গগনউড়া মাঠ
‘…একটি গগনউড়া মাঠ বিক্রয় হবে। মাঠের পরিমান তেপান্তরের সমান। মাঠের ভেতরে আছে নানাজাতের নদী,রংবেরঙের আকাশ আর নানাপ্রজাতির ছোটবড় অরণ্য’।
এই রকম একটা বিজ্ঞপ্তি দেখে শহরের শিল্পপতি কেসি দেব ঠিকানা মত এসে দেখে ম্যাচের কাঠি দাঁত দিয়ে ভেঙে দু টুকরোর একটুকরো থু করে ফেলে সরু অংশে দাঁত খোঁচাচ্ছে যে লোক; তার পরনে ময়লা লুঙ্গি শরীরে কুঁচকানো জামা।
—আমি এসেছি অনেকদূর থেকে—কেসি দেব বলল— শুনেছি গগনউড়া মাঠ নামে একটা মাঠ বিক্রয় হবে। আপনি কি বলতে পারেন সেটা কোথায় ?
দাঁত খোঁচানো বাদ দিয়ে লোকটা এবার কান খোঁচানো শুরু করল। চোখ সরু করে বলল—গগনউড়া মাঠ ক্রয় করতে আসছেন ?
—হ্যাঁ।কিন্তু মাঠটি কোথায় ? মালিক কে ? দামদস্তুর কি?
—অনেক দাম কিন্তু । পারবেন ক্রয় করতে?
—আমি গ্রুপ অব কম্পানিজের মালিক কেসি দেব। পুরো দুনিয়া কিনতে পারি আমি। এখন বলেন গগনউড়া মাঠ কোথায় ?
আঙ্গুল তুলে দেখাল—অইদিকে। একটা খাল দেখবেন । খালের পারে এক তালগাছ ।অইখানে।
লাল গাড়িতে উঠেই হুস করে টান দিল। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর এক মরাসূতার খালের দেখা মিলল। আর খালের পাশেই তালগাছ। মাথার ওপর তালগাছ নিয়ে বসে আছে এক ভিক্ষুক। গায়ে তালিমারা চাদর। আশেপাশে আর কেউ নাই।বিরানভুমি।
গাড়ি থেকেই জিজ্ঞাসা করল কেসি দেব— আচ্ছা, গগনউড়া মাঠ কোনটি ? এর মালিকই বা কোথায় থাকে?
ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে ভিখারিটি বলল— আপনি গগনউড়া মাঠে যাবেন বাবু? সে ত আরও খানিকটা দূরে।উৎরাইল হাটকে বামে রেখে তিন মাইল গেলে ভুমিপুত্রের কাছে ঠিকানা পাবেন । আচ্ছা, ওখানে কেন যাবেন—কিনবেন বুঝি?
—ইচ্ছা আছে। যদি পছন্দ হয়।
—এত দামি মাঠ কেনা সম্ভব হবে আপনার পক্ষে? শুনেছি অনেকেই এসে ফিরে গেছে। কুলায়নি ।
প্রকৃতই বিরক্ত হয়ে উঠল কেসি । এইসব ফকিরমিসকিনদের সাথে কথা বলাই ঠিক না—তার কী পরিমান টাকা পয়সা,এদের ধারণাই নাই।
সে সোজা গাড়ি স্টার্ট দিতেই গাড়ি উড়ে চলল ভূমিপুত্রের দিকে।
ভূমিপুত্র দেখেই বলল— কেসি দেব বাবু,আপনি কি জানেন গগনউড়া মাঠে কি কি আছে?
কেসি ঠিক বুঝতে পারল না, এক গগনউড়া মাঠ নিয়ে এত কথা কেন ? সে এই জীবনে এত এত জমিজমা কিনেছে যে মনে করেও বলতে পারবে না। তার সামনে নিতান্তই এক চাষাজাতীয় লোক কথা বলছে । কথা বলছে এমনভাবে, সে ঠিক নিতে পারছে না। হচ্ছেটা কি ?
কেসি দেবের রোখ চেপে গেছে। সে জীবনে কোথাও হারেনি আজও হারবে না। সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। ভূমিপুত্র বলল— মূল গগনউড়া মাঠ অই দিকে। আয়নালের দিকে।
গাড়ি ছুটে চলল অই দিকে।
আয়নাল বলল— গগনউড়া মাঠ সেইদিকে, জয়নালের দিকে।
গাড়ি ছুটে চলল সেইদিকে।
জয়নাল বলল— জগতপারের ঘাটে চিন্তামুনি জানে সব। নেই দিকে।
বিধ্বস্ত কেসি দেব এসে পড়ল নেই দিকে; চিন্তামুনির বেদীমুলে। চিন্তামণি বললেন— কেসি নিজের দিকে তাকাও । তোমার ভেতরেই আছে গগনউড়া মাঠ, বিস্তৃত আকাশ ।তোমার অন্তরে আছে থই থই করা পরম পাথার। সেখানে ডুব দাও। গগনওড়া মাঠ একা পড়ে আছে,সেখানে দাঁড়াও। আর এখানে বস।
এই বলে একটি আকাশমণি গাছের নিচে কেসি দেবকে বসিয়ে দিল। কেসি দেব বসে বসে কী ভাবল কে জানে ,শুধু এইটুকু বুঝতে পারল— কে যেন তার অন্তরের গহীনে একটি মহাজাগতিক ফুঁ দিল আর সে বোধশূন্যতায় পিছলে পড়ে হয়ে গেল । উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে লক্ষ্য করল— একটি শাদা রঙের গাড়ি এসে বলল— আচ্ছা, গগনউড়া মাঠ কোন দিকে?
শতচ্ছিন্ন পিরান গায়ে কেসি দেব বলল— ক্রয় করবেন বুঝি ? এত টাকা আছে কি আপনার ?
এনায়েত- মজাফফরদের গল্প
শহরের ঠিক মধ্যেখানে পাইন আর দেবদারু পরিবেষ্টিত মাঠে সবাই একত্র হয়েছে; অভিজাত পুরুষদের অভিজাত স্ত্রীরা। দেখা হয় প্রায় প্রায়ই,বিকেলে।
স্ত্রীদের হাতে থাকে চেইন; চেইনের মাথায় আটকে থাকে বিদেশি কুকুর। তারা চেইনে টান খেতে খেতে ঘোঁত ঘোঁত করে আর স্ত্রীদের হাত নরম হওয়ার ফলে সে-হাতে শক্তি থাকে কম। ফলে স্ত্রীদের গলায় আহ্লাদ থাকে পুর্ণরুপে। কৃত্তিম বিরক্ত ঢেলে বলে— আহ মজাফফর এমন করে না ! দুষ্টুমি করে না লক্ষ্মী!
শুনলে মনে হবে— মিসেস ধানমন্ডির কুকুরের নাম মজাফফর— ব্যাপারটা আসলে সেরকম না। অভিজাত স্ত্রীরা তাদের কুকুরদের নাম স্বামীদের নামে করে থাকে।পুরুষরা এই খবরের কিছুই জানে না। এই গোপন তথ্য শুধু স্ত্রীমহলই জানে। সুতরাং , গ্রে হাউন্ডরূপী মজাফফরকে যখন দুষ্টু বলে আহলাদ করে তখনও সে দুষ্টুমি করতেই থাকে। মজাফফর/ গ্রে হাউন্ডের মতই গন্ধ শোঁকে । ঘাসে মাটিতে কাদায় । স্ত্রীদের দামী শাড়িতে। গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সেলে বেশি চাপ পড়লে গায়ের ওপর ঝাঁপিয়েও পড়ে কখনও কখনও। আজকেও অইরকম।
দুষ্টুমি করে না , করে না— বলে রাগ দেখায় মিসেস ধানমণ্ডি । মিসেস বনানী বলে— আপনারটা একটু বেশি নটি ভাবী। আর কী কিউট! বলে একটু আদরও করে দেয়।
মিসেস ধানমণ্ডি বলে— নটি হলে ত ভালোই ছিল,আমারটা বুঝলেন ভাবী, খুব ক্রেজি । সামলাতে দম বন্ধ হয়ে যায় ।
—ওমা তাই নাকি ! এইবলে আকাশে চোখ তুলে অবাক হয়— মজাফফরকে একদিনের জন্যে দিয়েন ভাবী। দুষ্টু মজাফফর কত দুষ্টু কতটা ক্রেজি একবার দেখব। আমার এনায়েতুল্লাহকে না হয় একদিনের জন্যে ধার নিয়েন।
মজাফফরকে এনায়েতুল্লাহর সাথে বদলে নেয়ার এই প্রস্তাবে উত্তর দেয়ার আগেই মিসেস ধানমণ্ডির ফোন বেজে ওঠে— সিঙ্গাপুরে ? যাওয়ার আগে একবার জিজ্ঞেস করারও ইচ্ছে হয় না? তোমার সাথে কে গিয়েছে ?নিশ্চয়ই তোমার সেক্রেটারি । হ্যাঁ হ্যাঁ , জানি সব জানি।
লাইন কেটে দেয় ।
— কি হল ভাবী?
—দেখুন না ভাবী , হাজবেন্ড যদি মাসের তিরিশটা দিনই বিদেশে পড়ে থাকে কেমন লাগে?
—আর বইলেন না ভাবী , আমার হাজবেন্ড কতদিন ধরে বিদেশে আমি ভুলেই গেছি। আগে ফোন টোন দিত । এখন তাও দেয় না। সে যাক । এই ভাল আছি । আমার এনায়েতুল্লাহকে নিয়ে আছি বেশ , কী স্লিম ফিগার দেখেছেন ভাবী?
এলসেশিয়ানকে দেখিয়ে কুট কুট করে হাসে মিসেস বনানী।
এদিকে যখন এনায়েত আর মজাফফর অদল বদল হয়ে যাচ্ছিল তখন মিসেস গুলশান মাঠের অন্যপাশে মিসেস উত্তরার মধ্যে কি কথা হচ্ছিল , আদৌ কিছু অদল বদল হচ্ছিল কিনা শুনতে পাইনি। তবে তাদের দুজনের হাতে শেকলে ধরা ছিল এম মহিউদ্দীন এবং চৌধুরী কুরবান আলি।
কুমির বিষয়ক ধুলো
এই নদীতে কুমির নেই।ছিলও না কখনও ।
এইসব নদীতে; এমন জলটলটলা পিঁপড়েলাগা মিষ্টি জলের নদীতে কুমির থাকে না। এটা সাধারণত। প্রধানত হয় কি না জানা নেই, তবে দুইবেলা নিয়ম করে জোয়ার ভাটা হয়—সেটা প্রাকৃতিক। একবার এক মাঘীপুর্ণিমারাতে জোয়ারের কালে আকাশে মস্তবড় চাঁদ উঠেছিল;জনশ্রুতি আছে, সেবার নাকি জোয়ারের পানির সাথে ভেসে এসেছিল একটি কুমির ।
কুমিরটিকে কেউ দেখেনি।
নরেন জোয়ারদারের অনেকগুলি চোখ,সেজন্যে কোথায় কী ঘটে— দেখতে পায়।তার উঠানে ভিড় করে আসা গ্রামের মানুষদের বলেছিল— চৌইদ্দ হাত লম্বা কুমির। আরে লেঞ্জাটাই ত হইব তোমার নয় হাত। লেঞ্জার কী ডক! খাঁজ কাটা, খাঁজ কাটা।
গ্রামবাসী ভয় পায় । ভয় পেয়ে পোতায়ে যায় ।
কাটাভরা শবীরের কথা বাদই থাকল, অই নরেন জোয়ারদারের বর্ণনা সুত্র ধরেই অর্ধডোবা মাথা আর ড্যাবড্যাবে চোখ না দেখেও ভয়ে কাঁপতে থাকে পুরো গ্রাম।
নদীরঘাটে সকাল হয়,সন্ধ্যা হয়— কেউ নামে না নদীতে।চৈত্রমাসেও স্নান হয় না। মাছেরা বড় হতে হতে অনেক বড় হয়ে যায়—তাদের কেউ ধরে না। ঝাপাঝাপি হয় না আর আগের মত। তবু গ্রাম থেকে মধ্যে মধ্যেই মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়। কই যায় তারা, কেউ জানে না।
নদীরঘাটে মাঝবয়সী অশথ তলায় বসে ভাবে কেউ কেউ। নিজেদের মধ্যে কথা বলে।
—অই হাকি , নদীত নাকি কুমির আছে , দেখলাম না ত। দেখছস?
—না কাকা । অই মিবাই , তুমি দেখছনি চৌইদ্দ হাত লম্বা কুমিররে?
—না দেখি নাই। লালমিয়া ভাই তুমি?
—না।
—সুরেসদা তুমি ?
—নারে ।আমরা ত কেউ দেখি নাই। তাইলে কে দেখছে ?
—নরেন জোয়ারদার । সে দেখছে একলাই দেখছে।
সবাই ভাবে । গালে হাত দিয়ে ভাবে।
জোয়ারদার পকেটে রঙের ডিব্বা হতে একচিমটি রঙ এনে গ্রামের চোখে কাজলের মত পড়িয়ে দিলে ভাবুকরাও বলতে শুরু করল—আমি একবার কুমিরটারে দেখছি, ইয়াব্বড়!কিয়ের চৌইদ্দ হাত লম্বায় হইব কমছে কম আটাইশ হাত।
মুচকি হাসে নরেন জয়ার্দার।
বাড়ির পেছনে শনক্ষেতের ভেতরে অনেক বড় পানাপুকুর। সেখানে নড়েচড়ে কাঁটাওলা শরীর । শালায় শুধু মানুষ খেতে চায়।
তরিকা
পীর সাহেব জালালউদ্দীন রুহানী হুজরাশরীফ থেকে বাড়ির পেছনের যে জংলামত জায়গাটা আছে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মাঝেমধ্যেই। একটা ভয় কুড়ে কুড়ে খায়। বিশাল জঙ্গুলে জায়গাটা কেমন ভারী হয়ে থাকে। মনে হয় জঙ্গলটাও তার হুজরার দিকে তাকিয়ে আছে।
পীর সাহেবের মনের ভেতরে সারাক্ষণ এই ব্যাপারটা চেপে বসে থাকতে থাকতে আর না-পেরে খাস মুরীদ লোকমান হাকীমের সাথে আলোচনায় বসলেন।
— বুঝলে লোকমান হাকীম, হুজুরে কেবলার কবর বাড়ির পেছনে। সেখানে ঝোপঝাড়ে শেয়ালের বসতবাটি হয়েছে। সাপের প্রাদুর্ভাব হয়েছে । এসব দূর করার ব্যবস্থা কর নইলে হুজুরের কোপানল থেকে কেউ রক্ষা পাবা না।
লোকমান হাকীম মাথা নাড়ে ।
— সাপখোপ খেদানোর ব্যবস্থা নেও । গঞ্জ থেকে ওঝা আনাও । বাস্তু সাপে কিলবিল করে বাড়ির পেছনে ।
লোকমান হাকীম মাথা নাড়ে ।
— বাড়ির চারপাশে বাড়িবন্ধ করার দিন তারিখ ঠিক কর;জীনের আছর থেকে মুক্ত রাখতে হবে ।
— জি আচ্ছা ।
— বাড়িবন্ধের কাজটা আমি নিজেই করব । এলান করে দাও । সব মুরি্দানের মোকাবেলায় কাজটা করতে চাই।
— জি আচ্ছা ।
— চৈত মাসের মধ্যেই সব কাজ শেষ করে ওরসের কাজ ধরব।
হুজুর কেবলার সব আদেশ নির্দেশ জারি হওয়ার পর লোকমান হাকীমের ব্যস্ততা বহুগুণে বেড়ে গেল ।
নরম মাটির ভেতরে গর্ত খুড়ে শেয়ালদের বাসা করার মজা ছুটাইয়া দিতে হবে । সবার আগে দরকার বাড়ির পেছনের সাপ খেদানোর জন্যে বরকত মুন্সিকে । তার ডিমান্ড একটু বেশি । টাকা পয়সা বেশি না পেলে গঞ্জের বাইরে আসে না । মোটা অংক পেতেই একগাল হেসে বলল— কামডা কবে করতে চান ?
তারিখ নির্ধারিত হল । ১৩ আশ্বিন । ‘সই’—বলে ওঝা বিদায় নিলে লোকমান হাকীমের মনের ভেতর ভাসতে থাকে —চিশতিয়া তরিকার বড় হুজুরের গদীনশীন আওলাদ জালাল পীরের চেহারা মোবারক।
ওঝা আসে আশ্বিনের সকালে। সাথে অনেক সাগরেদ । বীনার ফুটায় ফুঁ দেয়ার আগে পুরো এলাকাটা চোখ বুলিয়ে নেয় বরকত মুন্সী।বাড়ির পেছনে ছোট ছোট কিছু টিলা । টিলার নিচে ডোবা । ডোবার ভেতরে আলো ছায়া জাফরি কাটে । আর এখানেই পা আটকে গেল মুন্সীর ।
সে দেখল— ডোবাটা ঘিরে প্রচুর ঝোপঝাড় । আর ঝোপের মধ্যেই মুন্সী শুনতে পেল বিজ বিজ শব্দ । হিস হিস শব্দ। খেয়াল করে দেখল ডোবা ঘিরে হাজার হাজার সাপ।
হাত থেকে বীন পড়ে গেল মুন্সীর। যে যে-দিকে পারল সাগরেদরা ছুটে পালাল। মুন্সী পালাতে পারল না । তার দুপা জড়িয়ে মাটির সাথে গেঁথে রেখেছে মোটা মোটা সাপ।
ডোবার নরম মাটিতে আস্তে আস্তে বরকত মুন্সী দেবে যেতে লাগল। কোমর পর্যন্ত ডুবে যাওয়ার পর যখন ভয়ে চিৎকার করে উঠতে যাবে তখনই কেউ কথা বলে উঠল—ভয় পেয়ো না মুন্সী!
মুন্সী দেখল তার সামনে জিহ্বা বের করা বিশাল এক সাপ। কুণ্ডলী পাকানো । তার সারা শরীরে কিলবিল করছে হাজার হাজার সাপ।
—যে সাপ ধরতে তুমি আসছ , সে সাপ নয় । সাপের সুরতে জীন । তুমি চলে যাও । হুজুর কেবলাকে বলে দিও সব আগের মতই থাকবে । শনবন । শেয়ালপাড়া । বালির ঢিবি । বনজঙ্গল ডোবা সব। বাড়িবন্ধ দিলে তারও সেই একই দশা হবে যেমন হয়েছিল তার বাবার। তুমি কি জান তার ইনতেকাল কীভাবে হয়েছিল ?
মুন্সী দরদর করে ঘামতে লাগল। সে দুদিকে মাথা নেড়ে জানাল— জানতে চায় না।
— আগামী মাঘে আসিও জালাল পীরের ওরস মোবারকে । জালাল পীরের সুরতে আমিই থাকব। যেমন ছিলাম তার বাবার সুরতে।
রগড়
বৃহস্পতিবার রাতে ভাস্কর হাসানের স্ত্রী হঠাত বলল— কাল রত্নার স্কুল নেই , রাহাতেরও নেই ।
কৌতূহল নিয়ে তাকাল কবি ভাস্কর হাসান । অনেকদিন পর এই কৌতূহল নিয়ে তাকাল সে। আসলে কৌতূহল নিয়ে তাকানোর বিষয়টি স্ত্রীর ওপর নির্ভর করে । স্ত্রী পছন্দ করে না বলে কৌতূহল নিয়ে তাকানো আর হয় না ।
স্ত্রীর পছন্দ -অপছন্দই ভাস্কর হাসানের পছন্দ- অপছন্দ ।
একটা কবিতা লিখছিল কবি । সেই সন্ধ্যা থেকে কবিতাটা যে আটকেছে—ছোটার নাম নেই । একমাত্রা কম হয়ে যাচ্ছে ।
স্ত্রী ঘাড়ের ওপর আয়েস করে দু'হাত তুলে বলল— আহ কী শান্তি !
— কেন , শান্তির কি হল ? অবাক কবি ।
— বাচ্চাদের স্কুল নেই । সকালের নাস্তা বানানোর তাড়া নেই । বেলা পর্যন্ত ঘুমাব । কাল হলি ডে !
ডে
ডে
ডে
ভাস্কর হাসান কিছুটা আশান্বিত হয়ে ওঠে । মনে মনে ভাবে--আজ হবে কি !
কবিতার খাতাটা সরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল । নাইটি পরা অবস্থায় ভালই লাগছে । কী এক পারফিউম মেখেছে ।
—কী পারফিউম ? বেশ ঝাঁঝালো কিন্তু ! টেক্সি টেক্সি !
প্রশ্ন করেন সদ্য কবিতা থেকে চোখ ফেরানো কবি । ভাস্কর হাসানের জিবের সামনের ছুঁচলো অংশটুকু ছোটবেলা থেকেই কাটা । এই কারণে অনেক বর্ণ উচ্চারণ করতে পারে না ।
যখন স্ত্রী ছিল বউ'র মত তখন মেনে নিয়েছিল ব্যাপারটা কিন্তু বউ থেকে ক্রমশ স্ত্রী হওয়ার পর আর মানতে পারেনি । ফলে কৃৎচ্ছতায় কেটে গেছে কতদিন— হিসাব করে বলতে পারবে না , সংখ্যাটা এত !
আজ স্ত্রীটি আবার বউ'র আচরণ করছে । আনন্দ আর ধরে না ।
—বললা না ,কি পারফিউম ?
—লইয়াগাছি । ফরাসি ।
—দাঁড়িয়ে আছ কেন , পাশে এসে বস ।
স্ত্রীটি একবার বউ'র মত তাকায় । ভাস্কর হাসানকে একবার দেখে । কিন্তু বসে না ।
—কী ,কবিতার মাত্রা মিলেছে ?
—মিলেছে । কিছুক্ষণ আগে । তুমি যখন ঘরে এলে । আমার কবিতা বিশুদ্ধ হয়েছে ।
বউটি হাসে । চুলায় রান্না । যাই ।
কিন্তু ভাস্কর হাসান অস্থির হয়ে হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয় । কত দিন মাস-বছর-পর !
দে
দে
দে ।
স্ত্রীটি বউ হয়ে মাখনের মত গলে গেল ।
ওদিকে , চুলায় কিছু পুড়ছে । সম্ভবত দুধের পায়েস ।
বিলাল হোসেন
জন্ম ১ জানুয়ারি, ১৯৭৪। মাদারিপুর জেলার শিবচর থানার রাজারচর কাজীকান্দি গ্রামে।
প্রকাশিত বই:
ক। কাব্যগ্রন্থ
১। বিরুপা’র শুঁড়িবাড়ি [২০১৪]
২।একলাজ্বলাপঙক্তি [২০১৬]
খ। অণুগল্প গ্রন্থ
১। পঞ্চাশ [২০১৫]
২। মহাপ্রভু ও অন্যান্য অণুগল্প [২০১৬]
৩। দেখবে এসো তিলের বাগান [২০১৭]
৪। বিলাল হোসেনের ১০০ অণুগল্প [২০১৮]
৫। যুগলবন্দী-[২০১৯]
গ। প্রবন্ধগ্রন্থ
১।অণুগল্পের অস্তিত্ব আছে [২০১৭]
২।অণুগল্প প্রবন্ধসিরিজ- অণুগল্পের অ আ ক খ-১,২,৩,৪,৫ [২০১৯]
ঘ। রোজনামচা
বিলাল হোসেনের রোজনামচা-[২০১৯]
ঙ। সম্পাদিত বই [প্রিন্ট]
১। সেরা ১০০ অণুগল্প
২। বাংলাভাষার সেরা অণুগল্প-১
চ। ইবুক সম্পাদনা
অণুগল্প সংগ্রহ-১,২,৩,৪; গোয়েন্দা অণুগল্প সংগ্রহ; ভূত অণুগল্প সংগ্রহ; রূপকথা অণুগল্প সংগ্রহ; নীতিঅণুগল্প সংগ্রহ; চিয়ার্স চিয়ার্স চিয়ার্স; দুনিয়ার মাতাল এক হও; মাতালে মাতাল চেনে; মধুগন্ধেভরা; যুগলবন্দী; অণুগল্পের বিষয় বৈচিত্র্যের সন্ধানে; তাহাদের গল্প; অণুগল্পের শিরদাঁড়া; অণুগল্পের রোজনামচা ইত্যাদি ।
ছ। পত্রিকা সম্পাদনা
ত্রৈমাসিক অণুগল্প পত্রিকা