ভ্রমণ কথা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ভ্রমণ কথা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কবি মৃদুল দাশগুপ্তের সাথে একটি বিকেল: সূর্যসেনের দেশ থেকে মঙ্গলপাণ্ডের দেশে • জিললুর রহমান

কবি মৃদুল দাশগুপ্তের সাথে একটি বিকেল: সূর্যসেনের দেশ থেকে মঙ্গলপাণ্ডের দেশে • জিললুর রহমান


২২ জানুয়ারী ২০১৮। কোলকাতায় নেমেই ছুটলাম হাওড়া রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। হুড়াহুড়ি করে টিকেট কেটে বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়াতে হবে। তড়িঘড়ি করে পৌঁছে দেখি কবি মৃদুল দাশগুপ্ত এসে দাঁড়িয়ে আছেন। বলেছিলাম, ট্রেনের ব্যাপারগুলো আমার জটিল লাগে। তাই শ্রীরামপুরে নিয়ে যাবার জন্যে সশরীরে এসে হাজির। চেপে বসলাম লোকাল ট্রেনে। মুড়িভাজা আর গজা চিবাতে চিবাতে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কথার শুরুতেই বললাম পশ্চিমবঙ্গের এই দিকটা আমার দেখা হয়নি। তখন দক্ষ ঐতিহাসিকের মত মৃদুলদা বলে গেলেন কিভাবে ডেনিস কলোনীর এই অঞ্চলটি ভারতীয় ফেডারেশনে যোগ দেয়। জানতে পেলাম ফরাসি অধ্যুষিত চন্দন নগরে গণভোটে ৯% লোক ফরাসি নিয়ন্ত্রণ থেকে ভারতীয় ফেডারেশনে সংযুক্ত হবার বিপক্ষে ভোট দিলে, তারা বংশপরম্পরায় ফরাসি নাগরিক সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের মধ্যে একজন মৃদুলদা’র বন্ধুও আছেন। জানতে পেলাম, এখানকার ইন্দুবতী ভট্টাচার্য বুদ্ধদেব বসুর আগেই সরাসরি ফরাসি থেকে বোদলেয়র অনুবাদ করেছিলেন, যিনি পরে কংগ্রেসের সাংসদ হন। তিনি দেখতে ছিলেন অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মতো। পরে জেনেছি এই ইন্দুমতী ভট্টাচার্য প্রকৃত-অর্থে বিদুষী। উনি চন্দননগরের প্রবর্তক নারীমন্দির নামে এক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা ছিলেন। তিনি কেবল ফরাসি নয় , কিছুটা স্প্যানিশও জানতেন।

আলাপ চলতে চলতে লিলুয়া, বালি, উত্তরপাড়া, রিষড়া পার হয়ে শ্রীরামপুর থামলাম। শ্রীরামপুর শহরের বুক চিরে রেললাইন দূরে ছুটে চলে যায়। রেললাইনের একপাশে গঙ্গার তীরে প্রাচীন শহর, যার পুরনো বাড়িঘর সব ডেনিস গথিকে তৈরি। কিছু ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে, কিছু সংস্কার করা হয়েছে, আবার কিছু ভবনের পলেস্তারা খসে ভেতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু নিশ্চিত বুঝা যায়, এসব বাড়িঘর ব্রিটিশ গথিকের নয়। রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরলাম গঙ্গার উল্টো দিকের পাড়ে গড়ে ওঠা নতুন শহরের দিকে। এদিকের বাড়িগুলো গত ৬০-৭০ বছরে উঠেছে। রেলস্টেশনের খুব কাছেই মৃদুলদা’র বাড়ি। বৌদি দরজা খুলে দিলেন, চায়ের আয়োজন করলেন। তারপর বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে।

প্রথমেই গেলাম প্রাচীনতম ডেনিস চার্চের সামনে। এই গির্জার প্রধান ফটক, তার কড়িবরগা, এমনকি ঝুলন্ত বাতিও ডেনিশ। গির্জার সামনেই একটি ছোটমতন পার্ক। তাতে সাজিয়ে রাখা সাতটি কামান দেখিয়ে মৃদুলদা জানালেন কৈশোরে দেয়ালে বসে বসে তিনি দেখেছেন ডেনিস রাজকুমারী কামানগুলো রং করতে। সেই শিশু রাজকুমারী পরে ডেনমার্কের রাণী হয়েছিলেন। আরো জানা গেল, সিরাজউদ্দৌল্লা যখন ডেনিশদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তখন এই ক’টা কামান নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে পারা যাবে না বুঝে ডেনিশরা সিরাজকে সাহায্য করেননি। সিরাজ এতে বেশ মনক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। এর পরে এগিয়ে গেলাম আদালতভবনের দিকে। পরিত্যক্ত আদালতভবনের স্তম্ভের দিকে তাকালেই তার বুনন যে ব্রিটিশ আদলে নয়, তা পরিষ্কার বুঝা যায়। 

বলা হয়নি, ২২ জানুয়ারি ছিল সরস্বতী পূজা। এখানে এইদিনে ভ্যানেনটাইন দিবসের মতো তরুণ তরুণীরা ঘুরে বেড়ায়। মৃদুলদা’র বাড়িতে ঢুকার মুখেই একটি পূজামণ্ডপ দেখলাম। যে মেয়েটি মণ্ডপের রক্ষণাবেক্ষণ করছে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানলাম সে বাঙালি হয়ে যাওয়া অবাঙালি। আমার বিস্ময় দেখে, মৃদুলদা আবার খুলে ধরলেন ইতিহাসের ঝাঁপি। শ্রীরামপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার ওপারেই সিপাহীবিদ্রোহ খ্যাত ব্যারাকপুর। এখনো সেখানে সেনানিবাস আছে। সিপাহীবিদ্রোহের সময় অবাঙালি সৈনিকদের পরিবার পরিজন পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এখানে। পরে ব্রিটিশ সরকার তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে যখন জুটমিল স্থাপন করে তাদের কর্মসংস্থান করে তারা এখানেই থেকে যায়। ১৫০ বছরের সময়বিবর্তনে তারা ধীরে মিশে যায় বাংলার আচার সংস্কৃতির সাথে। তারা বাংলায় ভাবে, বাংলায় কথা বলে, এমনকি বাংলার পূজাপার্বণে মেতে ওঠে উৎসবে। তাই যতই বেলা গড়াচ্ছে তরুণীরা সেজেগুজে বেরিয়ে আসছে তরুণদের সাথে সরস্বতী পূজার আনন্দমুখরতায়। তাই কোলকাতা শহরের কেন্দ্রে মাড়োয়ারিদের হিন্দি বাৎচিতে যারা মনে করেন বাংলা ভাষা এখানে বিপন্ন তাদের জানিয়ে রাখতে পারি — যেমন করে মৃদুলদাও বলেন যে, উন্নত সাহিত্য সংস্কৃতির বাংলা কখনো হিন্দির কাছে বিপন্ন হতে পারে না। বরং যেসব অবাঙালি আগে বা পরে বাংলায় আশ্রয় নিয়েছে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যারা থাকছে তারা বাঙালি হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

তাই দেখছি সারাদিন কলেজ পেরুনো কী কলেজ পড়ুয়া তরুণ তরুণীরা জোড়া বেঁধে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের অধিকাংশই বাঙালি বনে যাওয়া অবাঙালি সিপাহীদের বংশধর। 

ঘুরতে ঘুরতে আদালত পাড়া থেকে গঙ্গার ধার দিয়ে আবার শহরের উপকণ্ঠে নিয়ে এলেন কবি। বাড়িতে সরস্বতী দিবস উপলক্ষে নিরামিষ আয়োজন থাকাতে আমাদের নিয়ে গেলেন চমৎকার এক রেস্টুরেন্টে। রেস্তোরাঁ মালিক কর্মচারী সকলেই কবিকে খুব ভালবাসেন। এলাকায় তাঁকে সবাই খুব সম্মান ও খাতির করেন, বুঝা যায়। বেশ উপাদেয় খাবার খেয়ে আমরা আবার এগিয়ে গেলাম গঙ্গার ধার ধরে। আগে ইউরোপের মতো করে গঙ্গার ধারে বাগান করা ছিল। এখনো ২০০ বছরের পুরনো ভাঙা রেলিংয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তবে সে ফুলের বাগান অযত্নে মরে আগাছায় ভরে আছে। 


এই শ্রীরামপুরকে বাঙালি ভুলতে পারে না। এখানেই ভারতবর্ষের প্রথম ছাপাখানার বিকাশ। একসময় বাংলাসহ ভারতের সব ভাষায় ছাপার জন্যে শ্রীরামপুরের উপর নির্ভর করতে হতো। কাঠ কেটে কেটে হরফ বানানো হতো। আমরা যারা লেটার প্রেসে কাজ করেছি, সীসার হরফ দেখেছি—তারা নিশ্চয় বুঝতে পারবেন কাঠ খোদাই করে “ক্ষ” কিংবা “জ্ঞ” জাতীয় যুক্ত বর্ণের ছাঁচ তৈরি করা কতোটা দুরূহ। আজকের কম্পিউটার প্রিন্ট যুগের তরুণেরা কখনোই বুঝবে না ছাপানোর কাজ সে-যুগে কতো বড় বিপ্লবাত্মক ব্যাপার ছিল। 


এসব কথা ভাবতে ভাবতে জুটমিলের চৌহদ্দি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম এক বিশাল সুপরিসর গাছপালায় ঘেরা বিদ্যায়তনের সামনে। দূর থেকে দেখে মনে হলো যেন দাঁড়িয়ে আছি ইউরোপের কোনো রাজভবনের সামনে। ভাবতে পারেন? আজ থেকে ২০০ বছর আগে ১৮১৮ সনে এই শ্রীরামপুর কলেজ স্থাপন হয়। আর এই কলেজের কারিগর স্বয়ং উইলিয়াম কেরি। এই কলেজ বাংলা তথা ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। সেসময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে কেবল স্নাতক ডিগ্রী দেওয়া হতো। আর এই শ্রীরামপুর কলেজ থেকে থিয়োলজিতে মাস্টার্স ডিগ্রী দেওয়া হতো সে যুগের ডেনমার্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে। এর প্রধান ফটকটি উপহার দিয়েছিলেন ডেনমার্কের রাজা। সেকালে পুরো ঢালাই লোহার তৈরি ফটকটি বানাতে খরচ পড়েছিল ১০০০০ টাকা। কলেজটির প্রাঙ্গণে যখন প্রবেশ করি দেখি নানারকম অচেনা বৃক্ষের ছায়ায় এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে। মৃদুলদা বললেন, কেরি ছিলেন একজন বোটানিস্ট, তারও উপরে এক অসাধারণ সংগ্রাহক। তিনি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসব গাছ সংগ্রহ করে এখানে লাগিয়েছিলেন। এখানে নাকি ইউরোপ আফ্রিকা মালয়েশিয়াসহ নানাদেশের গাছ রয়েছে। প্রথমদিকে এসব গাছের নাম ও বৈজ্ঞানিক নাম লাগানো থাকলেও এখন আর তার চিহ্ন দেখলাম না। আহা, আমাদের রোবেন থাকলে ধরে ধরে গাছগুলোর নাম হয়তো জেনে নিতে পারতাম। মৃদুলদা তো যুউলজির ছাত্র। মজার ব্যাপার হলো, সাহেবরা ‘শ্রীরামপুর’ উচ্চারণ পারতেন না। তাই শ্রীরামপুর ইংরেজিতে Serumpore হয়ে গেল।

