নীল,
রাত কত হলো? দু'টা নাকি তিনটে? রুমজুড়ে এতো অন্ধকার, পলকে একবার মনে হয়__ আমি আমার রুমেই আছি
তো? সত্যি যে রুমে আছি
সেটার প্রমাণ পাবার জন্য দুইপাশ হাতড়ে স্বামীকে খুঁজি। আছে। তার মানে আমার রুমেই আছি। নিশ্চিন্তে সে ঘুমচ্ছে। মজা দ্যাখো! শারীরিকভাবে আমরা
পাশাপাশি, এত কাছে__ অথচ মনের দিক থেকে কতশত
ক্রোশ দূরে; এত দূরে যে আমি হয়ত আর কোনোদিন এই লোকটার নিকটবর্তী হতে
পারব না। কীভাবে হব? যেখানে আমাদের মধ্যে
রুচির কোনও মিল নেই, চিন্তার কোনও সাদৃশ্য নেই, জীবন-যাপন শৈলীতে
কোনও মিল নেই, শুধু বিয়ে নামক একটা সামাজিক প্রথায় আবদ্ধ আছি বলেই
পাশাপাশি থাকা__ সেখানে কীভাবে মানসিকভাবে কাছাকাছি থাকব? ভেবে আজো অবাক হই, বিয়ের এতগুলো বছর
কেটে গেল, অথচ একটাবারের জন্যও
স্বামী নামক এই লোকটাকে আজো ভালবাসতে পারলাম না। অথচ দৈহিকভাবে আমাদের অনিবার্যভাবে
কাছাকাছি থাকতে হয়।
জানি, নীল, তুমিও আমার মত আজো
তোমার বউয়ের মনের কাছাকাছি যেতে পারো নি। আচ্ছা, তোমার বউও কি তোমার
কাছাকাছি আসতে পারে নি? তুমি বলেছ, বিয়ের এতদিন কেটে
গেল, তবুও বউকে তোমার
ভালবাসা হয়ে ওঠে নি। তুমি চেষ্টা করেছিলে, পারো নি। সেটাও কি এই কারণে যে, তোমার রুচি, চিন্তা, মূল্যবোধ, লাইফ স্টাইল থেকে
তোমার বউয়ের রুচি, চিন্তা, মূল্যবোধ, লাইফ স্টাইল এইসব
সম্পূর্ণ ভিন্ন? তাহলে তুমিও কি আজ রাতে আমার মতন এমনি করে জেগে আছো? জেগে থাকো প্রতিদিন? অন্ধকারে হাত বাড়ালেই
বউয়ের শরীর হাতে ঠেকে, অথচ সে যেন কত দূরের কোন মানুষ__ এই অনুভূতি তোমারও
খেলে যায়? জানি, তোমারও আমার মত বোধ হয়। সামাজিকভাবে আমাদের একজন করে লাইফ
পার্টনার থাকলেও, এরা শুধু শারীরিক প্রয়োজন মেটায় ক্ষণিকের জন্য। দুই জগতে তুমি আর আমি একই রকম একা, আমরা নিজ নিজ গৃহে
মানসিকভাবে এত একা!
তাই, তুমি খুঁজে নিয়েছ
আমাকে, আমি খুঁজে নিয়েছি
তোমাকে। আমরা এখন সুখী। এইসবই সত্য। কিন্তু... নীল... গতকাল... তোমার সেই প্রস্তাবটা
নিয়ে অনেক ভেবেছি... না... না... এ সম্ভব না নীল... বুঝতে চেষ্টা করো
তুমি... এমন অবুঝ হয়ো না...
গতকাল জানালার গায়ে
হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। চোখের সামনে লাল রঙের
একটা সরু রাস্তা, তারপরেই খোলা মাঠ; এইসব ছাড়িয়ে আরও
সামনে, বহু দূরে গাছপালায়
ঘেরা একটা মসজিদ, আর একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি সেই মসজিদের গম্বুজের
দিকে। এই একটু আগে কাজ থেকে
ফিরলাম, কোনোমতে ড্রেস ছেড়ে
অমনি বসে পড়ি আমার প্রিয় এই জানালার ধারে। গৃহমুখী মানুষজনের
আনাগোনা বাড়ছে। তাদের পায়ের শব্দ
আমাকে জেমস জয়েসের ইভিলিন গল্পের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল বারবার। ইভিলিনকে তো চিনো? ইভিলিন। ইভি। মিস হিল। তিনজন একি মানুষ। মা মারা গেছে বেশ আগে। তিন ভাইয়ের ভেতরে একজন মারা গেছে, বাকি দুই ভাই থাকে
অনেক দূরে, বাড়িতে শুধু মদ্যপ
বাবা আর ও। সে কাজ করে এক দোকানে। ঘর সংসার সেই দেখে, প্রতিদিন ঘর সাজাই, ঝাড়পোছ দেয়; বাড়ি তার আত্মার অংশ
হয়ে যায়। নির্ভরতার প্রতীক। কতশত স্মৃতি জমে থাকে আছে সেই বাড়িটিকে
ঘিরে! কিন্তু সংসারের জোয়াল
টানতে টানতে, মদ্যপ আর ভয়ংকর বাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য ইভিলিন প্রেমিক
ফ্রাঙ্কের সাথে পালানোর প্রস্তুতি নেয়। ফ্রাঙ্ককে ওর বাবা
মেনে নেবে না ও জানে, বরং একদিন ফ্রাঙ্ককে অপমানও করে। কারণ ফ্রাঙ্ক বিদেশি, আর্জেন্টাইন। ও ফ্রাঙ্কের জন্য ঘর ছাড়তে চায়, এমন নয়। সে ঘর ছাড়তে চায় কারণ যে ঘরকে সে বড়
আপন আর নির্ভরশীলর প্রতীক মনে করে, সেই ঘরের প্রতি বাধ্যতামূলক দায়িত্বশীলতা, নিজের অসম্মান, ভবিষ্যতহীনতা আর
বাবার ভয় তার জীবনকে ক্রমশ বিষিয়ে তুলছে। তাই বিদেশি ফ্রাঙ্কের
সাথে পালিয়ে আয়ারল্যান্ড ছেড়ে যারার জন্য মনস্থির করে। সে স্বপ্ন দেখে সেই দেশে গেলে একটা আপন
ঘর পাবে, নিজের মত করে সাজাবে
সেই ঘর, সম্মান পাবে সেখানে, আর ভালবাসা পাবে
ফ্রাঙ্কের। কিন্তু যখন সে আর
ফ্রাঙ্ক পোতাশ্রয়ে জাহাজের জন্য অপেক্ষা করে, জাহাজ ছেড়ে যাবার
জন্য হুইসেল বাজায়। আর তখনই ইভিলিনের মনে
হতে থাকে, পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্র
যেন তার বুকের সৈকতে আছড়ে পড়ছে। ফ্রাংক তাকে সেই
সমুদ্রের গভীরে নিয়ে যাচ্ছে ডুবিয়ে মারার জন্য। তাই যখন ইভিলিনকে জাহাজে উঠার ইঙ্গিত
দিয়ে সে দ্রুত ছুটে যায় তারপর জাহাজের রেলিঙ ধরে তারস্বরে ইভি ইভি বলে ডাকতে থাকে, তখন ইভিলিনের চোখে
ভালবাসা বা পূর্বপরিচয়ের কোন চিহ্ন সে খুঁজে পায় না।
নীল, ফ্রাঙ্ক বুঝতে না
পারলেও আমি ইভিলিনকে বুঝতে পারি। না, নীল, আমার পক্ষে তোমার
সাথে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
আমি এখন আর শুধু আমার
নই। আমার বাবা-মা আছে, সন্তান আছে, একটা সামাজিক অবস্থান
আছে; আবার আমার বাবা-মা'র
একটা দৃঢ় সামাজিক অবস্থান আছে, আমার ভাই বা আত্মীয়-জনদের সামাজিকতা আছে, আমার সন্তানদের
নিজস্ব পরিমণ্ডলে সামাজিক পরিচিতি আছে। আমি আমার বাবা-মা'র, আমার সন্তানদের, আমার আত্মীয়-স্বজনদের। আমার ভেতরের যতটুকু আমার, ততোটুকু অস্তিত্ব
তোমাকে প্রচণ্ডভাবে অনুভব করে। তোমার প্রয়োজনীয়তা
অনুভব করে। কিন্তু অস্তিত্বের
বাকি অংশটুকু আমাকে তোমার দাবি মেনে নিতে প্রবলভাবে বাঁধা দেয়।
ইভিলিন পরিস্থিতি
ভেতরে গিয়ে যে সংকট অনুভব করেছে, আমি তা এখনই দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, সংসার ছেড়ে তোমার
সাথে পালিয়ে যাবার সাথে সাথে, আমার শত্রুরা আমার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। তারা এতদিন লুকিয়ে চুকিয়ে আমার নামে
কুৎসা রটাতো; তোমার সাথে পালিয়ে যাবার পর ওরা সদম্ভে প্রকাশ্যে বলতে
থাকবেঃ
‘আগেই জানতাম, এই মহিলা এমন কাজ করবে। এর মতো মহিলার জন্য এইসব তো ডাল-ভাত...'
আর, বিজয়ীর মত নানা
কাল্পনিক রটনায় মেতে থাকবে। আমার সন্তানেরা তাদের
বন্ধুদের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। ঘরে বন্দি হয়ে থাকবে
সারাদিন। পরিচিত মানুষদের
দৃষ্টির হাত থেকে পালিয়ে বেড়াবে। রাস্তায় বেরোলে
পরিচিতরা কখন না জানি তাদের দিকে আঙুল তাক করে বলে ওঠে, দ্যাখ, অই যে ছেলেটা/মেয়েটা
যাচ্ছে না? ওর মা আরেকজনের সাথে
পালিয়ে গেছে__ এইসব কুৎসা থেকে ওরা গা বাঁচিয়ে পালিয়ে বেড়াবে। স্কুলের সহপাঠীরা ফিসফাস করবে। কোনও পরিচিত টিচার শুনলে, চোখ বাঁকা করে তাকাবে
আমার সন্তানদের দিকে।আমার নিকট আত্মীয়-স্বজনদের
মাথা কাটা যাবে তাদের আত্মীয় বা পরিচিতদের কাছে।
আর, বাবা-মা! যাদের আমি এত
ভালবাসি, এত শ্রদ্ধা করি, তাদের অবস্থা কল্পনাও
করতে পারছি না। আর যে ক'টা দিন বেঁচে
থাকবে, আমার এই শোক নিয়ে কাটিয়ে দিতে হবে তাদের। বেঁচে থাকার স্পৃহাটাই হয়ত নষ্ট হয়ে
যাবে ওদের। আমি যে এমন একটা কাজ
করতে পারি না, এই বিশ্বাস ওদের ছিল
আমার প্রতি; আমি তাদের সেই বিশ্বাস
ভঙ্গ করায় ওরা বিহ্বল আর বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে। আমার এই পালিয়ে যাবার
ব্যাপার নিয়ে তারা এতটাই অবসেশনে থাকবে যে, চোখ
থেকে ঘুম টুটে যাবে। যাও একটু আসবে শেষ
রাত্রির দিকে, হয়ত সেই ঘুম থাকবে
আমাকে নিয়ে দুঃস্বপ্নে ভরা। সামাজিকতার চাপ
কীভাবে সইবে জানি না, তবে তারা যে
গৃহবন্দি আরো একা হয়ে যাবে, এটা
বুঝতে পারি। ভাইদের দিকে তাকিয়ে
অন্যেরা ছি ছি করে উঠবে।
আর, আমার একটা পারিবারিক পরিচিতি আছে। সেখানে আমি গৃহী, সন্তান বৎসলা, পিতা-মাতার বাধ্য, ভাইদের প্রতি অনুরক্ত, অতিথিপরায়ণ, স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত। সামাজিক পরিচিতিও আছে একটা। সেখানে আমি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, পরোপকারী, বন্ধু আর অতিথিবৎসল। এই সমস্ত কিছু তোমার সাথে পালিয়ে যাবার
সাথে সাথে মুহূর্তে ধ্বসে যাবে; মাটির
সাথে মিশে যাবে একেবারে।
নীল, ইভিলিন কিন্তু সত্যিই ফ্রাঙ্ককে ভালবাসত। ওর হাত দূর দেশে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। ও হয়ত সামাজিকতার ভয়ে ফিরে আসে নি, ফিরে এসেছিল পরিচিত ঘরের টানে। নতুন ঘরের নানা সম্ভাবনা ওকে যতই
হাতছানি দিয়ে ডাকুক, তার কাছে ওসবই
ছিল নতুন পদক্ষেপ। নতুনকে গ্রহণ করতে ও
হয়ত ভয় পেয়েছিল। কিন্তু আমার সঙ্কট যে
ভিন্ন তা বুঝতেই পারছ।
নীল, তোমাকে আমি ভালবাসি, এতে আমার নিজের কাছেও কোনও সন্দেহ নাই। এইসব ছেড়ে তোমার সাথে পালাতে পারলে আমি
নিজেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। কিন্তু আমার পক্ষে
কেন যে তা সম্ভব না, তা নিশ্চয়
এবার বুঝতে পারছ। আমার অক্ষমতাকে তুমি
ক্ষমা কর। ভালবাসি।
ইতি,
অপরাজিত