১১.৩.২০১৪
খুব সকালে যখন আমাদের ঝকঝকে স্টিমার কেত্তনখোলা নদীর জল
আলোড়ন করে বরিশাল শহরের পাশে সটান দাঁড়ায়,আমি তখন কেবিন খুলে বাইরে এসে রেলিং ভর
করে দাঁড়াই । মনে মনে বলি : শুভ জন্মদিন । কিছুক্ষণ পর নুভাও এসে দাঁড়ায় । ভোরের
আলোতে ওকে সত্যজিতের ছবির মতো সুন্দর লাগে । তবে ও গম্ভীর । বাইরে মিহি মসলিন
বৃষ্টি । আমি নুভাকে জিজ্ঞেস করি – নুভা তুই কি জানিস আজ
আমার জন্মদিন ? ও মৃদু হাসে । তার মানে জানে । কেত্তনখোলা
নদীতে একটা ছোট্ট জল সাপ এঁকে বেঁকে চলে যায় । ওকে দেখাই ।
তার আগে,স্টিমারটি যখন ঢাকা ছাড়ে আমাদের অফিসের গাড়িটি
আমাদের দুজনকে সদরঘাট পৌঁছে দেয় । আমি যখন তিনতলার কেবিনের সামনে বাতাস ও উড়ুউড়ু
চুল নিয়ে দাঁড়াই,মনে পড়ে এরকম আরকটি দিন ।
মিলুপা,রুমু খালা ও আমি ।
আকাশে বরিশাল বিভাগীয় চাঁদ । আঙ্গুল গলে পড়ছিল জ্যোৎস্না ।
মাখনের মাঝে গরম ছুরির মতো বুড়িগঙ্গা,মেঘনা ও পদ্মার জল কেটে কেটে আমাদের
লঞ্চ । আমরা তিনজন নীল চাঁদোয়া । রাত বাড়ছিল অথচ পাল্লা দিয়ে পালিয়েছিল আমাদের চোখ
থেকে সকলি ঘুম । আজকাল একসাথে কোথাও বেড়াতে গেলে কেউ নিজেদের মাঝে বেশিক্ষণ গল্প
করে না,একটু পরেই যে যার মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়
। আঙ্গুল টিপে টিপে ফেসবুক ।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নুভা আমি সাবধানে নামি ।
স্টিমারটি ভোঁ ছেড়ে দিল । রিক্সা নিয়ে দুজন সার্কিট হাউজ ।
খবর পেয়ে পাপিয়া,ওর বর দুজনেই ছুটে আসে । পাপিয়ার মেয়ে অদিতি আবৃত্তি করে সুনাম
কুড়িয়েছে । সারাদিন কাজ করে রাতে যখন সার্কিট হাউজে ফিরি,নি:সঙ্গ
ফেরারির মতো । মন খারাপ হয়ে যায় । আজ তো আমাদের দুজন একত্রে থাকবার কথা ছিল ।
অভিমান গলার কাছে একুশে ফেব্রুয়ারির মতো আটকে থাকে শোকে । রাত বাড়ে,বৃষ্টি বাড়ে । কেত্তনখোলার জল বাড়ে আর আমার ঘুম আসে না ।
১২.০৩.২০১৪
কাজ কাজ । মাঝখানে একদিন স্পিড বোটে করে হিজলা নামক থানায়
। বিরাট প্রমত্তা নদী আর আমি কালো জুতো পরে একলা । যদি তুমি থাকতে রোদ চশমা পরে ।
বাতাসে তোমার মুগ্ধতা উড়ত,বোকা বোকা তোমাকে দেখতাম আমি ।
১৩.০৩.২০১৪
নুভা রাতে পাপিয়ার কাছে থাকত । সারাদিনও । আমি বরিশাল চষে
বেড়াই । সেদিন সকালে গাড়ি নিয়ে গৌরনদী । নেমেই ভরপেট দই খেয়ে নেই । মামা বাড়িতে ঢুকে দেখি
দেয়ালে তোমার আঁকা পেন্টিং । অনেক ক্ষণ তাকিয়ে ঝিম হয়ে থাকি ।
১৮.০৩.২০১৪
আজ রাত আমি নুভা কটক স্থল থাকি । জলে কাদায় বিপন্ন গ্রাম ।
তবু ছোটবেলাকার স্মৃতি-মেদ বাড়ি । দল বেঁধে গ্রামের লোকজন আমাদের দেখতে আসে । কেউ
কেউ আমার বেতন জানতে চায় । ১৯ তারিখ বিকেলে বিষণ্ণতায় আবার বরিশাল শহরে চলে আসি ।
ওহ মাঝখানে একদিন মাধব পাশা দূর্গাসাগর দেখতে যাই । অবাক ব্যাপার তুমিও একদিন
এখানে এসেছো । আমিও । অথচ একত্রে নয় । তুমি কক্সবাজার গেছো,আমিও । অথচ
দ্বৈতাদ্বৈতে নয় ।
২০.০৩.২০১৪ থেকে ২৪.০৩.২০১৪
পচা এক লক্কড় ঝক্কর গাড়িতে আমি নুভা পটুয়াখালী । বরিশাল
পটুয়াখালী । বরিশাল পটুয়াখালী মাত্তর ৩৮ কি.মি । অথচ কতো ঝামেলা । একদিন মোটর
সাইকেলে করে আমরা কুয়াকাটা । পটুয়াখালী থেকে ৭০ কি.মি । বৃষ্টি বৃষ্টি । এ
বৃষ্টিতে কি কেউ সমুদ্র দেখে ?
সমুদ্রকে বলেছি আমি খুব সহসা তোমার কাছে চলে যেতে চাই ।
কতদিন একসাথে স্বপ্ন দেখি না । কতদিন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি না । লণ্ডভণ্ড করতে
পারি না লাজ লজ্জা,বিনুনি ।
২৫.০৩.২০১৪
পটুয়াখালী থেকে বরিশাল ফিরে সে রাতেই ঢাকা । নুভা’র
ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে ।
ঢাকা এসেই আবার কাজ কাজ । কাজল,তালাত,সোহানা,কলিমুল্লাহ ভাই,নীরদ,মনজু,মুকুট,শাহীন,সোমা কারো সাথেই যোগাযোগ নেই । ইচ্ছা
করে না । যোগাযোগ দ্বিপাক্ষিক না হলে কি হয় ? সোমা
জওহারলাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে গেছে । যাবার আগে বলেো গেল না । আবুল হাসান
ভাইয়ের কাছে শুনলাম । মধু সাইফুল কে মনে আছে ? ইকোনোমিকসের
। মৌমাছি চাষ করতো বলে আমার মধু সাইফুল বলতাম । ও আজ রাতেই জেনেভা ও মিউনিখ যাচ্ছে
এক মাসের জন্য । জসীম হল্যান্ড থেকে ফিরে এসেছে । আব্দুল হাইয়ের সাথে মাত্র একদিন
দেখা । এবার বোঝো আমার অবস্থা !
এ চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছাবে তুমি হার্টফেল করবে না তো ? কেউ আজকাল
চিঠি লেখে ? বলতো শেষ কবে তুমি চিঠি লিখেছিলে ?
তোমার নাকি শরীর খারাপ ? আমাকে জানাওনি কেন ? কোস্টারিকা থেকে কবে আসবে ? একদম মন খারাপ করে
থেকো না । মনে করো –এ হচ্ছে সুন্দরের প্রসব বেদনা ।
কেমন করে ভুলি
আমাকে জড়িয়ে সেই নখ সেই স্মৃতিগুলি !
শোনো হানাহানি থামলেই আমাদের দেখা হবে । দ্রুতই দেখা হবে ।
হাতে তুলে নেব আমলকী । আর এ ওকে বলব হাওয়ায় হাওয়ায় :
দ্যাখো এই হলো আমাদের পৃথিবী ।
তোমারই অমৃত,
অপরাহ্ণ সুসমিতো