শ্রীরামপুর কলেজের বৃক্ষশোভিত প্রান্তর ছেড়ে যখন আবার গঙ্গার ধার ধরে ফিরছিলাম তখন কিছুটা ঠাণ্ডা লাগছিল। সোয়েটার মাফলার এনেছিলাম

ঠিকই, তবে তা মৃদুলদা’র বাড়িতে রেখে এসেছি। দাদা টের পেয়ে নিজের গা থেকে জ্যাকেট খুলে পরতে দিতে চাইলেন। এতো আন্তরিক সে আহবান। তবে অবশ্য তাঁর ঠাণ্ডা লাগার সম্ভাবনা হেতু আমি জ্যাকেট নিলাম না। দাদা দেখালেন গঙ্গার ওইতীরে বৃক্ষাচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ব্যারাকপুর সেনানিবাস। মনে পড়ে, ১৮৫৭ সালে এখানেই দানা বেঁধেছিল সিপাহী বিদ্রোহ। আমরা এগিয়ে যেতে যেতে মনে পড়তে লাগল সেইসব কথা। মনে পড়ল মঙ্গল পাণ্ডে ও তার ফাঁসীর কাহিনী। কার্তুজে শুকর ও গরুর চর্বি ব্যবহারের অভিযোগ ইত্যাদি অনুষঙ্গ টেনে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল এই ব্যারাকপুরে অল্প সময়ের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ভারতে। মৃদুলদা’র কাছে জানলাম তাঁর শৈশবে ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁদের মাথার উপর দিয়ে বাড়ির উপর দিয়ে ছুটে যাওয়া গোলাগুলির রোমহর্ষক সব কাহিনী। তিনি নিজ চক্ষে দেখেছেন ভূপাতিত পাকিস্তানী বিমানের টুকরো যার গায়ে চাঁদতারা সুসজ্জিত। শুনতে শুনতে ফেরি পারাপারের টিকিট কেনা হয়ে গেল। আমাদের ফেরি যখন গঙ্গা অতিক্রম করছে তখন মৃদু বাতাস থাকলেও তেমন শীত অনুভব করলাম না। যেন মঙ্গল পাণ্ডে আর সিপাহী বিদ্রোহের উত্তাপ গায়ে এসে লাগছিল। যখন ব্যারাকপুরে ফেরি ভিড়েছে, ততক্ষণ সন্ধ্যা হয়েছে। অন্ধকারে যেন ভূতুরে আলোয় ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সেই বহু প্রতীক্ষিত স্তম্ভের দিকে। যাতে লেখা আছে মঙ্গল পাণ্ডের নাম। এখানেই ফাঁসীতে ঝুলানো হয়েছিল সেদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী মঙ্গল পাণ্ডেকে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ বাক্যরহিত হয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর সম্বিত ফিরতে দেখি দাদা ডাকছেন। সিপাহীবিদ্রোহের সূতিকাগারে পা পড়লো আজ সূর্যসেনের দেশের এক সন্তানের। এ আমার পরম অর্জন। ফাঁসীস্তম্ভের প্রতি নীরব স্যালুট জানিয়ে মৃদুপায়ে হেঁটে গেলাম লোকালয়ের দিকে। গাঢ় গভীর বৃক্ষছায়ায় বাড়িঘর গুলো নিরিবিলি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবগুলো সেনানিবাসের ঘর—হয়তো কোয়ার্টার বা বাসা, হয়তো অফিস ঘর। বাইরে থেকে বুঝার জো নেই। প্রধান সড়ক দিয়ে লোক চলাচলে কোনো বাধা নেই। কিছুদূর গিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

সেই মধ্যদুপুর থেকে আমার জন্যে শ্রীরামপুর থেকে হাওড়া হয়ে আবার শ্রীরামপুরে এসে সারা শহর চক্কর দিয়ে ব্যারাকপুর পর্যন্ত ঘুরে কিছুটা ক্লান্ত নিশ্চয় মৃদুলদা। কিন্তু তার কোনো প্রকাশ তার মুখভঙ্গিতে নেই। তবু জানতে পেলাম, চারবছর আগে তাঁর হৃৎপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয়েছে। তবে তিনি সেসব ভুলে গিয়ে ক্রমাগত ধূম্রসেবন করে চলেছেন। যুক্তি দিতে লাগলেন— ধূমপানে ক্যান্সার হবার প্রত্যক্ষপ্রমাণ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর অসুস্থ হবার যে কাহিনী শুনলাম তা যেন সরলা এরেন্দিরার শতবর্ষের নির্জনতার কোনো অতীন্দ্রিয় গল্প। একদিন তিনি হেঁটে চলেছেন কোথাও কোনো কাজে। হঠাৎ মনে হলো তিনি অনেক তারা দেখতে পেলেন চোখে। সেই তারা দেখতে দেখতে তিনি হেঁটে চলেন সামনের দিকে। তাঁর মনে হতে লাগলো তিনি কোনো ঘন গাঢ় তরলের মধ্যে নেমে যাচ্ছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে গভীর ঘন তরলে যেন ডুবে যান। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একসময় তিনি কোনো সিঁড়ির ধাপ ভেঙে উঠে এলেন উপরে। তখন তাঁর মাথা টলছে, লোকজন চারদিকে জড়ো হয়ে তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন। সবাই জানতে চাইল আপনি এভাবে হেঁটে হেঁটে নর্দমার ভেতরে ঢুকে গেলেন কেন? তিনি জানালেন যে তিনি কোনো মদ্যপান করেননি। তাঁর কেমন যেন মাথাটা ঘুরে উঠেছিল। এরপরে লোকজন তাঁকে একটি বাড়িতে নিয়ে স্নান করিয়ে তারপর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। 
এই কাহিনী শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম ফেরিঘাটে। মৃদুলদা’র হাতে সিগারেট। টিকেট চেকার সিগারেট ফেলে দিতে বললেন। ভাবছি, কতো কতো ফেরিঘাটেই না ঘুরলাম। সব জায়গায় দেখেছি এসব অঞ্চলে লোকজন প্রচুর ধূমপান করে। কিন্তু যুগ পাল্টাচ্ছে। মৃদুলদা মৃদু হেসে ফেলে দিলেন ধূম্রশলাকা। তারপর আবার ভেসে যাওয়া গঙ্গার বুকে। ফিরে আসি শ্রীরামপুর—যেন চিরচেনা পথঘাট। কেবল বর্তমান নয়, এ শহরের রাস্তাঘাট বাড়িঘরের সাথে জ্যান্ত হয়ে ওঠে শতবর্ষের ইতিহাস।

ফিরে আসি মৃদুলদা’র ঘরে। চা খেয়ে যখন বৌদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেলস্টেশনের দিকে এগুলাম, কেমন বিষণ্ণতা ভিড় করে আসে মনে। মৃদুলদা’র সাথে গল্প করতে করতেই ট্রেন এসে গেল। তাড়াহুড়া করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। ভিড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার পেছনে। আমি আর মৃদুলদা’র কাছে সৌজন্যের বিদায় নিতে পারলাম না; পারলাম না একবার হাতটিতে হাত মেলাবার। হলো না বিদায়ের আলিঙ্গন। 



জিললুর রহমান
জন্ম ১৬ নভেম্বর, ১৯৬৬; চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, উত্তর আধুনিক নন্দনতত্ত্ব চিন্তক জিললুর রহমান। আশির দশকের শেষার্ধ থেকে লেখালেখি করেন। পেশায় চিকিৎসাবিজ্ঞানী। শিক্ষা : এমবিবিএস, এমফিল (প্যাথলজি), পিএইচডি। পেশা : সহযোগী অধ্যাপক, প্যাথলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। প্রকাশিত বই : অন্যমন্ত্র [কাবিতা, লিরিক, ১৯৯৫] শাদা অন্ধকার [কবিতা, লিরিক, ২০১০], ডায়োজিনিসের হারিকেন [কবিতা, ভিন্নচোখ ২০১৮], আত্মজার প্রতি [দীর্ঘকবিতা, বাঙময় ২০১৭], শতখণ্ড [দীর্ঘকবিতা, বাঙময় ২০১৭], উত্তর আধুনিকতা : এ সবুজ করুণ ডাঙায় [প্রবন্ধ, লিরিক, ২০০১, পরিবর্ধিত ২য় সংস্করণ খড়িমাটি ২০১৯], অমৃত কথা [প্রবন্ধ, লিরিক, ২০১০], আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব : কয়েকটি অনুবাদ [অনুবাদ, লিরিক, ২০১০], নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ [অনুবাদ, বাতিঘর ২০১৮], এমিলি ডিকিনসনের কবিতা [অনুবাদ, চৈতন্য ২০১৮]।
সম্পাদনা : তরঙ্গ (১৯৯০, ১৯৯১) ‘লিরিক’ বুলেটিন (১৯৯৫), যদিও উত্তরমেঘ (২০১৭)। 
সম্পাদনা পরিষদ সদস্য— ‘লিরিক’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা ‘লিরিক’ উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যা ১,২,৩,৪। ই-মেইল : drzillur@gmail.com
ঘুরে এলাম চেগুয়াভারের স্বপ্ন সফল কিউবায় ।। রোকশানা লেইস

ঘুরে এলাম চেগুয়াভারের স্বপ্ন সফল কিউবায় ।। রোকশানা লেইস



বেলাভূমির নোনা বাতাস ভূমিময় উড়ছে। উত্তাল জলরাশির উছলে পরা উর্মি বাজিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত সঙ্গিত ব্যঞ্জনাময়। এক খণ্ড ভূমিকে চারপাশ থেকে ঘিরে আছে নীল জলরাশি, না নীল নয় সবুজ জলরাশি তাও নয় গোলাপী অথবা সোনালি। না আবার কখনও হয়ে যাচ্ছে রূপোর মতন উজ্জ্বল। আসলে জলের কোন রঙ নেই। সূর্যের আলো এবং তাপ আকাশের রঙের প্রভাব, মেঘ ও বাতাসের শক্তি সব মিলে ছাপ ফেলে জলের উপর। ভিন্ন সময়ে নতুন মায়াবী রঙ ধারন করে হাজির হয় চোখের সামনে।

চারপাশে সমুদ্র মহাসমুদ্র ও উপসমুদ্র ঘিরে আছে তার মাঝে ১০৪৫৫৬ কিলোমিটার দ্বীপ। আটলান্টিক, ক্যারেবিয়ান সাগর, ম্যাক্সিকো উপসাগর জড়ানো ভূমিটির নাম কিউবা। ষোলটি প্রভিন্সে ভাগ করা দ্বীপের মানুষগুলো আনন্দ উচছল, সচ্ছল। সাধারন নিরুদ্বেগ এবং স্বস্থির জীবন যাপন করছে।

কিউবা দেশটির কথা ভাবলেই কেমন আবেগ তাড়িত হয়ে যাই। আবেগের অনেকটা জুড়ে থাকে চেগুয়েভার। স্বপ্নময় এক মানুষের স্বপ্ন ধারনের দ্বীপটি মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় আমার হৃদয়ে। চে নামেই যে বহুল পরিচিত পৃথিবীর মানুষের কাছে। একজন মার্কসীয় বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক,সামরিক তাত্তিক,গেরিলা নেতা, কূটনীতিবীদ এবং কিউবান বিপ্লবের অন্যতম সেনানী। এখন পর্যন্ত সাম্যতার ধারক পৃথিবীর এই দেশটি। নিজেদের মতন পথ চলছে, চেষ্টা করে যাচ্ছে। পৃথিবী যখন অনেক এগিয়ে যাচ্ছে, ঝলোমলো উজ্জ্বলতায়, বয়াবহ আকর্ষন চারপাশে তখনও তারা আছে নিজেদের সামর্থের মধ্যে, সাধারন স্বনির্ভর প্রচেষ্টার জীবন যাপনে।

অনেকদিন ধরেই যাওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু সময় সুযোগ করাটা চাট্টিখানী কথা না। কিন্তু এবার আমার ভ্রমণের রাজযোটক। তাই অনেকটা প্রস্তুতিবিহীন অবস্থায় প্লেনে চড়ে বসলাম বলা যায়। ব্যপারটা ঘটেছে এমন ভাবে। আমি ছিলাম নিজের কিছু কাছে ভীষণ ব্যাস্ত। যে কাজ একান্ত আমার। দিনমানের সব কাজের শেষে রাত জেগে বইয়ের পান্ডুলিপি প্রস্তুত করছি। সব কিছু মিলিয়ে নিজের উপর বেশ একটা চাপ এবং ধকল চলছে। যার খবর আমি ছাড়া আর কেউ তেমন জানে না। ওরা যেমন সরবে জানান দিয়ে কাজ করে যায় আমি করি চুপচাপ আপন মনে। কিন্তু পরিবারের লোকজন ওদের ছুটির সাথে মিলিয়ে প্যাকেজ নিয়ে নিল। তাও শুনেছিলাম। ভালো দশদিনের সব ইনক্লুড প্যাকেজটা ফুরিয়ে গেলো সিদ্ধান্ত নিতে নিতে। কারণ ডিসেম্বরের ছুটি আর হীমে থেকে পালাতে ভ্রমণকারীদের লক্ষ থাকে বিষুবরেখার কাছাকাছি উষ্ণ অঞ্চলগুলো। দেখার সাথে সাথে দখল না করলে বক্সিং ডের জিনিসের মতনই ফুরিয়ে যায় নিমিশে।

হাবানার প্যাকেজটা ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে ডিসেম্বরের বাকি দিনগুলোতে তেমন কিছু আর পাওয়া যাচ্ছিল না। বড়দিন শেষ হতেই আবার নতুন করে সুলভ মূল্যের কিছু প্যাকেজ দেখা দিল। তবে আগের মতন প্রায় বিনামূল্যের নয় একটু দামী এবং একটু কম সময় পাওয়া গেলো। চট করে ধরে ফেলা হলো এই প্যাকেজটা কোন দ্বিধা না রেখে। আমাকে জানানো হচ্ছিল বছর শুরুর দিনটিতে আমরা উড়ছি। আমি হু হ্যা উত্তর দিয়ে হিসাব করছিলাম, প্রায় তিনশ পাতার লেখা এডিট, আরো কিছু গল্প কবিতা বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর কাজ এই দু চার দিনের মাঝে সারতে পারব কিনা। চব্বিস ঘন্টার মধ্যে পাওয়া যায় সর্ব সাকুল্যে দু এক ঘন্টা নিজের জন্য তাও ঘুম কেটেছেটে বাদ দিয়ে। আমার ইচ্ছে ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে গেলে শান্তি লাগত আমার। যদিও লেখা আঁকার কাজগুলো কোনদিন শেষ হবে না। কিন্তু সবার যখন ছুটি তার সাথে মিলিয়েই যেতে হবে। সমস্যা হচ্ছে ছুটি যখন আসে তখন যেন পৃথিবী ব্যাপী এক সাথে ছুটি আসে। তাই সব জায়গাতে ভীড় ভাট্টা লেগে থাকে। একদম ধনী এবং কাজহীন অলস মানুষ ছাড়া যখন তখন বেড়িয়ে পরা সম্ভব নয়, যখন ফাঁকা পরে থাকে সুন্দর দর্শনিয় জায়গা গুলো।

বছর শেষের একদিন বাকি। বাক্স প্যাটরা গোছানোয় হাত দেইনি এখনো। ছুটি আর উৎসব আয়োজনে, নানা দাওয়াত আর পার্টি সামাজিকতাও এর মাঝে করতে হচ্ছে। নিজের কাজগুলো বাদ দিয়ে। জীবনে সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম প্যাকেজটা না পাওয়ায় ভেবেছিলাম যাওয়া হচ্ছে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকেট কাটা সারা, থাকার জায়গা ভাড়া হয়ে গেছে। আমার কাজ শেষ হয় না কিন্তু ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তুতি সারা।

৩১শে ডিসেম্বর দুপুরে মনে হলো যাচ্ছি তো গ্রীষ্মকালিন দেশে এইসব বুটজুতা পরে চললে চামড়া উঠে যাবে গরমে। ফ্যাশন স্যান্ডেলও চলবে না। চাই ঢাকার ফুটপাত থেকে স্পঞ্জ স্যান্ডেল। যাবোতো সারাদিন বালুকা বেলায় হাঁটতে। সাগরের নোনাজলে ভাসতে।

যদিও প্রথম দিনের সারাদিন আছে আমার হাতে কিন্তু কোন কাজ হবে না। বছর শুরুর আনন্দে সব বন্ধ থাকবে। তাই পরি মরি ছুটলাম দোকানে কেনাকাটার জন্য। নিদেন একখানা হাওয়াই চপ্পল না হলেই নয়।

এই দেশে আবার সব কিছু সিজনমাফিক চলে। শীতের দিনে গরমের জিনিস পাওয়া ভারি মুসকিল। সবাই আছে নিউ ইয়ার পার্টির মুডে। একদিকে কখন দোকানের ঝাপি বন্ধ হয়ে যায় সেই চিন্তা। অন্য দিকে স্যান্ডেল কিনতে না পারলে কি মুসকিল হবে সেই দু:শচিন্তা তার মাঝে চষে বেড়াচ্ছি এ মার্কেট সে মার্কেট এ দোকান ও দোকান। যাক শেষমেস একখানা ছোট দোকানে স্পঞ্জ স্যান্ডেলের কাছাকাছি কিছু পেলাম কিন্তু তার সাইজ দশ বারোর নীচে নাই। কী মহা মুসিবত! এত্ত বড় জুতা পায়ে থপথপ করে হাঁটব নাকি বেড়াতে গিয়ে। যাক দোকানির অশেষ প্রচেষ্টায় এক জোড়া বেড়িয়ে এলো গুদাম থেকে। পাওয়া গেলো মাপ মতন।

বাড়ি ফিরে খাবার পর্ব শেষ করে আবার এডিট নিয়ে বসলাম। প্রকাশক মাথার দিব্বি দিয়ে রেখেছেন লেখা না পাঠিয়ে যেন কোথাও না যাই। রাত বারোটার তিন মিনিট আগে বসার ঘরে বাড়ির সবার সাথে পরবর্তি কিছু সময় নতুন বৎসরের উৎসব পালন করে পি সিতে ফিরে গেলাম আবার। ভোর সাড়ে ছয়টায় লেখা পাঠিয়ে ঘুমাতে গেলাম।

সাড়ে দশটায় উঠে নাস্তা সেরে স্যুটকেস গোছাতে বসলাম। প্লেন উড়বে সন্ধ্যা ছয়টায় অথচ এয়ারপোর্টে হাজির হতে হবে তিন ঘন্টা আগে। পৌঁছানোর এক ঘন্টা সব মিলিয়ে যাত্রার চার পাঁচ ঘন্টা আগেই যাত্রা শুরু হয়ে গেলো।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে চেকিং সেরে বোর্ডিং কার্ড হতে নিয়ে মনে হলো বেশ শূন্যতা এখন আর কোন কাজের ঝামেলা নাই। ঘন্টা দুই কিছু ফোনকল, ম্যাসেজ হ্যাপী নিউ ইয়ার উইস করা হলো ব্যস্ত বিমান বন্দরে বসে। কত ধরনের মানুষ হাঁটছে, জটলা করছে, বসে আছে। কত গন্তব্যের মানুষ এক বিন্দুতে জমেছে।

কাঁচের বাইরে বিকালের সোনালী আলোয় নানান দেশের যান্ত্রিক বলাকার আসা যাওয়া দেখছি। দিনটা সকালেও সুন্দর ছিল এই বিকালেও অনেক সুন্দর। শুধু এয়ারপোর্টে আসার সময় খানিক বরফ উড়াউড়ি করছিল। সাধারনত এই সময়ে আবহাওয়া খারাপ থাকার সমুহ সম্ভাবনা থাকে। বরফের কারণে নির্ধারিত সিডিউল বদল হয় অনেক সময়। বছর তিন আগে একবার তো ক্রিসমাস করতে হলো অনেক যাত্রীকে এয়ারপোর্টে।

সময়ের আধঘন্টা আগে কালো রঙের মাঝাারি একটা প্লেন এসে লাগল গেটে। যারা এলো তারা নেমে চলে গেলো অন্য পথে। আর আমাদের ওঠানোর জন্য ঝটপট দুজন পরিপাটি মানুষ এসে দাঁড়িয়ে গেলো ডেস্কে এবং দরজার সামনে। লম্বা সারি পরে গেলো সাথে সাথেই তাদের সামনে।

র্নিবিঘ্নে কিউবান প্লেনে উঠে আমরা আমাদের র্নিধারিত আসনে বসলাম। আমার আসনের জায়গাটি হলো দারুণ। খোলামেলা চওড়া । এবং পাশের দুটো আসনেও কেউ নাই সুতরাং সবটা জায়গা জুড়ে আমার রাজত্ব।

ঠিকঠাক হয়ে বসার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই প্লেন চলতে শুরু করল। আমার শেষ ম্যাসেজটা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে এরোপ্লেন মুড করে বন্ধ করে দিতে হলো মোবাইল। মিনিট খানেকের মধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টি। নিচের মেঘের ঘনঘটার উপরে এক রঙিন পৃথিবী। সন্ধ্যার অস্তরাগে রাঙ্গিয়ে দিয়েছে দিগন্ত। মেঘের উপর রঙের কারুকাজ। যার কোন তুলনা হয়না ব্যাখ্যা হয় না শুধু উপভোগ করা য়ায়। খুব ইচ্ছে হতে থাকল এমন একটা ছবি যদি আঁকতে পারতাম। যতক্ষন আলো দেখা গেল বাইরে আমার দৃষ্টি লেপ্টে রইল তার সাথে।

চোখের সামনের মুঠো আড়াল করে দেয় পাহাড়। তেমন হলো যখন বিমান ক্রুরা আলো জ্বালিয়ে কাজ শুরু করে দিল যাত্রী সেবার। আকাশের ঘরে ফিরে এলাম বাইরের দিগন্ত থেকে।

খাবার দাবার সেরে ঘুম জড়িয়ে আসতে শুরু করল চোখে। এখন কোন কাজ নেই আর কদিন ঠিক মতন না ঘুমানোর ধকল। বেশ আয়েসে শরীর বিছিয়ে দিলাম তিনখানা শূন্য সিট জুড়ে। রাজযোটক ভ্রমণের শুরুটা শুরু হলো আয়েসি ভাবে। পায়ের নিচে সর্ষে আমার, না চাইতে এমন হুটহাট বেড়িয়ে পরতে হয়েছে অনেকবার। আর ইচ্ছে আয়োজন করে লম্বা ভ্রমণ সেতো আমার প্রিয় একটা বিষয়।

সাড়ে তিনঘন্টার আকাশে ভাসা সময় দ্রুত শেষ হলো। ঘুম জড়ানো ভাব কাটাতে মাঝে আরো একবার কফি চেয়ে পান করলাম। কফিটা দারুণ লাগল। ফাস্টফুডের দোকানের মতন নয় একদম ঘরে বানানো ফ্রেস মনে হলো।

দারুণ ল্যান্ডিং করল পায়লট। সব যাত্রী হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল সুন্দর নিরাপদ ভাবে মাটিতে নিয়ে আসার জন্য।

আমার মনে হলো মাটিটি অন্যদেশের মাটি। এই পৃথিবীর এক আকাশের নিচে হলেও পাখির মতন উড়ে যে কোন দেশে চলে যেতে কত বাঁধা মানুষের। এয়ারপোর্টে কত পরীক্ষা নিরীক্ষা পেরিয়ে আসতে হয়। বাংলাদেশিরা ভিসা ছাড়া আসতে পারে কিউবাতে। এই সুযোগটা ভালোলাগল। আপনারা যারা কিউবা ঘুরতে যেতে চান তাদের জন্য তথ্যটা দিয়ে রাখলাম।

উপর থেকে অনেকটা লম্বা পথ পেরিয়ে নিচে নেমে এসে কয়েকজন গাইড দেখলাম। তারপর আর কোন পাহারাদার বা সিকিউরিটি বা গাইড কিছুই দেখলাম না। এত্ত মানুষ নেমে এলো কারো কোন সাড়া শব্দ নাই। হৈ চৈ চ্যাচামেচি নাই। নিঃশব্দ চলাচল লাল দেয়ালের পরিচ্ছন্ন বিশাল ঘর জুড়ে ।

সাধারনত প্লেনে একটা কাগজ দেয়া হয় পূরণ করার জন্য। কিন্তু এই প্লেনে সেটা দেয়া হয়নি। এয়ারপোর্টে ঢুকার পর দেখিয়ে দিল ফর্ম রাখা আছে সেটা পুরণ করার জন্য। সবাই এক একটা ফর্ম পুরণ করে এগিয়ে গেলাম লাগেজ বেল্টের কাছে। পরিপাটি করে নামানো আমাদের ব্যাগ স্যুটকেস এবং আরো অনেক যারা এখনও এসে পৌঁছাননি তাদের। টাকা পয়সা পাওয়ার আসায় বা হাতিয়ে নেয়ার জন্য শিকারী চোখ মেলে কাউকে ঘুরাঘুরি করতে দেখলাম না। যেমনটা হয় একমাত্র বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে। আমরা নিজেদের ব্যাগ স্যুটকেস তুলে নিয়ে আরো কিছু সামনে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। সামনের ছোট ছোট বুথে একজন করে যাত্রী যাচ্ছে ইমিগ্রেশন পার হতে। যদিও দলবদ্ধ সবাই পরিবার বা বন্ধুর। কেবল ছোট বাচ্চা মা বা বাবার কোলে তাদের সাথে যাচ্ছে ইমিগ্রেশনের ঘাটি পার হতে।

নিরাপত্তা বেষ্টনি পেরিয়ে বাইরে আসার পর, বেশ আবেস জমানো গরম হাওয়ার অভ্যথনা পেলাম। শরীর মন পুলকিত হয়ে গেলো। শীতের কবল থেকে শুধু নয় ভারী ভারী কাপড় জামার ওজন থেকেও মুক্ত থাকা যাবে। দেখলাম বেশ কজনা গাইড কোম্পানির নাম সম্বলিত কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের গাইডের সাথে দেখা হলো। সে আমাদের সাথে করে শাটল বাসের কাছে নিয়ে গেলো।

বাসের পেটের ভিতর ব্যাগ ঢুকিয়ে দিয়ে আমরা বাসে চড়ে বসলাম। গুনে গুনে সব যাত্রী আসার পর, গাড়ি ছাড়ল।

প্রতিটি হোটেলের দায়িত্ব শাটল বাস পাঠিয়ে যাত্রীদের হোটেলে নিয়ে যাওয়ার ।

বাস চলার সাথে গাইড নিজের পরিচয় দিয়ে কিউবার পরিচয় দিতে শুরু করল। যদিও ভালো ইংরেজি বলছিল মেয়েটি তারপরও বারবার সে ভালো ইংরেজি বলতে পারছেনা বলে দু:খ প্রকাশ করছিল। প্রয়োজনীও কিছু তথ্য সরবরাহ করল। যেমন চলতে ফিরতে অর্থ প্রয়োজন, সেই অর্থ কেমন করে কোথায় কিউবান পেসোতে বদল করা যাবে। হোটেলের কাছাকাছি খাবার দোকানের সময়। পেসো বদল করতে না পারলেও ডলার বা ইউরো দিয়ে কেনা কাটা করা যাবে। টেপের পানি খেয়ে পেট খারাপ হতে পারে। সাবধান, সতর্কতার টিপস।

আমাদের গন্তব্য ভেরেডেরো শহর, এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। প্যাকেজে পাওয়া আমাদের হোটেলটিও সবার শেষে। প্রায় আধঘন্টার যাত্রা মাঝেমাঝে এক একটা হোটেলে বাস থামছে। যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে তাদের নিদৃষ্ট গন্তব্যে। অন্ধকারে তেমন ভালো দেখতে পেলাম না বাইরের প্রকৃতি। তবে হোটেলগুলো অনেক সুন্দর এবং দারুণ ভাবে আলোক সজ্জায় সজ্জিত। ক্রিসমাস এবং নতুন বছরের সাজ নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করছে শহর।

শেষ গন্তব্যে পৌঁছে নিজেদের রুমে যাবার জন্য বাক্স প্যাটরা টানাটানি করতে গেলাম। হোটেল বয় বলল ও সব নিয়ে যাচ্ছে রুমে। রুমে ঢুকে চমকিত হলাম। দারুন আধুনিক একখানা ঝকঝকে এ্যপার্টমেন্ট বাড়ি। দুই রুম দুই বাথরুমসহ ফ্রিজ, মাক্রওয়েভ, স্টোভ, ওয়াশার, কফিমেকার, দুখানা টেলিভিশন। আধুনিকতার কোন কিছুরই কমতি নেই। কিচেনে রান্নার হাড়ি পাতিল থেকে প্লেট গ্লাস, চামুচ কাপ সব সাজানো আছে যথাযথ।

লজ্জিত হলাম নিজেই। আমি জানতে চেয়েছিলাম হোটেল ম্যানেজারের কাছে, গরম পানি আছে তো বাথরুমে। শীত, গ্রীষ্ম, সব সময় গরম পানির ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি অনেক বছর থেকে। এখানে গরম তাই হয়তো বা গরম পানি নাও থাকতে পারে। তবে বিষয়টা নির্ভর করে মানসিকতা এবং সংস্কৃতির উপর। প্রচণ্ড শীতে দারজিলিংয়ের হোটেলে জিজ্ঞেস করেছিল গরম পানির রুম নিবে নাকি ঠান্ডা পানিতে চলবে? এখানকার জীবন যাত্রা টুরিস্ট নির্ভর এবং বেশীর ভাগ মানুষ উন্নত বিশ্বের তাই তাদের পছন্দ এবং উপযোগী করে করা হয়েছে। ম্যানেজার গরম পানি, সাথে এয়ারকন্ডিসন আছে সেটাও জানিয়ে দিয়েছিল।

পরিপাটি সুন্দর বাড়িতে থাকতে কার না ভালোলাগে। মন ভালো হয়ে গেলো আমাদের। ফুরফুরে মন নিয়ে দরজা খুলে পিছনের বারান্দায় বের হলাম। বিশাল একখানা খোলা বারান্দার একপাশে বিছানা পাতা। একপাশে পেটিও চেয়ার টেবিল। দূরে হালকা আলোর মালা আর লবন হাওয়ার বাতাস জড়িয়ে নিতে থাকল শরীর। আমরা সবাই বারান্দার বিছানায় সটান হয়ে ঘন নীল আকাশ আর কারুকাজ বোনা তারা দেখে প্রথম কিউবান রাত উপভোগ করতে করতে। গল্পে মত্ত হলাম।

রাত একটা পর্যন্ত খাবার রেস্তোরা খোলা থাকে শুনেছি। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজলেও বাইরে জমজমাট আলোর ছন্দ আর মানুষের চলাচল গান বাজনার শব্দ আসছে ক্যানেলের ওপর পার থেকে । প্লেনের খাওয়া পেট ভরপুর ছিল। কেউ বাইরে যেতে চাইল না। টিভি চালিয়ে স্প্যানিস চ্যানেল দেখতে দেখতে পেয়ে গেলাম সিএনএন, সিটিভি। এমন কি হিন্দি মুভি!

যে যার বিছানায় শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কেটে গেলো।