ফরহাদ হোসেন খান এর কবিতা

বিষাক্ত দর্শনের পরিণতি 
                                                       
ঘড়ির কাটার মতো ঘুরেফিরে আসে
চেনা মানুষের মুখ লাখো মানুষের ভিড়ে আচমকা
হলুদ খামটা সূর্যাস্তের চিঠি নিয়ে দিনে দিনে
এনেছে রঙের অন্তহীন খেলা ডাকপিয়নের এই ঠিকানায়
অনেক বছর দেখা হয়নি যাদের সাথে
পাওয়া যেতে তাদের সাক্ষাত কোনো একদিন তবু
তোমাকে দেখার ভয়ে খেয়ালের চোখে লাগিয়েছি তাই  চির অবনত র্দা
কাঁঠালের মতো নুয়ে পড়ে থাকে চোখদুটো
চলার মাটির দিকে অপলক
তোমাকে যখনি দেখব হঠাৎ আমি
তখন ছড়ানো-ছিটানো আধারে ভিড় করবে মাছের ঝাঁক
মানবীর গন্ধে গন্ধময় হয়ে যাবে অন্তরের সমস্ত বাগানবাড়ি,
সেই গন্ধে মুছে যাবে হয়তো সেবার
আলোর কলম দিয়ে লেখা কষ্টার্জিত সুখ
নয়নের মণি চাই না দেখতে আর
হারানো প্রিয়ার অন্তর্ভেদী হলুদ খামের মতো পরিষ্কার মুখখানা
আমি জানি, রূপসীর স্তিমিতনেত্রের মাঝে ডুবে ডুবে
কোটি কোটি যুবকের দল মারা গেছে অনন্ত লগন
তাই আমার চোখের মণি
চোখ রাখে চিরচেনা এই শহরের রাস্তার চরণে,
রাস্তায় কখনো চোখ তুলে তাকাইনি,
চোখ তুলতেই যদি তুমি চোখে পড় শুধু সেই ভয়ে,
তুমি চোখে পড়া মানে
সিডরের অনিশ্চিত ধাক্কায় নিহত হবে সুখের সন্তান
আমি চাই না কখনো
হঠাৎ তোমার সাথে আমার আবার দেখা হোক,
তোমাকে দেখবে যখন চশমাপরা চোখজোড়া
চোখের বাড়িতে জ্বলবে তখন অনাকাঙ্ক্ষিত অনল
তাই তোমাকে দেখার অপ্রস্তুত ভয়ে
আমি দ্রুতবেগে হেটে চলি কোনোকিছু না দেখার ছলে প্রতিবার
প্রতিটি রাস্তার প্রতিটি কদমে অসতর্কতাবশত
আমি রাখতে চাই না চোখ হাজার চোখের ভিড়ে,
যদি সেই চোখের মিছিলে বিজয়ীর বেশে তুমি হেটে যাও মলমলে উত্তরীয় গায়ে দিয়ে
তাহলে আমি যে আবার মারা যাব প্রতিরাতে,
হিংস্র আঘাতের চাপে টুকরোটুকরো হয়ে যাবে
অন্তরের ড্রেসিং টেবিলে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা অমলিন কাঁচের সোনালি গ্লাস,
হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে দুঃখরাশি
যে পথেই হাটি সে কথাই ভাবি রাত থেকে দিন
দিন থেকে রাত বারবার,
দেখা হলে শোকের মিছিলে লাশ হবে আমার হৃদয়দেহ,
বাসা বাঁধবে নানান বিষাক্ত পোকামাকড়
দেখা হলে হলে কোনো বিষাক্ত দর্শনে
ছিঁড়ে যাবে জীবনাকাশের উড়ে চলা লাল ঘুড়ি
সিজদার মতো অবনত চোখে
আমি তাই আমার চোখকে সারাদিন স্থির করে রাখি তোমার না থাকাজুড়ে
তোমাকে দেখলে আবার নিজেকে
ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ করে দেব আমি, তা  নিশ্চিত
সেই রূপের পারিকুটিনে আর জ্বলতে চাই না আমি,
তাই তুমি অদেখার জ্বালা হয়ে যেন বেঁচে থাকো চিরকাল

জান্নাতনন্দিনী খুলে দেখেনি

প্রত্যাখ্যাত চিঠি নিয়ে ফিরে এলো সাদা কবুতর,
বক্ষে তার জমে আছে একফোঁটা দীর্ঘশ্বাস
জান্নাতনন্দিনী খুলে দেখেনি চিঠির অন্তরালে থাকা প্রেম,
পড়েনি সোনালি খামে আঁটা রূপালি বেদনা
স্বপ্নমুখর আকাশে মেঘ করেছে অনল্প আঁধারের জন্মদান করে,
তারপর বৃষ্টি এসে সৃষ্টি করলো বিধ্বংসী বন্যা,
বন্যাকবলিত এলাকায় ডুবে গেল একটি অনাথ শিশু,
শিশুহারা মায়ের পবিত্র কান্নায় আমিও সেখানে শরীক ছিলাম
নির্দোষ লোককে আসামীর কাঠগড়ায় বসিয়ে
উকিলটা হুট করে চম্পট মারলো,
শুধু ন্যায়বিচারের দাবি নিতে গিয়ে
সে অজান্তে ফেসে গেল,
রাগিণী নির্মিত কারাগারের আঁধার ভুবনে নীরবে ভিড় জমালো আজন্ম পাপ নামে প্রেম
চাঁদের আলোয় গাছের পাতারা সারারাত স্নান করেছিল অগণিত রাত,
স্মৃতির রাত্রিরা ডুবে গেল শেষরাতের চাঁদের সাথে
ছায়াবীথি রাস্তা কেঁদে কেঁদে  দিশেহারা হলো,
যেখানে এখন ছায়া নেই,বীথি নেই,নেই অপার্থিব সু
সেখানে কেবল পড়ে আছে ধরণীর তাজা তাজা লাশ,
পড়ে আছে আমাদের জীবনের জমে থাকা সবটুকু ভালোবাসা,

সবটুকু স্মৃতি,সবটুকু পাগলামি, সবটুকু মায়া

এতটুকু চাইনি কখনো

প্রয়োজন ফুরিয়েছে, ফুরিয়েছে বেঁচে থাকার অনন্ত স্বাদ,
আবার অন্তরে পচা রক্ত জমতে আরম্ভ হয়েছে নিঃশব্দে
সুখের জানালা দিয়ে লম্বা হাত নিয়ে ঢুকে গেল কষ্টবৃষ্টি,
তুমুল বৃষ্টির সমীরণে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ভরসার চিলেকোঠা
অস্থিতিশীল বাংলার নীলিমায়আমি হাটি, আমি বাঁচি,
আমি বসবাস করি মধ্যবিত্ত রক্তে
জেনে রেখো,খুব করে জেনে রেখো, প্রিয়তমা,
আমি আর বেঁচে নেই এই পৃথিবীর বুকে,
আমার দেহটা হয়তো পৃথিবী প্রতিদিন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে,
আমার অন্তরদেহ সেই কবে মরে মিশে আছে মৃত্তিকার সাথে
শুকনো কাঠের মতো অহর্নিশি জ্বলতে জ্বলতে
আমি ভস্ম হয়ে পড়ে আছি ছাই হয়ে
আর ছাইয়ের মতো উড়ে উড়ে আমি গিয়েছি বায়ুমণ্ডলে,
তারপর, বহুদিন কেটে গেল,
কেটে গেল  খণ্ড খণ্ড  মেঘলার বহুরাত,
এরপর ঝরঝর করে ঝরে গেল অবিরাম বাদলের ধারা
গর্ভবতী রমণীর মতো মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে
আমি কোটি কোটি  চিরকাল পার করে জন্ম দিয়েছি সুখের শিশু,
ডাকাতরা ডাকাতি করলো তাকে,
কেউ কেউ গলাটিপে হত্যা করেছে গোপন ক্ষোভে,
কেউ কেউ জাহেলিয়াতের মতো জীবন্ত কবর দিল
বস্তাপচা ভালোবাসা বলে গালি দিল অনেকেই,
ন্যাকামির উপাধিতে ভরে গেল আমার জীবন,
তবু সর্বনাশ গ্রহণ করেছি সর্ব আশা বুকে বেঁধে
এতটুকু চাইনি কখনো যতটুকু তাবৎ মানব চাই,
চেয়েছি একটু সুখ, চেয়েছি সামান্য ছোঁয়া,
তাও পলায়ন করে বেড়ায় সারাটাক্ষণ

বিভ্রম দুয়ারে দাঁড়িয়ে

জানালার বাইরে
আসমানি রঙের দেয়ালটাকে
আকাশ মনে করেছিলাম,
আমি জানতে পারলাম
আমার মনে হওয়াটা ভুল ছিল

কেউ বই পড়তে আসেনি

এক অনাবিল পাঠাগার আছে এ পাড়ায়,
এখানে কখনো কেউ বই পড়তে আসেনি,
সেই জন্মলগ্ন থেকে বন্ধ হয়ে আছে,
দরজাজানালা খোলা নেই,
নেই কারো আনাগোনা,
অনন্ত অবহেলায় বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে ধূলো জমে গেছে,
উইপোকা খেয়ে গেছে বইয়ের বহু পাতা,
কিছুকিছু ছিঁড়ে গেছে অগোচরে।
তুমুল তুফান এসে প্রায় ভূলুণ্ঠিত করেছে এ পুঁথিশালা,
কুঁজো হয়ে যাওয়া থুরথুরে বুড়ির মতন সীমাহীন শতক দাঁড়িয়ে আছে।
রোদে পুড়ে ঝলসে চলছে ভেতরের অবারিত গলি,
প্রবল বর্ষণে ভিজে একাকার হয়ে গেছে অমূল্য পুঁথির মালা।
সকলে কেবল দেখে দেখে চলে গেল,
কেউ ঠিকঠাক করে দিতে আসেনি এখানে,
কেউ ঘরে ঢুকে পড়তে আসেনি সোনার খনির মতো বইপত্র।

SHARE THIS

Author: