মৃদুল দাশগুপ্ত'র দশটি কবিতা

মৃদুল দাশগুপ্ত (জন্ম ৩ এপ্রিল- ১৯৫৫) বাংলা কবিতা-জগতের এক সুপরিচিত নাম। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ সারা পেয়েছে আপামর কবিতাপাঠকের কাছে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘এভাবে কাঁদে না’, ‘সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ’, ‘কবিতা সংগ্রহ’ ইত্যাদি বই। ‘সোনার বুদ্বুদ’বইয়ের জন্য পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। পড়া যাক মৃদুল দাশগুপ্ত'র দশটি কবিতা।


১.
গুপ্তপুঁথি-জ্ঞানে আমি দিয়ে যাব পাণ্ডুলিপিখানি
বিরাট কাঠের ওই পেটিকায় রেখে দিও গৃহে, এক কোণে
সযত্নে কিছুটা কাল, ক্রমে তুমি ভুলে যাবে, জানি।
কী আছে ভিতরে শুধু ভাবনাই ঢেউ দেবে মনে
সহজ সরল বাক্সে মনে হবে দাপাদাপি চৈত্রের বিকেলে
কলরব, হট্টগোল, ঘোররাতে ক্ষুধাতুর ক্রন্দনের ধ্বনি
আবার প্রভাতে হাসি খিল খিল—আমাদের একশত ছেলে!
তখন মুদ্রণে দিও, ওরা যেই চেঁচাবে—জননী
২.
যেই হস্তক্ষেপ করি তুমি বিন্দু, বৃত্তাকার হও।
হয়েই ঘুরতে থাকো, তখন বাতাস বয় শন শন শন
এ গৃহে পাড়ায় ক্রমে শহরে সদরে, টোকা দিতে
                                      পৃথিবীও ঘোরে
যেন বিপরীতে, জোরে। চন্দ্রসূর্য হতবাক হয়ে
কে আগে উদিত হবে, ভাবে।
কী কাণ্ড ঘটাও চিত্র, বিচিত্র হওয়ার পথে
                                       বন্ বন্ বন্!
গেল গেল রব ওঠে তারায় তারায় আর
                                         পাড়ায় পাড়ায়
পাহাড়ের চূড়ে যেন হায় হায়, সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে
                       হাহাকার মরু সাহারায়
পুনরায় হাত দিই, এবার এবার থামো
তখনই তো হয়ে যাও, স্তন।
৩.
পছন্দ হয় না বলে অপকর্মে কালি দেই ঢেলে
কী কাণ্ড প্রকাণ্ড দেশ মানচিত্র থেকে যায় মুছে
ঝপ করে নামে রাত্রি ঝকঝকে রোদের বিকেলে
সে ভয়ভীতিতে যাই অতি ঊর্ধ্বে একাকী, জাগর
তুষারে আবৃত হয় পৃথিবীর বিবিধ অঞ্চল।
একে একে সাত রাত যদিওবা যায় যায় ঘুচে
তবু না ফুরায় নিশি। মহাসূর্য করে হাহাকার
সেই ছায়া নিচে পড়ে, ক্ষোভে দোলে সকল পাহাড়
কাতর পাথর বলে, ‘থামো থামো’
অতি শূন্যে ভাসমান এক ফোঁটা জল
সে বলে, ‘এবার নামো, নইলে ধমক দেবো
                         আমি…আমি বঙ্গোপসাগর’
৪.
মানো বা না মানো তবে টোকা দিলে
                               ওড়ে এই ঘর
আমার এ গৃহখানি সেভাবে বানানো
তা ছাড়া বলার কথা, বিচিত্র শহর
যখন তখন রাতে বয়ে যায় জোনাকির ঝড়
এইখানে খুন হব, অথবা উল্লাসে যাব
                             জেলা কারাগারে
আমার বিশাল ছায়া তবু তো দুলবে ওই
                                   নদীর কিনারে
যে তুমি নিখোঁজ হবে, তুমি এসো
                      ঠিকানা তো জানো
আমাকে পাবে না কেউ ঘটনার পর
৫.
লাগো তো পিছনে লাগো গোয়েন্দা সকল
উড়ি কিনা
ডানা ছাড়া, জেট বিনা
করি কিনা দুনিয়া দখল
পিছু নাও, হাঁটো বা গাড়িতে চেপে খোঁজো খোঁজো
                                         তুমুল তল্লাশে
পদচিহ্ন আছে কিনা ঘাসে
বাতাসে গায়ের গন্ধ
কোন্ কাব্যে কোন্ ছন্দ
ধরো দেখি ছল!
কোথায় গড়ায় দেখো কোথাকার জল!
সকল সন্ধান করো, ধাও
ওই যে রোরুদ্যমানা, তার কাছে যাও
৬.
আবার আবার ফের পুনরায় পুনরায় ফের ফের
                                             আবার আবার
সময় হয়েছে যেন গুরুতর বিষয়ে ভাবার
শিখরে, গিরির শীর্ষে, অতলান্ত তলে বা অতলে
কোথায়বা যেতে হবে, কিভাবে যে যাব
কী দেবো তোমাকে আমি এবারের রথের মেলায়?
সে বড় চিন্তার কথা, তাও শূন্যে দপ দপ জ্বলে
যাত্রার সবুজ আলো, যে রকম পথ খুঁজে পাব
নিয়তির কোলে বসে উড়ে যাব খেলায় খেলায়
কী দেবো পৃথিবী আমি নদীতটে, সাগরবেলায়?
কী দেবো তোমাকে আমি

৭.
সঙ্কটে, সময়কালে কলহ-বিবাদ করো
                                    তুমিও, নীরব
ঘুমন্ত জাগ্রত দেখি কুকথায় ছোড়ো হস্তপদ
তবে তো সবাক স্তব্ধ, শাদা ধবধব
তোমার ইস্তফাপত্র দূর মহাশূন্যের সনদ।
কে পায় এবার—ভেবে অতিভারী জড়বস্তু
            কাপাস তুলোর চেয়ে ওড়ে
আগুনশলাই ছাড়া ধূম্রশলাকাখানি
                           নিজে নিজে পোড়ে
বলে চিত্র, ছোঁও ছোঁও, কাঁপে তার
                                 চক্ষুর পল্লব
পিপীলিকা দলটির শুনি কলরব

৮.
হয়তো অর্ধেক পথে বাধাপ্রাপ্ত হব, পেরোব না
                                 মরু বা প্রান্তর
থেমে যাব, কখনও হব আর কোনও নদী পার
অতএব তাকাব না, ঝটিকায় উড়ে যাবে ঘর
হতে পারে তারপর আবছায়া দেখা যাবে
                                    আমাকে আবার
কোথায় কে জানে তবু চারিদিক নীল বা নীলাভ
তখন পাব না স্তন, হয়তো মেঘের গায়ে
                                   দুহাত বোলাবো
৯.
সভয়ে আমার মন কাকুতি মিনতি করে, ছেড়ে দেয় হাল
আছাড়ি বিছাড়ি খায় দেহখানি, তবে হয়, এমন নিষ্প্রাণ
তথাপি সকল দৃশ্য
দিনরাত্রি শীত গ্রীষ্ম
অনুভূত হয় বলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে চলে কাল
আমি ক্ষত চিহ্নহীন
অতি শুষ্ক, বা রঙিন
যেখানে রয়েছি পড়ে, তা নয় শ্মশান।
আমার ওপর দিয়ে তবে কেন মেঘ যায়, ছোঁয় কেন
                                               সমুদ্রের জল
কানের ভিতর দিয়ে কেন পোকা ঢুকে যায়
               কেনবা শনাক্ত করে তারকা সকল

১০.
‌‍‍‍‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‘তুমি চন্দ্রে হাত দিয়েছিলে! গহ্বরে আঙুল দিয়ে
                                   পেয়েছিলে মধু!
চেটেছিলে চাঁদের বরফ? গড়ালে চাঁদের গায়ে, চাঁদে?
চাঁদ কী বলল, শুনি’—কন্যা জিজ্ঞাসা করে,
                          ‘বলো বলো’—হেসে বলে বধূ
চুরুট ধরিয়ে আমি ধীরে ধীরে উঠে যাই ছাদে।
‘এই তো চাঁদের লোক’—অযুত তারকারাশি একযোগে বলে
‘ওর গায়ে বালি লেগে, তা চাঁদের ওপিঠের বালি!’
‘ও চাঁদের।’ ‘ও চাঁদের’—চারিদিকে ঘন ঘন তালি
আমি উড়ে চলে যাই পুনরায় চাঁদের দখলে

SHARE THIS

Author: