কবির হোসেন এর দশটি কবিতা

''এখন আমি কাঁদতে গেলে কোথাও যেনো ছেঁৎ ছেঁৎ ভয়ানক শব্দ শুনতে পাই''

রাজবংশ

রাজবংশ এবং প্রাসাদের সাথে,উত্তরাধিকারসূত্রে আমি একটা বন্দুক পেয়েছি । এই বন্দুকে রয়েছে রাজবংশের শিকারের তাবৎ বীরত্ব ।এটা অত্যন্ত পুলকের বিষয় যে ,আমার পূর্বপুরুষগণ অবসরও কাটাতেন বীরত্ব প্রদর্শনে । এই বন্দুকটা এখন প্রাসাদের দেওয়ালে ঝুলানো-যার পাশেই রয়েছে হরিণের শুকনো খোলস আর শিং ।বনের হরিণ আর পাখির হরেক গল্প আছে এই বন্দুকে -যার ট্রিগার চেপে আমার বাবা একেকটা গল্প বলতেন এবং বন আর হরিণ সংকটে তাঁর শিকারহীনতার আফসোস ঝাড়তেন ।হরিণের শুকনো খোলস আর শিং দেখিয়ে বলি,তবে কী নিরীহ শিকারে ছিলো রাজাদের প্রভূত বীরত্ব ?যদিও জানি,পৃথিবীর যাবতীয় শান্তি চুক্তি ছিলো হিংস্রে হিংস্রে । আপাত,দেয়ালে হিংস্র কোনো প্রাণীর খোলস অথবা কোনো নিশানা রাজবংশীয় বীরত্বের পরিচায়ক ।

-শুনে মা মৃদু হাসেন আর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন পাশের দেয়ালে-যেখানে আমার পূর্বপুরুষদের পোর্ট্রেইট ক্রমানুসারে ।

অকৃতজ্ঞ

পৃথিবীর প্রতি আমার কোনো প্রেম নেই,আকর্ষণ নেই ।আমার প্রতি পৃথিবীর ব্যাপক । আমি যেকোনো মুহূর্তে উড়ে যেতে পারতাম, ফানুসের মতো,ওজোনস্তর টপকিয়ে চলে যেতে পারতাম ওপারে-যেখানে শৈত্য এবং অন্ধকারে মিশে আছে মৃতরা । পৃথিবী আমাকে বুকে আগলে রাখে পরম আদরে- প্রেমে,আকর্ষণে ।

আমার প্রতি পৃথিবীর ক্যানো এই প্রেম,আকর্ষণ ?- আমি জানি না । তবে জানি,সদ্যপ্রসূত এই আমি দু'হাত খিচে পৃথিবীকে ব্যাপক  খিস্তি মেরেছিলাম । দু'পা তড়িৎ প্রসারিত করে ব্যর্থ লাথি মেরেছিলাম তার মুখ বরাবর । আমার হেঁটে চলা পায়ের সহিংস ঘৃণা আর খিস্তি-খেঁউড় শ্রাবণে সে আজো স্যাঁতস্যাঁতে এক পুরাকীর্তি জলাভূমি । ( যদিও তার সমূদয় রাগ,গোস্যা,ক্ষোভ,অভিমান ঝেরে যাচ্ছে ফুজিয়ামায় )

এতদসত্বেও,সে বরাবরের মতো আমার প্রতি অকৃপণ স্রষ্টা । কি বেঁচে থাকা অথবা মৃত্যু-তার প্রসারিত ঐ ঈশ্বরীয় উদার বুকে ।

অথচ যখনই আমি তার এই মহিমান্বিত গুণে গুণমুগ্ধ এবং কৃতজ্ঞতায় জেগে ওঠি উদার হাত নিয়ে,তখনি আমার মনে পরে,পা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাথা দিয়ে হাঁটার বিদ্যাটা শিখা হয় নি কখনো ।

শুদ্ধতম প্রেমিক

আই এক্সট্রিমলি হেইট সাম্রাজ্যবাদ।সাম্রাজ্যবাদের মায়রে চুদতে গেলে দেশপ্রেম ধর্ষিতা হয়।যেহেতু দেশপ্রেমের জ্যৈষ্ঠ পুত্রের নাম সাম্রাজ্যবাদ।আমি দেশপ্রেম মানি না।দেশপ্রেমের চোখে কাঁটাতারের ওপারের মানুষকে পোশাক বলে গালি দিতে পারি না।তাই বলে ভাববেন না আমি মানবপ্রেমী।আমি মানবপ্রেম মানি না।মানবপ্রেমের কুত্তার দাঁত দিয়া আমি পশুপাখি কড়মড় করে খেতে পারি না।আমি পশুপ্রেমী না-গোত্র,জাত,ধর্ম,বর্ণপ্রেমীও না।

মূলত,প্রেম নিয়ে সমস্ত বিভাজনই  নীরব সাম্প্রদায়িক ঘাতক।এসমস্ত বিভাজন নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখে বিপরীতদের নীরব অত্যাচার বা ধ্বংসের কারণ।যদিও উক্ত স্ব স্ব প্রেমের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এমন বিভাজন।-আমি এসব মানি না।

শুধু মানি-আমি একজন শুদ্ধতম প্রেমিক।

ককপিট

ঘুড়ি,সুতো কাটার তর্কে নাটাইয়ের সাথে দ্বন্ধ বাঁধিওনা।দ্যাখো,তোমার স্ট্যাশনে কণ্টকাকীর্ণ স্ক্যাফোল্ড সাজিয়ে রেখেছে গাছ।আবর্জনায় হাত তুলে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে মাছের কাঁটা।মেঘ দেখে তোমার মনে যে লোভ,আকাঙ্ক্ষা-সমুদ্রের বুকে কান পেতে শুনতে পারো বৃষ্টির আর্তনাদ।কোকিলের গান তর্জমা করে দ্যাখো,কতগুলো হৃদয় পোড়ার আগুনে চিমনি দিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে বিরহী অন্ধকার।যে পথটা হেঁটে গেছে দিগন্তে,গোধূলিতে তাকিয়ে দ্যাখো,কি নৃশংস আত্মহত্যায় ভেসে গেছে রক্তে।

দ্যাখো,রাত এবং দিনের মারদাঙ্গা যুদ্ধটা নিয়েও ঝোনাকিটা কি সুন্দর উড়ে বেড়াচ্ছে জঙ্গলে।

মাছ এবং আমার আত্মজীবনী

গহীন জলে মাছদের সাঁতার কাটা দেখলেই আমার শ্বাস ফেলতে খুব কষ্ট হয় । যেনো আমিই জলের চাপে সাঁতার কাটছি বাধ্য হয়ে ।আর আমার দিকে খুব ধ্যান করে গহীনে তাকালে মনে হয়,দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়াটা এক ভয়ানক পদ্ধতি।

একদা,নদীর পাড়ে বসে স্বাভাবিক শ্বাস ফেলতে যেয়ে কতোগুলো মাছ ধরে ফেলি ।শ্বাসকষ্ট থেকে বেঁচে যাওয়ার পর আমার তখন মনেই হয় নি, আমার বেঁচে থাকাটা মাছদের মৃত্যুর উপর ।আর সেটার প্রমাণ পাই মায়ের মাছ কুটার দৃশ্যে আমার ক্ষুধা বৃদ্ধির কারণে । মা যখন প্রমাণ সাইজের কালো কড়াইয়ে মাছ ভাজেন-মাছ ভাজার এই ছেঁৎ ছেঁৎ শব্দে আমি গভীর রাতে আচমকা জেগে ওঠি ত্রাসে । বারান্দায় যাই আর উদাসে আকাশের দিকে তাকাই । দেখি,বিশাল সাইজের এক কড়াইয়ে অজস্র তারা ইলিশ ভাজা হচ্ছে,কতগুলো নাভিশ্বাসে নাকানি চুবানি খাচ্ছে-যেনো উল্টে-পাল্টে চই চই করে ভাজা হচ্ছে নিজেদের চোখের জলে।

-এখন আমি কাঁদতে গেলে কোথাও যেনো ছেঁৎ ছেঁৎ ভয়ানক শব্দ শুনতে পাই।

ভয়ংকর দৃশ্য

পৃথিবীর সর্ব নিকৃষ্ট ভয়ংকর দৃশ্য কী?-ভাবতে গেলে দ্বিধায় পড়ে যাই।কন্যার সামনে মায়ের ধর্ষণ দৃশ্য নাকি মায়ের সামনে কন্যার ?আবার ভাবি, কন্যার ধর্ষণ দৃশ্য দেখা বাবার নেতিয়ে পড়া শিশ্ন অথবা মায়ের ধর্ষণ দৃশ্য দেখা পুত্রের নেতিয়ে যাওয়া শিশ্নের সামনে আসা প্রতিটা যোনিতে ভয়ংকরের পরিমাণ কতোটুকু ?

মনে পড়ে, রাজনৈতিক আগুন লাগা একমাত্র পুত্রকে কেনো বাবা বংশের ঐতিহ্যবাহী বন্দুক দিয়ে গুলি করেছিলেন।গনিমতের মালে বিধর্মী স্ত্রী আর বাচ্চা মেয়েকে দেখে ধার্মিক পিতা কেনো বিষ খেয়ে নরকবাসী হয়েছিলেন সেদিন ।আহা!! তাই বলে ধর্ষিতার নিকট লিপস্টিকটাও ভয়ংকর হয়ে ওঠবে!

ভাবি,পৃথিবীতে এতো এতো ভয়ংকর দৃশ্য আছে যে,সেরাটা খুঁজে পাওয়ার আগেই আমার মৃত্যুটাও ভয়ংকর হয়ে ওঠতে পারে।

সেদিন  এক শিক্ষক বন্ধু জানালো,পৃথিবী সেরা নিকৃষ্ট ভয়ংকর দৃশ্য তো বিদ্যালয়ের পাঠদান-যেখানে মানুষকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়!

ইজরাইল

আমার বড়ো দুর্ভাগ্য,আমি ইজরাইল হয়ে জন্মাই নি।তাই কচুরিপানার দাড়ি দিয়ে তলদেশে নোঙর ফেলার চাপা ব্যর্থ আশা নিয়ে চলতে থাকি,চলতে হয়-উদ্দেশ্যে গন্তব্যহীন।মাকড়শা জালের হিংস্র থাবা বালিতে এঁকে শান্ত হই।থোকা থোকা স্বল্প জনমানবের পথে এক পায়ে হাঁটি,হাঁটতে হয়।রাতে ঘুমানোর আগে প্র্যাকটিস করি-ডান পায়ের বৃদ্ধাঙুলি দিয়ে হাঁটার সময় কীভাবে ভারসাম্য রাখতে হয়।শুয়ে ইজরাইলকে রোমন্থন করি।প্যালেস্টাইনে ইজরাইলের নোঙর ফেলা,নোঙরের অক্টোপাস হয়ে ওঠার রোমহর্ষক রোমন্থন-আমার রিলাক্সেন।জানি-পৃথিবীটা কেবলই অক্টোপাসের জন্য,বাকিদের জন্য বিবর্তনের উল্টো ধারা।

ইজরায়েল হয়ে জন্মানোর সৌভাগ্যটা আমার হয় নি,তাই আজ কবি।

যদিও জানি-এদেশে প্রতিমুহূর্তে মধ্যবিত্ত ঘরে ঘরে নিম্নবিত্ত কবি জন্মায়।

অবহেলিত সত্য:আমার বাস্তবতা

কে যেনো একটা শ্যামবর্ণীয় মুখোশ ফেলে গেছে সমুদ্রে।সমুদ্রের বৈশিষ্ট্য হলো-উদার উদরে মৃত কাউকে আশ্রয় না দেওয়া-জলদুধের পুষ্টি আর সবুজের সজীবতায় পোষ্যতা না দেওয়া।হয়-অন্ধকার নভোমণ্ডলের চাঁদকে বিনামূল্যে নিলামে তোলার মতো পৃষ্ঠে তুলে ধরবে, বুভুক্ষুতায় হতাশাগ্রস্ত লম্বা দৃষ্টি আর জিভের লোকমায়,পাখি শ্রেণীর বাজারে।নয়তো-চিত্রশিল্পীর 'অসহ্য"কে ক্যানভাসে সেঁটে দেওয়ার মতো সাজিয়ে রাখবে তীরে,কুকুর শ্রেণির বাজারে।এই মুহূর্তে কুকুর শ্রেণি বৃত্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অখাদ্য এই মুখোশকে বিন্দুতে ফেলে।বিন্দুর মুখোশটিকে কু-দৃশ্য বলে তাদের ভ্রম হয়,সটকে পড়ে ধীরে ধীরে।

সমুদ্র দর্শনে আসা কেতাদুরস্ত আমি দূর থেকে দেখি।কোনো এক আত্মিক টানে মুখোশের কাছে গিয়ে দেখি-একি! এ যে আমারই মুখচ্ছবি-যাকে যৌবনকালে রক্তসমেত উপড়ে ফেলেছিলাম বেঁচে থাকার তাগিদে!!

চাকা

আমার যদি একটা বাইক থাকতো-খেদিয়ে দিতে পারতাম বাল্যকালের বাই-সাইকেল না থাকার সেই খেদটা।ঘুমের ঘরে সাইকেলের ঘন্টার ক্রিং ক্রিং হেডেকটা পুড়িয়ে দিতে পারতাম সাইলেন্সারের মুখে।বাল্যকালের স্বপ্ন পোড়ার মধ্য দিয়ে,এ কালে হয়ে ওঠতে পারতাম বীর প্রতাপ সিং।জানি-আমার বাইক কেনার সামর্থ্য নাই।এই অসামর্থ্য স্বপ্নের বেদনা বয়ে যেতে হবে দীর্ঘকাল।যখন বাইক কেনার সামর্থ্য হবে-জানি,প্রয়োজনবোধ থাকবে প্রাইভেট কারের।প্রাইভেট কার যুগে হয়তো হুইল চেয়ারের!স্বপ্ন এভাবে আকাশ ছোঁয়ার মতই নৈকট্য এবং দূরত্ব বজায় চলে প্রতারণার হৃদয়ে।

-দেখছি,চাকার স্বপ্নের উপর ভর করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি চাকার গতিতেই!!

ল্যাম্প পোস্ট

পরাগায়নের জন্য,রাতের যে ফুল ফুটে থাকে সাদা রং নিয়ে এই আধারে,মূলত,তার হৃদয়ে রয়েছে কীট-পতঙ্গকে আকৃষ্ট করার এক উদ্দীপ্ত কামনা।তুমি কাকে আকৃষ্ট করার জন্য রাতে ফুটা ফুলের সাদা রং নিয়ে ফুটে আছো এই ঘন অন্ধকারে?আকাশ থেকে তুমুল বৃষ্টির মতো অন্ধকার নেমে এলে,মস্তক অবনত করে আলো দিয়ে যাচ্ছো যে পথিকের কদমে,দেখো,তোমাকে ভুলে কার যেনো হাত ধরে সে হেঁটে যাচ্ছে আপন গন্তব্যে।কণ্ঠের আজন্ম মরিচা দূর করতে,সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছো যে পথকে,তোমার সাথে গল্প করার তার সময় কোথায়?-দেখো,সেও হেঁটে গেছে পথিকের পায়ের গতিতে,সাথে সাথে।
তোমার পায়ে এককালীন  গজানো লোহার শিকড়, অন্ধকারে নত মাথা ফুটে ওঠা-তোমার বেঁচে থাকা
কেউ যদি তোমাকে বলে,দেখো,কতোগুলো পাখির দলগত পারফর্মেন্সে সৃষ্ট ধনুক উড়ে যাচ্ছে হর্ষ ধ্বনিতে,পিছনে সাদা মেঘের প্রতিকৃতি-হরিণের স্বাধীন বিচরণ পুরো আকাশ জুড়ে।পার্শ্ববর্তী ছাদে জোড়া কবুতর ময়ূরের পেখম মেলে চুমু খাচ্ছে প্রবল প্রেমে"-জেনো ,তোমার এসব দেখা তে আছে হাওয়ার গন্দম স্পর্শের ভয়াবহ নিষেধাজ্ঞা।

যদি লোভের সোৎসাহে ঘাড় সোজা করে প্রাণ জুড়াতে যাও একবার- এসব সৌন্দর্যে-জেনে রেখো,তোমার ঘাড় মটকে মৃত্যুর দায় রাষ্ট্র কখনো নিবে না।

এই পৃথিবীর,রাষ্ট্রের সমূদয় আলো শ্রদ্ধেয়,সম্মানিত মাদারচোদদের জন্য,তোমার জন্য অন্ধকার ।


SHARE THIS

Author: