দীর্ঘদিন বিদেশে চাকরি করার পর মাত্র ক`দিন হলো ডা. মাহবুব দেশে ফিরেছেন। একমাত্র সন্তান আরিফসহ স্ত্রী রুবিনাকে পাঠিয়েছিলেন বছরখানেক আগেই। এরই মধ্যে বনেদি এলাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনে রুবিনা সেটি সাজিয়ে রেখেছে আধুনিকতার সঙ্গে অরণ্যের নৈসর্গিকতায়।
বারান্দায় টবের চারা থেকে দেয়ালে ঝোলানো সিন্থেটিক লতা-পাতাগুলোও ভীষণভাবে নজর কাড়ছে সবার। আর প্রতিটি জিনিসপত্র নির্বাচন করা থেকে সেগুলো যথাস্থানে রাখতে যোগ হয়েছে রুবিনার নিজস্ব রুচি ও মেধা। সব দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারে না ডা. মাহবুবও। এমনিতে তিনি স্ত্রীর অনুগত স্বামী এ-কথাটি ঘুরিয়ে বললেও অত্যুক্তি হয় না।
আরিফকে ভর্তি করা হয়েছে একটি নামকরা ইংলিশ স্কুলে। ক্লাস এইটে পড়ে সে। সবদিক সামলে ছেলেকে পড়ানো রুবিনা একা পেরে ওঠে না। মাত্র মাস দু’য়েক হলো সামনের ফ্ল্যাট থেকে বুয়েটের এক ছাত্রী এসে আরিফকে পড়িয়ে যায়। মেয়েটির সঙ্গে আরিফের বেশ ভাব হয়ে গেছে দেখে নিশ্চিন্ত হয় রুবিনা। যা দুষ্ট আর একরোখা হয়েছে ছেলেটি। শুধু দাদা-দাদির কাছে গিয়ে কাজিনদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটাতে চায়।
ছেলেকে পড়াতে আসা মেয়েটিকে প্রথমবার দেখেই চমকে ওঠেন ডা. মাহবুব। তবু তিনি সেখান থেকে তখনই চলে যেতে পারলেন না। দাঁড়িয়ে থেকে বিদ্যুতের শক খেলেন অনবরত। তা কি ইচ্ছে করে নাকি ইচ্ছের বিরুদ্ধে। নাকি ওই বিদ্যুৎপ্রবাহ তাকে স্থানুর মতো করে রেখেছে। অনেকক্ষণ পর প্রথম কথাটি উদগ্রীব হয়ে ছুটে গিয়ে স্ত্রীর কাছে বললেন, ‘কে এই মেয়েটি?’
Ñএই তো এই সামনে দোতলার ফ্ল্যাটটি ওদের। পত্রিকায় ‘পড়াতে চাই’ বিজ্ঞাপন দেখে ফোনে যোগাযোগ করে ওদের বাসায় গেলাম। অনেকক্ষণ কথা হলো। ওর ডাক্তার মামা নিজের সন্তানের সঙ্গে সমান স্নেহে ওকে মানুষ করছেন। আরিফকে পড়ানোর সম্মতি দিলে টাকার প্রসঙ্গটি তুলতেই ও মেয়ে বললো, আসলে আমার কিছু একটা করতে ইচ্ছে হচ্ছে বলেই আমি কাউকে পড়াতে চাচ্ছি...।’
- ওদের দেশ কোথায় জানো? চোখের নজর তীরের মতো ধারালো হয়ে উঠেছে মাহবুবের।
- বলেছিলো মানিকগঞ্জে। বিছানার চাদর টানটান করতে করতে বললো রুবিনা।
- বাবা কী করেন? কপালের ঘাম দুহাতে মুখে একাকার করে দিলেন মাহবুব।
- একদিন ওর বাবার কথা জানতে চেয়ে খুব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। তাই ভুলেও আর ও প্রসঙ্গ টানি না।
- কেন? বলতে পারো? দুটি বাক্যে মাহবুব বললেন কথাটি।
- বলেছিলো, আমার মায়ের কথা জানতে চান আন্টি, আমার মায়ের নাম হেলেন। যার জন্য আমার কষ্ট। আমার জন্য যার খুব কষ্ট! আমি ছাড়া তার আর কোন স্বপ্ন নেই, কিছু নেই!
স্বামীর তীব্র কৌতূহলী চোখে চোখ রেখে রুবিনা বলতে লাগলো, তবুও বলেছিলাম, তোমার বাবার ওপর তোমার এত অভিমান? উত্তরে বলেছিলো, ‘অভিমান? যাকে দেখিইনি তার ওপর আবার কীসের অভিমান? যার অস্তিত্ব আমার মাকে শুধুই কষ্ট দিয়েছে, কলঙ্ক দিয়েছে, তাকে ঘৃণা করতেও করুণা হয়। তবে হ্যাঁ, স্কুলের ফাইলে একটা নাম অবশ্য থাকতে হয় বলেই আছে। আর এখনো তো সেরকম সময় আসেনি সন্তান শুধু তার মায়ের পরিচয়ে সম্মানজনক ভাবে বেড়ে উঠবে। না হলে ওটা বয়ে বেড়ানোর কোনো প্রয়োজনই ছিলো না।’
রুবিনা অন্যমনস্ক স্বামীর মনোযোগ আকর্ষণ করে বললো, ‘জানো সেদিন মেয়েটির চোখে যে স্ফুলিঙ্গ ঝরতে দেখেছি, ওসব নিয়ে আর কথা বলতে সাহসই পাইনি। খবরদার ওকে এ নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে যেও না যেন! শেষে চটে গিয়ে যদি আর না আসে। আরিফকে নিয়ে মুশকিলে পড়তে হবে। মেয়েটি যেদিন না আসে আরিফ হাঁফিয়ে ওঠে। আর দেখো, যেন ওরা দুটিতে ভাইবোন। ওর তো কোনো ভাইবোন নেই! Ñএকনাগাড়ে বলে যাওয়া রুবিনার কোনো কথাই মাহবুবের মাথায় ঢোকেনি।
‘হেলেন’ শব্দটি শুধু যখন রুবিনার মুখে উচ্চারিত হয়েছিলো, তখন রুবিনা টেরও পায়নি আচমকা উথাল-পাতাল একটি ঝড় কোথায় বইতে শুরু করেছে। তার ঝাপটায় তছনছ হবে তারও জীবন! রাত গড়িয়ে গভীর হচ্ছে, স্ত্রী-পুত্র ঘুমোচ্ছে অঘোরে। ডা. মাহবুবের কিছুতেই ঘুম আসছে না। জীবনে এই প্রথম তিনি মরিয়া হয়ে একটা ঘুমের বড়ি খুঁজতে লাগলেন। শরীরের ভেতরে একটি বিপর্যয় তাকে তাড়া করছে বুঝতে পেরে।
বহু বছর আগে, তখন তিনি এমবিবিএস পাস করেননি। তরুণ মাহবুব গিয়েছিলো বন্ধু শোয়েবের গ্রামে। রৌদ্র-ছায়ার পথগুলো, পূর্ণিমা রাতের নদীতে ভাসা নৌকা, মখমলে আকাশ আর অবারিত ফসলের মাঠ ছাপিয়ে বন্ধুটির সদ্য কলেজে ওঠা ছোট বোনটিই দখল করে নিয়েছিলো ওর মনের সবটুকু জায়গা। আকাক্সক্ষারও সবটুকু।
শোয়েবের বুঝতে দেরি হয়েছিলো ধনীর দুলাল মাহবুব বারবার সেধে তাঁর পিছু নেয় কীসের টানে। মাহবুব শোয়েবের কাছে হেলেনের বিয়ের
প্রস্তাবটি রাখামাত্রই চমকে ওঠে শোয়েব, বলে-‘বলিস কী? তোরা কত বড়লোক! আর ঢাকায় আমাদের একটু জমিও নেই। গ্রাম দেখার মতো এও তোদের আরেক বিলাসিতা দোস্ত। মাথা থেকে এ ভাবনা ঝেড়ে ফেল। গার্জিয়ান ছাড়া প্রস্তাব তুই রাখলে তোর সঙ্গে বাবা আমাকেও তাড়াবেন। মানুষ চিনতে ভুল করেছিস।’
অবশেষে হেলেন নিজেই পা রাখলো ভয়ঙ্কর সেই বালুর ফাঁদে। কাজীর অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছিলো ওরা। কিন্তু মাহবুব কোনোদিন বিষয়টি তার মা-বাবার কাছে গোচরে আনতে সাহস পায়নি। শোয়েব কতবার তাড়া দিয়েছেÑ‘হেলেন মা হতে যাচ্ছে, এভাবে ওখানে পড়ে থাকলে আমাদের
যে মান-সম্মান থাকে না।’
বিষয়টি নিয়ে আমি খুব ভাবছি। কিন্তু কূল-কিনারা পাচ্ছি না, মায়ের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাবো বলেও মনে হচ্ছে না, তবু আমি দেখছি কী করা যায়। নিরুপায় কণ্ঠে কথাগুলো বলেছিলো মাহবুব। বন্ধুর কাপুরুষোচিত আচরণে ঘৃণায়, ক্রোধে শোয়েব পরে আর মাহবুবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। এদিকে কী অবর্ণনীয় দুর্দশা বয়ে গেছে হেলেনের জীবনে! তা কি কখনো ভোলার মতো।
পাস করা মাত্রই মাহবুবকে পাঠানো হয় আমেরিকায়। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর সে ওখানেই সেটেল হয় এবং কোনো এক সময় বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যায় মামাতো বোন রুবিনাকে। এটা ছিলো তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত। অতীতের দুর্ঘটনা আর কোনো সঙ্কটই সৃষ্টি করেনি ডা. মাহবুবের জীবনে। নির্বিঘেœ সে তাই ভুলে যেতে পারলো সব। ক্রমে জীবনে প্লাবন আনে নতুন চাঁদের পূর্ণিমা। নতুন নতুন পথের হাতছানি তার স্মৃতি থেকে মুছে দেয় দ্যুতিময় সবুজ গ্রামের সেই আবেশও। কলতান ওঠা আলোকিত ঢেউয়ের পরশটুকুও মুছে যায় জলের রেখার মতো তার ঘটনাবহুল বর্ণাঢ্য জীবন থেকে অনায়াসে। কারণ ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর রুচি হেলেনদের পরিবারের মধ্যে কারো ছিলো না।
দু’দিন পর আবার এলো মেয়েটি। আরিফের ঘরে ঢুকে ডা. মাহবুব সোজা এগিয়ে গেলেন মেয়েটির কাছে। গভীর উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কৌতূহলে প্রশ্ন রাখলেন সরাসরিÑ‘তোমার নাম কী?’
‘মাহবুবা’ বলেই যেন ধনুর্বাণ চোখে তাকালো মাহবুবা।
হৃদপিণ্ডে
তীক্ষ্ণ বাণের মতো বোধ করলেন ডা. মাহবুব মেয়েটির উত্তরে। তারপর আর একটি কথাও বলতে তার সাহসে কুলালো না। সবকিছু এমন ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে ভাবতেই পারেননি।
হেলেন! হ্যাঁ সেই নাক, মুখ, গায়ের রং এমনকি কণ্ঠস্বরও! দু’চোখে ভরে আছে কাউকে পরোয়া না করার তেজ! শুধু কপালে বাড়তি আর বিশটি বছরের চিহ্ন নেই বলেই বিশটি বছর পরে এসে বিশ্বাস করতে হচ্ছে ও মাহবুবা! হেলেনের দ্বিতীয় কপি। আর সেই সব উপচে ঝিলিক মারছে দর্পণে দেখা তার নিজের ছায়াও! সবগুলো দেয়াল যেন গুটিয়ে আনছে ডা. মাহবুবের বিস্তৃত পৃথিবী।
আবার যেদিন মাহবুবার আরিফকে পড়াতে আসার কথা ছিলো, তার পরের দিনও সে এলো না দেখে রুবিনা ফোন করলো। শোয়েব আহমেদ ধরলেন, রুবিনার কণ্ঠ শুনে বললেন, আমিই আপনাকে ফোন করতাম, মাহবুবার কাছ থেকে নাম্বার রেখেছি। সিদ্ধান্তটি হঠাৎই নিতে হলো। ও হোস্টেলেই থাকবে। এখন ওর মাকে দেখতে মানিকগঞ্জে পাঠিয়েছি, ক’দিন পরেই তো ক্লাস শুরু হবে!
- ও নিজে আমাকে একটু বলে যেত পারতো। অভিমান ঝরলো রুবনার কণ্ঠে।
- সত্যি বলতে কী, ও আপনাদের খুব পছন্দ করে। গতরাতে তো ও ওর ছাত্রের বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলো... তিনি নাকি দেশে এসেছেন, এতদিন আমেরিকায় ছিলেন এবং তিনি নাকি আমার ব্যাচের। মনে হচ্ছে সত্যিই পৃথিবীটা সত্যিই খুব ছোট...।
ওপাশের সংলাপগুলো স্ত্রীর মুখে রিপিট হতে শুনে অস্থিরতা বেড়ে যায় ডা. মাহবুবের। অন্যমনস্ক ভাবে পায়চারী করেন তিনি সমস্ত বাড়ি জুড়ে। এক সময় নিজের ছায়াটিও তার কাছে অসহ্য হয়ে ঠেকে। ডাইনিং টেবিলে রাখা জগভর্তি পানি শেষ হয়ে গেলো মধ্যরাতের আগেই।
শূন্য জগটির দিকে তাকিয়ে আবার কণ্ঠ শুকিয়ে আসে ডা. মাহবুবের। তিনি উদ্বেগের সঙ্গে আবার ঘুমের ঔষধের বাক্সটির দিকে হাত না বাড়িয়ে পারলেন না।