অনুবাদ কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অনুবাদ কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
দীর্ঘ কবিতা • পানিকাউর • হাসান রোবায়েত

দীর্ঘ কবিতা • পানিকাউর • হাসান রোবায়েত






কোথাও অন্ধকার ছুড়ে দেয়
আলকাতরার বহু লীন স্মৃতি, দূরে চিমনির পোড়া নীল, ক্রমার্দ্র ধোঁয়া
ঘুমন্ত বয়লার ঘিরে কালো পোকা
বয়ে যাচ্ছে শরীর, রাত্রির লাশ—বাষ্পের মিথ
তার তামাটে চোখের ভেতর জ্বালায় হু হু গরাদের ফাঁকা সুর

এমন সময়, হে পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
বৃষ্টির রাতে
ছায়া-বিদ্যুতে, ঘনলীন তির, শীর্ষে ইলেকট্রনে
বসে থাকো—যেন ইয়াজুজ-মাজুজের সুষুম্না চিরে
এই নদী, খাল, স্ফটিক পানির যত উন্মূল চক্রাবর্ত
ফিরে ফিরে আসে
অনন্ত হাওয়া-বিচ্ছুরিত যে স্বেদ
পাক খায়, দোলে
সেখানে গভীর তারাম-লি আলোর অশ্রু ধরে থাক থাক
রাতের-সোপান পেরিয়ে নামছে এই চরাচরে, তারই তীক্ষ্ণ চূড়াটিতে তুমি
দৈবনখরে ধরে আছো আলো—
দেখছো, পাশার সারি সারি খেত
মানুষের ঘুমে ঢুকে মহিষেরা উড়িয়েছে ধুলা
গানের লুপ্ত সুর তারা খুঁজে খুঁজে হয়রান—
নম্র পাথর ও পাখি, তোমার কালো হর্মের ভেতর বাজছে
অনাদিকালের উনুনের বীথি
ডুবোনৌকার মোনামুনিবন
এমন গভীর তামাটে রাতের সৌর-অন্ধকারে
শুনেছো পানোখি—
শুয়োর...মাদার চোদ বলে বলে কয়েকটা চোর
উন্মাদ খোর
যাচ্ছে কোথায়
ক্রুর শঠতায়
বিস্মরণের এই ফোঁটা ফোঁটা ভিজে বৃষ্টিতে—

নোনতা দুপুর, গাধার সঙ্গে ফিরে আসা তারা
বাস ড্রাইভার—
শনি-রবি-সোম
ভেসে যায় মল, ফাঁপা কন্ডোম
ফিরে ফিরে আসে, পাক খায় আর
এই কানা বুধ, শুক্রের বার—
এমন সময়, ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
ভিজে ভিজে একা
দাঁড়িয়ে থেকেছো নদীখালবিলে
সূর্যের শত রশ্মি বিফলে
উরু ফাঁক করে ঢুকিয়ে নিয়েছে
শ্রান্ত সন্ধ্যা যেন কবেকার
ঢেকে দিছে গেছে গোধূলির হেম
সব ডুবে যাবে—
শীলিভূত হয়ে জীবাশ্মে, গানে
ওই দূর দূর
চক্রাবর্তে যেখানে বসন্তেরা শুয়ে আছে
নৌকায় খাঁড়িপাড়ে
বিকালের পুঁজ, ঝকঝকে খুঁত, মায়া-শ্লেষ-হাহাকার
আব্বার ভাঙা সাইকেলে বসা পেছনের ক্যারিয়ার—
তবু হে পানোখি
তোমার রয়েছে দিগন্ত উড়বার—
এখানে পচন, কূট মিথ্যা ও বীজানুর অধিকারে
রাত্রি ফুরিয়ে যাচ্ছে বাদামী ভেড়াদের অধিকারে
ফোঁপা কান্নায়, তামাকারবারি, জাতিয়তাবাদী এবং অশোক
গাছটার ডালে
বেওয়ারিশ কেউ, কয়েকটা চোর, লাশ-ব্যবসায়ী
প্রত্যেকে একা
করছিল পান তারার আরক
ছোট ছোট ঢেউ
ঢেউয়ের উপর আলোছায়াময় রাত
মাদী কুকুরের যৌন সে ঘ্রাণ
অন্ধকারের ডাক—
‘এই শাউয়ার চাঁদে এত ফাঁক!’

কী যেন বলছে গভীর আয়েশে বাতাসের দিকে চেয়ে

এমন সময়, ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
জানো, এ রাতের অবিশ্রান্ত করোটিতে
আমাদের দেখা হবে না কখনো—

সেই বিস্কুট ফ্যাক্টিরি থেকে বৃষ্টির দিনে আসতেছে ঘ্রাণ
অথবা জোছনা পিছে পিছে রাতে
হয়েছে সঙ্গী, কুশারের বন
আব্বা রয়েছে
আর ছোট বোন
আমরা নৌকা তুলেছি ডুবানো
আমাদের ছিল ভুখা পেট, গানও
গেয়েছি সে রাতে, ওপারে মাঝির ডাক নাম গেছি ভুলে
‘আর কতদূর’ বলে ছোট বোন
আব্বা তখন
নৌকার ঘ্রাণ
ছোট সে বোনটি ভাটিয়ালি গান
বহুদূর পথ হেঁটে গেছি ঝরা ধানখেত দিয়ে দূরে
আমাকে ডাকছে মাটিডালিপথ
সাবানের কারখানা—
তুমি হে পানোখি রাতের ডিভানে
আর ফিরে আনিয়ো না
সেইসব নাচ, ডুমুরের সারি, আপাত বিষাদ

ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—

ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
উড়ে যাও দূরে
যেখানে চাকা হিংসা-বলয়ে ঘুরতেছে ক্রমাগত

সিলভিয়া প্লাথ, কাফকার সম্মোহনী ও অন্যান্য • তিয়াশা সুরভী

সিলভিয়া প্লাথ, কাফকার সম্মোহনী ও অন্যান্য • তিয়াশা সুরভী






সিলভিয়া প্লাথ

জলের সাথে মিলেমিশে রক্ত গড়িয়ে গিয়ে সকালের পবিত্র আলো ছুঁয়ে দেয়। সে সময়ের সাথে সংঘর্ষ চলছে মানুষের।
মানুষ!
মানুষ কি চেনে অন্য মানুষকে?
মানুষের হাত, পা, চুল, প্রিয়তম চোখ এসকল যেন ভুল আয়াত হয়ে ঢুকে গেছে ইতিহাসের পাতায়।

মেয়ের লাশ শেষ বার দেখে হাত রাখে কফিনে।
সেই অতি প্রয়োজনীয় অথচ অপ্রিয় কফিন একজন বাবা বয়ে বেড়ায় চিরকাল।
ভাবে- এ হাত গড়েছিল একদিন সভ্যতার প্রাচীর
এ হাত এখন কিয়ামতের অপেক্ষা ছাড়া নিজের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পারে না।

আত্মহত্যার রঙ না কথিত সভ্যতার ব্লেডের ধার বেশি সুন্দর ?

সিলভিয়া প্লাথ, আপনার কবিতায় প্ররোচিত হয়ে কোন মানুষ কি মরেছিল? খুব সকালে?

কাফকার সম্মোহনী
নগ্ন সত্য আর মিথ্যের মাঝামাঝি মৃত্যু বেছে নেয়া কঠিন।

তবু
কবরে পৌঁছানোর রাস্তা দেখানো হচ্ছে।
আমার ডায়েরি আর স্ট্যানলির চিঠি গুলো সাথে দিতে বাধ্য করেছি।
ঠিক এই মুহুর্তে, চারজনের কাধের ওপরে শুয়ে, ঘুম ঘুম চোখে বুঝতে পারছি, স্ট্যানলিকে অনুবাদ করলে স্ট্যানলিই থাকে।

আমার মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে দুঃখ মেশানো হাসি। কার হাসি এতোটা তীক্ষ্ণ!
সে কি জানে আমি আর কবিতা লিখতে পারবো না, শ্লীল অথবা অশ্লীল শব্দে? আমাকে উপহাস করছো। আমার রেখে যাওয়া প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য, প্রতিটা কবিতা তোমার স্বেচ্ছামৃত্যু ডেকে আনবে, আমি বিশ্বাস করেই আরামে শুয়ে আছি এখন।

ফরাসিরা একবার কাফকা পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। অথচ কাফকার বানানো জগতে আমি রোজ বিকেলে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম। এখন একসাথে বসে সিগারেট ভাগাভাগি করতে পারবো ভাবতেই আরো দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে চাচ্ছি।

স্ট্যানলি,
আমাকে, এই আমার আমিকে নির্মাণে অথবা কাফকার কাছাকাছি পৌঁছে দেয়ায় ভূমিকা আছে তোমার একান্ত ব্যক্তিগত স্যুভেনিরের। অবশ্য তুমি আমাকে সম্মোহিত করনি। তবুও
তুমি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিও ট্রাফিকের তিন রকম আলো। (যদি পারো)

রেস্তোরা

নবী মূসা
অনেক মানুষের ভীড়ে
আপনার হাতটা যখন ছাড়লাম
পৃথিবীর ওজন বাড়িয়ে চাপিয়ে দেয়া হলো আমার ঘাড়ে।
ঘাড়ের তিলে চুমু খেয়েছিল যে, তাকে পাওয়া যাবে কফির দোকানে। চিনির দাম কম না বেশি এই নিয়ে আলোচনা চলছে তুমুল। এসব খুচরো আলোচনার সুবিধার্থে শহরে এতো দামী, কম দামী ক্যাফে, রেস্তোরাঁ।

ব্যাক্তিগত ঠোঁট থেকেই কেবল আমি চা পান করি। খেতে খেতে নতুন চশমাটা পরে শরীরের সমস্ত বাক দেখার আগেই অর্গাজম হয় কবিতার, কবিতায়!

বীর্যভেজা পাতার গন্ধে আমি লিখতে পারি না।

ভুল ঘুম

তীরবিদ্ধ বুক।

বুকের সমস্ত ভালোবাসা জড়ো করে, তোমার প্রাক্তনের জন্য বসে আছি, আজ দেড়শত বছর।

তোমার মুখোমুখি, আমি। অথচ মরে গিয়েছি গতরাতে সিগারেটের শেষ টানের সাথে।

মহাকাল থেকে অতীত ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় আমার শীত করছে।

প্রেমাতালের ওষুধ খেতে ভয় আমার। ভয়ংকর চোখ এখনো ছবিটায়। ধূসর হয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে ইতিহাসের আয়াত।

আর

নূর দেখেছিলাম যে চোখে সে চোখ পুড়ে যাচ্ছে ভুল ঘুমে।


ক্ষুধার্ত মানুষের গান

একদিন হাটতে হাটতে আমি চলে গিয়েছিলাম বব মার্লের তাবুতে। উনি গান লিখে আমাকে গেয়ে শোনালেন। দুঃখ দুর্দশা আর ক্ষুধার্ত মানুষের গান।
কতোকাল হাটতে থাকলে আমার বয়সের সমান ক্ষুধায় আমি নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবো বব?

এক কেজি করলার দাম আমি রেখে এসেছি বালিশের নিচে। চালের দাম? কিনি না তো। রাত হলে ভাতের হোটেলের সামনে বসে থাকি। বসেই থাকি। যখন ক্ষুধায় তৃষ্ণায় চোখে ঝাপসা দেখি আমি চলে যাই কোন আখড়ায়। গান শুনি। শুনি বেকারত্বের হার কমে গিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

বসন্ত শেষ। এখন বর্ষাকালীন কদম সময়।
প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়
ভিজে যায় অসহায় রাত
ঘুমহীন লাল চোখ, অবহেলায় পকেটে রাখা দু'টাকার কয়েন
খামছে ধরে বুকের ভেতরকার তীব্র ক্ষুধা।

হে
দিকভ্রান্ত কবি
চিরকাল মাতাল আপনি
ছিলেন সেখানে?
বিভ্রমের সঙ্গম শেষে জ্বলে গেলো ক্যাটালগ
ইবাদত ব্যতিত আগুনে জ্বলে যাওয়া পাপ
আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, আপনার ইবাদতের সাক্ষী মরে গিয়েছে আপনার মৃত্যুর আগেই।
তবে স্পষ্ট ঈমান আনুন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের।
নিজের লাশ আর কতোকাল কাঁধে বয়ে বেড়াবেন?

আমি আপনার ভাবনা, ভাবনা অব্দি না এনে, হেঁটে যেতে চাই ভ্রান্তিময় সময়ে। সময় যেখানে কবিতা, কবিতা যেখানে সময়। ওখানে চুমু খেতে প্রশ্ন প্রশ্ন খেলায় আমার আগ্রহ নেই। আগ্রহ আছে টকটকে লাল ঠোঁটে। দীর্ঘতম চুমুর রক্ত আমি হাটবাজারে বিক্রি করে ট্রেনে চেপে বসবো।

কারণ
বব জানালো -
বৃষ্টি থেমেছে
ম্যাপল পাতা ভিজে গেলে নরকের আগুন নিভিয়ে দেয়া হয়।
ঘুমোতে দেয়া হয় রাত প্রহরীকে।
বিভ্রান্তিকর অস্থিরতার কথা কেউ আর অনেকদিন বলে না।

বব, ক্ষুধা পেটে সিগারেট আমার দারুণ লাগে
লাইটার হবে?
নরকের আগুনটা, বড্ড মলিন।
সিগারেট ধরানোর মতো মহৎ কাজে লাগে না।
এগুলো বলার সময় এখন আমার হবে না।

করলা। করলা কিনে বাসায় ফিরতে হবে।
লাল গোলাপ পাশে নিয়ে ঘুমাতে হবে।
মানুষ মানুষকে মারছে এসব খবর না শুনে ঘুমাতে গেলে গোলাপের গন্ধ প্রাক্তনের কথা মনে করায়।
আমি চিৎকার করে 'দিকভ্রান্ত কবি' কে ডাকতে গিয়েও কোনদিন ডাকিনি, জানেনি কেউ, বলবো না তাঁর কথা কাউকে কখনোই।

বিষন্ন সুরে ক্ষুধামুক্তির কোন গান হবে নাকি, বব?


"Don't Worry
About a Thing
Cause Every Little Thing gonna be Alright"
লি পো’র এক গুচ্ছ কবিতা • ভাষান্তর: জিললুর রহমান

লি পো’র এক গুচ্ছ কবিতা • ভাষান্তর: জিললুর রহমান

চাইনিজ কবি লি বাই (Li Bai), লি বো (Li Bo), লি পো কিংবা লি তাইবাই (Li Taibai) এর জন্ম ৭০১ খ্রিষ্টাব্দে এবং মৃত্যু ৭৬২তে। তিনি নিজের সমকাল থেকে আজ পর্যন্ত স্বীকৃত হয়েছেন একজন প্রতিভাধর এবং রোমান্টিক ব্যক্তিত্বরূপে, যিনি ঐতিহ্যগত কাব্যরূপ বা ফর্মকে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করেছেন। লি পো এবং তাঁর বন্ধু তু ফু (Tu Fu) ওরফে দু ফু (Du Fu), যাঁর জীবনকাল ৭১২–৭৭০ সাল, দুজনেই ট্যাঙ সাম্রাজ্যে (Tang Dynasty) চিনা কবিতার বিকাশের জন্যে সবচেয়ে প্রনিধানযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এই সময়কালকে চিনা কবিতার স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। সেকালের ৩ বিস্ময় বলতে বুঝায় — লি পো’র কবিতা, পেই মিন’র তলোয়ার খেলা আর ঝাঙ জু’র ক্যালিগ্রাফি।


শরতে নদীর গান

সবুজ পানিতে ভাসে চকচকে চাঁদ
শুভ্র সারসেরা উড়ছে জোছনায়

যুবক শুনতে পায়, তরুণী কুড়ায় পানিফল:

রাতের আঁধারে, গান গাইতে গাইতে, তারা
একসাথে বাড়ির পথ ধরে

একা পর্বতের দিকে তাকিয়ে

সব কয়টা পক্ষী উইড়া গেছে চলে
একখান একলা মেঘ হেইলা-দুইলা ভাসে
কখনো ক্লান্ত হই না আমরা পরস্পর চাইয়া থাকতে—
খালি পর্বতটা আর আমি

তু-ফু সম্পর্কে

তু-ফু’র সাথে আমার দেখা এক পর্বত চূড়ায়
আগস্টের সূর্য তখন গরম

তার বিশাল খড়ের টুপির ছায়ায়
তার মুখখান আছিল বিষণ্ন

আগের বছরগুলাতে যখন আমরা মিলেছিলাম
তার থেইকা সে হইছে আরও ফ্যাকাসে, অবসন্ন

অসহায় বুড়া তু-ফু, তখন আমি ভাবছিলাম
সে আবার পীড়াদায়ী কবিতার যন্ত্রণায় ভুগছে

স্বীকারোক্তিমূলক

একটা সোনার কাপে মদ ছিল
আর ঊউ থেকে আসা পণ্চদশী কন্যা
তার ভুরুগুলা গাঢ় করে আঁকা
আর লাল জরিবুটিঅলা চপ্পল

যদি তার কথাবার্তা ছিল কমসম
কত সুন্দর সে গাইতে পারে!
আমরা একসাথে খাই আর পান করি
যতক্ষণ না সে আমার বাহুতে আশ্রয় নেয়

তার পেছনের পর্দায়
পদ্মফুলের সূচিকর্ম
আমি কেমনে অস্বীকার করি
তার এগিয়ে আসার প্রলোভন?

স্নাত এবং ধৌত

সুরভিতে গোসল করা
তোমার টুপিতে ব্রাশ কইরো না
সুগন্ধিতে ধোয়া
তোমার কোট ঝাইরো না

“দুনিয়াটা জাইনা
ভয় কতো বেশি বিশুদ্ধ
সর্বজ্ঞানী লোকে
মূল্য দেয় আর জমায়ে রাখে আলো”

নীল পানির ধারে
এক বুড়া বড়শিঅলা মাছশিকারী বসা:
তুমি আর আমি একসাথে
চল বাড়ি যাই

একা একা পান করা

আমার মদ বাইর কইরা আনি ফুলের ভেতর থেকে
একা পান করার জন্যে, বন্ধুরা ছাড়াই।

গেলাসটারে উপরে তুলি চাঁদকে লোভ দেখাইতে।
সে আর আমার ছায়া মিলায়ে আমরা তিনজন হই।

কিন্তু চাঁদ মদ্য খায় না,
আর আমার ছায়াও তারে অনুসরণ করে ।

আমি বেড়াইব চাঁদ আর ছায়ার লগে, সুখে
বসন্তের শেষদিন যাবৎ।

আমি যখন গান গাই, চাঁদ নাচতে থাকে।
আমি নাচলে আমার ছায়াও নাচে।

আমরা জীবনের আনন্দ ভাগ করে লই,
যখন শান্ত হই।
মদ্যপ, প্রত্যেকেই চলে আলাদা রাস্তায়।

চিরস্থায়ী বন্ধুরা, যদিও আমরা ঘুরে বেড়াই
আমরা আবার মিলব মিল্কি-পথে

ইওয়াঙ টাওয়ারে যাওয়া

ইওয়াঙ টাওয়ারের উপরে উঠবার সময়
সব দৃশ্যগুলা চোখের সামনে চলে আসে;
বড় নদীর উপরে দেখি নৌকাগুলা বাঁক নেয়
আর ঢুইকা পড়ে টাঙটিং লেইকের ভেতর;
রাজহাঁসগুলা কান্দে নদীরে বিদায় জানাতে
যখন তারা দক্ষিণদিকে উইড়া যায়;
বিকাল গড়ায়ে গেলে
যেমন পর্বতের চূড়াগুলা
চান্দের দিকে হা করে তাদের ঠোঁট দিয়ে;
আর আমরা ইউয়াঙে
যেন মাথাগুলা মেঘের ভেতর ঢুকে মদ্য খায়
যেন বেহেশত হইতে আপনাআপনিই
পাত্রগুলো আসলো।
তারপরে পুরা মাতাল হয়ে পড়লে
শীতল বাতাস বহে
আমাদের ঘুম নামে, যদিও
মনে হতে থাকে আমরা তার সাথে নৃত্যরত।

মেঙ হাওরানের জন্যে বার্তা

প্রভু, আমার অন্তর থেকে প্রণতি জানাই,
আর তোমার খ্যাতি আকাশ ছুঁয়েছে
কদর্য যৌবনে টুপি আর রথ অগ্রাহ্য করে
তুমি বেছে নিলে পাইন গাছ আর মেঘ; এবং এখন সাদাচুল,
চাঁদের সাথে মাতাল, স্বপ্নের এক প্রজ্ঞা,
পুষ্প-মুগ্ধ, তুমি সম্রাটের প্রতি বধির ...
সুউচ্চ পর্বত, তোমার পর্যায়ে পৌঁছতে কতো লম্বা হবো,
তোমার মিষ্টিঘ্রাণে এখানেও শ্বাস নিই!

বসন্তে

তোমার উত্তরের ঘাসগুলা জেড-পাত্থরের মতো নীলা,
আমাগো তুঁতগাছগুলা এইখানে সবুজ সুতার মত ডালপালা নিয়া বাঁকা;
আর হকশেষে তুমি বাড়ি ফিরবার চাও
এখন আমার হ্দয় যখন প্রায় ভাঙা...
ও বসন্ত-বাতাস, তুমি জানো যতক্ষণ না পাত্তা দিই,
কেন তবে সিল্ক-পর্দা আমার বিছানার ধারে?

জিঙমেন ফেরিতে বন্ধুকে বিদায়বাণী

জিঙমেন ফেরি থেকে বহুদূরে তরী বেয়ে
শিগগির তুমি হবে দক্ষিণের লোক,
যেখানে পর্বত শেষ আর সমতল শুরু
আর নদী ভেসে যায় বিজন প্রান্তরে ...
আয়নার মতোন চাঁদ উঠে আসে,
সমূদ্রের মেঘদল প্রাসাদের মতো কীরণ ছড়ায়,
আর পানি তোমাকে বাড়ির যেন পরশ বুলায়
তিনশ মাইল ধরে তোমার নৌকা টানার জন্যে।


হাসনাত নাগাসাকি এর গুচ্ছ কবিতা

হাসনাত নাগাসাকি এর গুচ্ছ কবিতা


রক্তদোষ 

কবিদের প্রতি শেষ আদেশ-
এ তল্লাট ছেড়ে যাও- সরে পড়ো এখনই চুপচাপ।

আর, তোমাদের স্ত্রী ও প্রেমিকাদের কাছে
জমা দাও সন্তানের নামের তালিকা ;
মনে রেখো, যে সন্তান এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি,
তার পিতৃত্বের দাবিদার তুমি নও।
আর শুনে রাখো, আমরা যাদের বার্থ সার্টিফিকেট দেবো-
নাম আর স্বীকৃতির সীলমোহর সাঁটা,
তারা হবে এ তল্লাটে পরবর্তী কবি।

যেহেতু তোমরা কেবল ভালবাসতে জানো,
যেহেতু তা কোনও মহাজনের গোলা
ভরে তোলে না কাঙ্ক্ষিত ধাতব শস্যে,
যেহেতু তোমরা আঙুল তোলো
রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগায়-
সেহেতু এই আবাস তোমাদের নয়।

তোমরা হুকুম তামিল করতে শেখোনি ;
রক্তের দোষ!
তোমাদের পিতৃপুরুষ ও গর্ভধারিণী মা
জন্মক্ষণে বলে দেননি- মাথা নত করতে হয়
কিভাবে - কখন!

নিরাপদ

এইসব নিরাপদ রাত আর দিনগুলোকে কি করবো আমি?
কি করবো আমাকে, এইসব নিরাপদ
রাত আর দিনের ভিতরে ?

বোধের আকাশকুসুম আরামের ধূম্রপথে
ধীর পায়ে চলা, যেন বা স্থবির এ্যমিবা-
যেন বা খোঁয়াড়-পালিত উট- উটের গ্রীবা,
কেন?
কি করবো এইসব গ্রীবার ভিতরে আমাকে
অথবা
আমার ভিতরে অনিচ্ছুক গ্রীবার আবাদ?

এ বিশাল খোঁয়াড়ে আমার
এইসব নিরাপদ রাত আর দিন
পুঁতে রেখে নষ্ট ভূমিতে অনর্থ বীজের বপন-
খেয়ে নেবে ধীরে ধীরে মাটি আর নীরব প্লাবন।
আদতে আমরা সেই জোয়ারের পানি!

কেবল, কখনো কেউ কেউ
সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ভালবেসে যদি
হতে চায় বাঁধভাঙা নদী,
বিধ্বংসী প্রলয়ের ঢেউ -
আমাদের সমুখে দাঁড়ায় এইসব নিরাপদ রাত আর দিন!
খুব ভিতরে টের পাই, মৃত্যুও জীবনের মতোই রঙিন?

ব্যতিহার 

যদি আমি লিখে যাই কিছু কিছু শব্দরূপ-
যেমন- 'মৃত্যু'; যেমন- 'ভালবাসা';
যদি লিখে যাই 'যক্ষ্মা' একটি কষ্টকর জীবনের নাম-
কখনো তোমার হাতে উড়ে গিয়ে পড়লে সেই চিঠি-
কী ভাববে তুমি? কল্পনায়?
ভাববে কি অপত্য ভালবাসাহীন একটি শুশুক সন্তানের কাছে যেতে পারেনি কখনো?
পাল্টানো জলের স্রোতে সন্তানের পাখনা- কানকো
খুঁজে পায়নি পিতার প্রবাল?

ধরো, আমি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিখলাম- 'প্রসাদ' ;
নিদারুণ অভিমান নিয়ে লিখলাম- 'ফেরারি';
অস্থির উন্মাদের মতো লিখলাম- 'প্রশান্তি';-
কোনও সায়াহ্নে বসে একাকী পাহাড়ের অন্ধকার চিবুকের কাছে
গড়িয়ে পড়ার আকুতি জানালে
পাহাড়টি আমাকে বক্ষ খুলে দেবে। আর,
আমি মৃত্যুর বদলে ঝুলে থাকবো স্তনবৃন্তে তার।
যেহেতু জেনেছি পাহাড়ের যোনির ভিতরে যেই ঘুম-
সেই সুধা ছেড়ে আর ফেরা হয় না।

এইভাবে ঝুলে থেকে রাত বাড়বে, হয়তো;
এই চরাচরে বাড়বে স্বাভাবিক শেয়ালের গান;
তুমি হয়তো অংশ নেবে সেই নৈশভোজে!

তখন হঠাৎ উড়ে
তোমার সমুখে পড়লে হলুদ বোতাম-
ঝুলে থাকা ছেঁড়া জামার বুকের উদাম-
কি ভাববে সেই সিল্কি সময়ে?

ভাববে কি- 'বোতামটা লাল হলে আরো ভালো হতো '?

অনাহূত 

শোনা যায়, বাতাস-ছেঁড়া হৈহৈ রৈরৈ?
শোনা যায়, অনাহূত বখতিয়ারের পায়ের আওয়াজ?
সুতরাং খিড়কি খুলে দাও,
তুলে রাখো অসমাপ্ত হাতের কার্যাদি,
কৃষ্ণবর্ণ বহুচর্বিত গলিত রমন।

বামন যুগের শেষ বাঁশি
তোমরাই বাজিয়েছ এ মোহনা-মন্দিরে।
কান্তার পাহাড় হতে  সব ক'টি খিড়কি, অন্দরে-
ঘন অন্ধকারে ডুবে যুবতি, রমনী,
শিশু ও বলিষ্ঠ কাপুরুষ-
ভুলে গেছে আপন সুরত!
অতলান্ত বৃষ্টি প্রার্থনায়
তোমরাই ছড়িয়েছ এ নগর বাতাসে
আবেদন গন্ধী রস, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস!


অতএব
দূর থেকে উড়ে এলে অনাহূত যোদ্ধা বখতিয়ার
ধুলোর- ক্ষুরের শব্দে- খুলে দাও সমূহ দুয়ার।

বিভ্রম

এ দুঃখ গেলো না আমাদের, এই ভ্রান্তি!

তিন রাস্তার মোড়ে গেলেই
আমরা পথ হারিয়ে ফেলি বারম্বার।
তারপর আমরা দশ বন্ধুর নয়জন তিনভাগ হই,
একজন বসে পড়ি তিনরাস্তার মোড়ে।
মূলত একজনের পথ খুঁজে পাবার কথা নয়।

তবু সান্তনা,
আমরা তিন বন্ধু এক আছি, এবং
তিন পথের একপথ ধরে চলছি এখনো।

চলতে চলতে আরেকটু সামনে গেলেই
আরেকটি চার রাস্তার মোড়।
চারভাগ হতে গিয়ে দেখি - চার রাস্তার মোড়ে
বসে পড়ার লোকটিও কম আছে।

তাতে আমরা থেমে পড়ি না। থামতে হয় না।
অধিকন্তু পেয়ে যাই অচেনা মুখের এক ঝাঁক সাথি।
ভুল রমন উৎফুল্ল করলে আমরা টের পাই না
হাতের উৎস ও পরিধি।

মুলত, পথ বিষয়ে আমরা কবিতা লিখতে পারতাম,
অথবা, পথকে অস্বীকার।
কিন্তু, ততোদিনে দেরি হয়ে যায়।
ততোদিনে আমরা টের পাই, আমাদের ঘাড়ে অন্যের হাত,
আমাদের পায়ে গোপন পথে আসা বিদেশি জুতো।
আমরা চাইলেও আর যেতে পারি না কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে আমাদের।

একটা সফল ভ্রমণ শেষে
আমরা জমা করি নয় বা ততোধিক পথের ইতিহাস।
সেখানে অবশিষ্ট থাকে আমাদের হাড়ে
বিদেশি মদের ঘ্রাণ।

জিলাপির ভিতরে ঢুকে পড়ি

জিলাপির ভিতরে আমি ঢুকে পড়ি-
জিলাপির আঠালো সুমিষ্ট রসের ভিতরে;
জল্লাদের হাতের মুঠোয় ঝুলন্ত দড়ির বিভ্রান্তির ভিতরে।

তারপর একঝাঁকে, একই মিছিলে
দেখা হয় অজস্র জিলাপির সাথে, ঐকান্তিক;
যেন বা খলসে পোনার মতো ছটফটে ধাবমান
এক ঝাঁক মৃত্যু,
এক প্রস্থ্য জীবন অথবা সাইক্লোন-কবলে পড়া নাবিকের জাহাজের শুঁড়!

তারপর, একটি কালচে-লাল পিঁপড়ার মতো
কোন ফাঁকে হয়ে উঠি শীতের 'রসদবাদী'!

কে না জানে -
পিঁপড়ার প্রসঙ্গে দু'টি কথা সমধিক সত্য -
এক, পিঁপড়েরা জিলাপির অন্ধ মুরিদ ;
দুই, লবন দিয়ে পিঁপড়ে খেতে মচমচে মজা!
এটুকু বলেই আমি হেসে উঠতে পারতাম হো হো!
কিন্তু, তৃতীয় সত্য হচ্ছে -
পিঁপড়েরা কাঁদতে জানে না।

যে কাঁদতে জানে না তাকে নিয়ে হাস্য করা সমীচীন নয়।

বিচারালয়

কাঠগড়া থেকে নেমেই গ্যালিলি বললেন
-মহামান্য আদালত, সব কিছুই ঘূর্ণায়মান।
নক্ষত্র, পৃথিবী, চাঁদ,
অক্ষিগোলক,হৃদয়, মানুষের হৃদয়ের ফাঁদ;
এমনকি সত্য, এমনকি মিথ্যা, আপনার হাতের কলম,কলমের নিভ।

মহামান্য আদালত, ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখুন,
পশ্চাতে আপনার ছায়া পৃথিবীর সেরা কৌতুক।
এখনো যারা ঘুরঘুর করে ঘুরছে এই বিচারালয়ে,
মূলত বের হবার পথ ভুলে গিয়ে, তাদেরকে  আদেশ দিন জামা- পাতলুন উল্টায়ে পড়ে আসতে; এবং সঙ্গমকালে তারা যেন সমধিক ঘূর্ণন রপ্ত করে।

মহামান্য আদালত, আমরা যারা আপনাকে মহামান্য বলি- আপনি কি বাড়ি ফিরে রেচনক্রিয়া করতে করতে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন? আমাদের নির্বুদ্ধিতায়?

গ্যালিলিও গ্যালিলি ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর দিকে দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে বললেন,  মহামান্য আদালত,
মানুষ কি ক্রমেই অস্বীকার করছে প্রপিতার নাম?
মানুষ কি দেখতে পাচ্ছে না যারযার মাথার খুলির ক্রম নিমজ্জন?
একদিন, যেদিন অন্ধকারে
টলে উঠবে বিচারালয়, টলে উঠবে চেয়ারের পায়া -
আমি বলবো, এখানে একটি মিথ্যার জাদুঘর হোক।

গ্যালিলিও গ্যালিলির অকস্মাৎ হিসু পেলে -
পৃথিবীর সর্বত্র তিনি দেখতে পেলেন পাপ ও পঙ্কিল ক্ষত।
বিচারালয় তাকে জেলে পাঠালেন।
জাকারিয়া প্রীণন এর গুচ্ছ কবিতা

জাকারিয়া প্রীণন এর গুচ্ছ কবিতা


ডাহুক

শ্রীলেখা--
আলোর সার্শিতে শিল্পকর্ম শিখতে
ঠোঁটের কাছে তুলে আনলে অন্ধকার
এক দিকে তোমার মন্দির
অন্যটায় আমার ধর্মের গেরস্থালি
আমি কী করে ভুলি---
তোমার দেহেই নিষিদ্ধ আছে
আমার ধর্মের পুরুষ

শ্রীলেখা-- শ্রীলেখা--
তোমার ধর্মের শরীরে-- সে আমি
প্রথম; নগ্ন বালকের ভেতর
আমার শৈশব দেখে কেঁদেছি
দেখেছি--
শাড়ীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা
ধর্মের গম্বুজ-- ক্ষীণ হতে হতে
নদী পথে চলে গেছে মহাসমুদ্রের দিকে;
তার আঁচড়ে মরা ঢেউয়ে--
আত্মঅহমে লাফিয়ে উঠে জন্ম-মৃত্যুর দর্শন

দূরের সেই ডাহুকের কাছে
জীবন এমনই এক কদমফুলের চিত্রকল্প মাত্র...!

বেনে বউ

অরণ্যের তরঙ্গ ভেদে
নেমে আসা
বেনে বউ
জোৎস্নার পাটিতে বসে
জীবন পোষ
আমার
ঘাট; রাখালির পালে
তোমারে পাই--
জোৎস্নার মতো সাদা শরীর
আর
সূর্যাস্তের মতন
উবে গেছে সিঁদুর
আমি
পাল বংশের ছেলে
জালের বুনন বুঝি না
পারি না তাঁতের ব্যাবহার
তোমার শাখা মুছা হাত
রাতের আড়ালে কত; সন্তানের খাবার
যুগাবে
আমি তো পাল বংশের ছেলে
ভেড়ার মাতৃত্ব দেখি;
দেখি পিতার ছন্দছাড়া মন,
কামের অশিল্প ব্যবহার
আমি তো পাল বংশের ছেলে
রুক্ষ মরুর দেশে;
ঘাসের ভেতর,
অরণ্যের ভেতর জীবন খুঁজি...

 দোয়েল

বাতাসের সিঁড়ি বেয়ে
উড়ে আসে দোয়েল
বাদামি রঙের ছায়ার দিকে
পাতার কণ্ঠে-উপকণ্ঠে
দ্রোহের বাতাস
যেন
একটি লাশের উপর
উবুড় হয়ে আছে
শিশির ভেজা সকালের মুখ

একটি বাদামি রঙের ছায়ার দিকে
মুখ করে বসে আছেন ঈশ্বর
শুধু
পাতাদের কণ্ঠে-উপকণ্ঠে
আলোর বিচ্ছুরণ
যেন
আয়নায় মুখদেখে
ঈষৎ কণ্ঠে হাসছে ঈশ্বরী
আর
নারীরা
দোয়েলের নামে খুলে দিচ্ছে পাজামার গিঁট...

গাছ

একা একটা গাছ
আকাশের দিকে চায়
তার
পাতা জুড়ে জোৎস্নার দুধ
যেন যৌবন গড়িয়ে নামছে
আধমরা বয়সে

কেউ একজন
চাঁদের ডগায় বিড়ি ধরায়ে;
ফুঁকতে ফুকতে নির্জন হয়ে এলে
গাছটা কোথায় জানি হারায়া যায়

এই যে শহর
তুমি; তোমার ঠোঁট
আপেলের মতো লাল হয়ে আছে
তারপরো
শরীর থেকে খুলতে চাও অন্ধকার;
পোড়া চাঁদের ধোঁয়ার ভেতর
একটা গাছ কোথায় জানি হারায়া যায়

যেমন গতরাত তোমার শরীরে শৈশব
খুজতে যায়া
আমার শরীরে বার্ধক্য নেমে এলো
একা একটা গাছ তোমারে তাকায়
দেখে- শৈশবমরা দেহে
প্রাচ্যের ফুল ফোটে আছে; তার
খাড়া দুই নিপল জোৎস্নার সতীন।

 মীন

গুনগুনী যে বাতাস ঝরে গেলো
গোধূলি বেলায়
তার গান থেকে আসছিল
প্রেম ও বিরহ মেশানো সুর
সূর্যের কাঁধ-ধরে সকাল দাঁড়ালে-
কোষ ছাড়ানো কলার মতো খুলে যায়
গোরখোদকের মন
সূর্যের আলো যতই উদ্ভাবনীয় মনে হোক না কেন
সে যায়
মৃত্যুর দিকে;
অথচ সময়
জীবনের কাছে কত অজুহাত রেখে যায়
আলোর কাছে আমি কতটা ঋণী?
ইতস্তুত প্রশ্ন-মাঝে ঢুকে যায় মুনীয়ার ডাক
ধ্যানের নিকেতন খোলে; শৈশব ঘিরে সে খেলছে;
চারপাশে আলো-প্রভা-প্রতিসরণ
আজ রাত্তিরে ঘুমাবো না কসম
তুমি এসো
পিয়ানোয় বাজাবো মিলেনের গান
সে সুরে অন্ধকার ভেঙে আসবে একটি পাখি;
তারপাশে আলো নিয়ে ধ্যানে যাবে একটি জিওল মাছ

 বৃষ্টির র্পালারে

উপশহরের ঝরাপাতা গাছটির ডালবেয়ে
তোমার দোয়ারে দাঁড়াল সূর্য
তুমিও তার হাত ধরে চলে গেলে সূর্যাস্তে

সবে মাত্র ছেড়ে যাওয়া রেল গাড়িটির ধুলো
যখন ভীড় জমালো সূর্য স্টেশনে
এমন সময় রোজভিও হোটেলে তোমাকে দেখলাম
স্টুডিবেকারে বাড়ি ফিরছো;
তোমার সোনালী রঙের চোখ
যেন
চুরি হয়ে গেছে আমাতে

জিন্দাবাজার, রেলগেট ঘুরে
তোমার বি ব্লকের বাড়িতে খোঁজলাম
এখানে শুকনা পাতার মতো পড়ে আছে পদছাপ

তোমাকে না পেয়ে যেই দাঁড়িয়েছি বাস-স্টেশনে
রংধনু শাড়ি পড়ে তুমি নেমে আসছো বৃষ্টির পার্লার থেকে

তারপর আমি আর বাড়ি যেতে পারি না
আমার আর বাড়ি ফেরা হয় না কোন দিন

ধানফুল

তোমার খোঁপার জন্য আত্মহত্যার গলা বাড়িয়ে দিলো পেঁকে যাওয়া ধানফুল;

‍কিষাণীর পা যখন মুদ্রাময় আদিমতার খেলা খেলে- তোমার খোঁপা ভরে ওঠে

বোশেখী আমেজে। তৈলানলের সমীরণে; রেশমী শাড়ীর আঁচলের মতো সরু-চিকণ

অই চাঁদ, তোমার উনুন থেকে ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়। জোনাকের অধিকারে নিদ্রামগ্ন

সমগ্র পৃথীবীতে জেগে আছি আমি এবং তুমি। জারুল ডালে ঝুলে আছে চাঁদ

চাঁদ ছুঁয়ে ঝরছে বৃষ্টি; বৃষ্টি ধুয়ে নামছে সমূহ নিরবতা- পৃথিবী প্রবাহে জাগছে

সূর্য এবং তদসংশ্লিষ্ট কবিতা।

ওপনিবেশ

জেসমিন--
তুমি লুকিয়ে নাও তোমার কাজল
কপালের টিপ
হাতের চুড়ি

তোমার মেঘরাঙা কাজল হত্যা করেছে বালকের মন
তোমার টিপ হৃদয়কে করেছে শশ্মান ভূমি
তোমার চুড়ি বোমারু-বিমানের মতো বাজে

জেসমিন--
প্রেমের প্রলোভন দেখিয়ো না: গোরখোদক মেয়ে
তোমার দেহের খাদক আমি নই
জন্মের আগেই দাফন করেছো প্রেম

ব্রোথেলের বারান্দায় প্রেমকে করেছো বানিজ্য
শুধু
মন চেয়েছি কেবল চাই নি দেহের ওপনিবেশ

জেসমিন--
তুমিও স্মৃতির মতো নিকটে আসো
আর
গাছ দেখে বুঝে নাও পাখির ভালোবাসা


জাকারিয়া প্রীণন
জন্ম: ১০/১১/১৯৯৮
ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায়। 
শামসেত তাবরেজী এর দশটি কবিতা

শামসেত তাবরেজী এর দশটি কবিতা


অনেকদিন পর আম্মাকে

কাঁপা কাঁপা ফুলগুলি-  তাদের স্বর
আপাতত হয়ে আছে বোধিশ্বর

যেহেতু কাঙ্খ্যা করে চেয়েছি ওদের
অভিকর্ষ টানে ওরা মজেওছে ঢের।
ভাঁজের ভিতর ভাঁজে বর্ণালি ঢেউ
খুশ দিলে দেখা যাচ্ছে আম্মাকেও।
এক ক্ষণকালে তারা সূর্য পরিধি
ঘুরে এসে আমাকেই বানিয়েছে নিধি।
আমি তো অবাক! হল বন্ধ জবান,
ওরা মুখে ভাষা দিয়ে রাখল প্রমাণ
মিছেমিছি নয় এই কেঁপে-কেঁপে ওঠা
আমার জন্যেই নাকি বিদগ্ধ ফোটা!
ক্রমশ অবাক হই শুনে বহু সূর
এক সঙ্গে কলেমা পড়ে, মদিনা-সুদূর
সুরভিত মালা হয়ে, গায়ত্রী গরিমা
ক্ষণে ক্ষণে অতিক্রমে’ রেখায়িত সীমা।

স্বরগুলি কাঁপা কাঁপা বিবর্ত ফুল
বাগানে বসে থাকা- আম্মা-  পারুল!

নুসরাতের জন্য

বলল বাতাস, ‘নুসরাত’, আমি নিরুত্তর।
হত্যাকারীর দেশে বসে চিবাই পান,
হাড় সাজিয়ে বানাচ্ছি প্রতিষ্ঠান,
এনেছি ডেকে ইহুদি কজন ওস্তাগর।

এ্যাই, তোমরা শরীর খোলো-  ব্যক্তিবাদ
চালু হচ্ছে ধর্ষে আপন আত্মজা,
দিল্লি থেকে আনিয়েছি মত্ত ষাঁড়
ইলেকট্রিকের তারে বসে বলল চাঁদ।

অশ্বডিম্ব আগলে রাখেন কয় নফর
মিষ্টদ্রব্য বিলি করেন মরণচাঁদ,
এটাই খাঁটি বিয়ের ধর্ম, ও নুসরাত,
সিরাজুদ্দৌলা নিজেই মীরজাফর।

বিকার

কি তুমি ভাবো? উৎপন্ন দধির
কণা ও কণাদ কেন নয় স্থির?
কেন ঘূর্ণি এ ঘৃণার পাঁক দেওয়া ব্যথা
সইতে হচ্ছে? তুমিই সুচেতা,
যদিও শব্দমূলে আর কিছু রয়,
ফুটন্ত ফোনেমের  মুহূর্ত-প্রলয়।
তুমি ভাবো বেশ্যা প্রণীত রাত
পবিত্র নয়? উরুস্তম্ভে দাঁত
বসালেই ধরে নিতে হবে হয়ে গেল পাপ?
পূণ্যও কি দ্যাখো নাই বিলাপ-
মাত্র? আদি ও অনাদি একাকার
হয়ে হয়ে গুলঞ্চলতায় ত্রিমুখী বিকার!
প্রেম, তুমি ভাবো চক্রাকারে ঘুরে
তমোঘ্ন তিথিতে থামবে? গত পরশুরে
বর্তমান বানিয়ে ফেনিল তরঙ্গয়
মেঘমধু ঘষে ঘষে দেহটার করবে বিলয়!

বৈকালিকী

বইয়ের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে
মোড়া টেনে বারান্দায় বসল বিকেল,
আইভিলতার ছায়া মদ-রং রোদ্দুরে মেশে
এক চিলতে হাসি যেন হঠাৎ গড়ানো মার্বেল।

গত বৎসর শীতরাত্রি পড়ে গেছে মনে?
একটি হরিণ হিয়া হারিয়ে কাঁদছিল একা
চন্দন গন্ধ গম্ভীর বিধুর কাননে,
কিন্তু তাতে হাসি কেন? কি বলে ফেকাহ্-

শাস্ত্রগুলি এইসব   স্ববিরোধী ঘটনা ঘটলে?
তোমাকে বুঝে নি কেউ-   উগ্রবাদী সভা,
বুঝ হতে হতে মেদমত্ত গল্প রটলে
তুমিও খোঁপায় পরো নি সামাজিক জবা।

গোপন ঈর্ষার আগুনে তাহলে তুমিও  পুড়ো?
ক্লান্তিকর অধ্যাপকের কাছ থেকে ছোট হয়ে আসো?
তাও কি প্রণয়ই নয়? জ্ঞান থাকে গৃহস্থ পশুরো,
এই কি কার্যকারণ যার জন্য মিহি করে হাসো!

প্রতিদিন নয়, আজ হেসে উঠল প্রচ্ছদ সরিয়ে
ইয়োলো অকার ছাওয়া সংক্ষিপ্ত শান্ত বিকেল,
কিছু আনন্দ-বা থাকে দুঃখের অতীত জড়িয়ে
 ভেবেছ কি সব কথা বলেছে বুড়ো বাইবেল?

সংসার এমনই-  পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিটা বলে
অসাচ্চা বাঁচাই সার মা-  আসলে তো পুড়ছ অনলে!

কেনা শেখা

দিন, দুটো টাকা দিন
কিছু কিনে খাই

আপনিও তো কেনেন, কেনেন না?

পরনারীর জন্যে সুবাসিত জাঙ্গিয়া
চর্বিহীন চাঁদের অমেয় সম্ভার

কালও দেখেছি  স্বপ্নজঙ্গলের ভিতর একটা হরিণের খাল খুলছেন আপনি
একটা প্রাকৃতিক পোলকা-ডট জ্যাকেট যে তার চাইই চাই
যা থেকে মৃগনাভির খোশবু বেরোবে
জাগিয়ে দেবে আপনার ক্ষমতাধর লোহা

প্রাণপণে চেষ্টা করেছি আরো ঘুমাতে যেন আমার দৃশ্যপর্দার বাইরে
দিনটা কেটে যায় দ্রুত আর নামে রাত্রি আবার অকাল ঘুমের
কিন্তু ঘুমটা চটকে দিয়ে গেল ও
ও মানে! আমি ভুলে গেছি তাও
না খেতে খেতে।

এত গরিবের বাচ্চা আমি ক্ষুধার আগুন লকলকিয়ে ওঠে সূর্যটা উঠতেই

দিন, দুটো টাকা দিন
আপনিও তো কেনেন, কেনেন না?
কবুতরের বুক কেনেন আপনি পারী থেকে
আর খোদ মার্কিন দেশ থেকে কেনেন অধিক আলট্রাথিন কনডম

কালই তো দেখলাম, কাল না পরশু
আপনি একটা বউ কিনলেন প্রথিতযশা নাট্যকারের কাছ থেকে

আমি তো কিছু মনে করি নাই তাতে?

বিশ্ববিতানে থুতু ফেলা হোমোস্যাপিয়ান আমরা
কিছুই যদি না কিনি কেমন দেখায় না?

দিন, দুটো টাকা দিন
কিছু কিনে খাই
খেয়ে কিনি আপনার মতাদর্শটাই

নামপদী ছলনা

ভোর কাটল পার্পলতায়
 রাত কাটল নীলে,
পর-স্ব রং নীরবতায়
 স্তব্ধ আঁচিলে।

একটু পর-  মানুষ হল লাশ।

প্রাচীর উঠল শূন্যজুড়ে
 আকাশ সঙ্কুচিত,
আজদাহাটা দাঁড়িয়ে দূরে
 ভ্যাবলা অসংস্কৃত।

চৈত্রে এ কি নতুন সর্বনাশ!

সাধের লাউয়ের ডুগডুগিতে
 শুধুই প্রবঞ্চনা,
ব্যক্তিসংঘে, জাতীয় গীতে
 নামপদী ছলনা।

এসব দেখে কবি খাচ্ছেন সিন্থেটিকের ঘাস!

(আবার)

ভোর কাটল...

সন্দেহবাদ

নিত্য সন্দেহ মনে
যমুনা কি সত্যিই বহে?
কারই বা দুধভরা স্তনে
ঈশ্বর একা একা দহে!

মাটিতে পড়ে থাকা ফুলে
কার স্পর্শ বীজময়?
কে তাকে চড়িয়েছে শূলে,
কার রক্তে হাত ধোয়?

বই খুলি, উত্তর নাই,
আর-কোথা যমুনা বিলীন,
পেকে পচে যায় জলপাই
সমগ্র শূন্যের অধীন।

সাধ

আয়ুষ্কাল ছাড়িয়ে গিয়ে উড়তে গেছে সারস
আবার-  আকাশ সীমা লঙ্ঘনের দায় নিতেও রাজি
জানা যায় নি কোথায় পেল এমন দুঃসাহস
নাকি-   এও হবে নতুন কোন তত্ত্বীয় কারসাজি!

আর, আমি বসুন্ধরা থেকে গ্রিনরোডে আসতে গিয়েই হাঁপাই

ভুলে গেছি আমারও ছিল ঝালর দেওয়া ডানা
শুধু-  আবছা দেখতে পেতাম একজোড়া কৈতর
নিকটতম দূরত্বে দেখেছি মটরদানা
কঁকিয়ে উঠে হতে চাইত শুধুই নৈশর

এসব স্নিগ্ধ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি নিতে আমি এখন হাফ-আখড়াই গাই

সাধ্য নাই, সাধ রয়েছে যুদ্ধে যাব ফের
মধ্যমনি যদিও তুমি হারানো প্রাচ্যের!

স্বাধীনতার উড়ালহীন পাখির গান

পাখির আদল নিয়ে বসে আছে পাখি
কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই, নাই তাকাতাকি,
কম্পুটার পর্দার ঝালরের তলা থেকে আসা
উজবুক লোকদের আহ্লাদের নানাবিধ ভাষা
তর্জমা করে করে ব্যথা হয় চম্পক আঙুল
আর সব ঘাড়-মোটাদের যাবতীয় বানানের ভুল
শুধরে দিতে দিতে মনে পড়ে তার
কোথায় সে পেল গুপ্ত ডানার বাহার?
অথচ উড়াল নাই, আকাশ-গঙ্গার নক্ষত্র-মাছ
ঝিলিক মারে নি কোনদিন, গ্রহের পিশাচ-
গুলি নাস্তানাবুদ রাখে স্বার্থ শিবিরে,
ঠাণ্ডা কফির মধ্যে নুলা এক পোকা সাঁতরায়
হয়ত ভাবছে,  বাঁচতে চায় না এই পোড়া দেশে
হয়ত মৃত্যুর ধারনা পেয়ে গেছে ও,
এসব তো এখন প্রত্যহের চ্যানেলিয়া-শো।
পাখি দ্যাখে তাই এক ফাঁকে ঘাড় ব্যথা ক’রে
এমন কি হবে বুঝি কেউ আছে ম’রে
অতলান্ত গহ্বরে তার, তাও-  সে কত কত কাল,
সেই থেকে তার আর হয় নাই উড়াল!
কবিরা মস্করা করে: মুক্তি হবে তোর
সে দিন-  যে দিন খুঁড়বি নিজ হাতে গোর।
পাখি তবু ভ্রূক্ষেপ করে না, পানপাতা-হাতে
লিখে যায় বাকীদের বেতন বৃদ্ধি, প্রমোশন যাতে
দ্রুত হয় কেননা তাদের ডানা আরো
শক্ত না হলে পার্টি হবে না জম্পেশ, রাত্রির গাঢ়
শাড়িটা হবে না কেনা, পাখিটার সেই ভাবনা নেই
একটু শান্তি হত দুদণ্ড ডানা দুটি মেলতে পারলেই।
একবার ভাবে শুধু কেন পেল পাখির আদল?
কি অভিপ্রায় নিঃসঙ্গ প্রভুর নাকি অন্য কোন ছল
প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি? এই পাখিটাকে
সর্বস্বান্ত করে ফেলে তাকে
রতিশূন্য করতে চান তিনি নিজের সৃজন?
পাখির আদলে পাখি শেষ ক্লান্তি করে উচ্চারণ,
ভাষাহীন ডানাহীন বিদ্যুতিন সভায়
মালিকও ঘাড়ের কাছে এসে সে সুযোগে কটুগন্ধ নিশ্বাস ছড়ায়!

বিভ্রম

হয়ত আমারই ভুল, ও ছিল না উজানের ঢেউয়ে
রূপালি রূপান্তর মৎসোজ্জ্বল উঠে ছিল ধ্বনি-বাঁধা খেউয়ে।

আসলে তাতো না-  গরাসিনে কেউ দেখে নাই
চুপিসাড়ে নেমে গিয়েছিল সেই রাতে, যেদিন তেলাই,

তারপর দুদশটা জঙ্গল পেড়িয়ে এই মজা-খালে
জালপাতা ছিল বলে রেহাই পেয়েছে শেষকালে।

এও তো আমার ভুল, নাম থেকে দূর্নাম অবধি,
ও আসলে কিছুই ছিল না-  না দুধ না পাতা-দধি।

বস্তাপচা যত গল্প পড়েছি এ দেশে,  শেষ পরিচ্ছেদ তার
সাকার আরতি জ্বেলে হয়ে  ছিল আমার আহার।

ভুল বটে ভুলই, গাঁয়ের লোকজন বলে, যা ঘুমিয়ে পড়,
টের পেয়েছি রক্তে, ভুল থেকে ভাত হচ্ছে নরকপ্রহর।

কবিতা দেবে না ধরা, এ তো আর শোভাদি না যে
আঁচলের খুঁট মুখে দ্রুত-  লুকাবেন কাজে।

এ ভ্রম বিশ্বাস নিয়ে নামি যদি কবরে তোমার,
বলবে পরস্ত্রী করিস? তুই কি নোস্ তোরি মা-র!

যা সেখানে-  লাউডগা বাঁক খেয়ে সূর্যের দিকে,
সেই একই বিভ্রমে আমি  এখন দুধ দিচ্ছি মাহিকে!



শামসেত তাবরেজী
জন্ম ১৯৬১ সালের ৫ এপ্রিল, ঢাকায়। 
লেখা শুরু করেছেন সেই ক্লাশ ফোর-এ পড়বার সময় তদানিন্তন ‘মুকুলের মহফিল’ দিয়ে। প্রথম বই ‘উদ্বাস্তু চিরকুট’, তারপর বেরয়: আবাগাবা, আম্রকাননে মাভৈ: কলের গান, হে অনেক ভাতের হোটেল (নির্বাচিত কবিতা), অবিরাম অরেঞ্জ। সম্পাদনা বলতে, বেনজামিন মলয়েজ- এর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ৩ ঘন্টার মধ্যে একটি কবিতা ফোল্ডার প্রকাশ করেন প্রয়াত বন্ধু কবি শ্যামল সেনকে সঙ্গে নিয়ে। মাও জে দং (মাওসেতুঙ), রাসুল ঝা প্রমুখের কয়েকটি কবিতা তর্জমা করেছিলেন।
এক গুচ্ছ কবিতা • শার্ল বোদলেয়ার • ভাষান্তর: বুদ্ধদেব বসু

এক গুচ্ছ কবিতা • শার্ল বোদলেয়ার • ভাষান্তর: বুদ্ধদেব বসু

সে-রাতে ছিলাম…

সে-রাতে ছিলাম কদাকার ইহুদিনীর পাশে,
পাশাপাশি দুটো মৃতদেহ যেন এ ওকে টানে ;
ব্যর্থ বাসনা ;পণ্য দেহের সন্নিধানে
সে- বিষাদময়ী রূপসী আমার স্বপ্নে ভাসে।

মনে প’ড়ে গেলো সহজাত রাজভঙ্গি তার,
দৃপ্তললিতে সে-কটাক্ষের সরঞ্জাম,
গন্ধমদির মুকুটের মত অলকদাম-
যার স্মৃতি আনে প্রণয়ের পুনরঙ্গীকার।

ও-বরতনুতে চুম্বনরাশি দিতাম ঢেলে,
শীতল পা থেকে কাল চুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে গভীর সোহাগের মণিরত্ন,-
বিনা চেষ্টায় যদি এক ফোঁটা অশ্রু ফেলে
কোনো সন্ধ্যায়- নিষ্ঠুরতমা হে রূপবতী!-
ম্লান ক’রে দিতে  ঠাণ্ডা চোখের তীব্র জ্যোতি।

শত্রু

আমার যৌবন ছিল শুধু এক আঁধার তুফান,
তির্যক সূর্যেরা যাকে কদাচিৎ করেছে উজ্জ্বল;
বজ্র আর বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত হ’য়ে আমার বাগান
ফলিয়েছে কেবল একটি-দুটি রক্তরঙা ফল।

এদিকে,মনের প্রান্তে,হেমন্ত যে আগত এখনই,
শাবল,কোদাল নিয়ে ব্যস্ত হ’তে হবে এইবার-
তবে যদি রক্ষা পায় ধারাজ্বলে ভেসে-যাওয়া জমি,
ফাটা কবরের মতো খানাখন্দ খুলে আছে যার।

যে-নূতন ফুলদলে স্বপ্ন আমি নিরন্তর দেখি,
সৈকতের মতো সিক্ত এ-মাটিতে, তারা কখনো কি
পাবে সে আলোকপথ্য, যা তাদের শক্তির সঞ্চয়?
-আক্ষেপ,আক্ষেপ শুধু! সময়ের খাদ্য এ-জীবন,

যে-গুপ্ত শত্রুর দাঁতে আমাদের জীবনের ক্ষয়
বাড়ায় বিক্রম তার আমাদেরই রক্তের তর্পণ।

পূর্বজন্ম

সরল স্তম্ভের সারি অলিন্দের বিরাট নির্ভর,
রঞ্জিত সিন্ধুর সূর্যে অন্তহীন রঙিন শিখায়,
সন্ধ্যারাগে কঠিন গুহার মতো-দৃপ্ত, অতিকায়-
আমি সেই মায়ালোকে কাটিয়েছি হাজার বৎসর।

আকাশের চিত্রাবলি তরঙ্গের বেগে ওঠে দুলে,
সে-গূঢ় গম্ভীর ছন্দে মিশে যায় অচিরে আমার
নয়নে প্রতিফলিত  সূর্যাস্তের বর্ণের সম্ভার
পরম  ক্ষমতাময় সংগীতের কলতান তুলে।

সেখানে পেয়েছি আমি ইন্দ্রিয়ের প্রশান্ত বিলাস,
নীলিমার কেন্দ্রে ব’সে, চারদিকে উজ্জ্বলতা, গতি,
আর নগ্ন দাসীদের গন্ধভারে মন্থর প্রণতি-
যাদের অনন্য ধ্যান, অবিরল সেবার প্রয়াস,

তালপত্র সঞ্চালনে,সে- গোপন দুঃখের উদ্ধার
যার তাপে তিলে-তিলে অবসন্ন হৃদয় আমার।

সিন্ধু  ও মানব

স্বাধীন মানব, র’বে চিরকাল সিন্ধুর প্রেমিক!
তোমার দর্পণ সিন্ধু; অন্তহীন আন্দোলনে তার
প্রতিবিম্ব দ্যাখো তুমি তরঙ্গিত আপন আত্মার,
তার তিক্ত, তলহীন পাতালের তুমিও শরিক।

ঝাঁপ দিতে ভালোবাসো আবক্ষ আপন রূপায়ণে;
তার চোখে, বাহুতে তোমার অঙ্গ আলিঙ্গনে মাতে,
হৃৎপিন্ড আপন ছন্দ ভুলে গিয়ে, নিজেকে মেলাতে
চায় মাঝে মাঝে তার দুঃশাসন বর্বর স্বননে।

উভয়ে অপরিমাণ,অন্ধকার,সতর্ক তোমরা ;
মানব,কেউ কি তল খুঁজে পায় তোমার গহ্বরে ?
হে সিন্ধু, কেউ কি জানে কত রত্ন তোমার অন্তরে ?
উভয়ে অসূয়াপন্ন দাও নিজ রহস্যে পাহারা !

আর ইতিমধ্যে হয় অপগত অযুত বৎসর,
নির্দয়,শোচনাহীন,  তবু দ্বন্দ্ব চালাও দু-জনে,
এত সুখ তোমাদের হত্যাকাণ্ডে এবং মরণে,
চিরন্তন দুই মল্ল, ক্ষমাহীন দুই সহোদর।

নরকে ডন জুয়ান

যেদিন ডন জুয়ান,কারনেরে কড়ি গুনে দিতে
নেমে এলো পাতালসলিলে, এক গম্ভীর ভিক্ষুক
আন্তিস্থিনীসের  মত দৃপ্ত চোখে, বলিষ্ঠ বাহুতে
দাঁড়ের কতৃত্ব নিয়ে হ’লো প্রতিহিংসায় উৎসুক ।

ঘোর কালো আকাশে কাৎরে ওঠে মেয়েরা উত্তাস,
ছিন্নভিন্ন গাত্রবাস, উন্মোচিত স্তনগুলি  ঝোলা ;
বিরাট মিছিলে চলে যূপকাষ্ঠে বধ্য পশুপাল,
দীর্ঘায়িত ক্রন্দন পশ্চাতে টানে, ফুরোয় না পালা।

স্‌গানারেল্লে, দেঁতো হেসে , খেসারৎ চায় ফিরে পেতে;
এদিকে ডন লুইস –মৃত যারা ঘোরে এলোমেলো,
তাদের দেখিয়ে দেন, অঙ্গুলির কম্পিত সংকেতে,
যে-পাপিষ্ঠ পুত্র তাঁর শুভ্র কেশে ব্যঙ্গ করেছিলো ।

একদা প্রেমিক,আর তার পরে প্রতারক পতি
যে ছিলো, গা ঘেঁষে তার সাধ্বী, রোগা এলভিরা ঘনায়,
যেন ফের দাবী করে, যে-পরম হাসির আরতি
মন্ত্রঃপূত প্রভাতেরে মেখেছিল কোমল সোনায়।

বর্মধারী, ঋজু এক শিলাময় বিরাট পুরুষ
হাল চেপে ধ’রে চলে কালো জল দুই দিকে চিরে ;
কিন্তু বীর, অসিতে হেলান দিয়ে, নিস্তব্ধ, বেহুঁশ,
বিদীর্ণ জলের রেখা দ্যাখে শুধু, তাকায় না ফিরে।

আলোকস্তম্ভ

রুবেন্স, সুখের শয্যা, তনুমাংসে স্নিগ্ধ উপাধান,
আলস্যের কুঞ্জবন, বিস্মৃতির মধুর নির্ঝর,
প্রেম নেই আছে শুধু অবিরাম আন্দোলিত প্রাণ-
যেমন আকাশে হাওয়া, কিংবা মহাসাগরে, সাগর ;

দা ভিঞ্চি, দর্পণ এক,অন্ধকার,গভীর আকাশ,
ছায়া ফেলে গ্লেসিয়ার, দিগন্তরে পাইনের বন,
সেখানে দেবদূতের অপরূপ হাসির উদ্ভাস
সংকেতে জানিয়ে দেয় অন্তরালে তাদের ভবন ;

বিষণ্ন হাসপাতাল, রেমব্রান্ট, দীর্ঘশ্বাসে ভরা,
অতিকায় ক্রুশকাষ্ঠে একমাত্র অলংকার ধরে,
বিষ্ঠায় উদ্গত কান্না,প্রার্থনার সজল পসরা-
একটি শীতের রশ্মি অকস্মাৎ তাকে দীর্ণ করে ;

বিস্তীর্ণ অস্পষ্ট দেশ, অনির্ণেয় : মিকেলাঞ্জেলো :
খ্রিষ্ট আর অসুর সেখানে মেশে, প্রখর বিক্রমে
উদ্ধত প্রেতের দল ভ’রে দেয় গোধূলির আলো,
ছিন্ন করে শবাচ্ছাদ নখরের ভীষণ উদ্যমে ;

মল্লের আরক্ত রোষ, কিন্নরের উল্লোল নয়ন,
চোর,গুণ্ডা, পাণ্ডুরোগী, মদস্ফীত হৃদয় বিরাট-
এদেরই অন্তর ছেনে করেছেন সৌন্দর্যচয়ন
প্যুজে সব কয়েদির মন:ক্ষুন্ন, বিধুর সম্রাট ;

ওয়াতো, মদনোৎসব ; খ্যাতিমান হৃদয় কত না
আলয় হারিয়ে পথ দগ্ধ হয় পতঙ্গ-প্রথায়,
চটুল, মোহন দৃশ্যে উদ্ভাসিত দীপের দ্যোতনা
ঘূর্ণিত নৃত্যেরে আরও গূঢ়তার আবেশে মাতায় ;
দারুণ দু:স্বপ্ন, গইয়া, অজানার নিপট সঞ্চয়,
ভ্রুণমাংসে অন্নপাক দাকিনীর পূজার থালায়,
দর্পণে নিবদ্ধ বৃদ্ধা, বালিকার নগ্ন অভিনয়
পা তুলে, মোজার বন্ধে, পিশাচের লালসা  জ্বালায় ;

ভ্রষ্ট দেবতার বাসা, দ্যালাক্রোয়া, শোণিতের হ্রদ,
চিরশ্যাম তরুশ্রেণী তাকে রাখে ছায়াচ্ছন্ন ক’রে,
অসুখী আকাশ থেকে ঝ’রে পড়ে ধ্বনির সম্পদ
অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসে, হ্বেবারের অদ্ভুত ঝংকারে ।

এই সব অভিশাপ, অবিশ্বাস, নারকী শপথ,
পুলক, চীৎকার,কান্না,অনুতাপ,উন্মাদ বন্দনা,
পার হ’য়ে প্রতিধ্বনি-পরিকীর্ণ অন্তহীন পথ
এনে দেয় মর প্রাণে আফিমের স্বর্গীয় সান্ত্বনা !

হাজার শাস্ত্রীয় কন্ঠে এই বাণী আবার উত্তাল,
হাজার তূর্যের মুখে পুনরুক্ত এক অভিযান,
হাজার দুর্গের ‘পরে অনির্বাণ প্রোজ্জ্বল মশাল,
বিরাট অরণ্যে লুপ্ত শিকারির উদাত্ত আহ্বান !

আর কী প্রমাণ আছে? ভগবান,এই তো পরম,
এ-ই তো নির্ভুল সাক্ষ্য আমাদের দীপ্ত মহিমার,
এই যে আকুল অশ্রু যুগে-যুগে করে পরিশ্রম
অবশেষে লীন হ’তে অসীমের সৈকতে তোমার !

দুরদৃষ্ট

সিসিফাস, তোর সাহসের সর্বস্ব
হার মানে এই বিরাট বোঝার কাছে!
একান্ত মনে যতই লাগি না কাজে
শিল্প বিশাল, আয়ু অতিশয় হ্রস্ব ।

বিখ্যাত স্মৃতিফলকের দূরবর্তী
পরিত্যক্ত কবর আমাকে ডাকে,
শবযাত্রায়, চাপা শব্দের ঢাকে,
তাল দিয়ে চলে হৃৎস্পন্দের আর্তি।

-তথাপি আমার তন্দ্রাবিলীন খনি
বুকে ঢেকে রাখে কত বিস্মৃত মণি,

খন্তা, কোদাল কখনো পায় না জানতে;
এবং অনেক ফুল্ল কুসুমদল
গোপনে বিলায় খেদময় পরিমল
রিক্ত,গভীর নির্জনতার প্রান্তে।

আত্মস্থতা

হে আমার দুঃখ, তুমি প্রাজ্ঞ হও, স্থৈর্য নাও শিখে।
চেয়েছিলে সন্ধারে;আসন্ন সে যে, এই তো আগতঃ
ধুমল মণ্ডল এক নগরীকে ক্রমে দেয় ঢেকে,
শান্ত কারো মন, আর অন্য কেউ দুশ্চিন্তায় নত।

এখনই ছুটুক ওরা- ক্ষমাহীন জল্লাদ,প্রমোদ,
চালায় চাবুক মেরে যে-কুৎসিত, ক্লিন্ন জনগণে,
ফুর্তির গোলামি ক’রে অনুতাপে তার প্রতিশোধ
দিক তারা ;- দুঃখ,এসো,হাত রাখো হাতে।   চলো দুইজনে
যাই বহুদূরে।  চেয়ে দ্যাখো, আকাশের বারান্দায়
নিঃশেষ বৎসর সব ঝুঁকে আছে প্রাচীন সজ্জায়;

দন্তময় মনস্তাপ জল থেকে ধীরে তোলে মাথা;
এদিকে মুমূর্ষু সূর্য শয্যা নেয় মেঘের তোরণে;
আর, যেন পূর্বাকাশে দীর্ঘায়িত শবাচ্ছাদ পাতা,
সেইমতো, শোনো প্রিয়, রাত্রি নামে মধুর চরণে।

অনুকম্পায়ী ত্রাস

অস্থির, তোর ভবিতব্যের মতো,
এবং ভয়াল, পাংশু গগন-তল
তোর ও শুন্যে নামায় অনবরত
সে কোন চিন্তা? লম্পট, কথা বল!
-তৃষ্ণা আমার তৃপ্তি আজো না শেখে,
অনিশ্চয়ের আঁধারেই আনাগোনা,
বঞ্চিত হয়ে লাতিন স্বর্গ থেকে
ওভিদের মতো কোনদিন কাঁদবো না।

ছিন্ন আকাশে সৈকত অনুমান,
তোমাতেই দেখি আমার অহংকার ;
তোমার মেঘের বিষণ্ণতার ভার
সে যেন আমারই স্বপ্নের শবযান,
এবং তোমার রশ্মিতে তারই ভাষা
যে- নরকে আমি বেঁধেছি সুখের ভাষা।

শয়তান স্তোত্র

হে তুমি, দেবদূত, জ্ঞানীর শিরোমণি, রূপের নেই যার তুলনা,
দেবতা, যার ভাগে জোটে না বন্দনা, নিয়তি দেয় শুধু ছলনা,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
রাজ্যহারাদের হে যুবরাজ, তুমি সয়েছো অন্যায় অপমান,
এবং হেরে গিয়ে আবার দাঁড়িয়েছো নতুন তেজে আরও বলীয়ান

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে- তুমি রসাতলে বিরাজো মহীপাল, কিছুই নেই যার অজানা,
বৈদ্য পরিচিত, জীবন-দুর্ভোগে আনো আরোগ্যের নিশানা,
মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে- তুমি সমতায় বিলাও বর, একই রতির লিপ্সায় পেতে ফাঁদ,
অধম চণ্ডাল, কুষ্ঠরোগীকেও ক্ষণিক স্বর্গের আস্বাদ,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
মরণ,যে তোমার বৃদ্ধা প্রণয়িনী, অথচ ক্ষমতায় দুর্জয়,
জন্ম দিলে তার গর্ভে আশা, যার মোহন মূঢ়তার নেই ক্ষয়!
মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যখন ফাঁসিকাঠ তৈরি, জমে ভিড়, যে-তুমি আসামির দৃষ্টি,
শান্ত নির্ভয়ে জ্বালিয়ে, অভিশাপ করো সে-জনতায় বৃষ্টি,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
ঈর্ষাপরায়ণ ব্যাপ্ত বসুধায়, যে-তুমি জানো সব সন্ধান,
রত্নমণি কোন গহন অগোচরে লুকিয়ে রেখেছেন ভগবান,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
দীপ্ত চোখ মেলে যে-তুমি দেখে নাও গভীর সেই সব ভাণ্ডার,
সুপ্ত রয় যেথা কবরে সমাহিত ধাতুর বহুরূপী সম্ভার,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
এড়িয়ে গহ্বর, বিশাল হাতে তুমি তাদেরও নিয়ে যাও চালিয়ে
স্বপ্নে, ঘুমে যারা ছাদের কার্নিশে বেড়াতে চ’লে আসে পালিয়ে,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে-তুমি মাতালের অবশ বুড়ো হাড় নম্য করো জাদুবিদ্যায়
যখন রাজপথে ঘোড়ার খুর তাকে মাড়িয়ে দিয়ে বুঝি চ’লে যায়-

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
মানুষ ক্ষীণ আর  দুঃখী ব’লে, তাকে পরম সান্ত্বনা জানাতে
লবণ গন্ধক মিশিয়ে কৌশলে শেখালে গোলাগুলি বানাতে,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে তুমি বেছে নাও কুবের যত আছে করুণাহীন আর ঘৃণ্য,
ললাটে এঁকে দিতে , হে কূট সহযোগী, তোমার তিলকের চিহ্ন

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে তুমি মেয়েদের নয়ন আর মন এমন ক’রে পারো জাগাতে,
নিছক জঞ্জালে বিলিয়ে ভালোবাসা, আরতি করে তারা আঘাতে-

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
বাস্তুহারাদের যষ্টি তুমি, আর আবিষ্কারকের দীপালোক,
ফাঁসিতে ঝোলে  ষড়যন্ত্রী যারা, হয় তোমারই মন্ত্রে বীতশোক,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
সকলে তারা মানে তোমাকে পিতা ব’লে, যাদের স্বর্গের উদ্যান
অন্ধ আক্রোশে পৃথিবী পার ক’রে দিলেন আদি পিতা ভগবান,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!

প্রার্থনা

ধন্য হোক নাম তোমার, শয়তান, ধন্য আকাশের শিখরে
যেখানে ছিলে তুমি রাজার মতো, আর এখন নরকের বিবরে
স্বপ্ন দ্যাখো নিঃশব্দে, পরাজিত, ধন্য সেখানেও হোক নাম!
আমার আত্মাকে এ-বর দাও, যেন সেখানে হয় তার বিশ্রাম,

যেখানে জ্ঞানতরু তোমাকে ছায়া দেয় এবং উন্নত,গম্ভীর
তোমার ভালে আমি ছড়াই ডালপালা নতুন যেন এক মন্দির।

স্তোত্র

প্রিয়তমা, সুন্দরীতমারে,
যে আমার উজ্জ্বল উদ্ধার-
অমৃতের দিব্য প্রতিমারে,
অমৃতেরে করি নমস্কার।

বাতাসের সত্তার লবণে
বাঁচায় সে জীবন আমার,
তৃপ্তিহীন আত্মার গহনে
গন্ধ ঢালে চিরন্তনতার।

শাশ্বত সৌরভ মাখে হাওয়া
কৌটো থেকে, কোন প্রিয় ঘরে;
সংগোপনে, কোনো ভুলে-যাওয়া
ধূপদানি জ্বলে রাত্রি ভ’রে।

কেমনে, অম্লেয় প্রেম, ধরি
ভাষায় তোমাকে অবিকার,
এক কণা অদৃশ্য কস্তূরী
অসীমের গহ্বরে আমার।

সে-উত্তমা,সুন্দরীতমারে,
স্বাস্থ্য আর আনন্দ আমার-
অমৃতের দিব্য প্রতিমারে,
অমৃতেরে করি নমস্কার।

প্যাঁচারা

ইউ গাছের কালো ছায়ার খাপে
কোন বিদেশের দেবতা, প্যাঁচার দল,
ঘুরিয়ে লাল চক্ষু অবিরল
ফুলকি ছড়ায়। তারা কেবল ভাবে।

নিথর তারা অসাড় হ’য়ে কাটায়,
যতক্ষণে বিষণ্ণ সেই যাম
হারিয়ে দিয়ে রবির সংগ্রাম
অন্ধকারের রাজত্ব না রটায়।

জ্ঞানীর চোখ, তা দেখে যায় খুলে,
হাতের কাছে যা আছে নেয় তুলে,
থামায় গতি, অবুঝ আন্দোলন;
হায় মানুষ, ছায়ার মোহে পাগল,
শাস্তি তার এ-ই তো চিরন্তন-
কেবল চায় বদল, বাসা-বদল!


ভ্রমণ
ম্যাক্সিম দ্যু কাঁ-কে



পঞ্জিকা,রঙিন ছবি ,বালকের হৃদয়লুন্ঠন,
দেখায় বিশ্বেরে তার অতিকায় ক্ষুধার সমান;
যে বিশ্ব বিরাট হ’য়ে দীপ্ত করে সন্ধ্যার লন্ঠন,
স্মরণের দৃষ্টিকোণে কত ক্ষুদ্র তার পরিমাণ!

একদা প্রভাতে যাত্রা ; মস্তিষ্কের বিবরে অনল,
হৃদয়ে বিদ্বেষ, না কি তিক্ত কাম, কে করে যাচাই!
তরঙ্গের ছন্দের পিছনে ছুটে, হিল্লোলে চঞ্চল,
আমাদের অসীমেরে সমুদ্রের সীমায় নাচাই।

কেউ ছোটে দূষিত স্বদেশ ছেড়ে মোহন অয়নে,
শৈশবের বিভীষিকা পার হ’তে উৎসুক অন্যেরা,
ক্বচিৎ জ্যোতিষী কেউ ডুবে মরে নারীর নয়নে-
মদমত্তা কির্কী এক, মারাত্মক অনুবাসে ঘেরা।

জান্তব রূপান্তরে পরিণতি সভয়ে ঠেকাতে
তারা হয় মাতাল আকাশ, আলো, দীপ্ত নীলিমায়;
তুষারের  তীক্ষ্ণ হুল, তামা-জ্বলা রৌদ্রের রেখাতে
ক্রমশ চুম্বনচিহ্ন লুপ্ত হয় দিগন্তসীমায়।

কিন্তু শুধু তারাই যথার্থ যাত্রী, যারা চ’লে যায়
কেবল যাবারই জন্য,হালকা মন, বেলুনের মতো,
নিশিত নিয়তি ফেলে একবার ফিরে না তাকায়,
কেন,তা জানে না, শুধু ‘চলো,চলো’ বলে অবিরত।

তাদের বাসনা পায় মেঘপুঞ্জে উজ্জ্বল বিন্যাস;
স্বপ্নে হানা দিয়ে যায়- সৈনিকেরে যেমন কামান-
পরিবর্তনীয় দেশ, মহাশুন্যে ইন্দ্রিয়বিলাস,
যার নাম কখনো জানেনি কোনো মানবসন্তান।

২, ৩

কী বিকট! লাটিম,বলের মতো ভাল্‌জের  তালে
উল্লোল আবেগে নাচি; কৌতূহল –প্রমত্ত বিদ্যুৎ-
ঘুমের ঘোরেও তার যন্ত্রণার আন্দোলন ঢালে,
সূর্যেরে চাবুক মারে ক্ষমাহীন কোন দেবদূত।

খেয়ালের খেলা, যার লক্ষ্য শুধু পিচ্ছিল প্রমাদ,
কোথাও তা নেই, তাই মনে হয় নেই কোনখানে!
মানুষ, হৃদয়ে যার দুরাশার নেই অবসাদ,
অবিরাম উন্মাদের মতো ছোটে শান্তির সন্ধানে।

আমাদের প্রাণ তার ইকারির এষণে আকুল
ডাকাত- নৌকোর মত। তক্তা কাঁপে –‘ খোলো, খোলো চোখ!’
উন্মাদ উত্তপ্ত কণ্ঠে হেঁকে ওঠে উল্লম্ব মাস্তুল,
‘প্রেম…  কীর্তি… পুরস্কার!’ ঠেকে চরে- সে-ই তো নরক।

মাল্লার বিহ্বল চোখে প্রতি ক্ষুদ্র দ্বীপের আভাস
হ’য়ে ওঠে আরেক এলদোরাদো,নিয়তিপ্রদীপ
ব্যাভিচারী কল্পনার উচ্ছৃঙ্খল, উন্নিদ্র উল্লাস
ভোরের আলোয় দ্যাখে শুধু বন্ধ্য পাথরের দ্বীপ।

হায় রে সিন্ধুর পারে রূপকথা রাজ্যের প্রেমিক!
বেড়ি বেঁধে জলে তাকে ফেলে দাও-এই তো সময়!
উদার আমেরিকার উদ্ভাবক মাতাল নাবিক,
যার স্বপ্ন তরঙ্গরে ক’রে তোলে আরো বিষময়।

এই বুড়ো বাউন্ডুলে,পায়ে ঠেলে কাদার ফাগুয়া,
উন্নাসিক, তৃপ্তিহীন,স্বপ্ন তার অপ্সরীর দিঠি,
মন্ত্রমুগ্ধ চোখে চেয়ে দ্যাখে তবু ভাস্বর কাপুয়া
যেখানেই বস্তির ধোঁয়াটে বাতি জ্বলে মিটিমিটি।

অদ্ভুত যাত্রীর দল! তলহীন,সমুদ্রের মতো,
বিলোল নয়ন ভ’রে নিয়ে এলে প্রোজ্জ্বল কাহিনী,
স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে দেখাও, সেখানে আছে কত
নীলিমার, নক্ষত্রের মনিহার,মুকুট, কিঙ্কিণী।

আমরাও যাবো দূরে,বিনা পালে, বায়ুব্যতিরেকে-
আমরা আজন্ম বন্দী, বক্ষে চাপা নির্বেদের ভার,
অকস্মাৎ উন্মোচিত আত্মার বনাতে দাও এঁকে
দিগন্তের চালচিত্রে পুলকিত স্মৃতির সম্ভার।

বলো, বলো, কী দেখেছো, বলো!



‘দেখেছি অপরিমেয়
আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ,বালুতট তরঙ্গপ্রহত;
এবং অচিন্তনীয় প্রলয়ের সংঘাত সত্ত্বেও
মাঝে-মাঝে হৃদয় হয়েছে ক্লান্ত, তোমাদেরই মতো।

বেগনি-রঙা সমুদ্রে মহান সূর্য কেলিপরায়ণ,
গরীয়ান অস্তরাগ নগরের উচ্ছল বিলাসে,
দেখে দেখে চেয়েছে আবেগদীপ্ত শান্তিহীন মন
ডুবে যেতে লোভন বিচ্ছুরণে রঙ্গিল আকাশে।

রমণীয় বনপথে, নগরের সমৃদ্ধ প্রাসাদে
কখনো স্পর্শেনি সেই রহস্যের গম্ভীর আবেগ
যা পেয়েছি পুঞ্জিত মেঘের মধ্যে, দৈবের প্রসাদে;
আর ছিলো হৃদয়ে অনবরত কামের উদ্বেগ!

-পুলকের অভ্যুদয় কামনার বাড়ায় ক্ষমতা।
হে কাম, প্রাচীন বৃক্ষ, সুখময় তোমার প্রান্তর,
যদিও বল্কলে বাড়ে দিনে-দিনে কঠিন ঘনতা
ডালপাখা ঊর্ধ্বে উঠে সূর্যেরেই খোঁজে নিরন্তর।

বনস্পতি, বৃক্ষরাজ, সাইপ্রেসের চেয়ে দীর্ঘজীবী,
অনন্তবর্ধিষ্ণু তুমি? –যত্নে তবু করেছি চয়ন
ক্ষুধাতুর তোমার পুঁথির যোগ্য কতিপয় ছবি,
আমরা, দূরত্বমুগ্ধ, সৌন্দর্যপিয়াসী ভ্রাতৃগণ।

দেখেছি অবাক চোখে শিং তোলা বিরাট প্রতিমা,
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো সিংহাসনে রত্নের বিলাস,
উৎকীর্ণ প্রাসাদ, যার জাদুকর কান্তির গরিমা
জোগাতে, ধনপতির অচিরাৎ হবে সর্বনাশ;

বসন, দর্শন মাত্রে, ব্যাপ্ত করে মদির আবেশ,
মোহিনী রমণীদের বর্ণলিপ্ত নখর, দশন,
সাপুড়ের কণ্ঠ ঘিরে সাপিনীর নিবিড় আশ্লেষ।’



তারপর, বলো, তারপর ?



‘হায় রে অবোধ মন !
সার কথা শোনো তবে, সনাতন, অবিস্মরণীয়,
ঊর্ধ্বে, নিম্নে সোপানের যত আছে মারাত্মক ধাপ,
সর্বত্র দেখেছি শুধু –সাধ ক’রে খুঁজিনি যদিও-
ক্লান্তিহীন মঞ্চে খেলে ক্লান্তিকর, মৃত্যুহীন পাপঃ

রমণী,আজন্ম দাসী,হাস্যহীন, দাম্ভিক,নির্বোধ
কিছুতে ন্যক্কার নেই- আত্মরতি,আত্মোপাসনায় ;
পুরুষ,লম্পট, লুব্ধ, অত্যাচারে নেয় প্রতিশোধ,
দাসীর দাসত্ব করে নর্দমার ক্লেদাক্ত ফেনায়।

শহীদ, ক্রন্দনে রত ; আনন্দিত,সপ্রেম ঘাতক,
রক্তের সৌরভ-মাখা উৎসবের মত্ত আয়োজন,
শক্তির কুটিল বিষে অবসন্ন লোকাধিনায়ক,
চাবুকের আকাঙ্ক্ষায় জনগণ নতিপরায়ণ;

অনেক আশ্রম,সিঁড়ি ভেঙে স্বর্গে ধাবমান,
আমাদেরই অনুরূপ; যাকে বলে পুণ্যের প্রভাব,
তাও, যেন ভোগক্লান্ত পালকের শয্যায় শয়ান,
কণ্টকিত চটেও প্রকট করে কামুক স্বভাব।

প্রগলভ মানুষ, তার প্রতিভার পীড়নে মাতাল-
সঙ্গী তার অচিকিৎস্য, চিরায়ত চিত্তের বিকার-
বিধাতারে জানায় যন্ত্রণা,ক্ষোভ ,আক্রোশে উত্তালঃ
“তবে নাও অভিশাপ, প্রভু আর প্রতিভূ আমার!”

আর যারা কিঞ্চিৎ  সজ্ঞান, তারা কঠিন সাহসে
জাড্যেরে জানায় প্রেম; অদৃষ্টের শৃঙ্খলে নাচার,
ডোবে, গড্ডলিকা ছেড়ে, আফিমের বিশাল প্রদোষে

-আদ্যন্ত জগৎময় চিরন্তন এ-ই সমাচার।’



অতি কটু সেই জ্ঞান, চঙ্ক্রমণে যাকে যায় পাওয়া,
এক্তাল,সঙ্কীর্ণ  এ-পৃথিবীর আকাশে, বায়ুতে
আজ, কাল, চিরকাল খেলে শুধু আমাদেরই ছায়া,
আতঙ্কের মরূদ্যান নির্বেদের বিস্তীর্ণ মরুতে।

গতি? না বিরাম চাও?  যদি পারো ঘরে থাকো, আর
যদি না-গেলেই নয়, যাও ছোটো,কিংবা দাও হামা,
ফাঁকি দাও শত্রুকে, নিস্পন্দ চোখে যে করে সংহার-
সময়! হায় রে যাত্রী, ধাবমান, নেই তার থামা,
অস্থির ইহুদি যেন, কিংবা পীর ধর্মের যাজক,
কিছুই পাথেয় নেই, অশ্ব , রথ,কিংবা জলযান,
এ-কুৎসিত মল্লেরে পলাবে ব’লে নিয়ত ব্রাজক;
অন্য কেউ আঁতুড়েই শিখে নেয় তার মৃত্যুবাণ।

অবশেষে যখন পা দিয়ে চেপে,  ছিঁড়ে নেবে টুঁটি,
সাধ্যে তবু কুলোবে আসার বাণীঃ  হও আগুয়ান!
যেমন ভেসেছিলুম, পুরাকালে, উপড়ে ফেলে খুঁটি,
সুদূর চৈনিক তটে,স্রস্ত কেশ, নিবদ্ধ নয়ান।

এবার তাহ’লে যাত্রা তমসার অতল সাগরে
সদ্য-পথিকের মতো পুলকিত হৃদয় উধাও,
শোনো, কারা শবযাত্রী গান গায় মোহময় স্বরেঃ
‘এদিকে,এদিকে এসো, যদি কেউ  স্বাদ নিতে চাও
মদগন্ধ কমলের।  এই হাটে তাকে যায় কেনা,
অলৌকিক সেই ফল, যার জন্যে হৃদয় ক্ষুধিত;
এখানে প্রদোষ নেই, অপরাহ্ণ আর ফুরোবে না,

এসো না, অদ্ভুত তার মাধুরিতে হবে আমোদিত!’
ওপারে বাড়ায় বাহু পিলাদেস, এখনো তেমনি,
প্রেতেরে চিনিয়ে দেয় পুরাতন গানের গুঞ্জন।

‘সাঁৎরে ধর এলেক্‌ত্রাকে,সে-ই তোর বিশল্যকরণী!’
বলে সে, একদা যার জানুতট করেছি চুম্বন।



হে মৃত্যু, সময় হলো!   এই দেশ নির্বেদে বিধুর।

এসো, বাঁধি কোমর, নোঙর তুলি, হে মৃত্যু প্রাচীন!
কাণ্ডারী ,তুমি তো জানো, অন্ধকার অম্বর,সিন্ধুর
অন্তরালে রৌদ্রময় আমাদের প্রাণের পুলিন।

ঢালো সে-গরল তুমি, যাতে আছে উজ্জীবনী বিভা!
জ্বালো সে-অনল, যাতে অতলান্তে খুঁজি নিমজ্জন!
হোক স্বর্গ,অথবা নরক, তাতে এসে যায় কী-বা,
যতক্ষণ অজানার গর্ভে পাই নূতন-নূতন!


শার্ল বোদলেয়ার (পুরো নাম - Charles-PierrBaudelaire; উচ্চারণ শার্ল-পিয়ের বোদলেয়ার; জন্ম - ৯ই এপ্রিল, ১৮২১ পারিতে)
ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম কবি ও অনুবাদক। প্রাবন্ধিক ও শিল্প-সমালোচক হিসেবে তাঁর কাজও উল্লেখের দাবি রাখে। ফরাসিতে এডগার অ্যালান পোর অন্যতম প্রথম অনুবাদক ছিলেন তিনি। ফরাসী সাহিত্য অঙ্গনে বোদলেয়ার একটি উজ্জ্বল নাম ফ্রান্সের সমাজে উনিশ শতকের শুরুর দিকে যেরকম কবিতা লেখা হত শার্ল বোদলেয়ার ওগুলো থেকেই কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। একজন মানুষের মধ্যে আসা রোমান্টিকতাকে কিভাবে আরো ব্যাপ্তিময় এবং সৌন্দর্যমন্ডিত করা যায় সেটা শার্ল ভাবতেন। তার কবিতায় শৈল্পিকতা পাওয়া যায়, তিনি প্যারিস নগরীকে তার কবিতায় অনেকবার স্থান দিয়েছেন, ফরাসী কবিতা পাঠকেরা তার কবিতা পড়ে এক অন্য জগতে চলে যেত।
সাদাত হোসাইন এর গুচ্ছ কবিতা

সাদাত হোসাইন এর গুচ্ছ কবিতা

এক.

যেতে যেতে মনে হয়, কোথায় যাবো?
তোমার মতো কোথাওতো আর কেউ নেই,
সকলেই বুকে পোষে নদী,
তবু সব নদীতে তো আর ঢেউ নেই!

দুই.

মিটে গেলে সব লেনদেন আর হয়ে গেলে সব শেষ,
তাকিয়ে দেখি, সহজ হিসেব ভুল করা অভ্যেস।

তিন.

কোথাও একটা পোস্টবক্স নেই, অথচ বুকের ভেতর চিঠি জমে জমে মেঘের মিনার,
কোথাও একটা ঠিকানা নেই, অথচ নীল খাম জমে জমে, ভেসে যায় বুকের কিনার।

চার.

আমাকে হারাতে দিলে, নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর।
একটা হিজল ফুলের গাছ,
একটা শান্ত পুকুর ঘাট,
ঘাটের পাশে পাখি, পাখির নামটি ডাহুক পাখি হলে, তাহার দুটি চোখ,
চোখের ভেতর মায়া, মায়ার ভেতর তোমার নামটি লেখা।
একটা আদিগন্ত মাঠ, মাঠের পাশে ঘর, ঘরের পাশে একটা সজল দীঘি।
অনন্ত এক কাব্যকথার রাত, রাতের ভেতর দিন, দিনের ভেতর তোমার আমার হাজার খেরোখাতায়, হাজার স্মৃতির ঋণ।
একটা হাতের ছোঁয়া, ছোঁয়ার ভেতর ছায়া, ছায়ার ভেতর আটকে থাকা তুমি, তোমার সকল কান্না দহন দিন।
চারদেয়ালের ভেতর হঠাৎ হাওয়া, হাওয়ার বুকে ঘুমপাড়ানি গান, গানের ভেতর মন।
একটা অমল আকাশ, আকাশজুড়ে ইচ্ছেমত ওড়া, রাত পোহাবার বাঁশি।
একটা অশত্থ গাছ, গাছের পাশে জলের কলরোল। ভালবাসার নহর।
বুকের ভেতর নদী।
এসব হারাও যদি?
এই শহরটা জানে, এমন করে কনক্রিটের বুকে, আর কাঁপে না কেউ।
কারো হৃদয় আর কাঁদে না, কেউ দেবে না আর, এমন মায়া মেখে।
আমার ছোট্ট বুকের ভেতর কেবল, কাঁপতো হৃদয়, কাঁদতো ভীষণ, তোমায় ভালোবেসে।

আর কে এমন, ভালোবাসার দামে, কিনবে তাহার প্রহর?
আমাকে হারাতে দিলে, নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর।

পাঁচ.

শেষ ট্রেন চলে যায়? যাক।
কারো কারো তাড়া নেই, আধুলিও ভাড়া নেই,
কোথাও যাবোনা দেখে, একা থাকা প্ল্যাটফর্ম, ভীষণ অবাক!

ছয়.

চিঠির পাতায় লেখা ছিলো, 'ভালো থাকবো, ভান হলেও'।
কুড়ি বছর অনেক সময়। অনেক।
ইলেক্ট্রিকের তার বসেছে মাঠের বুকে।
চুকে গেছে লুকিয়ে দেখা আয়নার দিন।
ঋণ বেড়েছে, খরচা খাতায় বেহিসেবে।
তবুও কোথাও রয়ে গেছে, সেই কথাটি, 'ভালো থাকবো, ভান হলেও'।
শিউলি ফুলের গন্ধে ডোবা অলস যে পথ, সে পথ এখন ব্যস্ত ভীষণ।
দূরে কোথাও, যেথায় আগে সূর্য ডুবতো, এখন সেথায় আকাশই নেই।

কুড়ি বছর অনেক সময়। কত আকাশ চুরি হলো, কত পাখির!
সেসব খবর কেউ রাখে না, পাখি এবং খাঁচা ছাড়া।

তখন কাজল লেপ্টে যেতো, লিপস্টিকের রঙটা যেন বেপরোয়া, ঠোঁট ছাড়িয়ে উঠেই যেত।
টিপখানাও দস্যি ভীষণ, রোজ বাঁকাবে, চোখ আঁকাবেই ভুল কাজলে।

তবুও তখন, নিজের একটা মানুষ থাকতো বুকের ভেতর।
এখন বুকে মানুষ থাকে, জনসভার ছবির মতন। চেহারা নেই, আদল আছে।

তখন থাকতো জোনাক জ্বলা তারার সন্ধ্যা,
বুকের ভেতর মেঘের মতন ব্যথা জমতো, ব্যথার বুকে লুকিয়ে থাকতো খানিক সুখও।
ধরা যায় না। পড়া যায়না, কোথায় এমন ‘সুখের মতন ব্যথার’ আবাস।
তখন কেবল কান্না পেতো, একটা নদী, উথাল পাথাল ঢেউ তুলতো যখন তখন।
একটা নিজের মানুষ থাকত। সেই মানুষটা হঠাৎ লিখলো, ‘ভালো থাকবো, ভান হলেও’।
ভান হলেও ভালো আছি, এই যে শহর, কোলাহলে ভীড়ের ভেতর, কে কার চোখে চোখ রেখে যায়?
কেউ রাখে না। কেউ দেখেনা কার চোখে কী রোজ জমেছে।

হাতের রেখায় কমছে আয়ু, তার হিসেবেই ব্যস্ত সবাই। চোখেরও যে আয়ু থাকে, বুঝতে কারো দায় পড়েনি!

কুড়ি বছর অনেক সময়।
ইলিক্ট্রিকের তার বসেছে মাঠের বুকে, চুকে গেছে কুপি জ্বালা সন্ধ্যা, বিকেল।
বুকের কাছে গোপন চিঠি আর জমেনা। ফ্রকের বুকে কুঁচির নিচে ধুকফুকানি আর বাড়েনা।
লুকিয়ে পরা মায়ের শাড়ি আর জানেনা, নিজের একটা মানুষ থাকে। কেবল নিজের।
সেই মানুষটার সবটা জুড়ে মায়া থাকে, দুপুর রোদে পুকুর জলে ছায়ার মতন।

এখন পুকুর ভরাট হয়ে হাঁট বসেছে, বেচাকেনা বেশ জমেছে।
মানুষও ঠিক রোজ মিলে যায়, যে যার মতো দামে কেনে।
নানান রঙের, ঢঙের মানুষ। ভংয়ের মানুষ, সঙয়ের মানুষ।
যে যার মতো দামে বিকোয়।

নিজের একটা মানুষ থাকতে বয়েই গেছে! একার মানুষ।

অসুখ হলে অপেক্ষায় আর কেউ থাকেনা, এখন সবাই ওষুধ গেলে।

কেউ জানেনা, গভীর রাতে কান্না এলে,-
অভিমানের ব্যথায় কাতর, বুকের গহীন,
ফিসফিসিয়ে জানিয়ে দেয়, তার কী ছিলো কথ্য?
এই অসুখে নিজের একটা মানুষ শুধুই পথ্য!

এখন সবাই ভালোই থাকে, ভান লাগেনা।
কুড়ি বছর অনেক সময়, অনেক সময়-
আমার তবু দুপুর-রাত্রি, সন্ধ্যা আকাশ ভাল্লাগে না।

সাত.

আমাদের সকলের বুকের ভেতর একেকটা পুকুর থাকে।
শান্ত জলের পুকুর।

কিন্তু সামান্য অনুভূতির হাওয়ায়ও সে জলে কম্পন তুলে কেঁপে ওঠে থরথর। কেউ স্পর্শের ঢিল ছুড়লে সে ঢেউ তুলে ভাসিয়ে নেয় মনের এপারওপার। ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা, দুঃখ কিংবা আনন্দ, সকলই তার কাছে ঢেউ তুলে কেঁপে উঠবার অজুহাত, এলোমেলো করে ভাসিয়ে দেয়ার উপলক্ষ।

আমরা জীবনজুড়েই নিজেদের গুছিয়ে রাখতে চাই, সেনাবাহিনীর মার্চপোস্ট বা সারি সারি কনভয়ের মতো। অথচ আমরা এলোমেলো হয়ে একুল ওকুল ভেসে যাওয়ার জন্য বুকের ভেতর যত্ন করে আজীবন পুষে রাখি পাখির চোখের মতন টলমলে স্বচ্ছ জলের এক পুকুর।

কে জানে, হয়তো এই পুকুরটার ছদ্ম নামই মন, আর মনের ছদ্ম নামই মানুষ!

আট.

চলে গেলে মুছে যেও ধুলোয় লেগে থাকা পায়ের ছাপ,
হাওয়ায় ছড়িয়ো না গায়ের ঘ্রাণ।
ওইখানে রেখে যেও যা ছিলো আমার।
রেখো যেও ভুলভাল স্মৃতির রুমাল।
চলে গেলে মুছে যেও দেয়ালের রঙ,
যেখানে যা ছায়া হয়ে ছিলো, তার সব নিয়ে নিও,
নিয়ে যেও মায়া হতো যা, তাও।
ওইখানে রেখে যেও অবহেলা যত,
যত ছিলো মিছে আর ভান।
চোখের পাতায় যদি লাগে কিছু ব্যথা, রেখে যেও তাও,
এইখানে এই বুকে জায়গা অনেক।
চলে গেলে ভুলে যেও, ফিরে আর এসোনা এ পথে,
এইখানে বৃক্ষের মতো, থেকে যাক কেউতো শপথে।
দরজায় লেগে থাক খিল, লেগে থাক দেয়ালে অমিল,
জানালায় লেখা থাক, ছিলো না কোথাও কেউ,
ভালো কেউ বাসেনি কখনো।
চলে গেছে যারা, তারা কেউ, এইখানে ছিলোনা কখনো।

নয়.

শুনছো মেয়ে?
এই যে ধূসর মেঘের খামে, বর্ষা নামে,
জমছে কতো ফুলের রেণু চুলের ভাঁজে।
দখিন হাওয়া হঠাৎ এসে, আঁচল ভাসায় সুবাস মেখে,
জলের কণা আলতো করে গাল ছুঁয়ে যায়।
ছুঁতে পারো, তুমিও খানিক?

শুনছো মেয়ে?
একটা চিঠি ঘুরে বেড়ায় এই শহরে, ঠিকানা নেই,
সেই চিঠিটার বুকের ভেতর জমছে ব্যথা সঙ্গোপনে,
বাতাস ভারি দীর্ঘশ্বাসে, কী যায় আসে!

একটা কেবল দুপুর থাকে, খা খা রোদের,
একটা খাঁচায় হলুদ রঙের পাখি থাকে,
সকাল দুপুর সেই পাখিটার বুকের ভেতর,
কে জানি কে আকাশ আঁকে!

শুনছো মেয়ে, সেই আকাশে একলা একা কে উড়ে যায়?
কার কী ভুলে?
ঠিকানাহীন, চিঠির মতো বাউন্ডুলে।

শুনছো মেয়ে, এই শহরে একটা বুকে,
তোমার নামে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা নামে!

দশ.


এই যে লোকে লোকারণ্য শহর, সকাল - সন্ধ্যা ভিড়ভাট্টা জাগে,
তবুও এমন একলা লাগার মানে, একটা 'নিজের মানুষ' সবার লাগে!


এই যে এমন ঝলমলে রোদ-দিন, সন্ধ্যা হতেই ল্যাম্পপোস্টের আলো,
তবুও বুকের জমাট আঁধার জানে, নিজের একটা প্রদীপ থাকা ভালো।


এই যে তুমুল বৃষ্টি নামে রোজ, ভিজছে শহর রোদের অপেক্ষায়,
তবুও কেন মেঘ জমেছে বুকে, ছলছল চোখ কার কী উপেক্ষায়!


এই যে এমন বিচ্ছিরি এক দিনে, এই যে হঠাৎ বসন্ত দিন জাগে,
কান্না ক্লান্ত চোখের অশ্রু জানে, একটা 'নিজের মানুষ' সবার লাগে।

এগার. 

এই যে সন্ধ্যা, তারার আকাশ, রাত্রির রঙ জানে,
কাছের মানুষ দূরে সরে যায়, কী গোপন অভিমানে!
আমরা জানিনা শুধু-
মেঘের ওপর মেঘ জমে জমে, দূরত্ব বাড়ে ধু ধু।
ধুসর কুয়াশা মুখ ঢেকে দেয়, ধুলো মোছে পদচিহ্ন,
আমরা জমাই হিসেবের খাতা, কার ক্ষত কত ভিন্ন!
অথচ জীবন জানে-
দূরে যাওয়া মানে কাছে আসবার, শপথ সঙ্গোপনে।


সাদাত হোসাইন
জন্ম: ২৯ জুন, ১৯৮৪, মাদারীপুর জেলা
কবি, উপন্যাসিক, উপস্থাপক, চলচ্চিত্র নির্মাতা 
কাঠগড়া ও কঙ্কাল ।। চঞ্চল মাহমুদ

কাঠগড়া ও কঙ্কাল ।। চঞ্চল মাহমুদ


ম্যালো, ভূমধ্যসাগরের মাঝে একটি বিকল হয়ে যাওয়া আপাত স্থির জাহাজে আমিসফোক্লিস আর জোকাস্টা বসে প্রাচীনকালের ওয়াইন পান করে যাচ্ছি; বিকল হবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত এ জাহাজের একমাত্র চালক ছিলো লেয়াস ।  আমাদের ৪ জনকে বিভিন্নভাবে ওয়াইন ঢেলে সহযোগিতা করে যাচ্ছে ঈদিপাসজাহাজ বিকল হওয়ার সাথেই সাথেই ঈদিপাসের ঢালাও আচরণ সফোক্লিসের দিকে লুণ্ঠিত হয়সফোক্লিসের নির্ধারিত গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে তাকে না দিয়েই বরং ঈদিপাস তা নিজের শঙ্কায় ঢকঢক করে ঢেলে দেয়... আমি হাসছিজোকাস্টাকে বোঝা যাচ্ছে না...... উদ্বিগ্ন হয়ে সফোক্লিস ভাবছে- সাইথিরন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে একবার ঝাপ দিয়ে আসি’; একমাত্র লেয়াসের আনন্দে বিকল হয়ে ওঠো জাহাজও কিছুক্ষণ চলতে শুরু করলো......  
আমি উঠে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম । ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লাইয়াস প্রবাহিত হয়ে আমার তামাটে পায়ের  নিচে রেখে গেলো কেন্দ্রগামী আগুন......। ম্যালোআয় উত্তপ্ত করি- নিজেদের তামা । শিরশির করে ওঠা এমন টগবগা রাতে ইটিওক্লেসপলিনেইসিসইসমেন ও অ্যান্টিগনিকে জোড়া লাগিয়ে দড়িতে রূপান্তর করে ঈদিপাসকে আদেশ করলাম- 'সফোক্লিসকে বেঁধে ফেলা হোক'। কুণ্ডলিত সফোক্লিসকে এনে হাজির করা হলো এমন পায়ের নিচে... যেখানে আগে থেকেই জড়ো হয়ে ছিলো তামাম-তামাম-গলিত-আগুন । তার গলার ভেতর চূড়ান্ত উত্তাপের তামা ঢেলে তাকে সংস্পর্শতাপী করে তুললাম... 

ধোঁয়া উঠছে...... ধোঁয়াকে পেছনে ফেলে আমাদের জাহাজ, চলমান........;  ম্যালো, পোড়ার গন্ধে ম-ম করে উঠেছে আমাদের গতিশীলতা......

একটু দূরেই জোকাস্টা স্থির......। সফোক্লিসের এমন নিয়তি দেখে সে কাঁদা শুরু করলো; তার কান্না থেকে ঝরে পড়ছে দলা-দলা আগুন তার শরীরেই......; ম্যালো, যে কান্নার ভেতর আগুন পালন করে এবং নিজেকে প্রয়োজনীয় হত্যার প্রয়োজনে সে আগুন ব্যবহার করে; তার পথ মেরামতের সাধ্য কি আমাদের আছে? 

জোকাস্টা পুড়ছে...... তাকে বোঝা যাচ্ছে না...
সফোক্লিসকে পোড়াচ্ছে চঞ্চল মাহমুদ (ঈদিপাস ও লেয়াসের সহযোগিতামূলক আচরণের আভাস নিরূপণেই তা সম্ভব হয়ে উঠছে.....) 

ম্যালো, শোকে ও অপরাধে নিমজ্জিত এ দুটি ভিন্ন অবস্থাকে একত্রিত করে জাহাজের ছাদ থেকে নিক্ষেপ করলাম- পতনের সৌন্দর্যের দিকে ...। নিক্ষেপিত পতনের সবটুকু সময় লেয়াস ও ঈদিপাস কাতরতার তরঙ্গে ঢুকে, নিমজ্জিত হয়ে বলতে থাকলো- 'তোমার দেখা না পেলে জোনাকিবিহীন অন্ধকারে আমরা বাপ-বেটা শুধুই ছটফট করতে থাকতাম......'  

ম্যালো, আরেকটি পতিত বৃত্তের পরিধিকে ঘোড়া বানিয়ে পতন শুরু হলো- অন্য কোন সংকটের কেন্দ্রের দিকে.....
সমকালীন বিশ্বসাহিত্য । কবিতা সংখ্যাঃ প্রথম পর্ব । অতিথি সম্পাদক: কালপুরুষ

সমকালীন বিশ্বসাহিত্য । কবিতা সংখ্যাঃ প্রথম পর্ব । অতিথি সম্পাদক: কালপুরুষ

অলংকরণ: রাজিব দত্ত

রেইনালদো আরেনাস


কিউবান কবি, ঔপোন্যাসিক ও নাট্যকার রেইনালদো আরেনাস (Reinaldo Arenas) জন্ম নেন ১৬ জুলাই ১৯৪৩ সনে। যৌবনের শুরুতে ফিদেল কাস্ত্রোর জন্য আন্দোলনে শরিক হন এবং পরবর্তিকালে সমকামীতা ও কাস্ত্রো সরকারবিরোধী সাহিত্যের অভিযোগে গ্রেফতার হন। জেলে অমানুষিক অত্যাচার থেকে তিনি রক্ষা পান সমুদ্রপথে আমেরিকা পাড়ি জমিয়ে। কবিতার পাশাপাশি তার সর্বাধিক বিখ্যাত কাজ পাঁচটি উপন্যাসে সমন্নিত Pentagonia সিরিজ। আরেনাসের সাহিত্যে ঘুরে ফিরে এসেছে কিউবার মাটি ও জলের ঘ্রাণ, জীবনের স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, বঞ্চনা। মারণব্যাধি এইডসের সঙ্গে যুদ্ধক্লান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন ১৯৯০ সনের ৭ই ডিসেম্বর। সংক্ষিপ্ত ও প্রায় বিক্ষুব্ধ-অশান্ত জীবন সত্ত্বেও রেইনালদো আরেনাসের রেখে যাওয়া সাহিত্যকর্মের পরিমাণ ঈর্ষণীয়।
অলংকরণ: নবী হোসেন

হে সমুদ্র
প্রেমিক আমার
ভাষান্তর: এনামুল রেজা


আমি সেই কুৎসিত শিশু
সমস্ত মিলিয়ে যে তোমাকে শুধু বিরক্ত করবে
"তুমি কি একটু স্থান দেবে?"

আমি কদাকার সেই শিশু
সংশয়াতীত অনাকাঙ্ক্ষিত
সেই উজ্জ্বল গাড়ী যেখানে অন্য শিশুরা হাসি ও আনন্দে নৃত্যরত
তার থেকে অনেক অনেক দূরের কেঊ

আমি সেই কদাকার অপ্রিয় শিশু
নিশ্চিত অবাঞ্চিত
যার সামনে রাস্তার দৈত্যাকৃতি আলোরা ক্রোধে জ্বলে ওঠে
এমনকি কোন বৃদ্ধা রমণীর স্নেহের ছায়াও সরে যায়
অথবা ছোট্ট বালিকারা যাদের শূন্যে ছুঁড়ে মারলে খুশি হত
তার কদর্যতা ওদেরও অপমানিত করে

আমি চিরকালের সেই রাগী এবং নিঃসঙ্গ শিশু,
যার বয়ে বেড়ানো ক্রোধ তোমায় অপমান
আর হুঁশিয়ারী দেয়:
যদি উন্মাদনায় আমার মাথায় চাঁটা মারো
সে সুযোগে তোমার পকেট মেরে দিতে পারি।

আমি সেই শিশু যে চিরকাল
দাঁড়িয়ে আছি বিস্তৃত সমাসন্ন আতঙ্ক,
আসন্ন কুষ্ঠআসন্ন মহামারী,
সমস্ত পাপ ও সমাগত অপরাধের কারণ হিসেবে,
আমি সেই ঘৃণ্য শিশু
যে এক প্রাচীন কার্ডবোর্ডে নিজের বিছানা বানিয়ে করে অপেক্ষা করছি,

এ নিশ্চয়তায় যে শুধু তুমিই আমার আশ্রয় হতে পারো।



পেট্রিশিয়া লকউড

পেট্রিশিয়া লকউড একজন নারীবাদী কবি যিনি ভালোবাসেন খুব কঠিন এবং বাস্তব বাস্তবতা। যৌনতা ও ঠাট্টার ছলে বলে ফেলতে জটিল সব কথা। কিন্তু গভীরতা হারান না মোটেও।
তিনি পরিচিত হয়েছেন রেপ জোক” কবিতাটি দিয়ে। জাতীয়তায়  আমেরিকান
অলংকরণ: নবী হোসেন

একজন হিপনো ডোমির বলে যাওয়া কথারা
ভাষান্তর: জোনায়েদ আহমেদ রাহাত

আমি জন্মেছি
নারী হয়ে,
আমি কথা বলতে বলতে আপনাকে নিয়ে যাবো মৃত্যুর কাছে,
অথবা বন্ধ করুন আপনার কানঅথবা ঘুমিয়ে পড়ুন।
কী আছে আমার কাছেপৃথিবীর সকল সময় এবং একটি কণ্ঠ  যা আগে পিছে ঘুরতে থাকে আপনি তা শুনতে পারবেন এবং আপনার চেহারার একটি অংশ যেখানে আমার থাকার কথা।
কী আছে আমার কাছেআছে নিশ্চিত ক্ষমতা এবং আমি যা চাই তা হলো আপনার অর্থ
এবং আপনার মন এবং আপনার মাঝে আমাকে বিষাক্ত সাপ মনে করার চিন্তা
এবং ঘাসের মাঝে একটি সাপ।
সে সাপের প্রতিটি হাড়ই নিতম্বের হাড়তার প্রতিটি অংশই নিতম্ব।
আমার প্রথম শব্দ নীরবতাতারপর হিসসসসস
আমার বলা প্রথম শব্দ শুনুন
ভেড়া-পালক এবং হিসাবরক্ষকদের মোহিত করা কঠিন কাজ
এবং নাবিকেরা তোমরা যারা সমুদ্র দেখো,
এবং যেই কিশোরেরা কাট কাট কাট কাট করে ঘাস কাটে
সতর্ক হও
লেখকেরা যারা লেখে নতুন নতুন কাব্য এবং যারা বার বার লিখে
একই
যারা হীরে কেটে বেড়ায় তারা হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসবে
এবং অনুরোধ করবে তাদের মোহিত করার জন্য
এবং আমি তাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠবো অনেক উজ্জ্বল,
তারা আমার কথা শুনবে এবং আমারই কথা শুনবেআমি তাদের বলবো,
নিজের বয়স গুনো উলটো করে এবং আমি তাদের বলবো শ্বাস নেয়ায় সতর্ক হও
এবং আমার নিশ্বাস নেও যা থেকে যাবে চিরতরে।
মেনে নাও তুমি একজন শিশুআমি যতদিন না তোমাকে প্রাপ্ত বয়স্ক বলি,
তারপর মেনে নাও তুমি একজন পুরুষ যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি তোমাকে
বলছি তুমি নর্দমা।
যখন তুমি একটি গুলির শব্দ শুনবে পড়ে থাকবে মৃতের মতো
যখন তুমি শুনবে “ শ্বাস চলছে” উঠে দাঁড়াবে,
কুকুরদের শ্রেষ্ঠ ভাষা হ্যা” এবং নিরাপত্তা দেয়া।
সাদা-কালো কুকুরেরও শ্রেষ্ঠ ভাষা হ্যা” এবং সে পিছে পিছে যায় সব জায়গায়
এবং তুমিও সেখানেই যাবে যেখানে আমি বলবো।
আমি কেন করিএটা সহজআমি এখনো স্কুল পার করছি
আমাকে অর্থ দাও আধুনিকতার জন্য এবং এরপর যা আসবে সব কিছুর জন্য
যখন তুমি বুঝে উঠবে তোমার দেহ আছে তুমি বুঝে উঠবে তা আর বেশিদিন তোমার নয়।
যখন তুমি বুঝে উঠবে এবং পড়বে কঠিনঅথবা না বুঝতে পারা কঠিন অথবা অবোধ্য কবিতা
তুমি আমার কাছে আসবে ।
যখন তুমি বইটি রেখে আমার কাছে আসবে তুমি শুনবে শব্দগুলো বই থেকে বেড়িয়ে পড়েছে
যখন তুমি আসবে

তুমি শুনবে



জয়ন্ত মহাপাত্র

জয়ন্ত মহাপাত্র (জন্ম: ২২শে অক্টোবর১৯২৮) ওড়িশার কটকে জয়ন্ত মহাপাত্রের জন্ম হয় এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। পদার্থবিদ্যায় মাস্টার ডিগ্রী লাভ করে তিনি ওড়িশার নানান সরকারী কলেজে অধ্যাপনার কাজ করেন। ৩৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করে আজ অবধি তিনি ১৮ টি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন যাদের মধ্যে "Close the Sky", Ten by Ten" ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর একমাত্র গদ্যের বই "The Green Gardener" ছিল ছোটগল্পের সংকলন। ইংরাজিতে লেখালেখি তাঁকে ভারতীয়-ইংরাজি কবিতার জগতে অনন্য করে তুলেছে। জয়ন্ত মহাপাত্র ভারতের একমাত্র সাহিত্যিক যিনি ইংরাজিতে লিখে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পান। "Relations" নামক তাঁর দীর্ঘ কবিতাটির জন্য তাঁকে এই পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। ইতিমধ্যেই তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়েছে।
অলংকরণ: নবী হোসেন
ভালো স্ত্রী
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

আমার বিছানায় শুয়ে থাকে
সারাটা দীর্ঘ বিকেল জুড়ে;
এখনো স্বপ্ন দেখেঅক্লান্ত
তীব্র অন্ত্যেষ্টি চিতাদের গর্জনে।


অলংকরণ: নবী হোসেন
তার হাত
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

আঁধার দিয়ে তৈরী বাচ্চা মেয়েটির হাত
আমি কিভাবে ধরি?

স্ট্রীটল্যাম্পগুলো ঝুলে আছে কাটা মাথার মত
রক্ত খুলে দেয় আমাদের মাঝের ভয়াবহ দরজাটা

দেশের ছড়ানো মুখ যন্ত্রণায় আবদ্ধ
যখন তার দেহ পেরেকের বিছানায় মোচড় খায়

এই বাচ্ছা মেয়েটির তার ধর্ষিতা শরীর আছে
আমার জন্য তার কাছে পৌঁছাতে

আমার দোষের ভার অসমর্থ
তাকে আলিঙ্গন করার বাধা পেরোতে

অলংকরণ: নবী হোসেন
প্রধান মন্দির সড়ক
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

খোঁড়া মানুষ আর সঙ্গমরত খচ্চরের দিকে
হাসতে থাকেমাটির মত বাদামীশিশুরা
তাদের নিয়ে কেউ ভাবেনা

বিরামহীন ছন্দের দিকে নির্দেশ করে মন্দিরটি

চাঁছা মাথা-রঙের ধুলোময় রাস্তার ওপর
কিছু জিনিস সবসময় নড়ছে
অথচ কোনোকিছুই দৃষ্টির বাইরে যাচ্ছেনা

উত্তাপে নিদ্রালু হয়ে আসা ক্ষতেরা

আর ঐ যে ওখানে আকাশ,
পবিত্র কর্তৃপক্ষের দ্বারা অধিকৃত
শক্ত করে নীরবতার যষ্ঠি ধরে থাকে

অলংকরণ: নবী হোসেন
গ্রীষ্ম
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

তবুও নয়।
আমগাছের তলায়
পরিত্যক্ত আগুনের শীতল ছাই।

কার ভবিষ্যত দরকার?

একটি দশ বছরের বালিকা
তার মায়ের চুল আঁচড়ে দেয়,
যেখানে প্রতিযোগিতার কাকেরা
শান্তিতে বাসা বেঁধেছে।

সেই ঘর কোনোদিনই
তার হবেনা

তার মনের এককোণে
একটা জীবিত সবুজ আম
মাটিতে ঝরে পড়ে আলতোভাবে। 

অলংকরণ: নবী হোসেন
একটি গ্রীষ্ম কবিতা
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

সোঁ সোঁ করা বিষণ্ণ বাতাসের ওপর
পুরোহিতেরা উচ্চতম কণ্ঠে স্তব করে;
খুলে যায় ভারতবর্ষের মুখ।

কুমীরেরা ঢোকে গভীরতর জলে।

উত্তপ্ত গোবরগাদার সকাল
রোদের তলায় ধোঁয়া

হোশাং মার্চেন্ট

হোশাং মার্চেন্ট (জন্ম:১৯৪৭) হোশাং মার্চেন্ট ভারতীয়-ইংরাজি কাব্যজগতের এক উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মুম্বইয়ের এক পার্সি পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। মুম্বইলস এঞ্জেলস ইত্যাদি জায়গায় নিজের শিক্ষালাভ শেষ করে তিনি হেইডেলবার্গজেরুজালেম এবং ইরানে থাকা এবং শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। আশির দশকের মাঝ থেকে তিনি হায়দ্রাবাদে বসবাস শুরু করেন যেখানে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ হায়দ্রাবাদে ইংরাজীর অধ্যাপকের কাজ করেন। এখনো অবধি তাঁর ২০টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে যাদের মধ্যে "Flower to Flame", "Stone to Fruit", "Homage to Jibanananda Das" ইত্যাদি তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য বই। নিজেকে "সমকামী" বলে প্রকাশ্যে দাবী করা এই কবি ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম সমকামিতার বই,  "Yaarana: Gay Writings from India" প্রকাশ করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।
অলংকরণ: নবী হোসেন

সিন্দ
ভাষান্তর: সুমন্ত চ্যাটার্জী

"আমি পাপ করেছি"  : নেপিয়ার

এক সিন্ধি বালকের মধ্যেই প্রেম খুঁজে পেয়েছিলাম প্রথমবার
সে প্রেম অনুভব করলেও বালক হওয়াতে আমাকে পিছন থেকে নিয়েছিল
যেভাবে পবিত্র আত্মা ঈশ্বরের খাড়াই সিঁড়িতে সেইন্ট জন'কে নিয়েছিল একরাতে

শীতল রাত ছিল
ট্রেনটা ছিন্নভিন্ন করে চলেছিল হিন্দুস্তানের হৃদয়
আর একটা স্টেশনে এসে থামলে
ফাঁস হয়ে গেছিল ভোর আর আমাদের প্রেম

যখন ইন্দুসেরা সমুদ্রকে দেখেছিল
তারা ভুলে গেছিল সে তুষারের শীতল কন্যা
সে উষ্ণ আর অগভীর হয়ে উঠেছিলবালিতে হারিয়ে
এই বালির দেশকে
তারা সিন্দ বলে ডেকেছিল

আর আরবেরা এসেছিল
আর সেখানে হিন্দুদের খুঁজে পেয়ে
তারা এই চোরাবালির দেশকে বলেছিলহিন্দুস্তান

বালকেরা শীঘ্রই তুর্কে পরিণত হয়েছিল
চোখেরা আয়না হয়ে উঠেছিল অন্য দেবতাদের প্রতিফলিত আলোর জন্য
উষ্ণ প্রেমকে চটকানো হয়েছিল গুরু আর শিষ্যের মাঝে সুরার মত

মানুষেরা তাদের নাম ভুলে যায়
তারা মনে রাখে সেইসব নাম
যা শীঘ্রই তারা ভুলে যাবে: তোমরা নাম জানতে চাও কেন?
তারা শুধু জেনেছিল আর মনে রেখেছিল ভালোবাসা

একজন রাখাল বাঁশি বাজিয়েছিল
একজন রাজা তাকে অনুসরণ করেছিল জঙ্গল অবধি
একজন মুঘল সন্তান কাবুল জয় করার পথে
পারসিক ভাষায় লিখে নিয়েছিল হিন্দু দেব-দেবীদের

আর সময় বন্য হলে আফিম সাহায্য করেছিল উত্তরাধিকারীদের যন্ত্রণাহীন মরতে
ভাইয়েরা শত্রু হয়ে উঠলে মৃত্যুই হয়ে যায় একমাত্র বন্ধু
কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া...আফিম ব্যতীত?
কিংবা জীবনের মুখোমুখি...কবিতা ব্যতীত?

নদীটা লাল হয়ে বয়ে গেছিল সেদিন
মহিলারা রেকাবে তাদের স্তন বয়ে এনেছিল ধর্ষণকারীদের জন্য
পুরুষেরা হাতে করে তাদের মাথা নিয়ে এসেছিল বিজয়ীদের জন্য

আর কবিতারা যারা এইসব ধ্বংসের উল্লেখ করে
এখন রেলস্টেশনে ধুলো জমিয়ে চলেছে
কিন্তু সজলের দুধরুমির মদিরা
মৃদুমন্দ বাতাসের নি:শ্বাস বয়েছিল "না"-এর ভেতর দিয়ে
বলেছিল: সে!

যতটুকু ভাবতে পারি যার হাতে মারা গেছিলাম
চিন্তারা থেমে গেছিল সেই রাত-ট্রেনের মত

আর আমার হৃদস্পন্দন হয়ে উঠেছিল একটি প্রকাশ্য ঘটনা। 



মরগান পার্কার
অলংকরণ: নবী হোসেন

হটেনটট ভেনাস
ভাষান্তরঃ আকাশ আহমেদ

বড় ইচ্ছে হয়-
আমার যোনীটা অম্লান থেকে অযথাই পাচ্ছে স্বীকৃতি
আমি কি তোমাদের ধন্যবাদ জানাবো?
ব্যবসায়ী চোখ ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমাকে কেউ আর
ভালবাসে নাযেভাবে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম
এক প্রাণচঞ্চলে শীত: আঘাত কিংবা সহানুভূতির
মদ্যপ সমন্বয়।

সূর্য উঠতেই আমার অপহরণকারীদের কেউ কেউ পান করে
আফ্রিকান গোলাপ পানীয়তারা আমাকে ব্যবহার করেছে
রাজকীয় ধৈর্যশীল খাবারের মতন যেহেতু আমি আসলে কিছুই না
মানুষও নাযতটুকু মনে পড়ে আমাকে ভোগ করে এক পুরুষ বলেছিলো
আমি কখনোই নারী হতে পারবো নাএটিই আমার নিয়তি।

এখন আমি বুঝতে পারি আমাকে নিয়ে কেউ দুশ্চিন্তা করছে না
কেননা আমি যথেষ্ট উপার্জন করছিএখানে এসেছি তোমাকে দেখাতে
কে তুমিতোমার মোটা মাথা বুকে নিয়ে জানিয়ে দিই তুমিই নিষ্কলঙ্ক
মা আমেরিকাছেড়ে দাও তোমার সন্তানদের-

তোমার সবকিছুই সুন্দর।

ডেভিড ব্রুকস

(১২ জানুয়ারি১৯৫৩- বর্তমান)

অস্ট্রেলিয়ান কবিঔপন্যাসিকপ্রাবন্ধিক। কবিতাগ্রন্থসমূহ : The Cold Front (1983); Walking to Point Clear (2005); Urban Elegies (2007); The Balcony (2008); Open House (2015)
অলংকরণ: নবী হোসেন

মাঠ
অনুবাদঃ রনক জামান

তোমাকে চলে যেতে

দেখলামচোখের কিনার হতেবাইরে,

বেরিয়ে গেলে, আর আমিও

পেছনে পেছনেযতটা সম্ভব দ্রুত,

অথচ ততক্ষণে, তুমি হয়ে গেছ :

এক বিস্তৃত মাঠ,

একটি আপাত সন্ধ্যা,

এক অচেনা পাখির কান্না।
অলংকরণ: নবী হোসেন
ব্যালকনি-৫
অনুবাদঃ রনক জামান

রাত ১০ টা,
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায়,
আবার আমরা দুজন
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুমু খেতে থাকি।
রাস্তায় মানুষ ছিলদেখে শিস বাজালো,
আরো কিছু লোকজন জড়ো হয় পথের ধারে।
কেউ বিদ্রুপ করছিল হেসে,
কেউ উল্লাসে দিশেহারা হলো। কেউ কেউ সাধুবাদ জানাচ্ছিল।
কেউ ট্যাক্সিতে আসে,
একটা বাস তার
সবকটা জানালাই খুলে দিয়ে
মাঝরাস্তায়বেমালুম থমকে দাঁড়ায়।
কয়েক মুহূর্ত পর
বিদ্রুপসাধুবাদহৈ চৈ
চুপ করে যায়। নীরবে দাঁড়িয়ে সব আমাদের দেখতে থাকে।
চুমু শেষে আমরা বাইরে তাকাই
দেখিকেউ নেই
ফিরে গেছে সবশুধু গাছের পাতাগুলো
পড়ে আছে পথের উপর
আর কোয়েল ও পরিযায়ী পাখিরা
উড়ে চলে গেছে তারা অনেক আগেই;
সংবিৎ ফিরে দেখিশীতকাল চারিদিকেশীত এসে গেছে।

ম্যাট রাসমিউসেন

আমেরিকান তরুণ কবিবার্ডস এলএলসি পাবলিশিং হাউজের প্রতিষ্ঠাতা। এমারসন কলেজ ও গুস্তাভান এডলফাস কলেজ থেকে ডিগ্রি লাভ করেন এবং বর্তমানে সেখানেই শিক্ষকতা করছেন। 'Black Aperture' তার ভাইয়ের আত্মহত্যার বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থটি খ্যাতি এনে দেয় তাঁকে। বইটি ২০১৩ তে ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড ফাইনালিস্ট হিসেবে মনোনীত হয় ও ২০১৪ সালে মিনেসোটা এওয়ার্ড লাভ করে। এছাড়া ২০১২ সালে সেরা তরুণ কবি হিসেবে ম্যাট রাসমিউসেন লাভ করেন ওয়াল্ট হুইটম্যান এওয়ার্ড।
অলংকরণ: নবী হোসেন

চাঁদ
অনুবাদঃ রনক জামান

লিখিত-শব্দবিহীন এক প্রামাণ্য নথি।
ঐ দিগন্তের টেবিলের ধারে পিছলে গেলে

আমাদের রেখে যায়
সংজ্ঞায়নে ব্যর্থ কিছু মূর্খের মতো।

দৃশ্য মুছে গিয়ে দুটো মেঘখণ্ড
সংঘর্ষের শব্দ শোনায়,

আরপরস্পর টুকরো টুকরো করে
নিজেরাই ছড়িয়ে পড়ে

হয়ত সেসবদৃশ্যত অন্য গ্রামের অধীন,
বাহয়ত নিজেরই অধীনেঅদৃশ্যত

ফুল ফুটবার মতো যুদ্ধ দামামা বেজে
ওঠেঅনুভবেবোধে

আর মেঘগুলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
গোধূলীর রক্তাক্ত রণক্ষেত্র পেরিয়েআকাশে

ঝুলে আছে জাতীয় পতাকার ন্যায় : নিরেট,
প্রেরণাদায়ক ঘননীল...
অলংকরণ: নবী হোসেন
এবং ঈশ্বর বললেন
অনুবাদঃ রনক জামান

আকাশকে জলে রূপান্তর করো।
সমস্ত প্রাণিকূল একত্র হয়ে ভাবলোতবে তো ডুবে যাবে সব।

ওরা কান্না জুড়ে দিলআর মহাসমুদ্র গড়ে উঠল তাতেসে জলে।
কিন্তু আকাশকে তো সমুদ্র করোনিবলেন ঈশ্বর।

...এক আকাশ জল তো করেছি
সেখানে পাখিদের ওড়ার ভঙ্গিতেমাছেরা সাঁতার কাটে।

নেহাতই দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়জানায় এক পশু।
আর ঈশ্বরযিনি আটকে গেছেন আকাশেতার বেরুবার পথ দরকার।

নিচে তাকালেই তাঁর নিজস্ব নীলাভ বিম্ব। তিনি বিব্রত হন।
পর্বতের দিকে তাকালেদৃশ্যত সেওভূমি সমান্তরাল।

এবং ঈশ্বর বললেনএবার কেঁদে কিছু শুকনো মাঠ তৈরি করো।
প্রাণিকূল একত্র হলো ফের কান্না জুড়ে দিলএতটাই যে আগে কাঁদেনি।

ঈশ্বর জানতেনসামান্য বেশিই চাওয়া হয়ে গেছে।
রাগে-ক্ষোভে তিনি নিজেকে ছুঁড়ে দেন সূর্যের পেটে।

পুড়ে ছাইউড়ে উড়ে আকাশ হতে ঝরেঢেকে দিল পর্বতমালা।

আর প্রাণিকূল একত্র হলোবরফ-পানি খেলাচ্ছলে নাম দিলো "বরফ"।



রবিন কোস্তা লুইস


রবিন কোস্তা লুইস জাতিগতভাবে একজন আমেরিকান কবি। তিনি পরিচিতি পান তার বিখ্যাত বই "Voyoga of the sable venus" এর জন্য। যা ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। এবং এই বইটির জন্য তিনি "ন্যাশনাল বুক এ্যাওয়ার্ড" লাভ করেন। লুইস জন্মগ্রহন করেন ক্যালফর্নিয়ার কোম্পটনে। তিনি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থাকে 'Master's of fine arts' ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তিতে হাভার্ড ডিভাইনিটি স্কুল থেকে 'সংস্কৃত ও তুলনামুলক ধর্মিয় সাহিত্যএর ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তার বিখ্যাত কবিতাগুলোর মাঝে অন্যতম হলো- Art and Craft, Mother Church No, The Mothers, Summer ইত্যাদি।

অলংকরণ: নবী হোসেন
আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট
সৌরভ মাহমুদ

প্রথমত আমার চিন্তা করা উচিৎ সমস্ত সঠিক উত্তর সম্পর্কে,
অতঃপর এর মাঝে কিছু চিহ্নিত করতে হবে ভুল।
যদি একটি কুইজে দশটি সমস্যা থাকেআমি বাতিল করে দেবো
যে কোনো একটি। যখন এটা বিশ হয়ে যাবেকামড়ে ধরবো নিজের জিহ্বা।

অতএব দু’টো প্রশ্ন ফাঁকা ছেড়ে দেওয়া হবে—
দ্বিতীয়টি উত্তম ছিলোকিন্তু প্রথমটি ছিলো সর্বোত্তম।
তাদের উচিৎ তোমার পোঁদে লাথি মারাডাকো তোমার বড় বোনকে
ধীরেতারাপর তাকাও তোমার টেবিলেযেনো তোমার তাকানোই উচিৎ

একটি সাঁপ বেরিয়ে আসলো ভিন্ন গর্ত থেকে। জেনে
চিন্তা করবো দ্রুত ব্যাখ্যা করার কথা সমাজের কাছে
অধিক সততার সাথেএ-কা-এ-কা।
শিল্প ও ব্যাবসায়বিদ্যার সময়যখন সম্মতি দেবেন মিস লারসন

কাঁচিটা বের করেআমার কেটে ফেলা উচিৎ এক জোড়া ছিঁচকে চোর,
অতঃপর কেটে ফেলতে হবে আমার চুলও

আমাকে আরও দীর্ঘ হওয়া থেকে থামানোর জন্যে।

রুথ স্টোন


অলংকরণ: নবী হোসেন
শব্দমালা
অনুবাদঃ মীর নিশাত তাসনিম তানিয়া

ওয়ালেস স্টিভস্ বলেন-
"একজন কবি পৃথিবীকে ঠিক সেভাবেই দেখে-
যেভাবে একজন পুরুষ দেখে একজন নারীকে।"

আমি কখনোই বুঝে উঠতে পারি না-
একজন পুরুষ একজন নারীর গভীরে মূলত কী খোঁজে?

আদৌতে সেটা-একটা মোহর সেঁটে দেয়া জগৎ।

বুজকুড়ির অবতলপৃষ্ঠ, যা সবকিছুকে টেনে নেয় অসীমের দিকে।

কালো শীর্ষযুক্ত গাছগুলোকে দেখে মনে হয় বৃদ্ধের শ্মশ্রু-
সারি সারি ঝিমুতে থাকা কমলালেবু গাছ দুলছে, যেন-সজ্জিত ধূসর দাড়ি,
তাদের বয়স্ক দাড়িগুলো কেটে ছিন্ন করছে-যাযাবর স্ত্রী মথ।

সবকটা কমলালেবু গাছ- গেঁথে যায় এই প্রতিমায়।

"একজন কবি পৃথিবীকে ঠিক সেভাবেই দেখে-

যেভাবে একজন পুরুষ দেখে একজন নারীকে।"