কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
দীর্ঘ কবিতা • পানিকাউর • হাসান রোবায়েত

দীর্ঘ কবিতা • পানিকাউর • হাসান রোবায়েত






কোথাও অন্ধকার ছুড়ে দেয়
আলকাতরার বহু লীন স্মৃতি, দূরে চিমনির পোড়া নীল, ক্রমার্দ্র ধোঁয়া
ঘুমন্ত বয়লার ঘিরে কালো পোকা
বয়ে যাচ্ছে শরীর, রাত্রির লাশ—বাষ্পের মিথ
তার তামাটে চোখের ভেতর জ্বালায় হু হু গরাদের ফাঁকা সুর

এমন সময়, হে পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
বৃষ্টির রাতে
ছায়া-বিদ্যুতে, ঘনলীন তির, শীর্ষে ইলেকট্রনে
বসে থাকো—যেন ইয়াজুজ-মাজুজের সুষুম্না চিরে
এই নদী, খাল, স্ফটিক পানির যত উন্মূল চক্রাবর্ত
ফিরে ফিরে আসে
অনন্ত হাওয়া-বিচ্ছুরিত যে স্বেদ
পাক খায়, দোলে
সেখানে গভীর তারাম-লি আলোর অশ্রু ধরে থাক থাক
রাতের-সোপান পেরিয়ে নামছে এই চরাচরে, তারই তীক্ষ্ণ চূড়াটিতে তুমি
দৈবনখরে ধরে আছো আলো—
দেখছো, পাশার সারি সারি খেত
মানুষের ঘুমে ঢুকে মহিষেরা উড়িয়েছে ধুলা
গানের লুপ্ত সুর তারা খুঁজে খুঁজে হয়রান—
নম্র পাথর ও পাখি, তোমার কালো হর্মের ভেতর বাজছে
অনাদিকালের উনুনের বীথি
ডুবোনৌকার মোনামুনিবন
এমন গভীর তামাটে রাতের সৌর-অন্ধকারে
শুনেছো পানোখি—
শুয়োর...মাদার চোদ বলে বলে কয়েকটা চোর
উন্মাদ খোর
যাচ্ছে কোথায়
ক্রুর শঠতায়
বিস্মরণের এই ফোঁটা ফোঁটা ভিজে বৃষ্টিতে—

নোনতা দুপুর, গাধার সঙ্গে ফিরে আসা তারা
বাস ড্রাইভার—
শনি-রবি-সোম
ভেসে যায় মল, ফাঁপা কন্ডোম
ফিরে ফিরে আসে, পাক খায় আর
এই কানা বুধ, শুক্রের বার—
এমন সময়, ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
ভিজে ভিজে একা
দাঁড়িয়ে থেকেছো নদীখালবিলে
সূর্যের শত রশ্মি বিফলে
উরু ফাঁক করে ঢুকিয়ে নিয়েছে
শ্রান্ত সন্ধ্যা যেন কবেকার
ঢেকে দিছে গেছে গোধূলির হেম
সব ডুবে যাবে—
শীলিভূত হয়ে জীবাশ্মে, গানে
ওই দূর দূর
চক্রাবর্তে যেখানে বসন্তেরা শুয়ে আছে
নৌকায় খাঁড়িপাড়ে
বিকালের পুঁজ, ঝকঝকে খুঁত, মায়া-শ্লেষ-হাহাকার
আব্বার ভাঙা সাইকেলে বসা পেছনের ক্যারিয়ার—
তবু হে পানোখি
তোমার রয়েছে দিগন্ত উড়বার—
এখানে পচন, কূট মিথ্যা ও বীজানুর অধিকারে
রাত্রি ফুরিয়ে যাচ্ছে বাদামী ভেড়াদের অধিকারে
ফোঁপা কান্নায়, তামাকারবারি, জাতিয়তাবাদী এবং অশোক
গাছটার ডালে
বেওয়ারিশ কেউ, কয়েকটা চোর, লাশ-ব্যবসায়ী
প্রত্যেকে একা
করছিল পান তারার আরক
ছোট ছোট ঢেউ
ঢেউয়ের উপর আলোছায়াময় রাত
মাদী কুকুরের যৌন সে ঘ্রাণ
অন্ধকারের ডাক—
‘এই শাউয়ার চাঁদে এত ফাঁক!’

কী যেন বলছে গভীর আয়েশে বাতাসের দিকে চেয়ে

এমন সময়, ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
জানো, এ রাতের অবিশ্রান্ত করোটিতে
আমাদের দেখা হবে না কখনো—

সেই বিস্কুট ফ্যাক্টিরি থেকে বৃষ্টির দিনে আসতেছে ঘ্রাণ
অথবা জোছনা পিছে পিছে রাতে
হয়েছে সঙ্গী, কুশারের বন
আব্বা রয়েছে
আর ছোট বোন
আমরা নৌকা তুলেছি ডুবানো
আমাদের ছিল ভুখা পেট, গানও
গেয়েছি সে রাতে, ওপারে মাঝির ডাক নাম গেছি ভুলে
‘আর কতদূর’ বলে ছোট বোন
আব্বা তখন
নৌকার ঘ্রাণ
ছোট সে বোনটি ভাটিয়ালি গান
বহুদূর পথ হেঁটে গেছি ঝরা ধানখেত দিয়ে দূরে
আমাকে ডাকছে মাটিডালিপথ
সাবানের কারখানা—
তুমি হে পানোখি রাতের ডিভানে
আর ফিরে আনিয়ো না
সেইসব নাচ, ডুমুরের সারি, আপাত বিষাদ

ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—

ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
উড়ে যাও দূরে
যেখানে চাকা হিংসা-বলয়ে ঘুরতেছে ক্রমাগত

জন্মদিনের শুভেচ্ছা সহ হাফিজ রশিদ খান এর কয়েকটি কবিতা

জন্মদিনের শুভেচ্ছা সহ হাফিজ রশিদ খান এর কয়েকটি কবিতা







হাফিজ রশিদ খান
জন্ম : ২৩ জুন ১৯৬১, চট্টগ্রাম।


বিগত শতকের আশির দশক থেকে হাফিজ রশিদ খান বাংলা কবিতার অস্তিত্বে এক জায়মান সত্তা হিশেবে নিজের বিকাশ ঘটিয়েছেন। প্রায় তিন দশকের পথচলায় একটা নিজস্ব কবি ভাষার মিনার গড়ে তুলেছেন নীরবে নিভৃতে। নব্বই দশকের গোড়ার দিক থেকে কাব্যে ও গদ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিসমূহের তৃণমূল সংস্কৃতি ও জীবনাচারকে তার অনন্য ভাষিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করছেন সমান তালে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তার 'আদিবাসী কাব্য' বাংলাদেশে তাকে পরিচিতি দেয় আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকাররূপে। ভালবাসা-বেদনা-কষ্ট-বিরহ এইসব হৃদয়দ্রাবী অনুভূতি যে কারাে একার সম্পত্তি নয়, সেটা উন্মোচিত হওয়ার এই তো সময় যখন সমস্ত অপেক্ষা কিংবা সংগ্রাম পাশাপাশি জাগিয়ে রাখে এক জাগ্রত চেতনা। বাইরে থেকে দৃষ্টিপাতের বিলাসী ভূমিকায় না থেকে ভেতরের একজন হয়ে ওঠার স্বাক্ষর হাফিজ রশিদ খানের কবিতা।

আজ কবির জন্মদিনে জলফড়িং এ পড়া যাক কয়েকটি কবিতা।

সংখ্যাগুরুর ক্রোধ

ব্যক্তি আর সংস্থা কতো গেল শান্তির সড়ক
তবু কতো ক্ষুদ্রজাতি নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে
                                                  বুকে নিয়ে কষ্টের নরক

নাফ সীমান্তে রোহিঙ্গা মরে
                   পারমাণবিক আস্ফালনে পৃথিবীটা কাঁপে ডরে

বোমাভর্তি বিমানের কুণ্ডলিত আগুনের জিবে
                    তামিল গ্রামের ঘরে-ঘরে মানুষেরা গেছে নিবে

কুর্দিদের বাসভূমে
              সংখ্যাগুরুর ক্রোধের ধূমে
                    তরুণ কবির শরীর নিথর হয়ে যায়

শাস্তি, থাকে উহা কাহাদের জোব্বার কোনায়...


বাইরে সৌন্দর্য নাইরে

মুগ্ধ হবো বলে তাকিয়ে রয়েছি
                      শ্রীমুখের নন্দনকাননে

চোখ ফেরাবো না আর
                       পুড়িব ভিজিব ওই ঝাউবনে

গগনে-গগনে তুমিই আমার সন্ধ্যাতারা
                         লাল ঠোঁটের আঙিনাজুড়ে সুর
                                   তোলা আমপারা

এই সব দৃশ্যের বাইরে
                           আর কোনো সৌন্দর্য নাইরে...


তারাছার শাদাফুল

তারাছার পথে যারা যায় পাহাড় ডিঙোবে বলে
তাদের ভেতরে দুর্বার আলেকজান্ডারের
                                               অশ্বারোহী বেগ
জ্ঞানদীপ্ত মাহিয়ানের তেজস্বী বৌদ্ধমন
নির্ভীক খালিদ বিন ওয়ালিদের উজ্জ্বল
                                               নিকষিত হৃৎপিণ্ড
ঋষি অরবিন্দের গভীর মেজাজ প্রতিস্থাপিত
                                               প্রত্যেকের চালু করোটিতে

আসলে ওরা তো অলখপিপাসু সূর্যের সন্তান
                           পায়ের প্রবল চাপ পাথরের বুকে
                               ঝরনার স্বচ্ছজলে জীবনের শুদ্ধ তাপ
                                     ঘূর্ণি হাওয়া
উড়ে যাওয়া দিগ্বিবিক

ক্লান্তিহারা সামুরাই দল
                         পাহাড় পেরিয়ে
পাখিদের গান শুনতে-শুনতে এলো
                           জুমঘরে সন্ধ্যার বৈঠকে

ঝোপের সবুজ খোঁপা থেকে
                             শাদাফুল নিয়ে হাতে
                                    দাঁড়ায় সমুখে আদিবাসী নারী

আঁধার তাড়াতে যেনো শক্তিশালী আলোর পেখম...

ও ঝিরিজল মৎস্য দিয়ো

হৃদয় সলতে পাপড়ি মেলো
এখন আলো আসবে অমল হাতের ছোঁয়ায়
লুসাই পাড়ার তস্বী উঠোন
                                মাদুর পাতো
                                       আজকে শীতের
                                                ঠাণ্ডা আমেজ হাওয়ায়...

সেই মেয়েটা মৎস্যপ্রিয়
সন্ধ্যা হলে পিনোনভরা
                         ও ঝিরিজল
                                মৎস্য দিয়ো...

আমি এবং বন্ধু আমার
আরো অনেক টাটকা সখা
শিশির অবগাহন শেষে
খুঁজতে যাবো
বাতুল পথের ঝোপে-ঝোপে
                                লক্ষ-লক্ষ
                                       রাত্রিপোকা...

সকল যুবক-যুবতিগণ আয়ুষ্মতী দেশলাই জ্বেলো...
অ্যালেক্স সিরিজ ।। চঞ্চল মাহমুদ

অ্যালেক্স সিরিজ ।। চঞ্চল মাহমুদ






অ্যালেক্স, আমাদের যে-জীবনের উপর ইউরোপ দাঁড়িয়ে আছে সে-জীবনকে আমরা মৃত ঘোষণা করেছি। ওরা মরা মানুষের শরীরকে নাচের স্কুল ভেবে নাচ শিখছে…

উচ্চতা-বিষয়ক

এই অনুর্বর মাটিতে পাথরের চাষ করে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি অ্যালেক্স। দিন শেষ হয়ে এলে আমরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছি। দূর থেকে কেউ কেউ ভাবছে শুয়োরের খামার জেগে উঠেছে পৃথিবীতে। আমাদের সেইসব তরঙ্গ উৎপাদনের দিন হেঁটে গেছি পাহাড়-ঘেঁষা রাস্তা বেয়ে। আর নিয়মিত পাহাড় ধসে গেছে আমাদের উপর।
অ্যালেক্স, আমরা চাপা পড়ে গেছি উচ্চতার নিচে। 

কার্পেট

অ্যালেক্স, আমাদের চামড়া কার্পেট হয়ে গেছে;
মেদ বিছানো আছে তার নিচে।
সন্ধ্যার পরেও যে-রাজহাঁস ফিরতে পারেনি ঘরে,
সেই রাজহাঁস খুঁজবে মানুষ
আমাদের কার্পেটে হেঁটে …

অ্যালেক্স, তোর ক্ষুধার্ত দাঁত আমাকে রক্তাক্ত করে চলে

অ্যালেক্স, ক্ষুধার্ত বন্ধু আমার, চল ভাত ছিটিয়ে চলি। বেলাভূমিতে পড়ে-থাকা ঝিনুকের মতো ভাতের বদলে ধর্ম কুড়িয়ে আনি। সভ্যতার ভাঙন আমাদের দোরগোড়ায়। চল, ভেঙে যাই, জেগে উঠি অন্য কোথাও সভ্য হয়ে।

অ্যালেক্স, পেটে এক হাত রাখ, অন্য হাত কপালে; পেট আর কপাল কতদূর অ্যালেক্স? মিটারস্কেল আর কম্পাস রক্তাক্ত করে মাপি। ভাগ্যবদল হয় না দেখে জীবন প্রায়ই উঠে আসে চটের ব্যাগে। অন্ধকারে স্বেচ্ছানির্বাসিত হয়ে সভ্যতা পড়ে থাকে পার্কের বেঞ্চিতে।

জেগে ওঠ মানবতা, শুয়োরের বাচ্চার মতো কোলাহল করে। আমার বন্ধুর বিক্ষত হাত কাঁদছে, বিস্রস্ত চুল, ভুরুতে ঘাম, পায়ের কালশিটে নির্মম হয়ে উঠছে ক্ষুধায়, চিৎকার করছে আলজিভ; শুনতে পাসনি?

অ্যালেক্সের হাসিতে ডুবে যাচ্ছে ইউরোপ

মনে পড়ে তখন বিকেলই ছিল। চগোর ওপর দাঁড়িয়ে যতখানি উপরে ওঠা যায়, ঠিক ততখানি উপরে উঠে আমি ঘোষণা করেছিলাম ইউরোপ এখন রাতের উদ্যান। এখানে মানুষ নেই! মানুষের মতো দেখতে কতগুলো ক্যাকটাস আর কিছু বিষাক্ত ফুলে ভরে আছে এ উদ্যান।

ভূমধ্যসাগরের নিচে যে বালিচাপা পড়ে আছে, তারও নিচে চাপা পড়ে গেছে এ অঞ্চলের আদিম-মানুষ-সংস্করণ। আর এতখানি উপরে উঠে এসেও অ্যালেক্স ঘুমিয়ে আছে কবরে। দেখো, কবরও জোনাকির মতো উড়ছে। ও রাত, ও উদ্যান — এই শেষ আলো। দেখে নিতে পারো পথ!

হাসতে হাসতে আমার মেদ কেটে যায়। যে সভ্যতা ডুবে গেছে বালির নিচে, কতদূর পেরিয়ে অ্যালেক্স এসেছে কবরে শুতে! কতদূর পেরিয়ে অ্যালেক্স এসেছে জোনাকি হতে!
জাদুকর, জাদু দ্যাখ এবার —
অ্যালেক্স বিদ্রুপ করে যখন ঘুংরি হাসি দেয়, পাক খেতে খেতে ইউরোপ তলিয়ে যায় আরো একবার অ্যালেক্সের উচ্চতার সমান। অ্যালেক্স, যে-সংগীত কোনোদিনই শুনিনি, সে-সংগীত পাঠ করে চার্চের উঠোনে গড়াগড়ি খাব দু’জন। ঘাসের ভেতর থেকে মাথা জাগিয়ে বলব — আমরা দেখে ফেলেছি চার্চের উঠোনে তোমাদের ডুবে-যাওয়ার দৃশ্য।

পাল খাড়া করে দাও অ্যালেক্স

পৃথিবীর সব মধু খেয়ে অ্যালেক্স যে তীর খাড়া করে দিল বাতাসে, সেই ভাংদ-কে পাল বানিয়ে বয়ে যাচ্ছে সময়।
বোঝোনি নিকোশিয়া!
তোমার চোখে পাল বেঁধে অ্যালেক্স খুঁজেছে এশিয়া।

উর্বর ভূমিতে গানের মৌসুম শেষ হয় নি কখনো

অ্যালেক্স, আমার এখানে ক্ষুধার মৌসুম। আমিও ক্ষুধার্ত। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যার বুকে উঠে হাঁটি। ইদানীং অফিসের সময় এবং অফিস-পরবর্তী সময়কে আমার পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র মনে হচ্ছে। সন্ধ্যাটাকে মনে হয় বর্ডার। অ্যালেক্স, আমি যখন অফিস থেকে বের হই তখন সন্ধ্যারা বর্ডার হয়ে আমার পায়ের কাছে জড়ো হতে থাকে। আমি আলগোছে বর্ডার ক্রস হয়ে স্বজনদের কাছে ফিরি। আমার ক্লান্ত শরীর কলতলায় যায়, কল ছেড়ে হাতে-মুখে পানি ঢেলে নেয়।

অ্যালেক্স, চোখে-মুখে পানি নিতে নিতে মনে হয়, পৃথিবীর নগরপিতারা আমার ক্লান্ত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুতে দিচ্ছে।

মাথাটা ঝাঁকি দাও রোদেকা

রোদেকা, অ্যালেক্সের হাঁপানি ছিল। অ্যালেক্স হাসি দিলে যে-তরঙ্গ, সে-তরঙ্গের ঝাঁকি পেড়ে আনতো জয়তুন ফলের মাঠ। জয়তুন শীতকালে পাকে। জয়তুনের আচার লবণ-পানির চেয়েও কিছুটা লবণ। লবণ খেলে অ্যালেক্সের হাঁপানি বাড়ে।
রোদেকা, অ্যালেক্স সাঁতার থেকে ঢেউ তুলে বিছানা পেতে ঘুমাত। অ্যালেক্স সাঁতারে যেত।

রোদেকা এখনো আমরা গভীরতায় ডুবে আছি

রোদেকা তুই তো জানিস, পৃথিবী কতখানি দুর্বল। তারও বেশি দুর্বলতা নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তোর পায়ের কাছে এসে। একদিন দুর্বলতা কেটে যাবে, ঘুম ভাঙবে। তোর দু-উরুর মাঝ থেকে টেনে বের করব ধারালো কাঁচি। রোদেকা, দু’জন মিলে আগাছা কেটে ধ্যানের জমি বাড়াব পৃথিবীতে। গুদামজাতকরণ হবে না কোনো বোধের। ভূমির ওপর বিছানো যে দেড়ফিট ভাবের গভীরতা, তা ঠোঁটে নিয়ে বাতাসে ভেসে যাবে কাকাতুয়া।
আর কাক ও শকুনের জন্য পচে উঠবে আগাছার স্তূপ।

সমুদ্র ও উচ্চতা বিষয়ক

রোদেকা, তোমার যৌনাঙ্গে পেতে দাও মই। পিচ্ছিল পথে সাবধানতা নিয়ে একটা উচ্চতা পাক পৃথিবী। মই সহ তুমি ডুবে থাকো উচ্চতার নিচে। হাতে ছাই নিয়ে যত উপরেই উঠে আসুক, অন্য উচ্চতার মানুষ একদিন ঠিকই বুঝে যাবে, তারা বন পুড়িয়ে উঠে এসেছে এখানে। বন মানেই তো সৌখিনলতার ঝোঁপে বাঘ ও দাঁতের হিংস্রতার দিকে খরগোশের এলিয়ে-দেওয়া চোখ ।

এত উঁচুতে হিংস্রতা থাকে না। কিছু অলসতা কাটিয়ে বাতাসে দাগ কাটতে কাটতে হারিয়ে যায় খরগোশ। যেখানে বন নেই, সেখানে বাঘ নেই। সেখানে খরগোশও থাকে না।

রোদেকা, জয়তুনক্ষেতে যে-রোদ জানিয়ে গেল — আধিপত্য অর্জনের কিছু নয়, সে-রোদে আমরা ফেলে দিয়েছিলাম আমাদের খালি-হয়ে-যাওয়া স্যুটকেস আর তোমার কপালের সমান একখানা ভাঙা আয়না।

আহ রোদেকা,
রোদে আয়নায় রপ্ত হলো দিন!
চাপা পড়ে যাও পৃথিবীর শীতকাল। আমরা উষ্ণ হতে থাকি।
নশ্বর, শ্মশান, তৃণ, নক্ষত্র ও শেষ ট্রেন • মণিশংকর বিশ্বাস

নশ্বর, শ্মশান, তৃণ, নক্ষত্র ও শেষ ট্রেন • মণিশংকর বিশ্বাস






নশ্বর

কোথাও যেও না তুমি
আমার হৃদয়ে থাকো।

চার্চদিনে ভোরবেলা যে-রকম ঘণ্টা পড়ে
সেই মত কাঁপা কাঁপা জল, জলের ও-পারে
নীল, নীলাভ জঙ্গল, আর বাঁশির সুরের মত
একটানা পথ; কতদূর যাওয়া যাবে এই পথে ?
প্রশ্ন করি আর দেখি, রেশম চাষির পাগড়ির মত
আকাশে উজ্জ্বল মেঘ, দুটি মেঘের মধ্যবর্তী সেতু—
একটি পাখির ঝাঁক…

এই ধর্মবোধ।

শ্মশান

ভালোবাসি— এই স্বতঃপ্রণোদনা যেরকম
তার চেয়ে কিছু কম গভীরতাময় ইঁদারার জলে
ঝুঁকে দেখা গেল চাঁদ, থমকে রয়েছে
যেন অদূরে বিজয় দেখে ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে
রোমাঞ্চবিহীন গৌড়-বাংলার শেষ ঘোড়সওয়ার,
আর কুয়াশায় কেঁপে কেঁপে ওঠে চন্দ্রমল্লিকা
যেন আমাদের বোনের হৃদয়—
চাঁদের আলোর মত কাছেই দূরের পাহাড় দেখে
বিহ্বল লাগে—‘দেবতার মল্লযুদ্ধ’, এই নামে
ছোট কোন হাওয়া এসে দোলা দেয় করবীর শাখা।
কোন এক সরল ঐকিক নিয়মের বশে
ফুলে ফুলে ভরে গেছে শালের জঙ্গল।
এইখানে রাত্রি এক মাকড়সা, আর তার আঁধারের
জালখানি ন্যস্ত রয়েছে সর্বত্র, সকল নশ্বর ফুল ঘিরে…

অনেক তারার নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছি

শাদা মেঘের মত ফাঁকা করতল।

জানি অদূরেই তুমি আছ।

তৃণ

মৃত্যুর পরেও আরো ক’টা দিন আমি
আমি বেঁচে থাকবো।
সন্ধ্যাতারা ভোরের শেফালী হ’য়ে
যে-রকম ছুঁয়ে থাকে মাটি।

দূর হতে আমাকেও ডাকে, ওই পারে…

প্রতিটি শেফালীর পাশে...

মরণ রে, তুঁহু মম…

তুমি ঘন নীল অথবা সোনালী
অলৌকিকতা
এখনো শুয়ে আছো
ধাবমান কার্তুজের খোলে

পাখির ঝাঁকের প্রতি—

একটি পাখির টানে…

নক্ষত্র

যাকে এতক্ষণ গুপ্ত-ঘাতক মনে হ’য়েছিল
কাহিনীর শেষে বোঝা যায় সে আসলে
ভালো মানুষের পো

অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে, সরলাবালা বালিকা বিদ্যালয়ের মত

ভিজে আকাশের নীচে খুব আস্তে
ফুটে উঠছে এক দুঃখী রাজপুত্র, একা, অবুঝ…

শেষ ট্রেন

শালবন আর সূর্যাস্তের কাছে তোমাদের হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি।

তোমার মনের কাছে এখন-কি অন্য কেউ বসে আছে?
এসব লেখার অর্থ কী তবে?
কাচফুল— রক্তমাখা তারকাটা— অতিদূর শ্রাবণের মত নীল
তোমার দুচোখে একটি বা দুটি তারা ফুটে ওঠে।
তাদের ভিতর জেগে উঠছে রাত্রির অসামান্য আয়োজন—
এর কিছুটা আমার নিজস্ব।

প্রতিদিন তোমাকে হাতের মুঠো থেকে বের করে দিই
অন্য অনেক তারার মত আমিও জেনেছি
এ-পথ আমার, একার—

একা একাই বাড়ি ফিরে যাব রাত বারোটা পাঁচের বনগাঁ লোকাল ধরে…


মণিশংকর বিশ্বাস
জন্ম: ১৯৭২, ৩-রা ডিসেম্বর (ঠাকুরনগর, উত্তর ২৪ পরগনা)। ১৯৯৬-৯৭ সাল থেকে গান্ধার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। পত্রিকা বলতে মূলত কফিহাউস-কেন্দ্রিক আড্ডা। ১৯৯৮ সালে গান্ধার থেকেই প্রথম সংকলন (ফোল্ডার), "নম্র বৈশাখী ও নীলিমার অন্যান্য আয়োজন"। স্বল্পকালের জন্য সম্পাদনা করেছেন "জড়ভরত", মূলত গান্ধারেরই উদ্যোগে।

প্রকাশিত বইঃ "চন্দনপিঁড়ি" (কবিতা, ২০১৪) "অশ্রুতরবার" (কবিতা, প্রকাশিতব্য)

বর্তমানে সিডনি, অস্ট্রেলিয়াতে বাস করেন।

সিলভিয়া প্লাথ, কাফকার সম্মোহনী ও অন্যান্য • তিয়াশা সুরভী

সিলভিয়া প্লাথ, কাফকার সম্মোহনী ও অন্যান্য • তিয়াশা সুরভী






সিলভিয়া প্লাথ

জলের সাথে মিলেমিশে রক্ত গড়িয়ে গিয়ে সকালের পবিত্র আলো ছুঁয়ে দেয়। সে সময়ের সাথে সংঘর্ষ চলছে মানুষের।
মানুষ!
মানুষ কি চেনে অন্য মানুষকে?
মানুষের হাত, পা, চুল, প্রিয়তম চোখ এসকল যেন ভুল আয়াত হয়ে ঢুকে গেছে ইতিহাসের পাতায়।

মেয়ের লাশ শেষ বার দেখে হাত রাখে কফিনে।
সেই অতি প্রয়োজনীয় অথচ অপ্রিয় কফিন একজন বাবা বয়ে বেড়ায় চিরকাল।
ভাবে- এ হাত গড়েছিল একদিন সভ্যতার প্রাচীর
এ হাত এখন কিয়ামতের অপেক্ষা ছাড়া নিজের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পারে না।

আত্মহত্যার রঙ না কথিত সভ্যতার ব্লেডের ধার বেশি সুন্দর ?

সিলভিয়া প্লাথ, আপনার কবিতায় প্ররোচিত হয়ে কোন মানুষ কি মরেছিল? খুব সকালে?

কাফকার সম্মোহনী
নগ্ন সত্য আর মিথ্যের মাঝামাঝি মৃত্যু বেছে নেয়া কঠিন।

তবু
কবরে পৌঁছানোর রাস্তা দেখানো হচ্ছে।
আমার ডায়েরি আর স্ট্যানলির চিঠি গুলো সাথে দিতে বাধ্য করেছি।
ঠিক এই মুহুর্তে, চারজনের কাধের ওপরে শুয়ে, ঘুম ঘুম চোখে বুঝতে পারছি, স্ট্যানলিকে অনুবাদ করলে স্ট্যানলিই থাকে।

আমার মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে দুঃখ মেশানো হাসি। কার হাসি এতোটা তীক্ষ্ণ!
সে কি জানে আমি আর কবিতা লিখতে পারবো না, শ্লীল অথবা অশ্লীল শব্দে? আমাকে উপহাস করছো। আমার রেখে যাওয়া প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য, প্রতিটা কবিতা তোমার স্বেচ্ছামৃত্যু ডেকে আনবে, আমি বিশ্বাস করেই আরামে শুয়ে আছি এখন।

ফরাসিরা একবার কাফকা পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। অথচ কাফকার বানানো জগতে আমি রোজ বিকেলে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম। এখন একসাথে বসে সিগারেট ভাগাভাগি করতে পারবো ভাবতেই আরো দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে চাচ্ছি।

স্ট্যানলি,
আমাকে, এই আমার আমিকে নির্মাণে অথবা কাফকার কাছাকাছি পৌঁছে দেয়ায় ভূমিকা আছে তোমার একান্ত ব্যক্তিগত স্যুভেনিরের। অবশ্য তুমি আমাকে সম্মোহিত করনি। তবুও
তুমি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিও ট্রাফিকের তিন রকম আলো। (যদি পারো)

রেস্তোরা

নবী মূসা
অনেক মানুষের ভীড়ে
আপনার হাতটা যখন ছাড়লাম
পৃথিবীর ওজন বাড়িয়ে চাপিয়ে দেয়া হলো আমার ঘাড়ে।
ঘাড়ের তিলে চুমু খেয়েছিল যে, তাকে পাওয়া যাবে কফির দোকানে। চিনির দাম কম না বেশি এই নিয়ে আলোচনা চলছে তুমুল। এসব খুচরো আলোচনার সুবিধার্থে শহরে এতো দামী, কম দামী ক্যাফে, রেস্তোরাঁ।

ব্যাক্তিগত ঠোঁট থেকেই কেবল আমি চা পান করি। খেতে খেতে নতুন চশমাটা পরে শরীরের সমস্ত বাক দেখার আগেই অর্গাজম হয় কবিতার, কবিতায়!

বীর্যভেজা পাতার গন্ধে আমি লিখতে পারি না।

ভুল ঘুম

তীরবিদ্ধ বুক।

বুকের সমস্ত ভালোবাসা জড়ো করে, তোমার প্রাক্তনের জন্য বসে আছি, আজ দেড়শত বছর।

তোমার মুখোমুখি, আমি। অথচ মরে গিয়েছি গতরাতে সিগারেটের শেষ টানের সাথে।

মহাকাল থেকে অতীত ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় আমার শীত করছে।

প্রেমাতালের ওষুধ খেতে ভয় আমার। ভয়ংকর চোখ এখনো ছবিটায়। ধূসর হয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে ইতিহাসের আয়াত।

আর

নূর দেখেছিলাম যে চোখে সে চোখ পুড়ে যাচ্ছে ভুল ঘুমে।


ক্ষুধার্ত মানুষের গান

একদিন হাটতে হাটতে আমি চলে গিয়েছিলাম বব মার্লের তাবুতে। উনি গান লিখে আমাকে গেয়ে শোনালেন। দুঃখ দুর্দশা আর ক্ষুধার্ত মানুষের গান।
কতোকাল হাটতে থাকলে আমার বয়সের সমান ক্ষুধায় আমি নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবো বব?

এক কেজি করলার দাম আমি রেখে এসেছি বালিশের নিচে। চালের দাম? কিনি না তো। রাত হলে ভাতের হোটেলের সামনে বসে থাকি। বসেই থাকি। যখন ক্ষুধায় তৃষ্ণায় চোখে ঝাপসা দেখি আমি চলে যাই কোন আখড়ায়। গান শুনি। শুনি বেকারত্বের হার কমে গিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

বসন্ত শেষ। এখন বর্ষাকালীন কদম সময়।
প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়
ভিজে যায় অসহায় রাত
ঘুমহীন লাল চোখ, অবহেলায় পকেটে রাখা দু'টাকার কয়েন
খামছে ধরে বুকের ভেতরকার তীব্র ক্ষুধা।

হে
দিকভ্রান্ত কবি
চিরকাল মাতাল আপনি
ছিলেন সেখানে?
বিভ্রমের সঙ্গম শেষে জ্বলে গেলো ক্যাটালগ
ইবাদত ব্যতিত আগুনে জ্বলে যাওয়া পাপ
আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, আপনার ইবাদতের সাক্ষী মরে গিয়েছে আপনার মৃত্যুর আগেই।
তবে স্পষ্ট ঈমান আনুন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের।
নিজের লাশ আর কতোকাল কাঁধে বয়ে বেড়াবেন?

আমি আপনার ভাবনা, ভাবনা অব্দি না এনে, হেঁটে যেতে চাই ভ্রান্তিময় সময়ে। সময় যেখানে কবিতা, কবিতা যেখানে সময়। ওখানে চুমু খেতে প্রশ্ন প্রশ্ন খেলায় আমার আগ্রহ নেই। আগ্রহ আছে টকটকে লাল ঠোঁটে। দীর্ঘতম চুমুর রক্ত আমি হাটবাজারে বিক্রি করে ট্রেনে চেপে বসবো।

কারণ
বব জানালো -
বৃষ্টি থেমেছে
ম্যাপল পাতা ভিজে গেলে নরকের আগুন নিভিয়ে দেয়া হয়।
ঘুমোতে দেয়া হয় রাত প্রহরীকে।
বিভ্রান্তিকর অস্থিরতার কথা কেউ আর অনেকদিন বলে না।

বব, ক্ষুধা পেটে সিগারেট আমার দারুণ লাগে
লাইটার হবে?
নরকের আগুনটা, বড্ড মলিন।
সিগারেট ধরানোর মতো মহৎ কাজে লাগে না।
এগুলো বলার সময় এখন আমার হবে না।

করলা। করলা কিনে বাসায় ফিরতে হবে।
লাল গোলাপ পাশে নিয়ে ঘুমাতে হবে।
মানুষ মানুষকে মারছে এসব খবর না শুনে ঘুমাতে গেলে গোলাপের গন্ধ প্রাক্তনের কথা মনে করায়।
আমি চিৎকার করে 'দিকভ্রান্ত কবি' কে ডাকতে গিয়েও কোনদিন ডাকিনি, জানেনি কেউ, বলবো না তাঁর কথা কাউকে কখনোই।

বিষন্ন সুরে ক্ষুধামুক্তির কোন গান হবে নাকি, বব?


"Don't Worry
About a Thing
Cause Every Little Thing gonna be Alright"
সুবর্ণ আদিত্যের নির্বাচিত | ২০ কবিতা

সুবর্ণ আদিত্যের নির্বাচিত | ২০ কবিতা






আয়না

মেয়েটি এগারো বছর বয়সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝে গেল যে, সে সুন্দরী—
পরবর্তী এগারো বছরে সে তীব্র রুপসী হলো
তার পরবর্তী আট বছরে সে বুঝে গেল তার সুন্দরী
হওয়াটা ভুল ছিল—

সে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো...
আয়না কখনো মিথ্যে বলে না

প্রেমিকার মৃত্যু

আপনি এখনো স্বপ্নের মধ্যে এলে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই—
অমন করে পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে কে বলেছিলো?
পাদদেশ আর কতটা নাগাল পেয়েছিলো বলুন!
রঙ মাখানো সবুজ শরীর তো ছড়িয়ে গেল লাল
আপনি টিয়া হয়ে টিমটাম নেমে এলেন
মনের খোঁজ পেয়েছিলেন?

একটা হাসপাতাল, তেরোজন ডাক্তার- নার্স
এ্যাম্বুলেন্স নাকি আমি, কে বয়ে বয়ে নিয়েছিলো আপনাকে?
আজও বুক টানটান করে দাঁড়াতে পারি না, জানেন?

শরীর যেখানে যায়, ছুঁয়ে যায়—
মন থাকে আরো গভীরে
কেবিন থেকে শশ্মান
আপনার অবকাশ যাপন শেষ হয় না

এমন উচ্চতর মৃত্যুকাঙ্খা নিয়েও আকাশী শাড়ীতে নিজেকে জড়ায় কেউ!
কোমর থেকে সরে যাওয়া ভাজ
ভরাট নাভী খুলে রাখে আহ্বান—

আপনি এখনো স্বপ্নের মধ্যে এলে আমি
অন্যমনস্ক হয়ে যাই...

মানবিক সিঁড়িপথ ধরে আমরা ছটফট করি
আপনাকে পোড়াবো বলে পুকুরর্ভতি তল সাজিয়ে রাখি

লম্বা চুরুটে ঠোঁট নিয়ে—
শেষবার আমাদের দেখা হলো চেক প্রজাতন্ত্রে
এইসব আর্তনাদ সাদারঙ না পেয়ে কুঁকড়ে গেলো

আপনাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি—
আমার নামজুড়ে মৃত্যুর গন্ধমাখা ধবধবে স্তন

আপনি এখনো স্বপ্নের মধ্যে এলে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই...

এক্যুরিয়াম

এইবার চলুন হেঁটে আসি আমাদের যুগল কবর থেকে
নুহামি, তিনশো বছর কি খুব বেশি সময়?

আপনি আড়ালে রাখলেন নোটবুক
সিলিকন সমুদ্র
পেয়ালায় থোকা থোকা মদ
হাসিটা দীর্ঘ হতে হতে ছোট করে কাশলেন—

গত তেরোযুগ—
পানাহার ফেলে আপনি এঞ্জেলোর নখ নিয়ে চুষলেন
ঘষলেন
কামড়ালেন
ছুঁড়ে মারলেন

আপনার বৈঠকখানায় তুলে রাখা বাইবেল
লাল কাপড়ে মোড়ানো আসমানি ভাষা
ছড়ানো দৃশ্যের ভেতর ঘাপটি কথা
সব, সব চেনাজানা পাপ
প্লেটে সাজিয়ে পরিবেশন করলো আরব্য সুন্দরী

আপনি ডানহাতে লিথুনিয়াম বামহাতে ডানহিল ঠোঁট করে
দুই আলট্রা রুপশীর কাঁধ নিয়ে
স্নানে গেলেন—

আপনি যে এতকাল এ্যাকুরিয়ামে বন্দি
ভুলে গেছিলাম...

নিরানব্বই নম্বর প্রেমিকা 

নিরানব্বই নম্বর প্রেমিকা হারিয়ে গেলে একশ তিন দিন শোক পালন করুন—
কিংবা সৎকারে অংশ নিয়ে আপনি চলে যেতে পারেন স্পেনে। হ্যাঁ, আপনার খানিকটা আফসোস থাকতেই পারে বরং এভাবেই ভাবুন- আপনি শতকের দিকেই এগিয়ে গেলেন! জানেন তো, ঋতু সংহারে নতুন কলিও ডানা মেলে।

আপনাকে চরিত্রহীন বলছিনা, বলছিনা আপনার চরিত্রে দোষ আছে। বিশ্বাস করুন!
আমরা জানি, রুপন্তি আপনার আবেগ-ভালবাসায় আছে। হ্যামিলটনের রাস্তায় ডানহিল টানতে-টানতে আপনি আবার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন, নাটাইয়ের সুতো ছাড়তে-ছাড়তে আপনি গোত্তা খেতে-খেতে নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন গন্তব্য।

বান্ধবী হারানোর শোকে আপনি পানশালায় চলে আসুন—বেঢপ মদ্যপবস্থায় আড়ালে খুঁজুন শততম লাবণ্য। যে মেয়ে চলে যায়, ছেড়ে যায়- তাকে চলে যেতে দিন। প্রেমিকা চলে গেলেই কেবল প্রেমিকের মুক্তি।

সমুদ্রে লবন চাষে নামতা জানতে হয়—দশের অংকে কয়টা ঘর ফাঁকা রাখলেন তার হিসেবও মানুষ রাখে

লাইফটা এনড্রয়েড হলেও বকুলের গন্ধ কিন্তু মলিন হয়না, সার্কাস মডেলের সন্ধাগুলি বোতলজাত থাকুক নেলপলিসে। ঝাঁ চিকচিক সী-বীচ হোক আপনার উদোম যাদুঘর।

আপনার তেরাশি নম্বর প্রেমিকা-প্রিয়ন্তী, দাঁতের বর্ণনায় ডায়েরীর পাতায়-পাতায় সেকি ঈঙ্গিত! পাতাগুলি পুড়িয়ে কালি না করে কয়লার গ্যারেজে চালান করে দিন। আড়াআড়ি তাকানো জেরিনের চোখের পাঁপড়ি মানিব্যাগ থেকে বের করে দান করুন কোনো মাকড়শার খামারে- রয়্যালটি পাবেন।

আপনাকে কেউ উন্মাদ বললে অট্টহাসি দিন- জানেন তো! আপনার প্রাপ্তির মতো তারও কিছু প্রত্যাশা থাকে।
মিস রহমানের কোকড়ানো চুল দেখে যতবার পরদেহী বাতাসে গা-ভাসিয়েছেন -তাকে বলে দিন—হোমারও এত ভালোবাসেনি তার প্রেমিকাকে।

নিরানব্বইতম প্রেমিকা চলে গেলে বরং উল্লাস করুন। ভাবুন—আপনি একধাপ এগিয়ে গেলেন।

অস্তিত্ব

যে কোনো দূর্দাশায় আমাকে স্মরণ কোরো—আমি ঈশ্বর নই যে সাড়া দেব না

যে স্বপ্ন বাবা দ্যাখেননি 

আমি বড় হচ্ছিলাম বাবার অগোচরে
সন্ধার বৈঠকখানায় নিয়মিত চা নিয়ে যাই
কোন ক্লাসে পড়ছি, বাবার বন্ধুরা বাবাকে জিজ্ঞেস করলে
আমার নাম ধরে বাবা বলতেন...
—বর্ণ, তুই কোন ক্লাস রে?
আর হো হো করে হেসে উঠতেন বাবার বন্ধুরা
ঠিক ততটাই নিচুস্বরে উত্তর দিয়ে আমি বেরিয়ে আসতাম

দিনদিন বাবা আমার কাছে আকাশ হয়ে উঠতেন

বাবার মুখস্থ থাকতো বাড়ির দুটো ল্যান্ড ফোনের নাম্বার, কোন গাড়ির চাবি রাখা থাকে কোথায়
আর কতগুলি ফ্যাক্টরি
এমনকি—সুদর্শন বড়ভাইয়ের প্রেমে পড়েছে কতগুলি মেয়ে
বাগানে হাঁটতে এসে কোন ললনা গোপনে রেখে যাচ্ছে চিঠি—তাও

সেই সাতাশি সালের দিন—কত কত ঋণ
আমি পুষে রাখি খুব

নরম কোরে সন্ধ্যা আসার মত আমি পালটে যেতে থাকি
বাড়ির দেয়াল ঘেষা ঝংকার ক্লাবের নাট্যদৃশ্যে
মাস্টার মশাইয়ের চরিত্রে তুখোড় মেজভাই—নায়ক বনে গেলেন
সেই থেকে রাত ফাঁকি দিয়ে নাটক দেখা
সিলেবাস ছেড়ে জীবনানন্দ-সুনীল পড়া
স্কুলের লাল কাগজের সাথে আসে বাবার নোটিশ
আমি 'দেবতা নাকি পশু'—এমন প্রজ্ঞাপন

আমি তো হতে চেয়েছিলাম স্বপ্ন—
ঘুমঘুমপ্রজাপতি-নিত্যবকুল, মায়ের গলার মিহিমিহি সুর...

বাবা চাইতেন আমি ধম্ম-কম্ম করি; করেছিও
ছোটবেলার ভোরগুলোতে-'আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম'
আর পাখি নীড়ে ফেরার আগেই বাড়ী
ফেরা—দেবলীনাও থামাতে পারেনি আমায়
আমার মা—তাকে দেখতাম, রাজত্ব সামলাতে প্রতিদিন দেড়মন চালের ভাত রাঁধতেন
এছাড়া শৈশব স্মৃতির মা'কে আমার খুব বেশি মনে পড়েনা

আজ আমার মা, চিরদুঃখী মা—বেদনা আমার,
এতদিন পর বুকের ভেতর দহন দারুন

মা'কে মনে করিনা ভয়ে, নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা
মা আমার কষ্ট পান, আবারো কষ্ট পান—আমি সইতে পারিনা
পৃথিবীর স-ব মা-ই সন্তানের দূর্বল স্থান
মাকে নিয়ে লেখার আছে ঢের—
আমি নিজেই বাবার মত দূর্বোধ্য পাঠ

এখন কেউ বাবার কথা বললে- আমি আকাশ দেখিয়ে দিই

বিজ্ঞাপন

এমনভাবে হারাবো—
খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হবে কয়েকটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র

ঈশ্বর

আমার কোনো শাখা নেই

চুরুটে বারুদ থাকুক

তুমি শিলং-গোয়াহাটি আর দার্জিলিং ঘুরে আমার জন্য চুরুট আনলে
সেইবার যুদ্ধের ময়দান খাঁচায় পুরে
রাজস্থান উলুধ্বনি দিলে
নারীরা আবার বন্দী হয়ে গেল

আমার দাদার দাদা কেরালার শাসক হিসাবে সিংহাসনচ্যুত হলেন
এখন বুঝতে পারি—
তিনি শাসক না হয়ে অবতার হলে আসনচ্যুত হতেন না

চুরুটে শ্বাস নিয়ে ভাবি—রেডিসন স্কয়ারের রাস্তায় একটা বিরতি নিয়ে
ফুল হাতে দাঁড়িয়ে যেতে পারতাম
তাতে আর যাইহোক—
তোমার দাদার সাথে আমার কাকার বিরোধ হত না

পাখির জন্য পালক
নারীর জন্য পোষাক
বাগানের জন্য বন্ধুর আগমনে কয়েকদিন আগের
ঝলমলে সন্ধায় আমি খুন হলাম—

চুরুলিয়ার রাস্তায় রাস্তায় আমার নাম হবে খুব—
এমন করে বলে তুমিও ধ্যানরত
ঘুটঘুটে কালো নিয়ে বসে থাকি স্থির

আমাদের আর কোনো রাজপ্রাসাদতুল্য ভবন নেই ভেবেই
তোমার প্রেমিক আমাকে পাহাড় কিনে দিল

সেই থেকে তোমাকে চুরুট আর নারীকে পাহাড় নামে জানি

বায়োস্কোপের জবানবন্দি

তুমি মরে যাবার বছর দেড়েক পর খবর পেয়েছিলাম—
যদিও কথা ছিল এমন যে,
যেদিন জানবো তুমি আর আমার নেই, সেদিন সারা পৃথিবী জানবে- তুমি আমার ছিলে
গির্জা নিয়ে আলাপের শেষে আমাদের চা ফুরিয়ে এলো—

২৬ ডিসেম্বর একটি দগদগে তারিখ লালশাড়িতে
ঝুলে ঝুলে চোখ নাচিয়ে চলে গেল
সেই শুরুটা সিনেমার পর্দায় বড় হলঘরের নিচের সিড়িতে
আমরা পপকর্ণ খেতে খেতে ধর্ম নিয়ে বিভক্ত হয়ে গেলাম
তোমার ইস্যুটা মারাত্মক দাপট নিয়ে সংসদে উঠে গেল

আবারো বছর দেড়েক পর—তুমি নিজের মরে যাবার খবর দিলে
আমরা মূলত মৃত্যুর খবর জেনে বারবার মরে যাই

যেহেতু শহরে স্টেশন জুড়ে কথার চাষ ভাল
সুতরাং আমরা নিরব থাকলাম
আমরা ভুলে গেলাম আমাদের কাতর হৃদপিন্ডের কথা
আমরা ভুলে গেলাম হাসপাতালের রোগীদের কথা
আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির কথা

এভাবে ভুলে থাকতে থাকতে হারিয়ে ফেলেছি
নবজাতকের মুখ
প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হলে শোক থাকতে নেই—

অথচ
কি মনে করে বহুবছর পরে ডাকহরকরার মত ছুটে আসে তীর তীর চোখ
সাদাকালো শহরের মানচিত্রে দুলে যায় জ্বলজ্বলে
টিপ

দেবযানী একটি দাউ দাউ নাম

ঠিক কতদিন পর আপনার সাথে দ্যাখা?
—নয় মাস
—একটা দেশ এই সময়ে স্বাধীন হতে পারে
মাত্র এক আঙ্গুলে, আঠারো মিনিটেই দাঁড়িয়ে যায় বাংলা

সেই যে অধিকার নিয়ে বলেছিলেন—
সমুদ্রের বাগান হবে- আপনার প্রেমিকের চোখ
দারুণ ফায়ারপ্লেস দাউ দাউ নিয়ে
ঝলসে দিবে চুমু চুমু আহার

ব্যাংকে দুই হাজার বছর গচ্ছিত রেখে
আপনার উরু নিয়ে দুমদাম ঘুমে-ঘুরে জাগলাম
তেষট্টি দিন গ্রামোফোন বাজিয়ে
মাছরাঙা নিখোঁজ মর্মে বিজ্ঞাপন ছাপলেন
আরো কতদিন পরে- ঠিক কতদিন?

পরবর্তী প্রশ্ন আসার আগেই সংবিধান সংশোধনে পার্লামেন্ট বসালাম
চুমুর উপর কোন ট্যাক্স বসানো হবেনা;
প্রেমিকার হাত ধরে হাটতে পারা আর
শিউলির ঘ্রাণ নিতে নিতে তৃতীয় সংখ্যার জীবন

মাত্র তেইশ টাকায় পাওয়া দাপ্তরিক খাদ্য
ষোল টাকায় এসি কামড়া
সারা পৃথিবী বিনামূল্যে ভ্রমণ
—মশাই, প্রেমিকার আবদার
এসব মন্ত্রীরাই কেবল রাখতে পারে

দেবযানীর কথা মনে পড়ে আপনার?
জলপাই জলপাই চোখ, মৌসুমি লিচুর মত মেয়েটা!
ভেতর-বাহির অঙ্গার—
ছেচল্লিশ বছর ধরে খুঁজছি, জারুলে-পারুলেও শোক
তবু সমুদ্র পুষছি

ফুলেদের আয়ু থাকে না

সমস্ত দুপুর খুলে তোমার কোলের বারান্দায় শুয়ে থাকি। মৃত্যুর গরিমায় টালমাটাল ঘ্রাণ ময়দানে ছায়া টেনে তারস্বরে চেঁচায় অবনত বৃক্ষ। ফলের শ্বাস ও ফুলের পতনে হুক খুলে দারস্থ হয় মধ্যরাতের বিস্তারিত গল্প।

লাল লাল কোয়া নিয়ে নরম ডালে ডালিম প্রার্থনা করে শীত। যেভাবে জেগে থাকে নাগলিঙ্গম, প্রতি ভোরে। আমাকে ভালোবেসে নাকফুল পরা মেয়েটা দিন দিন যোগ্য হয়ে ওঠে, ধ্যানে। মগজের মনন থাকে, ফুলেদের আফসোস থাকে; আয়ু থাকে না।

ফারদুন—তোমাকে গোলাপ নামে ডাকা হয়ে উঠবে না?

ফারদুন, হেমন্ত আমার

ফারদুন—
ডেনমার্ক এক শীতের দেশ। আমি বাংলাদেশ থেকেও অনুভব করি—তুমি মেয়ের আঙুল ছুঁয়ে হেঁটে যাচ্ছো বরফের পাহাড়।

হেমন্ত, প্রিয় ঋতু আমার। তুমি চলে যাবার পর, ভরা ডিসেম্বরেও এখানে শীত নেই—সবটাই নিয়ে গেছো?
অবশ্য অতিথি পাখি দেখলে আদর করি
তুমিও তো কোনো দেশে অতিথি হয়ে আছো!

জুলাই মাসে মাঝে-মধ্যে বৃষ্টি হয়
রঙিন ছাতা নিয়ে তুমি ভিজে যাচ্ছো শাহবাগে—এখনো দুপুর ঘোলা করে হেঁটে যাও নূপুরের পথ
এতো নরম করে হাঁটো—তোমার তুষার শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে ঝকঝকে রোদ্দুরে

ডাচ ভাষায় ‘ভাল আছি’—শিখিয়েছিলে
এক কেজি ডেনিস বেগুন বাংলাদেশী মুদ্রায় কত—তার হিসেবও দিয়েছিলে
ট্রেনে চেপে দু’শো কিলো পথ
নির্বিঘ্নে কুড়ি মিনিটে চলে যেতে পারো
আমি সাধারণ বাঙালী—আফসোস করি

দূর থেকে বুঝি—আরো কতটা গতিময় হয়েছো তুমি
ওখানকার সাহেবি বাচ্চাদের স্কুলে বাংলায় ‘কেমন আছো, ভালোবাসি’ নানাবিধ উচ্চারণ শেখাও...
বাংলাভাষীর চেয়ে ভিনদেশীর মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শুনতে অন্যরকম তৃপ্তি আছে

অথচ, এমন ভাঙা-ভাঙা করে কতবার বলেছি একই শব্দ—কানেও তোলোনি কখনো
যে বিধানের কারণে এক হলো না আমাদের পথ
আমি তো জানি...
পৃথিবীর ইতিহাস বদলে গেলে—তোমার ভেতর আমি সত্য

নীলক্ষেতের পথে একবার বলেছিলেঃ যানজট থাকলে, যানবাহন কিংবা যাত্রী
কারো জন্যই তোমার কষ্ট হয় না
দুঃখ হয় রাস্তাটার জন্য—কতটা ভার বয়ে রাখে সে
আজো—তোমার বুলেট ট্রেন কত ধীরভাবে অতিক্রম করে যায় আমার বুকের উপর দিয়ে

দিন বাড়ে, ফুলেদের আয়ুর মত সহজ হয়ে আসে মানুষের যাতায়াত

মানুষ মূলত ভায়োলিন

ফারদুন—
আমাদের রাত্রীরা ঘোলা হয়ে এলে মায়ের অসুখ করে
বাড়িজুড়ে আত্মীয়, শোক শোক কাতরতা
স্যালাইন, অ্যাম্বুলেন্সের লাল বাতি
হাসপাতালের গন্ধ—অবশ্য অসুখ হলেই হাসপাতালকে মায়ের মত মনে হয়

তোমাকে তেতো লাগে—
নরম ইনসুলিন কাঁপিয়ে নেয় চঞ্চল ধমনী
ভারি নিঃশ্বাস নিয়ে তুমি কাছে এলে
স্তনে হাত রাখতে রাখতেই শুকিয়ে যায় দক্ষিণ মেরু

মানুষ মূলত বেদনা ছড়াতে ভালোবাসে

তোমার প্রেমিককে পড়ে জেনেছি—চারশ আশি রিম কাগজে
তোমার নামে বিষন্নতা লেখা আছে, ভিন্নচোখে

সেই যে পাহাড়ে উঠেছিলে গত শীতে
শীত আড়ালে গেল বলে পাতাবাহারের আক্ষেপসূচক নীরবতায়
চিত্রকর মুখাবয়ব আঁকা বন্ধ রেখে অনশনে বসলো
বাতাসের বন ইজারা নিয়ে প্রজাপতি সমাবেশ ডাকলো কিছু গুপ্ত প্রেমিক
ভুল করে আমাকে মানুষ ভেবে তুমিও সূচনা সংগীত গাইলে

তোমার ঠোঁট কেঁপে ওঠার দিন—
ধ্যানবিদ্যা আত্মস্থ করতে করতে আমাকে মমি করে রাখলে, কী এমন কষ্ট থাকে মানুষের!

ভায়োলিনও জানে সে আসলে মানুষের প্রতিশব্দ

বদল

ফারদুন
তুমি এক দূরহ প্রলেপ আচ্ছাদিত ক্রিয়া
মুখোশের আকারে গতি নিয়ে ক্ষয়ে আসো
এবং আমাদের প্যারালাল পৃথিবী পেছনে ঘুরে গেলে
তোমাকে ও তোমার শ্বাস তুলে আনি ধীরে

কম্পাস ও যাবতীয় ফসলি সরঞ্জাম উঁকি নেয় জমিনে
রক্তের মতোন প্রগাঢ় চিহ্নের তুলি তোমার মুখ আঁকে

ঈশ্বরের সৃষ্টির সাথে ভুল হয়ে যায় তাকানো চোখের দৃশ্যায়ন
মানুষ হারায় না, জায়গা হারিয়ে যায়

আমাকে বদল করে আর কতদূর যেতে চাও তুমি?

সবজিমহল

রক্তাক্ত হয়ে যাই ফারদুন—যদিও তুমি একটা প্রমাণ সাইজের
টসটসে লাল টিপ আর পরীক্ষাগারে বর্ষাই গোলাপ নাম নিয়ে দুলছো

তোমার ভেতর চলতে চলতে বন-থমকে যাওয়া ঝাঁকঝাঁক অসমতল পাখিবন্দী জীবন
দেশ কাঁধে করে আসা বেদনা-প্রসব।
এইরূপ কুয়াশাসমগ্র শীত আর শুষ্ক হয়ে আসে প্রাত্যহিক ঋতু
আরো কিছু খরার আসন্ন সংবাদে আঙুলের ছাপ নিয়ে
প্রতিবার তোমাকে লুকিয়ে ফেলি; হারিয়ে ফেলার ভয় জন্ম নিতে নিতেই তোমাকে চাষ করি

ফারদুন—কতবার বৃষ্টি এলো তারপর নানাবিধ ফুল-ফল
ঔষধি চারা, পাহাড়িয়া ঢল আর রোদের করাতকল ঘাড়ে চেপে টইটই করে
হেঁটে গেল অনাগত বিধাতা, আরো অনেক অরণ্য
বেডরুমে চিৎকার করছে থকথক ঘ্রাণ

কম্পণ, বুক হাতড়ে আসে উলঙ্গ ছাউনি, ঐ যে যাপন! বসবাস করে যাবো জীবন
মেঘ, মৌমাছি আর অন্যান্য সন্ধ্যায় দূরাগত প্রেমিক আনো—
খাড়া নহর। ফলক আর বীজঃ মই দিয়ে যাই, থোকা থোকা কাঁটায় জন্ম নেয় রক্তালু আত্মজ
সেই নিরঙ্গম শ্বাস, প্রাসঙ্গিক গরিমা আর তুলতুলে সমুদ্রে রোপন করি সুচারু পতন

ফারদুন—আমি নিরেট চাষা বলেই তুমিও চমৎকার বীজসুপ্ত সবজিমহল

ফারদুন বিষয়ক চমৎকার পাখি

একটি চমৎকার নিয়ে পাখিটি ডানা খুলে উড়াল দিল
আমরা যেতে যেতে দেখলাম তার পালক পড়ে আছে
যে পালকগুলি চড়া দামে কিনে এনেছিল তার প্রিয়তম প্রেমিক

পাশেই পড়ে আছে যোগ-বিয়োগ
আমরা বুঝে নিই
ফারদুন গণিতে কাঁচা
একটা টিউটর নিয়োগ দিলে পাখিদের ভাষা শিখে নিতে পারত

এইভেবে প্রতিদিন বাজারে হাট বাড়াই
পাখিটি আরো আরো দৃশ্যবন্দী খাঁচায়
নাম আটকে রাখে

ফারদুন পাখি আঁকে
যেহেতু সে গির্জায় শেষবার রেখে এসেছিল পিয়ানো
তিলক
নূপুর
কবুতর আর
দুটি হাত

আমরা তার আঙুল সদৃশ কিছু কুড়িয়ে আনি
পুনরায় পাখিটি চমৎকার নিয়ে উড়ে যায়

আমরা মানুষ মানুষ ভাব ও মুখোশ নিয়ে
প্রতিদিন তাকে ফোন করি
তার স্বরে ভেসে আসে তীব্র করুণ
নীলকণ্ঠ
বেলুন

কুয়াশা ভরা মোমের পুকুর এঁকে
আরো কিছু দলছুট মাছ ও শিকারি বক
প্রতিবার শীত ডাকে
ঋতুর ভীরে শীতেরও দুঃখ থাকে

নদীটা গণিতে খাটো
গাছটা ছায়া বাঁকা
একদিন
হঠাৎ...

ফারদুন চমৎকার উড়ে গেল

পৃথিবী একটি মানবিক রোগ

ফারদুন
এক একটা দিন পরস্পর দুঃখ হয়ে যাই
এই যেমনঃ আমাদের কিছুই ভাল লাগবে না
দুইজন তিনটি জমজ আয়নায় তাকাবো
খাবারের প্লেট থেকে গড়িয়ে যাবে
ছাপান্ন হাজার মাইল দুর্ভিক্ষ

শুনেছি, কারো কারো রাতগুলো কেবলই রাত
তর্কের টেবিলে কত শত আলোচনায় স্থির হয়
রাজা নির্বাচন ফর্মুলা
আমরা শুধু দিনের আলো নিয়ে হেঁটেই যাচ্ছি—অমন রাত কখনোই এলো না

তিনদিন কেউ অভুক্ত থাকলে
তার সামনে প্রেমিকার কথা উচ্চারণ করতে নেই
বরং বারান্দায় হাস্নাহেনার টবে পানি আছে কিনা এইটুকু খোঁজ রাখা ভাল
কামিনী আর গন্ধরাজে কতটা সুবাস—এ নিয়ে পরে কথা বলা যাবে

ফারদুন
আমাদের হাতগুলো বেশ অগোছালো
পাখিদের শোক সমাবেশে প্রধান অতিথি রাখা নিয়ে
তিন দিনে হাসপাতালে ভর্তি হলো সাতাশজন যুবক

এইসব মিটিং শেষ পর্যন্ত কোথায় শেষ হয়?
বনমন্ত্রী কি জানে, যশোর রোডের গাছগুলোও গাছ!
তাদেরও প্রাণ আছে...

পরপর দুইবার মোবাইল-মানিব্যাগ কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চুরি হয়ে গেলে
আমরা হেনরিকে সন্দেহ করি
তোমার মাথায় হাত রেখে ভাবি
পুরো পৃথিবীর দুর্ভিক্ষটাকে চুরি করে নিয়ে যাবে—এমন চোর কোথায়?

হাড়ক্ষয় রোগ

হাসপাতালের বেডে...

নরম ইনসুলিন চলছে—আমার রক্তের ভেতর নড়েচড়ে উঠছো ফারদুন

হাড়ক্ষয় রোগ নিয়ে জন্মেছিলাম। এক স্বচ্ছ আকাশ রোদ আমাদের বাড়ি ঘিরে রাখে।
ভেতরবাড়ির উল্লাস, কাঁপনের দরজা খুলে
মা
বাবাকে
ডাকেন
দাদার আর কোনো ছেলেপুলে ছিল না
নাতির সাথে গল্প করবেন ভেবে
আমার আয়ুর বিনিময়ে প্রতিদিন
নিজেকে ইটভাটায় পোড়ান

দাদার অবশিষ্ট হাড়
বুকের পাজরে নিয়ে এখন আমি বাবার সাথে গল্প করি।

ধ্যানবিদ্যা

ধ্যানবিদ্যা আত্মস্থ করতে করতে ধ্যানি হই। ফারদুনের ঠোঁটের কাছে নিজেকে অবনত করি প্রেম ও শোকে। যেহেতু আমাদের পৃথিবী ও বৃক্ষরা খুব উদার। মানুষ বলেই বারবার অসুখে পড়ি, রোগী হই। কোনো কোমল নারী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ভেবে তৃতীয়বার ফারদুনকে ডাক্তার হবার পরামর্শ দিই। সমস্ত গরিমা নিয়ে হেঁটে যায় ফারদুন। আকাশের মত এক গমগমে পৃথিবী ফারদুনকে কেন্দ্র করে ঘোরে।

ফারদুন—আমাকে স্পর্শ করো, খোলাচুলে বুকের কাছাকাছি ঝুঁকে আসো, ঘন নিঃশ্বাসে গাঢ় করে কপালে সেবন করাও মৃত্যু নিরঙ্গম।

এরপর নত হতে হতে, তোমার বুক সমান আধিপত্য নিয়ে ফুল আর পাখির কাছে শিখে নিই সমূহ উড়াল জীবন।


সুবর্ণ আদিত্য 
বাংলাভাষার কবি। বসবাস ঢাকায়, মিরপুরে। ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ গাইবান্ধা শহরে জন্ম। শৈশব থেকেই যুক্ত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। পড়ালেখা ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ছিলেন ঢাকার পেশাদার নাটকের দল ‘পালাকার’-এর নাট্যকর্মী। যুক্ত ছিলেন উদীচীসহ কবিতা আবৃত্তি সংগঠনের সাথেও। পত্রিকা দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করে বর্তমানে কর্মরত আছেন একুশে টেলিভিশনে ক্রাইম রিপোর্টার হিসাবে। ১৯৯৫ সাল থেকে সচেতনভাবেই কবিতার সাথে বসবাস। ১৯৯৭ সাল থেকে বিভিন্ন পত্রিকা ও লিটলম্যাগে নিয়মিত লিখে আসছেন। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য বিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘পান্ডুলিপি’। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই- ‘দুধ পুকুরের সিঁড়ি’, একই বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতার বই- ‘ফারদুন সিরিজ’। বই দুটি থেকে ২০টি কবিতা পাঠকদের জন্য দেয়া হলো।
মাহমুদ শাওন এর গুচ্ছ কবিতা

মাহমুদ শাওন এর গুচ্ছ কবিতা

নারী

তোমার শারীরীক উপত্যকার মানচিত্র বহুদিন ধরে পড়ছিলাম,
মুখস্ত করছি অলি-গলি,
ভাগাড়,
ডোবা - নালা,
সরু পথ,
পাহাড়।
উপরোক্ত অর্গান গুলো আমি সাহিত্য, বইতে পড়ে পড়ে চিনি।
কখনো ধরিনি, দেখিনি।
হাঁটার চেষ্টাও করেছি কোনদিন কিন্তু মাঝপথে থেমে যাই,
হোঁচট খাই।

আমি যে তোমাকে চিনি এই তুমি তো সেই তুমি নও।
কড়া পারফিউম,
গাঢ় করা লিপষ্টিক,
ডিএনএ'র সিঁড়ির মত লাল ফিতের বেণী,
পিঠে আঁড়চের দাগ,
বুকে উপর নিচ সারির মিলিয়ে আটটি কামড় দেখে আমি দৌড়ে পালাই।

আমার কোন শরীর দরকার নেই!
আর কখনো সাহস করবো না বাইরে থেকে দৃশ্যায়মান পথগুলোতে হাঁটার।

নারীকে মানুষ ভাবতে শিখে গেছি আজ থেকে,
শুধু সঙ্গমের জন্য নারী নয়।

ঈশ্বরের কাছে প্রশ্ন

চা আর সিগারেটের উষ্ণ ধোঁয়া যখন অন্তরীক্ষ ছোঁয়,
আমি শীতল মনে তোমাকে ভেবে গাল ভেজাই ঈশ্বর!
প্রতিটি অবরুদ্ধ,
নিস্তব্ধ,
হাহাকার বিদগ্ধ রাত কুড়ে কুড়ে পোড়ায় আমায়!
আমার মগজের ঝোলে কারা যেন সেদ্ধভাতে চড়ুইভাতি খায়,
ওরা মানুষ!
ছিঃ ধিক্কার জানাই ওই সব নরপিশাচদের।
ওরা মানচিত্রকে বিছানা ভেবে ধর্ষন করে কারো ঘুঙুর রাঙানো বোন,
কারো মাতৃতুল্য ভাবী,
কারো নববধূ,
কারো দুগ্ধসহজাত মা।

ওরা,
ওরা মরচে পড়া টিনের চালে শকুনকে মানুষের হাঁড়-গোড় খেতে দেয়,
ওরা আঁতুরঘরে মায়ের বুকের দুধ খায়নি,
মুখে নেয়নি মধু।
ওদের জন্মলগ্নের সময় মসজিদে আযান হয়নি,
বাহুতে দেয়নি মুয়াজ্জিনের দোয়া পড়া কবজ।
ওরা জন্মেছে বেশ্যাপাড়ার দুর্গন্ধ ডোবায়,
জন্মেছে গরুর বাচুরের মত মাটিতে পড়ে,
জন্মেছে শেয়াল কুকুরের বীর্যে!

নিপীড়িত,
নিক্ষেপিত,
পরাজিত,
বিতাড়িত কিছু হায়েনার লালসার স্বীকার হওয়া মহীয়সী নারীর পবিত্র গর্ভে ওদের জন্ম।

আমি মাঝরাতে সমুদ্রের কান্না শুনি,
বাস্তুহারাদের আর্তনাদ আমার বিবেককে শুলে ঝুলায়,
মানচিত্রের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে আমি সাদা কাপড়ে পবিত্র রজঃচক্রের রক্ত খুঁজি।
এক ফোঁটা স্বাভাবিক রক্ত আমি পাই না!
বৃথা রোদনের ডাকবাক্সে অশ্রুকলমে লেখা চিঠি পড়ি,
আর তব্ধা খেয়ে হাসি।
আমার কান্না যে আজ মৃত,
মৃত কান্নারা এখন হাসে।

সবাই ভালো মানুষ,
আমি বাদে।
কারণ আমার কষ্ট হয় নির্যাতিত মানচিত্রের বুকের সবুজ মানুষগুলোর জন্য।

কাকে দোষ দিবো আমি?
ঈশ্বরকে ছাড়া কাউকেই তো পাচ্ছিনা।

মানবীর হাতে মৃত্যু

হয়তো খুচরো পয়সার মত একসময় আমি হারিয়ে যাবো তোমার বুকপকেট থেকে,
কেউ সমুদ্র তীর থেকে ঝিনুকের মত কু্ড়িয়ে আনবে না,
হয়তোবা শো শো করে আসা মাতাল ঢেউ'র বিধ্বংসী স্রোতে টেনে নিয়ে যাবে মাঝ সমুদ্রে,
লক্ষ লক্ষ নুড়ির মিছিলে আমি এক ক্ষুদ্র চিরকুট।
জলে মিশে যাওয়া কিছু শব্দ,
সৈকতে আহত মাছের মত কাতরে কাতরে জীবন্ত রোদ খাবো,
হামি খাবো ঠোঁট তুলে।

কোন এক মানবীর ক্লিভেজে চুমু দিয়ে এসেছিলাম সমুদ্রস্নানে পবিত্র হবো,
সাহিত্যের মতাদর্শনে নিজের কবিয়াল মনকে ধনাঢ্য করবো,
কবিতার বালিশে শির রেখে মৃগনাভীর সুগন্ধির ন্যায় সেই মানবীর গন্ধ নিয়ে কোলে ঘুমিয়ে যাবো।

নারীর যে গঙ্গাফড়িংয়ের মত সবুজ মন,
ব্যথার বাণে ঘাই মারতে মারতে আমি লুটিয়ে গিয়েছিলাম সেইবার,
হৃদয়ে ধারন করেছিলাম পরেরজন্মেও আমরা একে অন্যের সম্পূরক হবো যেমনটি আয়নার সামনে দাঁড়ালে হয়;
আমি বারবারই ভূলে যাই মানবীর চুমু আমার জন্য হেমলক!
মানবীর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে সৌভাগ্যবান মৃত্যুঞ্জয়ী কোন পুরুষ আছে বলে আমার জানা নেই,
মহাকালের গোরস্থানে আমাকে সমাহিত করা হোক!

নারী - ২

নারী প্রেমিকা হলে হয় কবিতা,
প্রস্থানে হয় সার্থক পূর্ণগল্প।

শেষদূত

বুকপকেটে তোমার স্বচ্ছ আলোর ওম জমেছে,
যে আগুনে আমি হিমশীতল বাতাসে উষ্ণতা পাই,
পাই স্বর্গসুখ,
আশার মশাল জ্বালাবে কবে?
হৃদয়ের ভাগাড়ের ডোবাজলে ভাসে কচুরিপানার ভ্রম,
নিঃশব্দ জগত সংসারে এবেলা ওবেলা করে আমার সন্ধ্যা ঘনায় তোমার বৈঠকখানায়,
মারনাস্ত্রে উরুর পকেটে বিলি কাটে শিশ্নের দরজায়,
তবুও অগত্যা দিন চলে যাচ্ছে হেলেদুলে,
সীমাহীন জটিলতায় বুকে বাঁশ গেড়ে বসে আছে মহাজন,
মাচার উপর কল্কি টানে,
গান টায়,
অবশিষ্ট ছাঁই ফেলে আমার নিতম্বের খাঁজে,
মহাজনের পৈশাচিক অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে তোমার মুখপানে চেয়ে।
ইচ্ছে করলেই বড়বাবু আমার কলিজা টান দিয়ে মৃৃত্যুসুধা পান করাতে পারে,
অথচ দ্যাখো অদেখা ভালোবাসার দোহাই বুকে নিয়ে বেঁচে আছি দিব্যি,
পাপের করাঘাতে অতিষ্ট ঝুলন্ত জীবন,
তুমি হাত বাড়ালেই বেঁচে ফিরবো ভুলেভরা দুয়ার থেকে,
জানালায় চোখ রাখলেই গর্ভবতী হবে পৃথিবীর সকল বন্ধ্যা নারী,
জরায়ুতে জ্যান্ত বীর্যের ঢল নামবে আষাঢ়ের মতন,
ফুল তো সারাবছরই ফুটে,
সকল ঋতুতে,
তোমার শ্বাসে কামউত্তেজনা বেড়ে যাবে সপ্ততলায়,
বেদ শাস্ত্রের ভুল ত্রুটি জনসম্মুখে খুলে যাবে তখন,
ত্রিপিটকের সকল গোঁড়ামি নিঃশেষ হবে,
গীতার অনৈতিক যত কর্মকান্ড ধুলিসাৎ হবে,
বন্ধ হবে সকল হানাহানি,
ধর্ষন,
রাসলীলা,
মহাজনের চাটুকারীতার অবসান হবে,
তোমার আশার অপেক্ষায় সকল বাস্তহারা,
বেদনার সমুদ্রে ডুবন্ত সকল মানুষের আহাজারি ভেঙে যাবে,
পৃথিবী আবার সৃষ্টি হোক নতুন "তুমিতে",
ঈশ্বরের স্ব-ইচ্ছায় জন্ম হোক তোমার।

তিতিরকে লেখা শেষ চিঠি

তিতির এখন কি তোমার জানালার পাশের জারুল গাছে মাঝে মাঝে কোন কাক ডাকে?
আমার দূত হয়ে কি তোমার ঘুম ভাঙায়?
জীবন্ত শব্দের মিছিলে কি তোমার মৌবনে ঘ্রাণ আসে সর্প জড়ানো রজনীগন্ধার মিথ হয়ে।

তোমার চুলের বেণী কি এখনো করো?
যে বেণীতে আমার কবিতার নির্যাস ছিলো,
লাল টুকটুকে বেণীর দোলনায় দোল খেতো আমার ফিকে হওয়া রাবীন্দ্রীক হৃদয়।
চিরুনীর অস্ফুট শাবলে কি তুমি আজো খুঁজে পাও আমার শীৎকার,
যে শীৎকারে ভারী হয়ে যেতো চারদেয়ালের বারান্দা।

অর্কিড গাছটা কেমন আছে তিতির?
কতদিন ওর গোড়ায় পানি দেয়া হয়না,
হয়না তোমার আটকে যাওয়া আঁচল ছুটানো,
টবের গায়ে শৈবাল জমেছে তাই না?
আমার আমি মন খারাপ করে অর্কিডের সাথে কথা বলতাম,
তুমি লাল শাড়িতে পিছন দিক থেকে এসে জড়িয়ে ধরতে,
তখন দেবদারু গাছটা লজ্জা পেতো ভীষণ,
আড়চোখে তাকিয়ে থাকতো আড়াআড়ি রোদের রশ্মি।

তিতির গ্রামাফোনে কি গান শুনো এখনো,
যে গ্রামাফোনের গান আর তোমার ভেজা চুলের গন্ধে আমার ঘুম ভাঙতো দিনের শুরুতে,
তিতির ক্যালেন্ডারটা পেরেকে কি তোমার অন্তবাস ঝুলে এখনো?

ওহ এখন তো তোমার আলমারী আছে,
আছে নামীদামী আসবাবপত্র,
কাপড় ঝুলে থাকা রশিগুলো হয়তো এখন নেই,
নতুন টাইলসের ওয়াশরুমে তুমি স্নান করো ইদানিং,
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শরীর থেকে ধুয়ে নাও আদর।

আমার বিদ্রোহী নখের আঁচড়গুলো কি তোমার ঘুমটা নষ্ট করে রাতে?
চিনচিন করে পোড়ায় না তাই না?
ব্লাউজের হুকে স্পর্শ পেলে আমাকে মনে পড়ে?
তিতির নীল শাড়িটার কথা মনে আছে তোমার,
যে শাড়িটা পরে প্রথম আমার সামনে দাঁড়ালে, আমি অভূক্তের মত চেয়ে চেয়ে তোমাকে দেখেছিলাম,
তুমি বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ফ্লোরে নখ ছড়াচ্ছিলে লজ্জায়,
শিহরণ বয়ে যাচ্ছিলো গোলাপের গন্ধে,
সৌরভ ছড়াছিলো তোমার শরীরে।

তিতির হাতে ব্রেসলেটটা কি আছে এখনো?
নাকি সোনার অলংকারের ভিড়ে পরা হয়ে উঠে না।
নাকফুলটা কি অবেলায় ঝরে পড়ে?
আমি খুঁজে দিতাম তোমায়।

আধা নষ্ট হওয়া কপালের টিপ কি খাটের পাশের দেয়ালে লেগে আছে?
তুমি আমাকে প্রায়ই বলতে;
'তুমি আমাকে যে কেন টিপ পড়তে বলো,
শুধু শুধু খুলে ফেলো, চুমু দিতে গিয়ে নাকি অসুবিধা হয় তোমার"।

এমনি করে রাখতে রাখতে কতগুলোই না জমেছিলো। এখন আর হয়তো জমে না। ভালোই আছো।

সর্বসাধারণের কবিতা

আমার একটা জোড়াসাঁকোর বুক দরকার ছিলো,
নিদারুণ প্রয়োজন ছিলো,
যে বুকে নিদ্রাহীনতার বিশাল খন্ডাকৃতির ঘুমরাত কেটে যাবে নিমিষেই,
যে বৈধ বুকে আমার শব্দেরা লুটোপুটি খাবে সুরসুরি পেয়ে,
আলগোছে শির তুলে জানান দিবে কবিতা তুমি আজ প্রিয়তমার দেহে আশ্রয় নাও,
বাস্তুহারাদের মত আঁচড়ে পড়ো প্রিয়তমার উনবিংশী শরীরের চিলেকোঠায়,
সাহিত্যের দুর্যোগে ভেসে বেড়াও কদলীর ভেলায় চড়ে,
কার্ণিশে প্রতীক্ষা করো কাল থেকে মহাকাল অবধি,
যে জমিনে আমি আবার পুনঃজন্ম নেবো।

আমার একটা কবিতার রাফখাতার মত বুক দরকার ছিলো কবিতার দুঃসময়ে,
যে খাতায় অনায়াসে লিখে নিতাম পৌরাণিক কিংবদন্তীদের মত শত শত কবিতা,
যে কবিতা দেহের কথা বলবে,
দ্রোহের কথা বলবে,
আত্মার কথা বলবে,
প্রেমের বিশ্লেষণীয় তর্জমার কথা বলবে,
কাঁটাতারের কথা বলবে প্রতিবাদী ভাষায়,
যে কবিতা দেশের কথা,
দশের কথা,
দেশ প্রেমের কথা বলবে,
ভাষা আন্দোলন,
যুদ্ধ বিজয়ী পতাকার কথা বলবে,
যে কবিতা কিশোরীর নুপুরের কথা,
কৃষাণীর ধানের কথা,
নবান্নের কথা বলবে,
যে কবিতা ভেসে যাওয়া ভ্রুনের কথা বলবে।

ষাটের কোঠায় শূন্য জীবন

তারপর কেটে গেছে তিনশত সাতষট্টি রাত। একটা বুক খুঁজে নিয়েছো ঘুমাবে বলে। আমাকে তোমার বালিশ থেকে সরিয়ে দিলে। বড় এবেলা ওবেলা করে রাত যায় আমার। তুমি নিদারুণ অভ্যাস করে নিলে। আমার অভ্যাস তুমিই রয়ে গেলে। সিগারেটটা নতুন করে যোগ হলো। তুমি বিয়োগ হলে। ভাগফল খুঁজতে গিয়ে দেখি আমিই অবশিষ্ট নাই। সমীকরণের উত্তর শূন্য। ব্যাকরণে নিয়ম নীতি সবই আছে। তুমিও নিয়মে। আমিই শুধু অনিয়মে। পদার্থে তুমি স্থির। আমি ত্বরণ হারিয়ে গতিহীন স্থিমিত। রসায়নে রস আছে। আমি নিরস। তুমি সরস কারো সিমেনে। আমি জীববিজ্ঞান পড়েও তোমাকে বুঝতে পারিনি। তুমি বিজ্ঞ ছিলে। আমাকে মূর্খের মত ছেড়ে দিলে। শোধরাও নি। অথচ তুমি সজীব কারো আদরে। আমি অনাদরে আঁতকে উঠি মাঝ রাতে। ভূগোল কখনোই আমি পারিনি। মানচিত্র। কাঁটাতার। দ্রাঘিমারেখা। অক্ষরেখা। কখনোই বুঝতাম না। কিন্তু আমি তোমার শরীরের মানচিত্রে আটকে আছি। স্মৃতির বেড়াজালে বন্দী। যাবজ্জীবন। তুমি স্বাধীন কোন পুরুষে। আমি পরাধীন তোমার মনের দেশে। অর্থনীতিতে কাঁচা ছিলাম। তুমি নিজের হিসাবটা করে নিলে ষোলআনা। আমার কানাকড়িও নেই। আমাকে নিঃস্ব করে দিলে বাস্তুহারার মত। তুমি ঠিকই আশ্রয়ে। আমি নিরাশ্রয়। সহায় সম্বলহীন। তুমি নগ্ন শরীরে কম্বল মুড়ি দাও। কেউ সাথী হয়। অথচ দেখো আমি সাথীহারা। তারপরও কেটে গেছে তিনশত সাতষট্টি রাত। কাল আটষট্টি হবে। পরশু উনসত্তর। আমার অভ্যুণ্থান আর হয়না। আমি যে থমকে আছি।

শূন্যতায় যাবজ্জীবন দন্ডাকৃত আমি

আমার স্বত্বাধিকারী একটা আকাশ ছিলো!
তাতে তুমি ছিলে একটা শশী দ্বিপ্রহরী আহ্লাদে,
ঘোর বরষায় আমাকে ঢেকে রাখতে ইথারীয় আঁচলে,
আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তোমার সুবাসিত কেশে নাক ডলতাম;
মারিজুয়ানার চেয়েও প্রবল নেশা ছিলো!
নিকোটিনের চেয়ে অধিক বাদামী ছিলো, তোমার চুলের রঙে রংধনু খুঁজে পেতাম,
এক রঙেই তুমি আমার শত রঙ ছিলে;
গাঢ়,
হালকা,
বিশ্লেষিত মৌলিক রঙ।

আমার একটি বৃষ্টি ছিলো!
তুমি বারোমাসি কাদাসিক্ত মৃন্ময়ী যৌবনা উঠোন,
আমি শুয়ে শুয়ে গায়ে মাখতাম তোমার ভেজা ঘাম,
মিশে যেত,
একটা কবিতার জন্ম হতো তোমার বুকে,
ক্লান্তিতে আঁচড়ে পড়তাম,
তুমি থোতা ধরে মুখ তুলে গলার নিচে কামড় দিতে আবেগে!
অতিরিক্ত ভালবাসায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো।

হঠাৎ কোথা থেকে জারজ একখন্ড মেঘ এলো আমাদের জোড়াসাঁকোর আকাশে,
দুটো পথ দু দিকে বাঁক নিলো,
ইউ টার্ন হয়ে গেলো ভালবাসার ধলেশ্বরীর পথ।
তুমি রেখে যাওয়া মোড়েই আমি এখন মদ গিলি,
নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি,
দৃষ্টি কোনরকম একটু তুলে দিন আর রাতের ফারাক দেখি,
হাতঘড়িটাও অকেজো এখন,
সময়ের তাড়া নেই অযাচিত অনুক্ষনকে কেন্দ্র করে।

আমি ভূলে যাই আমি একা!
কবিতায় আমার আহার মিলে,
শব্দ আমার রোজকার নাস্তা,
কাব্য আমার কাছে নিছকই একটা বনরুটি!
তুমি চলে যাবার পর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি,
সিগারেটটাই ইদানিং যাবত একটু বেশি খাচ্ছি;
আমি একা!
আমি যাবজ্জীবন কারাদন্ডী কয়েদীর মত একা,
ধূ ধূ মরুভূমির মত একা,
পুরুষাঙ্গের মত একা,
ধোঁয়ার মত একা উড়ি,
বাস্পে মিলে যাই উড়তে উড়তে,
আর বেঁচে আছি মরতে মরতে।

একটি পবিত্র কবিতা চাই

আঘাতে আঘাতে জর্জরিত সম্ভাবনাময় একটি কবিতার অমরত্ব চাই।
যে কবিতার গায়ে থাকবে না কোন চাবুকের রক্তাক্ত ফিনকির লোহিত ধারা।
খুব করে চাই একটি কবিতা জন্ম নিবে শকুনে খুবলানো মরা লাশের পাশে,
বুদ্ধিজীবিদের বাসি মগজের পাশে।
আততায়ীর পশ্চাতাঘাতে ভূমিশায়ী মানুষের শত ক্রোধের কথা বলবে,
বলবে আত্মহত্যা করা সাবিরা আর ধর্ষিত তনুদের কথা।

রমনীখেঁকো বেজন্মা কাঙালদের ঘরে জন্ম হউক বজ্রকন্ঠের সোনালি দোয়াতের কলমী কবি।
নিদারুণ চাতকের অপেক্ষার মত চাই নামে মাত্র একটা কবিতা জন্ম হউক সাংবিধানিক টেবিলে,
মুক্তিযোদ্ধার জরাগ্রস্থ জীর্ণকুটিরেও হউক;
পার্লামেন্টের ডেস্কে থাকা শত শত ধুলোজমা ফাইলের উপর টিকটিকির বিষ্ঠার মত বিদঘুটে অন্তত একটি কবিতার জন্ম হউক।

খালে-বিলে আর ডোবায় জন্তু জানোয়ারের মত ভেসে থাকা চার পাঁচ মাসের নগ্ন ভ্রুণের দেহে একটি পবিত্র কবিতার জন্ম হউক,
মহাকালের শেষ সাক্ষী রাতের বুকে শীতার্ত বাস্তুহারাদের জন্য একটি কবিতার জন্ম হউক,
মুখোশধারীদের উত্তপ্ত বীর্যে সস্তা স্নো-পাউডার ধুয়ে যাওয়া খাটের উপর একটি কবিতার জন্ম হউক।
নিবিড় প্রকৃতির ক্লিভেজে থেকে শুরু করে প্রিয়তমার খামচানো বিছানায় একটি সজীব কবিতার জন্ম হউক,
আঁতুরঘরের মেঝে থেকে ময়নাতদন্তের মর্গ পর্যন্ত একটি মিথ্যা কবিতা কবিতার জন্ম হউক,
বেশ্যালয় থেকে বিদ্যালয়;
উপাসনালয় থেকে নব বধূর শয্যালয় পর্যন্ত একটি কবিতার জন্ম হউক।

যে কবিতায় থাকবে না ক্ষমতার মায়াজাল,
রাজনীতিক চাল।
থাকবে না অনাহারীর পুনঃজন্মের অভিশাপকৃত অভাব,
থাকবে না 'বাংলাদেশ' নামক জননীর মানচিত্রে হাজার আঁচড়ের দাগ,
কোল খালি হওয়া নির্বিচারকৃত খুন।
চাই না আর কোন 'মা' বুক চাপড়ে কাঁদুক!
তবেমাত্র শুধু একটি কবিতার বেজন্ম হউক!
ব্যাঙের ছাতা থেকে শত শত দূর্বাঘাস প্রতিদিনই বেদুঈনের মত জন্ম নিচ্ছে,
আমি তো শুধু একটি কবিতার'ই জন্ম চাই।
যে কবিতা আমার, তোমার, তাদের, আমাদের সবার।
নোমান আহমেদ এর গুচ্ছ কবিতা

নোমান আহমেদ এর গুচ্ছ কবিতা

নিশ্চিহ্নকরণ

পথে পড়ে পাওয়া কাঠ পেন্সিল। কারো থেকে চেয়ে নিয়ে সাদা পৃষ্ঠা— আঁকতে শুরু করি নিজের অবয়ব— আপন গ্রন্থি। অবয়বের মধ্যে যদিও মুখটাই মূখ্য; তবুও আঁকি সমস্ত অঙ্গ—লিঙ্গ সংযোগে। আঁকি দেহের নানান জটিলতা। আঁকা শেষ হলে পেন্সিল রেখে হাতে তুলে নেই উন্নত ইরেজার। পাওয়া যায় ইরেজার থরেবিথরে। মুছতে শুরু করি পা থেকে এবং মাথা অব্দি পৌছাই;

ছেলেবেলা

হারিকেন রোদের পাশে মুখখানি উজ্জ্বল
কার? ভীষণ চেনা লাগে, ঘোমটার ভেতর!

পাঠের আলস্যে নিদ্রাচ্ছন্ন চোখের পাতা

বেথল পাকছে বনে
নীড়ে ফুটছে দুটো পাখিদের পোনা
জলের কোনা ধরে শাপলার হাসি তুলে
মালা গেঁথে গলার হার—ফাটিয়ে ঢ্যাপের পেট
পরিতৃপ্ত আহার কালো দানা

বিয়ারিং গতির পিঠে ভর রেখে ধুলোর সড়ক
সুপারি খোলের যান সওয়ার তুমি আমি ড্রাইভার

কলার ভেলায় ল্যাংটা শিশুরা যাচ্ছে সাঁতার
আর গামছার আজলায় ধরছে ডানকোনা—
ধুলো ভাত, কচতুরি চিকেন, মিছে সংসার

জলের বুক বেয়ে ঢোঁরা এক চ্যালচেলা

ধারাপাতের মতো আজো কেউ
মুখস্থ করছে ছেলেবেলা

কবিতা

কবিতা তখন প্রিয়—

যখন আমার মাগিটা কাছে নাই
গন্ধ নাই, মিশমিশে গতরখানা নাই
ছোঁবার দূরত্বে নাই মাই ঠোঁট নাভি
যখন ঢুকে পড়বার জন্য আর্দ্র যোনি নাই

কবিতা শুধু প্রিয় তখন—
যখন হাতের মুঠোতে কোন আনন্দ নাই
আঙ্গুলে নাই রক্তজবার প্রস্ফুটন
রক্তে নাই কোন বারুদের ঘাই

প্রেমিকাকে পেলে কবিতাকে লাথি মেরে
ফেলে দেই দশ হাত কিংবা আরো বহুদূর।

দুপুর

রোদ পোহাচ্ছে বাতাসের শরীর
বৃক্ষ ও ঘাসের আদর মেখে নিয়ে
সাঁতার কাটছে—তরঙ্গে নেচে ওঠা নদী বুক—

নিঃসঙ্গ মাঝি ঐ নৌকা বেয়ে কতদূর যাচ্ছে!

আলোর বল গড়িয়ে গড়িয়ে
উঠে এলে মাথার উপর
শহর ঘেমে জবজবে

আর লোকে তাকে দুপুর নামে ডাকে

মনে পড়ে, একদা আমারও এক দুপুর ছিলো;
ঘুরাতো হাওয়ার ভেতর এবং
সে ছিলো তাপহীন— শীতল।

এখন যে দুপুর ল্যাবরেটরির মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘামছে;
শুনেছি তার কোন প্রেমিকা নাই।

বাবা

বাবাগুলোকে কখনো আলাদা করতে
পারিনা আমি—
না স্নেহে, না শাসনে
না আদর্শে, না উপদেশে—
বাবাগুলো একই রকম আশ্চর্য ও গম্ভীর!

বাবাগুলোর পোশাক একই রকম
বাবাগুলোর ঘড়ি একই রকম
বাবাগুলোর ব্যাগ ও জুতোও একই রকম
প্রতিটি বাবার শরীরে একই রকম গন্ধ থাকে
প্রতিটি বাবার চোখ একই রকম মাইলস্টোন
প্রতিটি বাবা য্যানো হেঁটে যান একই ভঙ্গিতে—
সন্তানের ভবিষ্যৎ কাঁধে নিয়ে

বাবাগুলো দেখতে ঠিক একই রকম— বাবার মতো;

ফুল বিষয়ক

এসব ফুল ভাতের বিকল্প হতে পারতো
অথবা পাপড়ি গুলো হতে পারতো পাস্তা
হতে পারতো ফ্লাওয়ার চিপ্স
মচমচে হতে পারতো, মজাদার হতে পারতো
ক্ষুধা পেলে তুলে খেতে পারতো বুভুক্ষু
বিস্কুট হলে চায়ে চুবিয়ে খেতে পারতো সবাই

অথচ ফুল এসবের কিছুই হলোনা—
কেবল স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি হলো;
কপট মন্ত্রীর গলায় মাল্য হলো;
নব বর-বধুর বাসর সজ্জা হলো;

ম্লান হলো শুধু ম্লান হলো—

আর ঝরে পড়ার আগে
তোমার খোঁপায় টুপ করে গুঁজে পরা ছাড়া
ওরা আর কোন নির্মাণ শিখলোনা—

বুলেটের বিকল্প হতে পারতো এসব ফুল;
দু-দশ রাউন্ড বুকে গেঁথে দিলেও বিরূপ যন্ত্রণা হতোনা।

সড়ক

তুমি সড়ক হয়ে শুয়ে পড়ো
আমি তোমার ভেতর দিয়ে দৌড়ে চলে যাই—

যেমন দৌড়ে চলে যায় বাস
যেমন দৌড়ে চলে যায় ট্রাক
যেমন দৌড়ে চলে যায় প্রাইভেটকার
নতুন সোয়ারি নিয়ে মজিদ মিয়া টমটম ছুটায়
ব্যাক ছিটে প্রেমিকাকে চেপে সিনেমার কায়দায়
দেড়শো সিসি বাইক দাবড়ায় প্রেমিক, পাড়ার মাস্তান

পুলিশের তাড়া খেয়ে যেমন প্রাণপণ ডাকাত দৌড়ায়

তেমন দৌড়াবো আমি,
প্রবল গতি রবে পায়,
সড়ক হয়ে তুমি সঠিক ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ো
তোমার ভেতর দিয়ে আমি দৌড়ে চলে যাই।

শীত

বয়স্ক শোকের মতো নেমে আসে শীত
শীর্ণ হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ে
ঢুকে পড়ে আমাদের ভাঙা ঘরে—
আর আমরা তখনো উলে বুনিনাই ছোয়েটার

তবু আমরা এবার জঙ্গলে যাবো
ফায়ার ক্যাম্প করবো
রাতভর গান হবে—কেউ কেউ নাচবো যুগল
লোকাল মদের সাথে মাংস পোড়া খাবো,—
দূরে ঘাই হরিণীর শিৎকার শোনা যাবে

তারপর সব উৎসব থেমে গেলে—
হৃদয় ছুড়ে দিয়ে আরো শীতের দিকে
আবার আমরা কুয়াশা কুড়াতে বসবো
টুপ টাপ শিশির ঝড়াবো চোখে।

আত্মহত্যা

আত্মহত্যার আগে স্নান ঘরে যাই
উলঙ্গ হয়ে ছুঁয়ে দেই সর্বাত্মক শরীর
শরীর এক আশ্চর্য ম্যাজিকবক্স—
তুলনা নাই;
নিজের স্পর্শে নিজেই প্রচন্ড অধীর
ভাব-প্রকল্পে ১ম প্রেমিকার কথা ভাবি—
দুচোখ ক্রমশ রুধির—
শেষ বারের মতো সারি হস্তমৈথুন
ঘরোয়া ঝর্নার তলে দাঁড়াই—
জলে ভিজি—খুঁজি জলজ মনন—
সাবান-শ্যাম্পুতে ঘষে-মেজে সাফ করি
ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা যাবতীয় শ্যাওলা—

মন সাফের কসমেটিক কখনো কিনি নাই, মাওলা!

আর আয়না এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়
আয়না আমার জমজ বোন—
একই অন্তর বলে তার কাছে কিছুই থাকেনি গোপন!

ভেজা কুন্তল জুড়ে চিরুনি-আঙ্গুল
করে দেয় পরিপাটি—
কপালে নজরবন্দি টিপ রাত্রির আদল
চোখে এঁকে সুর্মার কাজল
পরিয়ে দেই ভাঁজ না ভাঙা নতুন পোশাক
ছিটিয়ে দেই আতর-সুগন্ধি—দু'গালে
আদর করি তারে, কপালে পাতি বিদায়ী চুম্বন—
মৃত্যু মূলত এক মহা-সফর, তারই আয়োজন;
ঘ্রাণ পাচ্ছি—য্যানো কবরে কার ফুটছে গোলাপ!

আত্মহত্যার আগে পান করি পেয়ালা ভর্তি রঙিন সারগাম
গাইছেন নুসরাত ফতেহ আলী খান—সাথে আমিও গাই;
জানালার ওপারেই আকাশ—
মন দিয়ে মেঘের মৃদঙ্গ বাজাই—
জীবন উড়াল দিলো আবৃত্তি করতে করতে ওমর খৈয়াম।

আমাকে কবরে রেখে

আমাকে কবরে রেখে আমি বাড়ি ফিরে আসি; বাড়ি ফিরে গেলে, কেউ আমাকে আর চিনতে পারলো না। মা-বাবা চিনলোনা, ভাই-বোন চিনলোনা। পাই পাই করে পরিচয় দেবার পরও বন্ধুরা কেউ চিনতেই পারলোনা। অথচ গত কালও একসাথে ডিনার করেছি। একমাঠে খেলেছি ক্রিকেট।

প্রবল মন খারাপ নিয়ে পুনরায় হই বাড়ির বাহির, উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকি— আসি 'ক্লাবঘাট'--ওখানে আমার প্রেমিকা থাকে। কলিংবেলের সাথে গেঁথে দেই নাম, নোমান, নোমান,—আমাকে ভালোবাস তুমি—ও সোনা চিনতে পারছো না! প্রেমিকার জবাব আসে সাফ, 'কে তুমি! যাও ভাগো, মোটেও চিনিনা' !

তখন আমার খুব কান্না পেলো। তখন আমার হৃদয় ভেঙ্গে গেলো। টুকরো টুকরো হওয়া হৃদয় পথে ছিটাতে ছিটাতে আমি ঠিক সেই দিকে দৌড়াতে থাকলাম, যেদিকে কিছুক্ষণ আগেই আমি আমাকে পুঁতে এসেছি, সদ্য খোঁড়া এক গোরের ভেতর। তালতাল মাটির মোচড়ে। আর আশ্চর্য হই! দেখি, আমার কবরে আমি নাই—শুয়ে আছেন অন্য কেউ!

মরে গিয়ে শিখেছি, মরে যাওয়া কোন মুখ মানুষ মনে রাখেনা!







নোমান আহমেদ। 
জন্ম: ১৯৮৮ইং। রাজবাড়ী।
হাসনাত নাগাসাকি এর গুচ্ছ কবিতা

হাসনাত নাগাসাকি এর গুচ্ছ কবিতা


রক্তদোষ 

কবিদের প্রতি শেষ আদেশ-
এ তল্লাট ছেড়ে যাও- সরে পড়ো এখনই চুপচাপ।

আর, তোমাদের স্ত্রী ও প্রেমিকাদের কাছে
জমা দাও সন্তানের নামের তালিকা ;
মনে রেখো, যে সন্তান এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি,
তার পিতৃত্বের দাবিদার তুমি নও।
আর শুনে রাখো, আমরা যাদের বার্থ সার্টিফিকেট দেবো-
নাম আর স্বীকৃতির সীলমোহর সাঁটা,
তারা হবে এ তল্লাটে পরবর্তী কবি।

যেহেতু তোমরা কেবল ভালবাসতে জানো,
যেহেতু তা কোনও মহাজনের গোলা
ভরে তোলে না কাঙ্ক্ষিত ধাতব শস্যে,
যেহেতু তোমরা আঙুল তোলো
রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগায়-
সেহেতু এই আবাস তোমাদের নয়।

তোমরা হুকুম তামিল করতে শেখোনি ;
রক্তের দোষ!
তোমাদের পিতৃপুরুষ ও গর্ভধারিণী মা
জন্মক্ষণে বলে দেননি- মাথা নত করতে হয়
কিভাবে - কখন!

নিরাপদ

এইসব নিরাপদ রাত আর দিনগুলোকে কি করবো আমি?
কি করবো আমাকে, এইসব নিরাপদ
রাত আর দিনের ভিতরে ?

বোধের আকাশকুসুম আরামের ধূম্রপথে
ধীর পায়ে চলা, যেন বা স্থবির এ্যমিবা-
যেন বা খোঁয়াড়-পালিত উট- উটের গ্রীবা,
কেন?
কি করবো এইসব গ্রীবার ভিতরে আমাকে
অথবা
আমার ভিতরে অনিচ্ছুক গ্রীবার আবাদ?

এ বিশাল খোঁয়াড়ে আমার
এইসব নিরাপদ রাত আর দিন
পুঁতে রেখে নষ্ট ভূমিতে অনর্থ বীজের বপন-
খেয়ে নেবে ধীরে ধীরে মাটি আর নীরব প্লাবন।
আদতে আমরা সেই জোয়ারের পানি!

কেবল, কখনো কেউ কেউ
সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ভালবেসে যদি
হতে চায় বাঁধভাঙা নদী,
বিধ্বংসী প্রলয়ের ঢেউ -
আমাদের সমুখে দাঁড়ায় এইসব নিরাপদ রাত আর দিন!
খুব ভিতরে টের পাই, মৃত্যুও জীবনের মতোই রঙিন?

ব্যতিহার 

যদি আমি লিখে যাই কিছু কিছু শব্দরূপ-
যেমন- 'মৃত্যু'; যেমন- 'ভালবাসা';
যদি লিখে যাই 'যক্ষ্মা' একটি কষ্টকর জীবনের নাম-
কখনো তোমার হাতে উড়ে গিয়ে পড়লে সেই চিঠি-
কী ভাববে তুমি? কল্পনায়?
ভাববে কি অপত্য ভালবাসাহীন একটি শুশুক সন্তানের কাছে যেতে পারেনি কখনো?
পাল্টানো জলের স্রোতে সন্তানের পাখনা- কানকো
খুঁজে পায়নি পিতার প্রবাল?

ধরো, আমি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিখলাম- 'প্রসাদ' ;
নিদারুণ অভিমান নিয়ে লিখলাম- 'ফেরারি';
অস্থির উন্মাদের মতো লিখলাম- 'প্রশান্তি';-
কোনও সায়াহ্নে বসে একাকী পাহাড়ের অন্ধকার চিবুকের কাছে
গড়িয়ে পড়ার আকুতি জানালে
পাহাড়টি আমাকে বক্ষ খুলে দেবে। আর,
আমি মৃত্যুর বদলে ঝুলে থাকবো স্তনবৃন্তে তার।
যেহেতু জেনেছি পাহাড়ের যোনির ভিতরে যেই ঘুম-
সেই সুধা ছেড়ে আর ফেরা হয় না।

এইভাবে ঝুলে থেকে রাত বাড়বে, হয়তো;
এই চরাচরে বাড়বে স্বাভাবিক শেয়ালের গান;
তুমি হয়তো অংশ নেবে সেই নৈশভোজে!

তখন হঠাৎ উড়ে
তোমার সমুখে পড়লে হলুদ বোতাম-
ঝুলে থাকা ছেঁড়া জামার বুকের উদাম-
কি ভাববে সেই সিল্কি সময়ে?

ভাববে কি- 'বোতামটা লাল হলে আরো ভালো হতো '?

অনাহূত 

শোনা যায়, বাতাস-ছেঁড়া হৈহৈ রৈরৈ?
শোনা যায়, অনাহূত বখতিয়ারের পায়ের আওয়াজ?
সুতরাং খিড়কি খুলে দাও,
তুলে রাখো অসমাপ্ত হাতের কার্যাদি,
কৃষ্ণবর্ণ বহুচর্বিত গলিত রমন।

বামন যুগের শেষ বাঁশি
তোমরাই বাজিয়েছ এ মোহনা-মন্দিরে।
কান্তার পাহাড় হতে  সব ক'টি খিড়কি, অন্দরে-
ঘন অন্ধকারে ডুবে যুবতি, রমনী,
শিশু ও বলিষ্ঠ কাপুরুষ-
ভুলে গেছে আপন সুরত!
অতলান্ত বৃষ্টি প্রার্থনায়
তোমরাই ছড়িয়েছ এ নগর বাতাসে
আবেদন গন্ধী রস, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস!


অতএব
দূর থেকে উড়ে এলে অনাহূত যোদ্ধা বখতিয়ার
ধুলোর- ক্ষুরের শব্দে- খুলে দাও সমূহ দুয়ার।

বিভ্রম

এ দুঃখ গেলো না আমাদের, এই ভ্রান্তি!

তিন রাস্তার মোড়ে গেলেই
আমরা পথ হারিয়ে ফেলি বারম্বার।
তারপর আমরা দশ বন্ধুর নয়জন তিনভাগ হই,
একজন বসে পড়ি তিনরাস্তার মোড়ে।
মূলত একজনের পথ খুঁজে পাবার কথা নয়।

তবু সান্তনা,
আমরা তিন বন্ধু এক আছি, এবং
তিন পথের একপথ ধরে চলছি এখনো।

চলতে চলতে আরেকটু সামনে গেলেই
আরেকটি চার রাস্তার মোড়।
চারভাগ হতে গিয়ে দেখি - চার রাস্তার মোড়ে
বসে পড়ার লোকটিও কম আছে।

তাতে আমরা থেমে পড়ি না। থামতে হয় না।
অধিকন্তু পেয়ে যাই অচেনা মুখের এক ঝাঁক সাথি।
ভুল রমন উৎফুল্ল করলে আমরা টের পাই না
হাতের উৎস ও পরিধি।

মুলত, পথ বিষয়ে আমরা কবিতা লিখতে পারতাম,
অথবা, পথকে অস্বীকার।
কিন্তু, ততোদিনে দেরি হয়ে যায়।
ততোদিনে আমরা টের পাই, আমাদের ঘাড়ে অন্যের হাত,
আমাদের পায়ে গোপন পথে আসা বিদেশি জুতো।
আমরা চাইলেও আর যেতে পারি না কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে আমাদের।

একটা সফল ভ্রমণ শেষে
আমরা জমা করি নয় বা ততোধিক পথের ইতিহাস।
সেখানে অবশিষ্ট থাকে আমাদের হাড়ে
বিদেশি মদের ঘ্রাণ।

জিলাপির ভিতরে ঢুকে পড়ি

জিলাপির ভিতরে আমি ঢুকে পড়ি-
জিলাপির আঠালো সুমিষ্ট রসের ভিতরে;
জল্লাদের হাতের মুঠোয় ঝুলন্ত দড়ির বিভ্রান্তির ভিতরে।

তারপর একঝাঁকে, একই মিছিলে
দেখা হয় অজস্র জিলাপির সাথে, ঐকান্তিক;
যেন বা খলসে পোনার মতো ছটফটে ধাবমান
এক ঝাঁক মৃত্যু,
এক প্রস্থ্য জীবন অথবা সাইক্লোন-কবলে পড়া নাবিকের জাহাজের শুঁড়!

তারপর, একটি কালচে-লাল পিঁপড়ার মতো
কোন ফাঁকে হয়ে উঠি শীতের 'রসদবাদী'!

কে না জানে -
পিঁপড়ার প্রসঙ্গে দু'টি কথা সমধিক সত্য -
এক, পিঁপড়েরা জিলাপির অন্ধ মুরিদ ;
দুই, লবন দিয়ে পিঁপড়ে খেতে মচমচে মজা!
এটুকু বলেই আমি হেসে উঠতে পারতাম হো হো!
কিন্তু, তৃতীয় সত্য হচ্ছে -
পিঁপড়েরা কাঁদতে জানে না।

যে কাঁদতে জানে না তাকে নিয়ে হাস্য করা সমীচীন নয়।

বিচারালয়

কাঠগড়া থেকে নেমেই গ্যালিলি বললেন
-মহামান্য আদালত, সব কিছুই ঘূর্ণায়মান।
নক্ষত্র, পৃথিবী, চাঁদ,
অক্ষিগোলক,হৃদয়, মানুষের হৃদয়ের ফাঁদ;
এমনকি সত্য, এমনকি মিথ্যা, আপনার হাতের কলম,কলমের নিভ।

মহামান্য আদালত, ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখুন,
পশ্চাতে আপনার ছায়া পৃথিবীর সেরা কৌতুক।
এখনো যারা ঘুরঘুর করে ঘুরছে এই বিচারালয়ে,
মূলত বের হবার পথ ভুলে গিয়ে, তাদেরকে  আদেশ দিন জামা- পাতলুন উল্টায়ে পড়ে আসতে; এবং সঙ্গমকালে তারা যেন সমধিক ঘূর্ণন রপ্ত করে।

মহামান্য আদালত, আমরা যারা আপনাকে মহামান্য বলি- আপনি কি বাড়ি ফিরে রেচনক্রিয়া করতে করতে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন? আমাদের নির্বুদ্ধিতায়?

গ্যালিলিও গ্যালিলি ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর দিকে দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে বললেন,  মহামান্য আদালত,
মানুষ কি ক্রমেই অস্বীকার করছে প্রপিতার নাম?
মানুষ কি দেখতে পাচ্ছে না যারযার মাথার খুলির ক্রম নিমজ্জন?
একদিন, যেদিন অন্ধকারে
টলে উঠবে বিচারালয়, টলে উঠবে চেয়ারের পায়া -
আমি বলবো, এখানে একটি মিথ্যার জাদুঘর হোক।

গ্যালিলিও গ্যালিলির অকস্মাৎ হিসু পেলে -
পৃথিবীর সর্বত্র তিনি দেখতে পেলেন পাপ ও পঙ্কিল ক্ষত।
বিচারালয় তাকে জেলে পাঠালেন।