নোমান আহমেদ এর গুচ্ছ কবিতা

নিশ্চিহ্নকরণ

পথে পড়ে পাওয়া কাঠ পেন্সিল। কারো থেকে চেয়ে নিয়ে সাদা পৃষ্ঠা— আঁকতে শুরু করি নিজের অবয়ব— আপন গ্রন্থি। অবয়বের মধ্যে যদিও মুখটাই মূখ্য; তবুও আঁকি সমস্ত অঙ্গ—লিঙ্গ সংযোগে। আঁকি দেহের নানান জটিলতা। আঁকা শেষ হলে পেন্সিল রেখে হাতে তুলে নেই উন্নত ইরেজার। পাওয়া যায় ইরেজার থরেবিথরে। মুছতে শুরু করি পা থেকে এবং মাথা অব্দি পৌছাই;

ছেলেবেলা

হারিকেন রোদের পাশে মুখখানি উজ্জ্বল
কার? ভীষণ চেনা লাগে, ঘোমটার ভেতর!

পাঠের আলস্যে নিদ্রাচ্ছন্ন চোখের পাতা

বেথল পাকছে বনে
নীড়ে ফুটছে দুটো পাখিদের পোনা
জলের কোনা ধরে শাপলার হাসি তুলে
মালা গেঁথে গলার হার—ফাটিয়ে ঢ্যাপের পেট
পরিতৃপ্ত আহার কালো দানা

বিয়ারিং গতির পিঠে ভর রেখে ধুলোর সড়ক
সুপারি খোলের যান সওয়ার তুমি আমি ড্রাইভার

কলার ভেলায় ল্যাংটা শিশুরা যাচ্ছে সাঁতার
আর গামছার আজলায় ধরছে ডানকোনা—
ধুলো ভাত, কচতুরি চিকেন, মিছে সংসার

জলের বুক বেয়ে ঢোঁরা এক চ্যালচেলা

ধারাপাতের মতো আজো কেউ
মুখস্থ করছে ছেলেবেলা

কবিতা

কবিতা তখন প্রিয়—

যখন আমার মাগিটা কাছে নাই
গন্ধ নাই, মিশমিশে গতরখানা নাই
ছোঁবার দূরত্বে নাই মাই ঠোঁট নাভি
যখন ঢুকে পড়বার জন্য আর্দ্র যোনি নাই

কবিতা শুধু প্রিয় তখন—
যখন হাতের মুঠোতে কোন আনন্দ নাই
আঙ্গুলে নাই রক্তজবার প্রস্ফুটন
রক্তে নাই কোন বারুদের ঘাই

প্রেমিকাকে পেলে কবিতাকে লাথি মেরে
ফেলে দেই দশ হাত কিংবা আরো বহুদূর।

দুপুর

রোদ পোহাচ্ছে বাতাসের শরীর
বৃক্ষ ও ঘাসের আদর মেখে নিয়ে
সাঁতার কাটছে—তরঙ্গে নেচে ওঠা নদী বুক—

নিঃসঙ্গ মাঝি ঐ নৌকা বেয়ে কতদূর যাচ্ছে!

আলোর বল গড়িয়ে গড়িয়ে
উঠে এলে মাথার উপর
শহর ঘেমে জবজবে

আর লোকে তাকে দুপুর নামে ডাকে

মনে পড়ে, একদা আমারও এক দুপুর ছিলো;
ঘুরাতো হাওয়ার ভেতর এবং
সে ছিলো তাপহীন— শীতল।

এখন যে দুপুর ল্যাবরেটরির মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘামছে;
শুনেছি তার কোন প্রেমিকা নাই।

বাবা

বাবাগুলোকে কখনো আলাদা করতে
পারিনা আমি—
না স্নেহে, না শাসনে
না আদর্শে, না উপদেশে—
বাবাগুলো একই রকম আশ্চর্য ও গম্ভীর!

বাবাগুলোর পোশাক একই রকম
বাবাগুলোর ঘড়ি একই রকম
বাবাগুলোর ব্যাগ ও জুতোও একই রকম
প্রতিটি বাবার শরীরে একই রকম গন্ধ থাকে
প্রতিটি বাবার চোখ একই রকম মাইলস্টোন
প্রতিটি বাবা য্যানো হেঁটে যান একই ভঙ্গিতে—
সন্তানের ভবিষ্যৎ কাঁধে নিয়ে

বাবাগুলো দেখতে ঠিক একই রকম— বাবার মতো;

ফুল বিষয়ক

এসব ফুল ভাতের বিকল্প হতে পারতো
অথবা পাপড়ি গুলো হতে পারতো পাস্তা
হতে পারতো ফ্লাওয়ার চিপ্স
মচমচে হতে পারতো, মজাদার হতে পারতো
ক্ষুধা পেলে তুলে খেতে পারতো বুভুক্ষু
বিস্কুট হলে চায়ে চুবিয়ে খেতে পারতো সবাই

অথচ ফুল এসবের কিছুই হলোনা—
কেবল স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি হলো;
কপট মন্ত্রীর গলায় মাল্য হলো;
নব বর-বধুর বাসর সজ্জা হলো;

ম্লান হলো শুধু ম্লান হলো—

আর ঝরে পড়ার আগে
তোমার খোঁপায় টুপ করে গুঁজে পরা ছাড়া
ওরা আর কোন নির্মাণ শিখলোনা—

বুলেটের বিকল্প হতে পারতো এসব ফুল;
দু-দশ রাউন্ড বুকে গেঁথে দিলেও বিরূপ যন্ত্রণা হতোনা।

সড়ক

তুমি সড়ক হয়ে শুয়ে পড়ো
আমি তোমার ভেতর দিয়ে দৌড়ে চলে যাই—

যেমন দৌড়ে চলে যায় বাস
যেমন দৌড়ে চলে যায় ট্রাক
যেমন দৌড়ে চলে যায় প্রাইভেটকার
নতুন সোয়ারি নিয়ে মজিদ মিয়া টমটম ছুটায়
ব্যাক ছিটে প্রেমিকাকে চেপে সিনেমার কায়দায়
দেড়শো সিসি বাইক দাবড়ায় প্রেমিক, পাড়ার মাস্তান

পুলিশের তাড়া খেয়ে যেমন প্রাণপণ ডাকাত দৌড়ায়

তেমন দৌড়াবো আমি,
প্রবল গতি রবে পায়,
সড়ক হয়ে তুমি সঠিক ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ো
তোমার ভেতর দিয়ে আমি দৌড়ে চলে যাই।

শীত

বয়স্ক শোকের মতো নেমে আসে শীত
শীর্ণ হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ে
ঢুকে পড়ে আমাদের ভাঙা ঘরে—
আর আমরা তখনো উলে বুনিনাই ছোয়েটার

তবু আমরা এবার জঙ্গলে যাবো
ফায়ার ক্যাম্প করবো
রাতভর গান হবে—কেউ কেউ নাচবো যুগল
লোকাল মদের সাথে মাংস পোড়া খাবো,—
দূরে ঘাই হরিণীর শিৎকার শোনা যাবে

তারপর সব উৎসব থেমে গেলে—
হৃদয় ছুড়ে দিয়ে আরো শীতের দিকে
আবার আমরা কুয়াশা কুড়াতে বসবো
টুপ টাপ শিশির ঝড়াবো চোখে।

আত্মহত্যা

আত্মহত্যার আগে স্নান ঘরে যাই
উলঙ্গ হয়ে ছুঁয়ে দেই সর্বাত্মক শরীর
শরীর এক আশ্চর্য ম্যাজিকবক্স—
তুলনা নাই;
নিজের স্পর্শে নিজেই প্রচন্ড অধীর
ভাব-প্রকল্পে ১ম প্রেমিকার কথা ভাবি—
দুচোখ ক্রমশ রুধির—
শেষ বারের মতো সারি হস্তমৈথুন
ঘরোয়া ঝর্নার তলে দাঁড়াই—
জলে ভিজি—খুঁজি জলজ মনন—
সাবান-শ্যাম্পুতে ঘষে-মেজে সাফ করি
ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা যাবতীয় শ্যাওলা—

মন সাফের কসমেটিক কখনো কিনি নাই, মাওলা!

আর আয়না এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়
আয়না আমার জমজ বোন—
একই অন্তর বলে তার কাছে কিছুই থাকেনি গোপন!

ভেজা কুন্তল জুড়ে চিরুনি-আঙ্গুল
করে দেয় পরিপাটি—
কপালে নজরবন্দি টিপ রাত্রির আদল
চোখে এঁকে সুর্মার কাজল
পরিয়ে দেই ভাঁজ না ভাঙা নতুন পোশাক
ছিটিয়ে দেই আতর-সুগন্ধি—দু'গালে
আদর করি তারে, কপালে পাতি বিদায়ী চুম্বন—
মৃত্যু মূলত এক মহা-সফর, তারই আয়োজন;
ঘ্রাণ পাচ্ছি—য্যানো কবরে কার ফুটছে গোলাপ!

আত্মহত্যার আগে পান করি পেয়ালা ভর্তি রঙিন সারগাম
গাইছেন নুসরাত ফতেহ আলী খান—সাথে আমিও গাই;
জানালার ওপারেই আকাশ—
মন দিয়ে মেঘের মৃদঙ্গ বাজাই—
জীবন উড়াল দিলো আবৃত্তি করতে করতে ওমর খৈয়াম।

আমাকে কবরে রেখে

আমাকে কবরে রেখে আমি বাড়ি ফিরে আসি; বাড়ি ফিরে গেলে, কেউ আমাকে আর চিনতে পারলো না। মা-বাবা চিনলোনা, ভাই-বোন চিনলোনা। পাই পাই করে পরিচয় দেবার পরও বন্ধুরা কেউ চিনতেই পারলোনা। অথচ গত কালও একসাথে ডিনার করেছি। একমাঠে খেলেছি ক্রিকেট।

প্রবল মন খারাপ নিয়ে পুনরায় হই বাড়ির বাহির, উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকি— আসি 'ক্লাবঘাট'--ওখানে আমার প্রেমিকা থাকে। কলিংবেলের সাথে গেঁথে দেই নাম, নোমান, নোমান,—আমাকে ভালোবাস তুমি—ও সোনা চিনতে পারছো না! প্রেমিকার জবাব আসে সাফ, 'কে তুমি! যাও ভাগো, মোটেও চিনিনা' !

তখন আমার খুব কান্না পেলো। তখন আমার হৃদয় ভেঙ্গে গেলো। টুকরো টুকরো হওয়া হৃদয় পথে ছিটাতে ছিটাতে আমি ঠিক সেই দিকে দৌড়াতে থাকলাম, যেদিকে কিছুক্ষণ আগেই আমি আমাকে পুঁতে এসেছি, সদ্য খোঁড়া এক গোরের ভেতর। তালতাল মাটির মোচড়ে। আর আশ্চর্য হই! দেখি, আমার কবরে আমি নাই—শুয়ে আছেন অন্য কেউ!

মরে গিয়ে শিখেছি, মরে যাওয়া কোন মুখ মানুষ মনে রাখেনা!







নোমান আহমেদ। 
জন্ম: ১৯৮৮ইং। রাজবাড়ী।

SHARE THIS

Author: