পাঁচ টি অণুগল্প • কামরুজ্জামান কাজল


একদিন সিএনজিতে

লোকটি আসল মুক্তিযোদ্ধা কি-না জানি না , তবে সিএনজিতে বসে তার গল্প শুনতে ভালোই লাগছিলো। 

আর বইলেন না স্যার, আপনি তো আমার নাতীর বয়সী, কি আর জানেন যুদ্ধের কথা। এটুকু বলেই লোকটি দম নিলো, খুব সম্ভবত শ্বাসটান ছিলো তার৷ আমি একটু উনাকে সাহায্য করলাম— হ্যাঁ দাদু, আমরা এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব অল্পই জানি! লোকটি আবার উৎসাহ নিয়ে শুরু করলেন, স্যার এই যে দেখেন কান্দাপাড়া বিরিজ, এইযে, এইখানডায় তখন বিরাট স্রোত৷ বলেই আবার একটু থামলেন। 
তখন বলতে একাত্তুর সাল৷ হরিরামপুরে আর্মির ক্যাম্প বানছইল। আষাড় মাস। মুক্তিবাহিনীর আমরা পাঁচজন, রব সাব আমাগো বড় ভাই, সে-ই আমাগো কমান্ডো । আগের রাইতে আবুল ভাই, সে আছলো আমাগো মুক্তিগো সিআইডি৷ কোড আছল— আইজ মেঘ করছে চাঁদ দেখা যাইবো না। সেই কোড শুইনাই নৌকার মাঝি নাজিম খবর দেছল, দুপ্পুরে খাওনের পর, শইল্ল্যে খালি ঘুম ঘুম। 
লোকটি আবার থামতেই আমি আগ্রহ করে প্রশ্ন করলাম—তারপর? 
শুনেন তাইলে— আবার লোকটি বলতে লাগলেন। কিভাবে এগারজন পাকিস্তানি আর্মি, একটা ট্রলারে করে এইদিকে আসছিলো, কিভাবে মাত্র পাঁচজন মিলে কচুরিপানা মাথায় নিয়ে নাক বের করে লুকিয়ে শ্বাস নিচ্ছেলেন তারা... 
সিনিজিতে ড্রাইভারের দুইপাশে দুইজন যাত্রী ঝুলছিলেন, একজন একটু পর পর পেছন ঘুরে তাকান আর গলা খাকাড়ি দেন। উশখুশ উশখুশ করেন৷ 
স্যার আমাগো তিনজনের হাতে থ্রি নট থ্রি, যদিও জিনিসটা ভালো আছিলো, ম্যাগাজিনে ৬ডা কইরা গুল্লি। তয় খান আর্মিগো হাতে কালাসনিকভ একে ৪৭। আমাগো পাঁঁচবার লোড করা সমান তাগো একবার। মেশিনগানের মুখে পড়লে আমরা জীবন লইয়া ফিরতে পারতাম না স্যার। রব সাব, আমাগো কমান্ডো যিনি, সে এইডা জানতো। খালি জীবনের মায়া না স্যার, তারচেয়ে বড় কথা আমাগো মিশন ফেইল করলে, এই পারের হিন্দু পাড়া স্যার, জ্বইলা পুইড়া ছারখার হইয়া যাইত.. 
আমি কেন জানি ভেতর ভেতর খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলাম। নিজেকে লোকটির জায়গায় বসিয়ে দৃশ্যটা কল্পনা করছিলাম। 
তারপর স্যার, আমরা কচুরিপানা থেইকা দক্ষিণ দিকে একটা গুল্লি করলাম। আর্মিগো ট্রলার আছল আমাগো থেইকা সামান্য উত্তরে, হেরা মুহুর্তেই এলোপাথাড়ি গুল্লি শুরু করলো। কোনো থামা থামি নাই, তাও পরায় দশমিনিট গুল্লি করতে থাকলো। মাথার উপরে কচুরিপানা, আমাগো দম বন্ধ হয়া আসে। কান ঝালাঝালা হয়া যায়। বুকের ভিত্রে স্যার একটাই ভয়, মিশন ফেইল হইলে হিন্দু পাড়াডা... 
আমি সিএনজিতে মাঝে বসছিলাম। আমার ডান পাশে বসে লোকটি যুদ্ধের সেইসব স্মৃতিগুলো টানা বলতে থাকেন । মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে পড়েন, এইযে স্যার আমার ডান পায়ের থুড়ায় গুল্লি লাগছল, এখনও দাগ আছে— বলেই লুংগিটা তুলে উরু বের করেন।আমার বাম পাশে বসা বয়স্ক লোকটা এইসব কথা শুনেও যেন শুনছে না। কোনো ভাবান্তর নাই তার। 
রাস্তা ফুরিয়ে আসল। মিশন ফেইল হয়েছিলো কিনা জানা হলো না, সিনজি থেকে নামতেই সামনে বসা লোকটি, যে উশখুশ করে বারবার গলা খাকাড়ি দিচ্ছিলো—আমাকে চিনতে পেরে সালাম দিয়ে বললো, স্যার কিছু মনে কইরেন না। লোকটার মাথায় একটু সমস্যা আছে! 
কি কইলি শুওরের পুত! তুইও! তুইও অই বান্দির বাচ্চা সুবিধাবাদীগো মতো আমারে পাগল কইস। একজন মুক্তিযোদ্ধারে পাগল বানাস? বিকট চিৎকারে লোকটি তেড়ে আসে৷ চাচা তুমি মুক্তিযোদ্ধা? তুমার সার্টিফিকেট কই? বাইর করো চ্যে? লোকটি এইবার আরও ক্ষেপে ওঠে, অরে খানকির পোলা, কাগজের লাইগ্যা আমি যুদ্ধ করছি? বলেই লুংগিটি একটানে খুলে ফেললো৷ দেখ বাইনচোত নেমক হারাম৷ আমার ল্যাওড়ার পাশে থুড়ায় দেখ, গুল্লির চিহ্ন। 
আমি সাহস করে আর তাকাইলাম না। চলে আসছিলাম। বাম পাশে বসা সেই লোকটি হঠাৎ আমার হাত ধরে বললো, স্যার লোকটা পাগল না, সে হাছাই মুক্তিবাহিনীতে সেইদিন আছিলো৷ সেইদিন মিশন ব্যর্থই হইছিলো, আর্মিরা আমাগো হিন্দু পাড়ায় আইসা... 
আমি এই লোকটিকে চিনতে পারলাম । আলীম সান্দার৷ সকালে কৃষিব্যাংকে এসে একলাখ টাকা লোনের জন্য খুব জোরাজোরি করছিলো ! বন্ধকের জন্য জমিজমার দলিল নাই বলে আমি ফিরায়ে দিছিলাম। সেই আলীম সান্দার হঠাৎ আমার হাত ধরে বলে উঠলো- স্যার- ৫৬ হাজার বর্গমাইল দলিল দিলে কয় ট্যাকা লোন দিবেন? 

ফোয়ারা বিবির হলুদ চাদর

শীত শেষ, সাময়িক মোহগ্রস্থ একটি হলুদ চাদর আলমারিতে ফিরে যায়। 

আলমারির ভেতরটা গুমোট, অন্ধকার। দম বন্ধ লাগে চাদরটির৷ খাঁজকাটা হলুদ রঙের ভেতর হালকা লাল লাল ডিজাইন৷ পুরানো, তবুও জৌলুশ আছে৷ আলমারির তৃতীয় থাকের এক কোণে পড়ে থেকে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চাদরটি। 
অহ মরে যাই, মরে যাই! বুড়ি হয়ে গেলো, তাও প্রেম এখনও ফুরায় না যেন!-- একটা বেগুনী শাড়ি আস্তে করে ফোড়ন দেয়। চাদরটি মুখরা ছিলো, কথার পিঠে কথা ভালোই বলতে পারে! তবুও কেন জানি শাড়ির এই বাঁকা কথাটার উত্তর দেয় না। অলস লাগে৷ 
চাদরটির কয়েকটা জায়গায় সুতা খুলে গিয়েছিলো। চাদরের মালিক ফোয়ারা বিবি, সেটা সেলাই করে করে জোড়া দেয়। রাকায়াত হাসে, খানিকটা বিরক্তও হয়। এতো পুরানো চাদর সেলাই করে কি লাভ! তোমার কি চাদরের অভাব? ফোয়ারা চশমাটা খুলে পাশে রাখে। সেলাইয়ের জায়গাটায় হাত বুলায়। কেন জানি চাদরের বুকের অংশটাই বারবার ছিড়ে যায়! 
চাদরটি ফিরে আসতেই চারিদিকে গুঞ্জন শুরু হয়৷ আলমারির অন্যান্য থাকে গুছিয়ে রাখা সালোয়ার-কামিজ, দেশী বিদেশী শাল থেকে শুরু করে গহনার বাক্স পর্যন্ত মুখ টেপাটেপি করে হাসে। চাদরটির অস্বস্তি হয়। দম বন্ধ লাগে। আবার কবে বাইরে বের হবে, ভাবে। ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে যায় অনেকগুলো শীতের পেছনে। 
ফোয়ারার পছন্দের এই হলুদ চাদরটির প্রেমে পড়েছিলো একটা কালো চাদর। চাদর হিসাবে কালো রঙ একটু আনাড়ি, কেমনজানি ছেলেমানুসি একটা রঙ। তবুও। প্রেম তো! হয়ে গেলেই হয়ে যায়। হয়ে যাওয়ার পরই চাদরের বুকটায় এসে ঘিরে ধরে শীত। 
চাদর দুটির কত যে কথা হতো! কালো চাদরটি একটু দুলে হলুদ চাদরটিকে স্বপ্ন দেখাতো--, দেইখেন প্রিয়, কোনো এক বসন্তের রাতে, তারের উপর পাশাপাশি আমরা ঝুলে থাকব । চাঁদের আলোয়, হাসনাহেনার গন্ধে-- তাকিয়ে তাকিয়ে একে অপরের দুলতে থাকা দেখব। হলুদ চাদরটি ঢং করে প্রশ্ন করে-- খালি তাকায়েই থাকবেন? গান করবেন না? বলেই খিলখিল করে হাসতো! 
ফোয়ারা বিবি চাদর দুটির কথা বুঝত কিনা কে জানে। 
ফোয়ারা বিবি দোলনায় পা ঝুলিয়ে দোল খায় 
ফোয়ারা বিবি চাঁদের আলোয় গা ভাসায় 
ফোয়ারা বিবি হাসনাহেনার তীব্র গন্ধে ডুবে যায় 
কালো চাদর পরা লোকটি টানা তাকিয়ে থাকে৷ ফোয়ারাকে ইশারা দেয়। ফোয়ারা আর সেই লোকটি সিদ্ধান্ত নেয় ওরা পালিয়ে যাবে শহর ছেড়ে৷ কে জানত, চাদর দুটিও ভেবে নিয়েছিলো, ওরা পালাবে। 
কালো চাদরের বুকে হলুদ চাদর 
হলুদ চাদর বাতাসে দোল খায় 
হলুদ চাদরের বুকে কালো চাদর 
বাতাস এসে এসে ফিরে যায় 
ফোয়ারার পালানো হয়নি৷ সেই লোকটিকে আর কোথাও অপেক্ষা করতে দেখেনি কেউ। কালো চাদরের কথাও কেউ মনে রাখেনি। একমাত্র হলুদ চাদরটি ছাড়া। 
সাময়িক মোহগ্রস্ত হলুদ চাদরটি আলমারিতে ফিরে আসার পরপরই একটা নীল চাদরের জায়গা হয় অর পাশে। যেমনটা হয় ফোয়ারা বিবির পাশে রাকায়াতের। শান্ত, ছিমছাম বোঝা পড়ার ত্রিশ বছরের সংসার। সব ঠিকঠাক। সবাই ভুলে গেলেও হলুদ চাদরটি সব মনে রাখে। আলমারির ন্যাপথলিনে কালো চাদরের স্মৃতির ঘ্রাণ, খুব টের পায় সে। 
ফোয়ারা বিবি মাঝে মাঝেই সেলাই করে হলুদ চাদরটিকে বাঁচিয়ে রাখে। বুকের বাম অংশটাই কেন জানি বারবার ছিঁড়ে যায়।

কাউন্টডাউন

ফাইশাকে যখন বিয়ে করি, আমরা দুইজনাই জানতাম—আমাদের সন্তান হবে না৷ 

বাইরে থেকে ফিরে এসে প্রায়দিনই খেয়াল করতাম, ফাইশা জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে৷ বাইরে সারি সারি মেঘ, পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠার দৃশ্যটা দেখে মনে হতো মেঘগুলা যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। ফাইশার চোখে সমস্যা থাকায় দূরের জিনিস ভালো দেখতে পেতো না৷ তাহলে কী ফাইশা হাপিয়ে পড়া মেঘগুলোকে খুঁজতো? 
আমার হারিয়ে ফেলা অভ্যাস, তার উপর কোথায় কী রাখি, মনে থাকে না৷ খুটখাট শব্দ শুনে, আমার দিকে না তাকিয়েই ফাইশা বলে দেয়—ফোনের চার্জারটা টেবিলের বামপাশে, চশমার খাপ বিছানায় মাথার কাছে। আমি মুচকি হেসে লজ্জা লজ্জা গলায় বলি—তুমি দেখি এই কয়দিনেই সব নখদর্পনে নিয়ে ফেলছো! 
ফাইশা ইদানীং বেশি কথা বলে না। চুপচাপ শুধু তাকিয়ে থাকে৷ যেন জানলাটাই ওর সংসার, পাহাড়ের গাছগুলো ওর সন্তান, আর হাপিয়ে পড়া মেঘগুলোই ওর নিত্যসঙ্গী। 
আমি দিনরাত ফাইশাকে বুঝাতে চাই, যতটা পারি সান্ত্বনা দেয়ার চেস্টা করি। ফাইশা হঠাত মেঘের সংসার ছেড়ে আমার দিকে তাকায়। ওর ফ্যাকাশে চোখে কী গভীর শীতলতা! আমি ভয় পেয়ে যাই। 
সেদিন বাজার থেকে একটা মাটির গহনা নিয়ে ওকে দিয়ে চোখ নাচিয়ে বললাম, মনে আছে দোয়েল চত্বরের সামনের সেই কারুরশিল্পের দোকানগুলার কথা? ফাইশা হঠাত হেসে দেয়, বলে—তুমি সারা সন্ধ্যা আমার ব্যাগগুলা দুই হাতে নিয়ে টানছিলা। একটু পর পর অতি সাবধানে মাটির জিনিসগুলাতে হাত দিয়ে আগলে রাখতে গিয়ে আরও বেশি ঠোকা লাগায়ে ভেঙে ফেলছিলা! আমি এবারো লজ্জা পেয়ে যাই৷ 
আহ কি দারুণ ছিলো সেইসব সন্ধ্যারা! আমরা দুইজনাই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সেই কতোদিনের কথা! একটা ক্যাম্পিং এ আমাদের পরিচয়। মনের দেনা লেনা। মাত্র সাতদিন হাতে ছিলো আমাদের। আমরা রোজ কাউন্টডাউন করতাম, আর মাত্র ছয় দিন বাকি। তারপরেই আবার কে কোথায় চলে যাবো, আর হয়ত দেখাই হবে না৷ ফাইশাও সাড়া দিতো, হুম, আর মাত্র পাঁচদিন। 
হুটহাট মনের লেনা দেনা হলেও আমরা যেন আমাদেরই ছিলাম। আমি যা যা বলতে চাইতাম কেমন করে ফাইশা যেন সব বুঝে ফেলতো৷ আর ও নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলো, আমার দেখা পেয়েই৷ না, ভনিতা করে আমরা সময় নস্ট করিনি। সারাদিন ক্যাম্পিং শেষে যতটা সময় পেতাম, আমরা আমাদের দিতাম। কারণ, আমাদের হাতে সময় ছিলো কম। মুহুর্তগুলো খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। 
আমরা বারবার হিসাব করতাম, আর বাকী মাত্র তিনদিন। দুই, এক..ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড.. 
সেইবার বিদায় নেবার সময় ফাইশা বলেছিলো ডাকবে৷ আমিও নিশ্চিত ছিলাম, আমি সাড়া দেবো৷ তারপরে সময়ের আড়ালে গড়িয়ে পড়ে দীর্ঘকাল আমাদের আর ডাকা বা ফেরা হয়নি। তাই বলে কী ফুরিয়ে গিয়েছিলো সব? 
ফাইশা কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা আমার হাতে দিয়ে পাশে বসে। হঠাৎ হেসে বলে ওঠে-- ত্রিশ বছর কি যথেস্ট? সেই তুমুল মুগ্ধতা ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য? আমি কাপা বুক নিয়ে শ্বাস ফেলি, বুঝতে পারি আমার ভেতরে ঢুকে পড়ছে শীত৷ 
হ্যাঁ, সেই তুমুল যৌবনে আমাদের ডাকা বা ফেরা না হলেও এই ষাটে এসে , ফাইশার জেদটা পূরণ হলো। আর আমিতো অপেক্ষাতেই ছিলাম৷ তবে আবারও কাউন্টডাউন। খুব বেশি সময় নেই আমাদের। ডাক্তার বলছে ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ, ,বড়জোর দুই মাস৷ তারপরেই আমাকে যেতে হবে৷ 
মাঝে মাঝে রাতে, ফাইশার ঘুম ভেঙে গেলে-- ওর দিকে টানা তাকিয়ে থাকা দেখে আমাকে বলে -- কি দেখো এতো? আমি হাসি। কাউন্টডাউন মনে করিয়ে দেই-- আর তো মাত্র একমাস! 
বিশ দিন, দশ, এক সপ্তাহ.. 
ফাইশা আমার মুখে হাত চাপা দেয়। কিছুক্ষণ চেস্টা করে নিজেকে শান্ত রাখার। তারপরে আর পারে না৷ ফুপিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে৷ আমি ওর কান্না থামাই না। শুধু শক্ত করে হাতটা ধরে রাখি৷ 
আমাদের ছোট্ট বাড়ির পাশেই থাংঝাং ঝর্ণা৷ দিন নাই, রাত নাই শুধু বয়েই চলে। কলকলকল...

বোকাপাখির ভাঙাডানা

নিজের আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবারের সেইরকম কোনো রেসপন্স না পাওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে গেল এমদাদুল হকের। 

তিনতলা বাড়ির সামনে পাকা গাঁথুনি দিয়ে উঁচু করে রাখা জায়গাটাতে তার খাটিয়া পাতা হয়েছে৷ এমদাদ অবাক হয়, এত বড় বাড়ি তার, এত আত্মীয় স্বজননের আনাগোনা, অথচ কান্নার তেমন শব্দ নাই! 
ছোট মেয়েটার গলা শোনা যাচ্ছে, একটু করে ফোপাঁতে ফোপাঁতে ওর বলদ জামাইকে বলছিলো— আব্বা আমাদের নতুন ফ্ল্যাটটা দেখে যেতে পারলো না। এহ, কি কথা! ফ্ল্যাট কিনতে কি যন্ত্রনাটাই না দিলো মেয়ের জামাই৷ এত করে এমদাদ বলেছিলো, এই বাড়িতেই থাইকা যা না মা,সবাই একসাথে মিলামিশে থাকি! না কিছুতেই মানলো না। জামাইয়ের অফিস, ছেলের স্কুল কত অজুহাত! 
একটু পরপর এলাকার লোকজন আসছে, দাড়াম দাড়াম করে মেইনগেইট খুলছে, লাগাচ্ছে৷ এসে কি একবার কোনোরকম মুখের দিকে আলগোছে তাকিয়ে ব্যাস দায় দেনা শেষ! এমদাদের এইসব আদিক্ষেতা মোটেও ভাল লাগে না। 
টাংগাইল থেকে বড় ছেলে বউ ছেলে মেয়েসহ রওনা দিছে। কখন আসবে কে জানে! এই রাতে কেন যে গাধাটা রওনা দিতে গেল! আরে বাবা, মারাই যখন গেছি এখন অত তাড়াহুড়ার কি আছে। ধীরে সুস্থে আসলেই তো পারিস। 
সবাই বলাবলি করছিলো, বড় ছেলে আসলেই দাফন হবে৷ এই প্রথম এমদাদ তার ছেলের বাড়ি আসার জন্য তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না৷ এইসব আসার কোনো মানে আছে? 
এমদাদ বড়ছেলেটাকে বলেছিলো, মাসে অন্তত একদিন ত আসতে পারিস! ছেলে হাসে, বলে আপনিই ত আমার এইখানে চলে আসতে পারেন আব্বা৷ রিটায়ার্ড করার পর, অইখানে থেকে আর কি করবেন!— কি কথা, কি যুক্তি! আমার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে এই বাড়ি বানায়ে উনার ভাড়া বাসায় যাবো!! এমদাদ খাটিয়ার উপর গম্ভীর হয়ে নিজ মনেই ঝগড়া করতে থাকে ৷ 
সত্তুর বছর! তাও শালা কাঁদার জন্য কেউ নাই! এই প্রথম এমদাদ নিজের বউটাকে যৌক্তিক সত্য কারণে মিস করা শুরু করে। ছেমড়িডা বাইচা থাকলে দুনিয়া কাপাইয়া কান্দত। নিশ্চিত৷ 
হঠাত চেঁচিয়ে কান্নার আওয়াজ পাওয়াতে এমদাদের মৃত বুকটা কেঁপে ওঠে৷ এ যে নাতীর কান্না! বেঁচে থাকতে ঠিকমত নাতীটাকে আদর করাও হয়নি! পরক্ষণেই মৃত এমদাদের ভুল ভাঙে। জেদী নাতির চেঁচিয়ে কান্নার কারণ—তাকে চাউমিন খেতে দিচ্ছে না! 
মানা যায়!! এমদাদের মেজাজ ক্রমেই আরো খারাপ থাকে। 
পাশের বাসার শফিউল ভাই, আহরে এই লোকটার সাথে রোজ সকালে হাঁটতো এমদাদ। কত মিশুক আর ভাল লোক! অথচ এই শালাই এমদাদের খাটিয়ার পাশে লোকজনকে বলছিলো— যাক, লোকটা ভালো ভাবেই গেলো! বিছানায় পড়ে ধুকে ধুকে কস্ট পেত হলো না!!! আহা, আরে হারামজাদা, আমি কি এই দ্রুত মরতে চাইছিলাম? কোথায় ছেলে মেয়েরা সবাই তাকে যত্ন টত্ন করবে , এমদাদের জন্য টেনশন করবে, রাতে ঘুম হবে না দুশ্চিন্তায়! তা না,ধপ করে পড়ে, দপ করে মরে গেলাম! এমদাদের ঠান্ডা শরীর রাগে যেন জ্বলছিলো! 
গভীর রাত৷ বাইরে অন্ধকারে খাটিয়ায় এমদাদ একা। দরজা জানলা লাগিয়ে সবাই ভেতরে বসে চুপশোক পালন করছে, অথবা দুখ দুখ একটা ভাব দেখাচ্ছে। এদিকে যে হালকা বৃষ্টি শুরু হইছে কারও সেদিকে খেয়াল নাই। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে এমদাদ খাটিয়া থেকে নেমে হাঁটা দেয়। গেট দিয়ে বের হয়ে সেই যে গেলো, অভিমানী এমদাদকে আর কেউ তিনতলা বাড়িটার ত্রি- সীমানায় ঘেঁষতে দেখেনি।

নওশান মিসয়াই

আদিবাসী বন্ধু নওশান মিসয়াই যখন ওর গোপন ইচ্ছাটা বললো, আমরা সকলেই হো হো করে হেসে দিলাম!

নওশান মিসয়াই এই শহরে নতুন। কি এক কারণে পাহাড় ছেড়ে আমাদের এই দমবন্ধ করা ঘিঞ্চিতে উঠেছে, আর কেমনে কেমনে যে আমাদের সাথে বন্ধুত্ব হলো সেটা হুট করে কারও খেয়াল হয় না। তবে আপাতত নওশান মিসয়াই রওনা হয়েছে কাঠের দোকানে। জানলা কিনবে৷ 
সেইদিন রাতের মিল খেয়ে আমরা তখনও কাজের বুয়াটাকে গালাগাল দিচ্ছিলাম, মহিলা রান্না করে না ইয়ারকি? এর ভেতরেই নওশান মিসয়াই হুড়মুড় করে আমাদের ছোট্ট ব্যাচেলর মেসটাতে ঢুকে পড়ে৷ ওর হাতে ছোটখাটো একটা কাঠের জানলা! 
আমরা একে একে নওশানকে রিমান্ডে নিলাম, অই শালা রোহিংগা ঘরবাড়ি নাই তুই জানলা দিয়ে কি করবি? নওশান ওর ছোট ছোট চোখগুলো আরও ছোট করে রাখে। আতিক খেকিয়ে ওঠে, অই চাইনিজের বাইচ্চা, এই ছোট্ট ঘরে পাঁচজনই ঠিকমতো থাকতে পারি না, আবার জানলাডা কই রাখবি? নওশান মিসয়াই কি যেন ভাবে। তারপর হঠাৎই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। 
সুতরাং নওশান মিসয়াই এবং তার জানলা নিয়ে আমরা আর জল ঘোলা করলাম না। 
সেদিন ছুটির দিনে, আতিক ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল-- নওশান আতিকের পা টা জানলার উপর থেকে সরিয়ে প্রনাম করায় আমরা বেশ বিস্মিত হই। আমি বললাম কিরে তোদের কি জানলারও দেবতা আছে নাকি? কথাটা আরেকটু আগাইতো, বাসা থেকে আম্মা ফোন করায় আমি সাইডে সরে আসলাম। 
আমাদের সবারই বাসা বা বাইরে থেকে ফোন আসে, কিন্তু নওশান মিসয়াই এর ফোন আসে না। ওকে জিজ্ঞাস করলে বলে-- পাহাড়ি এলাকায় নেটওয়ার্ক দুর্বল...আমাদের অবশ্য অন্য ধারনা, নওশান এর নিজের নেটওয়ার্কেই ঝামেলা আছে! 
প্রায় রাতেই নওশান জানলাটা নিয়ে বাইরের বেল্কুনিতে গিয়ে প্রার্থনা করে। আমরা ঘুমের মধ্যেই হাসি। নওশান কিছু বলে না, চুপচাপ জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ সেদিন মেসের আর সবাই বাইরে বেড়াতে যাওয়ায় আমি আর নওশান ছিলাম রাতে৷ নওশান যখন জানলার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠ করছিলো আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াই। নওশান এর কাঁধে হাত দিয়ে বলি, দোস্ত পাগলামু তো অনেক হলো,মান অভিমান ভুলে দেশে ফিরে যা। 
নওশান আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো আয় তোকে আমার দেশ দেখাই । বলেই জানলার পাল্লাটা খুলে আমাকে ঢুকিয়ে দিলো। আমিও কিছু না বুঝেই ছোট্ট জানলার ভেতর গলে যেতে লাগলাম। 
প্রথমে আমি মেঘ দেখলাম। তারপর দেখলাম পাহাড়ের বড় বড় টিলা। প্রচন্ড বাতাস আমার চোখ মুখ বুজে আসছিলো, একটু ধাতস্ত হতেই বুঝতে পারলাম আমি ভাসছি। কিন্ত হাত নাড়তে গিয়ে কেমন ফটফট আওয়াজ শুনে বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠলো৷ আমার হাতের বদল পালক! পায়ের দিকে তাকাতেই সন্দেহটা কেটে গেলো, হ্যাঁ আমি পাখিই হয়ে গেছি৷ 
কিরে বন্ধু, আমার পাহাড়ের দেশ কেমন লাগছে? উত্তর করতে ভয় পাচ্ছিলাম, কন্ঠটাও যদি পাখির মত কিচির মিচির শোনায়! তবে উড়তে উড়তে ভালোই লাগছিলো। বেশ কিছুক্ষণ ওড়ার পর নওশানকে বললাম এইবার জানলা দিয়ে আমাকে বের কর। 
কইরে নওশান 
নওশান 
নওশাইন্না.. 
নওশান জানলা বন্ধ করে কোথাও গেছে হয়ত। হয়ত ঘুমাইছে। নয়ত আশেপাশে গেছে, অগত্যা অপেক্ষা করতে থাকি 
আমি অপেক্ষা করি নওশান ঘুমায় 
আমি অপেক্ষা করি নওশান কোথাও থেকে ফিরে আসে না 
আমি ডানা ঝাপ্টাই, ছটফট করি, নওশান আমাকে ভুলে যায়.. 
শেষ পর্যন্ত রাগ অভিমান আর অসহায় ডানা নিয়ে আমি উড়তে শুরু করি, পাহাড়ের দেশে। আমি মেঘ দেখি না, সবুজ দেখি না, পাহাড়ের গা ঘেষে এঁকেবেকে চলা নদীটাও দেখি না, আমি শুধু উড়তে থাকি। আমার চোখ খুঁজতে থাকে একটা জানলার। 
উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে, একটা গাছের উপর কেবলই আমি ডানা ছড়িয়ে বসেছিলাম, হঠাত একটা সুতায় আমার পা আটকে গেল। এইবার সত্যিই আর চাপ নিতে পারছিলাম না। 
ফাঁদে আটকা পড়ে আমি ঝুলে আছি। সামনের আগুন ঝলসানো ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই বুকটা হিম হয়ে আসছিলো। হাফ প্যান্ট পরা শিকারী ছেলেটি এসে আমাকে দুই হাত চেপে ধরে পাখির খাচাটায় ঢুকিয়ে জানলাটা আটকে দিলো। 

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটিকে, এই তো সেই নওশান মিসয়াই...



কামরুজ্জামান কাজল
প্রকাশিত বই:
১. শ্যামপাহাড়ের আড়ালে (কাব্যগ্রন্থ ২০১৬)
২. দলছুট শালিকগণ(অণুগল্পগ্রন্থ ২০১৭)
৩. আটপুকুরের ফুল(অণুগল্পগ্রন্থ ২০১৮)
৪. ভেতরে ভেতরে খেলা করে যারা(অণুগল্পগ্রন্থ ২০১৯)

SHARE THIS

Author: