সিরিজ কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সিরিজ কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
হাসনাত নাগাসাকি এর গুচ্ছ কবিতা

হাসনাত নাগাসাকি এর গুচ্ছ কবিতা


রক্তদোষ 

কবিদের প্রতি শেষ আদেশ-
এ তল্লাট ছেড়ে যাও- সরে পড়ো এখনই চুপচাপ।

আর, তোমাদের স্ত্রী ও প্রেমিকাদের কাছে
জমা দাও সন্তানের নামের তালিকা ;
মনে রেখো, যে সন্তান এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি,
তার পিতৃত্বের দাবিদার তুমি নও।
আর শুনে রাখো, আমরা যাদের বার্থ সার্টিফিকেট দেবো-
নাম আর স্বীকৃতির সীলমোহর সাঁটা,
তারা হবে এ তল্লাটে পরবর্তী কবি।

যেহেতু তোমরা কেবল ভালবাসতে জানো,
যেহেতু তা কোনও মহাজনের গোলা
ভরে তোলে না কাঙ্ক্ষিত ধাতব শস্যে,
যেহেতু তোমরা আঙুল তোলো
রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগায়-
সেহেতু এই আবাস তোমাদের নয়।

তোমরা হুকুম তামিল করতে শেখোনি ;
রক্তের দোষ!
তোমাদের পিতৃপুরুষ ও গর্ভধারিণী মা
জন্মক্ষণে বলে দেননি- মাথা নত করতে হয়
কিভাবে - কখন!

নিরাপদ

এইসব নিরাপদ রাত আর দিনগুলোকে কি করবো আমি?
কি করবো আমাকে, এইসব নিরাপদ
রাত আর দিনের ভিতরে ?

বোধের আকাশকুসুম আরামের ধূম্রপথে
ধীর পায়ে চলা, যেন বা স্থবির এ্যমিবা-
যেন বা খোঁয়াড়-পালিত উট- উটের গ্রীবা,
কেন?
কি করবো এইসব গ্রীবার ভিতরে আমাকে
অথবা
আমার ভিতরে অনিচ্ছুক গ্রীবার আবাদ?

এ বিশাল খোঁয়াড়ে আমার
এইসব নিরাপদ রাত আর দিন
পুঁতে রেখে নষ্ট ভূমিতে অনর্থ বীজের বপন-
খেয়ে নেবে ধীরে ধীরে মাটি আর নীরব প্লাবন।
আদতে আমরা সেই জোয়ারের পানি!

কেবল, কখনো কেউ কেউ
সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ভালবেসে যদি
হতে চায় বাঁধভাঙা নদী,
বিধ্বংসী প্রলয়ের ঢেউ -
আমাদের সমুখে দাঁড়ায় এইসব নিরাপদ রাত আর দিন!
খুব ভিতরে টের পাই, মৃত্যুও জীবনের মতোই রঙিন?

ব্যতিহার 

যদি আমি লিখে যাই কিছু কিছু শব্দরূপ-
যেমন- 'মৃত্যু'; যেমন- 'ভালবাসা';
যদি লিখে যাই 'যক্ষ্মা' একটি কষ্টকর জীবনের নাম-
কখনো তোমার হাতে উড়ে গিয়ে পড়লে সেই চিঠি-
কী ভাববে তুমি? কল্পনায়?
ভাববে কি অপত্য ভালবাসাহীন একটি শুশুক সন্তানের কাছে যেতে পারেনি কখনো?
পাল্টানো জলের স্রোতে সন্তানের পাখনা- কানকো
খুঁজে পায়নি পিতার প্রবাল?

ধরো, আমি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিখলাম- 'প্রসাদ' ;
নিদারুণ অভিমান নিয়ে লিখলাম- 'ফেরারি';
অস্থির উন্মাদের মতো লিখলাম- 'প্রশান্তি';-
কোনও সায়াহ্নে বসে একাকী পাহাড়ের অন্ধকার চিবুকের কাছে
গড়িয়ে পড়ার আকুতি জানালে
পাহাড়টি আমাকে বক্ষ খুলে দেবে। আর,
আমি মৃত্যুর বদলে ঝুলে থাকবো স্তনবৃন্তে তার।
যেহেতু জেনেছি পাহাড়ের যোনির ভিতরে যেই ঘুম-
সেই সুধা ছেড়ে আর ফেরা হয় না।

এইভাবে ঝুলে থেকে রাত বাড়বে, হয়তো;
এই চরাচরে বাড়বে স্বাভাবিক শেয়ালের গান;
তুমি হয়তো অংশ নেবে সেই নৈশভোজে!

তখন হঠাৎ উড়ে
তোমার সমুখে পড়লে হলুদ বোতাম-
ঝুলে থাকা ছেঁড়া জামার বুকের উদাম-
কি ভাববে সেই সিল্কি সময়ে?

ভাববে কি- 'বোতামটা লাল হলে আরো ভালো হতো '?

অনাহূত 

শোনা যায়, বাতাস-ছেঁড়া হৈহৈ রৈরৈ?
শোনা যায়, অনাহূত বখতিয়ারের পায়ের আওয়াজ?
সুতরাং খিড়কি খুলে দাও,
তুলে রাখো অসমাপ্ত হাতের কার্যাদি,
কৃষ্ণবর্ণ বহুচর্বিত গলিত রমন।

বামন যুগের শেষ বাঁশি
তোমরাই বাজিয়েছ এ মোহনা-মন্দিরে।
কান্তার পাহাড় হতে  সব ক'টি খিড়কি, অন্দরে-
ঘন অন্ধকারে ডুবে যুবতি, রমনী,
শিশু ও বলিষ্ঠ কাপুরুষ-
ভুলে গেছে আপন সুরত!
অতলান্ত বৃষ্টি প্রার্থনায়
তোমরাই ছড়িয়েছ এ নগর বাতাসে
আবেদন গন্ধী রস, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস!


অতএব
দূর থেকে উড়ে এলে অনাহূত যোদ্ধা বখতিয়ার
ধুলোর- ক্ষুরের শব্দে- খুলে দাও সমূহ দুয়ার।

বিভ্রম

এ দুঃখ গেলো না আমাদের, এই ভ্রান্তি!

তিন রাস্তার মোড়ে গেলেই
আমরা পথ হারিয়ে ফেলি বারম্বার।
তারপর আমরা দশ বন্ধুর নয়জন তিনভাগ হই,
একজন বসে পড়ি তিনরাস্তার মোড়ে।
মূলত একজনের পথ খুঁজে পাবার কথা নয়।

তবু সান্তনা,
আমরা তিন বন্ধু এক আছি, এবং
তিন পথের একপথ ধরে চলছি এখনো।

চলতে চলতে আরেকটু সামনে গেলেই
আরেকটি চার রাস্তার মোড়।
চারভাগ হতে গিয়ে দেখি - চার রাস্তার মোড়ে
বসে পড়ার লোকটিও কম আছে।

তাতে আমরা থেমে পড়ি না। থামতে হয় না।
অধিকন্তু পেয়ে যাই অচেনা মুখের এক ঝাঁক সাথি।
ভুল রমন উৎফুল্ল করলে আমরা টের পাই না
হাতের উৎস ও পরিধি।

মুলত, পথ বিষয়ে আমরা কবিতা লিখতে পারতাম,
অথবা, পথকে অস্বীকার।
কিন্তু, ততোদিনে দেরি হয়ে যায়।
ততোদিনে আমরা টের পাই, আমাদের ঘাড়ে অন্যের হাত,
আমাদের পায়ে গোপন পথে আসা বিদেশি জুতো।
আমরা চাইলেও আর যেতে পারি না কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে আমাদের।

একটা সফল ভ্রমণ শেষে
আমরা জমা করি নয় বা ততোধিক পথের ইতিহাস।
সেখানে অবশিষ্ট থাকে আমাদের হাড়ে
বিদেশি মদের ঘ্রাণ।

জিলাপির ভিতরে ঢুকে পড়ি

জিলাপির ভিতরে আমি ঢুকে পড়ি-
জিলাপির আঠালো সুমিষ্ট রসের ভিতরে;
জল্লাদের হাতের মুঠোয় ঝুলন্ত দড়ির বিভ্রান্তির ভিতরে।

তারপর একঝাঁকে, একই মিছিলে
দেখা হয় অজস্র জিলাপির সাথে, ঐকান্তিক;
যেন বা খলসে পোনার মতো ছটফটে ধাবমান
এক ঝাঁক মৃত্যু,
এক প্রস্থ্য জীবন অথবা সাইক্লোন-কবলে পড়া নাবিকের জাহাজের শুঁড়!

তারপর, একটি কালচে-লাল পিঁপড়ার মতো
কোন ফাঁকে হয়ে উঠি শীতের 'রসদবাদী'!

কে না জানে -
পিঁপড়ার প্রসঙ্গে দু'টি কথা সমধিক সত্য -
এক, পিঁপড়েরা জিলাপির অন্ধ মুরিদ ;
দুই, লবন দিয়ে পিঁপড়ে খেতে মচমচে মজা!
এটুকু বলেই আমি হেসে উঠতে পারতাম হো হো!
কিন্তু, তৃতীয় সত্য হচ্ছে -
পিঁপড়েরা কাঁদতে জানে না।

যে কাঁদতে জানে না তাকে নিয়ে হাস্য করা সমীচীন নয়।

বিচারালয়

কাঠগড়া থেকে নেমেই গ্যালিলি বললেন
-মহামান্য আদালত, সব কিছুই ঘূর্ণায়মান।
নক্ষত্র, পৃথিবী, চাঁদ,
অক্ষিগোলক,হৃদয়, মানুষের হৃদয়ের ফাঁদ;
এমনকি সত্য, এমনকি মিথ্যা, আপনার হাতের কলম,কলমের নিভ।

মহামান্য আদালত, ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখুন,
পশ্চাতে আপনার ছায়া পৃথিবীর সেরা কৌতুক।
এখনো যারা ঘুরঘুর করে ঘুরছে এই বিচারালয়ে,
মূলত বের হবার পথ ভুলে গিয়ে, তাদেরকে  আদেশ দিন জামা- পাতলুন উল্টায়ে পড়ে আসতে; এবং সঙ্গমকালে তারা যেন সমধিক ঘূর্ণন রপ্ত করে।

মহামান্য আদালত, আমরা যারা আপনাকে মহামান্য বলি- আপনি কি বাড়ি ফিরে রেচনক্রিয়া করতে করতে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন? আমাদের নির্বুদ্ধিতায়?

গ্যালিলিও গ্যালিলি ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর দিকে দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে বললেন,  মহামান্য আদালত,
মানুষ কি ক্রমেই অস্বীকার করছে প্রপিতার নাম?
মানুষ কি দেখতে পাচ্ছে না যারযার মাথার খুলির ক্রম নিমজ্জন?
একদিন, যেদিন অন্ধকারে
টলে উঠবে বিচারালয়, টলে উঠবে চেয়ারের পায়া -
আমি বলবো, এখানে একটি মিথ্যার জাদুঘর হোক।

গ্যালিলিও গ্যালিলির অকস্মাৎ হিসু পেলে -
পৃথিবীর সর্বত্র তিনি দেখতে পেলেন পাপ ও পঙ্কিল ক্ষত।
বিচারালয় তাকে জেলে পাঠালেন।
শামসেত তাবরেজী এর দশটি কবিতা

শামসেত তাবরেজী এর দশটি কবিতা


অনেকদিন পর আম্মাকে

কাঁপা কাঁপা ফুলগুলি-  তাদের স্বর
আপাতত হয়ে আছে বোধিশ্বর

যেহেতু কাঙ্খ্যা করে চেয়েছি ওদের
অভিকর্ষ টানে ওরা মজেওছে ঢের।
ভাঁজের ভিতর ভাঁজে বর্ণালি ঢেউ
খুশ দিলে দেখা যাচ্ছে আম্মাকেও।
এক ক্ষণকালে তারা সূর্য পরিধি
ঘুরে এসে আমাকেই বানিয়েছে নিধি।
আমি তো অবাক! হল বন্ধ জবান,
ওরা মুখে ভাষা দিয়ে রাখল প্রমাণ
মিছেমিছি নয় এই কেঁপে-কেঁপে ওঠা
আমার জন্যেই নাকি বিদগ্ধ ফোটা!
ক্রমশ অবাক হই শুনে বহু সূর
এক সঙ্গে কলেমা পড়ে, মদিনা-সুদূর
সুরভিত মালা হয়ে, গায়ত্রী গরিমা
ক্ষণে ক্ষণে অতিক্রমে’ রেখায়িত সীমা।

স্বরগুলি কাঁপা কাঁপা বিবর্ত ফুল
বাগানে বসে থাকা- আম্মা-  পারুল!

নুসরাতের জন্য

বলল বাতাস, ‘নুসরাত’, আমি নিরুত্তর।
হত্যাকারীর দেশে বসে চিবাই পান,
হাড় সাজিয়ে বানাচ্ছি প্রতিষ্ঠান,
এনেছি ডেকে ইহুদি কজন ওস্তাগর।

এ্যাই, তোমরা শরীর খোলো-  ব্যক্তিবাদ
চালু হচ্ছে ধর্ষে আপন আত্মজা,
দিল্লি থেকে আনিয়েছি মত্ত ষাঁড়
ইলেকট্রিকের তারে বসে বলল চাঁদ।

অশ্বডিম্ব আগলে রাখেন কয় নফর
মিষ্টদ্রব্য বিলি করেন মরণচাঁদ,
এটাই খাঁটি বিয়ের ধর্ম, ও নুসরাত,
সিরাজুদ্দৌলা নিজেই মীরজাফর।

বিকার

কি তুমি ভাবো? উৎপন্ন দধির
কণা ও কণাদ কেন নয় স্থির?
কেন ঘূর্ণি এ ঘৃণার পাঁক দেওয়া ব্যথা
সইতে হচ্ছে? তুমিই সুচেতা,
যদিও শব্দমূলে আর কিছু রয়,
ফুটন্ত ফোনেমের  মুহূর্ত-প্রলয়।
তুমি ভাবো বেশ্যা প্রণীত রাত
পবিত্র নয়? উরুস্তম্ভে দাঁত
বসালেই ধরে নিতে হবে হয়ে গেল পাপ?
পূণ্যও কি দ্যাখো নাই বিলাপ-
মাত্র? আদি ও অনাদি একাকার
হয়ে হয়ে গুলঞ্চলতায় ত্রিমুখী বিকার!
প্রেম, তুমি ভাবো চক্রাকারে ঘুরে
তমোঘ্ন তিথিতে থামবে? গত পরশুরে
বর্তমান বানিয়ে ফেনিল তরঙ্গয়
মেঘমধু ঘষে ঘষে দেহটার করবে বিলয়!

বৈকালিকী

বইয়ের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে
মোড়া টেনে বারান্দায় বসল বিকেল,
আইভিলতার ছায়া মদ-রং রোদ্দুরে মেশে
এক চিলতে হাসি যেন হঠাৎ গড়ানো মার্বেল।

গত বৎসর শীতরাত্রি পড়ে গেছে মনে?
একটি হরিণ হিয়া হারিয়ে কাঁদছিল একা
চন্দন গন্ধ গম্ভীর বিধুর কাননে,
কিন্তু তাতে হাসি কেন? কি বলে ফেকাহ্-

শাস্ত্রগুলি এইসব   স্ববিরোধী ঘটনা ঘটলে?
তোমাকে বুঝে নি কেউ-   উগ্রবাদী সভা,
বুঝ হতে হতে মেদমত্ত গল্প রটলে
তুমিও খোঁপায় পরো নি সামাজিক জবা।

গোপন ঈর্ষার আগুনে তাহলে তুমিও  পুড়ো?
ক্লান্তিকর অধ্যাপকের কাছ থেকে ছোট হয়ে আসো?
তাও কি প্রণয়ই নয়? জ্ঞান থাকে গৃহস্থ পশুরো,
এই কি কার্যকারণ যার জন্য মিহি করে হাসো!

প্রতিদিন নয়, আজ হেসে উঠল প্রচ্ছদ সরিয়ে
ইয়োলো অকার ছাওয়া সংক্ষিপ্ত শান্ত বিকেল,
কিছু আনন্দ-বা থাকে দুঃখের অতীত জড়িয়ে
 ভেবেছ কি সব কথা বলেছে বুড়ো বাইবেল?

সংসার এমনই-  পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিটা বলে
অসাচ্চা বাঁচাই সার মা-  আসলে তো পুড়ছ অনলে!

কেনা শেখা

দিন, দুটো টাকা দিন
কিছু কিনে খাই

আপনিও তো কেনেন, কেনেন না?

পরনারীর জন্যে সুবাসিত জাঙ্গিয়া
চর্বিহীন চাঁদের অমেয় সম্ভার

কালও দেখেছি  স্বপ্নজঙ্গলের ভিতর একটা হরিণের খাল খুলছেন আপনি
একটা প্রাকৃতিক পোলকা-ডট জ্যাকেট যে তার চাইই চাই
যা থেকে মৃগনাভির খোশবু বেরোবে
জাগিয়ে দেবে আপনার ক্ষমতাধর লোহা

প্রাণপণে চেষ্টা করেছি আরো ঘুমাতে যেন আমার দৃশ্যপর্দার বাইরে
দিনটা কেটে যায় দ্রুত আর নামে রাত্রি আবার অকাল ঘুমের
কিন্তু ঘুমটা চটকে দিয়ে গেল ও
ও মানে! আমি ভুলে গেছি তাও
না খেতে খেতে।

এত গরিবের বাচ্চা আমি ক্ষুধার আগুন লকলকিয়ে ওঠে সূর্যটা উঠতেই

দিন, দুটো টাকা দিন
আপনিও তো কেনেন, কেনেন না?
কবুতরের বুক কেনেন আপনি পারী থেকে
আর খোদ মার্কিন দেশ থেকে কেনেন অধিক আলট্রাথিন কনডম

কালই তো দেখলাম, কাল না পরশু
আপনি একটা বউ কিনলেন প্রথিতযশা নাট্যকারের কাছ থেকে

আমি তো কিছু মনে করি নাই তাতে?

বিশ্ববিতানে থুতু ফেলা হোমোস্যাপিয়ান আমরা
কিছুই যদি না কিনি কেমন দেখায় না?

দিন, দুটো টাকা দিন
কিছু কিনে খাই
খেয়ে কিনি আপনার মতাদর্শটাই

নামপদী ছলনা

ভোর কাটল পার্পলতায়
 রাত কাটল নীলে,
পর-স্ব রং নীরবতায়
 স্তব্ধ আঁচিলে।

একটু পর-  মানুষ হল লাশ।

প্রাচীর উঠল শূন্যজুড়ে
 আকাশ সঙ্কুচিত,
আজদাহাটা দাঁড়িয়ে দূরে
 ভ্যাবলা অসংস্কৃত।

চৈত্রে এ কি নতুন সর্বনাশ!

সাধের লাউয়ের ডুগডুগিতে
 শুধুই প্রবঞ্চনা,
ব্যক্তিসংঘে, জাতীয় গীতে
 নামপদী ছলনা।

এসব দেখে কবি খাচ্ছেন সিন্থেটিকের ঘাস!

(আবার)

ভোর কাটল...

সন্দেহবাদ

নিত্য সন্দেহ মনে
যমুনা কি সত্যিই বহে?
কারই বা দুধভরা স্তনে
ঈশ্বর একা একা দহে!

মাটিতে পড়ে থাকা ফুলে
কার স্পর্শ বীজময়?
কে তাকে চড়িয়েছে শূলে,
কার রক্তে হাত ধোয়?

বই খুলি, উত্তর নাই,
আর-কোথা যমুনা বিলীন,
পেকে পচে যায় জলপাই
সমগ্র শূন্যের অধীন।

সাধ

আয়ুষ্কাল ছাড়িয়ে গিয়ে উড়তে গেছে সারস
আবার-  আকাশ সীমা লঙ্ঘনের দায় নিতেও রাজি
জানা যায় নি কোথায় পেল এমন দুঃসাহস
নাকি-   এও হবে নতুন কোন তত্ত্বীয় কারসাজি!

আর, আমি বসুন্ধরা থেকে গ্রিনরোডে আসতে গিয়েই হাঁপাই

ভুলে গেছি আমারও ছিল ঝালর দেওয়া ডানা
শুধু-  আবছা দেখতে পেতাম একজোড়া কৈতর
নিকটতম দূরত্বে দেখেছি মটরদানা
কঁকিয়ে উঠে হতে চাইত শুধুই নৈশর

এসব স্নিগ্ধ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি নিতে আমি এখন হাফ-আখড়াই গাই

সাধ্য নাই, সাধ রয়েছে যুদ্ধে যাব ফের
মধ্যমনি যদিও তুমি হারানো প্রাচ্যের!

স্বাধীনতার উড়ালহীন পাখির গান

পাখির আদল নিয়ে বসে আছে পাখি
কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই, নাই তাকাতাকি,
কম্পুটার পর্দার ঝালরের তলা থেকে আসা
উজবুক লোকদের আহ্লাদের নানাবিধ ভাষা
তর্জমা করে করে ব্যথা হয় চম্পক আঙুল
আর সব ঘাড়-মোটাদের যাবতীয় বানানের ভুল
শুধরে দিতে দিতে মনে পড়ে তার
কোথায় সে পেল গুপ্ত ডানার বাহার?
অথচ উড়াল নাই, আকাশ-গঙ্গার নক্ষত্র-মাছ
ঝিলিক মারে নি কোনদিন, গ্রহের পিশাচ-
গুলি নাস্তানাবুদ রাখে স্বার্থ শিবিরে,
ঠাণ্ডা কফির মধ্যে নুলা এক পোকা সাঁতরায়
হয়ত ভাবছে,  বাঁচতে চায় না এই পোড়া দেশে
হয়ত মৃত্যুর ধারনা পেয়ে গেছে ও,
এসব তো এখন প্রত্যহের চ্যানেলিয়া-শো।
পাখি দ্যাখে তাই এক ফাঁকে ঘাড় ব্যথা ক’রে
এমন কি হবে বুঝি কেউ আছে ম’রে
অতলান্ত গহ্বরে তার, তাও-  সে কত কত কাল,
সেই থেকে তার আর হয় নাই উড়াল!
কবিরা মস্করা করে: মুক্তি হবে তোর
সে দিন-  যে দিন খুঁড়বি নিজ হাতে গোর।
পাখি তবু ভ্রূক্ষেপ করে না, পানপাতা-হাতে
লিখে যায় বাকীদের বেতন বৃদ্ধি, প্রমোশন যাতে
দ্রুত হয় কেননা তাদের ডানা আরো
শক্ত না হলে পার্টি হবে না জম্পেশ, রাত্রির গাঢ়
শাড়িটা হবে না কেনা, পাখিটার সেই ভাবনা নেই
একটু শান্তি হত দুদণ্ড ডানা দুটি মেলতে পারলেই।
একবার ভাবে শুধু কেন পেল পাখির আদল?
কি অভিপ্রায় নিঃসঙ্গ প্রভুর নাকি অন্য কোন ছল
প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি? এই পাখিটাকে
সর্বস্বান্ত করে ফেলে তাকে
রতিশূন্য করতে চান তিনি নিজের সৃজন?
পাখির আদলে পাখি শেষ ক্লান্তি করে উচ্চারণ,
ভাষাহীন ডানাহীন বিদ্যুতিন সভায়
মালিকও ঘাড়ের কাছে এসে সে সুযোগে কটুগন্ধ নিশ্বাস ছড়ায়!

বিভ্রম

হয়ত আমারই ভুল, ও ছিল না উজানের ঢেউয়ে
রূপালি রূপান্তর মৎসোজ্জ্বল উঠে ছিল ধ্বনি-বাঁধা খেউয়ে।

আসলে তাতো না-  গরাসিনে কেউ দেখে নাই
চুপিসাড়ে নেমে গিয়েছিল সেই রাতে, যেদিন তেলাই,

তারপর দুদশটা জঙ্গল পেড়িয়ে এই মজা-খালে
জালপাতা ছিল বলে রেহাই পেয়েছে শেষকালে।

এও তো আমার ভুল, নাম থেকে দূর্নাম অবধি,
ও আসলে কিছুই ছিল না-  না দুধ না পাতা-দধি।

বস্তাপচা যত গল্প পড়েছি এ দেশে,  শেষ পরিচ্ছেদ তার
সাকার আরতি জ্বেলে হয়ে  ছিল আমার আহার।

ভুল বটে ভুলই, গাঁয়ের লোকজন বলে, যা ঘুমিয়ে পড়,
টের পেয়েছি রক্তে, ভুল থেকে ভাত হচ্ছে নরকপ্রহর।

কবিতা দেবে না ধরা, এ তো আর শোভাদি না যে
আঁচলের খুঁট মুখে দ্রুত-  লুকাবেন কাজে।

এ ভ্রম বিশ্বাস নিয়ে নামি যদি কবরে তোমার,
বলবে পরস্ত্রী করিস? তুই কি নোস্ তোরি মা-র!

যা সেখানে-  লাউডগা বাঁক খেয়ে সূর্যের দিকে,
সেই একই বিভ্রমে আমি  এখন দুধ দিচ্ছি মাহিকে!



শামসেত তাবরেজী
জন্ম ১৯৬১ সালের ৫ এপ্রিল, ঢাকায়। 
লেখা শুরু করেছেন সেই ক্লাশ ফোর-এ পড়বার সময় তদানিন্তন ‘মুকুলের মহফিল’ দিয়ে। প্রথম বই ‘উদ্বাস্তু চিরকুট’, তারপর বেরয়: আবাগাবা, আম্রকাননে মাভৈ: কলের গান, হে অনেক ভাতের হোটেল (নির্বাচিত কবিতা), অবিরাম অরেঞ্জ। সম্পাদনা বলতে, বেনজামিন মলয়েজ- এর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ৩ ঘন্টার মধ্যে একটি কবিতা ফোল্ডার প্রকাশ করেন প্রয়াত বন্ধু কবি শ্যামল সেনকে সঙ্গে নিয়ে। মাও জে দং (মাওসেতুঙ), রাসুল ঝা প্রমুখের কয়েকটি কবিতা তর্জমা করেছিলেন।
মৃদুল দাশগুপ্ত'র দশটি কবিতা

মৃদুল দাশগুপ্ত'র দশটি কবিতা

মৃদুল দাশগুপ্ত (জন্ম ৩ এপ্রিল- ১৯৫৫) বাংলা কবিতা-জগতের এক সুপরিচিত নাম। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ সারা পেয়েছে আপামর কবিতাপাঠকের কাছে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘এভাবে কাঁদে না’, ‘সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ’, ‘কবিতা সংগ্রহ’ ইত্যাদি বই। ‘সোনার বুদ্বুদ’বইয়ের জন্য পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। পড়া যাক মৃদুল দাশগুপ্ত'র দশটি কবিতা।


১.
গুপ্তপুঁথি-জ্ঞানে আমি দিয়ে যাব পাণ্ডুলিপিখানি
বিরাট কাঠের ওই পেটিকায় রেখে দিও গৃহে, এক কোণে
সযত্নে কিছুটা কাল, ক্রমে তুমি ভুলে যাবে, জানি।
কী আছে ভিতরে শুধু ভাবনাই ঢেউ দেবে মনে
সহজ সরল বাক্সে মনে হবে দাপাদাপি চৈত্রের বিকেলে
কলরব, হট্টগোল, ঘোররাতে ক্ষুধাতুর ক্রন্দনের ধ্বনি
আবার প্রভাতে হাসি খিল খিল—আমাদের একশত ছেলে!
তখন মুদ্রণে দিও, ওরা যেই চেঁচাবে—জননী
২.
যেই হস্তক্ষেপ করি তুমি বিন্দু, বৃত্তাকার হও।
হয়েই ঘুরতে থাকো, তখন বাতাস বয় শন শন শন
এ গৃহে পাড়ায় ক্রমে শহরে সদরে, টোকা দিতে
                                      পৃথিবীও ঘোরে
যেন বিপরীতে, জোরে। চন্দ্রসূর্য হতবাক হয়ে
কে আগে উদিত হবে, ভাবে।
কী কাণ্ড ঘটাও চিত্র, বিচিত্র হওয়ার পথে
                                       বন্ বন্ বন্!
গেল গেল রব ওঠে তারায় তারায় আর
                                         পাড়ায় পাড়ায়
পাহাড়ের চূড়ে যেন হায় হায়, সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে
                       হাহাকার মরু সাহারায়
পুনরায় হাত দিই, এবার এবার থামো
তখনই তো হয়ে যাও, স্তন।
৩.
পছন্দ হয় না বলে অপকর্মে কালি দেই ঢেলে
কী কাণ্ড প্রকাণ্ড দেশ মানচিত্র থেকে যায় মুছে
ঝপ করে নামে রাত্রি ঝকঝকে রোদের বিকেলে
সে ভয়ভীতিতে যাই অতি ঊর্ধ্বে একাকী, জাগর
তুষারে আবৃত হয় পৃথিবীর বিবিধ অঞ্চল।
একে একে সাত রাত যদিওবা যায় যায় ঘুচে
তবু না ফুরায় নিশি। মহাসূর্য করে হাহাকার
সেই ছায়া নিচে পড়ে, ক্ষোভে দোলে সকল পাহাড়
কাতর পাথর বলে, ‘থামো থামো’
অতি শূন্যে ভাসমান এক ফোঁটা জল
সে বলে, ‘এবার নামো, নইলে ধমক দেবো
                         আমি…আমি বঙ্গোপসাগর’
৪.
মানো বা না মানো তবে টোকা দিলে
                               ওড়ে এই ঘর
আমার এ গৃহখানি সেভাবে বানানো
তা ছাড়া বলার কথা, বিচিত্র শহর
যখন তখন রাতে বয়ে যায় জোনাকির ঝড়
এইখানে খুন হব, অথবা উল্লাসে যাব
                             জেলা কারাগারে
আমার বিশাল ছায়া তবু তো দুলবে ওই
                                   নদীর কিনারে
যে তুমি নিখোঁজ হবে, তুমি এসো
                      ঠিকানা তো জানো
আমাকে পাবে না কেউ ঘটনার পর
৫.
লাগো তো পিছনে লাগো গোয়েন্দা সকল
উড়ি কিনা
ডানা ছাড়া, জেট বিনা
করি কিনা দুনিয়া দখল
পিছু নাও, হাঁটো বা গাড়িতে চেপে খোঁজো খোঁজো
                                         তুমুল তল্লাশে
পদচিহ্ন আছে কিনা ঘাসে
বাতাসে গায়ের গন্ধ
কোন্ কাব্যে কোন্ ছন্দ
ধরো দেখি ছল!
কোথায় গড়ায় দেখো কোথাকার জল!
সকল সন্ধান করো, ধাও
ওই যে রোরুদ্যমানা, তার কাছে যাও
৬.
আবার আবার ফের পুনরায় পুনরায় ফের ফের
                                             আবার আবার
সময় হয়েছে যেন গুরুতর বিষয়ে ভাবার
শিখরে, গিরির শীর্ষে, অতলান্ত তলে বা অতলে
কোথায়বা যেতে হবে, কিভাবে যে যাব
কী দেবো তোমাকে আমি এবারের রথের মেলায়?
সে বড় চিন্তার কথা, তাও শূন্যে দপ দপ জ্বলে
যাত্রার সবুজ আলো, যে রকম পথ খুঁজে পাব
নিয়তির কোলে বসে উড়ে যাব খেলায় খেলায়
কী দেবো পৃথিবী আমি নদীতটে, সাগরবেলায়?
কী দেবো তোমাকে আমি

৭.
সঙ্কটে, সময়কালে কলহ-বিবাদ করো
                                    তুমিও, নীরব
ঘুমন্ত জাগ্রত দেখি কুকথায় ছোড়ো হস্তপদ
তবে তো সবাক স্তব্ধ, শাদা ধবধব
তোমার ইস্তফাপত্র দূর মহাশূন্যের সনদ।
কে পায় এবার—ভেবে অতিভারী জড়বস্তু
            কাপাস তুলোর চেয়ে ওড়ে
আগুনশলাই ছাড়া ধূম্রশলাকাখানি
                           নিজে নিজে পোড়ে
বলে চিত্র, ছোঁও ছোঁও, কাঁপে তার
                                 চক্ষুর পল্লব
পিপীলিকা দলটির শুনি কলরব

৮.
হয়তো অর্ধেক পথে বাধাপ্রাপ্ত হব, পেরোব না
                                 মরু বা প্রান্তর
থেমে যাব, কখনও হব আর কোনও নদী পার
অতএব তাকাব না, ঝটিকায় উড়ে যাবে ঘর
হতে পারে তারপর আবছায়া দেখা যাবে
                                    আমাকে আবার
কোথায় কে জানে তবু চারিদিক নীল বা নীলাভ
তখন পাব না স্তন, হয়তো মেঘের গায়ে
                                   দুহাত বোলাবো
৯.
সভয়ে আমার মন কাকুতি মিনতি করে, ছেড়ে দেয় হাল
আছাড়ি বিছাড়ি খায় দেহখানি, তবে হয়, এমন নিষ্প্রাণ
তথাপি সকল দৃশ্য
দিনরাত্রি শীত গ্রীষ্ম
অনুভূত হয় বলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে চলে কাল
আমি ক্ষত চিহ্নহীন
অতি শুষ্ক, বা রঙিন
যেখানে রয়েছি পড়ে, তা নয় শ্মশান।
আমার ওপর দিয়ে তবে কেন মেঘ যায়, ছোঁয় কেন
                                               সমুদ্রের জল
কানের ভিতর দিয়ে কেন পোকা ঢুকে যায়
               কেনবা শনাক্ত করে তারকা সকল

১০.
‌‍‍‍‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‘তুমি চন্দ্রে হাত দিয়েছিলে! গহ্বরে আঙুল দিয়ে
                                   পেয়েছিলে মধু!
চেটেছিলে চাঁদের বরফ? গড়ালে চাঁদের গায়ে, চাঁদে?
চাঁদ কী বলল, শুনি’—কন্যা জিজ্ঞাসা করে,
                          ‘বলো বলো’—হেসে বলে বধূ
চুরুট ধরিয়ে আমি ধীরে ধীরে উঠে যাই ছাদে।
‘এই তো চাঁদের লোক’—অযুত তারকারাশি একযোগে বলে
‘ওর গায়ে বালি লেগে, তা চাঁদের ওপিঠের বালি!’
‘ও চাঁদের।’ ‘ও চাঁদের’—চারিদিকে ঘন ঘন তালি
আমি উড়ে চলে যাই পুনরায় চাঁদের দখলে
কাঠগড়া ও কঙ্কাল ।। চঞ্চল মাহমুদ

কাঠগড়া ও কঙ্কাল ।। চঞ্চল মাহমুদ


ম্যালো, ভূমধ্যসাগরের মাঝে একটি বিকল হয়ে যাওয়া আপাত স্থির জাহাজে আমিসফোক্লিস আর জোকাস্টা বসে প্রাচীনকালের ওয়াইন পান করে যাচ্ছি; বিকল হবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত এ জাহাজের একমাত্র চালক ছিলো লেয়াস ।  আমাদের ৪ জনকে বিভিন্নভাবে ওয়াইন ঢেলে সহযোগিতা করে যাচ্ছে ঈদিপাসজাহাজ বিকল হওয়ার সাথেই সাথেই ঈদিপাসের ঢালাও আচরণ সফোক্লিসের দিকে লুণ্ঠিত হয়সফোক্লিসের নির্ধারিত গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে তাকে না দিয়েই বরং ঈদিপাস তা নিজের শঙ্কায় ঢকঢক করে ঢেলে দেয়... আমি হাসছিজোকাস্টাকে বোঝা যাচ্ছে না...... উদ্বিগ্ন হয়ে সফোক্লিস ভাবছে- সাইথিরন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে একবার ঝাপ দিয়ে আসি’; একমাত্র লেয়াসের আনন্দে বিকল হয়ে ওঠো জাহাজও কিছুক্ষণ চলতে শুরু করলো......  
আমি উঠে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম । ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লাইয়াস প্রবাহিত হয়ে আমার তামাটে পায়ের  নিচে রেখে গেলো কেন্দ্রগামী আগুন......। ম্যালোআয় উত্তপ্ত করি- নিজেদের তামা । শিরশির করে ওঠা এমন টগবগা রাতে ইটিওক্লেসপলিনেইসিসইসমেন ও অ্যান্টিগনিকে জোড়া লাগিয়ে দড়িতে রূপান্তর করে ঈদিপাসকে আদেশ করলাম- 'সফোক্লিসকে বেঁধে ফেলা হোক'। কুণ্ডলিত সফোক্লিসকে এনে হাজির করা হলো এমন পায়ের নিচে... যেখানে আগে থেকেই জড়ো হয়ে ছিলো তামাম-তামাম-গলিত-আগুন । তার গলার ভেতর চূড়ান্ত উত্তাপের তামা ঢেলে তাকে সংস্পর্শতাপী করে তুললাম... 

ধোঁয়া উঠছে...... ধোঁয়াকে পেছনে ফেলে আমাদের জাহাজ, চলমান........;  ম্যালো, পোড়ার গন্ধে ম-ম করে উঠেছে আমাদের গতিশীলতা......

একটু দূরেই জোকাস্টা স্থির......। সফোক্লিসের এমন নিয়তি দেখে সে কাঁদা শুরু করলো; তার কান্না থেকে ঝরে পড়ছে দলা-দলা আগুন তার শরীরেই......; ম্যালো, যে কান্নার ভেতর আগুন পালন করে এবং নিজেকে প্রয়োজনীয় হত্যার প্রয়োজনে সে আগুন ব্যবহার করে; তার পথ মেরামতের সাধ্য কি আমাদের আছে? 

জোকাস্টা পুড়ছে...... তাকে বোঝা যাচ্ছে না...
সফোক্লিসকে পোড়াচ্ছে চঞ্চল মাহমুদ (ঈদিপাস ও লেয়াসের সহযোগিতামূলক আচরণের আভাস নিরূপণেই তা সম্ভব হয়ে উঠছে.....) 

ম্যালো, শোকে ও অপরাধে নিমজ্জিত এ দুটি ভিন্ন অবস্থাকে একত্রিত করে জাহাজের ছাদ থেকে নিক্ষেপ করলাম- পতনের সৌন্দর্যের দিকে ...। নিক্ষেপিত পতনের সবটুকু সময় লেয়াস ও ঈদিপাস কাতরতার তরঙ্গে ঢুকে, নিমজ্জিত হয়ে বলতে থাকলো- 'তোমার দেখা না পেলে জোনাকিবিহীন অন্ধকারে আমরা বাপ-বেটা শুধুই ছটফট করতে থাকতাম......'  

ম্যালো, আরেকটি পতিত বৃত্তের পরিধিকে ঘোড়া বানিয়ে পতন শুরু হলো- অন্য কোন সংকটের কেন্দ্রের দিকে.....
অন্ধকার, সিরিজ কবিতা  ১-৫ ।। ইমেল নাঈম

অন্ধকার, সিরিজ কবিতা ১-৫ ।। ইমেল নাঈম



অন্ধকার ১

পরতে পরতে মিথ্যে লুকিয়ে আত্ম অহংকার সরিয়ে দেয় পা মাটির অনেক উপরে ক্রমশ অক্সিজেন শূন্যতায় ছিটকে পরে মাটির অনেক উপরে বুদ্ধিমান চোখ যখন অন্ধ সাজে, তখন ছড়াতে থাকে কানকথা  আত্মসম্মানবোধের তীব্রতায় পুড়ে যায় দর্শন ভস্মটুকু আঁকড়ে ধরে রাখে একদল বানোয়াট মুখ পুড়ে ফেলা কবিতায় ভুল বানানে আটকে দেয় সেফটিপিন

ছোট্ট ছিদ্রগলে আলো ঢুকে, সেইসাথে ঢুকে পড়ে দুষিত বাতাস পত্রিকার পাতায় লিখা থাকে আত্মপক্ষ বিশ্লেষণ আবেগ দিয়ে ভাসিয়ে নেওয়ার পরও ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে নিগুঁঢ় বাস্তবতা এটাকে অস্বীকার করলেই উড়ে আসতে থাকে উটকো ঝামেলা

বিকল্পপথে আমাদের পৃথিবী খোলা সেই পথে আমরা শ্বাস নিই প্রতিদিন রাগ অভিমানও ঝাড়ি, পুনরায় ছুটে চলার অদম্য নেশায় আমাদের সকালগুলো স্বপ্নমাখা আঘাতের পরেও উঠে দাঁড়াই, সেফটিপিনটাকে ছুঁড়ে ফেলি রাস্তায়

আমরা সর্বহারাদের দলভুক্ত নই তবুও সাহসটুকু বুকে নিয়ে চলি বারবার শুধরে নিই সঠিক পথ অথচ...আমাদের জন্য সর্বভুকের মতো হা করে তাকিয়ে আছে নিঃসীম অন্ধকার



অন্ধকার ২

চলো শান্তির পায়রা উড়াই সাদা পায়রা ওড়ানোর পরেই আয়োজন করি মোমবাতি জ্বালিয়ে এক মিনিটের নীরবতা পালনের উৎসবের এরপর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাই সকল অপচেতনা দূরীভূত করার প্রয়াস আসো এই মৃত্যু উল্লাসে কবিতা লিখি কবিতা লিখি প্রতিটি বোমার বিপরীতে জীবনের স্বাদ আস্বাদনের নিমিত্তে কবিতা লিখি আগেও বলেছিলাম, বস্তুবাদের জগতে কবিতার কোনো শক্তি নেই যদিও মধ্য পৃথিবীর প্রিয় সহযাত্রী একই অভিযোগে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে কবিতার লিখার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড আমরা কবিতা পড়ছি এরপর

কতগুলো বোমার আঘাতে একটা মানচিত্র ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে হিসাব কষে ফেলে লাভ ক্ষতির মুনাফা প্রাকৃতিক সম্পদের লুটপাট করলেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ভূখণ্ড এখানে শান্তির জন্য কবিতা নয়, বোমারু বিমান বরাদ্দ করেছে ঈশ্বর অতঃপর আঘাতের পর আঘাতে ঝাঁঝরা করে দাও সব সমান্তরাল জায়গা বোকাবাক্সে প্রচারিত করো নিজেদের ক্ষমতা ক্ষমতায়নের এই দুঃসময়ে নিজেকে প্রচার করার জন্যই এই প্রেসকিপশনেই বিশ্বাস তোমার 'দিকে সন্ত্রাসী মরে, বয়স ওদের কতই আর বারো...চৌদ্দ...ষোল...সন্ত্রাসের আস্তানা উড়ে যাওয়ার পর জানা যায়, ওটাকে ইশকুল নামেই চিনতো সবাই

ওখানের মানুষ সকাল দেখে না মসজিদে যায় না, অফিসে যায় না, হাটবাজারেও যায় না শুধু পালিয়ে বাঁচতে চায় অন্য কোনো সীমান্তে তাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক প্লাটুন পুলিশ শিশুর মৃতদেহ মিলে যায় সমুদ্র সৈকতে আমরা শান্তির জন্য মসজিদে যাই, গির্জায় ধর্না দিই, মন্দিরে যাই আর তারা বোমা মারে, নিরপরাধ মানুষ মারে, অথচ সন্ত্রাসী নয় একদমই

চলো আমরা কবিতা লিখি, মোমবাতি জ্বালাই মৃতদেহের স্মরণে এক মিনিটের নীরবতা পালন করি এটাই অক্ষম লোকের একমাত্র ক্ষমতা আমরা নৈতিকতার কারণে শান্তির কামনায় দাঁড়িয়ে থাকি ভুল সময়ে, ভুল দরজায়

অন্ধকার ৩

অন্ধকার ঘর অন্য দশ জন ঠিক আমারই মতো কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে, কেউ দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে নানান জন নানান সমস্যায় এখানে কেউ এখানের দশ বছরের অতিথি, কেউ আজীবনের সদস্য নানান ঘটনায় আমরা আজ মুখোমুখি কেউ আমার মতো নয়, আর বাকিরা সবাই প্রায় একই রকম একই ঘটনার পথ যাত্রী

আমার বিপরীতে আজ সব হৈ হুল্লোড় করা আয়োজন ঈশ্বরের বিপক্ষে লিখতে চাওয়ার জন্য এই দুর্বিনীত খড়গ ছিদ্র করে দিয়ে যায় বুকের প্রান্ত আমি সত্য লিখতে বসেই লিখে ফেলেছি তেল কূপের কথা আমি সত্য কে ধারণ করতে গিয়ে বলে ফেলেছি বিলাসিতার নির্মম বাক্য আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সবটাই শুধু ব্যক্তি স্বার্থের আঘাতে

আমি অন্ধকার ঘরে খাতা আর কলম চাই আমি লিখতে চাই অন্ধকারের কবিতা পাতা ভর্তি থাকুক সত্যে কেউ জানবে না এই খাতায় কি লিখা হয়েছিলো ঈশ্বরকে লিখে দিবো খোলা চিঠি আমি রাজা বাদশাহ কে লিখে দিবো তেল নিয়ে মিথ্যে অহংকারের ইতিবৃত্ত আমি লিখে যাবো মৃত্যু পথ যাত্রার সকল আয়োজন

বেশি দিন আর নেই, খাতার পাতা গুলো অধিকাংশই খালি রেখে যাবে কাল কোনো অচেনা জিপসি কবি লিখে ফেলবেন কিছু অংশ খাতায় লিখা থাকবে কৃষ্ণাঙ্গ হাতের ছোঁয়া, দক্ষিণ এশিয়ার উজ্জ্বল শ্যামল কোনো কবির আঙুল শ্বেতাঙ্গ কবিরাও সোচ্চার হবে এই শূন্যস্থান পূর্ণতার পথে আমার মৃত্যু খুলে দিবে অনেক জীবনের বন্ধ দরজা


অন্ধকার ৪

আকাশ বন্ধ করে দাও বোতাম টিপে বিকল্প পথযাত্রীদের রক্তাক্ত করো নানা অজুহাতে...কথায়...চোখে...মুখে...অঙ্গভঙ্গিতে ঘুম ভাঙলেই খুঁজে পাওয়া যায় রহস্যের ঘেরাটোপ, শীঘ্রই আলো আসবে অথচ দৃষ্টিসীমায় আলোকবর্তিকা নেই মাস্তুল জুড়ে অন্ধকার চাদরে ঢেকে দিয়েছে নিরাপদ যাত্রাপথের এটাই এক অভিন্ন উপায়

টিভি দেখি না বিজ্ঞাপন গিলতে হবে বলে এরই মাঝে টি.আর.পি'র অংকে সামনে চলে আসে নানা অপ্রীতিকর খবর ম্যানহোলে ডুবে যাওয়া শিশু, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত শরীর, বিল্ডিং ধ্বসে কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না ক্ষত বিক্ষত শরীরে কেউ হয়তো ফিরে, বাকিরা নয়...জনগণের বন্ধু বলে পরিচিত মুখগুলোর আচরণ শত্রুর মতো নেভি ব্লু চোখ রাস্তার মোড়ে মালবাহী ট্রাকের দিকে তাকিয়ে থাকে দিনের অনেকটা সময়

সেবক শব্দটাকে বড্ড অসহায় মনে হয় ঠিক আভিধানিক অর্থটা মেলাতে পারি না তারা নিজেদের নিয়ে প্রচারে এতো মগ্ন, ভুলে গেছেন প্রকৃত কাজ কক্ষপথ হীন একটা কণা খুঁজে ফিরে তার মূল কেন্দ্র

'দিকে দখল হয়ে যায় খেলার মাঠ কিশোর ছেলেটির ভিতরের পশুটিও প্রকাশ পায় সুযোগ বুঝে আটাশ দিনের বাচ্চা শিশুটিও পরীক্ষাকেন্দ্রে কে বোঝায়? এই শহরে আজ সব রাজার শাসন সবাই নিজেকে নিয়ে এতো মগ্ন যে দেখেনি তার চারপাশের প্রকৃতি নিজের দোষ ঢাকতে চলে যায় পিছনের পথে বন্ধ করে দেয় সব দরজা জানালা

মতের অমিল মানেই আঘাত করো সজোরে ছিন্নভিন্ন করে দাও সেই সকল মুখ আত্মপ্রচারের এটাই অতি উত্তম পথ পথিক হিসেবে আমি দেখি ঝরে যাওয়া কতগুলো পাখির পালক যারা গান লিখতে বসে হারিয়ে গেছে অজানা পথে


অন্ধকার ৫

এটাকে ঠিক কবিতা বলা যায় না প্রতিবাদও না অধিকার আদায়ের কোনো বক্তব্য লিপিবদ্ধ নেই খাতায় তবুও আপনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে একদম সন্মুখে চোখে চোখ রেখে শান্ত ভাষায়, দৃঢ় চিত্তে, নির্ভীক মননে কিছু কথা আপনার সামনে বিড়বিড় করতেই হয় আমাদের শোনার মতো সময় নেই আপনার, আর হবেই বা কি করে, আপনার এখন কতো কাজ পুরো একটা নিশান আপনার আঙুলে নাচে, উড়ে, ঘুরে, ফিরে

অজস্র কথা চাপিয়ে দিয়েছেন আমাদের উপরে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা কিন্তু ইঁদুর বিড়ালের খেলার মতোই খেলে যাচ্ছেন পুরোটা সময় আপনার কথাগুলো ক্রমশ মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হচ্ছে আর একের পর এক ঘটনা আপনাকে করে তুলছে প্রশ্নবিদ্ধ পত্রিকার পাতা খুললে এখন ভেসে আসে দুর্ঘটনার সংবাদ তালহীন ঘুড়িটিও আকাশের ঠিকানা পেলে নিজেকে রাজা মনে করে বসেন আর ক্রমশ সুতোর সান্নিধ্যটুকুও ভুলে যান

ভূমিকার বাইরে এসে কিছু কথা বলার থাকে বলতে গেলে সাতান্ন এসে জগদ্দল পাথরের মতো আটকে ঘরে ঘর থেকে বেরোই না, চুয়ান্ন শব্দটা খুব পরিচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করায় আপনাকে ফুলেল শুভেচ্ছা যদিও আপনার আত্মীয়স্বজন অনেকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ঘুরে ফিরে আসে বারবার আপনি তাদের বিপক্ষে সবসময় মিস্টেরিয়াস নীরবতা পালন করেন আমি চিমটি কেটে পরীক্ষা করি চেতনার থার্মোমিটার


পেপার খুলেই চমকে উঠলাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অনেক চিহ্নিত রাজাকার, অমুক্তিযোদ্ধারাও এখনো পেয়ে যাচ্ছেন ভাতা এরচেয়ে বেশি কিছু বলার নেই আমি শালা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে সবসময় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মেতে থাকি আমার কপাল অনেক ভালো, অন্য দশজন ছেলের মতো চাকরি নামের সোনার হরিণের খোঁজে ব্যস্ত থাকতেও পারতাম আমিও তো ম্যানহোলে পড়ে নেই হয়ে যেতেও পারতাম, হয়ে যেতে পারতাম গুম, মধ্যরাতে লাশ পাওয়া যেতো কোনো ঝোপঝাড়ে কিংবা চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে মরেও যেতে পারতাম