অ্যালেক্স সিরিজ ।। চঞ্চল মাহমুদ






অ্যালেক্স, আমাদের যে-জীবনের উপর ইউরোপ দাঁড়িয়ে আছে সে-জীবনকে আমরা মৃত ঘোষণা করেছি। ওরা মরা মানুষের শরীরকে নাচের স্কুল ভেবে নাচ শিখছে…

উচ্চতা-বিষয়ক

এই অনুর্বর মাটিতে পাথরের চাষ করে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি অ্যালেক্স। দিন শেষ হয়ে এলে আমরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছি। দূর থেকে কেউ কেউ ভাবছে শুয়োরের খামার জেগে উঠেছে পৃথিবীতে। আমাদের সেইসব তরঙ্গ উৎপাদনের দিন হেঁটে গেছি পাহাড়-ঘেঁষা রাস্তা বেয়ে। আর নিয়মিত পাহাড় ধসে গেছে আমাদের উপর।
অ্যালেক্স, আমরা চাপা পড়ে গেছি উচ্চতার নিচে। 

কার্পেট

অ্যালেক্স, আমাদের চামড়া কার্পেট হয়ে গেছে;
মেদ বিছানো আছে তার নিচে।
সন্ধ্যার পরেও যে-রাজহাঁস ফিরতে পারেনি ঘরে,
সেই রাজহাঁস খুঁজবে মানুষ
আমাদের কার্পেটে হেঁটে …

অ্যালেক্স, তোর ক্ষুধার্ত দাঁত আমাকে রক্তাক্ত করে চলে

অ্যালেক্স, ক্ষুধার্ত বন্ধু আমার, চল ভাত ছিটিয়ে চলি। বেলাভূমিতে পড়ে-থাকা ঝিনুকের মতো ভাতের বদলে ধর্ম কুড়িয়ে আনি। সভ্যতার ভাঙন আমাদের দোরগোড়ায়। চল, ভেঙে যাই, জেগে উঠি অন্য কোথাও সভ্য হয়ে।

অ্যালেক্স, পেটে এক হাত রাখ, অন্য হাত কপালে; পেট আর কপাল কতদূর অ্যালেক্স? মিটারস্কেল আর কম্পাস রক্তাক্ত করে মাপি। ভাগ্যবদল হয় না দেখে জীবন প্রায়ই উঠে আসে চটের ব্যাগে। অন্ধকারে স্বেচ্ছানির্বাসিত হয়ে সভ্যতা পড়ে থাকে পার্কের বেঞ্চিতে।

জেগে ওঠ মানবতা, শুয়োরের বাচ্চার মতো কোলাহল করে। আমার বন্ধুর বিক্ষত হাত কাঁদছে, বিস্রস্ত চুল, ভুরুতে ঘাম, পায়ের কালশিটে নির্মম হয়ে উঠছে ক্ষুধায়, চিৎকার করছে আলজিভ; শুনতে পাসনি?

অ্যালেক্সের হাসিতে ডুবে যাচ্ছে ইউরোপ

মনে পড়ে তখন বিকেলই ছিল। চগোর ওপর দাঁড়িয়ে যতখানি উপরে ওঠা যায়, ঠিক ততখানি উপরে উঠে আমি ঘোষণা করেছিলাম ইউরোপ এখন রাতের উদ্যান। এখানে মানুষ নেই! মানুষের মতো দেখতে কতগুলো ক্যাকটাস আর কিছু বিষাক্ত ফুলে ভরে আছে এ উদ্যান।

ভূমধ্যসাগরের নিচে যে বালিচাপা পড়ে আছে, তারও নিচে চাপা পড়ে গেছে এ অঞ্চলের আদিম-মানুষ-সংস্করণ। আর এতখানি উপরে উঠে এসেও অ্যালেক্স ঘুমিয়ে আছে কবরে। দেখো, কবরও জোনাকির মতো উড়ছে। ও রাত, ও উদ্যান — এই শেষ আলো। দেখে নিতে পারো পথ!

হাসতে হাসতে আমার মেদ কেটে যায়। যে সভ্যতা ডুবে গেছে বালির নিচে, কতদূর পেরিয়ে অ্যালেক্স এসেছে কবরে শুতে! কতদূর পেরিয়ে অ্যালেক্স এসেছে জোনাকি হতে!
জাদুকর, জাদু দ্যাখ এবার —
অ্যালেক্স বিদ্রুপ করে যখন ঘুংরি হাসি দেয়, পাক খেতে খেতে ইউরোপ তলিয়ে যায় আরো একবার অ্যালেক্সের উচ্চতার সমান। অ্যালেক্স, যে-সংগীত কোনোদিনই শুনিনি, সে-সংগীত পাঠ করে চার্চের উঠোনে গড়াগড়ি খাব দু’জন। ঘাসের ভেতর থেকে মাথা জাগিয়ে বলব — আমরা দেখে ফেলেছি চার্চের উঠোনে তোমাদের ডুবে-যাওয়ার দৃশ্য।

পাল খাড়া করে দাও অ্যালেক্স

পৃথিবীর সব মধু খেয়ে অ্যালেক্স যে তীর খাড়া করে দিল বাতাসে, সেই ভাংদ-কে পাল বানিয়ে বয়ে যাচ্ছে সময়।
বোঝোনি নিকোশিয়া!
তোমার চোখে পাল বেঁধে অ্যালেক্স খুঁজেছে এশিয়া।

উর্বর ভূমিতে গানের মৌসুম শেষ হয় নি কখনো

অ্যালেক্স, আমার এখানে ক্ষুধার মৌসুম। আমিও ক্ষুধার্ত। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যার বুকে উঠে হাঁটি। ইদানীং অফিসের সময় এবং অফিস-পরবর্তী সময়কে আমার পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র মনে হচ্ছে। সন্ধ্যাটাকে মনে হয় বর্ডার। অ্যালেক্স, আমি যখন অফিস থেকে বের হই তখন সন্ধ্যারা বর্ডার হয়ে আমার পায়ের কাছে জড়ো হতে থাকে। আমি আলগোছে বর্ডার ক্রস হয়ে স্বজনদের কাছে ফিরি। আমার ক্লান্ত শরীর কলতলায় যায়, কল ছেড়ে হাতে-মুখে পানি ঢেলে নেয়।

অ্যালেক্স, চোখে-মুখে পানি নিতে নিতে মনে হয়, পৃথিবীর নগরপিতারা আমার ক্লান্ত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুতে দিচ্ছে।

মাথাটা ঝাঁকি দাও রোদেকা

রোদেকা, অ্যালেক্সের হাঁপানি ছিল। অ্যালেক্স হাসি দিলে যে-তরঙ্গ, সে-তরঙ্গের ঝাঁকি পেড়ে আনতো জয়তুন ফলের মাঠ। জয়তুন শীতকালে পাকে। জয়তুনের আচার লবণ-পানির চেয়েও কিছুটা লবণ। লবণ খেলে অ্যালেক্সের হাঁপানি বাড়ে।
রোদেকা, অ্যালেক্স সাঁতার থেকে ঢেউ তুলে বিছানা পেতে ঘুমাত। অ্যালেক্স সাঁতারে যেত।

রোদেকা এখনো আমরা গভীরতায় ডুবে আছি

রোদেকা তুই তো জানিস, পৃথিবী কতখানি দুর্বল। তারও বেশি দুর্বলতা নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তোর পায়ের কাছে এসে। একদিন দুর্বলতা কেটে যাবে, ঘুম ভাঙবে। তোর দু-উরুর মাঝ থেকে টেনে বের করব ধারালো কাঁচি। রোদেকা, দু’জন মিলে আগাছা কেটে ধ্যানের জমি বাড়াব পৃথিবীতে। গুদামজাতকরণ হবে না কোনো বোধের। ভূমির ওপর বিছানো যে দেড়ফিট ভাবের গভীরতা, তা ঠোঁটে নিয়ে বাতাসে ভেসে যাবে কাকাতুয়া।
আর কাক ও শকুনের জন্য পচে উঠবে আগাছার স্তূপ।

সমুদ্র ও উচ্চতা বিষয়ক

রোদেকা, তোমার যৌনাঙ্গে পেতে দাও মই। পিচ্ছিল পথে সাবধানতা নিয়ে একটা উচ্চতা পাক পৃথিবী। মই সহ তুমি ডুবে থাকো উচ্চতার নিচে। হাতে ছাই নিয়ে যত উপরেই উঠে আসুক, অন্য উচ্চতার মানুষ একদিন ঠিকই বুঝে যাবে, তারা বন পুড়িয়ে উঠে এসেছে এখানে। বন মানেই তো সৌখিনলতার ঝোঁপে বাঘ ও দাঁতের হিংস্রতার দিকে খরগোশের এলিয়ে-দেওয়া চোখ ।

এত উঁচুতে হিংস্রতা থাকে না। কিছু অলসতা কাটিয়ে বাতাসে দাগ কাটতে কাটতে হারিয়ে যায় খরগোশ। যেখানে বন নেই, সেখানে বাঘ নেই। সেখানে খরগোশও থাকে না।

রোদেকা, জয়তুনক্ষেতে যে-রোদ জানিয়ে গেল — আধিপত্য অর্জনের কিছু নয়, সে-রোদে আমরা ফেলে দিয়েছিলাম আমাদের খালি-হয়ে-যাওয়া স্যুটকেস আর তোমার কপালের সমান একখানা ভাঙা আয়না।

আহ রোদেকা,
রোদে আয়নায় রপ্ত হলো দিন!
চাপা পড়ে যাও পৃথিবীর শীতকাল। আমরা উষ্ণ হতে থাকি।

SHARE THIS

Author: