
জোবেদা বেগম মাগরিবের অজু করতে নেমেছিল। উঠোনে কালো বোর্কায় মোড়া ছোট এক মেয়ে দেখে চমকে যায়, এই কে রে তুই ? এমন ভুতের মত ভর বিকেলে কেউ কারো বাসায় আসে ! এখুনি আজান দেবে। যা বাসায় যা। পরে আসিস । তিনি মনে করেন মেয়েটা তার মেয়ে সালমার ইশকুলের বান্ধবী হবে কেউ। কিন্তু মেয়েটা যায় না। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বোরকা খুলে ফেলে। একহাতে শাড়ি সামলে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে বারান্দায় উঠে বলে, বড় হুজুর আমারে এখানে থাকতি কইছে।
কোন হুজুর ? খাদিজা খানম মুতাসিম নূরে হাফেজির দ্বিতীয় বিবি তারের কাপড় তুলতে তুলতে জিগ্যেস করে। এবার মেয়েটা বড় বিবি মেজ বিবি দুজনকেই সালাম করে, আম্মা আমি বিউটি। বড় হুজুর আমারে আজকি দুপুরে বিয়ে করি এখানি নিয়ি আসিছি। ক্কি? মুতাসিম হুজুরের দুই বউই চেঁচিয়ে উঠে। বড় বউ জোবেদা বেগমের আবার হিস্টিরিয়া রোগ আছে। খাদিজা তাড়াতাড়ি বড় সতীনকে ধরে বারান্দার চকিতে বসিয়ে দেয়। জোবেদা বেগম কানতে গিয়েও খাদিজার ভয়ে দাঁত কপাট মেরে কান্না চাপিয়ে রাখে । খাদিজা বড় লেঠেল মেয়ে। কানতে দেখলে এমন ধমক দেবে যে তা ভাবা যায় না। বড় হুজুর নূরে মুতাসিম খাদিজার ভয়ে আজ আট বছর মসজিদে আস্তানা গেঁড়েছে । কোনো কোনো রাতে লুকিয়ে চুরিয়ে জোবেদা বেগমের ঘরে আসে। কিন্তু ফজরের আজানের আগেই পালিয়ে যায়। খাদিজা জানতে চাইলে তিনি ভয়ে সত্যি বলে দেন আর মুতাসিমের দেওয়া দু এক পাঁচশ টাকা খাদিজার হাতে দিয়ে দেন। খাদিজা সে টাকা থু থু করে ফেলে দিয়ে এমনভাবে তাকায় বড় বউয়ের মনে হয় সে পরপুরুষের সাথে শুয়ে টাকা এনেছে।
সংসার চালায় খাদিজা। তার পেটের দুই ছেলেও খুশি মনে খাদিজার হাতে সংসারের খরচ তুলে দেয়। মেয়ে সালমা খাদিজার কথায় মরে বাঁচে। কেবল তিনি এই সংসারের কান্নি ধরে কোনো রকমে টিকে আছেন। কোন কিছুতেই জোবেদা বেগম জোরে গলায় কিছু বলতে পারে না। খাদিজা বলে, আপা শোনেন আমার স্বামী যদি আমি ঘরে থাকতি আরেকটা বিয়ে করত তো কেস করে দিতাম। কেমন মেয়েমানুষ আপনি স্বামীকে ভাগ বাটোয়ারা করতি রাজি হতিছেন! আপনি কি চোক্ষে দা বটি কিছু দেখেন না? তাকে খুব ই যত্ন করে খাদিজা কিন্তু উঠতে বসতে যখন তখন ভীতু বলে গালিগালাজের তুফান বইয়ে দেয়। শুয়ে শুয়ে নিজের বুকের ধুকপুক শোনে জোবেদা বেগম। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। আল্লারে এই পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছর বয়সে আবার বিয়ে করল মানুষটা ? তাও অই টুকু এক আঙ্গুলে এক বাচ্চা মেয়েকে?
খাদিজা খাতুন বিউটিকে হ্যাঁচকা টানে তার ঘরে নিয়ে আসে। রাগের মাথায় ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে। আর অমনি ব্যাগ থেকে ঝপঝপ করে বেরিয়ে পড়ে কতগুলো বই খাতা কলম দুই তিনটে সস্তা জামা কাপড়। বিউটি ছুটে গিয়ে বইগুলো কুড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে । বয়েস কত তোর ? বারো । তয় আব্বা আর হুজুর কইছে সবাইরে আঠারো বলতি। আর একটু হলে শাড়িতে পা জড়িয়ে পড়ে যেত মেয়েটা। আম্মা আমি জামাপ্যান্ট পরি?
প্রচণ্ড রাগ নিয়ে খাদিজা এবার ভাল করে মেয়েটাকে দেখে। বড় সতিনের মেয়ে সালমার বয়েসি হবে। বাড়ন্ত শরীর। চাঁদ কপালের ডানদিকে একটা ঘূর্ণি। বুকের কাছে বই খাতার সাথে শাড়ির আঁচল জড়ো করে খাদিজার রাগে গনগনে মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে আছে। বড় মাপের ব্লাউজ ঢলঢল করছে। বাঁদিকে ঝুলে আছে বলে নরম শরীরের অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। বুক উঠেছে কি উঠেনি। কিন্তু কয়েকটা নখের আঁচড় লাল হয়ে জমে আছে। শুয়োরের বাচ্চা হুজুর মেয়েটাকে ছাড়েনি কামড়াতে খামচাতে। হাত পা শক্ত হয়ে যায় খাদিজার। হারামির বাচ্চা মেয়েটার সাথে শোয় নাই ত?
বইখাতা রাখে দে ওইখানে। অনির্দেশ্য এক জায়গা দেখিয়ে দেয় খাদিজা। মেয়েটা বইখাতা সালাম করে কপালে ছুঁইয়ে চুমু খায়। তারপর বিছানার উপর পরম যত্ন করে রেখে খাদিজার সামনেই শাড়ি ব্লাউজ খুলে ঝটপট জামা প্যান্ট পরে শাড়িটা কোনরকমে ভাঁজ করে তাকিয়ে থাকে। কি করে যেন বুঝে যায় এ সংসারে খাদিজাই শেষ কথা। লাল হলুদ জামায় কি ফুটফুটে লাগছে ছোট্ট মেয়েটাকে। বুকটা দুলে উঠে খাদিজার। মায়া লাগে। আহারে এইটুকু মেয়েকে এই বুড়োভামের সাথে কি করে এর বাপ মা বিয়ে দিলো!
তোর বাপ নাই? জামার ঝুল টানতে টানতে বিউটি জানায় , আছে। তয় ঠ্যাং ভাঙ্গি দুবচ্ছর ধরি পড়ি আছে ঘরে । খাদিজার রাগ নেমে আসে, কি করত? ঠেলা চালাত। আমার আম্মা এখন চাতালে ধান শুকানির কাজ করি সংসার চালাতিছে। ছোড একটা ভাই আছে। থিরিতে পড়ে। আমি সিক্সি। হুজুর আব্বারে কলো আমারে ইশকুলি পড়াবিনি। খাতি দিবিনি। থাকতি দিবিনি। ইট্টু আগে সেই তো এহানে দিয়ে গেছে । বুকের কাছে হাত জড়ো করে যেন পড়া দিচ্ছে মেয়েটা। খাদিজার মন একটু নরম হয়, তাই তোরে অই বুড়োর সাথি বে’ দে দেলো তোর বাপ মা? হ, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ে মেয়েটা, হুজুর আব্বার পা সারাতি কুড়ি হাজার টাকাও দেছে। আম্মা কানতিছিল। আম্মারেও দেছে পাঁচ হাজার টাকা । তয় আব্বা কইছে পা সারলি এই বিয়ে ভাঙ্গি আমারে ফের নে যাবিনি বাসায়।
কুলকুল করে বিদ্রূপের হাসি উঠে মিলিয়ে যায় খাদিজার মুখ থেকে। এবার আসল কথা জিগ্যেস করে , হুজুর তোরে কিছু কইরছে? এইগুলো কিসের দাগ? বিউটির চোখে পানি চলে আসে এবার। এক হাতে চোখ মুছে কান্না থামাতে মুখ নিচু করে। ধড়াস ধড়াস করে উঠে খাদিজার বুক। মনে হচ্ছে ওকেও যেন হিষ্টিরিয়া রোগে ধরে ফেলেছে । মনে মনে কাঁপতে কাঁপতে জিগ্যেস করে, শুইছে নাকি তোর সাথি ? বিউটি কেঁদে ফেলে, হুজুর খুব খারাপ লোক আম্মা। আমার আব্বা আম্মারে টাকা দিয়ি ঘরের বার যাতি কয়ে আমার বুকে হাত দেছে। আমার সাথি খারাপ কাজ করিছে। এবার খাদিজাও বসে পড়ে। বিনবিন করে উঠে ওর মাথা। মনে হচ্ছে এখুনি জবাই করে ফেলে হুজুরের বাচ্চাকে। ও কি খাড়া বটি হাতে মসজিদে চলে যাবে ? এক কোপে বুড়ো শয়তানের জান বের করে দিতে পারলে শান্তি লাগত মনে। কত বড় শয়তানের শয়তান মেয়ের বয়সি মেয়েটাকেও ছাড়েনি!
আম্মা কিছু খাতি দেবেন? খিদে লাগিচ্ছে খুব। ঘরের মেঝেতে বইখাতার পাশে বসা ছোট মেয়েটাকে দেখে বড় মায়া হয় খাদিজার। মুখটা যেন কতকালের চেনা। সম্পর্কের সুতোটাকে ধরতে না পেরে আম্মা করে ডেকে যাচ্ছে। অভাব মেয়েটাকে সাহসী করে তুলেছে। ভাত নয়, পুতুল খেলা নয় পড়াশুনার উপর মেয়েটার ইচ্ছাকে পুঁজি করে হুজুর বিয়ের খেলাটা খেলেছে। বিয়ে কি সত্যি করেছে নাকি গেল বারের মত বিয়ের মিথ্যে খেলা খেলে গরীবের মেয়েটাকে ভাগিয়ে এনেছে? মেয়েটাকে কিছু খেতে দিয়ে জেনে নিতে হবে ভাল করে।
জোবেদা বেগম আঁতকে উঠে । তুই কি পাগল হলি খোদে? ও আমি পারব না। আমার অত সাহস নাই। বড় ছেলে মেজো ছেলেও ধরে বসে। তারাও খাদিজার সাথে। মেজ ছেলে গলা তোলে, আম্মা এই জীবনে কখনো কি কোনোদিন একখান ভাল কাম করিছেন আপনি? মেজো ছেলের রাগে গনগনে মুখ দেখে জোবেদা বেগম লজ্জা পায়। বড় ছেলে বরাবর চুপচাপ। সেও ফুঁসছে । বাপের কীর্তিতে দু ছেলেই ক্ষিপ্ত। আট বছর আগে খাদিজাকে বিয়ে করার সময় ছোট ছিল ছেলেরা। তখন মায়ের কান্না দেখেছে আর বাপের ভয়ে আট ন বছরের বড় খাদিজাকে আম্মা বলে মেনে নিয়েছে ওরা। এখন কুড়ি বাইশ বছরের যুবক। তেজি, বিরক্ত। মার চেয়ে প্রতিবাদী খাদিজার সাথে ওদের ভাব বেশি। খাদিজার বুদ্ধিতেই দু ছেলে কলেজে পড়ছে আবার দোকানেও কাজ করছে। তিন বছর আগে একবার এক ইমামের মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলে ধরা খেয়েছিল নূরে মুতাসিম। সেবার খাদিজার বাপ ভাই জানতে পেরে শাসিয়ে বলে গেছিল ফের বিয়ের কথা জানতে পারলে জেলে ভরে দেবে হুজুরকে। এবার কি করে কে জানে। তিনি গরীব ঘরের মেয়ে। বাপ ভাই থাকা না থাকা সমান কথা। কোনদিন রাগ করে বাপ ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার কথা চিন্তাও করেনি। আবার উৎসব পার্বণে বা বিপদ আপদে বাপভাইদের ডাকার সাহসও তার ছিলনা। ছেলেরা তার অসহায় অবস্থা জেনেও এরকম কথা শুনাচ্ছে। অভিমান হয় তার। ওরা কি বোঝে না, তার স্বামী লম্পট বলে তিনি একটুকুও সুখে নেই?
খাদিজা ধমক দেয়, চুপ কর ত তোরা। আপা আপনি না করলি আমিই কোরবানি । আমার আর সহ্য হতিছে না হুজুরের কাম কাজ। জোবেদা বেগম মনে করিয়ে দেয় সালমার কথা। বাপ জেলে গেছে শুনলে কি সালমার ভাল বিয়ে হবে কখনো ? এইবার খাদিজা ক্ষেপে উঠে , আপা সালমা পড়াশুনা করবি, চাকরি করবি আপনি কি এরকম কথা কখনো ভাবতি পারেন না? খালি বিয়েই করতি হবে এই কথা কে বোঝাচ্ছে আপনাকে ? পড়াশুনা করি চাকরি করলি আমাগের সালমার জন্যি লাইন লাগি যাবেনে পাত্রদের। আরিফ শরীফ তোরা যা। সময় হলি আমিই তোগের ডাকবানি। বড় ছেলে রাগে কথা বলতে পারে না তেমন। কেবল বলে যায় ছোটআম্মা এবার কিছুতেই আর ছাড়ান দেওয়া যাবিনা কলাম। শাস্তি দিতিই হবি।
যে যার কাজের জায়গায় চলে যায় ওরা। খাদিজা বিউটিকে নিজের ঘরে রেখেছে। রোজ সকাল দুপুর সন্ধ্যায় মেয়েটা পড়তে বসে। ওর দেখাদেখি সালমাও পড়ে। টুকটাক কাজও করে খাদিজার পেছন ঘুরে ঘুরে। দু একজন পড়শি জানতে চেয়েছে, কে রে খাদিজা? ভাগ্নি বলে চালিয়ে দিয়েছে সে। বিউটিকে শিখিয়ে দিয়েছে বিয়ের কথা কাউকে বলবিনা। তোর কোন বিয়ে হয়নি তা জানিস? হুজুর তোরে কোরবানির ছাগলের মত কিনি আনিছে বুঝলি। ভয়ে বিউটি খাদিজার হাত জড়িয়ে ধরে, আম্মা আমারে কি হুজুর জবো করবেনে নাকি? খাদিজা বলতে চায়, তুই ত জবো হয়ে গিছিস রে মানিক । আর কি জবো করবিনে তোরে!
বিউটির মার সাথে দেখা করে এসেছে খাদিজা। বড় ছন্নছাড়া অবস্থা। উপায় না দেখেই হুজুরের কথায় রাজী হয়ে গেছে বিউটির বাপ। টাকা ছাড়া চিকিতসাও করতে পারছে না। এক ছটাক জায়গায় বসতবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নাই। গরীবের বাপ ভাইরাও গরীব হয়। স্বপ্নগুলোও থাকে ছেঁড়াফাটা টুটাফুটা। কিন্তু বিউটির বাপ মার স্বপ্ন ছিল। নিয়তি সেই স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছে। বিয়ের কাগজ দেখতে চেয়েছিল খাদিজা। কোন কাগজ নাই। সাক্ষী নাই। একাই বিয়ে করেছে মুখে মুখে কলেমা বলে। খাদিজা বুঝিয়ে দেয়, এটা কোন বিয়েই হয়নি মিয়া। হুজুর আসলে তোমার মেয়েকে কিনি নিছে। বিউটির আব্বা এখনো হাসপাতালে। খাদিজা দেখা করে বলে এসেছে ওরে হারামখোর বাপ তোরে আমি জেলে দেব। বাল্য বিয়ে নিষেধ তুই জানিস না? কান্নারত বাবা মায়ের হাতে আরো পাঁচ হাজার টাকা ধরে দিয়ে খাদিজা বলেছে, বিউটিকে দত্তক নিলাম। মেয়া এখন আমার। মনে রাখিস কথাটা।
আজ চারদিন হয়ে গেছে মুতাসিম নূরে হাফেজি জোবেদা বেগমের কাছে আসেনা। মসজিদেই আছে । খাচ্ছে মানুষের দেওয়া খাবার। আগের মতই আরামে আছে সে। কিন্তু রাতে ঘুম হচ্ছে না কিছুতে। তার হাতের মুঠোয় লেগে আছে কচি বুকের কাঁচা ঘ্রাণ। সেদিন কি যে হল। মেয়েটাকে ভাল করে বাগে পেলো না সে। আছাড়ি পাছাড়ি করে চেঁচাতে লাগল মেয়েটা। বাল্য বিবাহ নিষেধ । তিনি নিজেই এই ব্যাপারে সরকারের প্রতিনিধি। গ্রামে গঞ্জে, বিভিন্ন মিলাদ, মাহফিল, আলাপ আলোচনা দাওয়াতে, জুম্মার নামাজের খুতবায় বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে তিনিই প্রচারের কাজ করেন। সেই তিনি মাত্র বারো বছরের মেয়েকে বিয়ে করেছেন জানলে কেস খেয়ে জেলে যাবেন এটা নিশ্চিত। তাছাড়া বিয়ে ত তিনি করেন নাই। ধর্মের কথা বলে গরীবদের ঠকানো খুব সোজা। ভাগ্যিস এই বিয়ে বিয়ে খেলার কোন দলিল তিনি করেন নাই। মুখে মুখেই চুক্তি হয়েছে, মেয়েটা বালেগ হলে তার ইচ্ছায় সব হবে। এই ক বছর তিনি মেয়েটাকে পড়াবেন। খাওয়াবেন। থাকতে দিবেন। তার ছেলেরা বাইরে থাকে। বড়বউ মাটির মানুষ । দু একটা আদর সোহাগে না মানলে একটু কড়া পাকের ধমক ধামকে ভয় পেয়ে যাবে বড় বউ জোবেদা বেগম।
ভয়টা হল খাদিজাকে নিয়ে। খাদিজা বড় অশান্ত মেয়েছেলে। সন্তানহীনা। সুস্বাস্থ্যবতী হলে কি হবে খাদিজা তার ধারে কাছে মুতাসিমকে যেতে দেয় না। খাদিজাকে দেখলে তার সব ইচ্ছা মাথায় উঠে নাচতে থাকে। পাগল পাগল লাগে। বেহেশতি দণ্ডটা তরোয়ালের মত শক্ত হয়ে উঠে। অনেক ঘুরে অনেক খরচ করে খাদিজার আগের স্বামীকে দিয়ে তালাক করিয়ে তবে তিনি বিয়ে করেছেন খাদিজাকে।
সারোয়ার কি সহজে রাজী হয়েছে তালাক দিতে! গুণে গুনে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছে সে হারামির বাচ্চা। মসজিদের ফান্ড থেকে চুরি করে টাকা দিয়েছে মুতাসিম। দুটো দিরহামও আছে সে টাকার মধ্যে। অথচ সেই বিয়ের রাতে বাসর ঘরে সোহাগ করতে গেলে খাদিজা ব্লেড দেখিয়ে বলেছিল,হুজুরের বাচ্চা হুজুর আর যদি কোনদিন আমার কাছে আসিস তো ফাঁক করে দেব তোর মেশিন।তোর সব শয়তানি জানি আমি। লোকলজ্জার ভয়ে তালাক দিতে পারে না। ভয়ও পায়। খাদিজার বাপ ভাইরা বড় বড় মসজিদের ইমাম । কিন্তু কি করে সে ? বয়স যত বাড়ছে শরীরের ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে লাগাম ছেঁড়া গতিতে। তাওয়াফের কাছেও যেতে পারে না সে। শরীয়তের খেলাপে আটকা। তাই জৈবিক চাহিদা মেটাতে রাতের অন্ধকারে ছুটে আসে পুরনো বউ জোবেদা বেগমের কাছে।
জোবেদা যথেষ্ট সুন্দরী । যতভাবে পারে তাকে খুশি করার চেষ্টা করে কিন্তু মুতাসিম হুজুরের মন ভরে না। ঢিলে ঢালা লাগে জোবেদার শরীর। সে খাদিজাকে কল্পনা করে জোবেদাতে উপগত হয়। তবু তৃষ্ণা থাকে। জ্বলে জ্বালায়। এই বাড়ির কোথাও কোনও ঘরে খাদিজা আছে একথা ভেবে সে আরো আগ্রাসী হয়ে উঠলে জোবেদা বেগম ঠেলে ফেলে দেয়, আপনি দেহি চৈতা কুকুরের লাহান হয়ি যাতিছেন। ছেলে মেয়ে বড় হয়ি উঠিছে আর আপনার নোলা বাড়িচ্ছে দিন কে দিন, সরেন--
বিউটি নামের মেয়েটার সাথে কোথায় যেন খাদিজার মিল আছে। টরটর করে কথা বলে। তাছাড়া চোখের চাউনি, মুখের ছাদ, চাঁদ কপাল ঘিরে কোঁকড়া চুল, শরীরের গঠন অনেকটাই খাদিজার মত। আনকোরা মেয়ে পাওয়া যায় না এখন। মোবাইলের কারণে গ্রামে গঞ্জের ছেলেমেয়েরাও স্মার্ট হয়ে গেছে। সবাই পড়াশুনা করতে চায়। চাকরি করতে চায়। কোন মেয়ে বলে না সে বিয়ে করে সংসার সন্তান স্বামী সেবা করে থাকতে চায়। বিউটির বাপকে পানিপড়া ঝাড়ফুঁক দিয়ে সংসারের হাল সব জেনে নিয়েই খেলাটা খেলেছিল নূরে মুতাসিম। ভেবেছিল খাইয়ে পরিয়ে মোটাতাজা করে একটা বাচ্চা পেটে দিতে পারলে আর যাবে কই। খাদিজাকেও একটা শিক্ষা দেওয়া যাবে।
মেয়ে মানুষ বাড়ে লকলক করে। পুরুষের হাত পড়লে মেয়েমানুষের শরীর সার পায়। বারো তেরো বছর হলো মেয়েদের মোক্ষম সময়। এই সময় একটু ভাল খাবার পেলে মেয়ে শরীর নারী হয়ে উঠে। সে মন স্থির করে আজ রাতেই সে জোবেদার কাছে যাবে। তারপর যে করে হোক মেয়েটাকে সে ভোগ করবেই। তার জন্যে জোবেদাকে যদি টাকা দিতে হয় ত দেবে। মসজিদের ফান্ড উপচে পড়ছে টাকায়। ব্যক্তিগতভাবে দেওয়া অনেক দান মুতাসিম রেজিস্ট্রি করে না। খোদার ঘরে দেওয়া দান নিয়ে কেউ হিসাবও চায় না। অতৃপ্ত লালসায় জ্বলে পুড়ে তপ্ত হয়ে রাতের অপেক্ষা করে নূরে মুতাসিম হাফেজি।
সাংবাদিক পুলিশে ভরে গেছে বাড়ি। জোবেদা বেগম ফিট যাচ্ছে ঘন ঘন। খাদিজা খাতুন জোবেদার সেবা করছে দুই মেয়ে সালমা বিউটিকে নিয়ে। আরিফ শরীফ হাসপাতালে। পুলিশ কখন মুতাসিমের লাশ ছাড়বে সে জন্যে বসে আছে। মসজিদে কোরআন শরীফ দোয়া দরুদ পড়া হচ্ছে। খাদিজার বাপ ভাইরা চলে এসেছে। সবাই মুতাসিমের এমন মৃত্যুতে অবাক হয়েছে। ব্রিজে খারাপ জিন আছে বলে অনেকে গল্প জুড়ে দিয়েছে। তারাই হুজুরকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছে এ ব্যাপারে সবাই মত দেয়। সামান্য সময়ের জন্যে জ্ঞান এসেছিল জোবেদা বেগমের। পুলিশের পোশাকের দিকে তাকিয়ে কানতে কানতে বলেছিল, তিনি আল্লা বিল্লা মানুষ। তার শত্রু আল্লা, মিত্রও আল্লা। আল্লাই জানে সব।
পুলিশ ঝামেলা করেনি। মুতাসিমের কবরও ঠিক হয়ে গেছে। বিকেলে বাসা ঘুরিয়ে লাশ নিয়ে গেছে মসজিদে। বাদ আসর জানাজা। প্রচুর লোক হয়েছে জানাজায়। খাদিজার বাপ ইমামতি করেছে। ভাইরা পুলিশদের খাতির করেছে নানাভাবে। আগামীকাল আবার আসবে বলে চলে গেছে বাপভাইরা। মসজিদ কমিটির মিটিং করতে হবে। কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে মুতাসিমের জায়গায়। মুতাসিমের ছেলেরা মসজিদের দায়িত্ব নিতে চায় কিনা তা আগামীকাল জানাতে হবে। খাদিজা তিন দিনের সময় চেয়েছে। ছেলেরা এখন বিপর্যস্ত। ওদের মাও অসুস্থ। এর মধ্যে কি এত জরুরি কথা ভাবা যায়। আসলে আরিফ শরীফ বলে দিয়েছে তারা মসজিদের ইমামতি কিছুতেই করবে না। তারা চাকরি করবে।
অনেক রাতে জোবেদা বেগমের ভাল করে জ্ঞান আসে। পরিষ্কার চোখে তাকিয়ে দেখে তার দুই ছেলে মেঝেতে শুয়ে আছে । খাদিজা মাথার নীচে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মেয়েরা ঘুমাচ্ছে তার পায়ের কাছে। নাহ তার সংসার ঠিক আছে। খাদিজা যখন আছে তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোন চিন্তা নাই। কাল রাতে সহ্যের বাইরে জ্বালিয়েছে মুতাসিম । আগুন ধরে গেছিল শরীরে। বাধ্য হয়ে কথা দিতেই হয়েছিল বিউটিকে সে এনে দেবে। মুতাসিম বেরিয়ে যাওয়ার পরেই হঠাত মাথার জট খুলে যায়। সারা দুনিয়ার সাথে লড়ে খাদিজা যদি পারে তো সে কেন পারবে না? মেজ ছেলের কথাটা ধ্বক ধ্বক করে উঠে। সত্যি ত এই জানোয়ারটার সাথে শোয়া ছাড়া আর সে কি কাজ করেছে এই দুনিয়ার।
আরিফের আব্বা শুনিচ্ছেন? সাদা জোব্বা পরা নূরে মুতাসিমের দীর্ঘ দেহটা ঘুরে দাঁড়ায়,তুমি? ওইটুকু কথাই বলতে পেরেছিল লোকটা। সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয় জোবেদা বেগম। ইচ্ছে ছিল নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়বে। ব্রিজের নিচে মহব্বত কনট্রাকটরের জমানো লোহালক্কড়ের উপর একবার পড়লে আর রক্ষা নাই। কিন্তু কে যেন টেনে ধরে। তারপর আর কিছু মনে নাই। সে কি খাদিজাকে বলেছিল আমার ছেলেমেয়েদের দেখিস কিম্বা আমারে বাঁচা কিছুই মনে করতে পারেনা জোবেদা। কেবল অজস্র কান্নায় ভাসতে ভাসতে সে শুনেছিল, আপা আপনি কিছু করেন নাই। যা করার আল্লার ফেরেশতারা করিচ্ছে। তিনি আল্লা বিল্লা মানুষ ছিলেন। আমাদের মত কুচো মানুষের সাধ্য কি তাকে মারে। আল্লার মাল আল্লাহ তার হেফাজতে নিয়ে গেছে।