ভোর হয়েছে। মমতা হালকা অস্বাভাবিক আচরণ করছে।রোমেলা খাতুন বেশ ভেঙে পড়েছে। একদিকে সেই রাত থেকে হাসানের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। অপর দিকে ছেলে আহাদ আলীর খোঁজ নেই দশ-বার বছর।
একমাত্র মেয়ে ক' দিন ধরে ঠিক মত খাচ্ছে না।মুখটা ফ্যাকসা হয়ে যাচ্ছে, সব সময় মনমরা হয়ে থাকে। সকাল থেকেই সে নিজের চুল নিজে নিজেই ছিড়ছে ও পাগলীর মত আচরণ করছে।রোমেলা খাতুনে হতাশায় ও রাগে গিজগিজ করে বলল,মিন্সী কন যে যায়?মেয়িডার কি উপর দৃষ্টি হোইলু, আল্লাহ?
রোমেলা খাতুন যেন কোন কিনারা পাচ্ছে না,নদীর মাঝখানে পড়ে হাবু-ডুবু খাচ্ছে।
সাত সকালে মোবারক আলী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।এরকম অভিযোগও করছে রোমেলা খাতুন।
আবার মনে মনে ভাবে, মমতার বাপ তো রোজ সকালেই যায়।
অবশ্য দীর্ঘদিনই মোবারক আলী ভোরে উঠে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে এবং মাঠ-ঘাঠ দেখে বাড়ি ফেরে।রোমেলা খাতুন কী করবে বুঝতে পারছে না।একবার মমতাকে ধরে শুয়ায়ে দিয়ে মাথায় পানি ঢালতে চেষ্টা করল।কিন্তু একবার এক ঝ্যাটকা দিয়ে, রোমেলা খাতুনের হাত থেকে পানির বদনাটি কেড়ে নিয়ে, মমতা উঠানের দিকে ছূঁড়ে মারল।রোমেলা খাতুন ভয় পেয়ে গেল। আর যে কি করবে বুঝে উঠার আগেই উঠে বসে মমতা, হাঁপাতে লাগল।
রোমেলা খাতুন আর অপেক্ষা করল না।ঘরের পিড়ি থেকে নেমে দৌড় দিল হায়েত আলীর বাড়ির দিকে।বাড়ি বলতে, এই গ্রামের কোন এক বড় চাকুরীজীবি ঢাকায় বসবাস করে,তিনি মাঝে মাঝে গ্রামে এসে দুএকদিন থাকার জন্য একটি রেস্ট হাউজ মত করে রেখেছে।- সে রেস্ট হাউজে হায়েত আলী থাকে।শুনা যায় ঢাকার সে ভদ্রলোকও টাকুদহ গ্রামের টাকু বিশ্বাসের বংশধর।তবে মোবারক আলীর সাথে মিল- অমিল কিছুই নেই।যা হোক,রেস্ট হাউজের গ্রিলের ভিতর দাড়িয়ে ছিল হায়েত আলী। রোমেলা খাতুনকে যেতে দেখে বেশ আগ্রহভরে এগিয়ে আসতেই, রোমেলা খাতুনই মুখে আঁচলের কাপড় দিয়ে অর্ধ ঢাকা অবস্থায় বলল, হুজুর আমার মমতারে জ্বীনে ধোইরছে, তাড়াতাড়ি চলেন।সাথে সাথে গ্রিলের ভিতর থেকে বেরিয়ে,গ্রিলের গেটে তালা দিতে দিতে বলল,আপনি যান আমি আসছি।রোমেলা খাতুন দ্রুত পা ফেলে বাড়ির দিকে রওনা দিল।বাড়ি ফিরে দেখতে পেল, মোবারক আলী উঠানের মাঝখানে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।মোবারক আলী কিছু বলার আগেই চিৎকার করে সামনে গিয়ে পড়ে কপাল থাপড়াতে থাপড়াতে রোমেলা খাতুন বলতে লাগল,আমার মমতারে জ্বীনে ধোইরছে গো,জ্বীনে ধোইরছে।- হায় আল্লা আর কতকাল জ্বীনের জালা সইতে হবে।জ্বীনের আঁচড়ে আমার
বাড়িঘর-সংসার- ছেলিপুঁত সব শ্যাষ হয়ি গেলরে,আল্লা গো আল্লা; তুই বাঁচা বাঁচা।- বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।এমন সময় হায়েত আলী বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল এবং সোজা মমতার ঘরে গিয়ে পাশে বসল।বসতে বসতে রোমেলা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলল,এক ঘটি শষ্যের তেল দেন চাচী।রোমেলা খাতুন রান্নাঘরের দিকে তেল আনতে গেল,ঠিক সেই সময়ই মমতা বেশ বড় বড় করে চোখের পাতা তুলে বলল,হায়েত আলী আমাকে জ্বীনে ধরে নাই,আমার পেটের মদ্যে তুমার ছেলি বাইড়ি ওঠছে। মনে আছে সেদিন রাতের কতা?- হাসানের কাছে শুয়ার নাম কোইরি আমার কাছে আইয়েলি?
হায়েত আলী এদিকওদিক আড় চোখে তাকিয়ে দেখল, উঠানে বিধ্বস্ত শরীরে মোবারক আলী দাঁড়িয়ে আছে।
এবার হায়েত আলী আস্তে আস্তে বলল,নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ।- চুপ থাকো মম, চুপ থাকো;আমি, আমি ব্যবস্থা কইরি ফেইলবুনি।
মমতা খুব আস্তে ও দৃঢ় কণ্ঠে বলল,চুপ নাই কোরনু।- তে, তুমি জ্বীনে ধরা হাসানের কাছে যে রাইতে ছিলে,সে রাইতে হাসানের কাছে ছিলে?- না আমার কাছে ছিলে? আবারও কঠিন গলায় প্রশ্নটা করে, তীক্ষ্ণভাবে চেয়ে থাকল মমতা ।
হায়েত আলীর মুখটা শুকিয়ে গেল।তখনই রোমেলা খাতুন তেলের বাটি নিয়ে হায়েত আলীর দিকে ঠেলে দিল।হায়েত আলী বাটিটা নিজ হাতে টেনে নিয়ে ঠোঁটটা কয়েকবার নড়িয়ে যেই ফুঁ দিতে গেল, ঠিক তখনই ডান হাত দিয়ে জোরে আঘাত করে বাটিটা ফেলে দিল হায়েত আলীর হাত থেকে এবং মুখে উচ্চারণ করল ' হারামখোর'।
হায়েত আলী ভয়ে জড়ষড় হয়ে গেল, তবে উঠানের দিকে তাকিয়ে আবার মমতার কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করে বলল,ওরে বাপরে বাপ,বজ্জাত জ্বীন, বজ্জাত-বজ্জাত।দেখছি দাঁড়া বলতেই, বাড়ির গেট দিয়ে রকিব চেয়ারম্যান প্রবেশ করল।
নব নির্বাচিত চেয়ারম্যানের গলা ভর্তি অনেকগুলো ফুলের মালা রয়েছে এবং সাথে আছে বেশ কয়েক জন লোক।
হাসি মুখে রকিব মোবারক আলীর উদ্দেশ্যে বলল,স্লামালেকুৃম চাচা।
উলাইকুম আসসালাম, বলেই পিড়ির উপর থেকে খুব দ্রুত নেমে কোলাকুলি শুরু করে দিল হায়েত আলী। মোবারক আলীকে সালামের উত্তর দেওয়ার সুযোগই দিল না হায়েত আলী।
মোবারক আলী চেয়ারম্যান রকিব উদ্দিনের কাছে এগিয়ে গিয়েই ভগ্ন শরীরে ও আদ্র গলায় অভিযোগ দিল, বাবা আজ রাইতে আমার বড় বড় কাঁঠাল গাছগুলো কারা যেন কাইটি দি গিছে? রোমেলা খাতুন এতক্ষণ পর বুঝল তার স্বামীর মন কেন এত খারাপ এবং কেনইবা এত ভেঙে পড়েছে?
রকিব উদ্দিন বলল,সবেমাত্র চেয়ারম্যান হলাম চাচা, ক্ষমতা পালিই আপনার গাছ কাটার বিচার আগে কইরব।দোওয়া করবেন চাচা, বলে হাতে হাত মিলিয়ে বেরিয়ে গেল।
চেয়ারম্যান বেরিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কিছু লোকের সাথে হায়েত আলীও বেরিয়ে যাওয়ার যেন সুযোগ পেল,একবার মমতার দিকে আর একবার মোবারক আলীর দিকে পিছলেমুখে তাকিয়ে হায়েত আলী বেরিয়ে গেল।
মমতা খুঁটিতে হেলান দিয়ে হায়েত আলীর পালিয়ে যাওয়া উপলদ্ধি করল।হায়েত আলী পালিয়ে গিয়ে দম ছেড়ে বাঁচলেও মমতার দম আটকিয়ে আসছে।তবে মমতা অস্বাভাবিক আচরণ করা বন্ধ করে ঘরের ভিতর গেল।তার বার বার মনে হচ্ছিল,মাঠে বেড়ে উঠা বাপজানের হাতে অতি যত্নে লাগানো গাছগুলোর কথা।কে বা কারা এত বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলল? কেনই বা কাটল?
এখন আর মমতা তার পেটের সন্তানের কথা ভাবছে না।মমতা নিজেই নিজেকে বলে,একুন যদি মাতা গরম করি,তাইলে বাপজান বাইচপি নানে।
মমতা ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাকে এবং বলতে থাকে, 'আইজ যদি ভাইজান বাড়ি থাইকতু তাইলে সব সেই দেকতু। হাসানেরও খোঁজ নেই,ওইটুকু ছেলি কন যে গেল?- আল্লাহ আমার ছেলিডাকে ভাল রাইকু'।
এমন সময় রোমেলা খাতুন থালায় ভাত নিয়ে ঘরে ঢুকল।মমতা খুব শান্তভাবে বলল, ওখানে রাকো মা,আমি হাত- মুখ ধুয়ে আইসি, খাইয়ি নিবুন।
রোমেলা খাতুন ভাতের থালাটা রেখে মমতার মাথায় ও মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,মা
আনোয়ার রশীদ সাগর
জন্ম ১৯৬৫, ১২ জানুয়ারী।
প্রকাশিত বই: কবিতা- না, যাবো না, ও মেঘ ও নারী, মুখোশ মন্ত্রের ফড়িঙকাব্য, বৃষ্টি প্রেমে শ্রাবণসন্ধ্যা, আকাশ জুড়ে বাজপাখি ছোঁ।
গল্পের বই: বিচ্ছিন্ন হতাশা, নোম্যান্স ল্যান্ড
উপন্যাস: পাখি এক অষ্টাদশীর নাম, স্রোতের কালো চোখ।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক: ৭১ এর রণাঙ্গণে কাকিলাদহ যুদ্ধ।
বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। বসবাস: আলমডাঙ্গা পৌরসভার কোর্টপাড়ায়। লিটলম্যাগ সহ জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন।