ছোটগল্প • অন্তুর মন • ভাস্কর চৌধুরী


অন্তুর মন খারাপ। কেবল এই শিতেলা বিকেল। হালকা হালকা ঠান্ডা পড়ছে। বাড়ির পাশের কয়েকটা পুরনো সেগুন আর মেহেগুনি গাছের পাতা টুপ টুপ করে পড়ছে। একটু আলো চলে গেলে একটু আঁধার নেমে এলো। অন্তুর মন খারাপ বাড়লো। কেউ তো জিজ্ঞেস করবে, কিগো অন্তু, মন খারাপ ক্যানো? তোমার দিদির নাকি বিয়ে। আর জামাই নাকি অনেক বড় পাশ। বড় চাকুরী করে। তোমার দিদিকে সোজা ঢাকা নিয়ে যাবে। সাথে তুমিও যেতে পারবে। মন খারাপ ক্যানো?
অন্তু নিজেকেই বললো, মন খারাপের কি কারণ লাগে? এই যে , তোমরা বলছো, আমিও নাকি দিদির সাথে চলে যাবো। এটাও তো বড় কারণ হতে পারে। কিন্তু আমি তো মাকে ছাড়া কোথাও থাকতে পারবো না । তোমরা জানতো,এই পচা গ্রামের কোনে এই বিশাল দোতলা বাড়ি । বাড়ি মা আমি আর কবুতর থাকি । দিদিটা ছিলো। কলেজে যেত। এখানকার এক ছেলে পিছু নিলো। সুন্দর মিষ্টি চেহারা। কিন্তু বিড়ি খায়। আচ্ছা যদি বা তুমি দিদিকে চাও, তো বিড়ি ছেড়ে অন্তত ক্যাপিস্টেন সিগারেট টানবে। আর রাস্তা ছেড়ে অন্তত একটা চিঠি আমার হাতে দিলে, আমি দিদিকে দিতাম । মা জানতো পরে। ততদিনে হয়তো দিদির মনটা পেতে। তোমার বাবা তো এখানকার চেয়ারম্যান।পার্টির লোক । আর আমরা তো খুব নিরিবিলি মানুষ। এই গ্রামে মা ছাড়া এক পিসির বাড়ি আছে। পিসি আসে নিয়মিত। আমাদের খোঁজ খবর করে পিশে মশাই শহরে চাকুরী করে। সুন্দর সুন্দর বই এনে দেয়। বলে , অন্তু পড় । একা থাকলে বই বন্ধু হয়ে যায়। তুমি বই এর সাথে বন্ধুত্ব করো। কি ? পারবে না ? অন্তু বই এর প্রতি মনোযোগ দেবার সময় পায় নি। অন্তুর কত কাজ। জারুল গাছে ফুল এসেছে। লাগালিঙ্গমে অদ্ভুত সুগন্ধি ফুল। পলাশ ফুটেছে। এইসব ছেড়ে অন্তু বই পড়বে কখন । এখন শীত আসবে বলে, ছাদে লেপ শুকাচ্ছে। ছাদটা দ্যাখো, অন্তুর মতো একা। ভাবে অন্তু। দিদির ছাদে যাওয়া বারণ । ওই ছেলেটা তাকিয়ে থাকে। তাই মা দিদিকে বকেছে। দিদির চুল শুকনো ছাড়া কি ছাদটা মানায় বলো? অন্তু ভাবলো, সে দিদির সাথে যাবে না। ক্যানো যাবে? ছেলেটার প্রতি অন্তুর বড় মায়া। অথচ ওই ছেলেটা কারণেই দিদিকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেয়া হচ্ছে। পিসি বলেছে, পিসি জামাই ঠিক করেছে। দিদির লম্বা চুল দীঘল দীঘির মতো চোখ। ওই দীঘির মতো চোখের কথাটা তো তাকে ওই ছেলেটা বলেছে। সুন্দর কথাটা। দীঘির মতো দিদির চোখ । অন্তু আজ এই কথাটা দিদিকে বলে একটা চড় চেয়েছে। তারপর অন্তুর চোখ ফেটে জল। দিদি তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে বললো, ওসব শুনিস না আর। শুনে কি লাভ বল? আমি তো বিয়ের পর ঢাকা চলে যাবো। মনটা খারাপ করে দিলি। অন্তু বুঝলো, কথাটা দিদির মনে ধরেছে । কি জানি, আরো কত কি গোপন কথা আছে । সব কি অন্তু জানে? এই ভেবে অন্তু বিকেলে ঘরের বাইরে এলো। এই বিশাল বাড়িতে তিনটে মানুষ। সকলের মনের কথা সকলে কি জানে? দিদি একেলা।দিদির পাশে ছেলেটাকে মানাত ভালো। হলো না। মা একেলা। বাবা তার জন্মেরসময়েই চলে গেছেন। অন্তুও একেলা।দিদিটা একা একা কি যে ভাবে। রাজ্যের ভাবনা দিদির দীঘল চুলে। বাড়িটা নিজেও একেলা। আর গাছগুলো দ্যাখো? ওরাও বোবা আর একেলা। এই ভেবে অন্তু একটু ঢাল দেখে পা ঝুলিয়ে বসলো। আঁধার নেমে এলো । অন্তুর মনে হলো, এই বিশ্ব চরাচরে কোথাও কেউ দুই জন নেই। অন্তু এক সাথে দুজন মানুষ খুব কম দেখেছে।দিদিকে নয়। মাকে নয়। পিসিকেও নয়।
তখনই ছাদ থেকে ডাক পড়লো। অন্তু, বাড়ি এসো। বা ড়ি এ সো-- মায়ের ডাক। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গিয়েই অন্তু ঢাল গড়িয়ে ক্রমশঃ নিচে পড়তে লাগলো। মায়ের শেষ ডাক অন্তু শুনলো , ওরে অন্তু রে-----

SHARE THIS

Author: