গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গল্প • রাদো ঘড়ি • হামিম কামাল

গল্প • রাদো ঘড়ি • হামিম কামাল


১.

কে যেন অনশন করে মারা গিয়েছিল। যা চেয়েছিল পায়নি। আমার শৈশবের স্মৃতি এটা। কিন্তু এই এটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু মনে নেই যেটা বলে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারি। সেই প্রথম অনশনের সঙ্গে আমার পরিচয়। মনে আছে, অনশনকারী একজন নারী ছিলেন। মাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও না খেয়ে আছে কেন? মা আমাকে বুঝিয়েছিলেন, না খেয়ে ও আমাদের ওপর ভরসা করছে। এবার যেন আমরা ভালোবেসে ওর চাওয়াটা মেটাই। অনশনটা সবচেয়ে কোমল আন্দোলন। যাদের কাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন তাদের ভালো মানুষ ধরে নেওয়া হয়। যেন ওর না খেয়ে থাকায় ওদের অনেক কিছু এসে যায়। কখনো সত্যিই এসে যায়, কখনো কিছু এসে যায় না। আমি মায়ের কথা কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কিছু পারছিলাম। যেটুকু পারছিলাম সেটুকু বোঝার গৌরবে চুপ থাকলাম। কিন্তু যেটুকু বুঝলাম না সেটুকু লালন করে রাখলাম কখনো আর কাউকে জিজ্ঞেস করব। পরে মেয়েটা যখন মারা গেল, আমি এটুকু নিশ্চিতভাবে জেনেছিলাম, যাদের কাছে সে দাবি তুলেছিল, তার মৃত্যুতে তাদের কিছু যায় আসে না। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, মেয়েটা কি তা জানত না? 

২.

কী একটা যেন চেয়েছিলাম মায়ের কাছে। পাইনি। কী পাইনি খেয়াল নেই। কিন্তু সেই না পাওয়াটা আমাকে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে অনেক ভুগিয়েছিল। স্বপ্নে আমি শুধু লম্বা লম্বা পথ হেঁটে হেঁটে লম্বা লম্বা কথা বলে গেছি ধূসর সব মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছু একটা খোঁজে যেন আমাকে পাহাড় ডিঙাতে হবে, ঠিকানা জানা নেই, কেউ আমাকে ঠিকানাটা দিচ্ছিল না। একটার পর একটা বাধা এসে আমাকে কেবল সরিয়ে নিচ্ছিল। সব হচ্ছিল, কেবল যা চাই সেটাই হচ্ছিল না। আর বাস্তবে আমি খুব মনমরা হয়ে থাকলাম। আমার বন্ধু, মনে মনে যাকে ভালো বাসতাম আমি, এসে বারবার জিজ্ঞেস করে গেছে, ‘তোমার কী নিয়ে মন খারাপ?’ আমি বলিনি। শেষে সে বলেছে, আমাকেও সে কোনোদিন কিছু বলবে না। আমি তখন আর থাকতে পারিনি। তাকে ডেকে বলেছি, ‘শোনো, তুমি মন খারাপ কোরা না। আসলে কী একটা যেন আমাকে দেবে বলেছিল আমার মা, দেয়নি। তাই মন খারাপ। আবার, সেই জিনিসটা যে কী, সেটা মনে করতে না পেরেও আমার মন খারাপ। শুনলে তো। এবার বলো, কী করব। কিভাবে আমার মন ভালো হবে।’ আমার বন্ধুটি হেসে চুপ করে আমার পাশে বসেছিল। তার কাছে কোনো সমাধান ছিল না।

৩.

কাকে যেন কারা মেরে ফেলেছে, পত্রিকায় তার ছবি। আমার বাবা ছবিটা দেখে পত্রিকা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। আমি বসেছিলাম অপরপাশের চেয়ারে। খানিকটা উঠে এসে ঝুঁকে তাকিয়ে দেখলাম ছবিটা। একজন মানুষকে অনেকগুলো মানুষ ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। মানুষটার মাথা থেকে সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, মানুষটি কে? বাবার নিরুত্তর। আমি আমাকে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে মানুষটি? মা নিরুত্তর। আমি মানুষটির নাম উচ্চারণ করে পড়েছিলাম, মনে আছে, কিন্তু কী সেই নাম, তা আর মনে নেই। তবে তখন বেশ ক’দিন মনে ছিল। আমি স্কুলে গিয়ে আমার বন্ধুদের বলেছিলাম মানুষটিকে তারা চেনে কিনা। একজন চিনেছিল, সে আমার সেরা বন্ধু ক্লাসের। এখন দেশের বাইরে কোথাও থাকে। চেনে বলার পর আমি কী বলেছিলাম, সে-ই বা প্রত্যুত্তরে কিছু বলেছিল কিনা আমার মনে নেই। আজকাল অন্তর্জালে পুরনো, হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়। তাকে পেলে আমি জিজ্ঞেস করব- এরকম কিছু তার মনে আছে কিনা। 

৪.

কে যেন বিদেশে যাবে, আমরা সবাই বিমানবন্দরে ছিলাম। কিন্তু কে সেই লোক, কোথায়ই বা সে গিয়েছিল তার কিছুই আজ আর মনে করতে পারি না। শুধু মনে আছে বিমানবন্দরের বিরাট ছায়ান্ধকারে আমি আমার মায়ের হাত ধরে একবার এপাশে যাচ্ছি, আরেকবার ওপাশে। সবাই জিজ্ঞেস করছে, ‘সে’ এসেছে কিনা। ‘সে’ যাবে বিদেশে, কিন্তু তারই দেখা নেই। সবাই খুব বিরক্ত। কেউ কেউ আবার ভীত। আমাদের না দেখতে পেয়ে সে কাচের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে গেল কিনা। বিমানবন্দরের বাইরে অনেক মানুষ, এবং তখন মোবাইল ফোনের যুগও নয় যে এ তাকে ফোন করে খুঁজে বের করতে পারবে। যারা ‘তার’ অপেক্ষোয় ছিল তারা নিজেরাও মাঝে মাঝে একে অপরকে হারিয়ে ফেলছিল। এ অবস্থায় খুবই সম্ভব, যার জন্যে অপেক্ষা সে হতাশ হয়ে দুপাশে মাথা নেড়ে একসময় কাচের দেয়ালের ওপারে চলে গেছে, যেখানে বিরাট একটা উড়োজাহাজ তার অপেক্ষায়। যাওয়ার আগে সে হয়ত বারবার পেছনে তাকিয়েছিল একটা পরিচিত মুখের আশায়, কিন্তু দেখতে পায়নি। বিমানবন্দরের আকাশপ্রতীম বিপুলা ছাউনির নিচে উড়ে বেড়াচ্ছি অগনিত অসংখ্য জালালি কবুতর। সেই মানুষটির দেখা শেষতক পেয়েছিলাম কিনা আমার মনে নেই, সম্ভবত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, যে গাড়িটা আমরা ভাড়া করে নিয়ে গিয়েছিলাম- একটা নীলরঙা মাইক্রোবাস, তার সিটে গা এলিয়ে। কিছুদিন আগে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কে সেই লোক যার জন্যে...’ মা নিচের ঠোঁট কামড়ে ভুরু কুঁচকে ভাবতে বসল। এমন কিছু আদৌ ঘটেছিল কিনা সেটাই তার মনে নেই। 

৫.

কে যেন হারিয়ে গিয়েছিল। আমি আমার বন্ধু তালুকদারকে নিয়ে একটা খালের পাশ দিয়ে দৌড়ুচ্ছি। আমরা কি হারিয়ে যাওয়া তাকে খুঁজছিলাম? না। দূরে খালের পশ্চিমধারে এক ডোবাপুকুরর সঙ্গে যোগ, সেখানে কার যেন লাশ ভেসে উঠেছে। কোমরের কাছে ষোল মাছে খাওয়া। এতো কিছু আমার মনে আছে, কিন্তু কে হারিয়ে গিয়েছিল আর কার লাশই বা আমরা দেখেছিলাম, আদৌ দেখেছিলাম কিনা, কিছুই মনে নেই। 

৬.

কৈশোরে একবার দাদুবাড়ির পুকুরপাড়ে কার সঙ্গে যেন বসে মিষ্টি সব আলাপ করেছিলাম। তার মুখটা শ্যামল, চোখ দুটো টানা টানা, কণ্ঠ খানিকটা ছেলে ছেলে ভাঙা ভাঙা, শুনতে আমার ভালো লেগেছিল। একটাই সন্ধ্যা কেবল, পুকুরপাড়ে আমার পাশে বসে অনেক কথা সে বলেছিল। ঢাকা থেকে গিয়েছিলাম দাদার বাবার জন্মবার্ষিকী পালনে, বা মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে, ৯ ফাল্গুন। ঢাকায় থাকি বলেই বোধয় মেয়েটি আমার সঙ্গে সাধ্যমতো প্রমিত রীতিতে কথা বলছিল। মনে মনে তার সঙ্গে বুঝি প্রেম হয়ে গেল ভেবে সুখ সুখ পাচ্ছিলাম, আমি বরাবরই প্রেমিক প্রকৃতির। মেয়েটির সঙ্গে সারা দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি অসংখ্য রোমাঞ্চকর মানসিক লেনাদেনা হয়ে গেল। অনুষ্ঠান শেষ হলো, আমার সেই আত্মীয়াও চলে গেল। পরের বছল নাম ভুলে যাওয়া তার ছায়া ছায়া তার মুখের গড়ন, কথার বর্ণনা আমি পরে অনেকবার দিয়েও কারো কাছ থেকে তার পরিচয়টা পাইনি, কেউ চেনেনি তাকে। আর কখনও তার সঙ্গে দেখা হয়নি আমার।

৭.

দেয়ালের ওপর বসে পা দোলাতে দোলাতে কে যেন আমাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার আপার নাম পাখি, তাই না?’ ছেলেটা বয়সে আমার বড়, তাকে আজও চিনতে পারি না। ছেলেটা আমার হাত দুটো তুলে নিয়ে বলেছিল, ‘কী নরম!’ মেজাজ খারাপ হলেও আমি হাসলাম। সবচেয়ে শোচনীয় অংশটা ঘটল এরপর। ছেলেটা বলল, ‘তোমার আপার হাতও কি এমন নরম?’ তখনও আমি হাসলাম, সেই লাজুক লাজুক সুখী সুখী হাসি। আমার পিঠ চাপড়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কিছু খাবে?’ আমি তার হাত গলে বেঁকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম । কে সেই গোপন পাণিপ্রার্থী আমার বোনের? আমার বোন তখন প্রথম তারুণ্যে পা দিয়েছিল, আর সেও ছিল প্রথম তরুণ। আমি শেষ কৈশোরে।

৮.

কে যে আমায় কী যেন খেতে শিখিয়েছিল, অচিন গাছের নচিন কোনো ফল। আমার প্রথম গ্রামীন বন্ধু সে, এটুকু জানি। নানাবাড়ির সবুজ অন্ধকারে সারা দুপুর দুজন বিভূতিভূষণের গল্পের পাতায় যেন দৌড়ুলাম। সোনালী হলুদ-পাটকিলে এক অদ্ভুত রহস্যগন্ধা বিকেল। শহরে ফিরে এসে তার মুখ ভুলে গেলাম। এরপর দেখা হয়নি প্রায় চব্বিশটি বছর। অনেক অনেক দিন পর শুনেছি, কে যেন পাগল হয়ে গেছে গাঁয়ে, আমার নাকি বন্ধু ছিল সে, প্রায়ই এসে জিজ্ঞেস করত আমার কথা। নাম মনা। মনাই কি আমাকে... আমি মনে করতে পারলাম না। যদি সে-ই হয়ে থাকে তো... পুলকিত মন, আমি ভুললেও হয়ত সে ভোলেনি। তাকে যেদিন দেখতে যাব, শুনি পালিয়ে গেছে। পাগল পালিয়েছে, কে আর রাখে খোঁজ। সেবছর গেল। পরের বছর আবার গেলাম গাঁয়ৈ। মনে মনে কল্পনার কত জাল, যেন তার দেথা পাব, বোধয় সে-ই, এ-ই সেই, আমার সেই বন্ধুবর, গুঁড়োমরিচ আর লবণ মাখিয়ে খেতে শিখিয়েছিল সেই বুনো ফল। কিন্তু কোথায় কে। সে ফিরে আসেনি। পরের বছর নয়, তার পরের বছরও নয় হয়ত আর কোনোদিনই আসবে না। তার পরিবারও আশা ছেড়েছে। মনাকে যদি দেখতে না পাই, কোনোদিন জানতে পারব না ও আমার সেই বন্ধুটি কিনা। ভুলে যাওয়া এক মধুমধ্যাহ্নের অযাচনার বর-বিভূতিভূষণ।

৯.

কিন্তু একটা রাদো ঘড়ি আমার পাওয়ার কথা ছিল, মনে করতে পারি। বাবা কথা দিয়েছিলেন। তবে একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন— ক্লাসে প্রথম হতে হবে। প্রথম আমি কোনোদিন হতে পারিনি। বাবাও সেই গ্লানি নিয়ে একদিন ছবি হয়ে গেলেন। ঘড়ি আমার পাওয়া হলো না। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা যা দিতে চেয়েছিলেন তা যেন ঠিক ঘড়ি ছিল না। আমিও বাবার কাছ থেকে ঘড়ির আড়ালে যেন অন্য কিছু চেয়েছিলাম। 



হামিম কামাল
জন্ম: ৯ অগাস্ট ১৯৮৭, ঢাকা। 
প্রকাশিত বই: জঠর (২০১৫), কারখানার বাঁশি (২০১৮), সোনাইলের বনে (২০১৯)।
গল্প • চ্যাটিং • সত্যজিৎ বিশ্বাস

গল্প • চ্যাটিং • সত্যজিৎ বিশ্বাস


(এক) 

-আমি সাদিয়া ফারজানা একা। অপরিচিত কারো সাথে এই প্রথম চ্যাট করছি। বলেন তো কেন? 
-- কেন? 
- আপনার লেখা আমার খুব ভালো লাগে। আপনি এত ভালো লেখেন কি করে সেই রহস্য জানতে। 
-- রহস্য অতি সাধারন। একসময় প্রচুর প্রেমপত্র লিখতাম তো, সেই থেকেই। 
- ভাইয়া কি আমার সাথে ফান করছেন? 
-- কী বিপদ, ফান করবো কেন? সত্যিটাই তো বললাম। আজকাল সত্যি কে মানুষ ফান ভাবে আর ফান করলে ভাবে সত্যি। তাই না? 
- কী জানি ভাইয়া, আমি এত বুঝিনা। 
-- না বুঝলে চলবে কি করে? 
- মানে কি? কী চলবে কি করে? 
-- বললাম, না বুঝলে কথা চলবে কি করে? 
- ও, তাই বলেন। 
-- তাইই তো বলছি। এই যে এতগুলো কথা বললাম, এরমধ্যে কোনো মজার ব্যাপার কি বোঝা যায়নি? 
-ভাইয়া কী যে বলেন? এরমধ্যে বোঝার কি আছে? 
--অবশ্যই আছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝার কথা। 
-ভাইয়া, আমি কিন্তু বাচ্চা মেয়ে না। এই ছোট্ট পুরো কনভারসেশনটা দু’বার পড়লাম। এখানে বোঝার কিছুই নেই। আপনি আমাকে নিয়ে ফান করছেন। এটাই মজার। 
--হা, হা, হা... সেই কথাই তবে আবার বলি, আজকাল সত্যি কে মানুষ ফান ভাবে আর ফান করলে ভাবে সত্যি। কী অদ্ভুত, তাই না? 
-আপনি কিন্তু আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। 
--যদি সত্যি হয়? 
-যদি সত্যি আমাদের এই চ্যাটিং এ মজার কোনো ব্যাপার থেকে থাকে তাহলে আপনাকে একটা বর দেবো। ওই যে দেবতা যেমন বর দেয়, তেমন বর। 
--ঠিক তো? 
- খুব ঠিক। বলেন শুনি কি মজার ব্যাপার আছে? 
--এতক্ষন ধরে আমরা যে চ্যাটিং করলাম, আমি কি একবারো সাদিয়া ফারজানা একা-কে আপনি কিংবা তুমি কোনো কিছু সম্বোধন করে কিছু বলেছি? একটা মানুষের সাথে পরিচয়ের শুরুতেই কি মানুষ তাই করেনা? 
-ওমা তাইতো? এত সহজ কিন্তু ধরতে পারলাম না কেন? ভাইয়া, আপনি তো আসলেই ... ... 
--আসলেই কি? বিশেষণ বিহীন? হা, হা, হা... 
-সত্যি বলছি ভাইয়া, এতটা অবাক আমি কখনো হইনি। বলেন কি বর চান? 
--হা,হা,হা... আজ না, আরেকদিন... আজ টা টা 
-বাই ভাইয়া, ভালো থাকবেন। 
--খুব চেস্টা করবো। বাই। 

(দুই) 

-ভাইয়া কি অন লাইন? 
--হুম, এখনো লাইন থেকে ছিটকে পড়িনি। 
-হা, হা, হা... আপনি কি সবার সাথে এভাবেই কথা বলেন? 
--সবার সাথে বলি না, তো। একার সাথে একা বলি। 
-একার সাথে মানে? আমার সাথে? 
--একার সাথে মানে নিজের সাথে। 
-উফ... আপনি কি আমাকে বাচ্চা মনে করেন? 
--মনে করবো কেন? তাইতো। 
-জ্বী না। আমি তেইশ পার হয়ে চব্বিশে পড়বো পড়বো করছি।  
--তাহলে তো আপনি অনেক বড়। 
-এই প্রথম আপনি আমাকে কিছু একটা সম্বোধন করলেন। 
--হা, হা, হা... করবো না তবে? 
-করবেন, অবশ্যই করবেন। তবে তুমি করে বলবেন। 
--আচ্ছা বলবো। কি নামে ডাকবো তোমাকে? 
-এটা আবার কেমন কথা? আমার নাম যা, সেই নামে ডাকবেন। 
--তোমার তো তিনটা নাম তাই জিজ্ঞাসা করলাম। 
-আমার তিনটা নাম? 
--তাইতো। ‘সাদিয়া’ ‘ফারজানা’ ‘একা’। 
-ভাইয়া, আপনি কিন্তু আমার সাথে পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে বাচ্চাদের মতো ফান করছেন। আমার তিনটা নাম না, একটাই নাম। 
-- আচ্ছা বেশ। তাই যদি হয়, তাহলে নামে ভুল আছে। 
-নামে ভুল আছে মানে? কোথায় ভুল? 
--তাহলে তুমিই বলো- সাদিয়া আর ফারজানা, একা হয় কি করে? 
-হা, হা, হা ... আপনি পারেনও। তবে সাদিয়া ফারজানা একা শুধু না, এ জগতে সবাই একা। 
--তাই কি? এ ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা দেড় কোটি পার হয়েছে অনেক আগে। বাসায়, রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, শপিং মল কিংবা বাজারে হাজার হাজার মানুষ। 
-তাতে কি? হাজার ভীড়েও কি মানুষ একা হয়না? 
--প্রযুক্তির যুগে এ-যুক্তি ধোপে টেকে? একা হবার সময় কই শুনি? মোবাইল, অন লাইনে ই-মেল, ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস এপ... ... রেডিও-টেলিভিশনের একশ একটা চ্যানেল, এইদিবস, সেইদিবস, বিশাল বিশাল লাইভ কনসার্ট- মানুষকে কি করে একা থাকতে দেয় শুনি? পাঁচ মিনিটের জন্যও কী সবার সাথে, সব কিছুর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারছো? 
-তা অবশ্য ঠিক। 
--একা হওয়ার সব পথ এ শহরের মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। এটা এখন যান্ত্রিক শহর। মোরগ কিংবা পাখীর ডাক এখন আর এ শহরের মানুষের ঘুম ভাঙায় না,ঘুম ভাঙ্গায় এলার্ম ক্লক। 
-হুম বুঝলাম। 
--কি বুঝলে? 
-আপনি কথার যাদুকর। 
--ওরে বাবা, এত্তো বড় এওয়ার্ড? কোথায় যে রাখি? 
-রাখার জায়গা নেই বুঝি? সব ভর্তি? 
--হুম। সব। যাই এখন তবে একটা সেলফ বানাতে অর্ডার দিতে যাই দোকানে। 
-আমার কথার জন্য? 
--তোমার কথার জন্য হতে যাবে কেন? আমার এওয়ার্ড রাখার জন্য। 
- আপনি মানুষকে এত ইনসাল্ট করতে পারেন? 
-- ইনসাল্ট করলাম কই? সত্যিটা বললাম মাত্র। বাই তবে। 
- আপনি একটা যা ইচ্ছে তাই। বাই। 

(তিন) 

-হ্যালো 
--কোন দিকে হেলবো? 
-হা,হা,হা... কোন দিকে হেলতে ইচ্ছে করছে আপনার? 
--যার সাথে চ্যাট করছি তার দিকে। 
-ইসস...ইচ্ছে করলেই হলো? 
-ইচ্ছে না করলে হয় কি করে? 
--শুনুন লেখক সাহেব,এসব ইচ্ছা ভালো না। 
-ভালো না কেন, শুনি? যদি বোঝাতে পারো এসব ইচ্ছা কেন ভালো না, তাহলে আমাকে দেয়া তোমার বর ফিরিয়ে দেব। 
-আর যদি না পারি? 
--তাহলে আরো একটা বর দিতে হবে। 
হা, হা, হা... আপনি একটা পাগল। 
-কে না? এবার বলো, এসব ইচ্ছা ভালোনা কেন? 
--ওমা, আপনি কেন আমার দিকে হেলতে চাইবেন? 
-আমার ইচ্ছা হলো বলে। যে কোনো সৃষ্টির প্রথম শর্তই কি, ইচ্ছা না? আজ এত কিছু যে আবিষ্কার- তার মূলে কি ইচ্ছা না? 
--তা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমি তো একটা মেয়ে। আমার প্রতি এমন ইচ্ছা হওয়া টা ঠিক? 
-ইচ্ছার আবার ছেলে-মেয়ে কি? আচ্ছা- তোমার কোনদিন কোনো ব্যাপারে ইচ্ছা জাগেনি? 
--জাগবে না কেন? 
-তাহলে? ইচ্ছে হতে কি মেয়ে বা ছেলেতে বাঁধা আছে? 
--তা নেই, কিন্তু... 
-কিন্তু একটাই। আমার ইচ্ছেটা তোমার ইচ্ছে হচ্ছেনা। তাই তো? 
--আপনি বড্ড ঠোঁট কাটা। হুম তাই। 
-তাহলে সেটা বললেই তো পারতে। কেন বললে- এসব ইচ্ছা ভালো না? এমন ইচ্ছা কারো প্রতি তোমার হয়নি কখনো? মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার দাবী চিরন্তন। তেমনি চিরন্তন হাত ধরার দাবী, একটু হেলে পড়ার দাবী। 
--আপনি, এমন কেন? সব কিছুতে জেতার এত ইচ্ছা কেন? 
-হা, হা, হা... এর মানে কি? 
--এর মানে হলো- দ্বিতীয় কি বর চাই, শুনি? 
-হা, হা, হা... সময় হলে চেয়ে নেবো। আজ বাই। 
-- বাই, ভালো থাকবেন। 
- কথা দিচ্ছি না। বাই। 

(চার)

-ঠক, ঠক, ঠক... কথার যাদুকর, আছেন? 
--আছি, কিন্তু আজ দরজা খোলা যাবেনা। 
-কেন? 
--একটা লেখার মাঝপথে আছি যে। 
- ও 
--মন খারাপ করছো কেন? দরজা খুলিনি ঠিক, কিন্তু জানালায় উঁকি দিয়ে তো কিছু কথা বললাম, নাকি? 
-হা, হা, হা... আচ্ছা ঠিক আছে। লিখেন তবে। পরে কথা হবে। টা টা 
--টা টা 

(পাঁচ) 

-ব্যস্ত নাকি যাদুকর? 
--ছিলাম না, এই হয়ে গেলাম। 
-এই হয়ে গেলাম মানে? কেমন করে ব্যস্ত হয়ে গেলেন? 
--তোমার সাথে কথা বলে। 
-সব সময় হেয়ালি, না? 
--না তো। তোমার ব্যাপারে সব সময় সিরিয়াস। আজ সারাদিন ধরে মনে হচ্ছিলো একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো তোমায়? 
-বলেন কি? কি সেই মহা মূল্যবান কথা? 
--তোমার কি অনেক লম্বা চুল? 
-হুম। কিন্তু কেন? লম্বা চুল দিয়ে কি হবে? 
-- লম্বা চুলের মালিককে জিজ্ঞাসা করবো, সে যেমন করে তার লম্বা চুলের যত্ন নেয় তেমন করে আর কারো কি যত্ন নেয়? 
- জেনে কি হবে? 
--সেই জানার গল্পটা যদি খুব সুন্দর হয়- তবে গল্প লেখা হবে। 
-ও আচ্ছা। আপনি তাহলে গল্প লেখার জন্য জানতে চাইছেন? আপনি তো খুব স্বার্থপর। 
--কে স্বার্থপর না, শুনি? 
-কেন? আমি। 
--এটা অবশ্য ভালো বলেছো। তুমি অবশ্য স্বার্থপর না। তুমি হলে স্বার্থ নিজ। হা, হা, হা... 
-তারমানে? 
--মানে খুব সোজা। নিজ স্বার্থে গল্প করতে এসেছো। হয়তো কোনো গভীর কস্ট ভুলতে, নয়তো কিছু থেকে লুকিয়ে থাকতে। 
-আপনার কেন তা মনে হলো? 
--মানুষ জন্মগত স্বভাবেই একা থাকতে চায় না। তোমার বয়সী একটা মেয়ে তো আরো না। 
- এতো বোঝেন? এ মুহুর্তে আর কি মনে হচ্ছে? 
--আর মনে হচ্ছে, তোমার মনটা আমি এখন খারাপ করে দিলাম। তাই, এখনি এ মনটা ভালো করে দিতে হবে। 
-আমার মন খারাপ হলে খুব সহজে ভালো হয়না। 
--তাইতো হওয়া উচিত। মন খারাপ হলে তা সহজে ভালো হবে কেন? মনের কি একটা ভাব আছে না? কথা নেই, বার্তা নেই সেই ভাব ভুলে কি ঠা ঠা করে হাসবে? 
-হা,হা,হা... হাসবোই তো। 
--হাসো তবে। চাঁদ অবাক হয়ে লাস্যময়ী তরুণীর হাসি উপভোগ করুক। 
-আর আপনি? 
--আমি এখন টা টা... পরে কথা হবে 
-হুম বাই। 

(ছয়) 

- কি করছিলেন? 
-- সুপ্রিয়া চ্যাটার্জিকে কোলে তুলে আদর করছিলাম। 
-যাহ্‌। কি যে বলেন? 
--সত্যি বলি। কোলে তুলে, কখনো আঙুলে স্পর্শ করে চোখ বুলিয়ে... । একে যদি আদর না বলে তবে কাকে বলে? 
- কে উনি? 
-- স্বনামধন্য লেখিকা। আমি তার গল্পের বইয়ের অন্ধ ভক্ত। 
- তাঁকে পেলেন কই? 
-- কেন? তাঁর লেখা গল্পের বইয়ে। 
-অদ্ভুত লোক আপনি। এভাবে ভাবতে আপনাকে কে শিখিয়েছে? নাকি নিজে থেকেই? 
--কোনো যাদুকর কি তার জাদু ফাঁস করে? 
-আচ্ছা ফাঁস না করেন, একটা জাদু দেখান। 
-- ... ... ... 
-ওমা, এই ডট ডট ডট এর মানে কি? 
--এর মানে হলো- তোমাকে আমি ডট ডট ডট দিয়ে একটা কথা লিখছি। যেটা এখন তোমার কাছে অদৃশ্য। কিন্তু একদিন ঠিক বুঝে যাবে। যতদিন বুঝতে পারছো না, ততদিন এটা তোমার কাছে এটা জাদু। 
-আপনি এত অদ্ভুত কেন? 
--আমি আর কি অদ্ভুত। তারচেয়ে বড় অদ্ভুত মানুষ তোমার সাথে থাকে। 
-আমার সাথে মানে? 
--আচ্ছা তোমার নাম একা কে রেখেছে? 
-কেন, আমার বাবা। 
--কোনো বাবা তাঁর সন্তানের নাম – ‘একা’ কি করে রাখে? কোনো বাবা কি চায়, তাঁর সন্তান একা থাকুক? এটা কি কম অদ্ভুত? 
- সে জন্যই কি আপনি আজ পর্যন্ত আমার নাম ধরে ডাকেন নি? 
--আমি বিশ্বাস করিনা তুমি একা। 
-কিন্তু আমি তো তাইই। 
--কোথাও ভুল হচ্ছে। 
-কোথাও ভুল হচ্ছেনা জাদুকর। 
--কিকরে? বলবে? 
-আজ না, অন্য একদিন। 
-- ঠিক আছে। আজ তাহলে বাই। 
- বাই জাদুকর। 

(সাত) 

-টুং টাং, টুং টাং 
--কি ব্যাপার, কলিংবেল কেন? দরজা তো খোলাই। 
-চ্যাট ঘরে এলাম, কি খাওয়াবেন? 
--কথার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিপস। 
-হা, হা, হা... তেলে ভাজা আমার পছন্দ না। 
--তেল দিয়ে ভাজিনি তো, কথা দিয়েই ভাজলাম। 
-আপনি পারেনও। 
--শিখবে? 
-শেখাবেন? 
--মনের জোর আছে তো? 
-আপনার কি মনে হয়, নেই? 
--একা নামের মেয়ের কি, সেই মনের জোর থাকে? 
-হা, হা, হা... আপনি এখনো নাম নিয়ে আছেন? 
--তুমি নেই কেন বলবে? 
- আচ্ছা শুনুন তবে। আমার জন্মের সময় মায়ের অবস্থা খুব সঙ্গীন হয়ে উঠলো। ডাক্তার যখন বাবাকে জানালো- মা নয়তো বেবি যে কোনো একজনকে বাঁচানো যাবে। কার জন্য চেস্টা করবো? বাবা শুনে বোবা হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারকে কিছুই নাকি বলতে পারেনি সেদিন। তারও কিছু পরে আমাকে বাবার হাতে তুলে দিয়ে ডাক্তার মাথা নীচু করে ফিসফিস করে বলেছিল, ওর মাকে বাঁচানো গেলো না, সরি। এক হাতে চোখ মুছতে মুছতে অন্য হাতে আমাকে কোলে তুলে বাবা বাসায় ফিরলো। আমার নাম রাখলো একা। তাঁর একা হাতেই মানুষ আমি। 
-- ওহো। আমি সত্যিই সরি, না জেনে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। 
-আরে না, আপনি তো আর এতসব জানতেন না। 
--কিন্তু তবুও বলি, তুমি একা নও। তোমার বাবা ভুল নাম রেখেছে। আমি তোমার সাথে সারাদিন অনেক-অনেক কথা বলবো। তোমার মোবাইল নাম্বারটা দেবে, প্লিজ? 
-হা, হা, হা... আমার তো মোবাইল নাম্বার নেই। 
--মোবাইল নাম্বার দিতে চাচ্ছোনা, তাই বললেই হয়। 
-আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না? সত্যি আমার মোবাইল সেট নেই। আর দরকারও পড়ে না। 
--দরকার পড়ে না মানে? তোমার কোনো বন্ধু নেই? কারো সাথে কথা বলো না, তুমি? 
-বলি তো, সবার সাথেই বলি। তবে ইশারায়। আমি যে শব্দ করে কথা বলতে পারিনা। ইশারায় কথা বলতে মোবাইল লাগে বুঝি? 
-- কি বলছো এসব? 
- যে মেয়েটা শব্দ করে কথা বলতে পারে না, তার নাম ‘একা’ হওয়াটা কি খুব ভুল? তার অনেক বন্ধু না থাকাটা কি খুব অস্বাভাবিক? একা নামের মেয়েটা কি জন্ম থেকে একা জীবনের জলছাপ না? কী হলো কথার যাদুকর- কথা বলছেন না, কেন? 


সত্যজিৎ বিশ্বাস 
জন্ম: ১লা মার্চ, ১৯৭৪ 
কন্ট্রিবিউটর- স্যাটায়ার কার্টুন ম্যাগাজিন উন্মাদ। 
কন্ট্রিবিউটর- ফান ট্যাবলয়েড ‘ঠাট্টা’ (দৈনিক ইত্তেফাক) 
কন্ট্রিবিউটর- ফান ট্যাবলয়েড ‘প্যাঁচআল’ (দৈনিক সমকাল) 
কন্ট্রিবিউটর- ফান ট্যাবলয়েড ‘ঘোড়ার ডিম’ (দৈনিক কালের কন্ঠ) 
কন্ট্রিবিউটর- ফান ট্যাবলয়েড ‘বিচ্ছু’ (দৈনিক যুগান্তর) 

প্রকাশিত বইসমূহ: ভালবাসার অনেক রঙ (ছোটগল্প সমগ্র, শুদ্ধস্বর প্রকাশনী) 
জোকে জোঁকারণ্য (মৌলিক জোকস সমগ্র, নওরোজ কিতাবিস্তান) 
জলছাপ (ছোটগল্প সমগ্র, নওরোজ কিতাবিস্তান) 
রাম গরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা (মৌলিক জোকস, প্রিয়মুখ প্রকাশন) 
ইরেজার ভূত (শিশুতোষ গল্প, প্রিয়মুখ প্রকাশন)
আমি পারবো (শিশুতোষ গল্প, ভিন্নচোখ প্রকাশনী) 
আমরা সবাই রাজা (শিশুতোষ গল্প, বিদ্যানন্দ প্রকাশনী)
শ্রেয়সীর ডাইরী (কিশোর উপন্যাস, শব্দভূমি প্রকাশনা) 
গল্পগুলো রম্য (রম্য গল্প সমগ্র, শব্দভূমি প্রকাশনা)
গল্প • কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প • নাহিদ ধ্রুব

গল্প • কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প • নাহিদ ধ্রুব

ইচ্ছেরা নিজেদের গলা টিপে ধরলে পুরাতন ক্যাম্পে ফিরে আসা ছাড়া নিখিলেশের কাছে ছিল না তেমন কোন বিকল্প। শত্রুপক্ষের ব্যারাকে তাঁর গুপ্তচর পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর প্রতিটি সৈন্য যেন হয়ে গেছে একটি গন্ধ শোঁকা কুকুর আর অদ্ভুত ক্ষমতা বলে তারা কোন না কোন ভাবে খুঁজে বের করছিল নিখিলেশের অস্তিত্ব। যাদের জন্য সিঁধেল চোরের মতো পালিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে, তাদের অবশ্য নিখিলেশ বিশেষ দোষ দিতে পারে না। তাঁর বদৌলতে অর্থাৎ তাঁর তথ্যের বদৌলতে তাঁর প্রকৃত ব্যারাকের সৈন্যরা নির্ঘাত যমদূতের মতো এসে উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুপক্ষের দুটো ক্যাম্প, ঐ সব ক্যাম্পে যে নিখিলেশের নতুন গজিয়ে ওঠা বন্ধু ছিল না, তা না, কিন্তু যুদ্ধে এসব ভাবলে চলে? শত্রুপক্ষের সৈন্যদের বন্ধুত্বসুলভ আচরণ, গর্তে শুয়ে শুয়ে তারা দেখা কিংবা যুদ্ধ শেষে ফিরে গিয়ে কে কী করবে তাঁর লম্বা তালিকা’র কথা তাই গোপনে ভুলে যেতে চায় নিখিলেশ। কিন্তু, সীমান্তের কাঁটাতারের মতো তা ঠিক’ই এসে বিঁধে যাচ্ছে বুকে। 


প্রথম ব্যারাকে আক্রমণের সময়েই কেউ কেউ নিখিলেশ’কে সন্দেহ করেছিল কিন্তু স্রেফ ভালোবাসা থেকেই হয়তো তাঁকে আলাদা করে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি তখন আর এদিকে ভালোবাসার জাল কেটে তখন থেকেই পালাবার ফন্দি আঁটছিল নিখিলেশ। কথা ছিল, দ্বিতীয় ক্যাম্পে আক্রমণের সময় সে দল বদল করে যোগ দেবে তাঁর দলের সাথে আর মিশন শেষে পালিয়ে যাবে তাদের ছায়া অনুসরণ করে কিন্তু, দ্বিতীয় দফায় গোলাবর্ষণের সময় যখন তাঁর দলের সৈন্য’রা তাঁকে ইশারা করলো ভেতর থেকে আক্রমণের জন্য তখন নিখিলেশ হয়ে গেলো হাজার বছর ধরে স্থবির হয়ে থাকা কোন এক পাথর, কিছুতেই ভাঙল না তাঁর ধ্যান। ফলশ্রুতিতে, শত্রুপক্ষ আততায়ীদের অস্তিত্ব টের পেয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করলে নিখিলেশের মূল দলের যোদ্ধা’রা ধরাশায়ী হয়ে পড়ে কিন্তু রণভঙ্গ দেয় না কিছুতেই, বরং মুহুর্মুহু শেলের আক্রমণে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় দ্বিতীয় ক্যাম্প এবং একইসাথে তীব্র প্রতিরোধের মুখে নিজেরাও হয়ে যায় ধ্বংস। 

এমন ধ্বংসলীলার মধ্যে একসময় নিখিলেশের ধ্যান ভেঙে গেলে সে দৌড়াতে শুরু করে এবং জঙ্গলের মধ্যে খুঁজে নিতে চায় আশ্রয় কিন্তু, শত্রুপক্ষে ইতিমধ্যে তাঁর পরিচয় উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় তাঁর খোঁজে তারা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে শুরু করে গ্রাম, নগর, মাঠ , জলাশয়। ফলে, জঙ্গল থেকে নদী এবং তারপর কিছু পাহাড়ি জনপদ পাড়ি দিয়ে নিখিলেশ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় পুরাতন ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার। 

ক্ষতবিক্ষত শরীর, অবসাদগ্রস্ত মন এবং শত্রুপক্ষের ছেঁড়া ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় নিখিলেশ তাঁর পুরাতন ব্যারাকে ফিরে আসলে তাঁর জগত এক মুহূর্তে বদলে যায় যখন সে দেখতে পায় এই ব্যারাকের সবগুলো মুখ অপরিচিত। দ্বিতীয় ক্যাম্পে মিশনের সময় তাঁর অচলাবস্থার জন্য মারা যাওয়া বন্ধুদের কথা তখন মনে পড়ে তাঁর এবং ক্যাম্পে নতুন মুখের আগমনের কারণ স্পষ্ট হয় ধীরে ধীরে। কিন্তু, তাঁর এই আগমনের উৎস কিছুতেই স্পষ্ট হয় না নতুন করে ব্যারাকে আসা সৈন্যদের কাছে এবং নিখিলেশের গায়ে শত্রুপক্ষের পোশাক দেখতে পেয়ে তাদের মনে সংশয় হয় আরও গাঢ়। নিখিলেশ যখন নিজেকে এই ব্যারাকের পুরাতন সৈন্য হিসেবে দাবী করে তখন হিতে বিপরীত হাওয়া বয়ে গেলে নতুন ব্যারাকের সৈন্য’রা নিখিলেশ’কে শত্রুপক্ষের গুপ্তচর হিসেবে গ্রহণ করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। 

এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটি ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে খারাপ লাগে না নিখিলেশের যদিও ক্ষুধা থেমে থেমে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। মাথার উপর ষাট পাওয়ারের একটি বাল্ব আলো দিচ্ছিল কিছুক্ষণ আগে কিন্তু এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ কী আর রিমান্ডের তাৎপর্য বোঝে? বিদ্যুৎ নিজের খেয়াল খুশী মতো কোন এক অজানার পথে চলে গেলে ঘরে নেমে আসে কবরের অন্ধকার। এই অন্ধকার’ও নিখিলেশের খারাপ লাগে না অতোটা, কোন এক বিচিত্র কারণে দীর্ঘদিন পর তাঁর মনে ফিরে এসেছে শান্তি। তবে কী এই সে’ই শান্তি যার কথা ব্যারাকের সব মৃত বন্ধুরা বলতো অনবরত, সকলের মনেই ছিল যুদ্ধ সমাপ্তি’র কল্পনা, যে স্বপ্নের কাছে জয়-পরাজয় নিতান্তই তুচ্ছ যেমন তুচ্ছ এই মুহূর্তের অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা। 

নিখিলেশ এই অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে ক্রমশ এবং মনে উঁকি দিতে থাকে হারানো বন্ধুদের হারানো স্বপ্নগুলো, যা আশ্চর্য মেঘের মতো দৃষ্টির আড়ালে থেকেও আঁচড় কাটতে শুরু করে ক্ষিপ্রগতি’তে যার আঘাতে নিখিলেশের মনে আসে অনন্ত ঝিমুনি। এই স্থবিরতা অনন্তকালের পথে হাঁটতে শুরু করার আগেই বিদ্যুৎ ফিরে আসে এবং ষাট পাওয়ার বাল্ব মাথার উপর জ্বলে উঠলে কুর্দি পরিহিত একদল সৈন্য বিভিন্ন মারণাস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে ঘরে। 

ইন্টারোগেশনের সময় নিখিলেশের ধর্ম পরিচয় বের হয়ে আসলে তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন করার শেষ সুযোগটুকু হয়ে যায় হাতছাড়া। শত্রুপক্ষের ধর্ম আর নিখিলেশের ধর্ম যে এক, নিখিলেশ শত্রুপক্ষের চর না হয়ে আর কী’ইবা হতে পারে? সুতরাং, নিখিলেশ’কে শত্রুপক্ষ ভেবে টর্চারের মাত্রা বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের মজবুত বাঁধনে টান পড়ে কিন্তু নিখিলেশ সত্যের পথ থেকে একচুল’ও সরে আসে না বরং যখন ধীরে ধীরে তাঁর নখ আঙুল থেকে উঠে আসে কিংবা তার কিছুক্ষণ বাদে কব্জি আলাদা হয়ে যায় হাত থেকে, তখন নিখিলেশ নিজের সত্যিকারের পরিচয় ভুলে যেতে থাকে এবং ভুলে যেতে থাকে এইসব যুদ্ধের জন্য শেখা সমস্ত কৌশল। 

যদিও প্রশ্নবাণ এই সব ক্ষত’এর তোয়াক্কা করে না বরং ফলায় বিষ মাখিয়ে ক্রমাগত ফালাফালা করতে থাকে নিখিলেশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত। ফলে, একসময় নিখিলেশের চেতন জগত ক্রমশই ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে এবং ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলো’তেও চারপাশে নেমে আসে কুয়ায়াচ্ছন্ন অন্ধকার। মুখে পানি ছুঁড়ে পুনরায় নিখিলেশের জ্ঞান ফিরিয়ে এনে পুনরায় তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নের আগুনে নিখিলেশ’কে ঝলসে দেয়া হলে নিখিলেশ কেবল বলে যেতে থাকে একটি বাক্য, জগত একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং আমরা আসামী। 

এই বাক্যের মর্ম উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে সৈন্যের দল টর্চারের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে নিখিলেশের গোঙ্গানি কিংবা অন্ধকারের মমতার বলেই হয়তো বিদ্যুৎ আবার চলে যায় এবং পুরো ঘরে নেমে নীরবতা। নিখিলেশ এই নীরবতার ভেতর চোখ পিটপিট করে তাকায় এবং তার ইচ্ছে হয় শেষবারের মতো একবার আলোর সন্ধানে যাবার, তখন খোলা জানালা দিয়ে একটি জোনাকি এসে ঢুঁকে পড়ে ঘরে, অদ্ভুত সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে আর নিখিলেশের মনে হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প কিংবা পৃথিবী তো অতোটা মন্দ না! 


নাহিদ ধ্রুব 
জন্ম: ২ ডিসেম্বর; বরিশাল। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় স্নাতক। প্রকাশিত বই : মৃত্যুর মতো বানোয়াট [কবিতা; জেব্রাক্রসিং, ২০১৭] থাকে শুধু আলেয়া [কবিতা; চন্দ্রবিন্দু, ২০১৯] 

এক গুচ্ছ অণুগল্প • বিলাল হোসেন

এক গুচ্ছ অণুগল্প • বিলাল হোসেন

গগনউড়া মাঠ

‘…একটি গগনউড়া মাঠ বিক্রয় হবে। মাঠের পরিমান তেপান্তরের সমান। মাঠের ভেতরে আছে নানাজাতের নদী,রংবেরঙের আকাশ আর নানাপ্রজাতির ছোটবড় অরণ্য’।

এই রকম একটা বিজ্ঞপ্তি দেখে শহরের শিল্পপতি কেসি দেব ঠিকানা মত এসে দেখে ম্যাচের কাঠি দাঁত দিয়ে ভেঙে দু টুকরোর একটুকরো থু করে ফেলে সরু অংশে দাঁত খোঁচাচ্ছে যে লোক; তার পরনে ময়লা লুঙ্গি শরীরে কুঁচকানো জামা। 
—আমি এসেছি অনেকদূর থেকে—কেসি দেব বলল— শুনেছি গগনউড়া মাঠ নামে একটা মাঠ বিক্রয় হবে। আপনি কি বলতে পারেন সেটা কোথায় ? 
দাঁত খোঁচানো বাদ দিয়ে লোকটা এবার কান খোঁচানো শুরু করল। চোখ সরু করে বলল—গগনউড়া মাঠ ক্রয় করতে আসছেন ? 
—হ্যাঁ।কিন্তু মাঠটি কোথায় ? মালিক কে ? দামদস্তুর কি? 
—অনেক দাম কিন্তু । পারবেন ক্রয় করতে? 
—আমি গ্রুপ অব কম্পানিজের মালিক কেসি দেব। পুরো দুনিয়া কিনতে পারি আমি। এখন বলেন গগনউড়া মাঠ কোথায় ? 
আঙ্গুল তুলে দেখাল—অইদিকে। একটা খাল দেখবেন । খালের পারে এক তালগাছ ।অইখানে। 
লাল গাড়িতে উঠেই হুস করে টান দিল। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর এক মরাসূতার খালের দেখা মিলল। আর খালের পাশেই তালগাছ। মাথার ওপর তালগাছ নিয়ে বসে আছে এক ভিক্ষুক। গায়ে তালিমারা চাদর। আশেপাশে আর কেউ নাই।বিরানভুমি। 
গাড়ি থেকেই জিজ্ঞাসা করল কেসি দেব— আচ্ছা, গগনউড়া মাঠ কোনটি ? এর মালিকই বা কোথায় থাকে? 
ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে ভিখারিটি বলল— আপনি গগনউড়া মাঠে যাবেন বাবু? সে ত আরও খানিকটা দূরে।উৎরাইল হাটকে বামে রেখে তিন মাইল গেলে ভুমিপুত্রের কাছে ঠিকানা পাবেন । আচ্ছা, ওখানে কেন যাবেন—কিনবেন বুঝি? 
—ইচ্ছা আছে। যদি পছন্দ হয়। 
—এত দামি মাঠ কেনা সম্ভব হবে আপনার পক্ষে? শুনেছি অনেকেই এসে ফিরে গেছে। কুলায়নি । 
প্রকৃতই বিরক্ত হয়ে উঠল কেসি । এইসব ফকিরমিসকিনদের সাথে কথা বলাই ঠিক না—তার কী পরিমান টাকা পয়সা,এদের ধারণাই নাই। 
সে সোজা গাড়ি স্টার্ট দিতেই গাড়ি উড়ে চলল ভূমিপুত্রের দিকে। 
ভূমিপুত্র দেখেই বলল— কেসি দেব বাবু,আপনি কি জানেন গগনউড়া মাঠে কি কি আছে? 
কেসি ঠিক বুঝতে পারল না, এক গগনউড়া মাঠ নিয়ে এত কথা কেন ? সে এই জীবনে এত এত জমিজমা কিনেছে যে মনে করেও বলতে পারবে না। তার সামনে নিতান্তই এক চাষাজাতীয় লোক কথা বলছে । কথা বলছে এমনভাবে, সে ঠিক নিতে পারছে না। হচ্ছেটা কি ? 
কেসি দেবের রোখ চেপে গেছে। সে জীবনে কোথাও হারেনি আজও হারবে না। সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। ভূমিপুত্র বলল— মূল গগনউড়া মাঠ অই দিকে। আয়নালের দিকে। 
গাড়ি ছুটে চলল অই দিকে। 
আয়নাল বলল— গগনউড়া মাঠ সেইদিকে, জয়নালের দিকে। 
গাড়ি ছুটে চলল সেইদিকে। 
জয়নাল বলল— জগতপারের ঘাটে চিন্তামুনি জানে সব। নেই দিকে। 
বিধ্বস্ত কেসি দেব এসে পড়ল নেই দিকে; চিন্তামুনির বেদীমুলে। চিন্তামণি বললেন— কেসি নিজের দিকে তাকাও । তোমার ভেতরেই আছে গগনউড়া মাঠ, বিস্তৃত আকাশ ।তোমার অন্তরে আছে থই থই করা পরম পাথার। সেখানে ডুব দাও। গগনওড়া মাঠ একা পড়ে আছে,সেখানে দাঁড়াও। আর এখানে বস। 
এই বলে একটি আকাশমণি গাছের নিচে কেসি দেবকে বসিয়ে দিল। কেসি দেব বসে বসে কী ভাবল কে জানে ,শুধু এইটুকু বুঝতে পারল— কে যেন তার অন্তরের গহীনে একটি মহাজাগতিক ফুঁ দিল আর সে বোধশূন্যতায় পিছলে পড়ে হয়ে গেল । উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে লক্ষ্য করল— একটি শাদা রঙের গাড়ি এসে বলল— আচ্ছা, গগনউড়া মাঠ কোন দিকে?  
শতচ্ছিন্ন পিরান গায়ে কেসি দেব বলল— ক্রয় করবেন বুঝি ? এত টাকা আছে কি আপনার ? 

এনায়েত- মজাফফরদের গল্প

শহরের ঠিক মধ্যেখানে পাইন আর দেবদারু পরিবেষ্টিত মাঠে সবাই একত্র হয়েছে; অভিজাত পুরুষদের অভিজাত স্ত্রীরা। দেখা হয় প্রায় প্রায়ই,বিকেলে। 
স্ত্রীদের হাতে থাকে চেইন; চেইনের মাথায় আটকে থাকে বিদেশি কুকুর। তারা চেইনে টান খেতে খেতে ঘোঁত ঘোঁত করে আর স্ত্রীদের হাত নরম হওয়ার ফলে সে-হাতে শক্তি থাকে কম। ফলে স্ত্রীদের গলায় আহ্লাদ থাকে পুর্ণরুপে। কৃত্তিম বিরক্ত ঢেলে বলে— আহ মজাফফর এমন করে না ! দুষ্টুমি করে না লক্ষ্মী!

শুনলে মনে হবে— মিসেস ধানমন্ডির কুকুরের নাম মজাফফর— ব্যাপারটা আসলে সেরকম না। অভিজাত স্ত্রীরা তাদের কুকুরদের নাম স্বামীদের নামে করে থাকে।পুরুষরা এই খবরের কিছুই জানে না। এই গোপন তথ্য শুধু স্ত্রীমহলই জানে। সুতরাং , গ্রে হাউন্ডরূপী মজাফফরকে যখন দুষ্টু বলে আহলাদ করে তখনও সে দুষ্টুমি করতেই থাকে। মজাফফর/ গ্রে হাউন্ডের মতই গন্ধ শোঁকে । ঘাসে মাটিতে কাদায় । স্ত্রীদের দামী শাড়িতে। গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সেলে বেশি চাপ পড়লে গায়ের ওপর ঝাঁপিয়েও পড়ে কখনও কখনও। আজকেও অইরকম।

দুষ্টুমি করে না , করে না— বলে রাগ দেখায় মিসেস ধানমণ্ডি । মিসেস বনানী বলে— আপনারটা একটু বেশি নটি ভাবী। আর কী কিউট! বলে একটু আদরও করে দেয়।

মিসেস ধানমণ্ডি বলে— নটি হলে ত ভালোই ছিল,আমারটা বুঝলেন ভাবী, খুব ক্রেজি । সামলাতে দম বন্ধ হয়ে যায় । 
—ওমা তাই নাকি ! এইবলে আকাশে চোখ তুলে অবাক হয়— মজাফফরকে একদিনের জন্যে দিয়েন ভাবী। দুষ্টু মজাফফর কত দুষ্টু কতটা ক্রেজি একবার দেখব। আমার এনায়েতুল্লাহকে না হয় একদিনের জন্যে ধার নিয়েন।

মজাফফরকে এনায়েতুল্লাহর সাথে বদলে নেয়ার এই প্রস্তাবে উত্তর দেয়ার আগেই মিসেস ধানমণ্ডির ফোন বেজে ওঠে— সিঙ্গাপুরে ? যাওয়ার আগে একবার জিজ্ঞেস করারও ইচ্ছে হয় না? তোমার সাথে কে গিয়েছে ?নিশ্চয়ই তোমার সেক্রেটারি । হ্যাঁ হ্যাঁ , জানি সব জানি। 
লাইন কেটে দেয় । 
— কি হল ভাবী? 
—দেখুন না ভাবী , হাজবেন্ড যদি মাসের তিরিশটা দিনই বিদেশে পড়ে থাকে কেমন লাগে? 
—আর বইলেন না ভাবী , আমার হাজবেন্ড কতদিন ধরে বিদেশে আমি ভুলেই গেছি। আগে ফোন টোন দিত । এখন তাও দেয় না। সে যাক । এই ভাল আছি । আমার এনায়েতুল্লাহকে নিয়ে আছি বেশ , কী স্লিম ফিগার দেখেছেন ভাবী?

এলসেশিয়ানকে দেখিয়ে কুট কুট করে হাসে মিসেস বনানী।

এদিকে যখন এনায়েত আর মজাফফর অদল বদল হয়ে যাচ্ছিল তখন মিসেস গুলশান মাঠের অন্যপাশে মিসেস উত্তরার মধ্যে কি কথা হচ্ছিল , আদৌ কিছু অদল বদল হচ্ছিল কিনা শুনতে পাইনি। তবে তাদের দুজনের হাতে শেকলে ধরা ছিল এম মহিউদ্দীন এবং চৌধুরী কুরবান আলি। 

কুমির বিষয়ক ধুলো

এই নদীতে কুমির নেই।ছিলও না কখনও । 
এইসব নদীতে; এমন জলটলটলা পিঁপড়েলাগা মিষ্টি জলের নদীতে কুমির থাকে না। এটা সাধারণত। প্রধানত হয় কি না জানা নেই, তবে দুইবেলা নিয়ম করে জোয়ার ভাটা হয়—সেটা প্রাকৃতিক। একবার এক মাঘীপুর্ণিমারাতে জোয়ারের কালে আকাশে মস্তবড় চাঁদ উঠেছিল;জনশ্রুতি আছে, সেবার নাকি জোয়ারের পানির সাথে ভেসে এসেছিল একটি কুমির ।

কুমিরটিকে কেউ দেখেনি।

নরেন জোয়ারদারের অনেকগুলি চোখ,সেজন্যে কোথায় কী ঘটে— দেখতে পায়।তার উঠানে ভিড় করে আসা গ্রামের মানুষদের বলেছিল— চৌইদ্দ হাত লম্বা কুমির। আরে লেঞ্জাটাই ত হইব তোমার নয় হাত। লেঞ্জার কী ডক! খাঁজ কাটা, খাঁজ কাটা।

গ্রামবাসী ভয় পায় । ভয় পেয়ে পোতায়ে যায় ।

কাটাভরা শবীরের কথা বাদই থাকল, অই নরেন জোয়ারদারের বর্ণনা সুত্র ধরেই অর্ধডোবা মাথা আর ড্যাবড্যাবে চোখ না দেখেও ভয়ে কাঁপতে থাকে পুরো গ্রাম।

নদীরঘাটে সকাল হয়,সন্ধ্যা হয়— কেউ নামে না নদীতে।চৈত্রমাসেও স্নান হয় না। মাছেরা বড় হতে হতে অনেক বড় হয়ে যায়—তাদের কেউ ধরে না। ঝাপাঝাপি হয় না আর আগের মত। তবু গ্রাম থেকে মধ্যে মধ্যেই মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়। কই যায় তারা, কেউ জানে না।

নদীরঘাটে মাঝবয়সী অশথ তলায় বসে ভাবে কেউ কেউ। নিজেদের মধ্যে কথা বলে। 
—অই হাকি , নদীত নাকি কুমির আছে , দেখলাম না ত। দেখছস? 
—না কাকা । অই মিবাই , তুমি দেখছনি চৌইদ্দ হাত লম্বা কুমিররে? 
—না দেখি নাই। লালমিয়া ভাই তুমি? 
—না। 
—সুরেসদা তুমি ? 
—নারে ।আমরা ত কেউ দেখি নাই। তাইলে কে দেখছে ? 
—নরেন জোয়ারদার । সে দেখছে একলাই দেখছে।

সবাই ভাবে । গালে হাত দিয়ে ভাবে।

জোয়ারদার পকেটে রঙের ডিব্বা হতে একচিমটি রঙ এনে গ্রামের চোখে কাজলের মত পড়িয়ে দিলে ভাবুকরাও বলতে শুরু করল—আমি একবার কুমিরটারে দেখছি, ইয়াব্বড়!কিয়ের চৌইদ্দ হাত লম্বায় হইব কমছে কম আটাইশ হাত।

মুচকি হাসে নরেন জয়ার্দার।

বাড়ির পেছনে শনক্ষেতের ভেতরে অনেক বড় পানাপুকুর। সেখানে নড়েচড়ে কাঁটাওলা শরীর । শালায় শুধু মানুষ খেতে চায়।

তরিকা 

পীর সাহেব জালালউদ্দীন রুহানী হুজরাশরীফ থেকে বাড়ির পেছনের যে জংলামত জায়গাটা আছে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মাঝেমধ্যেই। একটা ভয় কুড়ে কুড়ে খায়। বিশাল জঙ্গুলে জায়গাটা কেমন ভারী হয়ে থাকে। মনে হয় জঙ্গলটাও তার হুজরার দিকে তাকিয়ে আছে। 
পীর সাহেবের মনের ভেতরে সারাক্ষণ এই ব্যাপারটা চেপে বসে থাকতে থাকতে আর না-পেরে খাস মুরীদ লোকমান হাকীমের সাথে আলোচনায় বসলেন। 
— বুঝলে লোকমান হাকীম, হুজুরে কেবলার কবর বাড়ির পেছনে। সেখানে ঝোপঝাড়ে শেয়ালের বসতবাটি হয়েছে। সাপের প্রাদুর্ভাব হয়েছে । এসব দূর করার ব্যবস্থা কর নইলে হুজুরের কোপানল থেকে কেউ রক্ষা পাবা না। 
লোকমান হাকীম মাথা নাড়ে । 
— সাপখোপ খেদানোর ব্যবস্থা নেও । গঞ্জ থেকে ওঝা আনাও । বাস্তু সাপে কিলবিল করে বাড়ির পেছনে । 
লোকমান হাকীম মাথা নাড়ে । 
— বাড়ির চারপাশে বাড়িবন্ধ করার দিন তারিখ ঠিক কর;জীনের আছর থেকে মুক্ত রাখতে হবে । 
— জি আচ্ছা । 
— বাড়িবন্ধের কাজটা আমি নিজেই করব । এলান করে দাও । সব মুরি্দানের মোকাবেলায় কাজটা করতে চাই। 
— জি আচ্ছা । 
— চৈত মাসের মধ্যেই সব কাজ শেষ করে ওরসের কাজ ধরব।

হুজুর কেবলার সব আদেশ নির্দেশ জারি হওয়ার পর লোকমান হাকীমের ব্যস্ততা বহুগুণে বেড়ে গেল । 
নরম মাটির ভেতরে গর্ত খুড়ে শেয়ালদের বাসা করার মজা ছুটাইয়া দিতে হবে । সবার আগে দরকার বাড়ির পেছনের সাপ খেদানোর জন্যে বরকত মুন্সিকে । তার ডিমান্ড একটু বেশি । টাকা পয়সা বেশি না পেলে গঞ্জের বাইরে আসে না । মোটা অংক পেতেই একগাল হেসে বলল— কামডা কবে করতে চান ?

তারিখ নির্ধারিত হল । ১৩ আশ্বিন । ‘সই’—বলে ওঝা বিদায় নিলে লোকমান হাকীমের মনের ভেতর ভাসতে থাকে —চিশতিয়া তরিকার বড় হুজুরের গদীনশীন আওলাদ জালাল পীরের চেহারা মোবারক।

ওঝা আসে আশ্বিনের সকালে। সাথে অনেক সাগরেদ । বীনার ফুটায় ফুঁ দেয়ার আগে পুরো এলাকাটা চোখ বুলিয়ে নেয় বরকত মুন্সী।বাড়ির পেছনে ছোট ছোট কিছু টিলা । টিলার নিচে ডোবা । ডোবার ভেতরে আলো ছায়া জাফরি কাটে । আর এখানেই পা আটকে গেল মুন্সীর ।

সে দেখল— ডোবাটা ঘিরে প্রচুর ঝোপঝাড় । আর ঝোপের মধ্যেই মুন্সী শুনতে পেল বিজ বিজ শব্দ । হিস হিস শব্দ। খেয়াল করে দেখল ডোবা ঘিরে হাজার হাজার সাপ। 

হাত থেকে বীন পড়ে গেল মুন্সীর। যে যে-দিকে পারল সাগরেদরা ছুটে পালাল। মুন্সী পালাতে পারল না । তার দুপা জড়িয়ে মাটির সাথে গেঁথে রেখেছে মোটা মোটা সাপ।

ডোবার নরম মাটিতে আস্তে আস্তে বরকত মুন্সী দেবে যেতে লাগল। কোমর পর্যন্ত ডুবে যাওয়ার পর যখন ভয়ে চিৎকার করে উঠতে যাবে তখনই কেউ কথা বলে উঠল—ভয় পেয়ো না মুন্সী!

মুন্সী দেখল তার সামনে জিহ্বা বের করা বিশাল এক সাপ। কুণ্ডলী পাকানো । তার সারা শরীরে কিলবিল করছে হাজার হাজার সাপ।

—যে সাপ ধরতে তুমি আসছ , সে সাপ নয় । সাপের সুরতে জীন । তুমি চলে যাও । হুজুর কেবলাকে বলে দিও সব আগের মতই থাকবে । শনবন । শেয়ালপাড়া । বালির ঢিবি । বনজঙ্গল ডোবা সব। বাড়িবন্ধ দিলে তারও সেই একই দশা হবে যেমন হয়েছিল তার বাবার। তুমি কি জান তার ইনতেকাল কীভাবে হয়েছিল ?

মুন্সী দরদর করে ঘামতে লাগল। সে দুদিকে মাথা নেড়ে জানাল— জানতে চায় না।

— আগামী মাঘে আসিও জালাল পীরের ওরস মোবারকে । জালাল পীরের সুরতে আমিই থাকব। যেমন ছিলাম তার বাবার সুরতে।

রগড় 

বৃহস্পতিবার রাতে ভাস্কর হাসানের স্ত্রী হঠাত বলল— কাল রত্নার স্কুল নেই , রাহাতেরও নেই । 

কৌতূহল নিয়ে তাকাল কবি ভাস্কর হাসান । অনেকদিন পর এই কৌতূহল নিয়ে তাকাল সে। আসলে কৌতূহল নিয়ে তাকানোর বিষয়টি স্ত্রীর ওপর নির্ভর করে । স্ত্রী পছন্দ করে না বলে কৌতূহল নিয়ে তাকানো আর হয় না । 

স্ত্রীর পছন্দ -অপছন্দই ভাস্কর হাসানের পছন্দ- অপছন্দ । 

একটা কবিতা লিখছিল কবি । সেই সন্ধ্যা থেকে কবিতাটা যে আটকেছে—ছোটার নাম নেই । একমাত্রা কম হয়ে যাচ্ছে ।

স্ত্রী ঘাড়ের ওপর আয়েস করে দু'হাত তুলে বলল— আহ কী শান্তি !

— কেন , শান্তির কি হল ? অবাক কবি ।

— বাচ্চাদের স্কুল নেই । সকালের নাস্তা বানানোর তাড়া নেই । বেলা পর্যন্ত ঘুমাব । কাল হলি ডে ! 
ডে 
ডে 
ডে 
ভাস্কর হাসান কিছুটা আশান্বিত হয়ে ওঠে । মনে মনে ভাবে--আজ হবে কি !

কবিতার খাতাটা সরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল । নাইটি পরা অবস্থায় ভালই লাগছে । কী এক পারফিউম মেখেছে । 

—কী পারফিউম ? বেশ ঝাঁঝালো কিন্তু ! টেক্সি টেক্সি !

প্রশ্ন করেন সদ্য কবিতা থেকে চোখ ফেরানো কবি । ভাস্কর হাসানের জিবের সামনের ছুঁচলো অংশটুকু ছোটবেলা থেকেই কাটা । এই কারণে অনেক বর্ণ উচ্চারণ করতে পারে না । 

যখন স্ত্রী ছিল বউ'র মত তখন মেনে নিয়েছিল ব্যাপারটা কিন্তু বউ থেকে ক্রমশ স্ত্রী হওয়ার পর আর মানতে পারেনি । ফলে কৃৎচ্ছতায় কেটে গেছে কতদিন— হিসাব করে বলতে পারবে না , সংখ্যাটা এত !

আজ স্ত্রীটি আবার বউ'র আচরণ করছে । আনন্দ আর ধরে না । 

—বললা না ,কি পারফিউম ?

—লইয়াগাছি । ফরাসি । 
—দাঁড়িয়ে আছ কেন , পাশে এসে বস । 
স্ত্রীটি একবার বউ'র মত তাকায় । ভাস্কর হাসানকে একবার দেখে । কিন্তু বসে না । 

—কী ,কবিতার মাত্রা মিলেছে ?

—মিলেছে । কিছুক্ষণ আগে । তুমি যখন ঘরে এলে । আমার কবিতা বিশুদ্ধ হয়েছে ।

বউটি হাসে । চুলায় রান্না । যাই । 

কিন্তু ভাস্কর হাসান অস্থির হয়ে হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয় । কত দিন মাস-বছর-পর !

দে 
দে 
দে । 
স্ত্রীটি বউ হয়ে মাখনের মত গলে গেল ।

ওদিকে , চুলায় কিছু পুড়ছে । সম্ভবত দুধের পায়েস । 



বিলাল হোসেন
জন্ম ১ জানুয়ারি, ১৯৭৪। মাদারিপুর জেলার শিবচর থানার রাজারচর কাজীকান্দি গ্রামে। 

প্রকাশিত বই:
ক। কাব্যগ্রন্থ 
১। বিরুপা’র শুঁড়িবাড়ি [২০১৪] 
২।একলাজ্বলাপঙক্তি [২০১৬] 

খ। অণুগল্প গ্রন্থ 
১। পঞ্চাশ [২০১৫] 
২। মহাপ্রভু ও অন্যান্য অণুগল্প [২০১৬] 
৩। দেখবে এসো তিলের বাগান [২০১৭] 
৪। বিলাল হোসেনের ১০০ অণুগল্প [২০১৮] 
৫। যুগলবন্দী-[২০১৯] 

গ। প্রবন্ধগ্রন্থ 
১।অণুগল্পের অস্তিত্ব আছে [২০১৭] 
২।অণুগল্প প্রবন্ধসিরিজ- অণুগল্পের অ আ ক খ-১,২,৩,৪,৫ [২০১৯] 

ঘ। রোজনামচা 
বিলাল হোসেনের রোজনামচা-[২০১৯] 

ঙ। সম্পাদিত বই [প্রিন্ট] 
১। সেরা ১০০ অণুগল্প 
২। বাংলাভাষার সেরা অণুগল্প-১ 

চ। ইবুক সম্পাদনা 
অণুগল্প সংগ্রহ-১,২,৩,৪; গোয়েন্দা অণুগল্প সংগ্রহ; ভূত অণুগল্প সংগ্রহ; রূপকথা অণুগল্প সংগ্রহ; নীতিঅণুগল্প সংগ্রহ; চিয়ার্স চিয়ার্স চিয়ার্স; দুনিয়ার মাতাল এক হও; মাতালে মাতাল চেনে; মধুগন্ধেভরা; যুগলবন্দী; অণুগল্পের বিষয় বৈচিত্র্যের সন্ধানে; তাহাদের গল্প; অণুগল্পের শিরদাঁড়া; অণুগল্পের রোজনামচা ইত্যাদি । 

ছ। পত্রিকা সম্পাদনা 
ত্রৈমাসিক অণুগল্প পত্রিকা 

গল্প • ফিরে আসা • আনোয়ার রশীদ সাগর

গল্প • ফিরে আসা • আনোয়ার রশীদ সাগর


ভোর হয়েছে। মমতা হালকা অস্বাভাবিক আচরণ করছে।রোমেলা খাতুন বেশ ভেঙে পড়েছে। একদিকে সেই রাত থেকে হাসানের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। অপর দিকে ছেলে আহাদ আলীর খোঁজ নেই দশ-বার বছর।
একমাত্র মেয়ে ক' দিন ধরে ঠিক মত খাচ্ছে না।মুখটা ফ্যাকসা হয়ে যাচ্ছে, সব সময় মনমরা হয়ে থাকে। সকাল থেকেই সে নিজের চুল নিজে নিজেই ছিড়ছে ও পাগলীর মত আচরণ করছে।রোমেলা খাতুনে হতাশায় ও রাগে গিজগিজ করে বলল,মিন্সী কন যে যায়?মেয়িডার কি উপর দৃষ্টি হোইলু, আল্লাহ?
রোমেলা খাতুন যেন কোন কিনারা পাচ্ছে না,নদীর মাঝখানে পড়ে হাবু-ডুবু খাচ্ছে।
সাত সকালে মোবারক আলী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।এরকম অভিযোগও করছে রোমেলা খাতুন।
আবার মনে মনে ভাবে, মমতার বাপ তো রোজ সকালেই যায়।
অবশ্য দীর্ঘদিনই মোবারক আলী ভোরে উঠে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে এবং মাঠ-ঘাঠ দেখে বাড়ি ফেরে।রোমেলা খাতুন কী করবে বুঝতে পারছে না।একবার মমতাকে ধরে শুয়ায়ে দিয়ে মাথায় পানি ঢালতে চেষ্টা করল।কিন্তু একবার এক ঝ্যাটকা দিয়ে, রোমেলা খাতুনের হাত থেকে পানির বদনাটি কেড়ে নিয়ে, মমতা উঠানের দিকে ছূঁড়ে মারল।রোমেলা খাতুন ভয় পেয়ে গেল। আর যে কি করবে বুঝে উঠার আগেই উঠে বসে মমতা, হাঁপাতে লাগল।
রোমেলা খাতুন আর অপেক্ষা করল না।ঘরের পিড়ি থেকে নেমে দৌড় দিল হায়েত আলীর বাড়ির দিকে।বাড়ি বলতে, এই গ্রামের কোন এক বড় চাকুরীজীবি ঢাকায় বসবাস করে,তিনি মাঝে মাঝে গ্রামে এসে দুএকদিন থাকার জন্য একটি রেস্ট হাউজ মত করে রেখেছে।- সে রেস্ট হাউজে হায়েত আলী থাকে।শুনা যায় ঢাকার সে ভদ্রলোকও টাকুদহ গ্রামের টাকু বিশ্বাসের বংশধর।তবে মোবারক আলীর সাথে মিল- অমিল কিছুই নেই।যা হোক,রেস্ট হাউজের গ্রিলের ভিতর দাড়িয়ে ছিল হায়েত আলী। রোমেলা খাতুনকে যেতে দেখে বেশ আগ্রহভরে এগিয়ে আসতেই, রোমেলা খাতুনই মুখে আঁচলের কাপড় দিয়ে অর্ধ ঢাকা অবস্থায় বলল, হুজুর আমার মমতারে জ্বীনে ধোইরছে, তাড়াতাড়ি চলেন।সাথে সাথে গ্রিলের ভিতর থেকে বেরিয়ে,গ্রিলের গেটে তালা দিতে দিতে বলল,আপনি যান আমি আসছি।রোমেলা খাতুন দ্রুত পা ফেলে বাড়ির দিকে রওনা দিল।বাড়ি ফিরে দেখতে পেল, মোবারক আলী উঠানের মাঝখানে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।মোবারক আলী কিছু বলার আগেই চিৎকার করে সামনে গিয়ে পড়ে কপাল থাপড়াতে থাপড়াতে রোমেলা খাতুন বলতে লাগল,আমার মমতারে জ্বীনে ধোইরছে গো,জ্বীনে ধোইরছে।- হায় আল্লা আর কতকাল জ্বীনের জালা সইতে হবে।জ্বীনের আঁচড়ে আমার 
বাড়িঘর-সংসার- ছেলিপুঁত সব শ্যাষ হয়ি গেলরে,আল্লা গো আল্লা; তুই বাঁচা বাঁচা।- বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।এমন সময় হায়েত আলী বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল এবং সোজা মমতার ঘরে গিয়ে পাশে বসল।বসতে বসতে রোমেলা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলল,এক ঘটি শষ্যের তেল দেন চাচী।রোমেলা খাতুন রান্নাঘরের দিকে তেল আনতে গেল,ঠিক সেই সময়ই মমতা বেশ বড় বড় করে চোখের পাতা তুলে বলল,হায়েত আলী আমাকে জ্বীনে ধরে নাই,আমার পেটের মদ্যে তুমার ছেলি বাইড়ি ওঠছে। মনে আছে সেদিন রাতের কতা?- হাসানের কাছে শুয়ার নাম কোইরি আমার কাছে আইয়েলি? 
হায়েত আলী এদিকওদিক আড় চোখে তাকিয়ে দেখল, উঠানে বিধ্বস্ত শরীরে মোবারক আলী দাঁড়িয়ে আছে।
এবার হায়েত আলী আস্তে আস্তে বলল,নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ।- চুপ থাকো মম, চুপ থাকো;আমি, আমি ব্যবস্থা কইরি ফেইলবুনি।
মমতা খুব আস্তে ও দৃঢ় কণ্ঠে বলল,চুপ নাই কোরনু।- তে, তুমি জ্বীনে ধরা হাসানের কাছে যে রাইতে ছিলে,সে রাইতে হাসানের কাছে ছিলে?- না আমার কাছে ছিলে? আবারও কঠিন গলায় প্রশ্নটা করে, তীক্ষ্ণভাবে চেয়ে থাকল মমতা ।
হায়েত আলীর মুখটা শুকিয়ে গেল।তখনই রোমেলা খাতুন তেলের বাটি নিয়ে হায়েত আলীর দিকে ঠেলে দিল।হায়েত আলী বাটিটা নিজ হাতে টেনে নিয়ে ঠোঁটটা কয়েকবার নড়িয়ে যেই ফুঁ দিতে গেল, ঠিক তখনই ডান হাত দিয়ে জোরে আঘাত করে বাটিটা ফেলে দিল হায়েত আলীর হাত থেকে এবং মুখে উচ্চারণ করল ' হারামখোর'।
হায়েত আলী ভয়ে জড়ষড় হয়ে গেল, তবে উঠানের দিকে তাকিয়ে আবার মমতার কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করে বলল,ওরে বাপরে বাপ,বজ্জাত জ্বীন, বজ্জাত-বজ্জাত।দেখছি দাঁড়া বলতেই, বাড়ির গেট দিয়ে রকিব চেয়ারম্যান প্রবেশ করল।
নব নির্বাচিত চেয়ারম্যানের গলা ভর্তি অনেকগুলো ফুলের মালা রয়েছে এবং সাথে আছে বেশ কয়েক জন লোক।
হাসি মুখে রকিব মোবারক আলীর উদ্দেশ্যে বলল,স্লামালেকুৃম চাচা।
উলাইকুম আসসালাম, বলেই পিড়ির উপর থেকে খুব দ্রুত নেমে কোলাকুলি শুরু করে দিল হায়েত আলী। মোবারক আলীকে সালামের উত্তর দেওয়ার সুযোগই দিল না হায়েত আলী।
মোবারক আলী চেয়ারম্যান রকিব উদ্দিনের কাছে এগিয়ে গিয়েই ভগ্ন শরীরে ও আদ্র গলায় অভিযোগ দিল, বাবা আজ রাইতে আমার বড় বড় কাঁঠাল গাছগুলো কারা যেন কাইটি দি গিছে? রোমেলা খাতুন এতক্ষণ পর বুঝল তার স্বামীর মন কেন এত খারাপ এবং কেনইবা এত ভেঙে পড়েছে? 
রকিব উদ্দিন বলল,সবেমাত্র চেয়ারম্যান হলাম চাচা, ক্ষমতা পালিই আপনার গাছ কাটার বিচার আগে কইরব।দোওয়া করবেন চাচা, বলে হাতে হাত মিলিয়ে বেরিয়ে গেল।
চেয়ারম্যান বেরিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কিছু লোকের সাথে হায়েত আলীও বেরিয়ে যাওয়ার যেন সুযোগ পেল,একবার মমতার দিকে আর একবার মোবারক আলীর দিকে পিছলেমুখে তাকিয়ে হায়েত আলী বেরিয়ে গেল।
মমতা খুঁটিতে হেলান দিয়ে হায়েত আলীর পালিয়ে যাওয়া উপলদ্ধি করল।হায়েত আলী পালিয়ে গিয়ে দম ছেড়ে বাঁচলেও মমতার দম আটকিয়ে আসছে।তবে মমতা অস্বাভাবিক আচরণ করা বন্ধ করে ঘরের ভিতর গেল।তার বার বার মনে হচ্ছিল,মাঠে বেড়ে উঠা বাপজানের হাতে অতি যত্নে লাগানো গাছগুলোর কথা।কে বা কারা এত বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলল? কেনই বা কাটল?
এখন আর মমতা তার পেটের সন্তানের কথা ভাবছে না।মমতা নিজেই নিজেকে বলে,একুন যদি মাতা গরম করি,তাইলে বাপজান বাইচপি নানে।
মমতা ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাকে এবং বলতে থাকে, 'আইজ যদি ভাইজান বাড়ি থাইকতু তাইলে সব সেই দেকতু। হাসানেরও খোঁজ নেই,ওইটুকু ছেলি কন যে গেল?- আল্লাহ আমার ছেলিডাকে ভাল রাইকু'। 
এমন সময় রোমেলা খাতুন থালায় ভাত নিয়ে ঘরে ঢুকল।মমতা খুব শান্তভাবে বলল, ওখানে রাকো মা,আমি হাত- মুখ ধুয়ে আইসি, খাইয়ি নিবুন।
রোমেলা খাতুন ভাতের থালাটা রেখে মমতার মাথায় ও মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,মা



আনোয়ার রশীদ সাগর

জন্ম ১৯৬৫, ১২ জানুয়ারী।
প্রকাশিত বই: কবিতা- না, যাবো না, ও মেঘ ও নারী, মুখোশ মন্ত্রের ফড়িঙকাব্য, বৃষ্টি প্রেমে শ্রাবণসন্ধ্যা, আকাশ জুড়ে বাজপাখি ছোঁ। 
গল্পের বই: বিচ্ছিন্ন হতাশা, নোম্যান্স ল্যান্ড 
উপন্যাস: পাখি এক অষ্টাদশীর নাম, স্রোতের কালো চোখ।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক: ৭১ এর রণাঙ্গণে কাকিলাদহ যুদ্ধ।
বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। বসবাস: আলমডাঙ্গা পৌরসভার কোর্টপাড়ায়। লিটলম্যাগ সহ জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। 
ছোটগল্প • অন্তুর মন • ভাস্কর চৌধুরী

ছোটগল্প • অন্তুর মন • ভাস্কর চৌধুরী


অন্তুর মন খারাপ। কেবল এই শিতেলা বিকেল। হালকা হালকা ঠান্ডা পড়ছে। বাড়ির পাশের কয়েকটা পুরনো সেগুন আর মেহেগুনি গাছের পাতা টুপ টুপ করে পড়ছে। একটু আলো চলে গেলে একটু আঁধার নেমে এলো। অন্তুর মন খারাপ বাড়লো। কেউ তো জিজ্ঞেস করবে, কিগো অন্তু, মন খারাপ ক্যানো? তোমার দিদির নাকি বিয়ে। আর জামাই নাকি অনেক বড় পাশ। বড় চাকুরী করে। তোমার দিদিকে সোজা ঢাকা নিয়ে যাবে। সাথে তুমিও যেতে পারবে। মন খারাপ ক্যানো?
অন্তু নিজেকেই বললো, মন খারাপের কি কারণ লাগে? এই যে , তোমরা বলছো, আমিও নাকি দিদির সাথে চলে যাবো। এটাও তো বড় কারণ হতে পারে। কিন্তু আমি তো মাকে ছাড়া কোথাও থাকতে পারবো না । তোমরা জানতো,এই পচা গ্রামের কোনে এই বিশাল দোতলা বাড়ি । বাড়ি মা আমি আর কবুতর থাকি । দিদিটা ছিলো। কলেজে যেত। এখানকার এক ছেলে পিছু নিলো। সুন্দর মিষ্টি চেহারা। কিন্তু বিড়ি খায়। আচ্ছা যদি বা তুমি দিদিকে চাও, তো বিড়ি ছেড়ে অন্তত ক্যাপিস্টেন সিগারেট টানবে। আর রাস্তা ছেড়ে অন্তত একটা চিঠি আমার হাতে দিলে, আমি দিদিকে দিতাম । মা জানতো পরে। ততদিনে হয়তো দিদির মনটা পেতে। তোমার বাবা তো এখানকার চেয়ারম্যান।পার্টির লোক । আর আমরা তো খুব নিরিবিলি মানুষ। এই গ্রামে মা ছাড়া এক পিসির বাড়ি আছে। পিসি আসে নিয়মিত। আমাদের খোঁজ খবর করে পিশে মশাই শহরে চাকুরী করে। সুন্দর সুন্দর বই এনে দেয়। বলে , অন্তু পড় । একা থাকলে বই বন্ধু হয়ে যায়। তুমি বই এর সাথে বন্ধুত্ব করো। কি ? পারবে না ? অন্তু বই এর প্রতি মনোযোগ দেবার সময় পায় নি। অন্তুর কত কাজ। জারুল গাছে ফুল এসেছে। লাগালিঙ্গমে অদ্ভুত সুগন্ধি ফুল। পলাশ ফুটেছে। এইসব ছেড়ে অন্তু বই পড়বে কখন । এখন শীত আসবে বলে, ছাদে লেপ শুকাচ্ছে। ছাদটা দ্যাখো, অন্তুর মতো একা। ভাবে অন্তু। দিদির ছাদে যাওয়া বারণ । ওই ছেলেটা তাকিয়ে থাকে। তাই মা দিদিকে বকেছে। দিদির চুল শুকনো ছাড়া কি ছাদটা মানায় বলো? অন্তু ভাবলো, সে দিদির সাথে যাবে না। ক্যানো যাবে? ছেলেটার প্রতি অন্তুর বড় মায়া। অথচ ওই ছেলেটা কারণেই দিদিকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেয়া হচ্ছে। পিসি বলেছে, পিসি জামাই ঠিক করেছে। দিদির লম্বা চুল দীঘল দীঘির মতো চোখ। ওই দীঘির মতো চোখের কথাটা তো তাকে ওই ছেলেটা বলেছে। সুন্দর কথাটা। দীঘির মতো দিদির চোখ । অন্তু আজ এই কথাটা দিদিকে বলে একটা চড় চেয়েছে। তারপর অন্তুর চোখ ফেটে জল। দিদি তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে বললো, ওসব শুনিস না আর। শুনে কি লাভ বল? আমি তো বিয়ের পর ঢাকা চলে যাবো। মনটা খারাপ করে দিলি। অন্তু বুঝলো, কথাটা দিদির মনে ধরেছে । কি জানি, আরো কত কি গোপন কথা আছে । সব কি অন্তু জানে? এই ভেবে অন্তু বিকেলে ঘরের বাইরে এলো। এই বিশাল বাড়িতে তিনটে মানুষ। সকলের মনের কথা সকলে কি জানে? দিদি একেলা।দিদির পাশে ছেলেটাকে মানাত ভালো। হলো না। মা একেলা। বাবা তার জন্মেরসময়েই চলে গেছেন। অন্তুও একেলা।দিদিটা একা একা কি যে ভাবে। রাজ্যের ভাবনা দিদির দীঘল চুলে। বাড়িটা নিজেও একেলা। আর গাছগুলো দ্যাখো? ওরাও বোবা আর একেলা। এই ভেবে অন্তু একটু ঢাল দেখে পা ঝুলিয়ে বসলো। আঁধার নেমে এলো । অন্তুর মনে হলো, এই বিশ্ব চরাচরে কোথাও কেউ দুই জন নেই। অন্তু এক সাথে দুজন মানুষ খুব কম দেখেছে।দিদিকে নয়। মাকে নয়। পিসিকেও নয়।
তখনই ছাদ থেকে ডাক পড়লো। অন্তু, বাড়ি এসো। বা ড়ি এ সো-- মায়ের ডাক। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গিয়েই অন্তু ঢাল গড়িয়ে ক্রমশঃ নিচে পড়তে লাগলো। মায়ের শেষ ডাক অন্তু শুনলো , ওরে অন্তু রে-----
এক গুচ্ছ অণুগল্প • জীবনের প্রতিচ্ছবি ।। নাঈম হাসান

এক গুচ্ছ অণুগল্প • জীবনের প্রতিচ্ছবি ।। নাঈম হাসান


রানী 

চশমার কাচ পরিষ্কার করতে করতে মৌমিতার সামনে এসে বসল আকাশ ।

"কি সমস্যা ? " চোখ মুখে বিরক্তি ঢেলে বলল মৌমিতা । 
"কই কি সমস্যা ? " আর চোখে তার দিকে চাইল আকাশ । 

"এই যে আজকাল এত ভাব নাও । " 
"কি ভাব নিলাম ? আশ্চর্য । " 
"ফেইসবুক ম্যাসেজ দিয়েছি কাল এখনো সিন করইনি । " 
"ওহ , ম্যাসেজে ঢোকা হয়না । " 
"এতই যদি ব্যস্ত তবে কবিতা লিখে টাইমলাইনে পোষ্ট দিলে কিভাবে ? " 
" এখন সমস্যা কি বলত ? ম্যাসেজ না রিপ্লেই দিলেও রাগ করবে ? " চোখ পাকিয়ে বলল আকাশ । 
"এখন সব সময়ই তুমি আমায় ইগ্নোর কর । " 
" কি বল এসব ? " 
"ফোন দিলে ধরনা , দেখাও করনা আগের মত । " 
"ব্যস্ত আমি তাই । আর সারাদিন এত কিসের কথা ? " 
" হুম । আর রিলেশনের আগে কি বলেছিলে ? আমার সব সময় তোমার , তোমার জন্যই বেঁচে আছি , তুমি ছাড়া একা , বাচবনা , আরো কি কি । এখন কি সব মিথ্যেই ......? " চোখে পানি চলে আসে মৌমিতার । 
"দেখ এখন ন্যাকামি করোনা প্লিজ । তুমি আসলে আমার ভাল চাওনা । তুমি চাওনা আমি মন দিয়ে চাকরি করি , নিজের ক্যারিয়ার গড়ি । এই জন্য এমন কর খালি , পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া । " 
"ঠিক আছেনা দিতে হবেনা সময় , থাকো তুমি ব্যস্ত ।" কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় মৌমিতা । 
হা হা হা , অট্ট হাসিতে ফেটে পরে আকাশ । পৈশাচিক আনন্দ পায় সে । তিন বছর পাগল মত পিছে ঘুরিয়েছ , হাত কেটে তোমার নাম লিখেছি , বলতে গেলে প্রায় পা ধরেছি প্রেম পেতে , কত কেঁদে কেটে একাকার হয়েছি , লাখ খানেক টাকা খরচ করেছি , এরপর প্রেমে পরেছ । এবার এই তিন বছর এত্ত যন্ত্রনা দেয়ার প্রতিশোধ নেব তিলে তিলে । হা হা হা .........
" কিরে তুই ঘুমের মধ্যে হাসতাছস কেলা ? " মামাতো ভাই নাঈমের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে আকাশের । 
"ধুর বা* এইটা স্বপ্ন ছিল ! আমি ভাবলাম........নাহ মৌমিতা আমার প্রেমে পড়লেও এমন করুম না , মরলেও না । অনেক লাভ করি ওরে আমি । সারা জীবন রাজ রানী বানায়া রাখুম । " মনে মনে বলে আকাশ । এরপর বালিশের নীচ থেকে মোবাইল বেড় করে ফেইসবুক ঢোকে । নাহ আজও রিপ্লেই দেয়নি । এক সপ্তাহ হয়ে গেল অথচ মৌমিতা ম্যাসেজের কোন উত্তরি দিলনা ।

ধূমপান 

বালিকার সবচেয়ে বড় কষ্টের কারন ছিল, তার প্রিয়তম একজন ধূমপায়ী । 
আরিফ ধূমপান ছেড়েছে বছরখানেক হল , কিন্তু মানা করার সেই বালিকাই নেই ।

মূল্য 

সেলিম চৌধুরী চেয়েছিলেন তার মেয়েকে সুপাত্রে দান করবেন । সারাজীবন মা মরা মেয়েকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন , মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয় বিয়েও করেননি । অথচ মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করল , কোথাকার কোন ছেলেকে , দেখেই মনে হয় নিয়মিত গাজা-হিরোইন কিনতে চুরি বাটপারি করে । মেনে নিলেননা , মেয়ে আর জামাইকে ,ত্যাজ্য করলেন । ক'বছরের মাথায় পরপারে পারি জমালেন , সম্পত্তি পেল তাঁর ভাইয়ের ছেলে । 

খদ্দের বিদেয় হবার পর টাকা গোনে রিমা , নিজের ভালবাসার মূল্য না দিয়ে বাবার ভালবাসার কথা ভাবলে আজ পতীতালয়ের বাসিন্দা হতে হতনা তাকে !

ক্ষমা 

অনিক রাতভর মন খারাপ করত কেউ তার খেয়াল রাখেনা তাই ,

বালিকা তার প্রিয়তমর খাওয়া , ঘুম আর লেখা- পড়ার ব্যপারে জানতে চাইলেই শোনে অশ্রাব্য গালাগাল । 
অনিক এখন রাত ভর দু চোখে অশ্রু ঝড়ায় , বালিকার ক্ষমা পাবার আশায় !

পাসওয়ার্ড

নীল তিন বছর উর্মিকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসার পরেও উর্মির দিক থেকে কোন সারা পেলনা । পাশা পাশি বাসায় থাকে ওরা । নীল দিনের কয়েক ঘন্টা বারান্দায় ব্যয় করে শুধু উর্মিকে দেখবে বলে । কি না করল মেয়েটাকে পেতে , কিন্তু পাথর হৃদয় গলেনা । 

উর্মি গান ভালবাসে তাই সে গিটার বাজানো শিখল । উর্মির জন্মদিনে কেক , চোকলেট , ফুল এনে উইশ করল । এবং ভালবাসার কথা বলল , উর্মির উত্তর না । 
ভ্যালেন্টাইন্সে নেইল পলিশ , গ্লস, পারফিউম দিয়ে আবার প্রেম নিবেদন , এবারো উত্তর একি । 
সবশেষে উর্মির জন্য হাত পা কাঁটা কাটি করল , এবং আত্নহত্যার হুমকি দিল , কিন্তু কোন লাভ হলনা । তবুও নীল চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে । 
তারপর একদিন , 
উর্মি মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছে , দু চোখ ভেজা ! 
"কি ব্যপার কাঁদছ কেন ? মন খারাপ ? " ওপাশের বারান্দা থেকে বলল নীল । 
"এমনি । " 
"আরে কি হয়েছে বলবেতো ? " 
" ফেইসবুকে যেতে পারছিনা , ফোনের এম বি শেষ । কিরন মালার ফটো শেয়ারো করতে পারছিনা । " 
নীল মুখে হাসি টেনে বলল , "আরে পাগলী এই জন্য কাঁদতে হয় ? আমি কি মরে গেছি ? আমার ওয়াইফাই আছে আর তুমি কি এম বি নিয়ে পরে আছো , বোকা । " 
"তোমার ওয়াইফাই মানে ? তুমি ওয়াইফাই চালাও কবে থেকে ? কই তোমার নামেতো কোন ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক দেখিনি ? " 
" সেতো প্রায় তিন বছর হল , কেন Neel shagorer Urmi এই নামে দেখনি ? তোমার আমার নামে । " 
"ও তাই বল । খেয়াল করিনি । " চোখ মুছে হেসে উঠে উর্মি । 
" এখন যত খুশি ফেইসবুক চালাও , ইউটিউব দেখ , মুভি ডাউনলোড দাও , ওসব এমবি টেমবি নিয়ে আর ভাবতে হবেনা । " 
"আগে পাস ওয়ার্ড তো দাও । " 
"ও হ্যা , এক সাথে বড় হাতের অক্ষরে লিখ - NEEL LOVE URMI " 
"তুমি না একটা পাগল । " হেসে নীলের দিকে চাইল সে । 
সে রাতেই নীলের প্রেমের প্রস্তাবে সারা দেয় উর্মি । নীল খুশিতে লাফাতে লাফাতে ভাবে , " তিন বছর আগে ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ড টা দিলে আজ উর্মির বাচ্চার বাপ হয়ে যেতাম । " 

অপেক্ষা 

আমেরিকার ভিসা হাতে মাসুমের চোখ জ্বালা করে ওঠে , টুম্পা আজ অন্যের ঘরে । 
বেকারত্বই ছিল বিচ্ছেদের একটি অংশ মাত্র ।

টুম্পার ঘর ভর্তি সিগারেটের ধোয়া , চারটে ছেকার দাগ আগেই ছিল পিঠে । আজ বুকে আরো দুটো যুক্ত হল ! 
অপেক্ষায় না থাকা আজ তিলে তিলে মরার অন্যতম কারন !

দাবার চাল

মোজাম্মেল ভালবাসে প্রিয়ন্তিকাকে , প্রিয়ন্তিকা চায় শুধু আকাশকে । 

আকাশের কাছে প্রেমের অর্থ দৈহিক চাহিদা । 
ফলাফল , মোজাম্মেল পুড়ে দহনে , প্রিয়ন্তিকা সাজে দাবার চাল । 
ত্রিভুজ প্রেমে একমাত্র আকাশি লাভবান ব্যক্তি ! 
প্রিয়ন্তিকাকে বিদেয় করে আকাশ নেমে পরে নতুন পাখির খোঁজে , ফাঁদ তার সুদর্শন চাউনি । 
তার পরবর্তি টার্গেট রুম্পা ! 
যদিও সে জানেনা নিজেই এবার হতে যাচ্ছে দাবার চাল ! 
"দোস্ত লুইচ্চা টার আইফোন সেভেন আর মানিব্যাগে নগদ সাত হাজার টাকা নিয়া আইলাম । " 
" রুম্পা আমার বান্ধুবী তুই এত ভাল ক্যারে ? লাভ ইউ দোস্ত ! কেমনে বাশ দিলি মাগির পুত রে ? " 
" আমি জামানের ফ্ল্যাটে আইতে কইছিলাম । পরে জামান আর সুমন মিল্যা হালারে ল্যাংটা কইরা বাইন্দা পিডায় পরে ফোটো তুইল্যা রাখে । আর হালারে কইছি পুলিশি কাহিনি করলেই ফোটো সব নেটে ছাইড়া দিমু । পরে হালায় কসম টসম কাইট্যা কইছে কাওরে কইবনা । " 
"থ্যঙ্কস দোস্ত । অনেক উপকার করলি । তোর বিকাশের নাম্বারে বিশ হাজার টাকা পাঠিয়া দিছি । " 
"আরে টাকা পাঠাইলি কেন ? তোর জন্য এতটুকু করতে পারুম না ? " 
"তবুও দোস্ত এইটা অনেক রিস্কি কাম ছিল । মাইন্ড করিস না । রাখি তবে ভাল থাকিস । " ফোন রেখেই ক্রুর হাসি দিল মোজাম্মেল , অবশেষে আকাশকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়েছে । 
এখন যেতে হবে হাসপাতালে । প্রিয়ন্তিকার এবর্সন হবে একটু পরে , পাপ নিশ্চিহ্ন করবে আজ । অন্তসত্বা হয়েছে জেনেও আগের মতই তাকে ভালবাসে মোজাম্মেল ।

বেহায়া মন 

রোকন যতই ভাবুক বাবলির দিকে আর তাকাবেনা তবুও চোখ চলে যায় । বেহায়া মন , নাকি সে নিজেই ? কেউ না বললেও সে নিজেকে জগতের শ্রেষ্ঠ নিলজ্জ আখ্যাইত করেছে মনে মনে । বিশ্ববিদ্যালয় গত একবছর এক সাথে ক্লাস করছে সে আর বাবলি । এই এক বছরে না বলেছে সে মনের কথা , না পেরেছে দৃষ্টি সরাতে , যদিও বাবলির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই , এমনি তাকে তেমন কোন মূল্যায়নও দেয়না । কখনো বলেনা , চল ক্যান্টিনে আড্ডা দিই । কখনো বলেনা , চল এক সাথে বাসায় যাই । আর যদিও কিছু বলে সেটা তার দরকারে । যেমন ক্লাস রুটিন জানতে চাইবে , কিংবা কোন পড়া না বুঝলে জিজ্ঞেস করবে , এসাইনমেন্ট করে দিতে বলবে ব্যাস । 

ক্লাসের সবাই জানে রোকন বাবলিকে কতটা চায় । কিন্তু বাবলি সর্বদা এরিয়ে চলে তাকে । 
সে যদি বলে , চল কোন রেস্টুরেন্টে আড্ডা দেই ? বাবলি বলবে ব্যস্ত , বাসায় সমস্যা , শরীর খারাপ ইত্যাদি । অথচ ক্লাসের যত বদ , নিম্ন মানের , ফাকিবাজ , লুচ্চা মার্কা ছেলেগুলোই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড । তাদের কাজ হল সারাদিন টোটো করে রাস্তায় ঘোরা , আড্ডা দেয়া , মেয়েদের দেখলে সিস দেয়া , সিগারেট গাঁজা খাওয়া , আর ক্লাস শেষে অশ্লীল বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়া । 
এরা যদি বাবলিকে বলে কোথাও যেতে ,দুনিয়া উলটে গেলেও তাদের সাথে যাবেই । 
আজকাল বাবলির উপর অন্য কারনে রাগ হয় তার । ভার্সিটির এক বড় ভাইর সাথে সব সময় থাকে । 
শুধু থাকেনা , 
উঠে, বসে , 
সময় কাটায় , 
রিক্সায় আসা যাওয়া করে । 
প্রচন্ড কষ্টে বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে রোকনের , যখন দেখে সেই বড় ভাইর কথা বলতে বলতে বাবলির চুলে হাত নারায় , তাদের মাঝেকি প্রেম ? 

সে রাতেই ফোন দেয় বাবলিকে ......

" হ্যা রোকন বল । " ফোন ধরে বলে বাবলি । 
" তোমায় বহুদিন ধরে একটা কথা বলব বলব করে আর বলা হয়না । " প্রচন্ড রকমের হৃদ স্পন্দন শুরু হয় রোকনের । 
"হু তা তো প্রায়ই বল , কিন্তু কথাটা কি ? প্রোপোজ করবে ? শোন আমার বি এফ আছে । ওসব করে এখন আর লাভ নাই । " 
চোখে পানি চলে আসে রোকনের , কোনরকমে বলে , " না না ওসব কিছু না । আমিতো মজা করি , কি আর বলব তোমায় ? বাই দ্যা ওয়ে তোমার কাছেকি একাউন্টিং এর নোট গুলো হবে ? " 
'নাহ , সেগুলো নিয়ে কি আর ভাবা লাগে , হাসানিতো সব করে দেয় । " 
"হাসান টা কে ? " 
"হাসান কে আবার ? আমার উনি । সে ফাইনাল ইয়ারে না এবার । কত সিনিয়র আমাদের চেয়ে । সব হেল্পি করে । " 
"ও তাই বল ,ঠিক আছে । " বলে ফোন কেটে দেয় রোকন , কাঁদতে কাঁদতে দাঁড়ানো থেকে বসে পরে সে । যা ভেবেছিল তাই , সেই বড় ভাইকেও ভালবাসে বাবলি । 

এর কয়েকদিন পর , এক দুপুরে লাইব্রেরিতে বসে জরুরী কিছু নোট করছিল রোকন , এরমধ্যে তাদের ক্লাসের অন্যতম রূপসি ডালিয়া এসে উপস্থিত , " কি ব্যপার রোকন আজকাল দেখাই পাওয়া যায়না তোমার ? মন খারাপ ? "

"হ্যা কিছুটা । " শুকনো মুখে বলে সে । 
"কেন গো ? বাবলি বিএফ পেয়েছে তাই ? " নাকি সুরে বলল ডালিয়া । 
"তুমি এত বেশি বোঝ কেন ? " 
"আমি বেশি না ঠিক টাই বুঝি , এবার তো আমায় নিয়ে ভাব প্লিজ । " 
"শোন ফানের একটা লিমিট আছে , কই তুমি আর কই আমি ? তোমার পিছে গোটা ভার্সিটির সবাই ঘোরে । আর আমি ? ক্ষেত , দেখতে ভালনা , বাবার কারি কারি টাকা নেই , প্লিজ আমার সাথে এমন করনা । " 
"তুমি কি বলতে চাও ? আমি তোমার সাথে ফ্লার্ট করছি ? " রাগে ডালিয়ার ফর্শা গাল দুটো লাল হয়ে যায় । 
"নাতো কি ? " 
" শোন বিশ্বাস কর আর নাই কর , আমি তোমাকেই ভালবাসি অনেক ভালবাসি । আমি টাকা , পয়সা , চেহারা কিছুই চাইনা , শুধুই তোমায় চাই । " 
"প্লিজ আমি আর মন ভাংতে চাইনা । তুমি চলে যাও , ভাল লাগছেনা তোমার এসব মিথ্যে ফাইজলামি । " রাগ হয় রোকনের । 
কাঁদতে কাদতে চলে যায় ডালিয়া । 
সেদিন রাতে রোকনের মনে হয় নাহ কাজটা ঠিক হয়নি , মেয়েটার সাথে বেশিই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে , ফোন দেয় ডালিয়ার নাম্বারে । 

২ । 
এরমধ্যে কেটেগেল একমাস , এদিকে বাবলি জানতে পারে হাসান বড় সর এক লম্পট , মেয়েদের ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে তার বন্ধু লিটনের ফ্ল্যাটে নিয়ে জৈবিক চাহিদা মেটানই তার আসল উদ্দেশ্য । হাসান তার কোন ক্ষতি করার আগেই সটকে পরে সে । 
তবে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত । সে ভাবে আজ যদি রোকন হত তবে জীবনটা হত অন্য রকম , রানী করে রাখত ওকে , বাবলি জানে কত ভালবাসে রোকন তাকে , হয়ত দেখতে তেমন স্মার্ট না সর্বদা সিম্পল থাকে , কথা কম বলে , তবে কোন খারাপ স্বভাবো নেই , কখনোই কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি তার ওপর সে ক্লাসের ফার্স্ট বয় । যখনি যা সাহায্য চেয়েছে করেছে , অথচ বিনিময় সর্বদা এড়িয়ে চলেছে ওকে । 
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই কয়েকদিন কেটে যায় , বাবলি বুঝতে পারে সে রোকনের প্রতি দুর্বল হয়ে গেছে । 
কয়েকদিন পর ক্যম্পাসে রোকনকে দেখতেই এগিয়ে আসে সে , "রোকন কেমন আছো ? " 
"ভাল অনেক ভাল । তুমি ? " হেসে উত্তর দেয় রোকন । 
"ভালনা ,তুমিতো আমায় ভুলেই গেলে । " 
"কেন কি হয়েছে ? ভুলিনি একটু ব্যস্ত তো তাই । " 
" হয়েছে অনেক কিছুই , তুমি কি জান হাসানের সাথে যে আমার আর সম্পর্ক নেই ? " 
মাথা নাড়ায় রোকন , " জানি । " 
"আমি জানি তুমি আমায় অনেক চাইতে , জানিনা এখন চাও কিনা । আচ্ছা এখন কি যায়না আমায় গ্রহণ করা , আরেকবার যায়না ভালবাসা ? " 
বিস্ময়ে হতবাক রোকন , বলছে কি এই মেয়ে ? গত এক বছর সয়নে, স্বপনে যেই মেয়েকে সে চেয়েছে , সেই আজ মনের কথা বলছে ? 

দূর থেকে ডালিয়া রোকনকে দেখে বাবলির সাথে হেসে কথা বলতে , প্রচন্ড রাগ লাগে ওর , বুঝতে অসুবিধা হয়না কেন সেধে কথা বলছে বাবলি , গত এক বছর যে রোকনের দিকে ফিরে চায়নি আজ সে কেন ভাব করছে , হাসানের শূন্যতা কাঁটাতেই যে রোকনের কাছে এসেছে তাও বোঝে ডালিয়া , আর দাড়িয়ে না থেকে তাদের কাছে গিয়েই রোকনের হাত ধরে হেচকা টান দেয় , "কি ব্যপার আমায় ভুলে নিজের অতীতের ক্রাশের সাথে কি কর হু ? হা হা হা । " মিষ্টি করে মেকি হাসি দেয় বাবলির দিকে চেয়ে । 
"কেমন আছিস ডালিয়া ? " বাবলিও মেকি হাসি দেয় । 
"ভালই , আচ্ছা তোকেতো বলাই হয়নি , এক সপ্তাহ হল রোকনের সাথে আমার রিলেসন । " 
"তাই ? খুবি ভাল , ট্রিট দিচ্ছিস কবে ? " কোনরকমে মুখে হাসি টেনে বলে বাবলি । 
"খুব দ্রুত দিব দোস্ত । আচ্ছা থাক যাই । " বলেই রোকনকে প্রায় টেনেই নিয়ে যায় ডালিয়া । 

বাবলি চিন্তা করে , একজন মানুষের মন মানসিকতার কথা চিন্তা না করে তার অর্থ আর বাজ্যিক চাক চিক্য দেখে ভালবাসার ফল কি তিক্ততাই হয় ? না রোকন তার ভাগ্যেই ছিলনা ? 


নাঈম হাসান
জন্ম ১৯৯৫ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ঢাকায়। দৈনিক পত্রিকা, ছোট কাগজ, লিটল ম্যাগ, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা ছাড়াও সাহিত্যের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখা লিখি করছেন কবিতা, উপন্যাস, গল্প । এছাড়াও আবৃত্তির প্রতিও রয়েছে বিশেষ ঝোঁক। বর্তমানে স্নাতকোত্তর করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে । 
২০১৯ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে   তাঁর প্রথম উপন্যাস “এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ” প্রকাশিত হয়।

খাদিজা ।। রুখসানা কাজল

খাদিজা ।। রুখসানা কাজল

                      মুতাসিম নূরে হাফেজি ঘোর ঘোর সন্ধ্যালাগা বিকেলে বাড়ির  গেটের কাছে পুটুলি মত  কি যেন রিকশা থেকে দ্রুত নামিয়ে নেয়। তারপর পাটখড়ির গেট  খুলে পুটুলিটাকে উঠোনে ঠেলে দিয়ে অই রিকশায়  করেই মসজিদে চলে আসে। এই সামান্য কাজটুকু করতে তার কাল ঘাম ছুটে  গেছে। রিকশাওয়ালাকে বার বার তাগাদা দিয়েছে, মিয়ার বেটা  একটু জলদি  চালাও। আরো জলদি। ডাবল পয়সা দিবানি তোমারে। ক্ষেপে  গেছিল  রিকশাওয়ালা। ব্রিজের মাঝামাঝি রিকসা থামিয়ে বলেছিল, মনে কয়  হুজুর য্যান চুরি ডাকাতি করি আসিছেন! পুলিশ দাবড়াতিছে পেছুনি পেছুনি! এরচে আর জোরি চালাতি পারব না মামু। আমি  কি মেশিন নাকি! মসজিদের ঘরে ফ্যান ছেড়ে হাপরের মত শ্বাস  নিতে নিতে নূরে মুতাসিম হাফেজি ভাবে আপাতত এখন বাঁচলেও  এরপরের  ঘটনাগুলো সে কি করে সামাল দেবে তার ফন্দি ফিকির!      
               জোবেদা বেগম মাগরিবের অজু করতে নেমেছিল। উঠোনে  কালো বোর্কায় মোড়া  ছোট এক মেয়ে দেখে চমকে যায়, এই কে রে তুই ? এমন ভুতের মত ভর বিকেলে কেউ কারো বাসায় আসে ! এখুনি  আজান দেবে। যা বাসায় যা। পরে  আসিস । তিনি মনে  করেন মেয়েটা  তার মেয়ে সালমার ইশকুলের বান্ধবী হবে কেউ। কিন্তু মেয়েটা যায় না। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বোরকা  খুলে ফেলে। একহাতে শাড়ি সামলে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে বারান্দায় উঠে বলে, বড় হুজুর আমারে এখানে থাকতি কইছে।
                 কোন হুজুর ? খাদিজা খানম মুতাসিম  নূরে হাফেজির দ্বিতীয় বিবি তারের কাপড় তুলতে তুলতে জিগ্যেস করে। এবার মেয়েটা বড় বিবি মেজ বিবি দুজনকেই সালাম করে, আম্মা আমি বিউটি। বড় হুজুর  আমারে আজকি দুপুরে বিয়ে করি এখানি নিয়ি আসিছি। ক্কি?  মুতাসিম  হুজুরের  দুই বউই চেঁচিয়ে উঠে। বড় বউ জোবেদা বেগমের আবার  হিস্টিরিয়া  রোগ আছে। খাদিজা তাড়াতাড়ি বড় সতীনকে ধরে বারান্দার চকিতে বসিয়ে দেয়। জোবেদা বেগম কানতে গিয়েও খাদিজার ভয়ে দাঁত কপাট মেরে কান্না চাপিয়ে রাখে । খাদিজা বড় লেঠেল মেয়ে।  কানতে দেখলে এমন  ধমক  দেবে  যে  তা  ভাবা  যায়  না। বড় হুজুর নূরে মুতাসিম  খাদিজার ভয়ে আজ  আট বছর মসজিদে আস্তানা গেঁড়েছে । কোনো কোনো  রাতে লুকিয়ে চুরিয়ে জোবেদা বেগমের ঘরে আসে।  কিন্তু  ফজরের আজানের আগেই পালিয়ে যায়।  খাদিজা জানতে চাইলে তিনি ভয়ে সত্যি বলে দেন আর মুতাসিমের দেওয়া দু এক পাঁচশ টাকা খাদিজার হাতে দিয়ে দেন। খাদিজা সে টাকা থু থু  করে ফেলে দিয়ে এমনভাবে তাকায় বড় বউয়ের মনে হয় সে পরপুরুষের সাথে শুয়ে টাকা এনেছে।
                  সংসার চালায় খাদিজা। তার পেটের দুই ছেলেও খুশি মনে  খাদিজার হাতে সংসারের খরচ তুলে দেয়। মেয়ে সালমা খাদিজার কথায় মরে বাঁচে। কেবল তিনি এই সংসারের কান্নি ধরে কোনো রকমে টিকে  আছেন।  কোন কিছুতেই জোবেদা বেগম জোরে গলায় কিছু বলতে পারে না। খাদিজা বলে, আপা শোনেন আমার স্বামী যদি আমি ঘরে থাকতি  আরেকটা  বিয়ে করত তো কেস করে দিতাম। কেমন মেয়েমানুষ আপনি স্বামীকে ভাগ বাটোয়ারা করতি রাজি হতিছেন! আপনি কি চোক্ষে দা বটি কিছু দেখেন না? তাকে খুব ই যত্ন করে খাদিজা কিন্তু উঠতে বসতে যখন তখন ভীতু বলে  গালিগালাজের তুফান বইয়ে দেয়। শুয়ে শুয়ে নিজের বুকের ধুকপুক শোনে জোবেদা বেগম। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার।  আল্লারে এই পঞ্চাশ পঞ্চান্ন  বছর বয়সে আবার বিয়ে  করল মানুষটা ? তাও অই টুকু এক আঙ্গুলে এক বাচ্চা মেয়েকে?  
                                                                     
                  খাদিজা খাতুন বিউটিকে হ্যাঁচকা টানে তার ঘরে নিয়ে আসে। রাগের মাথায় ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে। আর অমনি ব্যাগ থেকে ঝপঝপ করে বেরিয়ে পড়ে  কতগুলো বই খাতা কলম দুই তিনটে সস্তা  জামা কাপড়। বিউটি ছুটে গিয়ে বইগুলো কুড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ।   বয়েস কত তোর ? বারো । তয় আব্বা আর হুজুর কইছে সবাইরে আঠারো বলতি। আর একটু হলে  শাড়িতে পা জড়িয়ে পড়ে যেত মেয়েটা। আম্মা আমি জামাপ্যান্ট পরি?  
               প্রচণ্ড রাগ নিয়ে খাদিজা এবার ভাল করে মেয়েটাকে দেখে। বড় সতিনের মেয়ে সালমার বয়েসি হবে। বাড়ন্ত শরীর। চাঁদ কপালের ডানদিকে একটা ঘূর্ণি। বুকের কাছে বই খাতার সাথে শাড়ির আঁচল  জড়ো করে খাদিজার রাগে গনগনে মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে আছে।   বড় মাপের ব্লাউজ ঢলঢল করছে। বাঁদিকে ঝুলে আছে বলে নরম শরীরের অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। বুক উঠেছে কি উঠেনি। কিন্তু  কয়েকটা নখের আঁচড় লাল হয়ে জমে আছে।  শুয়োরের বাচ্চা হুজুর মেয়েটাকে ছাড়েনি কামড়াতে খামচাতে। হাত পা শক্ত হয়ে যায়  খাদিজার।  হারামির বাচ্চা মেয়েটার সাথে শোয় নাই ত?  
                বইখাতা রাখে দে ওইখানে। অনির্দেশ্য এক জায়গা দেখিয়ে  দেয় খাদিজা।  মেয়েটা বইখাতা সালাম করে কপালে ছুঁইয়ে চুমু খায়। তারপর বিছানার  উপর পরম যত্ন করে রেখে  খাদিজার সামনেই শাড়ি  ব্লাউজ খুলে ঝটপট জামা প্যান্ট পরে শাড়িটা কোনরকমে ভাঁজ করে  তাকিয়ে থাকে। কি করে যেন বুঝে যায় এ সংসারে খাদিজাই শেষ কথা। লাল হলুদ জামায় কি ফুটফুটে  লাগছে ছোট্ট মেয়েটাকে। বুকটা দুলে উঠে খাদিজার। মায়া লাগে। আহারে এইটুকু মেয়েকে এই বুড়োভামের সাথে  কি করে এর বাপ মা বিয়ে দিলো!
               তোর বাপ নাই? জামার ঝুল টানতে  টানতে বিউটি জানায় , আছে। তয় ঠ্যাং ভাঙ্গি দুবচ্ছর ধরি পড়ি আছে ঘরে । খাদিজার রাগ  নেমে আসে, কি করত? ঠেলা  চালাত।  আমার আম্মা এখন চাতালে ধান  শুকানির কাজ করি সংসার চালাতিছে। ছোড একটা ভাই আছে। থিরিতে  পড়ে। আমি সিক্সি। হুজুর আব্বারে কলো আমারে ইশকুলি পড়াবিনি।  খাতি দিবিনি। থাকতি দিবিনি। ইট্টু আগে সেই তো এহানে দিয়ে গেছে ।   বুকের  কাছে  হাত  জড়ো করে যেন পড়া দিচ্ছে মেয়েটা। খাদিজার মন  একটু নরম হয়, তাই তোরে অই বুড়োর সাথি বে’ দে দেলো তোর বাপ মা? হ, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ে মেয়েটা, হুজুর আব্বার পা সারাতি কুড়ি   হাজার টাকাও দেছে। আম্মা কানতিছিল। আম্মারেও দেছে পাঁচ হাজার টাকা । তয় আব্বা কইছে পা সারলি  এই  বিয়ে ভাঙ্গি  আমারে ফের নে যাবিনি বাসায়।   
                 কুলকুল করে  বিদ্রূপের হাসি উঠে মিলিয়ে যায় খাদিজার মুখ থেকে। এবার আসল কথা জিগ্যেস করে , হুজুর তোরে কিছু কইরছে? এইগুলো  কিসের দাগ?  বিউটির চোখে পানি চলে আসে এবার।  এক হাতে চোখ  মুছে কান্না থামাতে মুখ নিচু করে। ধড়াস ধড়াস করে উঠে খাদিজার বুক। মনে হচ্ছে ওকেও যেন হিষ্টিরিয়া রোগে ধরে ফেলেছে । মনে মনে কাঁপতে কাঁপতে জিগ্যেস করে, শুইছে নাকি তোর সাথি ? বিউটি কেঁদে ফেলে, হুজুর  খুব খারাপ লোক আম্মা। আমার আব্বা আম্মারে টাকা  দিয়ি ঘরের বার যাতি কয়ে আমার বুকে  হাত দেছে। আমার সাথি খারাপ কাজ করিছে। এবার খাদিজাও বসে পড়ে। বিনবিন করে উঠে ওর মাথা।  মনে হচ্ছে এখুনি জবাই করে ফেলে হুজুরের বাচ্চাকে। ও কি খাড়া বটি হাতে মসজিদে চলে যাবে ? এক কোপে বুড়ো শয়তানের জান বের করে দিতে পারলে শান্তি লাগত মনে। কত বড় শয়তানের শয়তান মেয়ের বয়সি মেয়েটাকেও ছাড়েনি!  
                আম্মা কিছু  খাতি দেবেন? খিদে লাগিচ্ছে খুব। ঘরের মেঝেতে বইখাতার পাশে বসা ছোট মেয়েটাকে দেখে বড় মায়া হয় খাদিজার। মুখটা যেন কতকালের চেনা। সম্পর্কের সুতোটাকে ধরতে না  পেরে আম্মা করে ডেকে যাচ্ছে। অভাব মেয়েটাকে সাহসী করে তুলেছে।  ভাত নয়, পুতুল খেলা নয় পড়াশুনার উপর মেয়েটার ইচ্ছাকে পুঁজি করে হুজুর বিয়ের খেলাটা খেলেছে। বিয়ে কি সত্যি করেছে নাকি গেল বারের মত বিয়ের  মিথ্যে খেলা খেলে গরীবের মেয়েটাকে ভাগিয়ে  এনেছে? মেয়েটাকে কিছু খেতে দিয়ে জেনে নিতে হবে ভাল করে।    
                 জোবেদা বেগম আঁতকে উঠে । তুই কি পাগল হলি খোদে? ও  আমি পারব না। আমার অত সাহস নাই। বড় ছেলে মেজো ছেলেও ধরে বসে। তারাও খাদিজার সাথে। মেজ ছেলে গলা তোলে, আম্মা এই  জীবনে কখনো কি কোনোদিন একখান ভাল কাম করিছেন আপনি? মেজো  ছেলের রাগে  গনগনে মুখ দেখে জোবেদা বেগম লজ্জা পায়। বড় ছেলে বরাবর চুপচাপ। সেও ফুঁসছে । বাপের কীর্তিতে দু ছেলেই ক্ষিপ্ত। আট বছর আগে খাদিজাকে বিয়ে করার সময় ছোট ছিল ছেলেরা। তখন মায়ের কান্না দেখেছে আর বাপের ভয়ে আট ন বছরের বড় খাদিজাকে আম্মা বলে মেনে নিয়েছে ওরা। এখন কুড়ি বাইশ বছরের যুবক। তেজি, বিরক্ত। মার চেয়ে প্রতিবাদী খাদিজার সাথে ওদের ভাব  বেশি।  খাদিজার বুদ্ধিতেই  দু ছেলে কলেজে পড়ছে আবার দোকানেও  কাজ করছে। তিন বছর আগে একবার এক ইমামের মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলে ধরা খেয়েছিল নূরে মুতাসিম। সেবার খাদিজার বাপ ভাই জানতে পেরে শাসিয়ে বলে গেছিল  ফের বিয়ের কথা জানতে পারলে জেলে ভরে দেবে হুজুরকে। এবার কি করে কে জানে। তিনি গরীব ঘরের  মেয়ে। বাপ ভাই থাকা না থাকা সমান কথা। কোনদিন রাগ করে বাপ ভাইয়ের বাড়ি  যাওয়ার কথা চিন্তাও করেনি। আবার উৎসব পার্বণে বা বিপদ আপদে  বাপভাইদের ডাকার সাহসও তার ছিলনা। ছেলেরা তার অসহায় অবস্থা জেনেও এরকম কথা শুনাচ্ছে। অভিমান হয় তার। ওরা কি বোঝে না, তার স্বামী লম্পট বলে তিনি একটুকুও সুখে নেই?      
                  খাদিজা ধমক দেয়, চুপ কর ত তোরা। আপা আপনি না করলি আমিই কোরবানি । আমার আর সহ্য হতিছে না হুজুরের কাম কাজ।  জোবেদা বেগম মনে করিয়ে দেয় সালমার কথা। বাপ জেলে গেছে  শুনলে কি সালমার ভাল বিয়ে  হবে কখনো ? এইবার খাদিজা ক্ষেপে উঠে , আপা সালমা পড়াশুনা করবি, চাকরি করবি আপনি কি এরকম কথা কখনো ভাবতি পারেন না? খালি বিয়েই করতি হবে এই কথা কে  বোঝাচ্ছে আপনাকে ? পড়াশুনা করি চাকরি করলি আমাগের সালমার জন্যি লাইন লাগি যাবেনে পাত্রদের।  আরিফ শরীফ তোরা  যা। সময়  হলি আমিই তোগের ডাকবানি। বড় ছেলে রাগে কথা বলতে পারে না তেমন। কেবল বলে যায় ছোটআম্মা এবার কিছুতেই আর ছাড়ান  দেওয়া যাবিনা কলাম। শাস্তি দিতিই হবি।   
                  যে যার কাজের জায়গায় চলে যায় ওরা। খাদিজা বিউটিকে নিজের ঘরে রেখেছে। রোজ সকাল দুপুর সন্ধ্যায় মেয়েটা পড়তে বসে। ওর দেখাদেখি সালমাও পড়ে। টুকটাক কাজও করে খাদিজার পেছন ঘুরে ঘুরে।  দু একজন পড়শি জানতে চেয়েছে, কে রে খাদিজা? ভাগ্নি বলে চালিয়ে দিয়েছে সে। বিউটিকে শিখিয়ে দিয়েছে বিয়ের কথা কাউকে বলবিনা। তোর কোন  বিয়ে হয়নি তা জানিস? হুজুর তোরে  কোরবানির ছাগলের মত  কিনি আনিছে বুঝলি। ভয়ে বিউটি খাদিজার হাত জড়িয়ে ধরে, আম্মা আমারে কি হুজুর জবো করবেনে নাকি? খাদিজা বলতে চায়, তুই ত জবো হয়ে গিছিস রে মানিক । আর কি জবো করবিনে তোরে!
                   বিউটির মার সাথে দেখা করে এসেছে খাদিজা। বড়  ছন্নছাড়া অবস্থা। উপায় না দেখেই হুজুরের কথায় রাজী হয়ে গেছে বিউটির বাপ। টাকা ছাড়া চিকিতসাও করতে পারছে না। এক ছটাক  জায়গায় বসতবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নাই। গরীবের বাপ ভাইরাও গরীব হয়। স্বপ্নগুলোও থাকে ছেঁড়াফাটা টুটাফুটা। কিন্তু বিউটির বাপ মার স্বপ্ন  ছিল। নিয়তি সেই স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছে। বিয়ের কাগজ দেখতে  চেয়েছিল খাদিজা। কোন কাগজ নাই।  সাক্ষী নাই। একাই বিয়ে করেছে মুখে মুখে কলেমা বলে। খাদিজা বুঝিয়ে দেয়, এটা কোন বিয়েই হয়নি  মিয়া। হুজুর আসলে তোমার মেয়েকে কিনি নিছে। বিউটির আব্বা এখনো হাসপাতালে। খাদিজা দেখা করে বলে এসেছে ওরে হারামখোর বাপ তোরে আমি  জেলে দেব। বাল্য বিয়ে নিষেধ তুই জানিস না? কান্নারত বাবা মায়ের হাতে আরো পাঁচ হাজার টাকা ধরে দিয়ে খাদিজা বলেছে, বিউটিকে দত্তক নিলাম। মেয়া এখন আমার। মনে রাখিস  কথাটা।    
                 আজ চারদিন হয়ে গেছে মুতাসিম নূরে হাফেজি  জোবেদা বেগমের কাছে আসেনা। মসজিদেই আছে । খাচ্ছে মানুষের দেওয়া খাবার। আগের মতই আরামে আছে সে। কিন্তু  রাতে ঘুম হচ্ছে না  কিছুতে। তার  হাতের মুঠোয় লেগে আছে কচি বুকের কাঁচা ঘ্রাণ। সেদিন কি যে হল।  মেয়েটাকে ভাল করে বাগে পেলো না সে। আছাড়ি পাছাড়ি করে চেঁচাতে লাগল মেয়েটা। বাল্য বিবাহ নিষেধ । তিনি নিজেই এই ব্যাপারে সরকারের প্রতিনিধি। গ্রামে গঞ্জে, বিভিন্ন মিলাদ, মাহফিল, আলাপ আলোচনা  দাওয়াতে, জুম্মার নামাজের খুতবায় বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে তিনিই প্রচারের কাজ করেন। সেই তিনি মাত্র বারো বছরের মেয়েকে  বিয়ে করেছেন জানলে কেস খেয়ে জেলে যাবেন এটা নিশ্চিত। তাছাড়া বিয়ে ত তিনি করেন নাই। ধর্মের কথা বলে গরীবদের ঠকানো খুব সোজা। ভাগ্যিস এই বিয়ে বিয়ে খেলার কোন দলিল তিনি করেন নাই। মুখে মুখেই চুক্তি  হয়েছে, মেয়েটা বালেগ হলে তার  ইচ্ছায় সব হবে। এই  ক বছর তিনি মেয়েটাকে পড়াবেন। খাওয়াবেন। থাকতে দিবেন। তার ছেলেরা বাইরে  থাকে। বড়বউ মাটির মানুষ । দু একটা আদর সোহাগে  না মানলে একটু কড়া পাকের ধমক ধামকে ভয়  পেয়ে যাবে বড় বউ জোবেদা বেগম।   
                ভয়টা হল খাদিজাকে নিয়ে। খাদিজা বড় অশান্ত মেয়েছেলে।  সন্তানহীনা। সুস্বাস্থ্যবতী হলে কি হবে খাদিজা তার ধারে কাছে  মুতাসিমকে যেতে  দেয় না। খাদিজাকে দেখলে তার সব ইচ্ছা মাথায় উঠে নাচতে থাকে। পাগল পাগল লাগে। বেহেশতি দণ্ডটা তরোয়ালের মত শক্ত হয়ে উঠে। অনেক ঘুরে অনেক খরচ করে খাদিজার আগের স্বামীকে দিয়ে তালাক করিয়ে তবে তিনি বিয়ে করেছেন খাদিজাকে।                  


                    সারোয়ার কি সহজে রাজী হয়েছে তালাক দিতে! গুণে গুনে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছে সে হারামির বাচ্চা। মসজিদের ফান্ড থেকে চুরি করে টাকা দিয়েছে মুতাসিম। দুটো দিরহামও আছে সে টাকার মধ্যে। অথচ সেই বিয়ের রাতে বাসর ঘরে সোহাগ করতে গেলে খাদিজা ব্লেড দেখিয়ে বলেছিল,হুজুরের বাচ্চা হুজুর আর যদি কোনদিন আমার কাছে আসিস তো ফাঁক করে দেব তোর মেশিন।তোর সব শয়তানি জানি আমি। লোকলজ্জার ভয়ে তালাক দিতে পারে না। ভয়ও পায়। খাদিজার       বাপ ভাইরা বড় বড় মসজিদের ইমাম । কিন্তু কি করে সে ? বয়স যত  বাড়ছে শরীরের ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে লাগাম ছেঁড়া গতিতে। তাওয়াফের কাছেও যেতে পারে না সে। শরীয়তের খেলাপে আটকা। তাই জৈবিক  চাহিদা মেটাতে রাতের অন্ধকারে ছুটে আসে পুরনো বউ জোবেদা বেগমের কাছে।
                    জোবেদা যথেষ্ট  সুন্দরী । যতভাবে পারে তাকে খুশি করার চেষ্টা করে কিন্তু মুতাসিম হুজুরের মন ভরে না। ঢিলে ঢালা লাগে জোবেদার শরীর। সে খাদিজাকে কল্পনা করে জোবেদাতে উপগত হয়। তবু তৃষ্ণা থাকে। জ্বলে জ্বালায়। এই বাড়ির কোথাও কোনও ঘরে খাদিজা আছে একথা ভেবে সে আরো আগ্রাসী হয়ে উঠলে জোবেদা বেগম ঠেলে ফেলে দেয়, আপনি দেহি চৈতা কুকুরের লাহান হয়ি যাতিছেন। ছেলে মেয়ে বড় হয়ি উঠিছে আর আপনার নোলা বাড়িচ্ছে দিন কে দিন, সরেন--
                    বিউটি নামের মেয়েটার সাথে কোথায় যেন খাদিজার মিল  আছে। টরটর করে কথা বলে। তাছাড়া চোখের চাউনি, মুখের ছাদ, চাঁদ কপাল ঘিরে কোঁকড়া চুল, শরীরের গঠন অনেকটাই খাদিজার মত। আনকোরা মেয়ে পাওয়া যায় না এখন। মোবাইলের কারণে গ্রামে গঞ্জের ছেলেমেয়েরাও স্মার্ট হয়ে গেছে। সবাই পড়াশুনা করতে চায়। চাকরি করতে চায়। কোন মেয়ে বলে না সে বিয়ে করে সংসার সন্তান স্বামী সেবা করে থাকতে চায়। বিউটির বাপকে পানিপড়া ঝাড়ফুঁক দিয়ে সংসারের   হাল সব জেনে নিয়েই খেলাটা খেলেছিল নূরে মুতাসিম। ভেবেছিল  খাইয়ে পরিয়ে মোটাতাজা করে একটা বাচ্চা পেটে দিতে পারলে আর যাবে কই। খাদিজাকেও একটা শিক্ষা দেওয়া যাবে।  
                মেয়ে মানুষ বাড়ে লকলক করে। পুরুষের হাত পড়লে মেয়েমানুষের শরীর সার পায়। বারো তেরো বছর হলো মেয়েদের মোক্ষম সময়। এই সময় একটু ভাল খাবার পেলে মেয়ে শরীর নারী হয়ে  উঠে। সে মন স্থির করে আজ রাতেই সে জোবেদার কাছে যাবে। তারপর যে করে হোক মেয়েটাকে সে ভোগ করবেই। তার জন্যে জোবেদাকে যদি টাকা দিতে হয় ত দেবে। মসজিদের ফান্ড উপচে পড়ছে টাকায়। ব্যক্তিগতভাবে দেওয়া অনেক দান মুতাসিম রেজিস্ট্রি করে না। খোদার ঘরে দেওয়া দান নিয়ে কেউ হিসাবও চায় না। অতৃপ্ত লালসায় জ্বলে  পুড়ে তপ্ত হয়ে রাতের অপেক্ষা করে নূরে মুতাসিম হাফেজি।    
                 সাংবাদিক পুলিশে ভরে গেছে বাড়ি। জোবেদা বেগম ফিট যাচ্ছে ঘন ঘন। খাদিজা খাতুন জোবেদার সেবা করছে দুই মেয়ে সালমা বিউটিকে নিয়ে। আরিফ শরীফ হাসপাতালে। পুলিশ কখন মুতাসিমের লাশ ছাড়বে সে জন্যে বসে আছে। মসজিদে কোরআন শরীফ দোয়া দরুদ পড়া হচ্ছে। খাদিজার বাপ ভাইরা চলে এসেছে। সবাই মুতাসিমের এমন মৃত্যুতে অবাক হয়েছে। ব্রিজে খারাপ জিন আছে বলে অনেকে গল্প জুড়ে দিয়েছে। তারাই হুজুরকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছে এ ব্যাপারে সবাই মত দেয়। সামান্য সময়ের জন্যে জ্ঞান এসেছিল জোবেদা বেগমের। পুলিশের পোশাকের দিকে তাকিয়ে কানতে কানতে বলেছিল,  তিনি আল্লা বিল্লা মানুষ। তার শত্রু আল্লা, মিত্রও আল্লা। আল্লাই জানে সব।  
                 পুলিশ ঝামেলা করেনি। মুতাসিমের কবরও ঠিক হয়ে গেছে। বিকেলে বাসা ঘুরিয়ে লাশ নিয়ে গেছে মসজিদে। বাদ আসর জানাজা। প্রচুর লোক হয়েছে জানাজায়। খাদিজার বাপ ইমামতি করেছে। ভাইরা পুলিশদের খাতির করেছে নানাভাবে। আগামীকাল আবার আসবে বলে চলে গেছে বাপভাইরা। মসজিদ কমিটির মিটিং করতে হবে। কাকে দায়িত্ব দেওয়া  হবে মুতাসিমের জায়গায়। মুতাসিমের ছেলেরা মসজিদের দায়িত্ব নিতে চায় কিনা তা আগামীকাল জানাতে হবে। খাদিজা তিন দিনের সময় চেয়েছে। ছেলেরা এখন বিপর্যস্ত। ওদের মাও অসুস্থ। এর মধ্যে কি এত জরুরি কথা ভাবা যায়। আসলে আরিফ শরীফ বলে দিয়েছে তারা মসজিদের ইমামতি কিছুতেই করবে না। তারা চাকরি করবে।
                  অনেক রাতে জোবেদা বেগমের ভাল করে জ্ঞান আসে। পরিষ্কার চোখে তাকিয়ে দেখে তার দুই ছেলে মেঝেতে শুয়ে আছে । খাদিজা মাথার নীচে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মেয়েরা ঘুমাচ্ছে তার পায়ের কাছে। নাহ তার সংসার ঠিক আছে। খাদিজা যখন  আছে  তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোন চিন্তা নাই। কাল রাতে সহ্যের বাইরে জ্বালিয়েছে মুতাসিম । আগুন ধরে গেছিল শরীরে। বাধ্য হয়ে কথা দিতেই হয়েছিল বিউটিকে সে এনে দেবে। মুতাসিম বেরিয়ে যাওয়ার পরেই হঠাত মাথার জট খুলে যায়। সারা দুনিয়ার সাথে লড়ে খাদিজা যদি পারে তো সে কেন পারবে না? মেজ ছেলের কথাটা ধ্বক ধ্বক করে উঠে। সত্যি ত এই জানোয়ারটার সাথে শোয়া ছাড়া আর সে কি কাজ করেছে এই দুনিয়ার।
                 আরিফের আব্বা শুনিচ্ছেন? সাদা জোব্বা পরা  নূরে  মুতাসিমের দীর্ঘ দেহটা ঘুরে দাঁড়ায়,তুমি? ওইটুকু  কথাই বলতে পেরেছিল লোকটা। সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয় জোবেদা বেগম। ইচ্ছে ছিল নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়বে। ব্রিজের নিচে  মহব্বত কনট্রাকটরের জমানো লোহালক্কড়ের উপর একবার পড়লে আর রক্ষা নাই। কিন্তু কে যেন টেনে   ধরে। তারপর আর কিছু মনে নাই। সে  কি খাদিজাকে বলেছিল আমার ছেলেমেয়েদের দেখিস কিম্বা আমারে বাঁচা  কিছুই মনে করতে পারেনা জোবেদা। কেবল অজস্র কান্নায় ভাসতে ভাসতে সে শুনেছিল, আপা  আপনি কিছু করেন নাই। যা করার আল্লার ফেরেশতারা করিচ্ছে। তিনি আল্লা বিল্লা মানুষ ছিলেন। আমাদের মত কুচো মানুষের সাধ্য কি  তাকে  মারে।  আল্লার মাল আল্লাহ তার হেফাজতে নিয়ে গেছে।