একটি শীতবাগান অথবা দূরের আকাশ ।। মেঘ অদিতি









বসে আছি জিনিয়া কসমসের সাথে শীতবাগানে। দু'টো ইউক্যালিপটাস থেকে পাতা ঝরছে ঝর ঝর ঝর। শুকনো পাতার স্তূপ, তার নিচ দিয়ে সরসর করে কী একটা দৌড়ে পালালো। সজারু নাকি! বাগানের এদিকটায় রোদ আছে, কিন্তু হুহু হাওয়াও দিচ্ছে খুব.. কী শীত যে করে! হাতের তালু ঘষে ঘষে গরম করি আর দেখি শীতকালে ফুলগুলো কত্ত রঙে ফোটে! ফুলের গায়ে আবার হলদে ডানার প্রজাপতি, লাল-গোলাপি-হলুদ কী যে সুন্দর দেখায় তাদের। সাদা আর গোলাপি কসমস দিয়ে লতিফ ভাই এবার বৃত্তীয় পথের এক বাগান করেছে যার ভেতর কেবল গোলকধাঁধা। একবার ঢোকো যদি সেই বৃত্তে, গাছগুলো দৈর্ঘ্যে তোমার মাথায় মাথায় আর ওরা হাত ধরাধরি করে তোমার দিকে চেয়ে প্রথমেই খুব হাসবে আর তুমি আলতো করে ওদের ছুঁয়ে ঘুরতে থাকবে, ঘুরতেই থাকবে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় অবশ্য প্রথম গাছটার কাছে পৌঁছনো যায় আর একবার কেন্দ্রটা পেয়ে গেলে তখন সেটাই একটা মজার খেলা।

আমি এখন একদম প্রথম গাছটার কাছে মাথা নিচু করে বসে আছি। একটা পাখি ডাকছে টররর-টর। 

শিল্পী, তমাল কেউ  আজ আসেনি। আজ ওদের সাথে এই বৃত্তপথে লুকোচুরি খেলাও নেই। মাঝে মাঝে ওদের এই না আসাটা আমার খারাপ লাগে না। নিজের মত করে একা একা বাগানে ঘোরা যায়। দুপুরগুলো অবশ্য আমার একারই, বেশিরভাগ দুপুর কাটে সুপুরি বাগানে। মাটিতে পড়ে থাকে ছোট ছোট দুর্বল সুপুরি। সেসব কুড়োই তখন। খোসা কেটে ভেতরটা মুখে দিলে কেমন কশকশ নরম। মা দেখলে অবশ্য ধরে নিয়ে পিঠে দু’ ঘা কষায় আর বলে, পাজি মেয়ে সারা দুপুর ঘুম নেই। খালি ঘুরঘুর করা। মা যে কী! একটু এদিকওদিক হলেই বড্ড মারে। কত ব্যথা লাগে, চোখ দিয়ে জল নামে কিন্তু মা অত দেখে নাকি। সময় কই তার, আর দেখলেই কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে সে মানুষ মা নয়, ফলে চুলের মুঠি ধরে পিঠে দু’ ঘা পড়ার যন্ত্রণাকে চোখের জল দিয়ে আর নিজের মন দিয়েই শুশ্রূষা করতে হয়। মনে মনে ভাবি তখন বড় হলে সারা শহর ঘুরে বেড়াব এইসব দুপুর বেলায়। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে ডালিম কুমার এসে হেসে হেসে হাত ধরে বলে, কী গো কন্যে, মা বকলেই অমন ঠোঁট ফুলোতে আছে! আমি তো আছি, মন খারাপ করে না, চলো তোমায় মেঘের বাড়ি ঘুরিয়ে আনি। দুপুরে ঘুমোলেই এই ডালিম কুমার আসে। রাতের ঘুমে কিন্তু কক্ষনো ডালিম কুমার আসে না তখন রাতের স্বপ্নে দেখা মেলে পাতাল ঘরে ঘাপটি মেরে থাকা এক অজানা ভয়কে। এ স্বপ্নের প্রধান চরিত্র সেই পাতাল ঘর। না, ওই ঘরে আর কোথাও কিছু নেই, কেউ নেই, শুধু আছে লাল কমলা মেশানো অদ্ভুত এক আলোর খেলা আর তার ভেতর দিয়ে উড়ে বেড়ানো এক রাশ ভয়। ঘূর্ণনরত প্যানারমিক ভিউ থেকে ভয় গুলো বড় হতে শুরু করে। তাদের প্রসারিত হাতের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর তখন নদীর পাড় ভাঙছে।  ধ্বস নামছে প্রবল আর পাতালঘরের দ্বিতীয়,  তৃতীয়, চতুর্থ দরজা একে একে খুলে যাচ্ছে। 

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ভেঙে যায়। ঘরে ডিমলাইটের ভৌতিক আলো। দেয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছে একা এক টিকটিকি। অকাতরে পাশে ঘুমাচ্ছে আমার সেজদি।

বলছিলাম আজ শিল্পী বা তমাল কেউ আসেনি। তুমি অবশ্য দু’জনের কাউকে চেনো না কিন্তু বুঝে নিয়েছ ওরা আমার বন্ধুই হবে, তাই না! বন্ধুই তো, তমাল আমার এক বছরের বড় মামাত দাদা এবং বন্ধু। আর শিল্পী আমাদের প্রতিবেশী সেই মেয়েটা যার গায়ের শ্যামলা রঙ থেকে অদ্ভুত সবুজ পোখরাজ আভা ঠিকরে বেরোয়। আমরা তিনজন মিলে টিকটিকির ডিম থেকে শুরু করে বালির স্তূপের ভেতর লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট ঝিনুক, ঘুড়ির লেজ থেকে চিতল মাছের কাঁটা কত কিছুই না জমিয়ে রাখি একটা পুরনো ট্রাঙ্কে আর হাত ধরাধরি করে আকাশের নীলে একটানা তাকিয়ে থাকতে গিয়ে দেখি চিলগুলো আকাশপথে বৃত্ত এঁকে ওড়ে। মাঝে মাঝে তমাল বা শিল্পী দুজনের একজন হয়ত থাকে না। কখনও দুজনের কেউই থাকে না, যেমন আজ। ভাবছি আজ আমি ফুলেদের বন্ধু হব। কসমস, জিনিয়া আর বোতাম ফুল  এ কথা বুঝতে পেরে হেসে উঠল আর আমায় ছুঁইয়ে দিল ঠিক তক্ষুনি। রঙের গায়ে এসে পড়ল প্রজাপতি ডানায় ভরা রোদ্দুর। কত যে আলোর ঢেউ উঠেছে তখন। সে ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে কানে ভেসে এলো মন্দ্রস্বর। 

কান পাতলাম। একটানা ভেসে আসছে সে গম্ভীর ডাক। মা বলল, ওই দেখো সমুদ্র। সমুদ্র? কিন্তু কী করে! আমি তো ছিলাম শীতবাগানে জিনিয়া ডালিয়াদের হাত ধরে। তাকিয়ে দেখি মেজদি, সেজদি ঢেউয়ের সাথে আলাপ জুড়েছে মন দিয়ে। বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে দেখছি মস্ত আকাশ মিলেছে দূরে অগাধ জলরাশির সাথে আর সেখান থেকে উঠে আসছে একটানা গম্ভীর সুর.. বুক হুহু করছে সেই ডাকে। ভেতর ভেতর দুমড়ে যাচ্ছে যেন কী.. বালিয়াড়ি ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছে ঢেউ। আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে মা, যেমনটা মা বাইরে কোথাও এলেই করে। বাবা কিন্তু হাত ছেড়ে দেয় বলে একা হাঁটো। নিজে না হাঁটলে কিছু শেখা হয় না।  মা অমন করে ভাবে না, মা ভাবে হাত না ধরলে পথ ভুল হতে পারে। আমি অত বুঝি না, মার হাতে শক্ত করে ধরে রাখা আমার হাতটা টেনে নিজের দিকে ফেরাতে চাই। মা ছাড়ে না, বলে ওই দেখো কত বড় ঢেউ আসছে। একা সামলাতে পারবে না তো। হাত ছেড়ো না। তাকিয়ে দেখি কি সুন্দর সাদা ফেনার মুকুট পরা জল উঠে আসছে আমাদের দিকে। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি। জল কাছে এলে মা আমাকে তুলে ধরার আগেই খানিক জল মুখের ভেতর ঢুকে পড়ে আর আমি অবাক, এ তো জল নয়, কী নুন.. হাত থেকে তক্ষুনি রুমালটা টুপ করে পড়ে জলে আর ঢেউয়ের সাথে দূরে সরতে থাকে দ্রুত। আরে আরে ও তো আমার প্রিয় রুমাল এক, তুমি তাকে কেন টেনে নিচ্ছ নিজের দিকে? জল দ্রুত তাকে নিয়ে ফিরে যায় নিজের বাড়ির দিকে নাকি আকাশের কাছে.. আমি ভাবি গোলাপি  ফুল আর সবুজ  ডাল আর পাতা আঁকা হেমসেলাই দিয়ে চারদিক মোড়া সে রুমালের কথা আজ যে আমায় ফেলে ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে আমায় ফেলে হারিয়ে গেল। প্রিয় কিছু হারাবার যন্ত্রণা সেই প্রথম। বুকে যন্ত্রণা বিদ্ধ হতে হতে কেঁদে ফেললাম শেষে। মা বলল, কী হলো? আমি বললাম রুমাল.. মা বলল চল ফিরতে হবে.. আমি মুখ লুকিয়ে বললাম রুমাল… সমুদ্রের একটানা ডাকে আমার শব্দগুলো কোথাও হারাতে থাকলো। আবার একটা বড় ঢেউ উঠে এলো আর জলের ঝাপটায় আমি হারালাম নিজেকে।

একটা রুমাল দিয়ে হারানো শুরু। তারপর ডাকটিকিট জমাবার খাতা, প্রিয় বই, চুলের গার্টার,  পেন্সিল কত কী  হারিয়ে গেছে। কিন্তু রুমাল হারাবার দুঃখ ঘুচে গেল যখন লতিফ ভাই দুটো পরীর ডানা সেঁটে দিল সেবার বাড়ি ফিরবার পর। তুমি কি দেখতে পাও, সে ডানা দুটো কী করে যেন আজও আমার পিঠে রয়ে গেছে.. ও, হ্যাঁ তুমি জানতে চেয়েছিলে কে এই লতিফ ভাই যার কথা তোমায় আমি প্রায়ই বলি! লতিফ ভাই আসলে আমাদের বাড়ির সমস্ত কিছু দেখাশোনা করত। কোন ছোটবেলা আসাম থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছিল বঙ্গদেশের এক ছোট্ট মফস্বলে আর কবে যেন আমাদের পরিবারে যোগ দিয়ে হয়ে উঠছিল পরিবারেরই একজন। সেদিন আমার পিঠে পরীর ডানা সেঁটে দিতে দিতে লতিফ ভাই  বলল, আজ থেকে তুমি আমাদের পরী। হোক কাগজের আমার কাছে কাগুজে ডানা আর সত্যিকারের ডানার পার্থক্য কই তখন। ডানা আর তার প্রাপ্তিতে আমার তখন কী আনন্দ, কিন্তু পরী না নিজেকে পাখি ভাবতে চাইছি তখন, বাবাকেও বলছি এ ডানায় ওড়া যাবে কি না পাখির মত। পাখির ডানা, পাখির ওড়ার কথায় বাবা এনে দিল ‘আকাশ যারা করল জয়’,  খুলে দেখি উইলভার রাইট আর অরভিল রাইট আমার ঢের ঢের আগেই ওড়াওড়ির কথা ভেবেছিল। আহা উড়োজাহাজ ওতে করে আকাশে ওড়া যায় কী আনন্দ গো!  বাবা বলল শুধু কি উড়বি, বসবি না কোথাও এক দণ্ড! হ্যাঁ তাই তো, লেবুমামার সপ্তকাণ্ড তখন পড়ে আছে উঠোনে বিছানো মাদুরের ওপর। বসিই বরং।  মাথার ওপর ছায়া দেওয়া বেলফুল গাছের ডালগুলো একে অন্যকে জড়িয়ে উঠে যাক আরও অনেকটা আকাশের দিকে। বই বন্ধ করে আমি আবার সেই আকাশ দেখি। ঝকঝকে এক মস্ত আকাশ আমায় দেখে হাসতে থাকে। 

দু’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলি, একদিন ঠিক পাখি হব দেখো, উড়ে বেড়াবো তোমার সমস্ত শরীরে, নীল থেকে দূর আরো দূরের নীলে, পাখি হব আমি, দেখো...


SHARE THIS

Author: