রক্তদোষ
কবিদের প্রতি শেষ আদেশ-
এ তল্লাট ছেড়ে যাও- সরে পড়ো এখনই চুপচাপ।
আর, তোমাদের স্ত্রী ও প্রেমিকাদের কাছে
জমা দাও সন্তানের নামের তালিকা ;
মনে রেখো, যে সন্তান এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি,
তার পিতৃত্বের দাবিদার তুমি নও।
আর শুনে রাখো, আমরা যাদের বার্থ সার্টিফিকেট দেবো-
নাম আর স্বীকৃতির সীলমোহর সাঁটা,
তারা হবে এ তল্লাটে পরবর্তী কবি।
যেহেতু তোমরা কেবল ভালবাসতে জানো,
যেহেতু তা কোনও মহাজনের গোলা
ভরে তোলে না কাঙ্ক্ষিত ধাতব শস্যে,
যেহেতু তোমরা আঙুল তোলো
রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগায়-
সেহেতু এই আবাস তোমাদের নয়।
তোমরা হুকুম তামিল করতে শেখোনি ;
রক্তের দোষ!
তোমাদের পিতৃপুরুষ ও গর্ভধারিণী মা
জন্মক্ষণে বলে দেননি- মাথা নত করতে হয়
কিভাবে - কখন!
নিরাপদ
এইসব নিরাপদ রাত আর দিনগুলোকে কি করবো আমি?
কি করবো আমাকে, এইসব নিরাপদ
রাত আর দিনের ভিতরে ?
বোধের আকাশকুসুম আরামের ধূম্রপথে
ধীর পায়ে চলা, যেন বা স্থবির এ্যমিবা-
যেন বা খোঁয়াড়-পালিত উট- উটের গ্রীবা,
কেন?
কি করবো এইসব গ্রীবার ভিতরে আমাকে
অথবা
আমার ভিতরে অনিচ্ছুক গ্রীবার আবাদ?
এ বিশাল খোঁয়াড়ে আমার
এইসব নিরাপদ রাত আর দিন
পুঁতে রেখে নষ্ট ভূমিতে অনর্থ বীজের বপন-
খেয়ে নেবে ধীরে ধীরে মাটি আর নীরব প্লাবন।
আদতে আমরা সেই জোয়ারের পানি!
কেবল, কখনো কেউ কেউ
সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ভালবেসে যদি
হতে চায় বাঁধভাঙা নদী,
বিধ্বংসী প্রলয়ের ঢেউ -
আমাদের সমুখে দাঁড়ায় এইসব নিরাপদ রাত আর দিন!
খুব ভিতরে টের পাই, মৃত্যুও জীবনের মতোই রঙিন?
ব্যতিহার
যদি আমি লিখে যাই কিছু কিছু শব্দরূপ-
যেমন- 'মৃত্যু'; যেমন- 'ভালবাসা';
যদি লিখে যাই 'যক্ষ্মা' একটি কষ্টকর জীবনের নাম-
কখনো তোমার হাতে উড়ে গিয়ে পড়লে সেই চিঠি-
কী ভাববে তুমি? কল্পনায়?
ভাববে কি অপত্য ভালবাসাহীন একটি শুশুক সন্তানের কাছে যেতে পারেনি কখনো?
পাল্টানো জলের স্রোতে সন্তানের পাখনা- কানকো
খুঁজে পায়নি পিতার প্রবাল?
ধরো, আমি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিখলাম- 'প্রসাদ' ;
নিদারুণ অভিমান নিয়ে লিখলাম- 'ফেরারি';
অস্থির উন্মাদের মতো লিখলাম- 'প্রশান্তি';-
কোনও সায়াহ্নে বসে একাকী পাহাড়ের অন্ধকার চিবুকের কাছে
গড়িয়ে পড়ার আকুতি জানালে
পাহাড়টি আমাকে বক্ষ খুলে দেবে। আর,
আমি মৃত্যুর বদলে ঝুলে থাকবো স্তনবৃন্তে তার।
যেহেতু জেনেছি পাহাড়ের যোনির ভিতরে যেই ঘুম-
সেই সুধা ছেড়ে আর ফেরা হয় না।
এইভাবে ঝুলে থেকে রাত বাড়বে, হয়তো;
এই চরাচরে বাড়বে স্বাভাবিক শেয়ালের গান;
তুমি হয়তো অংশ নেবে সেই নৈশভোজে!
তখন হঠাৎ উড়ে
তোমার সমুখে পড়লে হলুদ বোতাম-
ঝুলে থাকা ছেঁড়া জামার বুকের উদাম-
কি ভাববে সেই সিল্কি সময়ে?
ভাববে কি- 'বোতামটা লাল হলে আরো ভালো হতো '?
অনাহূত
শোনা যায়, বাতাস-ছেঁড়া হৈহৈ রৈরৈ?
শোনা যায়, অনাহূত বখতিয়ারের পায়ের আওয়াজ?
সুতরাং খিড়কি খুলে দাও,
তুলে রাখো অসমাপ্ত হাতের কার্যাদি,
কৃষ্ণবর্ণ বহুচর্বিত গলিত রমন।
বামন যুগের শেষ বাঁশি
তোমরাই বাজিয়েছ এ মোহনা-মন্দিরে।
কান্তার পাহাড় হতে সব ক'টি খিড়কি, অন্দরে-
ঘন অন্ধকারে ডুবে যুবতি, রমনী,
শিশু ও বলিষ্ঠ কাপুরুষ-
ভুলে গেছে আপন সুরত!
অতলান্ত বৃষ্টি প্রার্থনায়
তোমরাই ছড়িয়েছ এ নগর বাতাসে
আবেদন গন্ধী রস, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস!
অতএব
দূর থেকে উড়ে এলে অনাহূত যোদ্ধা বখতিয়ার
ধুলোর- ক্ষুরের শব্দে- খুলে দাও সমূহ দুয়ার।
বিভ্রম
এ দুঃখ গেলো না আমাদের, এই ভ্রান্তি!
তিন রাস্তার মোড়ে গেলেই
আমরা পথ হারিয়ে ফেলি বারম্বার।
তারপর আমরা দশ বন্ধুর নয়জন তিনভাগ হই,
একজন বসে পড়ি তিনরাস্তার মোড়ে।
মূলত একজনের পথ খুঁজে পাবার কথা নয়।
তবু সান্তনা,
আমরা তিন বন্ধু এক আছি, এবং
তিন পথের একপথ ধরে চলছি এখনো।
চলতে চলতে আরেকটু সামনে গেলেই
আরেকটি চার রাস্তার মোড়।
চারভাগ হতে গিয়ে দেখি - চার রাস্তার মোড়ে
বসে পড়ার লোকটিও কম আছে।
তাতে আমরা থেমে পড়ি না। থামতে হয় না।
অধিকন্তু পেয়ে যাই অচেনা মুখের এক ঝাঁক সাথি।
ভুল রমন উৎফুল্ল করলে আমরা টের পাই না
হাতের উৎস ও পরিধি।
মুলত, পথ বিষয়ে আমরা কবিতা লিখতে পারতাম,
অথবা, পথকে অস্বীকার।
কিন্তু, ততোদিনে দেরি হয়ে যায়।
ততোদিনে আমরা টের পাই, আমাদের ঘাড়ে অন্যের হাত,
আমাদের পায়ে গোপন পথে আসা বিদেশি জুতো।
আমরা চাইলেও আর যেতে পারি না কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে আমাদের।
একটা সফল ভ্রমণ শেষে
আমরা জমা করি নয় বা ততোধিক পথের ইতিহাস।
সেখানে অবশিষ্ট থাকে আমাদের হাড়ে
বিদেশি মদের ঘ্রাণ।
জিলাপির ভিতরে ঢুকে পড়ি
জিলাপির ভিতরে আমি ঢুকে পড়ি-
জিলাপির আঠালো সুমিষ্ট রসের ভিতরে;
জল্লাদের হাতের মুঠোয় ঝুলন্ত দড়ির বিভ্রান্তির ভিতরে।
তারপর একঝাঁকে, একই মিছিলে
দেখা হয় অজস্র জিলাপির সাথে, ঐকান্তিক;
যেন বা খলসে পোনার মতো ছটফটে ধাবমান
এক ঝাঁক মৃত্যু,
এক প্রস্থ্য জীবন অথবা সাইক্লোন-কবলে পড়া নাবিকের জাহাজের শুঁড়!
তারপর, একটি কালচে-লাল পিঁপড়ার মতো
কোন ফাঁকে হয়ে উঠি শীতের 'রসদবাদী'!
কে না জানে -
পিঁপড়ার প্রসঙ্গে দু'টি কথা সমধিক সত্য -
এক, পিঁপড়েরা জিলাপির অন্ধ মুরিদ ;
দুই, লবন দিয়ে পিঁপড়ে খেতে মচমচে মজা!
এটুকু বলেই আমি হেসে উঠতে পারতাম হো হো!
কিন্তু, তৃতীয় সত্য হচ্ছে -
পিঁপড়েরা কাঁদতে জানে না।
যে কাঁদতে জানে না তাকে নিয়ে হাস্য করা সমীচীন নয়।
বিচারালয়
কাঠগড়া থেকে নেমেই গ্যালিলি বললেন
-মহামান্য আদালত, সব কিছুই ঘূর্ণায়মান।
নক্ষত্র, পৃথিবী, চাঁদ,
অক্ষিগোলক,হৃদয়, মানুষের হৃদয়ের ফাঁদ;
এমনকি সত্য, এমনকি মিথ্যা, আপনার হাতের কলম,কলমের নিভ।
মহামান্য আদালত, ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখুন,
পশ্চাতে আপনার ছায়া পৃথিবীর সেরা কৌতুক।
এখনো যারা ঘুরঘুর করে ঘুরছে এই বিচারালয়ে,
মূলত বের হবার পথ ভুলে গিয়ে, তাদেরকে আদেশ দিন জামা- পাতলুন উল্টায়ে পড়ে আসতে; এবং সঙ্গমকালে তারা যেন সমধিক ঘূর্ণন রপ্ত করে।
মহামান্য আদালত, আমরা যারা আপনাকে মহামান্য বলি- আপনি কি বাড়ি ফিরে রেচনক্রিয়া করতে করতে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন? আমাদের নির্বুদ্ধিতায়?
গ্যালিলিও গ্যালিলি ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর দিকে দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে বললেন, মহামান্য আদালত,
মানুষ কি ক্রমেই অস্বীকার করছে প্রপিতার নাম?
মানুষ কি দেখতে পাচ্ছে না যারযার মাথার খুলির ক্রম নিমজ্জন?
একদিন, যেদিন অন্ধকারে
টলে উঠবে বিচারালয়, টলে উঠবে চেয়ারের পায়া -
আমি বলবো, এখানে একটি মিথ্যার জাদুঘর হোক।
গ্যালিলিও গ্যালিলির অকস্মাৎ হিসু পেলে -
পৃথিবীর সর্বত্র তিনি দেখতে পেলেন পাপ ও পঙ্কিল ক্ষত।
বিচারালয় তাকে জেলে পাঠালেন।