অণুগল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অণুগল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গল্প • চ্যাটিং • সত্যজিৎ বিশ্বাস

গল্প • চ্যাটিং • সত্যজিৎ বিশ্বাস


(এক) 

-আমি সাদিয়া ফারজানা একা। অপরিচিত কারো সাথে এই প্রথম চ্যাট করছি। বলেন তো কেন? 
-- কেন? 
- আপনার লেখা আমার খুব ভালো লাগে। আপনি এত ভালো লেখেন কি করে সেই রহস্য জানতে। 
-- রহস্য অতি সাধারন। একসময় প্রচুর প্রেমপত্র লিখতাম তো, সেই থেকেই। 
- ভাইয়া কি আমার সাথে ফান করছেন? 
-- কী বিপদ, ফান করবো কেন? সত্যিটাই তো বললাম। আজকাল সত্যি কে মানুষ ফান ভাবে আর ফান করলে ভাবে সত্যি। তাই না? 
- কী জানি ভাইয়া, আমি এত বুঝিনা। 
-- না বুঝলে চলবে কি করে? 
- মানে কি? কী চলবে কি করে? 
-- বললাম, না বুঝলে কথা চলবে কি করে? 
- ও, তাই বলেন। 
-- তাইই তো বলছি। এই যে এতগুলো কথা বললাম, এরমধ্যে কোনো মজার ব্যাপার কি বোঝা যায়নি? 
-ভাইয়া কী যে বলেন? এরমধ্যে বোঝার কি আছে? 
--অবশ্যই আছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝার কথা। 
-ভাইয়া, আমি কিন্তু বাচ্চা মেয়ে না। এই ছোট্ট পুরো কনভারসেশনটা দু’বার পড়লাম। এখানে বোঝার কিছুই নেই। আপনি আমাকে নিয়ে ফান করছেন। এটাই মজার। 
--হা, হা, হা... সেই কথাই তবে আবার বলি, আজকাল সত্যি কে মানুষ ফান ভাবে আর ফান করলে ভাবে সত্যি। কী অদ্ভুত, তাই না? 
-আপনি কিন্তু আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। 
--যদি সত্যি হয়? 
-যদি সত্যি আমাদের এই চ্যাটিং এ মজার কোনো ব্যাপার থেকে থাকে তাহলে আপনাকে একটা বর দেবো। ওই যে দেবতা যেমন বর দেয়, তেমন বর। 
--ঠিক তো? 
- খুব ঠিক। বলেন শুনি কি মজার ব্যাপার আছে? 
--এতক্ষন ধরে আমরা যে চ্যাটিং করলাম, আমি কি একবারো সাদিয়া ফারজানা একা-কে আপনি কিংবা তুমি কোনো কিছু সম্বোধন করে কিছু বলেছি? একটা মানুষের সাথে পরিচয়ের শুরুতেই কি মানুষ তাই করেনা? 
-ওমা তাইতো? এত সহজ কিন্তু ধরতে পারলাম না কেন? ভাইয়া, আপনি তো আসলেই ... ... 
--আসলেই কি? বিশেষণ বিহীন? হা, হা, হা... 
-সত্যি বলছি ভাইয়া, এতটা অবাক আমি কখনো হইনি। বলেন কি বর চান? 
--হা,হা,হা... আজ না, আরেকদিন... আজ টা টা 
-বাই ভাইয়া, ভালো থাকবেন। 
--খুব চেস্টা করবো। বাই। 

(দুই) 

-ভাইয়া কি অন লাইন? 
--হুম, এখনো লাইন থেকে ছিটকে পড়িনি। 
-হা, হা, হা... আপনি কি সবার সাথে এভাবেই কথা বলেন? 
--সবার সাথে বলি না, তো। একার সাথে একা বলি। 
-একার সাথে মানে? আমার সাথে? 
--একার সাথে মানে নিজের সাথে। 
-উফ... আপনি কি আমাকে বাচ্চা মনে করেন? 
--মনে করবো কেন? তাইতো। 
-জ্বী না। আমি তেইশ পার হয়ে চব্বিশে পড়বো পড়বো করছি।  
--তাহলে তো আপনি অনেক বড়। 
-এই প্রথম আপনি আমাকে কিছু একটা সম্বোধন করলেন। 
--হা, হা, হা... করবো না তবে? 
-করবেন, অবশ্যই করবেন। তবে তুমি করে বলবেন। 
--আচ্ছা বলবো। কি নামে ডাকবো তোমাকে? 
-এটা আবার কেমন কথা? আমার নাম যা, সেই নামে ডাকবেন। 
--তোমার তো তিনটা নাম তাই জিজ্ঞাসা করলাম। 
-আমার তিনটা নাম? 
--তাইতো। ‘সাদিয়া’ ‘ফারজানা’ ‘একা’। 
-ভাইয়া, আপনি কিন্তু আমার সাথে পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে বাচ্চাদের মতো ফান করছেন। আমার তিনটা নাম না, একটাই নাম। 
-- আচ্ছা বেশ। তাই যদি হয়, তাহলে নামে ভুল আছে। 
-নামে ভুল আছে মানে? কোথায় ভুল? 
--তাহলে তুমিই বলো- সাদিয়া আর ফারজানা, একা হয় কি করে? 
-হা, হা, হা ... আপনি পারেনও। তবে সাদিয়া ফারজানা একা শুধু না, এ জগতে সবাই একা। 
--তাই কি? এ ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা দেড় কোটি পার হয়েছে অনেক আগে। বাসায়, রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, শপিং মল কিংবা বাজারে হাজার হাজার মানুষ। 
-তাতে কি? হাজার ভীড়েও কি মানুষ একা হয়না? 
--প্রযুক্তির যুগে এ-যুক্তি ধোপে টেকে? একা হবার সময় কই শুনি? মোবাইল, অন লাইনে ই-মেল, ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস এপ... ... রেডিও-টেলিভিশনের একশ একটা চ্যানেল, এইদিবস, সেইদিবস, বিশাল বিশাল লাইভ কনসার্ট- মানুষকে কি করে একা থাকতে দেয় শুনি? পাঁচ মিনিটের জন্যও কী সবার সাথে, সব কিছুর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারছো? 
-তা অবশ্য ঠিক। 
--একা হওয়ার সব পথ এ শহরের মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। এটা এখন যান্ত্রিক শহর। মোরগ কিংবা পাখীর ডাক এখন আর এ শহরের মানুষের ঘুম ভাঙায় না,ঘুম ভাঙ্গায় এলার্ম ক্লক। 
-হুম বুঝলাম। 
--কি বুঝলে? 
-আপনি কথার যাদুকর। 
--ওরে বাবা, এত্তো বড় এওয়ার্ড? কোথায় যে রাখি? 
-রাখার জায়গা নেই বুঝি? সব ভর্তি? 
--হুম। সব। যাই এখন তবে একটা সেলফ বানাতে অর্ডার দিতে যাই দোকানে। 
-আমার কথার জন্য? 
--তোমার কথার জন্য হতে যাবে কেন? আমার এওয়ার্ড রাখার জন্য। 
- আপনি মানুষকে এত ইনসাল্ট করতে পারেন? 
-- ইনসাল্ট করলাম কই? সত্যিটা বললাম মাত্র। বাই তবে। 
- আপনি একটা যা ইচ্ছে তাই। বাই। 

(তিন) 

-হ্যালো 
--কোন দিকে হেলবো? 
-হা,হা,হা... কোন দিকে হেলতে ইচ্ছে করছে আপনার? 
--যার সাথে চ্যাট করছি তার দিকে। 
-ইসস...ইচ্ছে করলেই হলো? 
-ইচ্ছে না করলে হয় কি করে? 
--শুনুন লেখক সাহেব,এসব ইচ্ছা ভালো না। 
-ভালো না কেন, শুনি? যদি বোঝাতে পারো এসব ইচ্ছা কেন ভালো না, তাহলে আমাকে দেয়া তোমার বর ফিরিয়ে দেব। 
-আর যদি না পারি? 
--তাহলে আরো একটা বর দিতে হবে। 
হা, হা, হা... আপনি একটা পাগল। 
-কে না? এবার বলো, এসব ইচ্ছা ভালোনা কেন? 
--ওমা, আপনি কেন আমার দিকে হেলতে চাইবেন? 
-আমার ইচ্ছা হলো বলে। যে কোনো সৃষ্টির প্রথম শর্তই কি, ইচ্ছা না? আজ এত কিছু যে আবিষ্কার- তার মূলে কি ইচ্ছা না? 
--তা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমি তো একটা মেয়ে। আমার প্রতি এমন ইচ্ছা হওয়া টা ঠিক? 
-ইচ্ছার আবার ছেলে-মেয়ে কি? আচ্ছা- তোমার কোনদিন কোনো ব্যাপারে ইচ্ছা জাগেনি? 
--জাগবে না কেন? 
-তাহলে? ইচ্ছে হতে কি মেয়ে বা ছেলেতে বাঁধা আছে? 
--তা নেই, কিন্তু... 
-কিন্তু একটাই। আমার ইচ্ছেটা তোমার ইচ্ছে হচ্ছেনা। তাই তো? 
--আপনি বড্ড ঠোঁট কাটা। হুম তাই। 
-তাহলে সেটা বললেই তো পারতে। কেন বললে- এসব ইচ্ছা ভালো না? এমন ইচ্ছা কারো প্রতি তোমার হয়নি কখনো? মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার দাবী চিরন্তন। তেমনি চিরন্তন হাত ধরার দাবী, একটু হেলে পড়ার দাবী। 
--আপনি, এমন কেন? সব কিছুতে জেতার এত ইচ্ছা কেন? 
-হা, হা, হা... এর মানে কি? 
--এর মানে হলো- দ্বিতীয় কি বর চাই, শুনি? 
-হা, হা, হা... সময় হলে চেয়ে নেবো। আজ বাই। 
-- বাই, ভালো থাকবেন। 
- কথা দিচ্ছি না। বাই। 

(চার)

-ঠক, ঠক, ঠক... কথার যাদুকর, আছেন? 
--আছি, কিন্তু আজ দরজা খোলা যাবেনা। 
-কেন? 
--একটা লেখার মাঝপথে আছি যে। 
- ও 
--মন খারাপ করছো কেন? দরজা খুলিনি ঠিক, কিন্তু জানালায় উঁকি দিয়ে তো কিছু কথা বললাম, নাকি? 
-হা, হা, হা... আচ্ছা ঠিক আছে। লিখেন তবে। পরে কথা হবে। টা টা 
--টা টা 

(পাঁচ) 

-ব্যস্ত নাকি যাদুকর? 
--ছিলাম না, এই হয়ে গেলাম। 
-এই হয়ে গেলাম মানে? কেমন করে ব্যস্ত হয়ে গেলেন? 
--তোমার সাথে কথা বলে। 
-সব সময় হেয়ালি, না? 
--না তো। তোমার ব্যাপারে সব সময় সিরিয়াস। আজ সারাদিন ধরে মনে হচ্ছিলো একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো তোমায়? 
-বলেন কি? কি সেই মহা মূল্যবান কথা? 
--তোমার কি অনেক লম্বা চুল? 
-হুম। কিন্তু কেন? লম্বা চুল দিয়ে কি হবে? 
-- লম্বা চুলের মালিককে জিজ্ঞাসা করবো, সে যেমন করে তার লম্বা চুলের যত্ন নেয় তেমন করে আর কারো কি যত্ন নেয়? 
- জেনে কি হবে? 
--সেই জানার গল্পটা যদি খুব সুন্দর হয়- তবে গল্প লেখা হবে। 
-ও আচ্ছা। আপনি তাহলে গল্প লেখার জন্য জানতে চাইছেন? আপনি তো খুব স্বার্থপর। 
--কে স্বার্থপর না, শুনি? 
-কেন? আমি। 
--এটা অবশ্য ভালো বলেছো। তুমি অবশ্য স্বার্থপর না। তুমি হলে স্বার্থ নিজ। হা, হা, হা... 
-তারমানে? 
--মানে খুব সোজা। নিজ স্বার্থে গল্প করতে এসেছো। হয়তো কোনো গভীর কস্ট ভুলতে, নয়তো কিছু থেকে লুকিয়ে থাকতে। 
-আপনার কেন তা মনে হলো? 
--মানুষ জন্মগত স্বভাবেই একা থাকতে চায় না। তোমার বয়সী একটা মেয়ে তো আরো না। 
- এতো বোঝেন? এ মুহুর্তে আর কি মনে হচ্ছে? 
--আর মনে হচ্ছে, তোমার মনটা আমি এখন খারাপ করে দিলাম। তাই, এখনি এ মনটা ভালো করে দিতে হবে। 
-আমার মন খারাপ হলে খুব সহজে ভালো হয়না। 
--তাইতো হওয়া উচিত। মন খারাপ হলে তা সহজে ভালো হবে কেন? মনের কি একটা ভাব আছে না? কথা নেই, বার্তা নেই সেই ভাব ভুলে কি ঠা ঠা করে হাসবে? 
-হা,হা,হা... হাসবোই তো। 
--হাসো তবে। চাঁদ অবাক হয়ে লাস্যময়ী তরুণীর হাসি উপভোগ করুক। 
-আর আপনি? 
--আমি এখন টা টা... পরে কথা হবে 
-হুম বাই। 

(ছয়) 

- কি করছিলেন? 
-- সুপ্রিয়া চ্যাটার্জিকে কোলে তুলে আদর করছিলাম। 
-যাহ্‌। কি যে বলেন? 
--সত্যি বলি। কোলে তুলে, কখনো আঙুলে স্পর্শ করে চোখ বুলিয়ে... । একে যদি আদর না বলে তবে কাকে বলে? 
- কে উনি? 
-- স্বনামধন্য লেখিকা। আমি তার গল্পের বইয়ের অন্ধ ভক্ত। 
- তাঁকে পেলেন কই? 
-- কেন? তাঁর লেখা গল্পের বইয়ে। 
-অদ্ভুত লোক আপনি। এভাবে ভাবতে আপনাকে কে শিখিয়েছে? নাকি নিজে থেকেই? 
--কোনো যাদুকর কি তার জাদু ফাঁস করে? 
-আচ্ছা ফাঁস না করেন, একটা জাদু দেখান। 
-- ... ... ... 
-ওমা, এই ডট ডট ডট এর মানে কি? 
--এর মানে হলো- তোমাকে আমি ডট ডট ডট দিয়ে একটা কথা লিখছি। যেটা এখন তোমার কাছে অদৃশ্য। কিন্তু একদিন ঠিক বুঝে যাবে। যতদিন বুঝতে পারছো না, ততদিন এটা তোমার কাছে এটা জাদু। 
-আপনি এত অদ্ভুত কেন? 
--আমি আর কি অদ্ভুত। তারচেয়ে বড় অদ্ভুত মানুষ তোমার সাথে থাকে। 
-আমার সাথে মানে? 
--আচ্ছা তোমার নাম একা কে রেখেছে? 
-কেন, আমার বাবা। 
--কোনো বাবা তাঁর সন্তানের নাম – ‘একা’ কি করে রাখে? কোনো বাবা কি চায়, তাঁর সন্তান একা থাকুক? এটা কি কম অদ্ভুত? 
- সে জন্যই কি আপনি আজ পর্যন্ত আমার নাম ধরে ডাকেন নি? 
--আমি বিশ্বাস করিনা তুমি একা। 
-কিন্তু আমি তো তাইই। 
--কোথাও ভুল হচ্ছে। 
-কোথাও ভুল হচ্ছেনা জাদুকর। 
--কিকরে? বলবে? 
-আজ না, অন্য একদিন। 
-- ঠিক আছে। আজ তাহলে বাই। 
- বাই জাদুকর। 

(সাত) 

-টুং টাং, টুং টাং 
--কি ব্যাপার, কলিংবেল কেন? দরজা তো খোলাই। 
-চ্যাট ঘরে এলাম, কি খাওয়াবেন? 
--কথার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিপস। 
-হা, হা, হা... তেলে ভাজা আমার পছন্দ না। 
--তেল দিয়ে ভাজিনি তো, কথা দিয়েই ভাজলাম। 
-আপনি পারেনও। 
--শিখবে? 
-শেখাবেন? 
--মনের জোর আছে তো? 
-আপনার কি মনে হয়, নেই? 
--একা নামের মেয়ের কি, সেই মনের জোর থাকে? 
-হা, হা, হা... আপনি এখনো নাম নিয়ে আছেন? 
--তুমি নেই কেন বলবে? 
- আচ্ছা শুনুন তবে। আমার জন্মের সময় মায়ের অবস্থা খুব সঙ্গীন হয়ে উঠলো। ডাক্তার যখন বাবাকে জানালো- মা নয়তো বেবি যে কোনো একজনকে বাঁচানো যাবে। কার জন্য চেস্টা করবো? বাবা শুনে বোবা হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারকে কিছুই নাকি বলতে পারেনি সেদিন। তারও কিছু পরে আমাকে বাবার হাতে তুলে দিয়ে ডাক্তার মাথা নীচু করে ফিসফিস করে বলেছিল, ওর মাকে বাঁচানো গেলো না, সরি। এক হাতে চোখ মুছতে মুছতে অন্য হাতে আমাকে কোলে তুলে বাবা বাসায় ফিরলো। আমার নাম রাখলো একা। তাঁর একা হাতেই মানুষ আমি। 
-- ওহো। আমি সত্যিই সরি, না জেনে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। 
-আরে না, আপনি তো আর এতসব জানতেন না। 
--কিন্তু তবুও বলি, তুমি একা নও। তোমার বাবা ভুল নাম রেখেছে। আমি তোমার সাথে সারাদিন অনেক-অনেক কথা বলবো। তোমার মোবাইল নাম্বারটা দেবে, প্লিজ? 
-হা, হা, হা... আমার তো মোবাইল নাম্বার নেই। 
--মোবাইল নাম্বার দিতে চাচ্ছোনা, তাই বললেই হয়। 
-আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না? সত্যি আমার মোবাইল সেট নেই। আর দরকারও পড়ে না। 
--দরকার পড়ে না মানে? তোমার কোনো বন্ধু নেই? কারো সাথে কথা বলো না, তুমি? 
-বলি তো, সবার সাথেই বলি। তবে ইশারায়। আমি যে শব্দ করে কথা বলতে পারিনা। ইশারায় কথা বলতে মোবাইল লাগে বুঝি? 
-- কি বলছো এসব? 
- যে মেয়েটা শব্দ করে কথা বলতে পারে না, তার নাম ‘একা’ হওয়াটা কি খুব ভুল? তার অনেক বন্ধু না থাকাটা কি খুব অস্বাভাবিক? একা নামের মেয়েটা কি জন্ম থেকে একা জীবনের জলছাপ না? কী হলো কথার যাদুকর- কথা বলছেন না, কেন? 


সত্যজিৎ বিশ্বাস 
জন্ম: ১লা মার্চ, ১৯৭৪ 
কন্ট্রিবিউটর- স্যাটায়ার কার্টুন ম্যাগাজিন উন্মাদ। 
কন্ট্রিবিউটর- ফান ট্যাবলয়েড ‘ঠাট্টা’ (দৈনিক ইত্তেফাক) 
কন্ট্রিবিউটর- ফান ট্যাবলয়েড ‘প্যাঁচআল’ (দৈনিক সমকাল) 
কন্ট্রিবিউটর- ফান ট্যাবলয়েড ‘ঘোড়ার ডিম’ (দৈনিক কালের কন্ঠ) 
কন্ট্রিবিউটর- ফান ট্যাবলয়েড ‘বিচ্ছু’ (দৈনিক যুগান্তর) 

প্রকাশিত বইসমূহ: ভালবাসার অনেক রঙ (ছোটগল্প সমগ্র, শুদ্ধস্বর প্রকাশনী) 
জোকে জোঁকারণ্য (মৌলিক জোকস সমগ্র, নওরোজ কিতাবিস্তান) 
জলছাপ (ছোটগল্প সমগ্র, নওরোজ কিতাবিস্তান) 
রাম গরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা (মৌলিক জোকস, প্রিয়মুখ প্রকাশন) 
ইরেজার ভূত (শিশুতোষ গল্প, প্রিয়মুখ প্রকাশন)
আমি পারবো (শিশুতোষ গল্প, ভিন্নচোখ প্রকাশনী) 
আমরা সবাই রাজা (শিশুতোষ গল্প, বিদ্যানন্দ প্রকাশনী)
শ্রেয়সীর ডাইরী (কিশোর উপন্যাস, শব্দভূমি প্রকাশনা) 
গল্পগুলো রম্য (রম্য গল্প সমগ্র, শব্দভূমি প্রকাশনা)
গল্প • কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প • নাহিদ ধ্রুব

গল্প • কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প • নাহিদ ধ্রুব

ইচ্ছেরা নিজেদের গলা টিপে ধরলে পুরাতন ক্যাম্পে ফিরে আসা ছাড়া নিখিলেশের কাছে ছিল না তেমন কোন বিকল্প। শত্রুপক্ষের ব্যারাকে তাঁর গুপ্তচর পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর প্রতিটি সৈন্য যেন হয়ে গেছে একটি গন্ধ শোঁকা কুকুর আর অদ্ভুত ক্ষমতা বলে তারা কোন না কোন ভাবে খুঁজে বের করছিল নিখিলেশের অস্তিত্ব। যাদের জন্য সিঁধেল চোরের মতো পালিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে, তাদের অবশ্য নিখিলেশ বিশেষ দোষ দিতে পারে না। তাঁর বদৌলতে অর্থাৎ তাঁর তথ্যের বদৌলতে তাঁর প্রকৃত ব্যারাকের সৈন্যরা নির্ঘাত যমদূতের মতো এসে উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুপক্ষের দুটো ক্যাম্প, ঐ সব ক্যাম্পে যে নিখিলেশের নতুন গজিয়ে ওঠা বন্ধু ছিল না, তা না, কিন্তু যুদ্ধে এসব ভাবলে চলে? শত্রুপক্ষের সৈন্যদের বন্ধুত্বসুলভ আচরণ, গর্তে শুয়ে শুয়ে তারা দেখা কিংবা যুদ্ধ শেষে ফিরে গিয়ে কে কী করবে তাঁর লম্বা তালিকা’র কথা তাই গোপনে ভুলে যেতে চায় নিখিলেশ। কিন্তু, সীমান্তের কাঁটাতারের মতো তা ঠিক’ই এসে বিঁধে যাচ্ছে বুকে। 


প্রথম ব্যারাকে আক্রমণের সময়েই কেউ কেউ নিখিলেশ’কে সন্দেহ করেছিল কিন্তু স্রেফ ভালোবাসা থেকেই হয়তো তাঁকে আলাদা করে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি তখন আর এদিকে ভালোবাসার জাল কেটে তখন থেকেই পালাবার ফন্দি আঁটছিল নিখিলেশ। কথা ছিল, দ্বিতীয় ক্যাম্পে আক্রমণের সময় সে দল বদল করে যোগ দেবে তাঁর দলের সাথে আর মিশন শেষে পালিয়ে যাবে তাদের ছায়া অনুসরণ করে কিন্তু, দ্বিতীয় দফায় গোলাবর্ষণের সময় যখন তাঁর দলের সৈন্য’রা তাঁকে ইশারা করলো ভেতর থেকে আক্রমণের জন্য তখন নিখিলেশ হয়ে গেলো হাজার বছর ধরে স্থবির হয়ে থাকা কোন এক পাথর, কিছুতেই ভাঙল না তাঁর ধ্যান। ফলশ্রুতিতে, শত্রুপক্ষ আততায়ীদের অস্তিত্ব টের পেয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করলে নিখিলেশের মূল দলের যোদ্ধা’রা ধরাশায়ী হয়ে পড়ে কিন্তু রণভঙ্গ দেয় না কিছুতেই, বরং মুহুর্মুহু শেলের আক্রমণে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় দ্বিতীয় ক্যাম্প এবং একইসাথে তীব্র প্রতিরোধের মুখে নিজেরাও হয়ে যায় ধ্বংস। 

এমন ধ্বংসলীলার মধ্যে একসময় নিখিলেশের ধ্যান ভেঙে গেলে সে দৌড়াতে শুরু করে এবং জঙ্গলের মধ্যে খুঁজে নিতে চায় আশ্রয় কিন্তু, শত্রুপক্ষে ইতিমধ্যে তাঁর পরিচয় উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় তাঁর খোঁজে তারা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে শুরু করে গ্রাম, নগর, মাঠ , জলাশয়। ফলে, জঙ্গল থেকে নদী এবং তারপর কিছু পাহাড়ি জনপদ পাড়ি দিয়ে নিখিলেশ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় পুরাতন ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার। 

ক্ষতবিক্ষত শরীর, অবসাদগ্রস্ত মন এবং শত্রুপক্ষের ছেঁড়া ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় নিখিলেশ তাঁর পুরাতন ব্যারাকে ফিরে আসলে তাঁর জগত এক মুহূর্তে বদলে যায় যখন সে দেখতে পায় এই ব্যারাকের সবগুলো মুখ অপরিচিত। দ্বিতীয় ক্যাম্পে মিশনের সময় তাঁর অচলাবস্থার জন্য মারা যাওয়া বন্ধুদের কথা তখন মনে পড়ে তাঁর এবং ক্যাম্পে নতুন মুখের আগমনের কারণ স্পষ্ট হয় ধীরে ধীরে। কিন্তু, তাঁর এই আগমনের উৎস কিছুতেই স্পষ্ট হয় না নতুন করে ব্যারাকে আসা সৈন্যদের কাছে এবং নিখিলেশের গায়ে শত্রুপক্ষের পোশাক দেখতে পেয়ে তাদের মনে সংশয় হয় আরও গাঢ়। নিখিলেশ যখন নিজেকে এই ব্যারাকের পুরাতন সৈন্য হিসেবে দাবী করে তখন হিতে বিপরীত হাওয়া বয়ে গেলে নতুন ব্যারাকের সৈন্য’রা নিখিলেশ’কে শত্রুপক্ষের গুপ্তচর হিসেবে গ্রহণ করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। 

এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটি ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে খারাপ লাগে না নিখিলেশের যদিও ক্ষুধা থেমে থেমে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। মাথার উপর ষাট পাওয়ারের একটি বাল্ব আলো দিচ্ছিল কিছুক্ষণ আগে কিন্তু এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ কী আর রিমান্ডের তাৎপর্য বোঝে? বিদ্যুৎ নিজের খেয়াল খুশী মতো কোন এক অজানার পথে চলে গেলে ঘরে নেমে আসে কবরের অন্ধকার। এই অন্ধকার’ও নিখিলেশের খারাপ লাগে না অতোটা, কোন এক বিচিত্র কারণে দীর্ঘদিন পর তাঁর মনে ফিরে এসেছে শান্তি। তবে কী এই সে’ই শান্তি যার কথা ব্যারাকের সব মৃত বন্ধুরা বলতো অনবরত, সকলের মনেই ছিল যুদ্ধ সমাপ্তি’র কল্পনা, যে স্বপ্নের কাছে জয়-পরাজয় নিতান্তই তুচ্ছ যেমন তুচ্ছ এই মুহূর্তের অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা। 

নিখিলেশ এই অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে ক্রমশ এবং মনে উঁকি দিতে থাকে হারানো বন্ধুদের হারানো স্বপ্নগুলো, যা আশ্চর্য মেঘের মতো দৃষ্টির আড়ালে থেকেও আঁচড় কাটতে শুরু করে ক্ষিপ্রগতি’তে যার আঘাতে নিখিলেশের মনে আসে অনন্ত ঝিমুনি। এই স্থবিরতা অনন্তকালের পথে হাঁটতে শুরু করার আগেই বিদ্যুৎ ফিরে আসে এবং ষাট পাওয়ার বাল্ব মাথার উপর জ্বলে উঠলে কুর্দি পরিহিত একদল সৈন্য বিভিন্ন মারণাস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে ঘরে। 

ইন্টারোগেশনের সময় নিখিলেশের ধর্ম পরিচয় বের হয়ে আসলে তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন করার শেষ সুযোগটুকু হয়ে যায় হাতছাড়া। শত্রুপক্ষের ধর্ম আর নিখিলেশের ধর্ম যে এক, নিখিলেশ শত্রুপক্ষের চর না হয়ে আর কী’ইবা হতে পারে? সুতরাং, নিখিলেশ’কে শত্রুপক্ষ ভেবে টর্চারের মাত্রা বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের মজবুত বাঁধনে টান পড়ে কিন্তু নিখিলেশ সত্যের পথ থেকে একচুল’ও সরে আসে না বরং যখন ধীরে ধীরে তাঁর নখ আঙুল থেকে উঠে আসে কিংবা তার কিছুক্ষণ বাদে কব্জি আলাদা হয়ে যায় হাত থেকে, তখন নিখিলেশ নিজের সত্যিকারের পরিচয় ভুলে যেতে থাকে এবং ভুলে যেতে থাকে এইসব যুদ্ধের জন্য শেখা সমস্ত কৌশল। 

যদিও প্রশ্নবাণ এই সব ক্ষত’এর তোয়াক্কা করে না বরং ফলায় বিষ মাখিয়ে ক্রমাগত ফালাফালা করতে থাকে নিখিলেশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত। ফলে, একসময় নিখিলেশের চেতন জগত ক্রমশই ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে এবং ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলো’তেও চারপাশে নেমে আসে কুয়ায়াচ্ছন্ন অন্ধকার। মুখে পানি ছুঁড়ে পুনরায় নিখিলেশের জ্ঞান ফিরিয়ে এনে পুনরায় তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নের আগুনে নিখিলেশ’কে ঝলসে দেয়া হলে নিখিলেশ কেবল বলে যেতে থাকে একটি বাক্য, জগত একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং আমরা আসামী। 

এই বাক্যের মর্ম উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে সৈন্যের দল টর্চারের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে নিখিলেশের গোঙ্গানি কিংবা অন্ধকারের মমতার বলেই হয়তো বিদ্যুৎ আবার চলে যায় এবং পুরো ঘরে নেমে নীরবতা। নিখিলেশ এই নীরবতার ভেতর চোখ পিটপিট করে তাকায় এবং তার ইচ্ছে হয় শেষবারের মতো একবার আলোর সন্ধানে যাবার, তখন খোলা জানালা দিয়ে একটি জোনাকি এসে ঢুঁকে পড়ে ঘরে, অদ্ভুত সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে আর নিখিলেশের মনে হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প কিংবা পৃথিবী তো অতোটা মন্দ না! 


নাহিদ ধ্রুব 
জন্ম: ২ ডিসেম্বর; বরিশাল। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় স্নাতক। প্রকাশিত বই : মৃত্যুর মতো বানোয়াট [কবিতা; জেব্রাক্রসিং, ২০১৭] থাকে শুধু আলেয়া [কবিতা; চন্দ্রবিন্দু, ২০১৯] 

পাঁচ টি অণুগল্প • কামরুজ্জামান কাজল

পাঁচ টি অণুগল্প • কামরুজ্জামান কাজল


একদিন সিএনজিতে

লোকটি আসল মুক্তিযোদ্ধা কি-না জানি না , তবে সিএনজিতে বসে তার গল্প শুনতে ভালোই লাগছিলো। 

আর বইলেন না স্যার, আপনি তো আমার নাতীর বয়সী, কি আর জানেন যুদ্ধের কথা। এটুকু বলেই লোকটি দম নিলো, খুব সম্ভবত শ্বাসটান ছিলো তার৷ আমি একটু উনাকে সাহায্য করলাম— হ্যাঁ দাদু, আমরা এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব অল্পই জানি! লোকটি আবার উৎসাহ নিয়ে শুরু করলেন, স্যার এই যে দেখেন কান্দাপাড়া বিরিজ, এইযে, এইখানডায় তখন বিরাট স্রোত৷ বলেই আবার একটু থামলেন। 
তখন বলতে একাত্তুর সাল৷ হরিরামপুরে আর্মির ক্যাম্প বানছইল। আষাড় মাস। মুক্তিবাহিনীর আমরা পাঁচজন, রব সাব আমাগো বড় ভাই, সে-ই আমাগো কমান্ডো । আগের রাইতে আবুল ভাই, সে আছলো আমাগো মুক্তিগো সিআইডি৷ কোড আছল— আইজ মেঘ করছে চাঁদ দেখা যাইবো না। সেই কোড শুইনাই নৌকার মাঝি নাজিম খবর দেছল, দুপ্পুরে খাওনের পর, শইল্ল্যে খালি ঘুম ঘুম। 
লোকটি আবার থামতেই আমি আগ্রহ করে প্রশ্ন করলাম—তারপর? 
শুনেন তাইলে— আবার লোকটি বলতে লাগলেন। কিভাবে এগারজন পাকিস্তানি আর্মি, একটা ট্রলারে করে এইদিকে আসছিলো, কিভাবে মাত্র পাঁচজন মিলে কচুরিপানা মাথায় নিয়ে নাক বের করে লুকিয়ে শ্বাস নিচ্ছেলেন তারা... 
সিনিজিতে ড্রাইভারের দুইপাশে দুইজন যাত্রী ঝুলছিলেন, একজন একটু পর পর পেছন ঘুরে তাকান আর গলা খাকাড়ি দেন। উশখুশ উশখুশ করেন৷ 
স্যার আমাগো তিনজনের হাতে থ্রি নট থ্রি, যদিও জিনিসটা ভালো আছিলো, ম্যাগাজিনে ৬ডা কইরা গুল্লি। তয় খান আর্মিগো হাতে কালাসনিকভ একে ৪৭। আমাগো পাঁঁচবার লোড করা সমান তাগো একবার। মেশিনগানের মুখে পড়লে আমরা জীবন লইয়া ফিরতে পারতাম না স্যার। রব সাব, আমাগো কমান্ডো যিনি, সে এইডা জানতো। খালি জীবনের মায়া না স্যার, তারচেয়ে বড় কথা আমাগো মিশন ফেইল করলে, এই পারের হিন্দু পাড়া স্যার, জ্বইলা পুইড়া ছারখার হইয়া যাইত.. 
আমি কেন জানি ভেতর ভেতর খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলাম। নিজেকে লোকটির জায়গায় বসিয়ে দৃশ্যটা কল্পনা করছিলাম। 
তারপর স্যার, আমরা কচুরিপানা থেইকা দক্ষিণ দিকে একটা গুল্লি করলাম। আর্মিগো ট্রলার আছল আমাগো থেইকা সামান্য উত্তরে, হেরা মুহুর্তেই এলোপাথাড়ি গুল্লি শুরু করলো। কোনো থামা থামি নাই, তাও পরায় দশমিনিট গুল্লি করতে থাকলো। মাথার উপরে কচুরিপানা, আমাগো দম বন্ধ হয়া আসে। কান ঝালাঝালা হয়া যায়। বুকের ভিত্রে স্যার একটাই ভয়, মিশন ফেইল হইলে হিন্দু পাড়াডা... 
আমি সিএনজিতে মাঝে বসছিলাম। আমার ডান পাশে বসে লোকটি যুদ্ধের সেইসব স্মৃতিগুলো টানা বলতে থাকেন । মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে পড়েন, এইযে স্যার আমার ডান পায়ের থুড়ায় গুল্লি লাগছল, এখনও দাগ আছে— বলেই লুংগিটা তুলে উরু বের করেন।আমার বাম পাশে বসা বয়স্ক লোকটা এইসব কথা শুনেও যেন শুনছে না। কোনো ভাবান্তর নাই তার। 
রাস্তা ফুরিয়ে আসল। মিশন ফেইল হয়েছিলো কিনা জানা হলো না, সিনজি থেকে নামতেই সামনে বসা লোকটি, যে উশখুশ করে বারবার গলা খাকাড়ি দিচ্ছিলো—আমাকে চিনতে পেরে সালাম দিয়ে বললো, স্যার কিছু মনে কইরেন না। লোকটার মাথায় একটু সমস্যা আছে! 
কি কইলি শুওরের পুত! তুইও! তুইও অই বান্দির বাচ্চা সুবিধাবাদীগো মতো আমারে পাগল কইস। একজন মুক্তিযোদ্ধারে পাগল বানাস? বিকট চিৎকারে লোকটি তেড়ে আসে৷ চাচা তুমি মুক্তিযোদ্ধা? তুমার সার্টিফিকেট কই? বাইর করো চ্যে? লোকটি এইবার আরও ক্ষেপে ওঠে, অরে খানকির পোলা, কাগজের লাইগ্যা আমি যুদ্ধ করছি? বলেই লুংগিটি একটানে খুলে ফেললো৷ দেখ বাইনচোত নেমক হারাম৷ আমার ল্যাওড়ার পাশে থুড়ায় দেখ, গুল্লির চিহ্ন। 
আমি সাহস করে আর তাকাইলাম না। চলে আসছিলাম। বাম পাশে বসা সেই লোকটি হঠাৎ আমার হাত ধরে বললো, স্যার লোকটা পাগল না, সে হাছাই মুক্তিবাহিনীতে সেইদিন আছিলো৷ সেইদিন মিশন ব্যর্থই হইছিলো, আর্মিরা আমাগো হিন্দু পাড়ায় আইসা... 
আমি এই লোকটিকে চিনতে পারলাম । আলীম সান্দার৷ সকালে কৃষিব্যাংকে এসে একলাখ টাকা লোনের জন্য খুব জোরাজোরি করছিলো ! বন্ধকের জন্য জমিজমার দলিল নাই বলে আমি ফিরায়ে দিছিলাম। সেই আলীম সান্দার হঠাৎ আমার হাত ধরে বলে উঠলো- স্যার- ৫৬ হাজার বর্গমাইল দলিল দিলে কয় ট্যাকা লোন দিবেন? 

ফোয়ারা বিবির হলুদ চাদর

শীত শেষ, সাময়িক মোহগ্রস্থ একটি হলুদ চাদর আলমারিতে ফিরে যায়। 

আলমারির ভেতরটা গুমোট, অন্ধকার। দম বন্ধ লাগে চাদরটির৷ খাঁজকাটা হলুদ রঙের ভেতর হালকা লাল লাল ডিজাইন৷ পুরানো, তবুও জৌলুশ আছে৷ আলমারির তৃতীয় থাকের এক কোণে পড়ে থেকে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চাদরটি। 
অহ মরে যাই, মরে যাই! বুড়ি হয়ে গেলো, তাও প্রেম এখনও ফুরায় না যেন!-- একটা বেগুনী শাড়ি আস্তে করে ফোড়ন দেয়। চাদরটি মুখরা ছিলো, কথার পিঠে কথা ভালোই বলতে পারে! তবুও কেন জানি শাড়ির এই বাঁকা কথাটার উত্তর দেয় না। অলস লাগে৷ 
চাদরটির কয়েকটা জায়গায় সুতা খুলে গিয়েছিলো। চাদরের মালিক ফোয়ারা বিবি, সেটা সেলাই করে করে জোড়া দেয়। রাকায়াত হাসে, খানিকটা বিরক্তও হয়। এতো পুরানো চাদর সেলাই করে কি লাভ! তোমার কি চাদরের অভাব? ফোয়ারা চশমাটা খুলে পাশে রাখে। সেলাইয়ের জায়গাটায় হাত বুলায়। কেন জানি চাদরের বুকের অংশটাই বারবার ছিড়ে যায়! 
চাদরটি ফিরে আসতেই চারিদিকে গুঞ্জন শুরু হয়৷ আলমারির অন্যান্য থাকে গুছিয়ে রাখা সালোয়ার-কামিজ, দেশী বিদেশী শাল থেকে শুরু করে গহনার বাক্স পর্যন্ত মুখ টেপাটেপি করে হাসে। চাদরটির অস্বস্তি হয়। দম বন্ধ লাগে। আবার কবে বাইরে বের হবে, ভাবে। ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে যায় অনেকগুলো শীতের পেছনে। 
ফোয়ারার পছন্দের এই হলুদ চাদরটির প্রেমে পড়েছিলো একটা কালো চাদর। চাদর হিসাবে কালো রঙ একটু আনাড়ি, কেমনজানি ছেলেমানুসি একটা রঙ। তবুও। প্রেম তো! হয়ে গেলেই হয়ে যায়। হয়ে যাওয়ার পরই চাদরের বুকটায় এসে ঘিরে ধরে শীত। 
চাদর দুটির কত যে কথা হতো! কালো চাদরটি একটু দুলে হলুদ চাদরটিকে স্বপ্ন দেখাতো--, দেইখেন প্রিয়, কোনো এক বসন্তের রাতে, তারের উপর পাশাপাশি আমরা ঝুলে থাকব । চাঁদের আলোয়, হাসনাহেনার গন্ধে-- তাকিয়ে তাকিয়ে একে অপরের দুলতে থাকা দেখব। হলুদ চাদরটি ঢং করে প্রশ্ন করে-- খালি তাকায়েই থাকবেন? গান করবেন না? বলেই খিলখিল করে হাসতো! 
ফোয়ারা বিবি চাদর দুটির কথা বুঝত কিনা কে জানে। 
ফোয়ারা বিবি দোলনায় পা ঝুলিয়ে দোল খায় 
ফোয়ারা বিবি চাঁদের আলোয় গা ভাসায় 
ফোয়ারা বিবি হাসনাহেনার তীব্র গন্ধে ডুবে যায় 
কালো চাদর পরা লোকটি টানা তাকিয়ে থাকে৷ ফোয়ারাকে ইশারা দেয়। ফোয়ারা আর সেই লোকটি সিদ্ধান্ত নেয় ওরা পালিয়ে যাবে শহর ছেড়ে৷ কে জানত, চাদর দুটিও ভেবে নিয়েছিলো, ওরা পালাবে। 
কালো চাদরের বুকে হলুদ চাদর 
হলুদ চাদর বাতাসে দোল খায় 
হলুদ চাদরের বুকে কালো চাদর 
বাতাস এসে এসে ফিরে যায় 
ফোয়ারার পালানো হয়নি৷ সেই লোকটিকে আর কোথাও অপেক্ষা করতে দেখেনি কেউ। কালো চাদরের কথাও কেউ মনে রাখেনি। একমাত্র হলুদ চাদরটি ছাড়া। 
সাময়িক মোহগ্রস্ত হলুদ চাদরটি আলমারিতে ফিরে আসার পরপরই একটা নীল চাদরের জায়গা হয় অর পাশে। যেমনটা হয় ফোয়ারা বিবির পাশে রাকায়াতের। শান্ত, ছিমছাম বোঝা পড়ার ত্রিশ বছরের সংসার। সব ঠিকঠাক। সবাই ভুলে গেলেও হলুদ চাদরটি সব মনে রাখে। আলমারির ন্যাপথলিনে কালো চাদরের স্মৃতির ঘ্রাণ, খুব টের পায় সে। 
ফোয়ারা বিবি মাঝে মাঝেই সেলাই করে হলুদ চাদরটিকে বাঁচিয়ে রাখে। বুকের বাম অংশটাই কেন জানি বারবার ছিঁড়ে যায়।

কাউন্টডাউন

ফাইশাকে যখন বিয়ে করি, আমরা দুইজনাই জানতাম—আমাদের সন্তান হবে না৷ 

বাইরে থেকে ফিরে এসে প্রায়দিনই খেয়াল করতাম, ফাইশা জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে৷ বাইরে সারি সারি মেঘ, পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠার দৃশ্যটা দেখে মনে হতো মেঘগুলা যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। ফাইশার চোখে সমস্যা থাকায় দূরের জিনিস ভালো দেখতে পেতো না৷ তাহলে কী ফাইশা হাপিয়ে পড়া মেঘগুলোকে খুঁজতো? 
আমার হারিয়ে ফেলা অভ্যাস, তার উপর কোথায় কী রাখি, মনে থাকে না৷ খুটখাট শব্দ শুনে, আমার দিকে না তাকিয়েই ফাইশা বলে দেয়—ফোনের চার্জারটা টেবিলের বামপাশে, চশমার খাপ বিছানায় মাথার কাছে। আমি মুচকি হেসে লজ্জা লজ্জা গলায় বলি—তুমি দেখি এই কয়দিনেই সব নখদর্পনে নিয়ে ফেলছো! 
ফাইশা ইদানীং বেশি কথা বলে না। চুপচাপ শুধু তাকিয়ে থাকে৷ যেন জানলাটাই ওর সংসার, পাহাড়ের গাছগুলো ওর সন্তান, আর হাপিয়ে পড়া মেঘগুলোই ওর নিত্যসঙ্গী। 
আমি দিনরাত ফাইশাকে বুঝাতে চাই, যতটা পারি সান্ত্বনা দেয়ার চেস্টা করি। ফাইশা হঠাত মেঘের সংসার ছেড়ে আমার দিকে তাকায়। ওর ফ্যাকাশে চোখে কী গভীর শীতলতা! আমি ভয় পেয়ে যাই। 
সেদিন বাজার থেকে একটা মাটির গহনা নিয়ে ওকে দিয়ে চোখ নাচিয়ে বললাম, মনে আছে দোয়েল চত্বরের সামনের সেই কারুরশিল্পের দোকানগুলার কথা? ফাইশা হঠাত হেসে দেয়, বলে—তুমি সারা সন্ধ্যা আমার ব্যাগগুলা দুই হাতে নিয়ে টানছিলা। একটু পর পর অতি সাবধানে মাটির জিনিসগুলাতে হাত দিয়ে আগলে রাখতে গিয়ে আরও বেশি ঠোকা লাগায়ে ভেঙে ফেলছিলা! আমি এবারো লজ্জা পেয়ে যাই৷ 
আহ কি দারুণ ছিলো সেইসব সন্ধ্যারা! আমরা দুইজনাই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সেই কতোদিনের কথা! একটা ক্যাম্পিং এ আমাদের পরিচয়। মনের দেনা লেনা। মাত্র সাতদিন হাতে ছিলো আমাদের। আমরা রোজ কাউন্টডাউন করতাম, আর মাত্র ছয় দিন বাকি। তারপরেই আবার কে কোথায় চলে যাবো, আর হয়ত দেখাই হবে না৷ ফাইশাও সাড়া দিতো, হুম, আর মাত্র পাঁচদিন। 
হুটহাট মনের লেনা দেনা হলেও আমরা যেন আমাদেরই ছিলাম। আমি যা যা বলতে চাইতাম কেমন করে ফাইশা যেন সব বুঝে ফেলতো৷ আর ও নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলো, আমার দেখা পেয়েই৷ না, ভনিতা করে আমরা সময় নস্ট করিনি। সারাদিন ক্যাম্পিং শেষে যতটা সময় পেতাম, আমরা আমাদের দিতাম। কারণ, আমাদের হাতে সময় ছিলো কম। মুহুর্তগুলো খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। 
আমরা বারবার হিসাব করতাম, আর বাকী মাত্র তিনদিন। দুই, এক..ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড.. 
সেইবার বিদায় নেবার সময় ফাইশা বলেছিলো ডাকবে৷ আমিও নিশ্চিত ছিলাম, আমি সাড়া দেবো৷ তারপরে সময়ের আড়ালে গড়িয়ে পড়ে দীর্ঘকাল আমাদের আর ডাকা বা ফেরা হয়নি। তাই বলে কী ফুরিয়ে গিয়েছিলো সব? 
ফাইশা কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা আমার হাতে দিয়ে পাশে বসে। হঠাৎ হেসে বলে ওঠে-- ত্রিশ বছর কি যথেস্ট? সেই তুমুল মুগ্ধতা ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য? আমি কাপা বুক নিয়ে শ্বাস ফেলি, বুঝতে পারি আমার ভেতরে ঢুকে পড়ছে শীত৷ 
হ্যাঁ, সেই তুমুল যৌবনে আমাদের ডাকা বা ফেরা না হলেও এই ষাটে এসে , ফাইশার জেদটা পূরণ হলো। আর আমিতো অপেক্ষাতেই ছিলাম৷ তবে আবারও কাউন্টডাউন। খুব বেশি সময় নেই আমাদের। ডাক্তার বলছে ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ, ,বড়জোর দুই মাস৷ তারপরেই আমাকে যেতে হবে৷ 
মাঝে মাঝে রাতে, ফাইশার ঘুম ভেঙে গেলে-- ওর দিকে টানা তাকিয়ে থাকা দেখে আমাকে বলে -- কি দেখো এতো? আমি হাসি। কাউন্টডাউন মনে করিয়ে দেই-- আর তো মাত্র একমাস! 
বিশ দিন, দশ, এক সপ্তাহ.. 
ফাইশা আমার মুখে হাত চাপা দেয়। কিছুক্ষণ চেস্টা করে নিজেকে শান্ত রাখার। তারপরে আর পারে না৷ ফুপিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে৷ আমি ওর কান্না থামাই না। শুধু শক্ত করে হাতটা ধরে রাখি৷ 
আমাদের ছোট্ট বাড়ির পাশেই থাংঝাং ঝর্ণা৷ দিন নাই, রাত নাই শুধু বয়েই চলে। কলকলকল...

বোকাপাখির ভাঙাডানা

নিজের আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবারের সেইরকম কোনো রেসপন্স না পাওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে গেল এমদাদুল হকের। 

তিনতলা বাড়ির সামনে পাকা গাঁথুনি দিয়ে উঁচু করে রাখা জায়গাটাতে তার খাটিয়া পাতা হয়েছে৷ এমদাদ অবাক হয়, এত বড় বাড়ি তার, এত আত্মীয় স্বজননের আনাগোনা, অথচ কান্নার তেমন শব্দ নাই! 
ছোট মেয়েটার গলা শোনা যাচ্ছে, একটু করে ফোপাঁতে ফোপাঁতে ওর বলদ জামাইকে বলছিলো— আব্বা আমাদের নতুন ফ্ল্যাটটা দেখে যেতে পারলো না। এহ, কি কথা! ফ্ল্যাট কিনতে কি যন্ত্রনাটাই না দিলো মেয়ের জামাই৷ এত করে এমদাদ বলেছিলো, এই বাড়িতেই থাইকা যা না মা,সবাই একসাথে মিলামিশে থাকি! না কিছুতেই মানলো না। জামাইয়ের অফিস, ছেলের স্কুল কত অজুহাত! 
একটু পরপর এলাকার লোকজন আসছে, দাড়াম দাড়াম করে মেইনগেইট খুলছে, লাগাচ্ছে৷ এসে কি একবার কোনোরকম মুখের দিকে আলগোছে তাকিয়ে ব্যাস দায় দেনা শেষ! এমদাদের এইসব আদিক্ষেতা মোটেও ভাল লাগে না। 
টাংগাইল থেকে বড় ছেলে বউ ছেলে মেয়েসহ রওনা দিছে। কখন আসবে কে জানে! এই রাতে কেন যে গাধাটা রওনা দিতে গেল! আরে বাবা, মারাই যখন গেছি এখন অত তাড়াহুড়ার কি আছে। ধীরে সুস্থে আসলেই তো পারিস। 
সবাই বলাবলি করছিলো, বড় ছেলে আসলেই দাফন হবে৷ এই প্রথম এমদাদ তার ছেলের বাড়ি আসার জন্য তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না৷ এইসব আসার কোনো মানে আছে? 
এমদাদ বড়ছেলেটাকে বলেছিলো, মাসে অন্তত একদিন ত আসতে পারিস! ছেলে হাসে, বলে আপনিই ত আমার এইখানে চলে আসতে পারেন আব্বা৷ রিটায়ার্ড করার পর, অইখানে থেকে আর কি করবেন!— কি কথা, কি যুক্তি! আমার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে এই বাড়ি বানায়ে উনার ভাড়া বাসায় যাবো!! এমদাদ খাটিয়ার উপর গম্ভীর হয়ে নিজ মনেই ঝগড়া করতে থাকে ৷ 
সত্তুর বছর! তাও শালা কাঁদার জন্য কেউ নাই! এই প্রথম এমদাদ নিজের বউটাকে যৌক্তিক সত্য কারণে মিস করা শুরু করে। ছেমড়িডা বাইচা থাকলে দুনিয়া কাপাইয়া কান্দত। নিশ্চিত৷ 
হঠাত চেঁচিয়ে কান্নার আওয়াজ পাওয়াতে এমদাদের মৃত বুকটা কেঁপে ওঠে৷ এ যে নাতীর কান্না! বেঁচে থাকতে ঠিকমত নাতীটাকে আদর করাও হয়নি! পরক্ষণেই মৃত এমদাদের ভুল ভাঙে। জেদী নাতির চেঁচিয়ে কান্নার কারণ—তাকে চাউমিন খেতে দিচ্ছে না! 
মানা যায়!! এমদাদের মেজাজ ক্রমেই আরো খারাপ থাকে। 
পাশের বাসার শফিউল ভাই, আহরে এই লোকটার সাথে রোজ সকালে হাঁটতো এমদাদ। কত মিশুক আর ভাল লোক! অথচ এই শালাই এমদাদের খাটিয়ার পাশে লোকজনকে বলছিলো— যাক, লোকটা ভালো ভাবেই গেলো! বিছানায় পড়ে ধুকে ধুকে কস্ট পেত হলো না!!! আহা, আরে হারামজাদা, আমি কি এই দ্রুত মরতে চাইছিলাম? কোথায় ছেলে মেয়েরা সবাই তাকে যত্ন টত্ন করবে , এমদাদের জন্য টেনশন করবে, রাতে ঘুম হবে না দুশ্চিন্তায়! তা না,ধপ করে পড়ে, দপ করে মরে গেলাম! এমদাদের ঠান্ডা শরীর রাগে যেন জ্বলছিলো! 
গভীর রাত৷ বাইরে অন্ধকারে খাটিয়ায় এমদাদ একা। দরজা জানলা লাগিয়ে সবাই ভেতরে বসে চুপশোক পালন করছে, অথবা দুখ দুখ একটা ভাব দেখাচ্ছে। এদিকে যে হালকা বৃষ্টি শুরু হইছে কারও সেদিকে খেয়াল নাই। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে এমদাদ খাটিয়া থেকে নেমে হাঁটা দেয়। গেট দিয়ে বের হয়ে সেই যে গেলো, অভিমানী এমদাদকে আর কেউ তিনতলা বাড়িটার ত্রি- সীমানায় ঘেঁষতে দেখেনি।

নওশান মিসয়াই

আদিবাসী বন্ধু নওশান মিসয়াই যখন ওর গোপন ইচ্ছাটা বললো, আমরা সকলেই হো হো করে হেসে দিলাম!

নওশান মিসয়াই এই শহরে নতুন। কি এক কারণে পাহাড় ছেড়ে আমাদের এই দমবন্ধ করা ঘিঞ্চিতে উঠেছে, আর কেমনে কেমনে যে আমাদের সাথে বন্ধুত্ব হলো সেটা হুট করে কারও খেয়াল হয় না। তবে আপাতত নওশান মিসয়াই রওনা হয়েছে কাঠের দোকানে। জানলা কিনবে৷ 
সেইদিন রাতের মিল খেয়ে আমরা তখনও কাজের বুয়াটাকে গালাগাল দিচ্ছিলাম, মহিলা রান্না করে না ইয়ারকি? এর ভেতরেই নওশান মিসয়াই হুড়মুড় করে আমাদের ছোট্ট ব্যাচেলর মেসটাতে ঢুকে পড়ে৷ ওর হাতে ছোটখাটো একটা কাঠের জানলা! 
আমরা একে একে নওশানকে রিমান্ডে নিলাম, অই শালা রোহিংগা ঘরবাড়ি নাই তুই জানলা দিয়ে কি করবি? নওশান ওর ছোট ছোট চোখগুলো আরও ছোট করে রাখে। আতিক খেকিয়ে ওঠে, অই চাইনিজের বাইচ্চা, এই ছোট্ট ঘরে পাঁচজনই ঠিকমতো থাকতে পারি না, আবার জানলাডা কই রাখবি? নওশান মিসয়াই কি যেন ভাবে। তারপর হঠাৎই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। 
সুতরাং নওশান মিসয়াই এবং তার জানলা নিয়ে আমরা আর জল ঘোলা করলাম না। 
সেদিন ছুটির দিনে, আতিক ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল-- নওশান আতিকের পা টা জানলার উপর থেকে সরিয়ে প্রনাম করায় আমরা বেশ বিস্মিত হই। আমি বললাম কিরে তোদের কি জানলারও দেবতা আছে নাকি? কথাটা আরেকটু আগাইতো, বাসা থেকে আম্মা ফোন করায় আমি সাইডে সরে আসলাম। 
আমাদের সবারই বাসা বা বাইরে থেকে ফোন আসে, কিন্তু নওশান মিসয়াই এর ফোন আসে না। ওকে জিজ্ঞাস করলে বলে-- পাহাড়ি এলাকায় নেটওয়ার্ক দুর্বল...আমাদের অবশ্য অন্য ধারনা, নওশান এর নিজের নেটওয়ার্কেই ঝামেলা আছে! 
প্রায় রাতেই নওশান জানলাটা নিয়ে বাইরের বেল্কুনিতে গিয়ে প্রার্থনা করে। আমরা ঘুমের মধ্যেই হাসি। নওশান কিছু বলে না, চুপচাপ জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ সেদিন মেসের আর সবাই বাইরে বেড়াতে যাওয়ায় আমি আর নওশান ছিলাম রাতে৷ নওশান যখন জানলার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠ করছিলো আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াই। নওশান এর কাঁধে হাত দিয়ে বলি, দোস্ত পাগলামু তো অনেক হলো,মান অভিমান ভুলে দেশে ফিরে যা। 
নওশান আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো আয় তোকে আমার দেশ দেখাই । বলেই জানলার পাল্লাটা খুলে আমাকে ঢুকিয়ে দিলো। আমিও কিছু না বুঝেই ছোট্ট জানলার ভেতর গলে যেতে লাগলাম। 
প্রথমে আমি মেঘ দেখলাম। তারপর দেখলাম পাহাড়ের বড় বড় টিলা। প্রচন্ড বাতাস আমার চোখ মুখ বুজে আসছিলো, একটু ধাতস্ত হতেই বুঝতে পারলাম আমি ভাসছি। কিন্ত হাত নাড়তে গিয়ে কেমন ফটফট আওয়াজ শুনে বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠলো৷ আমার হাতের বদল পালক! পায়ের দিকে তাকাতেই সন্দেহটা কেটে গেলো, হ্যাঁ আমি পাখিই হয়ে গেছি৷ 
কিরে বন্ধু, আমার পাহাড়ের দেশ কেমন লাগছে? উত্তর করতে ভয় পাচ্ছিলাম, কন্ঠটাও যদি পাখির মত কিচির মিচির শোনায়! তবে উড়তে উড়তে ভালোই লাগছিলো। বেশ কিছুক্ষণ ওড়ার পর নওশানকে বললাম এইবার জানলা দিয়ে আমাকে বের কর। 
কইরে নওশান 
নওশান 
নওশাইন্না.. 
নওশান জানলা বন্ধ করে কোথাও গেছে হয়ত। হয়ত ঘুমাইছে। নয়ত আশেপাশে গেছে, অগত্যা অপেক্ষা করতে থাকি 
আমি অপেক্ষা করি নওশান ঘুমায় 
আমি অপেক্ষা করি নওশান কোথাও থেকে ফিরে আসে না 
আমি ডানা ঝাপ্টাই, ছটফট করি, নওশান আমাকে ভুলে যায়.. 
শেষ পর্যন্ত রাগ অভিমান আর অসহায় ডানা নিয়ে আমি উড়তে শুরু করি, পাহাড়ের দেশে। আমি মেঘ দেখি না, সবুজ দেখি না, পাহাড়ের গা ঘেষে এঁকেবেকে চলা নদীটাও দেখি না, আমি শুধু উড়তে থাকি। আমার চোখ খুঁজতে থাকে একটা জানলার। 
উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে, একটা গাছের উপর কেবলই আমি ডানা ছড়িয়ে বসেছিলাম, হঠাত একটা সুতায় আমার পা আটকে গেল। এইবার সত্যিই আর চাপ নিতে পারছিলাম না। 
ফাঁদে আটকা পড়ে আমি ঝুলে আছি। সামনের আগুন ঝলসানো ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই বুকটা হিম হয়ে আসছিলো। হাফ প্যান্ট পরা শিকারী ছেলেটি এসে আমাকে দুই হাত চেপে ধরে পাখির খাচাটায় ঢুকিয়ে জানলাটা আটকে দিলো। 

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটিকে, এই তো সেই নওশান মিসয়াই...



কামরুজ্জামান কাজল
প্রকাশিত বই:
১. শ্যামপাহাড়ের আড়ালে (কাব্যগ্রন্থ ২০১৬)
২. দলছুট শালিকগণ(অণুগল্পগ্রন্থ ২০১৭)
৩. আটপুকুরের ফুল(অণুগল্পগ্রন্থ ২০১৮)
৪. ভেতরে ভেতরে খেলা করে যারা(অণুগল্পগ্রন্থ ২০১৯)
এক গুচ্ছ অণুগল্প • বিলাল হোসেন

এক গুচ্ছ অণুগল্প • বিলাল হোসেন

গগনউড়া মাঠ

‘…একটি গগনউড়া মাঠ বিক্রয় হবে। মাঠের পরিমান তেপান্তরের সমান। মাঠের ভেতরে আছে নানাজাতের নদী,রংবেরঙের আকাশ আর নানাপ্রজাতির ছোটবড় অরণ্য’।

এই রকম একটা বিজ্ঞপ্তি দেখে শহরের শিল্পপতি কেসি দেব ঠিকানা মত এসে দেখে ম্যাচের কাঠি দাঁত দিয়ে ভেঙে দু টুকরোর একটুকরো থু করে ফেলে সরু অংশে দাঁত খোঁচাচ্ছে যে লোক; তার পরনে ময়লা লুঙ্গি শরীরে কুঁচকানো জামা। 
—আমি এসেছি অনেকদূর থেকে—কেসি দেব বলল— শুনেছি গগনউড়া মাঠ নামে একটা মাঠ বিক্রয় হবে। আপনি কি বলতে পারেন সেটা কোথায় ? 
দাঁত খোঁচানো বাদ দিয়ে লোকটা এবার কান খোঁচানো শুরু করল। চোখ সরু করে বলল—গগনউড়া মাঠ ক্রয় করতে আসছেন ? 
—হ্যাঁ।কিন্তু মাঠটি কোথায় ? মালিক কে ? দামদস্তুর কি? 
—অনেক দাম কিন্তু । পারবেন ক্রয় করতে? 
—আমি গ্রুপ অব কম্পানিজের মালিক কেসি দেব। পুরো দুনিয়া কিনতে পারি আমি। এখন বলেন গগনউড়া মাঠ কোথায় ? 
আঙ্গুল তুলে দেখাল—অইদিকে। একটা খাল দেখবেন । খালের পারে এক তালগাছ ।অইখানে। 
লাল গাড়িতে উঠেই হুস করে টান দিল। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর এক মরাসূতার খালের দেখা মিলল। আর খালের পাশেই তালগাছ। মাথার ওপর তালগাছ নিয়ে বসে আছে এক ভিক্ষুক। গায়ে তালিমারা চাদর। আশেপাশে আর কেউ নাই।বিরানভুমি। 
গাড়ি থেকেই জিজ্ঞাসা করল কেসি দেব— আচ্ছা, গগনউড়া মাঠ কোনটি ? এর মালিকই বা কোথায় থাকে? 
ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে ভিখারিটি বলল— আপনি গগনউড়া মাঠে যাবেন বাবু? সে ত আরও খানিকটা দূরে।উৎরাইল হাটকে বামে রেখে তিন মাইল গেলে ভুমিপুত্রের কাছে ঠিকানা পাবেন । আচ্ছা, ওখানে কেন যাবেন—কিনবেন বুঝি? 
—ইচ্ছা আছে। যদি পছন্দ হয়। 
—এত দামি মাঠ কেনা সম্ভব হবে আপনার পক্ষে? শুনেছি অনেকেই এসে ফিরে গেছে। কুলায়নি । 
প্রকৃতই বিরক্ত হয়ে উঠল কেসি । এইসব ফকিরমিসকিনদের সাথে কথা বলাই ঠিক না—তার কী পরিমান টাকা পয়সা,এদের ধারণাই নাই। 
সে সোজা গাড়ি স্টার্ট দিতেই গাড়ি উড়ে চলল ভূমিপুত্রের দিকে। 
ভূমিপুত্র দেখেই বলল— কেসি দেব বাবু,আপনি কি জানেন গগনউড়া মাঠে কি কি আছে? 
কেসি ঠিক বুঝতে পারল না, এক গগনউড়া মাঠ নিয়ে এত কথা কেন ? সে এই জীবনে এত এত জমিজমা কিনেছে যে মনে করেও বলতে পারবে না। তার সামনে নিতান্তই এক চাষাজাতীয় লোক কথা বলছে । কথা বলছে এমনভাবে, সে ঠিক নিতে পারছে না। হচ্ছেটা কি ? 
কেসি দেবের রোখ চেপে গেছে। সে জীবনে কোথাও হারেনি আজও হারবে না। সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। ভূমিপুত্র বলল— মূল গগনউড়া মাঠ অই দিকে। আয়নালের দিকে। 
গাড়ি ছুটে চলল অই দিকে। 
আয়নাল বলল— গগনউড়া মাঠ সেইদিকে, জয়নালের দিকে। 
গাড়ি ছুটে চলল সেইদিকে। 
জয়নাল বলল— জগতপারের ঘাটে চিন্তামুনি জানে সব। নেই দিকে। 
বিধ্বস্ত কেসি দেব এসে পড়ল নেই দিকে; চিন্তামুনির বেদীমুলে। চিন্তামণি বললেন— কেসি নিজের দিকে তাকাও । তোমার ভেতরেই আছে গগনউড়া মাঠ, বিস্তৃত আকাশ ।তোমার অন্তরে আছে থই থই করা পরম পাথার। সেখানে ডুব দাও। গগনওড়া মাঠ একা পড়ে আছে,সেখানে দাঁড়াও। আর এখানে বস। 
এই বলে একটি আকাশমণি গাছের নিচে কেসি দেবকে বসিয়ে দিল। কেসি দেব বসে বসে কী ভাবল কে জানে ,শুধু এইটুকু বুঝতে পারল— কে যেন তার অন্তরের গহীনে একটি মহাজাগতিক ফুঁ দিল আর সে বোধশূন্যতায় পিছলে পড়ে হয়ে গেল । উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে লক্ষ্য করল— একটি শাদা রঙের গাড়ি এসে বলল— আচ্ছা, গগনউড়া মাঠ কোন দিকে?  
শতচ্ছিন্ন পিরান গায়ে কেসি দেব বলল— ক্রয় করবেন বুঝি ? এত টাকা আছে কি আপনার ? 

এনায়েত- মজাফফরদের গল্প

শহরের ঠিক মধ্যেখানে পাইন আর দেবদারু পরিবেষ্টিত মাঠে সবাই একত্র হয়েছে; অভিজাত পুরুষদের অভিজাত স্ত্রীরা। দেখা হয় প্রায় প্রায়ই,বিকেলে। 
স্ত্রীদের হাতে থাকে চেইন; চেইনের মাথায় আটকে থাকে বিদেশি কুকুর। তারা চেইনে টান খেতে খেতে ঘোঁত ঘোঁত করে আর স্ত্রীদের হাত নরম হওয়ার ফলে সে-হাতে শক্তি থাকে কম। ফলে স্ত্রীদের গলায় আহ্লাদ থাকে পুর্ণরুপে। কৃত্তিম বিরক্ত ঢেলে বলে— আহ মজাফফর এমন করে না ! দুষ্টুমি করে না লক্ষ্মী!

শুনলে মনে হবে— মিসেস ধানমন্ডির কুকুরের নাম মজাফফর— ব্যাপারটা আসলে সেরকম না। অভিজাত স্ত্রীরা তাদের কুকুরদের নাম স্বামীদের নামে করে থাকে।পুরুষরা এই খবরের কিছুই জানে না। এই গোপন তথ্য শুধু স্ত্রীমহলই জানে। সুতরাং , গ্রে হাউন্ডরূপী মজাফফরকে যখন দুষ্টু বলে আহলাদ করে তখনও সে দুষ্টুমি করতেই থাকে। মজাফফর/ গ্রে হাউন্ডের মতই গন্ধ শোঁকে । ঘাসে মাটিতে কাদায় । স্ত্রীদের দামী শাড়িতে। গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সেলে বেশি চাপ পড়লে গায়ের ওপর ঝাঁপিয়েও পড়ে কখনও কখনও। আজকেও অইরকম।

দুষ্টুমি করে না , করে না— বলে রাগ দেখায় মিসেস ধানমণ্ডি । মিসেস বনানী বলে— আপনারটা একটু বেশি নটি ভাবী। আর কী কিউট! বলে একটু আদরও করে দেয়।

মিসেস ধানমণ্ডি বলে— নটি হলে ত ভালোই ছিল,আমারটা বুঝলেন ভাবী, খুব ক্রেজি । সামলাতে দম বন্ধ হয়ে যায় । 
—ওমা তাই নাকি ! এইবলে আকাশে চোখ তুলে অবাক হয়— মজাফফরকে একদিনের জন্যে দিয়েন ভাবী। দুষ্টু মজাফফর কত দুষ্টু কতটা ক্রেজি একবার দেখব। আমার এনায়েতুল্লাহকে না হয় একদিনের জন্যে ধার নিয়েন।

মজাফফরকে এনায়েতুল্লাহর সাথে বদলে নেয়ার এই প্রস্তাবে উত্তর দেয়ার আগেই মিসেস ধানমণ্ডির ফোন বেজে ওঠে— সিঙ্গাপুরে ? যাওয়ার আগে একবার জিজ্ঞেস করারও ইচ্ছে হয় না? তোমার সাথে কে গিয়েছে ?নিশ্চয়ই তোমার সেক্রেটারি । হ্যাঁ হ্যাঁ , জানি সব জানি। 
লাইন কেটে দেয় । 
— কি হল ভাবী? 
—দেখুন না ভাবী , হাজবেন্ড যদি মাসের তিরিশটা দিনই বিদেশে পড়ে থাকে কেমন লাগে? 
—আর বইলেন না ভাবী , আমার হাজবেন্ড কতদিন ধরে বিদেশে আমি ভুলেই গেছি। আগে ফোন টোন দিত । এখন তাও দেয় না। সে যাক । এই ভাল আছি । আমার এনায়েতুল্লাহকে নিয়ে আছি বেশ , কী স্লিম ফিগার দেখেছেন ভাবী?

এলসেশিয়ানকে দেখিয়ে কুট কুট করে হাসে মিসেস বনানী।

এদিকে যখন এনায়েত আর মজাফফর অদল বদল হয়ে যাচ্ছিল তখন মিসেস গুলশান মাঠের অন্যপাশে মিসেস উত্তরার মধ্যে কি কথা হচ্ছিল , আদৌ কিছু অদল বদল হচ্ছিল কিনা শুনতে পাইনি। তবে তাদের দুজনের হাতে শেকলে ধরা ছিল এম মহিউদ্দীন এবং চৌধুরী কুরবান আলি। 

কুমির বিষয়ক ধুলো

এই নদীতে কুমির নেই।ছিলও না কখনও । 
এইসব নদীতে; এমন জলটলটলা পিঁপড়েলাগা মিষ্টি জলের নদীতে কুমির থাকে না। এটা সাধারণত। প্রধানত হয় কি না জানা নেই, তবে দুইবেলা নিয়ম করে জোয়ার ভাটা হয়—সেটা প্রাকৃতিক। একবার এক মাঘীপুর্ণিমারাতে জোয়ারের কালে আকাশে মস্তবড় চাঁদ উঠেছিল;জনশ্রুতি আছে, সেবার নাকি জোয়ারের পানির সাথে ভেসে এসেছিল একটি কুমির ।

কুমিরটিকে কেউ দেখেনি।

নরেন জোয়ারদারের অনেকগুলি চোখ,সেজন্যে কোথায় কী ঘটে— দেখতে পায়।তার উঠানে ভিড় করে আসা গ্রামের মানুষদের বলেছিল— চৌইদ্দ হাত লম্বা কুমির। আরে লেঞ্জাটাই ত হইব তোমার নয় হাত। লেঞ্জার কী ডক! খাঁজ কাটা, খাঁজ কাটা।

গ্রামবাসী ভয় পায় । ভয় পেয়ে পোতায়ে যায় ।

কাটাভরা শবীরের কথা বাদই থাকল, অই নরেন জোয়ারদারের বর্ণনা সুত্র ধরেই অর্ধডোবা মাথা আর ড্যাবড্যাবে চোখ না দেখেও ভয়ে কাঁপতে থাকে পুরো গ্রাম।

নদীরঘাটে সকাল হয়,সন্ধ্যা হয়— কেউ নামে না নদীতে।চৈত্রমাসেও স্নান হয় না। মাছেরা বড় হতে হতে অনেক বড় হয়ে যায়—তাদের কেউ ধরে না। ঝাপাঝাপি হয় না আর আগের মত। তবু গ্রাম থেকে মধ্যে মধ্যেই মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়। কই যায় তারা, কেউ জানে না।

নদীরঘাটে মাঝবয়সী অশথ তলায় বসে ভাবে কেউ কেউ। নিজেদের মধ্যে কথা বলে। 
—অই হাকি , নদীত নাকি কুমির আছে , দেখলাম না ত। দেখছস? 
—না কাকা । অই মিবাই , তুমি দেখছনি চৌইদ্দ হাত লম্বা কুমিররে? 
—না দেখি নাই। লালমিয়া ভাই তুমি? 
—না। 
—সুরেসদা তুমি ? 
—নারে ।আমরা ত কেউ দেখি নাই। তাইলে কে দেখছে ? 
—নরেন জোয়ারদার । সে দেখছে একলাই দেখছে।

সবাই ভাবে । গালে হাত দিয়ে ভাবে।

জোয়ারদার পকেটে রঙের ডিব্বা হতে একচিমটি রঙ এনে গ্রামের চোখে কাজলের মত পড়িয়ে দিলে ভাবুকরাও বলতে শুরু করল—আমি একবার কুমিরটারে দেখছি, ইয়াব্বড়!কিয়ের চৌইদ্দ হাত লম্বায় হইব কমছে কম আটাইশ হাত।

মুচকি হাসে নরেন জয়ার্দার।

বাড়ির পেছনে শনক্ষেতের ভেতরে অনেক বড় পানাপুকুর। সেখানে নড়েচড়ে কাঁটাওলা শরীর । শালায় শুধু মানুষ খেতে চায়।

তরিকা 

পীর সাহেব জালালউদ্দীন রুহানী হুজরাশরীফ থেকে বাড়ির পেছনের যে জংলামত জায়গাটা আছে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মাঝেমধ্যেই। একটা ভয় কুড়ে কুড়ে খায়। বিশাল জঙ্গুলে জায়গাটা কেমন ভারী হয়ে থাকে। মনে হয় জঙ্গলটাও তার হুজরার দিকে তাকিয়ে আছে। 
পীর সাহেবের মনের ভেতরে সারাক্ষণ এই ব্যাপারটা চেপে বসে থাকতে থাকতে আর না-পেরে খাস মুরীদ লোকমান হাকীমের সাথে আলোচনায় বসলেন। 
— বুঝলে লোকমান হাকীম, হুজুরে কেবলার কবর বাড়ির পেছনে। সেখানে ঝোপঝাড়ে শেয়ালের বসতবাটি হয়েছে। সাপের প্রাদুর্ভাব হয়েছে । এসব দূর করার ব্যবস্থা কর নইলে হুজুরের কোপানল থেকে কেউ রক্ষা পাবা না। 
লোকমান হাকীম মাথা নাড়ে । 
— সাপখোপ খেদানোর ব্যবস্থা নেও । গঞ্জ থেকে ওঝা আনাও । বাস্তু সাপে কিলবিল করে বাড়ির পেছনে । 
লোকমান হাকীম মাথা নাড়ে । 
— বাড়ির চারপাশে বাড়িবন্ধ করার দিন তারিখ ঠিক কর;জীনের আছর থেকে মুক্ত রাখতে হবে । 
— জি আচ্ছা । 
— বাড়িবন্ধের কাজটা আমি নিজেই করব । এলান করে দাও । সব মুরি্দানের মোকাবেলায় কাজটা করতে চাই। 
— জি আচ্ছা । 
— চৈত মাসের মধ্যেই সব কাজ শেষ করে ওরসের কাজ ধরব।

হুজুর কেবলার সব আদেশ নির্দেশ জারি হওয়ার পর লোকমান হাকীমের ব্যস্ততা বহুগুণে বেড়ে গেল । 
নরম মাটির ভেতরে গর্ত খুড়ে শেয়ালদের বাসা করার মজা ছুটাইয়া দিতে হবে । সবার আগে দরকার বাড়ির পেছনের সাপ খেদানোর জন্যে বরকত মুন্সিকে । তার ডিমান্ড একটু বেশি । টাকা পয়সা বেশি না পেলে গঞ্জের বাইরে আসে না । মোটা অংক পেতেই একগাল হেসে বলল— কামডা কবে করতে চান ?

তারিখ নির্ধারিত হল । ১৩ আশ্বিন । ‘সই’—বলে ওঝা বিদায় নিলে লোকমান হাকীমের মনের ভেতর ভাসতে থাকে —চিশতিয়া তরিকার বড় হুজুরের গদীনশীন আওলাদ জালাল পীরের চেহারা মোবারক।

ওঝা আসে আশ্বিনের সকালে। সাথে অনেক সাগরেদ । বীনার ফুটায় ফুঁ দেয়ার আগে পুরো এলাকাটা চোখ বুলিয়ে নেয় বরকত মুন্সী।বাড়ির পেছনে ছোট ছোট কিছু টিলা । টিলার নিচে ডোবা । ডোবার ভেতরে আলো ছায়া জাফরি কাটে । আর এখানেই পা আটকে গেল মুন্সীর ।

সে দেখল— ডোবাটা ঘিরে প্রচুর ঝোপঝাড় । আর ঝোপের মধ্যেই মুন্সী শুনতে পেল বিজ বিজ শব্দ । হিস হিস শব্দ। খেয়াল করে দেখল ডোবা ঘিরে হাজার হাজার সাপ। 

হাত থেকে বীন পড়ে গেল মুন্সীর। যে যে-দিকে পারল সাগরেদরা ছুটে পালাল। মুন্সী পালাতে পারল না । তার দুপা জড়িয়ে মাটির সাথে গেঁথে রেখেছে মোটা মোটা সাপ।

ডোবার নরম মাটিতে আস্তে আস্তে বরকত মুন্সী দেবে যেতে লাগল। কোমর পর্যন্ত ডুবে যাওয়ার পর যখন ভয়ে চিৎকার করে উঠতে যাবে তখনই কেউ কথা বলে উঠল—ভয় পেয়ো না মুন্সী!

মুন্সী দেখল তার সামনে জিহ্বা বের করা বিশাল এক সাপ। কুণ্ডলী পাকানো । তার সারা শরীরে কিলবিল করছে হাজার হাজার সাপ।

—যে সাপ ধরতে তুমি আসছ , সে সাপ নয় । সাপের সুরতে জীন । তুমি চলে যাও । হুজুর কেবলাকে বলে দিও সব আগের মতই থাকবে । শনবন । শেয়ালপাড়া । বালির ঢিবি । বনজঙ্গল ডোবা সব। বাড়িবন্ধ দিলে তারও সেই একই দশা হবে যেমন হয়েছিল তার বাবার। তুমি কি জান তার ইনতেকাল কীভাবে হয়েছিল ?

মুন্সী দরদর করে ঘামতে লাগল। সে দুদিকে মাথা নেড়ে জানাল— জানতে চায় না।

— আগামী মাঘে আসিও জালাল পীরের ওরস মোবারকে । জালাল পীরের সুরতে আমিই থাকব। যেমন ছিলাম তার বাবার সুরতে।

রগড় 

বৃহস্পতিবার রাতে ভাস্কর হাসানের স্ত্রী হঠাত বলল— কাল রত্নার স্কুল নেই , রাহাতেরও নেই । 

কৌতূহল নিয়ে তাকাল কবি ভাস্কর হাসান । অনেকদিন পর এই কৌতূহল নিয়ে তাকাল সে। আসলে কৌতূহল নিয়ে তাকানোর বিষয়টি স্ত্রীর ওপর নির্ভর করে । স্ত্রী পছন্দ করে না বলে কৌতূহল নিয়ে তাকানো আর হয় না । 

স্ত্রীর পছন্দ -অপছন্দই ভাস্কর হাসানের পছন্দ- অপছন্দ । 

একটা কবিতা লিখছিল কবি । সেই সন্ধ্যা থেকে কবিতাটা যে আটকেছে—ছোটার নাম নেই । একমাত্রা কম হয়ে যাচ্ছে ।

স্ত্রী ঘাড়ের ওপর আয়েস করে দু'হাত তুলে বলল— আহ কী শান্তি !

— কেন , শান্তির কি হল ? অবাক কবি ।

— বাচ্চাদের স্কুল নেই । সকালের নাস্তা বানানোর তাড়া নেই । বেলা পর্যন্ত ঘুমাব । কাল হলি ডে ! 
ডে 
ডে 
ডে 
ভাস্কর হাসান কিছুটা আশান্বিত হয়ে ওঠে । মনে মনে ভাবে--আজ হবে কি !

কবিতার খাতাটা সরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল । নাইটি পরা অবস্থায় ভালই লাগছে । কী এক পারফিউম মেখেছে । 

—কী পারফিউম ? বেশ ঝাঁঝালো কিন্তু ! টেক্সি টেক্সি !

প্রশ্ন করেন সদ্য কবিতা থেকে চোখ ফেরানো কবি । ভাস্কর হাসানের জিবের সামনের ছুঁচলো অংশটুকু ছোটবেলা থেকেই কাটা । এই কারণে অনেক বর্ণ উচ্চারণ করতে পারে না । 

যখন স্ত্রী ছিল বউ'র মত তখন মেনে নিয়েছিল ব্যাপারটা কিন্তু বউ থেকে ক্রমশ স্ত্রী হওয়ার পর আর মানতে পারেনি । ফলে কৃৎচ্ছতায় কেটে গেছে কতদিন— হিসাব করে বলতে পারবে না , সংখ্যাটা এত !

আজ স্ত্রীটি আবার বউ'র আচরণ করছে । আনন্দ আর ধরে না । 

—বললা না ,কি পারফিউম ?

—লইয়াগাছি । ফরাসি । 
—দাঁড়িয়ে আছ কেন , পাশে এসে বস । 
স্ত্রীটি একবার বউ'র মত তাকায় । ভাস্কর হাসানকে একবার দেখে । কিন্তু বসে না । 

—কী ,কবিতার মাত্রা মিলেছে ?

—মিলেছে । কিছুক্ষণ আগে । তুমি যখন ঘরে এলে । আমার কবিতা বিশুদ্ধ হয়েছে ।

বউটি হাসে । চুলায় রান্না । যাই । 

কিন্তু ভাস্কর হাসান অস্থির হয়ে হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয় । কত দিন মাস-বছর-পর !

দে 
দে 
দে । 
স্ত্রীটি বউ হয়ে মাখনের মত গলে গেল ।

ওদিকে , চুলায় কিছু পুড়ছে । সম্ভবত দুধের পায়েস । 



বিলাল হোসেন
জন্ম ১ জানুয়ারি, ১৯৭৪। মাদারিপুর জেলার শিবচর থানার রাজারচর কাজীকান্দি গ্রামে। 

প্রকাশিত বই:
ক। কাব্যগ্রন্থ 
১। বিরুপা’র শুঁড়িবাড়ি [২০১৪] 
২।একলাজ্বলাপঙক্তি [২০১৬] 

খ। অণুগল্প গ্রন্থ 
১। পঞ্চাশ [২০১৫] 
২। মহাপ্রভু ও অন্যান্য অণুগল্প [২০১৬] 
৩। দেখবে এসো তিলের বাগান [২০১৭] 
৪। বিলাল হোসেনের ১০০ অণুগল্প [২০১৮] 
৫। যুগলবন্দী-[২০১৯] 

গ। প্রবন্ধগ্রন্থ 
১।অণুগল্পের অস্তিত্ব আছে [২০১৭] 
২।অণুগল্প প্রবন্ধসিরিজ- অণুগল্পের অ আ ক খ-১,২,৩,৪,৫ [২০১৯] 

ঘ। রোজনামচা 
বিলাল হোসেনের রোজনামচা-[২০১৯] 

ঙ। সম্পাদিত বই [প্রিন্ট] 
১। সেরা ১০০ অণুগল্প 
২। বাংলাভাষার সেরা অণুগল্প-১ 

চ। ইবুক সম্পাদনা 
অণুগল্প সংগ্রহ-১,২,৩,৪; গোয়েন্দা অণুগল্প সংগ্রহ; ভূত অণুগল্প সংগ্রহ; রূপকথা অণুগল্প সংগ্রহ; নীতিঅণুগল্প সংগ্রহ; চিয়ার্স চিয়ার্স চিয়ার্স; দুনিয়ার মাতাল এক হও; মাতালে মাতাল চেনে; মধুগন্ধেভরা; যুগলবন্দী; অণুগল্পের বিষয় বৈচিত্র্যের সন্ধানে; তাহাদের গল্প; অণুগল্পের শিরদাঁড়া; অণুগল্পের রোজনামচা ইত্যাদি । 

ছ। পত্রিকা সম্পাদনা 
ত্রৈমাসিক অণুগল্প পত্রিকা 

এক গুচ্ছ অণুগল্প • জীবনের প্রতিচ্ছবি ।। নাঈম হাসান

এক গুচ্ছ অণুগল্প • জীবনের প্রতিচ্ছবি ।। নাঈম হাসান


রানী 

চশমার কাচ পরিষ্কার করতে করতে মৌমিতার সামনে এসে বসল আকাশ ।

"কি সমস্যা ? " চোখ মুখে বিরক্তি ঢেলে বলল মৌমিতা । 
"কই কি সমস্যা ? " আর চোখে তার দিকে চাইল আকাশ । 

"এই যে আজকাল এত ভাব নাও । " 
"কি ভাব নিলাম ? আশ্চর্য । " 
"ফেইসবুক ম্যাসেজ দিয়েছি কাল এখনো সিন করইনি । " 
"ওহ , ম্যাসেজে ঢোকা হয়না । " 
"এতই যদি ব্যস্ত তবে কবিতা লিখে টাইমলাইনে পোষ্ট দিলে কিভাবে ? " 
" এখন সমস্যা কি বলত ? ম্যাসেজ না রিপ্লেই দিলেও রাগ করবে ? " চোখ পাকিয়ে বলল আকাশ । 
"এখন সব সময়ই তুমি আমায় ইগ্নোর কর । " 
" কি বল এসব ? " 
"ফোন দিলে ধরনা , দেখাও করনা আগের মত । " 
"ব্যস্ত আমি তাই । আর সারাদিন এত কিসের কথা ? " 
" হুম । আর রিলেশনের আগে কি বলেছিলে ? আমার সব সময় তোমার , তোমার জন্যই বেঁচে আছি , তুমি ছাড়া একা , বাচবনা , আরো কি কি । এখন কি সব মিথ্যেই ......? " চোখে পানি চলে আসে মৌমিতার । 
"দেখ এখন ন্যাকামি করোনা প্লিজ । তুমি আসলে আমার ভাল চাওনা । তুমি চাওনা আমি মন দিয়ে চাকরি করি , নিজের ক্যারিয়ার গড়ি । এই জন্য এমন কর খালি , পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া । " 
"ঠিক আছেনা দিতে হবেনা সময় , থাকো তুমি ব্যস্ত ।" কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় মৌমিতা । 
হা হা হা , অট্ট হাসিতে ফেটে পরে আকাশ । পৈশাচিক আনন্দ পায় সে । তিন বছর পাগল মত পিছে ঘুরিয়েছ , হাত কেটে তোমার নাম লিখেছি , বলতে গেলে প্রায় পা ধরেছি প্রেম পেতে , কত কেঁদে কেটে একাকার হয়েছি , লাখ খানেক টাকা খরচ করেছি , এরপর প্রেমে পরেছ । এবার এই তিন বছর এত্ত যন্ত্রনা দেয়ার প্রতিশোধ নেব তিলে তিলে । হা হা হা .........
" কিরে তুই ঘুমের মধ্যে হাসতাছস কেলা ? " মামাতো ভাই নাঈমের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে আকাশের । 
"ধুর বা* এইটা স্বপ্ন ছিল ! আমি ভাবলাম........নাহ মৌমিতা আমার প্রেমে পড়লেও এমন করুম না , মরলেও না । অনেক লাভ করি ওরে আমি । সারা জীবন রাজ রানী বানায়া রাখুম । " মনে মনে বলে আকাশ । এরপর বালিশের নীচ থেকে মোবাইল বেড় করে ফেইসবুক ঢোকে । নাহ আজও রিপ্লেই দেয়নি । এক সপ্তাহ হয়ে গেল অথচ মৌমিতা ম্যাসেজের কোন উত্তরি দিলনা ।

ধূমপান 

বালিকার সবচেয়ে বড় কষ্টের কারন ছিল, তার প্রিয়তম একজন ধূমপায়ী । 
আরিফ ধূমপান ছেড়েছে বছরখানেক হল , কিন্তু মানা করার সেই বালিকাই নেই ।

মূল্য 

সেলিম চৌধুরী চেয়েছিলেন তার মেয়েকে সুপাত্রে দান করবেন । সারাজীবন মা মরা মেয়েকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন , মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয় বিয়েও করেননি । অথচ মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করল , কোথাকার কোন ছেলেকে , দেখেই মনে হয় নিয়মিত গাজা-হিরোইন কিনতে চুরি বাটপারি করে । মেনে নিলেননা , মেয়ে আর জামাইকে ,ত্যাজ্য করলেন । ক'বছরের মাথায় পরপারে পারি জমালেন , সম্পত্তি পেল তাঁর ভাইয়ের ছেলে । 

খদ্দের বিদেয় হবার পর টাকা গোনে রিমা , নিজের ভালবাসার মূল্য না দিয়ে বাবার ভালবাসার কথা ভাবলে আজ পতীতালয়ের বাসিন্দা হতে হতনা তাকে !

ক্ষমা 

অনিক রাতভর মন খারাপ করত কেউ তার খেয়াল রাখেনা তাই ,

বালিকা তার প্রিয়তমর খাওয়া , ঘুম আর লেখা- পড়ার ব্যপারে জানতে চাইলেই শোনে অশ্রাব্য গালাগাল । 
অনিক এখন রাত ভর দু চোখে অশ্রু ঝড়ায় , বালিকার ক্ষমা পাবার আশায় !

পাসওয়ার্ড

নীল তিন বছর উর্মিকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসার পরেও উর্মির দিক থেকে কোন সারা পেলনা । পাশা পাশি বাসায় থাকে ওরা । নীল দিনের কয়েক ঘন্টা বারান্দায় ব্যয় করে শুধু উর্মিকে দেখবে বলে । কি না করল মেয়েটাকে পেতে , কিন্তু পাথর হৃদয় গলেনা । 

উর্মি গান ভালবাসে তাই সে গিটার বাজানো শিখল । উর্মির জন্মদিনে কেক , চোকলেট , ফুল এনে উইশ করল । এবং ভালবাসার কথা বলল , উর্মির উত্তর না । 
ভ্যালেন্টাইন্সে নেইল পলিশ , গ্লস, পারফিউম দিয়ে আবার প্রেম নিবেদন , এবারো উত্তর একি । 
সবশেষে উর্মির জন্য হাত পা কাঁটা কাটি করল , এবং আত্নহত্যার হুমকি দিল , কিন্তু কোন লাভ হলনা । তবুও নীল চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে । 
তারপর একদিন , 
উর্মি মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছে , দু চোখ ভেজা ! 
"কি ব্যপার কাঁদছ কেন ? মন খারাপ ? " ওপাশের বারান্দা থেকে বলল নীল । 
"এমনি । " 
"আরে কি হয়েছে বলবেতো ? " 
" ফেইসবুকে যেতে পারছিনা , ফোনের এম বি শেষ । কিরন মালার ফটো শেয়ারো করতে পারছিনা । " 
নীল মুখে হাসি টেনে বলল , "আরে পাগলী এই জন্য কাঁদতে হয় ? আমি কি মরে গেছি ? আমার ওয়াইফাই আছে আর তুমি কি এম বি নিয়ে পরে আছো , বোকা । " 
"তোমার ওয়াইফাই মানে ? তুমি ওয়াইফাই চালাও কবে থেকে ? কই তোমার নামেতো কোন ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক দেখিনি ? " 
" সেতো প্রায় তিন বছর হল , কেন Neel shagorer Urmi এই নামে দেখনি ? তোমার আমার নামে । " 
"ও তাই বল । খেয়াল করিনি । " চোখ মুছে হেসে উঠে উর্মি । 
" এখন যত খুশি ফেইসবুক চালাও , ইউটিউব দেখ , মুভি ডাউনলোড দাও , ওসব এমবি টেমবি নিয়ে আর ভাবতে হবেনা । " 
"আগে পাস ওয়ার্ড তো দাও । " 
"ও হ্যা , এক সাথে বড় হাতের অক্ষরে লিখ - NEEL LOVE URMI " 
"তুমি না একটা পাগল । " হেসে নীলের দিকে চাইল সে । 
সে রাতেই নীলের প্রেমের প্রস্তাবে সারা দেয় উর্মি । নীল খুশিতে লাফাতে লাফাতে ভাবে , " তিন বছর আগে ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ড টা দিলে আজ উর্মির বাচ্চার বাপ হয়ে যেতাম । " 

অপেক্ষা 

আমেরিকার ভিসা হাতে মাসুমের চোখ জ্বালা করে ওঠে , টুম্পা আজ অন্যের ঘরে । 
বেকারত্বই ছিল বিচ্ছেদের একটি অংশ মাত্র ।

টুম্পার ঘর ভর্তি সিগারেটের ধোয়া , চারটে ছেকার দাগ আগেই ছিল পিঠে । আজ বুকে আরো দুটো যুক্ত হল ! 
অপেক্ষায় না থাকা আজ তিলে তিলে মরার অন্যতম কারন !

দাবার চাল

মোজাম্মেল ভালবাসে প্রিয়ন্তিকাকে , প্রিয়ন্তিকা চায় শুধু আকাশকে । 

আকাশের কাছে প্রেমের অর্থ দৈহিক চাহিদা । 
ফলাফল , মোজাম্মেল পুড়ে দহনে , প্রিয়ন্তিকা সাজে দাবার চাল । 
ত্রিভুজ প্রেমে একমাত্র আকাশি লাভবান ব্যক্তি ! 
প্রিয়ন্তিকাকে বিদেয় করে আকাশ নেমে পরে নতুন পাখির খোঁজে , ফাঁদ তার সুদর্শন চাউনি । 
তার পরবর্তি টার্গেট রুম্পা ! 
যদিও সে জানেনা নিজেই এবার হতে যাচ্ছে দাবার চাল ! 
"দোস্ত লুইচ্চা টার আইফোন সেভেন আর মানিব্যাগে নগদ সাত হাজার টাকা নিয়া আইলাম । " 
" রুম্পা আমার বান্ধুবী তুই এত ভাল ক্যারে ? লাভ ইউ দোস্ত ! কেমনে বাশ দিলি মাগির পুত রে ? " 
" আমি জামানের ফ্ল্যাটে আইতে কইছিলাম । পরে জামান আর সুমন মিল্যা হালারে ল্যাংটা কইরা বাইন্দা পিডায় পরে ফোটো তুইল্যা রাখে । আর হালারে কইছি পুলিশি কাহিনি করলেই ফোটো সব নেটে ছাইড়া দিমু । পরে হালায় কসম টসম কাইট্যা কইছে কাওরে কইবনা । " 
"থ্যঙ্কস দোস্ত । অনেক উপকার করলি । তোর বিকাশের নাম্বারে বিশ হাজার টাকা পাঠিয়া দিছি । " 
"আরে টাকা পাঠাইলি কেন ? তোর জন্য এতটুকু করতে পারুম না ? " 
"তবুও দোস্ত এইটা অনেক রিস্কি কাম ছিল । মাইন্ড করিস না । রাখি তবে ভাল থাকিস । " ফোন রেখেই ক্রুর হাসি দিল মোজাম্মেল , অবশেষে আকাশকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়েছে । 
এখন যেতে হবে হাসপাতালে । প্রিয়ন্তিকার এবর্সন হবে একটু পরে , পাপ নিশ্চিহ্ন করবে আজ । অন্তসত্বা হয়েছে জেনেও আগের মতই তাকে ভালবাসে মোজাম্মেল ।

বেহায়া মন 

রোকন যতই ভাবুক বাবলির দিকে আর তাকাবেনা তবুও চোখ চলে যায় । বেহায়া মন , নাকি সে নিজেই ? কেউ না বললেও সে নিজেকে জগতের শ্রেষ্ঠ নিলজ্জ আখ্যাইত করেছে মনে মনে । বিশ্ববিদ্যালয় গত একবছর এক সাথে ক্লাস করছে সে আর বাবলি । এই এক বছরে না বলেছে সে মনের কথা , না পেরেছে দৃষ্টি সরাতে , যদিও বাবলির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই , এমনি তাকে তেমন কোন মূল্যায়নও দেয়না । কখনো বলেনা , চল ক্যান্টিনে আড্ডা দিই । কখনো বলেনা , চল এক সাথে বাসায় যাই । আর যদিও কিছু বলে সেটা তার দরকারে । যেমন ক্লাস রুটিন জানতে চাইবে , কিংবা কোন পড়া না বুঝলে জিজ্ঞেস করবে , এসাইনমেন্ট করে দিতে বলবে ব্যাস । 

ক্লাসের সবাই জানে রোকন বাবলিকে কতটা চায় । কিন্তু বাবলি সর্বদা এরিয়ে চলে তাকে । 
সে যদি বলে , চল কোন রেস্টুরেন্টে আড্ডা দেই ? বাবলি বলবে ব্যস্ত , বাসায় সমস্যা , শরীর খারাপ ইত্যাদি । অথচ ক্লাসের যত বদ , নিম্ন মানের , ফাকিবাজ , লুচ্চা মার্কা ছেলেগুলোই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড । তাদের কাজ হল সারাদিন টোটো করে রাস্তায় ঘোরা , আড্ডা দেয়া , মেয়েদের দেখলে সিস দেয়া , সিগারেট গাঁজা খাওয়া , আর ক্লাস শেষে অশ্লীল বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়া । 
এরা যদি বাবলিকে বলে কোথাও যেতে ,দুনিয়া উলটে গেলেও তাদের সাথে যাবেই । 
আজকাল বাবলির উপর অন্য কারনে রাগ হয় তার । ভার্সিটির এক বড় ভাইর সাথে সব সময় থাকে । 
শুধু থাকেনা , 
উঠে, বসে , 
সময় কাটায় , 
রিক্সায় আসা যাওয়া করে । 
প্রচন্ড কষ্টে বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে রোকনের , যখন দেখে সেই বড় ভাইর কথা বলতে বলতে বাবলির চুলে হাত নারায় , তাদের মাঝেকি প্রেম ? 

সে রাতেই ফোন দেয় বাবলিকে ......

" হ্যা রোকন বল । " ফোন ধরে বলে বাবলি । 
" তোমায় বহুদিন ধরে একটা কথা বলব বলব করে আর বলা হয়না । " প্রচন্ড রকমের হৃদ স্পন্দন শুরু হয় রোকনের । 
"হু তা তো প্রায়ই বল , কিন্তু কথাটা কি ? প্রোপোজ করবে ? শোন আমার বি এফ আছে । ওসব করে এখন আর লাভ নাই । " 
চোখে পানি চলে আসে রোকনের , কোনরকমে বলে , " না না ওসব কিছু না । আমিতো মজা করি , কি আর বলব তোমায় ? বাই দ্যা ওয়ে তোমার কাছেকি একাউন্টিং এর নোট গুলো হবে ? " 
'নাহ , সেগুলো নিয়ে কি আর ভাবা লাগে , হাসানিতো সব করে দেয় । " 
"হাসান টা কে ? " 
"হাসান কে আবার ? আমার উনি । সে ফাইনাল ইয়ারে না এবার । কত সিনিয়র আমাদের চেয়ে । সব হেল্পি করে । " 
"ও তাই বল ,ঠিক আছে । " বলে ফোন কেটে দেয় রোকন , কাঁদতে কাঁদতে দাঁড়ানো থেকে বসে পরে সে । যা ভেবেছিল তাই , সেই বড় ভাইকেও ভালবাসে বাবলি । 

এর কয়েকদিন পর , এক দুপুরে লাইব্রেরিতে বসে জরুরী কিছু নোট করছিল রোকন , এরমধ্যে তাদের ক্লাসের অন্যতম রূপসি ডালিয়া এসে উপস্থিত , " কি ব্যপার রোকন আজকাল দেখাই পাওয়া যায়না তোমার ? মন খারাপ ? "

"হ্যা কিছুটা । " শুকনো মুখে বলে সে । 
"কেন গো ? বাবলি বিএফ পেয়েছে তাই ? " নাকি সুরে বলল ডালিয়া । 
"তুমি এত বেশি বোঝ কেন ? " 
"আমি বেশি না ঠিক টাই বুঝি , এবার তো আমায় নিয়ে ভাব প্লিজ । " 
"শোন ফানের একটা লিমিট আছে , কই তুমি আর কই আমি ? তোমার পিছে গোটা ভার্সিটির সবাই ঘোরে । আর আমি ? ক্ষেত , দেখতে ভালনা , বাবার কারি কারি টাকা নেই , প্লিজ আমার সাথে এমন করনা । " 
"তুমি কি বলতে চাও ? আমি তোমার সাথে ফ্লার্ট করছি ? " রাগে ডালিয়ার ফর্শা গাল দুটো লাল হয়ে যায় । 
"নাতো কি ? " 
" শোন বিশ্বাস কর আর নাই কর , আমি তোমাকেই ভালবাসি অনেক ভালবাসি । আমি টাকা , পয়সা , চেহারা কিছুই চাইনা , শুধুই তোমায় চাই । " 
"প্লিজ আমি আর মন ভাংতে চাইনা । তুমি চলে যাও , ভাল লাগছেনা তোমার এসব মিথ্যে ফাইজলামি । " রাগ হয় রোকনের । 
কাঁদতে কাদতে চলে যায় ডালিয়া । 
সেদিন রাতে রোকনের মনে হয় নাহ কাজটা ঠিক হয়নি , মেয়েটার সাথে বেশিই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে , ফোন দেয় ডালিয়ার নাম্বারে । 

২ । 
এরমধ্যে কেটেগেল একমাস , এদিকে বাবলি জানতে পারে হাসান বড় সর এক লম্পট , মেয়েদের ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে তার বন্ধু লিটনের ফ্ল্যাটে নিয়ে জৈবিক চাহিদা মেটানই তার আসল উদ্দেশ্য । হাসান তার কোন ক্ষতি করার আগেই সটকে পরে সে । 
তবে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত । সে ভাবে আজ যদি রোকন হত তবে জীবনটা হত অন্য রকম , রানী করে রাখত ওকে , বাবলি জানে কত ভালবাসে রোকন তাকে , হয়ত দেখতে তেমন স্মার্ট না সর্বদা সিম্পল থাকে , কথা কম বলে , তবে কোন খারাপ স্বভাবো নেই , কখনোই কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি তার ওপর সে ক্লাসের ফার্স্ট বয় । যখনি যা সাহায্য চেয়েছে করেছে , অথচ বিনিময় সর্বদা এড়িয়ে চলেছে ওকে । 
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই কয়েকদিন কেটে যায় , বাবলি বুঝতে পারে সে রোকনের প্রতি দুর্বল হয়ে গেছে । 
কয়েকদিন পর ক্যম্পাসে রোকনকে দেখতেই এগিয়ে আসে সে , "রোকন কেমন আছো ? " 
"ভাল অনেক ভাল । তুমি ? " হেসে উত্তর দেয় রোকন । 
"ভালনা ,তুমিতো আমায় ভুলেই গেলে । " 
"কেন কি হয়েছে ? ভুলিনি একটু ব্যস্ত তো তাই । " 
" হয়েছে অনেক কিছুই , তুমি কি জান হাসানের সাথে যে আমার আর সম্পর্ক নেই ? " 
মাথা নাড়ায় রোকন , " জানি । " 
"আমি জানি তুমি আমায় অনেক চাইতে , জানিনা এখন চাও কিনা । আচ্ছা এখন কি যায়না আমায় গ্রহণ করা , আরেকবার যায়না ভালবাসা ? " 
বিস্ময়ে হতবাক রোকন , বলছে কি এই মেয়ে ? গত এক বছর সয়নে, স্বপনে যেই মেয়েকে সে চেয়েছে , সেই আজ মনের কথা বলছে ? 

দূর থেকে ডালিয়া রোকনকে দেখে বাবলির সাথে হেসে কথা বলতে , প্রচন্ড রাগ লাগে ওর , বুঝতে অসুবিধা হয়না কেন সেধে কথা বলছে বাবলি , গত এক বছর যে রোকনের দিকে ফিরে চায়নি আজ সে কেন ভাব করছে , হাসানের শূন্যতা কাঁটাতেই যে রোকনের কাছে এসেছে তাও বোঝে ডালিয়া , আর দাড়িয়ে না থেকে তাদের কাছে গিয়েই রোকনের হাত ধরে হেচকা টান দেয় , "কি ব্যপার আমায় ভুলে নিজের অতীতের ক্রাশের সাথে কি কর হু ? হা হা হা । " মিষ্টি করে মেকি হাসি দেয় বাবলির দিকে চেয়ে । 
"কেমন আছিস ডালিয়া ? " বাবলিও মেকি হাসি দেয় । 
"ভালই , আচ্ছা তোকেতো বলাই হয়নি , এক সপ্তাহ হল রোকনের সাথে আমার রিলেসন । " 
"তাই ? খুবি ভাল , ট্রিট দিচ্ছিস কবে ? " কোনরকমে মুখে হাসি টেনে বলে বাবলি । 
"খুব দ্রুত দিব দোস্ত । আচ্ছা থাক যাই । " বলেই রোকনকে প্রায় টেনেই নিয়ে যায় ডালিয়া । 

বাবলি চিন্তা করে , একজন মানুষের মন মানসিকতার কথা চিন্তা না করে তার অর্থ আর বাজ্যিক চাক চিক্য দেখে ভালবাসার ফল কি তিক্ততাই হয় ? না রোকন তার ভাগ্যেই ছিলনা ? 


নাঈম হাসান
জন্ম ১৯৯৫ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ঢাকায়। দৈনিক পত্রিকা, ছোট কাগজ, লিটল ম্যাগ, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা ছাড়াও সাহিত্যের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখা লিখি করছেন কবিতা, উপন্যাস, গল্প । এছাড়াও আবৃত্তির প্রতিও রয়েছে বিশেষ ঝোঁক। বর্তমানে স্নাতকোত্তর করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে । 
২০১৯ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে   তাঁর প্রথম উপন্যাস “এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ” প্রকাশিত হয়।

পাভেল আল ইমরান'র চারটি অণুগল্প

পাভেল আল ইমরান'র চারটি অণুগল্প

ঝাড়ুদার

মদের পেয়ালার পুরো মদটুকু গিলে ফেলে দুচোখ বন্ধ করে মাথাটা এক ঝাঁকি মারলো রানী। 
রাজদরবারে আসা মদগুলো খুব উন্নতমানের হয়- বলল উজির।

হ্যাঁ, এটাই রাজার একমাত্র সার্থকতা। কিন্তু রাজাকে মরতে হলো শুধু আমাকে অতিমাত্রায় ভালোবাসার দরুন। অপর দিকে আপনাকে ভালবাসলাম রাজাকে অতিমাত্রায় ঘৃণা করেন বলে- বলেই বিশাল আওয়াজ করে হেসে উঠলেন রানী সেরেনা। শব্দটা দ্রুত পাখায় উড়ে গেলো রঙ্গশালা পেরিয়ে উঠোনে, উঠোন ডিঙিয়ে বাউন্ডারি ছেড়ে সারা রাজ্যময় যেন হাত ফসকে সিসার থাল মেঝেতে পড়ার আওয়াজে  নড়ে উঠলো। কানে পৌঁছলো ঝাড়ুদার মিসস্যুর বাড়ির খাঁচায় বন্দি তোতাপাখিরও।পাখিটি এদিক সেদিক তাকিয়ে খুঁজে পেলো, রাজবাড়ি থেকেই এসেছে এই ধ্বংসনীয় ধ্বনি।

মিসস্যু সারা রাজবাড়ি ঝাড়ু দেওয়া শেষে নিজ বাড়ি ফিরলো, গায়ে ঘামের গন্ধ।পাখিটি সেই গন্ধ পেয়েই ডাকাডাকি শুরু করলো। মিসস্যু পাখির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই জিজ্ঞাস করলো পাখি, এই আকারহীন শব্দের কারণ কী হে?

মিসস্যুর নির্লিপ্ত জবাব, কোথায় শব্দ? ঝাড়ুর শব্দের কথা বলছো নাকি?
না, শব্দটি রাজবাড়ি থেকে আসা।তুমি তো সেখানেই কাজ করছিলে।- তোতাপাখি বলল।
আমি তো ঝাড়ু দিচ্ছিলাম। ঝাড়ুর শব্দে আমি আর পৃথিবীর কিছুই শুনতে পাইনা।- ঝাড়ুদার মিসস্যুর ক্লান্ত কণ্ঠের জবাব।


সাবান

গোসলে যাবো তাই সাবান খুঁজছি,আর ভাবছি- দুনিয়াতে নাস্তিকতা বেড়েই চলছে, অতি ভয়ংকর গতিতেই বাড়ছে।আমার ফ্লাটের আঠারো প্রাণীর মধ্যে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের  ষোলোজনই অবিশ্বাসী। বাড়ির দারোয়ানটি মালোয়ারি ভাষা ছাড়া আর কিছুই জানেনা, তবু জানে ধর্মকর্ম করা বোকামি আর কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণ প্রাকৃতিক কারণেই জন্মেছে, শেয়াল কুকুর শেওলা পাহাড় কিংবা মানুষ। মানুষের যা জ্ঞানবুদ্ধি কিছু ভালো হাতি শিম্পাঞ্জীদের চেয়ে ।

সাবান খুঁজতে খুঁজতে ভাবছি, এতো এতো নাস্তিক , তাদের তো একটা স্ট্যান্ডার্ড পলিসি দরকার, যাতে কোনো নাস্তিক ভিন্নপথে না হেটে যায়,  তাহলে কি নতুন আরেকটি ধর্ম তৈরি হবে শীঘ্রই!নাস্তিক ধর্ম!

সাবানটা খুঁজেই পাচ্ছিনা, রুম অন্ধকার, যেখানে সাবান থাকে, সেখানে ফেসওয়াস শ্যাম্পু, টুথপেস্টসহ অনেককিছুই রাখা জড়ো করে। অন্ধের মত সাবান হাতে নিতে চাচ্ছি হাতে আসছে কখনো ফেসওয়াসের টিউব, কখনো টুথপেস্ট, সাবানটাই শুধু হাতে আসতে চাচ্ছে না। ঈশ্বরই বুঝি সাবানটা না দিয়ে অন্যকিছু দিয়ে আমার সাথে অন্যায় করছে। আমার সাথে এমনই করে ঈশ্বর।

শরীরে রাগ জমে লাল হয়ে উঠেছে। চূড়ান্ত জেদে বাঁ হাতে যা ছিলো পূর্ণ শক্তিতে ছুড়ে মেরেছি।হাত থেকে সাবানটি তীরের গতিতে ছয় তলার বারান্দা গলে রাস্তায় চিতপটাং। 

আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি, ধর্মই বারান্দা গলে পড়ে গেছে রাস্তায়।



ঝাড়ুদার - ২

রাজার মৃত্যুর পর অনতিবিলম্বে প্রমাণিত হলো,এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।কিভাবে মৃত্যু ঘটেছে, তার উপর অসংখ্য ধারনা সৃষ্টি হয়েছে। ধারনা থেকে কেচ্ছা, গল্প, আখ্যান, শোকগাথা, শোকগীতিসহ আরো কতকিছু। প্রত্যেকটি ধারনাই ভিন্ন, একটার সাথে অন্যটার কোনোভাবে মিল নেই; প্রত্যেকটিই সত্য এবং যুক্তিসংগত মনে হয়।

এসব ধারনা সমস্ত পুথি বদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারে স্থান পেয়েছে, রাজ অতিথিরা এসে নীরবে পড়ে।কিন্তু কেউই মূল রহস্য জানতে পারেনি।এরই মধ্যে যত আইনজ্ঞ রানীর অন্দরমহলে প্রবেশ করেছেন, সবাই প্রগাঢ়ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছেন, কারো আর ঘুম ভাঙার নজির নেই।

রানীও প্রতি প্রভাতে বারান্দায় তার অন্তর্বাস রোদে শুকাতে দিলে সূর্য সব জল শুষে নেন; কোথায় এই জল নিয়ে ঢালে তা জানেনা কেউ।
রাজা যে ধারালো কোনো বস্তুর আঘাত পেয়ে বা নিয়ে মরেছে তা নিশ্চিত, তাই রাজবাড়িতে ধারালো বস্তু নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মিসস্যুর ঝাড়ুটাও এই আইনে কাটা পড়ল ; ঝাড়ুর অগ্রভাগ বেশ ধারালো বলে বিবেচিত হয়েছে।ঝাড়ু নিষিদ্ধ রাজবাড়িতে।

ঝাড়ু নেই,ঝাড়ু দেওয়ার কাজও নেই,তাই খাবারও নেই- থুতনির নিচে হাতের ঠেস দিয়ে বসে তোতাপাখিকে বলছে মিসস্যু।

তোতাও বেশ চিন্তিত কণ্ঠে জবাব দিলো -তোমার মেয়ে রাজার মৃত্যুর কাহিনী পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে, সে আর জাগবে না।



ঝাড়ুদার -৩

অর্ধমৃত অথবা মৃত অবস্থায় ঝাড়ুদার মিসস্যুর দেহটি পড়েছিলো রাজবাড়ির সামনে। সাঁঝসকালে রানীর উষ্ণ অন্দরমহলে এই সংবাদ যেতেই উজিরের ক্ষিপ্র আদেশ, ফেলে এসো এই অযথা প্রাণীটিকে কবরস্থানে। শেয়ালে খাবলে খাক।

আদেশ করে রানীকে জড়িয়ে অলস তন্দ্রায় রত হলেন উজির।

মিসস্যুর শব কররস্থানে ফেলতেই তরতাজা সকালটা দপ করে নিভে গেলো, চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন।সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে বাঁচতে চাইলো; কিন্তু দেখলো, তাদের শরীর বোধশক্তিহীন,যেন মোটা শিকলে বাঁধা প্রতিটি অঙ্গ-  নড়তে পারছিলো না কেউ। তারা দেখলো অন্ধকার সকালের করবস্থানে, একটি উজ্জ্বল আলোর বল লাফিয়ে গিয়ে মিসস্যুর শরীরে গেঁথে গেলো, শবটির সারাশরীর তখন আগুনে পোড়া লোহার মত জ্বলে উঠলো। তারপর একজন পরিপূর্ণ সুস্থ মানুষ দাঁড়িয়ে গেলো। ধীরেসুস্থে হেটে সৈন্যদের কাছে গেলো, এবং প্রায়দৈবকন্ঠে বলে উঠলো -আমি রাজা ডিসুজা,ফিরে এলাম আপনাদের মাঝে। মিস্টার অ্যালেক্স,আপনি তো দিগ্বিজয়ী বীর। এভাবে কাঁপছেন কেনো? কতবার অস্ত্র পরীক্ষায় আপনি আমায় হারিয়েছেন।প্রিয় সৈনিকগন, আপনাদের সাহসী তলোয়ারের ধারে কলাগাছের মত ফালিফালি হয়েছে আমার শত্রুসেনারা। আজ সেই আপনারাই সামান্য অতিপ্রাকৃত ঘটনায় কাঁপছেন?

সসৈন্য রাজ্যে ফিরে রাজা ডিসুজা, মৃত্যুদণ্ড দিলেন রানী সেরেনা, উজির সহ আরো বেশ কয়েকজনকে, যারা রাজার খুব নিকটজন ছিলেন; তারাই রাজাকে হত্যা করেছিলেন।

সবকিছু আবার আগের মত চলতে লাগলো। রাজ্যে আবার ঝাড়ু দেওয়ার আদেশ হলো। সকল ঝাড়ুদার নিজ কাজে লেগে গেলো। কোত্থাও মিসস্যুকে দেখতে পেলো না রাজা। কিন্তু রাজার যে মিসস্যুকেই প্রয়োজন।

মিসস্যু তার ঝাড়ুর ঘ্যারঘ্যার আওয়াজের সুরেই বানিয়েছিল মৃত্যুর পরও বেঁচে উঠার মন্ত্র ;যা  রাজাকে পুনরায় জীবিত করেছে।রাজাকে মুখস্থ করিয়েছিল, সেই মন্ত্র রাজা ভুলে গেছে।