হে সময় হে অগ্নি হে শিলাস্তর ... তুমি কি শিমুল! এই নাম ধরে কে কাকে তোমায়? এখনও জেগে আছে কেউ? রাজা ইডিপাস? না। একজোড়া ক্ষয়িষ্ণু চোখ! চেয়ে আছে বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদের দিকে। চোখের কুঠরিতে পূর্ণিমার ঢেউ ভেঙে পড়ে যেন জলপতনের ছলাৎ! আর, আত্মজীবনীর একেকটা খসা-পাতায় পত্রপতনশীল বৃক্ষের মতো কয়েকটি লম্বা দাগ : একটু থামো, তোমার দুপায় আজ নূপুর পরাই/তুমি থামো, এক পা তুলে রাখো আমার হাতের ওপর/হাতের তালুর ওপর, রাখো তোমার উদ্যত পা... হে শিলা! আমার জমিয়ে রাখা স্মৃতি! শহর সিলেট। পল্লবী। আখালিয়া। কুমারগাঁও... শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়... সেই একটি ভবিতব্যের গাছ। যে তুমি মহীরুহ হবে, দুনিয়ের বুকে রেখে যাবে স্কেচ... হে অগ্নি হে সময়, নমস্কার! তোমার পায়ে আমার শরণ! শরণার্থী আমি। আজ কতদূর থেকে, জানালার ঝাপসা কাচে তুমি জলছবি! হে সময় সখা... আমি তো তোমার দিকে চেয়ে। এই যে দেখো... লোডশেডিঙের রাত। পূর্ণিমার ঢেউ ভেঙে পড়েছে আমাদের উঠোন জুড়ে। আর সেই অদ্ভুত আলোয় তাকিয়ে দেখি এক অচিন দেশ। গান গাইছি বলে খুন করতে এগিয়ে আসছ তুমি! ভেঙচি কাটছি বলে আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছ তুমি! সন্ধ্যা হয়ে এলো। এখনি ছুটতে হবে জিন্দাবাজার। মোস্তাক আহমাদ দীনের কাছে, বইপত্রে। তুমি নাম ধরে বলে ডাকছ! এমদাদ। এমদাদ। আমি নূপুর পরিয়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। হে অনন্ত, আর বুঝি জেগে নেই কেউ? সবাইকে হত্যা করা হয়েছে? বাহ... কী চতুর শয়তান তুমি! কিন্তু ভেবে দেখো, তুমি কিন্তু একদিন আমাদের সামনে ন্যাংটো হয়ে পড়বে। আসলে কিন্তু তুমি তোমাকেই হত্যা করছ। একদিন তোমার সঙ্গে আমার কত কথা হতো... তোমার 'আউটসাইডার' পড়া চোখ বলত : আর কোনও জ্বলজ্বলে চোখ জানালার শার্সি গলে তাকিয়ে নেই বাইরে?
: আছে। মুখ আছে। বিগত সেই মুখে বাঁশি। বেহুলার গান!
: বেহালা!
: কে বাজায়?
: ওই, ওই তো সেই হাত, বাজাচ্ছে- নখগুলো খসে পড়ে গেছে!
: রাজা!
: তুমিই রাজা ইডি... ঘুরছি। বইপত্র থেকে, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের 'অলীক মানুষ' কিনে, জিন্দাবাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে আম্বরখানা পয়েন্ট। কোথায় চলেছি! তুমি কোথায়? আজ একটি বই দেখে এসেছি। কাল কিনতে যাব আবার। শরণার্থীর ঋতু ও অন্যান্য প্রবন্ধ। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। কতজন আমরা! এক দঙ্গল মুখ। সুবিদবাজার পেরিয়ে মদিনা মার্কেট পেরিয়ে ঢুলতে ঢুলতে ফিরে চলেছি ক্যাম্পাসে।
: তোমার সামনে পাত্র উপচানো রক্ত। টকটকে লাল। চারপাশে খুন, আর্তের চিৎকার, নয়?
: না, আমি বীণাবাদিনি। সরস্বতী। দেখো, আমার নাভি ঝলসে যাচ্ছে।
: আমি রুগ্ন মানুষের ছায়া নিয়ে শুনি পায়ের আওয়াজ।
: জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে থাকে এইসব। ঘামে শরীর যেমন জবজব করে, চুম্বনের ঘ্রাণ যেমন পৌঁছে যায় ঠোঁট থেকে ঠোঁটে, পরস্পরের প্রাত্যহিক কথোপকথনে, মৃত্যু যেমন দৃশ্যের জন্ম দেয়, ভাঙে, গড়ে আর আমরা...
: আমি-
: আমি চণ্ডাল
: তবে দেখাও তোমার বুক!
: না
: দেখাও, নয় কেন!
: না, এ অসম্ভব আবদার। এ বুকে এ্যাপাচি হেলিকপ্টার রেখে গেছে ক্ষত!
: এসব অলীক, স্বপ্ন, মিথ্যা
: মিথ্যা! মিথ্যা হবে কেন?
: এখন তুমি, বীণাবাদিনি, অদৃশ্য হবে, ক্রমশ এবং ক্রমাগত!
: অর্জুন!
: না, এ অসম্ভব। আমার কবজকুণ্ডুলী নেই। নিঃস্ব। দেখো, চিকচিক করছে লবণাক্ত জল। বৃষ্টি হলে নাকে শুধু হারানো দিনের গন্ধ এসে লাগে। প্রতিদিন তাই এক অপেক্ষা করি, সেই ওম, মাতৃগর্ভের ওম! যদি কোনও ফেরিওয়ালার কাছে পাওয়া যায়!
: মুখের রেখায় দুই-দুইটি যুগের ঘাম, গন্ধ, জন্মাবধি মৃত চোখ-
: জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন জননী ও জনক। নিজেও সিকি শতাব্দী পার করে দিয়েছি।
: অথচ, জন্মমুহূর্তের কান্না!
: সেই কান্না আর কোনোদিন কাঁদতে পারব না।
: অর্জুন!
: অথচ, স্খলন মুহূর্তে চিৎকার করে উঠি- জন্ম, জন্ম।
: তখন, এই অতলভ্রম কাটানোর জন্য খুঁজি তোমার অট্টহাসি। কিন্তু পেয়ে যাই তার চেয়েও কঠিন কিছু। পাথরের ভাষা। অহল্যা।
: আজ, এই বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে, মেঘে মেঘে যখন শাদা হাতির পায়চারি, তখন তুমি কোথায়?
: সর্বনাশে।
: দেখো, বৃক্ষগুলো পত্রপতনশীল।
: মৃত।
: কঙ্কালসার।
: আমাদেরই বংশধর!
: বিষাদ?
: বিষাদ...
: লাইব্রেরি বিল্ডিঙয়ের সামনে কদম গাছটার ঝুমবৃষ্টিতে ভিজতে থাকার এক অসম্ভব দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রায় ফাঁকা হয়ে আসা রাস্তায় আমি একদিন শুধু তোমার হেঁটে যাওয়া দেখবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব।