গল্প • কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প • নাহিদ ধ্রুব

ইচ্ছেরা নিজেদের গলা টিপে ধরলে পুরাতন ক্যাম্পে ফিরে আসা ছাড়া নিখিলেশের কাছে ছিল না তেমন কোন বিকল্প। শত্রুপক্ষের ব্যারাকে তাঁর গুপ্তচর পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর প্রতিটি সৈন্য যেন হয়ে গেছে একটি গন্ধ শোঁকা কুকুর আর অদ্ভুত ক্ষমতা বলে তারা কোন না কোন ভাবে খুঁজে বের করছিল নিখিলেশের অস্তিত্ব। যাদের জন্য সিঁধেল চোরের মতো পালিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে, তাদের অবশ্য নিখিলেশ বিশেষ দোষ দিতে পারে না। তাঁর বদৌলতে অর্থাৎ তাঁর তথ্যের বদৌলতে তাঁর প্রকৃত ব্যারাকের সৈন্যরা নির্ঘাত যমদূতের মতো এসে উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুপক্ষের দুটো ক্যাম্প, ঐ সব ক্যাম্পে যে নিখিলেশের নতুন গজিয়ে ওঠা বন্ধু ছিল না, তা না, কিন্তু যুদ্ধে এসব ভাবলে চলে? শত্রুপক্ষের সৈন্যদের বন্ধুত্বসুলভ আচরণ, গর্তে শুয়ে শুয়ে তারা দেখা কিংবা যুদ্ধ শেষে ফিরে গিয়ে কে কী করবে তাঁর লম্বা তালিকা’র কথা তাই গোপনে ভুলে যেতে চায় নিখিলেশ। কিন্তু, সীমান্তের কাঁটাতারের মতো তা ঠিক’ই এসে বিঁধে যাচ্ছে বুকে। 


প্রথম ব্যারাকে আক্রমণের সময়েই কেউ কেউ নিখিলেশ’কে সন্দেহ করেছিল কিন্তু স্রেফ ভালোবাসা থেকেই হয়তো তাঁকে আলাদা করে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি তখন আর এদিকে ভালোবাসার জাল কেটে তখন থেকেই পালাবার ফন্দি আঁটছিল নিখিলেশ। কথা ছিল, দ্বিতীয় ক্যাম্পে আক্রমণের সময় সে দল বদল করে যোগ দেবে তাঁর দলের সাথে আর মিশন শেষে পালিয়ে যাবে তাদের ছায়া অনুসরণ করে কিন্তু, দ্বিতীয় দফায় গোলাবর্ষণের সময় যখন তাঁর দলের সৈন্য’রা তাঁকে ইশারা করলো ভেতর থেকে আক্রমণের জন্য তখন নিখিলেশ হয়ে গেলো হাজার বছর ধরে স্থবির হয়ে থাকা কোন এক পাথর, কিছুতেই ভাঙল না তাঁর ধ্যান। ফলশ্রুতিতে, শত্রুপক্ষ আততায়ীদের অস্তিত্ব টের পেয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করলে নিখিলেশের মূল দলের যোদ্ধা’রা ধরাশায়ী হয়ে পড়ে কিন্তু রণভঙ্গ দেয় না কিছুতেই, বরং মুহুর্মুহু শেলের আক্রমণে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় দ্বিতীয় ক্যাম্প এবং একইসাথে তীব্র প্রতিরোধের মুখে নিজেরাও হয়ে যায় ধ্বংস। 

এমন ধ্বংসলীলার মধ্যে একসময় নিখিলেশের ধ্যান ভেঙে গেলে সে দৌড়াতে শুরু করে এবং জঙ্গলের মধ্যে খুঁজে নিতে চায় আশ্রয় কিন্তু, শত্রুপক্ষে ইতিমধ্যে তাঁর পরিচয় উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় তাঁর খোঁজে তারা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে শুরু করে গ্রাম, নগর, মাঠ , জলাশয়। ফলে, জঙ্গল থেকে নদী এবং তারপর কিছু পাহাড়ি জনপদ পাড়ি দিয়ে নিখিলেশ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় পুরাতন ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার। 

ক্ষতবিক্ষত শরীর, অবসাদগ্রস্ত মন এবং শত্রুপক্ষের ছেঁড়া ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় নিখিলেশ তাঁর পুরাতন ব্যারাকে ফিরে আসলে তাঁর জগত এক মুহূর্তে বদলে যায় যখন সে দেখতে পায় এই ব্যারাকের সবগুলো মুখ অপরিচিত। দ্বিতীয় ক্যাম্পে মিশনের সময় তাঁর অচলাবস্থার জন্য মারা যাওয়া বন্ধুদের কথা তখন মনে পড়ে তাঁর এবং ক্যাম্পে নতুন মুখের আগমনের কারণ স্পষ্ট হয় ধীরে ধীরে। কিন্তু, তাঁর এই আগমনের উৎস কিছুতেই স্পষ্ট হয় না নতুন করে ব্যারাকে আসা সৈন্যদের কাছে এবং নিখিলেশের গায়ে শত্রুপক্ষের পোশাক দেখতে পেয়ে তাদের মনে সংশয় হয় আরও গাঢ়। নিখিলেশ যখন নিজেকে এই ব্যারাকের পুরাতন সৈন্য হিসেবে দাবী করে তখন হিতে বিপরীত হাওয়া বয়ে গেলে নতুন ব্যারাকের সৈন্য’রা নিখিলেশ’কে শত্রুপক্ষের গুপ্তচর হিসেবে গ্রহণ করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। 

এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটি ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে খারাপ লাগে না নিখিলেশের যদিও ক্ষুধা থেমে থেমে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। মাথার উপর ষাট পাওয়ারের একটি বাল্ব আলো দিচ্ছিল কিছুক্ষণ আগে কিন্তু এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ কী আর রিমান্ডের তাৎপর্য বোঝে? বিদ্যুৎ নিজের খেয়াল খুশী মতো কোন এক অজানার পথে চলে গেলে ঘরে নেমে আসে কবরের অন্ধকার। এই অন্ধকার’ও নিখিলেশের খারাপ লাগে না অতোটা, কোন এক বিচিত্র কারণে দীর্ঘদিন পর তাঁর মনে ফিরে এসেছে শান্তি। তবে কী এই সে’ই শান্তি যার কথা ব্যারাকের সব মৃত বন্ধুরা বলতো অনবরত, সকলের মনেই ছিল যুদ্ধ সমাপ্তি’র কল্পনা, যে স্বপ্নের কাছে জয়-পরাজয় নিতান্তই তুচ্ছ যেমন তুচ্ছ এই মুহূর্তের অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা। 

নিখিলেশ এই অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে ক্রমশ এবং মনে উঁকি দিতে থাকে হারানো বন্ধুদের হারানো স্বপ্নগুলো, যা আশ্চর্য মেঘের মতো দৃষ্টির আড়ালে থেকেও আঁচড় কাটতে শুরু করে ক্ষিপ্রগতি’তে যার আঘাতে নিখিলেশের মনে আসে অনন্ত ঝিমুনি। এই স্থবিরতা অনন্তকালের পথে হাঁটতে শুরু করার আগেই বিদ্যুৎ ফিরে আসে এবং ষাট পাওয়ার বাল্ব মাথার উপর জ্বলে উঠলে কুর্দি পরিহিত একদল সৈন্য বিভিন্ন মারণাস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে ঘরে। 

ইন্টারোগেশনের সময় নিখিলেশের ধর্ম পরিচয় বের হয়ে আসলে তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন করার শেষ সুযোগটুকু হয়ে যায় হাতছাড়া। শত্রুপক্ষের ধর্ম আর নিখিলেশের ধর্ম যে এক, নিখিলেশ শত্রুপক্ষের চর না হয়ে আর কী’ইবা হতে পারে? সুতরাং, নিখিলেশ’কে শত্রুপক্ষ ভেবে টর্চারের মাত্রা বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের মজবুত বাঁধনে টান পড়ে কিন্তু নিখিলেশ সত্যের পথ থেকে একচুল’ও সরে আসে না বরং যখন ধীরে ধীরে তাঁর নখ আঙুল থেকে উঠে আসে কিংবা তার কিছুক্ষণ বাদে কব্জি আলাদা হয়ে যায় হাত থেকে, তখন নিখিলেশ নিজের সত্যিকারের পরিচয় ভুলে যেতে থাকে এবং ভুলে যেতে থাকে এইসব যুদ্ধের জন্য শেখা সমস্ত কৌশল। 

যদিও প্রশ্নবাণ এই সব ক্ষত’এর তোয়াক্কা করে না বরং ফলায় বিষ মাখিয়ে ক্রমাগত ফালাফালা করতে থাকে নিখিলেশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত। ফলে, একসময় নিখিলেশের চেতন জগত ক্রমশই ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে এবং ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলো’তেও চারপাশে নেমে আসে কুয়ায়াচ্ছন্ন অন্ধকার। মুখে পানি ছুঁড়ে পুনরায় নিখিলেশের জ্ঞান ফিরিয়ে এনে পুনরায় তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নের আগুনে নিখিলেশ’কে ঝলসে দেয়া হলে নিখিলেশ কেবল বলে যেতে থাকে একটি বাক্য, জগত একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং আমরা আসামী। 

এই বাক্যের মর্ম উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে সৈন্যের দল টর্চারের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে নিখিলেশের গোঙ্গানি কিংবা অন্ধকারের মমতার বলেই হয়তো বিদ্যুৎ আবার চলে যায় এবং পুরো ঘরে নেমে নীরবতা। নিখিলেশ এই নীরবতার ভেতর চোখ পিটপিট করে তাকায় এবং তার ইচ্ছে হয় শেষবারের মতো একবার আলোর সন্ধানে যাবার, তখন খোলা জানালা দিয়ে একটি জোনাকি এসে ঢুঁকে পড়ে ঘরে, অদ্ভুত সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে আর নিখিলেশের মনে হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প কিংবা পৃথিবী তো অতোটা মন্দ না! 


নাহিদ ধ্রুব 
জন্ম: ২ ডিসেম্বর; বরিশাল। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় স্নাতক। প্রকাশিত বই : মৃত্যুর মতো বানোয়াট [কবিতা; জেব্রাক্রসিং, ২০১৭] থাকে শুধু আলেয়া [কবিতা; চন্দ্রবিন্দু, ২০১৯] 


SHARE THIS

Author: