কবি মৃদুল দাশগুপ্তের সাথে একটি বিকেল: সূর্যসেনের দেশ থেকে মঙ্গলপাণ্ডের দেশে • জিললুর রহমান


২২ জানুয়ারী ২০১৮। কোলকাতায় নেমেই ছুটলাম হাওড়া রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। হুড়াহুড়ি করে টিকেট কেটে বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়াতে হবে। তড়িঘড়ি করে পৌঁছে দেখি কবি মৃদুল দাশগুপ্ত এসে দাঁড়িয়ে আছেন। বলেছিলাম, ট্রেনের ব্যাপারগুলো আমার জটিল লাগে। তাই শ্রীরামপুরে নিয়ে যাবার জন্যে সশরীরে এসে হাজির। চেপে বসলাম লোকাল ট্রেনে। মুড়িভাজা আর গজা চিবাতে চিবাতে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কথার শুরুতেই বললাম পশ্চিমবঙ্গের এই দিকটা আমার দেখা হয়নি। তখন দক্ষ ঐতিহাসিকের মত মৃদুলদা বলে গেলেন কিভাবে ডেনিস কলোনীর এই অঞ্চলটি ভারতীয় ফেডারেশনে যোগ দেয়। জানতে পেলাম ফরাসি অধ্যুষিত চন্দন নগরে গণভোটে ৯% লোক ফরাসি নিয়ন্ত্রণ থেকে ভারতীয় ফেডারেশনে সংযুক্ত হবার বিপক্ষে ভোট দিলে, তারা বংশপরম্পরায় ফরাসি নাগরিক সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের মধ্যে একজন মৃদুলদা’র বন্ধুও আছেন। জানতে পেলাম, এখানকার ইন্দুবতী ভট্টাচার্য বুদ্ধদেব বসুর আগেই সরাসরি ফরাসি থেকে বোদলেয়র অনুবাদ করেছিলেন, যিনি পরে কংগ্রেসের সাংসদ হন। তিনি দেখতে ছিলেন অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মতো। পরে জেনেছি এই ইন্দুমতী ভট্টাচার্য প্রকৃত-অর্থে বিদুষী। উনি চন্দননগরের প্রবর্তক নারীমন্দির নামে এক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা ছিলেন। তিনি কেবল ফরাসি নয় , কিছুটা স্প্যানিশও জানতেন।

আলাপ চলতে চলতে লিলুয়া, বালি, উত্তরপাড়া, রিষড়া পার হয়ে শ্রীরামপুর থামলাম। শ্রীরামপুর শহরের বুক চিরে রেললাইন দূরে ছুটে চলে যায়। রেললাইনের একপাশে গঙ্গার তীরে প্রাচীন শহর, যার পুরনো বাড়িঘর সব ডেনিস গথিকে তৈরি। কিছু ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে, কিছু সংস্কার করা হয়েছে, আবার কিছু ভবনের পলেস্তারা খসে ভেতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু নিশ্চিত বুঝা যায়, এসব বাড়িঘর ব্রিটিশ গথিকের নয়। রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরলাম গঙ্গার উল্টো দিকের পাড়ে গড়ে ওঠা নতুন শহরের দিকে। এদিকের বাড়িগুলো গত ৬০-৭০ বছরে উঠেছে। রেলস্টেশনের খুব কাছেই মৃদুলদা’র বাড়ি। বৌদি দরজা খুলে দিলেন, চায়ের আয়োজন করলেন। তারপর বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে।

প্রথমেই গেলাম প্রাচীনতম ডেনিস চার্চের সামনে। এই গির্জার প্রধান ফটক, তার কড়িবরগা, এমনকি ঝুলন্ত বাতিও ডেনিশ। গির্জার সামনেই একটি ছোটমতন পার্ক। তাতে সাজিয়ে রাখা সাতটি কামান দেখিয়ে মৃদুলদা জানালেন কৈশোরে দেয়ালে বসে বসে তিনি দেখেছেন ডেনিস রাজকুমারী কামানগুলো রং করতে। সেই শিশু রাজকুমারী পরে ডেনমার্কের রাণী হয়েছিলেন। আরো জানা গেল, সিরাজউদ্দৌল্লা যখন ডেনিশদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তখন এই ক’টা কামান নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে পারা যাবে না বুঝে ডেনিশরা সিরাজকে সাহায্য করেননি। সিরাজ এতে বেশ মনক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। এর পরে এগিয়ে গেলাম আদালতভবনের দিকে। পরিত্যক্ত আদালতভবনের স্তম্ভের দিকে তাকালেই তার বুনন যে ব্রিটিশ আদলে নয়, তা পরিষ্কার বুঝা যায়। 

বলা হয়নি, ২২ জানুয়ারি ছিল সরস্বতী পূজা। এখানে এইদিনে ভ্যানেনটাইন দিবসের মতো তরুণ তরুণীরা ঘুরে বেড়ায়। মৃদুলদা’র বাড়িতে ঢুকার মুখেই একটি পূজামণ্ডপ দেখলাম। যে মেয়েটি মণ্ডপের রক্ষণাবেক্ষণ করছে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানলাম সে বাঙালি হয়ে যাওয়া অবাঙালি। আমার বিস্ময় দেখে, মৃদুলদা আবার খুলে ধরলেন ইতিহাসের ঝাঁপি। শ্রীরামপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার ওপারেই সিপাহীবিদ্রোহ খ্যাত ব্যারাকপুর। এখনো সেখানে সেনানিবাস আছে। সিপাহীবিদ্রোহের সময় অবাঙালি সৈনিকদের পরিবার পরিজন পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এখানে। পরে ব্রিটিশ সরকার তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে যখন জুটমিল স্থাপন করে তাদের কর্মসংস্থান করে তারা এখানেই থেকে যায়। ১৫০ বছরের সময়বিবর্তনে তারা ধীরে মিশে যায় বাংলার আচার সংস্কৃতির সাথে। তারা বাংলায় ভাবে, বাংলায় কথা বলে, এমনকি বাংলার পূজাপার্বণে মেতে ওঠে উৎসবে। তাই যতই বেলা গড়াচ্ছে তরুণীরা সেজেগুজে বেরিয়ে আসছে তরুণদের সাথে সরস্বতী পূজার আনন্দমুখরতায়। তাই কোলকাতা শহরের কেন্দ্রে মাড়োয়ারিদের হিন্দি বাৎচিতে যারা মনে করেন বাংলা ভাষা এখানে বিপন্ন তাদের জানিয়ে রাখতে পারি — যেমন করে মৃদুলদাও বলেন যে, উন্নত সাহিত্য সংস্কৃতির বাংলা কখনো হিন্দির কাছে বিপন্ন হতে পারে না। বরং যেসব অবাঙালি আগে বা পরে বাংলায় আশ্রয় নিয়েছে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যারা থাকছে তারা বাঙালি হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

তাই দেখছি সারাদিন কলেজ পেরুনো কী কলেজ পড়ুয়া তরুণ তরুণীরা জোড়া বেঁধে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের অধিকাংশই বাঙালি বনে যাওয়া অবাঙালি সিপাহীদের বংশধর। 

ঘুরতে ঘুরতে আদালত পাড়া থেকে গঙ্গার ধার দিয়ে আবার শহরের উপকণ্ঠে নিয়ে এলেন কবি। বাড়িতে সরস্বতী দিবস উপলক্ষে নিরামিষ আয়োজন থাকাতে আমাদের নিয়ে গেলেন চমৎকার এক রেস্টুরেন্টে। রেস্তোরাঁ মালিক কর্মচারী সকলেই কবিকে খুব ভালবাসেন। এলাকায় তাঁকে সবাই খুব সম্মান ও খাতির করেন, বুঝা যায়। বেশ উপাদেয় খাবার খেয়ে আমরা আবার এগিয়ে গেলাম গঙ্গার ধার ধরে। আগে ইউরোপের মতো করে গঙ্গার ধারে বাগান করা ছিল। এখনো ২০০ বছরের পুরনো ভাঙা রেলিংয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তবে সে ফুলের বাগান অযত্নে মরে আগাছায় ভরে আছে। 


এই শ্রীরামপুরকে বাঙালি ভুলতে পারে না। এখানেই ভারতবর্ষের প্রথম ছাপাখানার বিকাশ। একসময় বাংলাসহ ভারতের সব ভাষায় ছাপার জন্যে শ্রীরামপুরের উপর নির্ভর করতে হতো। কাঠ কেটে কেটে হরফ বানানো হতো। আমরা যারা লেটার প্রেসে কাজ করেছি, সীসার হরফ দেখেছি—তারা নিশ্চয় বুঝতে পারবেন কাঠ খোদাই করে “ক্ষ” কিংবা “জ্ঞ” জাতীয় যুক্ত বর্ণের ছাঁচ তৈরি করা কতোটা দুরূহ। আজকের কম্পিউটার প্রিন্ট যুগের তরুণেরা কখনোই বুঝবে না ছাপানোর কাজ সে-যুগে কতো বড় বিপ্লবাত্মক ব্যাপার ছিল। 


এসব কথা ভাবতে ভাবতে জুটমিলের চৌহদ্দি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম এক বিশাল সুপরিসর গাছপালায় ঘেরা বিদ্যায়তনের সামনে। দূর থেকে দেখে মনে হলো যেন দাঁড়িয়ে আছি ইউরোপের কোনো রাজভবনের সামনে। ভাবতে পারেন? আজ থেকে ২০০ বছর আগে ১৮১৮ সনে এই শ্রীরামপুর কলেজ স্থাপন হয়। আর এই কলেজের কারিগর স্বয়ং উইলিয়াম কেরি। এই কলেজ বাংলা তথা ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। সেসময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে কেবল স্নাতক ডিগ্রী দেওয়া হতো। আর এই শ্রীরামপুর কলেজ থেকে থিয়োলজিতে মাস্টার্স ডিগ্রী দেওয়া হতো সে যুগের ডেনমার্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে। এর প্রধান ফটকটি উপহার দিয়েছিলেন ডেনমার্কের রাজা। সেকালে পুরো ঢালাই লোহার তৈরি ফটকটি বানাতে খরচ পড়েছিল ১০০০০ টাকা। কলেজটির প্রাঙ্গণে যখন প্রবেশ করি দেখি নানারকম অচেনা বৃক্ষের ছায়ায় এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে। মৃদুলদা বললেন, কেরি ছিলেন একজন বোটানিস্ট, তারও উপরে এক অসাধারণ সংগ্রাহক। তিনি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসব গাছ সংগ্রহ করে এখানে লাগিয়েছিলেন। এখানে নাকি ইউরোপ আফ্রিকা মালয়েশিয়াসহ নানাদেশের গাছ রয়েছে। প্রথমদিকে এসব গাছের নাম ও বৈজ্ঞানিক নাম লাগানো থাকলেও এখন আর তার চিহ্ন দেখলাম না। আহা, আমাদের রোবেন থাকলে ধরে ধরে গাছগুলোর নাম হয়তো জেনে নিতে পারতাম। মৃদুলদা তো যুউলজির ছাত্র। মজার ব্যাপার হলো, সাহেবরা ‘শ্রীরামপুর’ উচ্চারণ পারতেন না। তাই শ্রীরামপুর ইংরেজিতে Serumpore হয়ে গেল।

শ্রীরামপুর কলেজের বৃক্ষশোভিত প্রান্তর ছেড়ে যখন আবার গঙ্গার ধার ধরে ফিরছিলাম তখন কিছুটা ঠাণ্ডা লাগছিল। সোয়েটার মাফলার এনেছিলাম

ঠিকই, তবে তা মৃদুলদা’র বাড়িতে রেখে এসেছি। দাদা টের পেয়ে নিজের গা থেকে জ্যাকেট খুলে পরতে দিতে চাইলেন। এতো আন্তরিক সে আহবান। তবে অবশ্য তাঁর ঠাণ্ডা লাগার সম্ভাবনা হেতু আমি জ্যাকেট নিলাম না। দাদা দেখালেন গঙ্গার ওইতীরে বৃক্ষাচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ব্যারাকপুর সেনানিবাস। মনে পড়ে, ১৮৫৭ সালে এখানেই দানা বেঁধেছিল সিপাহী বিদ্রোহ। আমরা এগিয়ে যেতে যেতে মনে পড়তে লাগল সেইসব কথা। মনে পড়ল মঙ্গল পাণ্ডে ও তার ফাঁসীর কাহিনী। কার্তুজে শুকর ও গরুর চর্বি ব্যবহারের অভিযোগ ইত্যাদি অনুষঙ্গ টেনে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল এই ব্যারাকপুরে অল্প সময়ের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ভারতে। মৃদুলদা’র কাছে জানলাম তাঁর শৈশবে ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁদের মাথার উপর দিয়ে বাড়ির উপর দিয়ে ছুটে যাওয়া গোলাগুলির রোমহর্ষক সব কাহিনী। তিনি নিজ চক্ষে দেখেছেন ভূপাতিত পাকিস্তানী বিমানের টুকরো যার গায়ে চাঁদতারা সুসজ্জিত। শুনতে শুনতে ফেরি পারাপারের টিকিট কেনা হয়ে গেল। আমাদের ফেরি যখন গঙ্গা অতিক্রম করছে তখন মৃদু বাতাস থাকলেও তেমন শীত অনুভব করলাম না। যেন মঙ্গল পাণ্ডে আর সিপাহী বিদ্রোহের উত্তাপ গায়ে এসে লাগছিল। যখন ব্যারাকপুরে ফেরি ভিড়েছে, ততক্ষণ সন্ধ্যা হয়েছে। অন্ধকারে যেন ভূতুরে আলোয় ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সেই বহু প্রতীক্ষিত স্তম্ভের দিকে। যাতে লেখা আছে মঙ্গল পাণ্ডের নাম। এখানেই ফাঁসীতে ঝুলানো হয়েছিল সেদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী মঙ্গল পাণ্ডেকে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ বাক্যরহিত হয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর সম্বিত ফিরতে দেখি দাদা ডাকছেন। সিপাহীবিদ্রোহের সূতিকাগারে পা পড়লো আজ সূর্যসেনের দেশের এক সন্তানের। এ আমার পরম অর্জন। ফাঁসীস্তম্ভের প্রতি নীরব স্যালুট জানিয়ে মৃদুপায়ে হেঁটে গেলাম লোকালয়ের দিকে। গাঢ় গভীর বৃক্ষছায়ায় বাড়িঘর গুলো নিরিবিলি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবগুলো সেনানিবাসের ঘর—হয়তো কোয়ার্টার বা বাসা, হয়তো অফিস ঘর। বাইরে থেকে বুঝার জো নেই। প্রধান সড়ক দিয়ে লোক চলাচলে কোনো বাধা নেই। কিছুদূর গিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

সেই মধ্যদুপুর থেকে আমার জন্যে শ্রীরামপুর থেকে হাওড়া হয়ে আবার শ্রীরামপুরে এসে সারা শহর চক্কর দিয়ে ব্যারাকপুর পর্যন্ত ঘুরে কিছুটা ক্লান্ত নিশ্চয় মৃদুলদা। কিন্তু তার কোনো প্রকাশ তার মুখভঙ্গিতে নেই। তবু জানতে পেলাম, চারবছর আগে তাঁর হৃৎপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয়েছে। তবে তিনি সেসব ভুলে গিয়ে ক্রমাগত ধূম্রসেবন করে চলেছেন। যুক্তি দিতে লাগলেন— ধূমপানে ক্যান্সার হবার প্রত্যক্ষপ্রমাণ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর অসুস্থ হবার যে কাহিনী শুনলাম তা যেন সরলা এরেন্দিরার শতবর্ষের নির্জনতার কোনো অতীন্দ্রিয় গল্প। একদিন তিনি হেঁটে চলেছেন কোথাও কোনো কাজে। হঠাৎ মনে হলো তিনি অনেক তারা দেখতে পেলেন চোখে। সেই তারা দেখতে দেখতে তিনি হেঁটে চলেন সামনের দিকে। তাঁর মনে হতে লাগলো তিনি কোনো ঘন গাঢ় তরলের মধ্যে নেমে যাচ্ছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে গভীর ঘন তরলে যেন ডুবে যান। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একসময় তিনি কোনো সিঁড়ির ধাপ ভেঙে উঠে এলেন উপরে। তখন তাঁর মাথা টলছে, লোকজন চারদিকে জড়ো হয়ে তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন। সবাই জানতে চাইল আপনি এভাবে হেঁটে হেঁটে নর্দমার ভেতরে ঢুকে গেলেন কেন? তিনি জানালেন যে তিনি কোনো মদ্যপান করেননি। তাঁর কেমন যেন মাথাটা ঘুরে উঠেছিল। এরপরে লোকজন তাঁকে একটি বাড়িতে নিয়ে স্নান করিয়ে তারপর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। 
এই কাহিনী শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম ফেরিঘাটে। মৃদুলদা’র হাতে সিগারেট। টিকেট চেকার সিগারেট ফেলে দিতে বললেন। ভাবছি, কতো কতো ফেরিঘাটেই না ঘুরলাম। সব জায়গায় দেখেছি এসব অঞ্চলে লোকজন প্রচুর ধূমপান করে। কিন্তু যুগ পাল্টাচ্ছে। মৃদুলদা মৃদু হেসে ফেলে দিলেন ধূম্রশলাকা। তারপর আবার ভেসে যাওয়া গঙ্গার বুকে। ফিরে আসি শ্রীরামপুর—যেন চিরচেনা পথঘাট। কেবল বর্তমান নয়, এ শহরের রাস্তাঘাট বাড়িঘরের সাথে জ্যান্ত হয়ে ওঠে শতবর্ষের ইতিহাস।

ফিরে আসি মৃদুলদা’র ঘরে। চা খেয়ে যখন বৌদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেলস্টেশনের দিকে এগুলাম, কেমন বিষণ্ণতা ভিড় করে আসে মনে। মৃদুলদা’র সাথে গল্প করতে করতেই ট্রেন এসে গেল। তাড়াহুড়া করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। ভিড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার পেছনে। আমি আর মৃদুলদা’র কাছে সৌজন্যের বিদায় নিতে পারলাম না; পারলাম না একবার হাতটিতে হাত মেলাবার। হলো না বিদায়ের আলিঙ্গন। 



জিললুর রহমান
জন্ম ১৬ নভেম্বর, ১৯৬৬; চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, উত্তর আধুনিক নন্দনতত্ত্ব চিন্তক জিললুর রহমান। আশির দশকের শেষার্ধ থেকে লেখালেখি করেন। পেশায় চিকিৎসাবিজ্ঞানী। শিক্ষা : এমবিবিএস, এমফিল (প্যাথলজি), পিএইচডি। পেশা : সহযোগী অধ্যাপক, প্যাথলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। প্রকাশিত বই : অন্যমন্ত্র [কাবিতা, লিরিক, ১৯৯৫] শাদা অন্ধকার [কবিতা, লিরিক, ২০১০], ডায়োজিনিসের হারিকেন [কবিতা, ভিন্নচোখ ২০১৮], আত্মজার প্রতি [দীর্ঘকবিতা, বাঙময় ২০১৭], শতখণ্ড [দীর্ঘকবিতা, বাঙময় ২০১৭], উত্তর আধুনিকতা : এ সবুজ করুণ ডাঙায় [প্রবন্ধ, লিরিক, ২০০১, পরিবর্ধিত ২য় সংস্করণ খড়িমাটি ২০১৯], অমৃত কথা [প্রবন্ধ, লিরিক, ২০১০], আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব : কয়েকটি অনুবাদ [অনুবাদ, লিরিক, ২০১০], নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ [অনুবাদ, বাতিঘর ২০১৮], এমিলি ডিকিনসনের কবিতা [অনুবাদ, চৈতন্য ২০১৮]।
সম্পাদনা : তরঙ্গ (১৯৯০, ১৯৯১) ‘লিরিক’ বুলেটিন (১৯৯৫), যদিও উত্তরমেঘ (২০১৭)। 
সম্পাদনা পরিষদ সদস্য— ‘লিরিক’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা ‘লিরিক’ উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যা ১,২,৩,৪। ই-মেইল : drzillur@gmail.com

SHARE THIS

Author: