গল্প • রাদো ঘড়ি • হামিম কামাল


১.

কে যেন অনশন করে মারা গিয়েছিল। যা চেয়েছিল পায়নি। আমার শৈশবের স্মৃতি এটা। কিন্তু এই এটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু মনে নেই যেটা বলে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারি। সেই প্রথম অনশনের সঙ্গে আমার পরিচয়। মনে আছে, অনশনকারী একজন নারী ছিলেন। মাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও না খেয়ে আছে কেন? মা আমাকে বুঝিয়েছিলেন, না খেয়ে ও আমাদের ওপর ভরসা করছে। এবার যেন আমরা ভালোবেসে ওর চাওয়াটা মেটাই। অনশনটা সবচেয়ে কোমল আন্দোলন। যাদের কাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন তাদের ভালো মানুষ ধরে নেওয়া হয়। যেন ওর না খেয়ে থাকায় ওদের অনেক কিছু এসে যায়। কখনো সত্যিই এসে যায়, কখনো কিছু এসে যায় না। আমি মায়ের কথা কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কিছু পারছিলাম। যেটুকু পারছিলাম সেটুকু বোঝার গৌরবে চুপ থাকলাম। কিন্তু যেটুকু বুঝলাম না সেটুকু লালন করে রাখলাম কখনো আর কাউকে জিজ্ঞেস করব। পরে মেয়েটা যখন মারা গেল, আমি এটুকু নিশ্চিতভাবে জেনেছিলাম, যাদের কাছে সে দাবি তুলেছিল, তার মৃত্যুতে তাদের কিছু যায় আসে না। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, মেয়েটা কি তা জানত না? 

২.

কী একটা যেন চেয়েছিলাম মায়ের কাছে। পাইনি। কী পাইনি খেয়াল নেই। কিন্তু সেই না পাওয়াটা আমাকে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে অনেক ভুগিয়েছিল। স্বপ্নে আমি শুধু লম্বা লম্বা পথ হেঁটে হেঁটে লম্বা লম্বা কথা বলে গেছি ধূসর সব মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছু একটা খোঁজে যেন আমাকে পাহাড় ডিঙাতে হবে, ঠিকানা জানা নেই, কেউ আমাকে ঠিকানাটা দিচ্ছিল না। একটার পর একটা বাধা এসে আমাকে কেবল সরিয়ে নিচ্ছিল। সব হচ্ছিল, কেবল যা চাই সেটাই হচ্ছিল না। আর বাস্তবে আমি খুব মনমরা হয়ে থাকলাম। আমার বন্ধু, মনে মনে যাকে ভালো বাসতাম আমি, এসে বারবার জিজ্ঞেস করে গেছে, ‘তোমার কী নিয়ে মন খারাপ?’ আমি বলিনি। শেষে সে বলেছে, আমাকেও সে কোনোদিন কিছু বলবে না। আমি তখন আর থাকতে পারিনি। তাকে ডেকে বলেছি, ‘শোনো, তুমি মন খারাপ কোরা না। আসলে কী একটা যেন আমাকে দেবে বলেছিল আমার মা, দেয়নি। তাই মন খারাপ। আবার, সেই জিনিসটা যে কী, সেটা মনে করতে না পেরেও আমার মন খারাপ। শুনলে তো। এবার বলো, কী করব। কিভাবে আমার মন ভালো হবে।’ আমার বন্ধুটি হেসে চুপ করে আমার পাশে বসেছিল। তার কাছে কোনো সমাধান ছিল না।

৩.

কাকে যেন কারা মেরে ফেলেছে, পত্রিকায় তার ছবি। আমার বাবা ছবিটা দেখে পত্রিকা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। আমি বসেছিলাম অপরপাশের চেয়ারে। খানিকটা উঠে এসে ঝুঁকে তাকিয়ে দেখলাম ছবিটা। একজন মানুষকে অনেকগুলো মানুষ ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। মানুষটার মাথা থেকে সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, মানুষটি কে? বাবার নিরুত্তর। আমি আমাকে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে মানুষটি? মা নিরুত্তর। আমি মানুষটির নাম উচ্চারণ করে পড়েছিলাম, মনে আছে, কিন্তু কী সেই নাম, তা আর মনে নেই। তবে তখন বেশ ক’দিন মনে ছিল। আমি স্কুলে গিয়ে আমার বন্ধুদের বলেছিলাম মানুষটিকে তারা চেনে কিনা। একজন চিনেছিল, সে আমার সেরা বন্ধু ক্লাসের। এখন দেশের বাইরে কোথাও থাকে। চেনে বলার পর আমি কী বলেছিলাম, সে-ই বা প্রত্যুত্তরে কিছু বলেছিল কিনা আমার মনে নেই। আজকাল অন্তর্জালে পুরনো, হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়। তাকে পেলে আমি জিজ্ঞেস করব- এরকম কিছু তার মনে আছে কিনা। 

৪.

কে যেন বিদেশে যাবে, আমরা সবাই বিমানবন্দরে ছিলাম। কিন্তু কে সেই লোক, কোথায়ই বা সে গিয়েছিল তার কিছুই আজ আর মনে করতে পারি না। শুধু মনে আছে বিমানবন্দরের বিরাট ছায়ান্ধকারে আমি আমার মায়ের হাত ধরে একবার এপাশে যাচ্ছি, আরেকবার ওপাশে। সবাই জিজ্ঞেস করছে, ‘সে’ এসেছে কিনা। ‘সে’ যাবে বিদেশে, কিন্তু তারই দেখা নেই। সবাই খুব বিরক্ত। কেউ কেউ আবার ভীত। আমাদের না দেখতে পেয়ে সে কাচের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে গেল কিনা। বিমানবন্দরের বাইরে অনেক মানুষ, এবং তখন মোবাইল ফোনের যুগও নয় যে এ তাকে ফোন করে খুঁজে বের করতে পারবে। যারা ‘তার’ অপেক্ষোয় ছিল তারা নিজেরাও মাঝে মাঝে একে অপরকে হারিয়ে ফেলছিল। এ অবস্থায় খুবই সম্ভব, যার জন্যে অপেক্ষা সে হতাশ হয়ে দুপাশে মাথা নেড়ে একসময় কাচের দেয়ালের ওপারে চলে গেছে, যেখানে বিরাট একটা উড়োজাহাজ তার অপেক্ষায়। যাওয়ার আগে সে হয়ত বারবার পেছনে তাকিয়েছিল একটা পরিচিত মুখের আশায়, কিন্তু দেখতে পায়নি। বিমানবন্দরের আকাশপ্রতীম বিপুলা ছাউনির নিচে উড়ে বেড়াচ্ছি অগনিত অসংখ্য জালালি কবুতর। সেই মানুষটির দেখা শেষতক পেয়েছিলাম কিনা আমার মনে নেই, সম্ভবত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, যে গাড়িটা আমরা ভাড়া করে নিয়ে গিয়েছিলাম- একটা নীলরঙা মাইক্রোবাস, তার সিটে গা এলিয়ে। কিছুদিন আগে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কে সেই লোক যার জন্যে...’ মা নিচের ঠোঁট কামড়ে ভুরু কুঁচকে ভাবতে বসল। এমন কিছু আদৌ ঘটেছিল কিনা সেটাই তার মনে নেই। 

৫.

কে যেন হারিয়ে গিয়েছিল। আমি আমার বন্ধু তালুকদারকে নিয়ে একটা খালের পাশ দিয়ে দৌড়ুচ্ছি। আমরা কি হারিয়ে যাওয়া তাকে খুঁজছিলাম? না। দূরে খালের পশ্চিমধারে এক ডোবাপুকুরর সঙ্গে যোগ, সেখানে কার যেন লাশ ভেসে উঠেছে। কোমরের কাছে ষোল মাছে খাওয়া। এতো কিছু আমার মনে আছে, কিন্তু কে হারিয়ে গিয়েছিল আর কার লাশই বা আমরা দেখেছিলাম, আদৌ দেখেছিলাম কিনা, কিছুই মনে নেই। 

৬.

কৈশোরে একবার দাদুবাড়ির পুকুরপাড়ে কার সঙ্গে যেন বসে মিষ্টি সব আলাপ করেছিলাম। তার মুখটা শ্যামল, চোখ দুটো টানা টানা, কণ্ঠ খানিকটা ছেলে ছেলে ভাঙা ভাঙা, শুনতে আমার ভালো লেগেছিল। একটাই সন্ধ্যা কেবল, পুকুরপাড়ে আমার পাশে বসে অনেক কথা সে বলেছিল। ঢাকা থেকে গিয়েছিলাম দাদার বাবার জন্মবার্ষিকী পালনে, বা মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে, ৯ ফাল্গুন। ঢাকায় থাকি বলেই বোধয় মেয়েটি আমার সঙ্গে সাধ্যমতো প্রমিত রীতিতে কথা বলছিল। মনে মনে তার সঙ্গে বুঝি প্রেম হয়ে গেল ভেবে সুখ সুখ পাচ্ছিলাম, আমি বরাবরই প্রেমিক প্রকৃতির। মেয়েটির সঙ্গে সারা দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি অসংখ্য রোমাঞ্চকর মানসিক লেনাদেনা হয়ে গেল। অনুষ্ঠান শেষ হলো, আমার সেই আত্মীয়াও চলে গেল। পরের বছল নাম ভুলে যাওয়া তার ছায়া ছায়া তার মুখের গড়ন, কথার বর্ণনা আমি পরে অনেকবার দিয়েও কারো কাছ থেকে তার পরিচয়টা পাইনি, কেউ চেনেনি তাকে। আর কখনও তার সঙ্গে দেখা হয়নি আমার।

৭.

দেয়ালের ওপর বসে পা দোলাতে দোলাতে কে যেন আমাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার আপার নাম পাখি, তাই না?’ ছেলেটা বয়সে আমার বড়, তাকে আজও চিনতে পারি না। ছেলেটা আমার হাত দুটো তুলে নিয়ে বলেছিল, ‘কী নরম!’ মেজাজ খারাপ হলেও আমি হাসলাম। সবচেয়ে শোচনীয় অংশটা ঘটল এরপর। ছেলেটা বলল, ‘তোমার আপার হাতও কি এমন নরম?’ তখনও আমি হাসলাম, সেই লাজুক লাজুক সুখী সুখী হাসি। আমার পিঠ চাপড়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কিছু খাবে?’ আমি তার হাত গলে বেঁকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম । কে সেই গোপন পাণিপ্রার্থী আমার বোনের? আমার বোন তখন প্রথম তারুণ্যে পা দিয়েছিল, আর সেও ছিল প্রথম তরুণ। আমি শেষ কৈশোরে।

৮.

কে যে আমায় কী যেন খেতে শিখিয়েছিল, অচিন গাছের নচিন কোনো ফল। আমার প্রথম গ্রামীন বন্ধু সে, এটুকু জানি। নানাবাড়ির সবুজ অন্ধকারে সারা দুপুর দুজন বিভূতিভূষণের গল্পের পাতায় যেন দৌড়ুলাম। সোনালী হলুদ-পাটকিলে এক অদ্ভুত রহস্যগন্ধা বিকেল। শহরে ফিরে এসে তার মুখ ভুলে গেলাম। এরপর দেখা হয়নি প্রায় চব্বিশটি বছর। অনেক অনেক দিন পর শুনেছি, কে যেন পাগল হয়ে গেছে গাঁয়ে, আমার নাকি বন্ধু ছিল সে, প্রায়ই এসে জিজ্ঞেস করত আমার কথা। নাম মনা। মনাই কি আমাকে... আমি মনে করতে পারলাম না। যদি সে-ই হয়ে থাকে তো... পুলকিত মন, আমি ভুললেও হয়ত সে ভোলেনি। তাকে যেদিন দেখতে যাব, শুনি পালিয়ে গেছে। পাগল পালিয়েছে, কে আর রাখে খোঁজ। সেবছর গেল। পরের বছর আবার গেলাম গাঁয়ৈ। মনে মনে কল্পনার কত জাল, যেন তার দেথা পাব, বোধয় সে-ই, এ-ই সেই, আমার সেই বন্ধুবর, গুঁড়োমরিচ আর লবণ মাখিয়ে খেতে শিখিয়েছিল সেই বুনো ফল। কিন্তু কোথায় কে। সে ফিরে আসেনি। পরের বছর নয়, তার পরের বছরও নয় হয়ত আর কোনোদিনই আসবে না। তার পরিবারও আশা ছেড়েছে। মনাকে যদি দেখতে না পাই, কোনোদিন জানতে পারব না ও আমার সেই বন্ধুটি কিনা। ভুলে যাওয়া এক মধুমধ্যাহ্নের অযাচনার বর-বিভূতিভূষণ।

৯.

কিন্তু একটা রাদো ঘড়ি আমার পাওয়ার কথা ছিল, মনে করতে পারি। বাবা কথা দিয়েছিলেন। তবে একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন— ক্লাসে প্রথম হতে হবে। প্রথম আমি কোনোদিন হতে পারিনি। বাবাও সেই গ্লানি নিয়ে একদিন ছবি হয়ে গেলেন। ঘড়ি আমার পাওয়া হলো না। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা যা দিতে চেয়েছিলেন তা যেন ঠিক ঘড়ি ছিল না। আমিও বাবার কাছ থেকে ঘড়ির আড়ালে যেন অন্য কিছু চেয়েছিলাম। 



হামিম কামাল
জন্ম: ৯ অগাস্ট ১৯৮৭, ঢাকা। 
প্রকাশিত বই: জঠর (২০১৫), কারখানার বাঁশি (২০১৮), সোনাইলের বনে (২০১৯)।

SHARE THIS

Author: