো কতটা গতিময় হয়েছো তুমি
ওখানকার সাহেবি বাচ্চাদের স্কুলে বাংলায় ‘কেমন আছো, ভালোবাসি’ নানাবিধ উচ্চারণ শেখাও...
বাংলাভাষীর চেয়ে ভিনদেশীর মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শুনতে অন্যরকম তৃপ্তি আছে

অথচ, এমন ভাঙা-ভাঙা করে কতবার বলেছি একই শব্দ—কানেও তোলোনি কখনো
যে বিধানের কারণে এক হলো না আমাদের পথ
আমি তো জানি...
পৃথিবীর ইতিহাস বদলে গেলে—তোমার ভেতর আমি সত্য

নীলক্ষেতের পথে একবার বলেছিলেঃ যানজট থাকলে, যানবাহন কিংবা যাত্রী
কারো জন্যই তোমার কষ্ট হয় না
দুঃখ হয় রাস্তাটার জন্য—কতটা ভার বয়ে রাখে সে
আজো—তোমার বুলেট ট্রেন কত ধীরভাবে অতিক্রম করে যায় আমার বুকের উপর দিয়ে

দিন বাড়ে, ফুলেদের আয়ুর মত সহজ হয়ে আসে মানুষের যাতায়াত

মানুষ মূলত ভায়োলিন

ফারদুন—
আমাদের রাত্রীরা ঘোলা হয়ে এলে মায়ের অসুখ করে
বাড়িজুড়ে আত্মীয়, শোক শোক কাতরতা
স্যালাইন, অ্যাম্বুলেন্সের লাল বাতি
হাসপাতালের গন্ধ—অবশ্য অসুখ হলেই হাসপাতালকে মায়ের মত মনে হয়

তোমাকে তেতো লাগে—
নরম ইনসুলিন কাঁপিয়ে নেয় চঞ্চল ধমনী
ভারি নিঃশ্বাস নিয়ে তুমি কাছে এলে
স্তনে হাত রাখতে রাখতেই শুকিয়ে যায় দক্ষিণ মেরু

মানুষ মূলত বেদনা ছড়াতে ভালোবাসে

তোমার প্রেমিককে পড়ে জেনেছি—চারশ আশি রিম কাগজে
তোমার নামে বিষন্নতা লেখা আছে, ভিন্নচোখে

সেই যে পাহাড়ে উঠেছিলে গত শীতে
শীত আড়ালে গেল বলে পাতাবাহারের আক্ষেপসূচক নীরবতায়
চিত্রকর মুখাবয়ব আঁকা বন্ধ রেখে অনশনে বসলো
বাতাসের বন ইজারা নিয়ে প্রজাপতি সমাবেশ ডাকলো কিছু গুপ্ত প্রেমিক
ভুল করে আমাকে মানুষ ভেবে তুমিও সূচনা সংগীত গাইলে

তোমার ঠোঁট কেঁপে ওঠার দিন—
ধ্যানবিদ্যা আত্মস্থ করতে করতে আমাকে মমি করে রাখলে, কী এমন কষ্ট থাকে মানুষের!

ভায়োলিনও জানে সে আসলে মানুষের প্রতিশব্দ

বদল

ফারদুন
তুমি এক দূরহ প্রলেপ আচ্ছাদিত ক্রিয়া
মুখোশের আকারে গতি নিয়ে ক্ষয়ে আসো
এবং আমাদের প্যারালাল পৃথিবী পেছনে ঘুরে গেলে
তোমাকে ও তোমার শ্বাস তুলে আনি ধীরে

কম্পাস ও যাবতীয় ফসলি সরঞ্জাম উঁকি নেয় জমিনে
রক্তের মতোন প্রগাঢ় চিহ্নের তুলি তোমার মুখ আঁকে

ঈশ্বরের সৃষ্টির সাথে ভুল হয়ে যায় তাকানো চোখের দৃশ্যায়ন
মানুষ হারায় না, জায়গা হারিয়ে যায়

আমাকে বদল করে আর কতদূর যেতে চাও তুমি?

সবজিমহল

রক্তাক্ত হয়ে যাই ফারদুন—যদিও তুমি একটা প্রমাণ সাইজের
টসটসে লাল টিপ আর পরীক্ষাগারে বর্ষাই গোলাপ নাম নিয়ে দুলছো

তোমার ভেতর চলতে চলতে বন-থমকে যাওয়া ঝাঁকঝাঁক অসমতল পাখিবন্দী জীবন
দেশ কাঁধে করে আসা বেদনা-প্রসব।
এইরূপ কুয়াশাসমগ্র শীত আর শুষ্ক হয়ে আসে প্রাত্যহিক ঋতু
আরো কিছু খরার আসন্ন সংবাদে আঙুলের ছাপ নিয়ে
প্রতিবার তোমাকে লুকিয়ে ফেলি; হারিয়ে ফেলার ভয় জন্ম নিতে নিতেই তোমাকে চাষ করি

ফারদুন—কতবার বৃষ্টি এলো তারপর নানাবিধ ফুল-ফল
ঔষধি চারা, পাহাড়িয়া ঢল আর রোদের করাতকল ঘাড়ে চেপে টইটই করে
হেঁটে গেল অনাগত বিধাতা, আরো অনেক অরণ্য
বেডরুমে চিৎকার করছে থকথক ঘ্রাণ

কম্পণ, বুক হাতড়ে আসে উলঙ্গ ছাউনি, ঐ যে যাপন! বসবাস করে যাবো জীবন
মেঘ, মৌমাছি আর অন্যান্য সন্ধ্যায় দূরাগত প্রেমিক আনো—
খাড়া নহর। ফলক আর বীজঃ মই দিয়ে যাই, থোকা থোকা কাঁটায় জন্ম নেয় রক্তালু আত্মজ
সেই নিরঙ্গম শ্বাস, প্রাসঙ্গিক গরিমা আর তুলতুলে সমুদ্রে রোপন করি সুচারু পতন

ফারদুন—আমি নিরেট চাষা বলেই তুমিও চমৎকার বীজসুপ্ত সবজিমহল

ফারদুন বিষয়ক চমৎকার পাখি

একটি চমৎকার নিয়ে পাখিটি ডানা খুলে উড়াল দিল
আমরা যেতে যেতে দেখলাম তার পালক পড়ে আছে
যে পালকগুলি চড়া দামে কিনে এনেছিল তার প্রিয়তম প্রেমিক

পাশেই পড়ে আছে যোগ-বিয়োগ
আমরা বুঝে নিই
ফারদুন গণিতে কাঁচা
একটা টিউটর নিয়োগ দিলে পাখিদের ভাষা শিখে নিতে পারত

এইভেবে প্রতিদিন বাজারে হাট বাড়াই
পাখিটি আরো আরো দৃশ্যবন্দী খাঁচায়
নাম আটকে রাখে

ফারদুন পাখি আঁকে
যেহেতু সে গির্জায় শেষবার রেখে এসেছিল পিয়ানো
তিলক
নূপুর
কবুতর আর
দুটি হাত

আমরা তার আঙুল সদৃশ কিছু কুড়িয়ে আনি
পুনরায় পাখিটি চমৎকার নিয়ে উড়ে যায়

আমরা মানুষ মানুষ ভাব ও মুখোশ নিয়ে
প্রতিদিন তাকে ফোন করি
তার স্বরে ভেসে আসে তীব্র করুণ
নীলকণ্ঠ
বেলুন

কুয়াশা ভরা মোমের পুকুর এঁকে
আরো কিছু দলছুট মাছ ও শিকারি বক
প্রতিবার শীত ডাকে
ঋতুর ভীরে শীতেরও দুঃখ থাকে

নদীটা গণিতে খাটো
গাছটা ছায়া বাঁকা
একদিন
হঠাৎ...

ফারদুন চমৎকার উড়ে গেল

পৃথিবী একটি মানবিক রোগ

ফারদুন
এক একটা দিন পরস্পর দুঃখ হয়ে যাই
এই যেমনঃ আমাদের কিছুই ভাল লাগবে না
দুইজন তিনটি জমজ আয়নায় তাকাবো
খাবারের প্লেট থেকে গড়িয়ে যাবে
ছাপান্ন হাজার মাইল দুর্ভিক্ষ

শুনেছি, কারো কারো রাতগুলো কেবলই রাত
তর্কের টেবিলে কত শত আলোচনায় স্থির হয়
রাজা নির্বাচন ফর্মুলা
আমরা শুধু দিনের আলো নিয়ে হেঁটেই যাচ্ছি—অমন রাত কখনোই এলো না

তিনদিন কেউ অভুক্ত থাকলে
তার সামনে প্রেমিকার কথা উচ্চারণ করতে নেই
বরং বারান্দায় হাস্নাহেনার টবে পানি আছে কিনা এইটুকু খোঁজ রাখা ভাল
কামিনী আর গন্ধরাজে কতটা সুবাস—এ নিয়ে পরে কথা বলা যাবে

ফারদুন
আমাদের হাতগুলো বেশ অগোছালো
পাখিদের শোক সমাবেশে প্রধান অতিথি রাখা নিয়ে
তিন দিনে হাসপাতালে ভর্তি হলো সাতাশজন যুবক

এইসব মিটিং শেষ পর্যন্ত কোথায় শেষ হয়?
বনমন্ত্রী কি জানে, যশোর রোডের গাছগুলোও গাছ!
তাদেরও প্রাণ আছে...

পরপর দুইবার মোবাইল-মানিব্যাগ কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চুরি হয়ে গেলে
আমরা হেনরিকে সন্দেহ করি
তোমার মাথায় হাত রেখে ভাবি
পুরো পৃথিবীর দুর্ভিক্ষটাকে চুরি করে নিয়ে যাবে—এমন চোর কোথায়?

হাড়ক্ষয় রোগ

হাসপাতালের বেডে...

নরম ইনসুলিন চলছে—আমার রক্তের ভেতর নড়েচড়ে উঠছো ফারদুন

হাড়ক্ষয় রোগ নিয়ে জন্মেছিলাম। এক স্বচ্ছ আকাশ রোদ আমাদের বাড়ি ঘিরে রাখে।
ভেতরবাড়ির উল্লাস, কাঁপনের দরজা খুলে
মা
বাবাকে
ডাকেন
দাদার আর কোনো ছেলেপুলে ছিল না
নাতির সাথে গল্প করবেন ভেবে
আমার আয়ুর বিনিময়ে প্রতিদিন
নিজেকে ইটভাটায় পোড়ান

দাদার অবশিষ্ট হাড়
বুকের পাজরে নিয়ে এখন আমি বাবার সাথে গল্প করি।

ধ্যানবিদ্যা

ধ্যানবিদ্যা আত্মস্থ করতে করতে ধ্যানি হই। ফারদুনের ঠোঁটের কাছে নিজেকে অবনত করি প্রেম ও শোকে। যেহেতু আমাদের পৃথিবী ও বৃক্ষরা খুব উদার। মানুষ বলেই বারবার অসুখে পড়ি, রোগী হই। কোনো কোমল নারী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ভেবে তৃতীয়বার ফারদুনকে ডাক্তার হবার পরামর্শ দিই। সমস্ত গরিমা নিয়ে হেঁটে যায় ফারদুন। আকাশের মত এক গমগমে পৃথিবী ফারদুনকে কেন্দ্র করে ঘোরে।

ফারদুন—আমাকে স্পর্শ করো, খোলাচুলে বুকের কাছাকাছি ঝুঁকে আসো, ঘন নিঃশ্বাসে গাঢ় করে কপালে সেবন করাও মৃত্যু নিরঙ্গম।

এরপর নত হতে হতে, তোমার বুক সমান আধিপত্য নিয়ে ফুল আর পাখির কাছে শিখে নিই সমূহ উড়াল জীবন।


সুবর্ণ আদিত্য 
বাংলাভাষার কবি। বসবাস ঢাকায়, মিরপুরে। ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ গাইবান্ধা শহরে জন্ম। শৈশব থেকেই যুক্ত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। পড়ালেখা ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ছিলেন ঢাকার পেশাদার নাটকের দল ‘পালাকার’-এর নাট্যকর্মী। যুক্ত ছিলেন উদীচীসহ কবিতা আবৃত্তি সংগঠনের সাথেও। পত্রিকা দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করে বর্তমানে কর্মরত আছেন একুশে টেলিভিশনে ক্রাইম রিপোর্টার হিসাবে। ১৯৯৫ সাল থেকে সচেতনভাবেই কবিতার সাথে বসবাস। ১৯৯৭ সাল থেকে বিভিন্ন পত্রিকা ও লিটলম্যাগে নিয়মিত লিখে আসছেন। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য বিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘পান্ডুলিপি’। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই- ‘দুধ পুকুরের সিঁড়ি’, একই বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতার বই- ‘ফারদুন সিরিজ’। বই দুটি থেকে ২০টি কবিতা পাঠকদের জন্য দেয়া হলো।
হাসনাত নাগাসাকি এর গুচ্ছ কবিতা

হাসনাত নাগাসাকি এর গুচ্ছ কবিতা


রক্তদোষ 

কবিদের প্রতি শেষ আদেশ-
এ তল্লাট ছেড়ে যাও- সরে পড়ো এখনই চুপচাপ।

আর, তোমাদের স্ত্রী ও প্রেমিকাদের কাছে
জমা দাও সন্তানের নামের তালিকা ;
মনে রেখো, যে সন্তান এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি,
তার পিতৃত্বের দাবিদার তুমি নও।
আর শুনে রাখো, আমরা যাদের বার্থ সার্টিফিকেট দেবো-
নাম আর স্বীকৃতির সীলমোহর সাঁটা,
তারা হবে এ তল্লাটে পরবর্তী কবি।

যেহেতু তোমরা কেবল ভালবাসতে জানো,
যেহেতু তা কোনও মহাজনের গোলা
ভরে তোলে না কাঙ্ক্ষিত ধাতব শস্যে,
যেহেতু তোমরা আঙুল তোলো
রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগায়-
সেহেতু এই আবাস তোমাদের নয়।

তোমরা হুকুম তামিল করতে শেখোনি ;
রক্তের দোষ!
তোমাদের পিতৃপুরুষ ও গর্ভধারিণী মা
জন্মক্ষণে বলে দেননি- মাথা নত করতে হয়
কিভাবে - কখন!

নিরাপদ

এইসব নিরাপদ রাত আর দিনগুলোকে কি করবো আমি?
কি করবো আমাকে, এইসব নিরাপদ
রাত আর দিনের ভিতরে ?

বোধের আকাশকুসুম আরামের ধূম্রপথে
ধীর পায়ে চলা, যেন বা স্থবির এ্যমিবা-
যেন বা খোঁয়াড়-পালিত উট- উটের গ্রীবা,
কেন?
কি করবো এইসব গ্রীবার ভিতরে আমাকে
অথবা
আমার ভিতরে অনিচ্ছুক গ্রীবার আবাদ?

এ বিশাল খোঁয়াড়ে আমার
এইসব নিরাপদ রাত আর দিন
পুঁতে রেখে নষ্ট ভূমিতে অনর্থ বীজের বপন-
খেয়ে নেবে ধীরে ধীরে মাটি আর নীরব প্লাবন।
আদতে আমরা সেই জোয়ারের পানি!

কেবল, কখনো কেউ কেউ
সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ভালবেসে যদি
হতে চায় বাঁধভাঙা নদী,
বিধ্বংসী প্রলয়ের ঢেউ -
আমাদের সমুখে দাঁড়ায় এইসব নিরাপদ রাত আর দিন!
খুব ভিতরে টের পাই, মৃত্যুও জীবনের মতোই রঙিন?

ব্যতিহার 

যদি আমি লিখে যাই কিছু কিছু শব্দরূপ-
যেমন- 'মৃত্যু'; যেমন- 'ভালবাসা';
যদি লিখে যাই 'যক্ষ্মা' একটি কষ্টকর জীবনের নাম-
কখনো তোমার হাতে উড়ে গিয়ে পড়লে সেই চিঠি-
কী ভাববে তুমি? কল্পনায়?
ভাববে কি অপত্য ভালবাসাহীন একটি শুশুক সন্তানের কাছে যেতে পারেনি কখনো?
পাল্টানো জলের স্রোতে সন্তানের পাখনা- কানকো
খুঁজে পায়নি পিতার প্রবাল?

ধরো, আমি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিখলাম- 'প্রসাদ' ;
নিদারুণ অভিমান নিয়ে লিখলাম- 'ফেরারি';
অস্থির উন্মাদের মতো লিখলাম- 'প্রশান্তি';-
কোনও সায়াহ্নে বসে একাকী পাহাড়ের অন্ধকার চিবুকের কাছে
গড়িয়ে পড়ার আকুতি জানালে
পাহাড়টি আমাকে বক্ষ খুলে দেবে। আর,
আমি মৃত্যুর বদলে ঝুলে থাকবো স্তনবৃন্তে তার।
যেহেতু জেনেছি পাহাড়ের যোনির ভিতরে যেই ঘুম-
সেই সুধা ছেড়ে আর ফেরা হয় না।

এইভাবে ঝুলে থেকে রাত বাড়বে, হয়তো;
এই চরাচরে বাড়বে স্বাভাবিক শেয়ালের গান;
তুমি হয়তো অংশ নেবে সেই নৈশভোজে!

তখন হঠাৎ উড়ে
তোমার সমুখে পড়লে হলুদ বোতাম-
ঝুলে থাকা ছেঁড়া জামার বুকের উদাম-
কি ভাববে সেই সিল্কি সময়ে?

ভাববে কি- 'বোতামটা লাল হলে আরো ভালো হতো '?

অনাহূত 

শোনা যায়, বাতাস-ছেঁড়া হৈহৈ রৈরৈ?
শোনা যায়, অনাহূত বখতিয়ারের পায়ের আওয়াজ?
সুতরাং খিড়কি খুলে দাও,
তুলে রাখো অসমাপ্ত হাতের কার্যাদি,
কৃষ্ণবর্ণ বহুচর্বিত গলিত রমন।

বামন যুগের শেষ বাঁশি
তোমরাই বাজিয়েছ এ মোহনা-মন্দিরে।
কান্তার পাহাড় হতে  সব ক'টি খিড়কি, অন্দরে-
ঘন অন্ধকারে ডুবে যুবতি, রমনী,
শিশু ও বলিষ্ঠ কাপুরুষ-
ভুলে গেছে আপন সুরত!
অতলান্ত বৃষ্টি প্রার্থনায়
তোমরাই ছড়িয়েছ এ নগর বাতাসে
আবেদন গন্ধী রস, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস!


অতএব
দূর থেকে উড়ে এলে অনাহূত যোদ্ধা বখতিয়ার
ধুলোর- ক্ষুরের শব্দে- খুলে দাও সমূহ দুয়ার।

বিভ্রম

এ দুঃখ গেলো না আমাদের, এই ভ্রান্তি!

তিন রাস্তার মোড়ে গেলেই
আমরা পথ হারিয়ে ফেলি বারম্বার।
তারপর আমরা দশ বন্ধুর নয়জন তিনভাগ হই,
একজন বসে পড়ি তিনরাস্তার মোড়ে।
মূলত একজনের পথ খুঁজে পাবার কথা নয়।

তবু সান্তনা,
আমরা তিন বন্ধু এক আছি, এবং
তিন পথের একপথ ধরে চলছি এখনো।

চলতে চলতে আরেকটু সামনে গেলেই
আরেকটি চার রাস্তার মোড়।
চারভাগ হতে গিয়ে দেখি - চার রাস্তার মোড়ে
বসে পড়ার লোকটিও কম আছে।

তাতে আমরা থেমে পড়ি না। থামতে হয় না।
অধিকন্তু পেয়ে যাই অচেনা মুখের এক ঝাঁক সাথি।
ভুল রমন উৎফুল্ল করলে আমরা টের পাই না
হাতের উৎস ও পরিধি।

মুলত, পথ বিষয়ে আমরা কবিতা লিখতে পারতাম,
অথবা, পথকে অস্বীকার।
কিন্তু, ততোদিনে দেরি হয়ে যায়।
ততোদিনে আমরা টের পাই, আমাদের ঘাড়ে অন্যের হাত,
আমাদের পায়ে গোপন পথে আসা বিদেশি জুতো।
আমরা চাইলেও আর যেতে পারি না কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে আমাদের।

একটা সফল ভ্রমণ শেষে
আমরা জমা করি নয় বা ততোধিক পথের ইতিহাস।
সেখানে অবশিষ্ট থাকে আমাদের হাড়ে
বিদেশি মদের ঘ্রাণ।

জিলাপির ভিতরে ঢুকে পড়ি

জিলাপির ভিতরে আমি ঢুকে পড়ি-
জিলাপির আঠালো সুমিষ্ট রসের ভিতরে;
জল্লাদের হাতের মুঠোয় ঝুলন্ত দড়ির বিভ্রান্তির ভিতরে।

তারপর একঝাঁকে, একই মিছিলে
দেখা হয় অজস্র জিলাপির সাথে, ঐকান্তিক;
যেন বা খলসে পোনার মতো ছটফটে ধাবমান
এক ঝাঁক মৃত্যু,
এক প্রস্থ্য জীবন অথবা সাইক্লোন-কবলে পড়া নাবিকের জাহাজের শুঁড়!

তারপর, একটি কালচে-লাল পিঁপড়ার মতো
কোন ফাঁকে হয়ে উঠি শীতের 'রসদবাদী'!

কে না জানে -
পিঁপড়ার প্রসঙ্গে দু'টি কথা সমধিক সত্য -
এক, পিঁপড়েরা জিলাপির অন্ধ মুরিদ ;
দুই, লবন দিয়ে পিঁপড়ে খেতে মচমচে মজা!
এটুকু বলেই আমি হেসে উঠতে পারতাম হো হো!
কিন্তু, তৃতীয় সত্য হচ্ছে -
পিঁপড়েরা কাঁদতে জানে না।

যে কাঁদতে জানে না তাকে নিয়ে হাস্য করা সমীচীন নয়।

বিচারালয়

কাঠগড়া থেকে নেমেই গ্যালিলি বললেন
-মহামান্য আদালত, সব কিছুই ঘূর্ণায়মান।
নক্ষত্র, পৃথিবী, চাঁদ,
অক্ষিগোলক,হৃদয়, মানুষের হৃদয়ের ফাঁদ;
এমনকি সত্য, এমনকি মিথ্যা, আপনার হাতের কলম,কলমের নিভ।

মহামান্য আদালত, ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখুন,
পশ্চাতে আপনার ছায়া পৃথিবীর সেরা কৌতুক।
এখনো যারা ঘুরঘুর করে ঘুরছে এই বিচারালয়ে,
মূলত বের হবার পথ ভুলে গিয়ে, তাদেরকে  আদেশ দিন জামা- পাতলুন উল্টায়ে পড়ে আসতে; এবং সঙ্গমকালে তারা যেন সমধিক ঘূর্ণন রপ্ত করে।

মহামান্য আদালত, আমরা যারা আপনাকে মহামান্য বলি- আপনি কি বাড়ি ফিরে রেচনক্রিয়া করতে করতে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন? আমাদের নির্বুদ্ধিতায়?

গ্যালিলিও গ্যালিলি ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর দিকে দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে বললেন,  মহামান্য আদালত,
মানুষ কি ক্রমেই অস্বীকার করছে প্রপিতার নাম?
মানুষ কি দেখতে পাচ্ছে না যারযার মাথার খুলির ক্রম নিমজ্জন?
একদিন, যেদিন অন্ধকারে
টলে উঠবে বিচারালয়, টলে উঠবে চেয়ারের পায়া -
আমি বলবো, এখানে একটি মিথ্যার জাদুঘর হোক।

গ্যালিলিও গ্যালিলির অকস্মাৎ হিসু পেলে -
পৃথিবীর সর্বত্র তিনি দেখতে পেলেন পাপ ও পঙ্কিল ক্ষত।
বিচারালয় তাকে জেলে পাঠালেন।
সাদাত হোসাইন এর গুচ্ছ কবিতা

সাদাত হোসাইন এর গুচ্ছ কবিতা

এক.

যেতে যেতে মনে হয়, কোথায় যাবো?
তোমার মতো কোথাওতো আর কেউ নেই,
সকলেই বুকে পোষে নদী,
তবু সব নদীতে তো আর ঢেউ নেই!

দুই.

মিটে গেলে সব লেনদেন আর হয়ে গেলে সব শেষ,
তাকিয়ে দেখি, সহজ হিসেব ভুল করা অভ্যেস।

তিন.

কোথাও একটা পোস্টবক্স নেই, অথচ বুকের ভেতর চিঠি জমে জমে মেঘের মিনার,
কোথাও একটা ঠিকানা নেই, অথচ নীল খাম জমে জমে, ভেসে যায় বুকের কিনার।

চার.

আমাকে হারাতে দিলে, নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর।
একটা হিজল ফুলের গাছ,
একটা শান্ত পুকুর ঘাট,
ঘাটের পাশে পাখি, পাখির নামটি ডাহুক পাখি হলে, তাহার দুটি চোখ,
চোখের ভেতর মায়া, মায়ার ভেতর তোমার নামটি লেখা।
একটা আদিগন্ত মাঠ, মাঠের পাশে ঘর, ঘরের পাশে একটা সজল দীঘি।
অনন্ত এক কাব্যকথার রাত, রাতের ভেতর দিন, দিনের ভেতর তোমার আমার হাজার খেরোখাতায়, হাজার স্মৃতির ঋণ।
একটা হাতের ছোঁয়া, ছোঁয়ার ভেতর ছায়া, ছায়ার ভেতর আটকে থাকা তুমি, তোমার সকল কান্না দহন দিন।
চারদেয়ালের ভেতর হঠাৎ হাওয়া, হাওয়ার বুকে ঘুমপাড়ানি গান, গানের ভেতর মন।
একটা অমল আকাশ, আকাশজুড়ে ইচ্ছেমত ওড়া, রাত পোহাবার বাঁশি।
একটা অশত্থ গাছ, গাছের পাশে জলের কলরোল। ভালবাসার নহর।
বুকের ভেতর নদী।
এসব হারাও যদি?
এই শহরটা জানে, এমন করে কনক্রিটের বুকে, আর কাঁপে না কেউ।
কারো হৃদয় আর কাঁদে না, কেউ দেবে না আর, এমন মায়া মেখে।
আমার ছোট্ট বুকের ভেতর কেবল, কাঁপতো হৃদয়, কাঁদতো ভীষণ, তোমায় ভালোবেসে।

আর কে এমন, ভালোবাসার দামে, কিনবে তাহার প্রহর?
আমাকে হারাতে দিলে, নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর।

পাঁচ.

শেষ ট্রেন চলে যায়? যাক।
কারো কারো তাড়া নেই, আধুলিও ভাড়া নেই,
কোথাও যাবোনা দেখে, একা থাকা প্ল্যাটফর্ম, ভীষণ অবাক!

ছয়.

চিঠির পাতায় লেখা ছিলো, 'ভালো থাকবো, ভান হলেও'।
কুড়ি বছর অনেক সময়। অনেক।
ইলেক্ট্রিকের তার বসেছে মাঠের বুকে।
চুকে গেছে লুকিয়ে দেখা আয়নার দিন।
ঋণ বেড়েছে, খরচা খাতায় বেহিসেবে।
তবুও কোথাও রয়ে গেছে, সেই কথাটি, 'ভালো থাকবো, ভান হলেও'।
শিউলি ফুলের গন্ধে ডোবা অলস যে পথ, সে পথ এখন ব্যস্ত ভীষণ।
দূরে কোথাও, যেথায় আগে সূর্য ডুবতো, এখন সেথায় আকাশই নেই।

কুড়ি বছর অনেক সময়। কত আকাশ চুরি হলো, কত পাখির!
সেসব খবর কেউ রাখে না, পাখি এবং খাঁচা ছাড়া।

তখন কাজল লেপ্টে যেতো, লিপস্টিকের রঙটা যেন বেপরোয়া, ঠোঁট ছাড়িয়ে উঠেই যেত।
টিপখানাও দস্যি ভীষণ, রোজ বাঁকাবে, চোখ আঁকাবেই ভুল কাজলে।

তবুও তখন, নিজের একটা মানুষ থাকতো বুকের ভেতর।
এখন বুকে মানুষ থাকে, জনসভার ছবির মতন। চেহারা নেই, আদল আছে।

তখন থাকতো জোনাক জ্বলা তারার সন্ধ্যা,
বুকের ভেতর মেঘের মতন ব্যথা জমতো, ব্যথার বুকে লুকিয়ে থাকতো খানিক সুখও।
ধরা যায় না। পড়া যায়না, কোথায় এমন ‘সুখের মতন ব্যথার’ আবাস।
তখন কেবল কান্না পেতো, একটা নদী, উথাল পাথাল ঢেউ তুলতো যখন তখন।
একটা নিজের মানুষ থাকত। সেই মানুষটা হঠাৎ লিখলো, ‘ভালো থাকবো, ভান হলেও’।
ভান হলেও ভালো আছি, এই যে শহর, কোলাহলে ভীড়ের ভেতর, কে কার চোখে চোখ রেখে যায়?
কেউ রাখে না। কেউ দেখেনা কার চোখে কী রোজ জমেছে।

হাতের রেখায় কমছে আয়ু, তার হিসেবেই ব্যস্ত সবাই। চোখেরও যে আয়ু থাকে, বুঝতে কারো দায় পড়েনি!

কুড়ি বছর অনেক সময়।
ইলিক্ট্রিকের তার বসেছে মাঠের বুকে, চুকে গেছে কুপি জ্বালা সন্ধ্যা, বিকেল।
বুকের কাছে গোপন চিঠি আর জমেনা। ফ্রকের বুকে কুঁচির নিচে ধুকফুকানি আর বাড়েনা।
লুকিয়ে পরা মায়ের শাড়ি আর জানেনা, নিজের একটা মানুষ থাকে। কেবল নিজের।
সেই মানুষটার সবটা জুড়ে মায়া থাকে, দুপুর রোদে পুকুর জলে ছায়ার মতন।

এখন পুকুর ভরাট হয়ে হাঁট বসেছে, বেচাকেনা বেশ জমেছে।
মানুষও ঠিক রোজ মিলে যায়, যে যার মতো দামে কেনে।
নানান রঙের, ঢঙের মানুষ। ভংয়ের মানুষ, সঙয়ের মানুষ।
যে যার মতো দামে বিকোয়।

নিজের একটা মানুষ থাকতে বয়েই গেছে! একার মানুষ।

অসুখ হলে অপেক্ষায় আর কেউ থাকেনা, এখন সবাই ওষুধ গেলে।

কেউ জানেনা, গভীর রাতে কান্না এলে,-
অভিমানের ব্যথায় কাতর, বুকের গহীন,
ফিসফিসিয়ে জানিয়ে দেয়, তার কী ছিলো কথ্য?
এই অসুখে নিজের একটা মানুষ শুধুই পথ্য!

এখন সবাই ভালোই থাকে, ভান লাগেনা।
কুড়ি বছর অনেক সময়, অনেক সময়-
আমার তবু দুপুর-রাত্রি, সন্ধ্যা আকাশ ভাল্লাগে না।

সাত.

আমাদের সকলের বুকের ভেতর একেকটা পুকুর থাকে।
শান্ত জলের পুকুর।

কিন্তু সামান্য অনুভূতির হাওয়ায়ও সে জলে কম্পন তুলে কেঁপে ওঠে থরথর। কেউ স্পর্শের ঢিল ছুড়লে সে ঢেউ তুলে ভাসিয়ে নেয় মনের এপারওপার। ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা, দুঃখ কিংবা আনন্দ, সকলই তার কাছে ঢেউ তুলে কেঁপে উঠবার অজুহাত, এলোমেলো করে ভাসিয়ে দেয়ার উপলক্ষ।

আমরা জীবনজুড়েই নিজেদের গুছিয়ে রাখতে চাই, সেনাবাহিনীর মার্চপোস্ট বা সারি সারি কনভয়ের মতো। অথচ আমরা এলোমেলো হয়ে একুল ওকুল ভেসে যাওয়ার জন্য বুকের ভেতর যত্ন করে আজীবন পুষে রাখি পাখির চোখের মতন টলমলে স্বচ্ছ জলের এক পুকুর।

কে জানে, হয়তো এই পুকুরটার ছদ্ম নামই মন, আর মনের ছদ্ম নামই মানুষ!

আট.

চলে গেলে মুছে যেও ধুলোয় লেগে থাকা পায়ের ছাপ,
হাওয়ায় ছড়িয়ো না গায়ের ঘ্রাণ।
ওইখানে রেখে যেও যা ছিলো আমার।
রেখো যেও ভুলভাল স্মৃতির রুমাল।
চলে গেলে মুছে যেও দেয়ালের রঙ,
যেখানে যা ছায়া হয়ে ছিলো, তার সব নিয়ে নিও,
নিয়ে যেও মায়া হতো যা, তাও।
ওইখানে রেখে যেও অবহেলা যত,
যত ছিলো মিছে আর ভান।
চোখের পাতায় যদি লাগে কিছু ব্যথা, রেখে যেও তাও,
এইখানে এই বুকে জায়গা অনেক।
চলে গেলে ভুলে যেও, ফিরে আর এসোনা এ পথে,
এইখানে বৃক্ষের মতো, থেকে যাক কেউতো শপথে।
দরজায় লেগে থাক খিল, লেগে থাক দেয়ালে অমিল,
জানালায় লেখা থাক, ছিলো না কোথাও কেউ,
ভালো কেউ বাসেনি কখনো।
চলে গেছে যারা, তারা কেউ, এইখানে ছিলোনা কখনো।

নয়.

শুনছো মেয়ে?
এই যে ধূসর মেঘের খামে, বর্ষা নামে,
জমছে কতো ফুলের রেণু চুলের ভাঁজে।
দখিন হাওয়া হঠাৎ এসে, আঁচল ভাসায় সুবাস মেখে,
জলের কণা আলতো করে গাল ছুঁয়ে যায়।
ছুঁতে পারো, তুমিও খানিক?

শুনছো মেয়ে?
একটা চিঠি ঘুরে বেড়ায় এই শহরে, ঠিকানা নেই,
সেই চিঠিটার বুকের ভেতর জমছে ব্যথা সঙ্গোপনে,
বাতাস ভারি দীর্ঘশ্বাসে, কী যায় আসে!

একটা কেবল দুপুর থাকে, খা খা রোদের,
একটা খাঁচায় হলুদ রঙের পাখি থাকে,
সকাল দুপুর সেই পাখিটার বুকের ভেতর,
কে জানি কে আকাশ আঁকে!

শুনছো মেয়ে, সেই আকাশে একলা একা কে উড়ে যায়?
কার কী ভুলে?
ঠিকানাহীন, চিঠির মতো বাউন্ডুলে।

শুনছো মেয়ে, এই শহরে একটা বুকে,
তোমার নামে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা নামে!

দশ.


এই যে লোকে লোকারণ্য শহর, সকাল - সন্ধ্যা ভিড়ভাট্টা জাগে,
তবুও এমন একলা লাগার মানে, একটা 'নিজের মানুষ' সবার লাগে!


এই যে এমন ঝলমলে রোদ-দিন, সন্ধ্যা হতেই ল্যাম্পপোস্টের আলো,
তবুও বুকের জমাট আঁধার জানে, নিজের একটা প্রদীপ থাকা ভালো।


এই যে তুমুল বৃষ্টি নামে রোজ, ভিজছে শহর রোদের অপেক্ষায়,
তবুও কেন মেঘ জমেছে বুকে, ছলছল চোখ কার কী উপেক্ষায়!


এই যে এমন বিচ্ছিরি এক দিনে, এই যে হঠাৎ বসন্ত দিন জাগে,
কান্না ক্লান্ত চোখের অশ্রু জানে, একটা 'নিজের মানুষ' সবার লাগে।

এগার. 

এই যে সন্ধ্যা, তারার আকাশ, রাত্রির রঙ জানে,
কাছের মানুষ দূরে সরে যায়, কী গোপন অভিমানে!
আমরা জানিনা শুধু-
মেঘের ওপর মেঘ জমে জমে, দূরত্ব বাড়ে ধু ধু।
ধুসর কুয়াশা মুখ ঢেকে দেয়, ধুলো মোছে পদচিহ্ন,
আমরা জমাই হিসেবের খাতা, কার ক্ষত কত ভিন্ন!
অথচ জীবন জানে-
দূরে যাওয়া মানে কাছে আসবার, শপথ সঙ্গোপনে।


সাদাত হোসাইন
জন্ম: ২৯ জুন, ১৯৮৪, মাদারীপুর জেলা
কবি, উপন্যাসিক, উপস্থাপক, চলচ্চিত্র নির্মাতা 
মৃদুল দাশগুপ্ত'র দশটি কবিতা

মৃদুল দাশগুপ্ত'র দশটি কবিতা

মৃদুল দাশগুপ্ত (জন্ম ৩ এপ্রিল- ১৯৫৫) বাংলা কবিতা-জগতের এক সুপরিচিত নাম। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ সারা পেয়েছে আপামর কবিতাপাঠকের কাছে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘এভাবে কাঁদে না’, ‘সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ’, ‘কবিতা সংগ্রহ’ ইত্যাদি বই। ‘সোনার বুদ্বুদ’বইয়ের জন্য পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। পড়া যাক মৃদুল দাশগুপ্ত'র দশটি কবিতা।


১.
গুপ্তপুঁথি-জ্ঞানে আমি দিয়ে যাব পাণ্ডুলিপিখানি
বিরাট কাঠের ওই পেটিকায় রেখে দিও গৃহে, এক কোণে
সযত্নে কিছুটা কাল, ক্রমে তুমি ভুলে যাবে, জানি।
কী আছে ভিতরে শুধু ভাবনাই ঢেউ দেবে মনে
সহজ সরল বাক্সে মনে হবে দাপাদাপি চৈত্রের বিকেলে
কলরব, হট্টগোল, ঘোররাতে ক্ষুধাতুর ক্রন্দনের ধ্বনি
আবার প্রভাতে হাসি খিল খিল—আমাদের একশত ছেলে!
তখন মুদ্রণে দিও, ওরা যেই চেঁচাবে—জননী
২.
যেই হস্তক্ষেপ করি তুমি বিন্দু, বৃত্তাকার হও।
হয়েই ঘুরতে থাকো, তখন বাতাস বয় শন শন শন
এ গৃহে পাড়ায় ক্রমে শহরে সদরে, টোকা দিতে
                                      পৃথিবীও ঘোরে
যেন বিপরীতে, জোরে। চন্দ্রসূর্য হতবাক হয়ে
কে আগে উদিত হবে, ভাবে।
কী কাণ্ড ঘটাও চিত্র, বিচিত্র হওয়ার পথে
                                       বন্ বন্ বন্!
গেল গেল রব ওঠে তারায় তারায় আর
                                         পাড়ায় পাড়ায়
পাহাড়ের চূড়ে যেন হায় হায়, সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে
                       হাহাকার মরু সাহারায়
পুনরায় হাত দিই, এবার এবার থামো
তখনই তো হয়ে যাও, স্তন।
৩.
পছন্দ হয় না বলে অপকর্মে কালি দেই ঢেলে
কী কাণ্ড প্রকাণ্ড দেশ মানচিত্র থেকে যায় মুছে
ঝপ করে নামে রাত্রি ঝকঝকে রোদের বিকেলে
সে ভয়ভীতিতে যাই অতি ঊর্ধ্বে একাকী, জাগর
তুষারে আবৃত হয় পৃথিবীর বিবিধ অঞ্চল।
একে একে সাত রাত যদিওবা যায় যায় ঘুচে
তবু না ফুরায় নিশি। মহাসূর্য করে হাহাকার
সেই ছায়া নিচে পড়ে, ক্ষোভে দোলে সকল পাহাড়
কাতর পাথর বলে, ‘থামো থামো’
অতি শূন্যে ভাসমান এক ফোঁটা জল
সে বলে, ‘এবার নামো, নইলে ধমক দেবো
                         আমি…আমি বঙ্গোপসাগর’
৪.
মানো বা না মানো তবে টোকা দিলে
                               ওড়ে এই ঘর
আমার এ গৃহখানি সেভাবে বানানো
তা ছাড়া বলার কথা, বিচিত্র শহর
যখন তখন রাতে বয়ে যায় জোনাকির ঝড়
এইখানে খুন হব, অথবা উল্লাসে যাব
                             জেলা কারাগারে
আমার বিশাল ছায়া তবু তো দুলবে ওই
                                   নদীর কিনারে
যে তুমি নিখোঁজ হবে, তুমি এসো
                      ঠিকানা তো জানো
আমাকে পাবে না কেউ ঘটনার পর
৫.
লাগো তো পিছনে লাগো গোয়েন্দা সকল
উড়ি কিনা
ডানা ছাড়া, জেট বিনা
করি কিনা দুনিয়া দখল
পিছু নাও, হাঁটো বা গাড়িতে চেপে খোঁজো খোঁজো
                                         তুমুল তল্লাশে
পদচিহ্ন আছে কিনা ঘাসে
বাতাসে গায়ের গন্ধ
কোন্ কাব্যে কোন্ ছন্দ
ধরো দেখি ছল!
কোথায় গড়ায় দেখো কোথাকার জল!
সকল সন্ধান করো, ধাও
ওই যে রোরুদ্যমানা, তার কাছে যাও
৬.
আবার আবার ফের পুনরায় পুনরায় ফের ফের
                                             আবার আবার
সময় হয়েছে যেন গুরুতর বিষয়ে ভাবার
শিখরে, গিরির শীর্ষে, অতলান্ত তলে বা অতলে
কোথায়বা যেতে হবে, কিভাবে যে যাব
কী দেবো তোমাকে আমি এবারের রথের মেলায়?
সে বড় চিন্তার কথা, তাও শূন্যে দপ দপ জ্বলে
যাত্রার সবুজ আলো, যে রকম পথ খুঁজে পাব
নিয়তির কোলে বসে উড়ে যাব খেলায় খেলায়
কী দেবো পৃথিবী আমি নদীতটে, সাগরবেলায়?
কী দেবো তোমাকে আমি

৭.
সঙ্কটে, সময়কালে কলহ-বিবাদ করো
                                    তুমিও, নীরব
ঘুমন্ত জাগ্রত দেখি কুকথায় ছোড়ো হস্তপদ
তবে তো সবাক স্তব্ধ, শাদা ধবধব
তোমার ইস্তফাপত্র দূর মহাশূন্যের সনদ।
কে পায় এবার—ভেবে অতিভারী জড়বস্তু
            কাপাস তুলোর চেয়ে ওড়ে
আগুনশলাই ছাড়া ধূম্রশলাকাখানি
                           নিজে নিজে পোড়ে
বলে চিত্র, ছোঁও ছোঁও, কাঁপে তার
                                 চক্ষুর পল্লব
পিপীলিকা দলটির শুনি কলরব

৮.
হয়তো অর্ধেক পথে বাধাপ্রাপ্ত হব, পেরোব না
                                 মরু বা প্রান্তর
থেমে যাব, কখনও হব আর কোনও নদী পার
অতএব তাকাব না, ঝটিকায় উড়ে যাবে ঘর
হতে পারে তারপর আবছায়া দেখা যাবে
                                    আমাকে আবার
কোথায় কে জানে তবু চারিদিক নীল বা নীলাভ
তখন পাব না স্তন, হয়তো মেঘের গায়ে
                                   দুহাত বোলাবো
৯.
সভয়ে আমার মন কাকুতি মিনতি করে, ছেড়ে দেয় হাল
আছাড়ি বিছাড়ি খায় দেহখানি, তবে হয়, এমন নিষ্প্রাণ
তথাপি সকল দৃশ্য
দিনরাত্রি শীত গ্রীষ্ম
অনুভূত হয় বলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে চলে কাল
আমি ক্ষত চিহ্নহীন
অতি শুষ্ক, বা রঙিন
যেখানে রয়েছি পড়ে, তা নয় শ্মশান।
আমার ওপর দিয়ে তবে কেন মেঘ যায়, ছোঁয় কেন
                                               সমুদ্রের জল
কানের ভিতর দিয়ে কেন পোকা ঢুকে যায়
               কেনবা শনাক্ত করে তারকা সকল

১০.
‌‍‍‍‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‘তুমি চন্দ্রে হাত দিয়েছিলে! গহ্বরে আঙুল দিয়ে
                                   পেয়েছিলে মধু!
চেটেছিলে চাঁদের বরফ? গড়ালে চাঁদের গায়ে, চাঁদে?
চাঁদ কী বলল, শুনি’—কন্যা জিজ্ঞাসা করে,
                          ‘বলো বলো’—হেসে বলে বধূ
চুরুট ধরিয়ে আমি ধীরে ধীরে উঠে যাই ছাদে।
‘এই তো চাঁদের লোক’—অযুত তারকারাশি একযোগে বলে
‘ওর গায়ে বালি লেগে, তা চাঁদের ওপিঠের বালি!’
‘ও চাঁদের।’ ‘ও চাঁদের’—চারিদিকে ঘন ঘন তালি
আমি উড়ে চলে যাই পুনরায় চাঁদের দখলে
কাঠগড়া ও কঙ্কাল ।। চঞ্চল মাহমুদ

কাঠগড়া ও কঙ্কাল ।। চঞ্চল মাহমুদ


ম্যালো, ভূমধ্যসাগরের মাঝে একটি বিকল হয়ে যাওয়া আপাত স্থির জাহাজে আমিসফোক্লিস আর জোকাস্টা বসে প্রাচীনকালের ওয়াইন পান করে যাচ্ছি; বিকল হবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত এ জাহাজের একমাত্র চালক ছিলো লেয়াস ।  আমাদের ৪ জনকে বিভিন্নভাবে ওয়াইন ঢেলে সহযোগিতা করে যাচ্ছে ঈদিপাসজাহাজ বিকল হওয়ার সাথেই সাথেই ঈদিপাসের ঢালাও আচরণ সফোক্লিসের দিকে লুণ্ঠিত হয়সফোক্লিসের নির্ধারিত গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে তাকে না দিয়েই বরং ঈদিপাস তা নিজের শঙ্কায় ঢকঢক করে ঢেলে দেয়... আমি হাসছিজোকাস্টাকে বোঝা যাচ্ছে না...... উদ্বিগ্ন হয়ে সফোক্লিস ভাবছে- সাইথিরন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে একবার ঝাপ দিয়ে আসি’; একমাত্র লেয়াসের আনন্দে বিকল হয়ে ওঠো জাহাজও কিছুক্ষণ চলতে শুরু করলো......  
আমি উঠে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম । ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লাইয়াস প্রবাহিত হয়ে আমার তামাটে পায়ের  নিচে রেখে গেলো কেন্দ্রগামী আগুন......। ম্যালোআয় উত্তপ্ত করি- নিজেদের তামা । শিরশির করে ওঠা এমন টগবগা রাতে ইটিওক্লেসপলিনেইসিসইসমেন ও অ্যান্টিগনিকে জোড়া লাগিয়ে দড়িতে রূপান্তর করে ঈদিপাসকে আদেশ করলাম- 'সফোক্লিসকে বেঁধে ফেলা হোক'। কুণ্ডলিত সফোক্লিসকে এনে হাজির করা হলো এমন পায়ের নিচে... যেখানে আগে থেকেই জড়ো হয়ে ছিলো তামাম-তামাম-গলিত-আগুন । তার গলার ভেতর চূড়ান্ত উত্তাপের তামা ঢেলে তাকে সংস্পর্শতাপী করে তুললাম... 

ধোঁয়া উঠছে...... ধোঁয়াকে পেছনে ফেলে আমাদের জাহাজ, চলমান........;  ম্যালো, পোড়ার গন্ধে ম-ম করে উঠেছে আমাদের গতিশীলতা......

একটু দূরেই জোকাস্টা স্থির......। সফোক্লিসের এমন নিয়তি দেখে সে কাঁদা শুরু করলো; তার কান্না থেকে ঝরে পড়ছে দলা-দলা আগুন তার শরীরেই......; ম্যালো, যে কান্নার ভেতর আগুন পালন করে এবং নিজেকে প্রয়োজনীয় হত্যার প্রয়োজনে সে আগুন ব্যবহার করে; তার পথ মেরামতের সাধ্য কি আমাদের আছে? 

জোকাস্টা পুড়ছে...... তাকে বোঝা যাচ্ছে না...
সফোক্লিসকে পোড়াচ্ছে চঞ্চল মাহমুদ (ঈদিপাস ও লেয়াসের সহযোগিতামূলক আচরণের আভাস নিরূপণেই তা সম্ভব হয়ে উঠছে.....) 

ম্যালো, শোকে ও অপরাধে নিমজ্জিত এ দুটি ভিন্ন অবস্থাকে একত্রিত করে জাহাজের ছাদ থেকে নিক্ষেপ করলাম- পতনের সৌন্দর্যের দিকে ...। নিক্ষেপিত পতনের সবটুকু সময় লেয়াস ও ঈদিপাস কাতরতার তরঙ্গে ঢুকে, নিমজ্জিত হয়ে বলতে থাকলো- 'তোমার দেখা না পেলে জোনাকিবিহীন অন্ধকারে আমরা বাপ-বেটা শুধুই ছটফট করতে থাকতাম......'  

ম্যালো, আরেকটি পতিত বৃত্তের পরিধিকে ঘোড়া বানিয়ে পতন শুরু হলো- অন্য কোন সংকটের কেন্দ্রের দিকে.....
তুই আমার মৌলিক অধিকার ।। আলিফ মেহেরাব

তুই আমার মৌলিক অধিকার ।। আলিফ মেহেরাব

কবিতা ০১

তুই আমার মৌলিক অধিকার
এখানে বুকের ঝি ঝি পোকারা ঘুমায় না,
ওরা যে রাত ভর জেগে থাকে চাল ডাল নুনের মত।
এদিকে দেশ বরণ্য সব উৎসবে,
বার্নিশড দেয়ালে যখন ঝোলে
অভুক্ত মুখের নিদারুণ পেইন্টিং,

তখন কাঠগোরায় দাঁড়িয়ে সব শুন্যতা দাবী তুলে বলবে,
মেয়ে- অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের মতই
তুই আমার মৌলিক অধিকার।

এখানে বেয়োনেটে বাঁধা ৫৭ মুলার সালাদই
ভাতের বদলে মূল খাদ্য।
সুস্বাস্থ্য নিশ্চয়তার প্রশ্ন করা
তাই নিশ্চিত বারণ।
তবুও কাকপক্ষির এ শহরের জর্জেট শাড়ি পরিহিতা,
তুই যদি, চুড়ি বাজিয়ে চলে যেতে চাস,
আদালতে বসা ভালোবাসারা
সব দাবী তুলে বলবে,
অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের মতই, মেয়ে,
তুই আমার মৌলিক অধিকার।

পাগলীরে, তুই আমার মিছিলে মৃতদেহ বহনকারী শোকার্ত মায়ের চিৎকার,
আধিপত্য জমানো ক্ষোভে কেঁপে ওঠা ভুমিকম্পের নয় মাত্রার রিক্টারস্কেল।
অথবা, দিন মজুরের বউয়ের বাজারের ফর্দে লিখা
অনেক আহ্লাদের একটি পারফিউম।
তাই হিসাব না চাওয়া মহাশুণ্য‌‍
আমি পূর্ণ করে বলে দিতে চাই-
আমার বহনকারী শরীরটার মতই, মেয়ে,
তুই আমার মৌলিক অধিকার।


কবিতা ০২

এ কোন কবিতা নয়
এ কোন স্যাডিস্টিক কবিতা নয়।
এ এক ভীতু বিদ্রোহ,
যেখানে শতশত প্যারাট্রুপারস
স্টেইনগান ফেলে ভাবে
কয় বিঘাত জমি তার জন্য বারাদ্ধকৃত আছে,
কয়জন রমণী তার শরীর মেলে রেখেছে।
দিয়েছে বৈধতায় শুদ্ধতম স্লেভ। 


এ কোন সামরিক কবিতা নয়।
এ এক প্রনয়ী শরীরে, প্রতি
অন্ধ ক্যাফেতে খাদ্য
সমেত খামচানো চুম্বন।
দুলদুলের সাদা সব চর্বাংশে
উত্তেজনাকর বৈদেশিক খেলোয়াড়ে
ভরপুর প্রিমিয়ারলীগ।
গোল দেয়া ধর্ষক নিজেই একাধিক দর্শক
ক্লিভেজ খোলার নারীত্বের
মিছিলে যোগ দেয়া বিছিন্ন ঘটনার
অবিছিন্ন প্রকাশক। 


এ কোন প্রেমের কবিতা নয়।
এ এক আলপনায় আঁকা প্রশস্ততর মিথ্যাবাদ।
বুনোহাঁস এক সরল বিশ্বাস।তুমি আমির ক্ষুধাশান্তি তলে,
অনাগত লক্ষাধিক শিশু সব হাত পা ছুড়ে কাঁদে।
বিগব্যাঙ বক্ষদেশ থিওরিতে
প্রাক্টিকাল ফোম বসে।
এ কোন স্যাডিস্টিক কবিতা নয়।
এ কোন সামরিক কবিতা নয়।
এ কোন প্রেমের কবিতা নয়।
এ এক বাথরুমে কমোডে

ফেলে দেওয়া বীজাণুর প্রতিদিনকার প্রতিবাদ।
বাড়ি ফিরেনি একজোড়া চোখ বিমুগ্ধ বিষণ্ণতায় ।। সোয়েব মাহমুদ

বাড়ি ফিরেনি একজোড়া চোখ বিমুগ্ধ বিষণ্ণতায় ।। সোয়েব মাহমুদ

ষাট পয়সার নিউজপ্রিন্ট কাগজে লেখা কবি প্রতিবাদে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে যায়
কবি, কবি দাঁড়ানো হয়না সমাজে!
কবি ভুলে গ্যাছে কবে খেয়েছে ভাত পরিবারে,
কবে হেসেছে প্রাণখুলে?

বাবা মাথা হেঁট করে বাজারে যায়,
মা সেলাই করে কবিপুত্র জন্মের কষ্ট
কবি ভুলে যায় বোন কবে দিয়েছিল শেষ পরিচয়

প্রেমিকা বলে গেছে যাবার সময়-
উঠতে পারলে ষাটপয়সার কাগজ থেকে দেখা করে বিয়ে খেয়ে যেও পরবর্তী সয়ম্বর সভার

কবি বসে থাকে রোদ জর্জর চোখে, মশাল জ্বলা বুকে
চায়ের দোকানের খিস্তি খেউরে অথবা তীব্র আর্তনাদে
শহর গড়ায় সভ্যতায়
রাষ্ট্র দাঁড়ায় বিনির্মাণের উন্নয়নে,
কবি দাঁড়াতে পারেনা,
কবি হাঁটতে পারেনা বুকে ব্যাথা খুব

কবি আঙ্গুলে দাঁড়ানো পতাকা উপহাস করে,
কবি বাড়ি ফেরেনা
ঘর হারানো লোকমুখে শোনা কালো কৌতুকে

রাস্তায় মাঝে দ্যাখা হয় কিছু
ফেরীওয়ালা, কায়কাওসের ছেলে অথবা বিব্রত ময়ুরের সাথে
দ্যাখা হয় বেনিয়া বেশ্যাদের উর্বর স্তনবাহী অনুর্বর যোণীনির্ভর মেদের সাথে
দ্যাখা হয় ধর্ষক কবিতার পুরষ্কার নেয়া একুশের স্মরণসভা
দ্যাখা হয় কুকুরের পা তুলে পেচ্ছাপ করা নষ্ট আয়োজিত কবিতা উৎসবের

এত কিছু দ্যাখতে দ্যাখতে দ্যাখা হয়না,
কবি পিতার মলিন মুখ,
কবি মাতার বিষন্ন চোখ,
বোনের ভেজা আঁচল,
প্রেমিকার ন্যায্য অবহেলা
কবি বাড়ি ফেরেনা,
কবি মিছিলে যায়, মিছিলে ঘুমায়
বাবা জেগে থাকে
কবি পিতারা মারা যান সন্তানের প্রথম কবিতায়
কবিমাতাদের আত্মহত্যার কারণ প্রথম লেখা
তবুও কি থামে কবি, থেমেছে কি কখনও?

জনতার আগুন কলমে নিয়ে অধিকারের দাবীতে লেখা ফেষ্টুন,
প্রেমিকার ওড়নায় আদায়কৃত নামাযের কারণে ব্রাত্য সে
সামাজিক সাপ্তাহিক বাজারের ছোট ফর্দে

তবুও থেমেছে কি কখনও মহানায়ক!

কবি পিতারা কবি জন্মের অভিশাপে বন্ধ করেছেন যৌনক্রিয়া
কবি মাতারা রুদ্ধ করেছে পথ জরায়ুর
তবুও কিছু কি এসে গ্যাছে কবিতার?

আর তাই
জনশ্রুতি আছে একজন কবি, একজন মহানায়কের লাশ ঈশ্বর অগ্রাহ্য করেছে সহস্রবছর আগে
জনশ্রুতি আছে পচে গলে যাওয়া কবি মৃতদেহ হয় দূর্দান্ত জৈব সার

( রাষ্ট্র এই কবিতাটির নাম নির্ধারনে অপারগতা জানানোতে কোনও নাম দেয়া হয়নি )


কবিতা আবার প্যারিস

ল্যুভর জাদুঘরের হামলায় বিস্মিত নই, নই হতভম্ব
প্রিয় প্যারিস তোমার বুকে জমে আছে আলজেরিয়ার হতভাগ্য কিশোরীর ধর্ষিত আর্তনাদ
দেয়ালে ঝুলে থাকা চোখ উপরে নেয়া বাবা
সদর দরোজায় সাতান্নো টুকরোর মা
ব্যবচ্ছেদকৃত ধর্মে ত্রিস্তরের আর্থ-সামাজিকতা

অটিসম আর ক্যাপিটালিজম, দ্যা ভোগ অথবা রেগে ,
ঘুরছো ঠুনকো আভিজাত্যে

তোমার মধ্যবিত্তের যাপিত ক্রোধ যখন তোমার লিখিত পান্ডুলিপিতে মন্চস্থ তখন আমি কেবলই চুপ থাকতে পারি
প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ফুহ্

রাষ্ট্র যখন নিজেই ঘাতক তখন প্রতিবাদ কেবল চার অক্ষরের গান

প্যারিস আমি তোমাকে চিনি আমার হন্তারক প্রিয়তমার ন্যায়
তোমাকে বুঝি স্ট্রেইটকাট ছুরি ঢুকানোর আগ মূহুর্তের মোনালিসার হাসির অনুবাদে!!

 তাই বলছি এবার থামো!


দ্যাখা - অদ্যাখা কাব্যঃ

রিকশা কিংবা বিছানার বামপাশটায় অথবা হৃদয়ের বাম-অলিন্দে
একটা অসহ্য শূন্যস্থান; আশ্চর্য শুন্যস্থাণ নিয়ে পরিব্রাজক আমি
বেঁচে থাকি নিঃশ্বাস নেই এই যোণীবাহিত পৃথিবীতে
অদ্ভুত নষ্টালজিক কিছু শব্দের হাহাকারে আমার ঘুম আসেনা
তুমিহীন তুমিময়তার সেই শুন্যস্থাণ হিলিয়ামে পূর্ন কানায় কানায়
-    হাইড্রোজেনের দুই জোকার উড়ে যাওয়া সাংকেতিক পানির
উপচে পড়া ঢেউ নিয়ে তাই রিকশাটাকে নদী ভেবে
রাস্তায় হাটি আমি, বিছানাটার সমুদ্র হোয়ে ওঠা দ্যাখতে দ্যাখতে
একটা নিস্তব্ধতার একাকীত্বে গোল হোয়ে বসে থাকি
পাশের বারান্দায়
অপেক্ষা আর অপেক্ষায় কাটে আমার সোয়া দুই বছর!
ছুটি থেকে ছুটি নেয়া হয়না আমার,
দেয়া হয়না এক দেয়াশলাই বক্সে- ভালোবাসা মসলিন
আমি চাই
তাই আমি চাই তোমার যে তুমি; তারসাথে আমার কখনওই যাতে দ্যাখা
না হয়
তোমার; তোমার সাথে আমার দ্যাখা সে'তো ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যে এক নিগৃহিত বাংলার ইতিহাস!
তাই এই আমি চাই,
খুব কোরে চাই এই স্বাধীন বাংলায় আমার যে তুমি
সেই সন্ধ্যের ডুবে যাওয়া আকাশে লাল শাড়ি ছোট্ট লাল টিপে
ছাদে দাড়িয়ে
আমায় খোজায় ব্যস্ত যে অস্থির তুমি
সেই তোমার সাথে আমার দ্যাখা হউক,আবার
আবার,
রিকশার বা'য়ে বসো তুমি, বিছানার বা'য়ে শুয়ে পড়ো
আমি পাশে বসে আংগুল ছুই আংগুলে,
ছুয়ে দেই তোমার ঠোটের তিল আমার নিঃশ্বাসে,
সরিয়ে এলোমেঘ চুমু আকি কপালে তোমার,
কিছু শব্দে আবার কিছু কথা হউক,
হউক লেখা একটা কবিতা আবার দ্যাখার পর হউক
ফুচকাতে ভর করা এক সন্ধ্যে
একটা পায়ে হাটা পথে গোলাপ ফুটুক;আবার
একটা ছবি হউক ভোরের,
একটা ঘর হউক আমাদের; ছোট্ট এক ঘর
তোমার আমার মাঝে ছোট্ট একটা বালিশ হউক,
ছোট্ট এক আংগুল আধোবোলে বাধুক আমাদের
তারপর ঠিক ৪৭ বছর পর আমি মরে যাই তোমার ঠোটে...
৪৭ বছর পরবর্তী মৃত্যুর আগে
ভালোবাসা-বাসি সংসারের জন্য হলেও আমার
- তোমার আমার সাথে দ্যাখা হউক অথবা হোয়ে যাক...


বাড়ি আছে

ভেবেছিলাম ভুলে যাবো, ছাপোষা ঘামে ভেজা শার্ট ভুলতে দিলো না
ভেবেছিলাম অগ্নিদগ্ধ হৃদয় সপাটে বন্ধ করেছে স্বপ্নের জানলা,
ভেবেছিলাম চোখ খুলে ঘুমানো এই ভ্রষ্ট সময়টা পেরিয়ে যাবো,
পেরিয়ে যাবো সম্পর্কের সুতো ছিড়তে ছিড়তে একলাফে

একটা মানুষের ভেতর কতশত মানুষ আজকাল মরে পচে গলে যায়?
একটা বিপ্লবের মাঝে কত  হাজারটা বিপ্লব, মাজা ভাঙ্গা বিপ্লবী সেজে বিক্রি হয়?
একটা নারী কতটা সহজে জরায়ু দিয়ে দেয় বন্ধক?
ভেবেছিলাম এসবকিছুর জবাব পাবার পর
ছাপোষা আমি সরকারী দফতরের লাল কালো সিল আর স্ট্যাম্পপ্যাডে
লিখবো না বিপ্লব চাই  – একটা ঘুমের শিশুর ভাত  ঘুম চাই, নিশ্চিন্ত
লিখবো না বিপ্লব চাই  – মায়ের  আঁচলে মোছা হউক ঘাম সন্তানের
লিখবো না বিপ্লব চাইপ্রেমিকার হাত ভরা চুড়ীর আঁজলা ভরা জলে বুক ভেজাক প্রেমিক

কিন্তু না, পথের  মাঝেই ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়া দুপুরটা ঘুরে দাঁড়ায়
শব্দগুলো  আমার উদ্ধ্যত কৈশোর
শব্দগুলো  আমার নির্লোভ মাথা উঁচু তারুণ্য হয়ে
ওড়না খসে যাওয়া বুকে মন খারাপের কুয়াশা সরিয়ে  রোদ প্রস্তাবে লিখে দেয়
আমি একদিন জন্ম যন্ত্রণায় নিজের দিকেই ছুঁটে যাবো
আমি একদিন অভিমান ভেঙ্গে মিছিলের শ্লোগাণে বলে উঠবো
"বাড়ি আছে, বাড়ি আছেসোয়েব মাহমুদ , বাড়িতেই আছে"


অনাগত মুখ

যদি মরে যাই,
যদি বেঁচে না থাকি,
যদি অনাগত আধোবোল শুনতে না পারি,
তবুও তোমার চোখের ভেতরকার চোখ হয়ে থাকবো
তবুও তোমার বুকের ঘামে লিখে যাবো তোমায়

তবুও তোমার আঙুল ছুঁয়ে আঙুলে থেকে যাবো মৃত্যুশোকে