লাবণ্যরিক্ত
অবিরত বেজে চলেছে
গোলাপের সুরভিত নহবত।
রাত্রির কালো কোরাসে
মিশে গিয়ে দেখি
আজকের কাননে
আঁধার মূলত সমুজ্জ্বল।
আর ঘুমন্ত স্নায়ুর ভেতর
জাগ্রত রক্তমিনার;
আরো রক্তাভ হবে বলে
দশদিগন্তের হাট ঘুরে কিনছে
খয়েরি-সবুজ-রুপালি রোদন।
নিঃসুর ভোরের কাছে
রেখে গেলাম
আমার এই নিশিচ্যুত মীড়;
নতুন সুরকুসুম ফুটল বনে।
শাশ্বতী, সাম্প্রতিক
পৃথিবীর প্রতিটি বিগ্রহে
নৃশংস বোধনের সুর।
লাজুক চাঁদের চোখেও
সোনালি মর্গের স্বপ্ন।
কালের রাজা বৃদ্ধ ছত্রাক বলে
‘অপেক্ষায় থাকো,
মৃত্যু নামছে মুষলধারে
রেহাই নেই বৃষ্টিরও।’
কুহুবন
তোমার শীতপ্রাসাদ থেকে ছিটকে পড়লাম
এই কুঁড়েঘরে;
ডাকনাম ফাল্গুন তার, ভালো নাম চৈত্র।
পাতাঝরার কাকলিসব গোর দিয়ে
ফিরে ফিরে আসি তোমার দিকে;
নতুন পত্রালির খোঁজে;
দেখি নৃত্য মৃত, নাচের রশ্মি শুধু ঝুলে আছে
রক্ততরুর শাখায় প্রশাখায়।
অর্থাৎ বসন্ত মানেই নয় নিরঙ্কুশ সবুজ
হরিতের শিরার সমতালে বয়ে চলে
লাল মোহরের নদী,
আমি সে রঞ্জিত জলধারায় ছেড়ে দিলাম জয়যান।
কোকিল, রাত্রিভোর অগ্নিপাতে
তোমার পুড়ে যাওয়া কুহু নির্মাণ করেছে
আমার সে অনিন্দ্যযানের প্রতিটি চাকা।
রক্তরাগ
উড়ে গেছে ময়ূরী
এখন আমার কেকাদগ্ধ দিনরাত।
পোড়া প্রহরের স্তূপে
এত তারাপাহাড়ের সিঁড়ি বুনে গেল কে !
নিরুত্তর চন্দ্রিমার শেষ মাথায়
অবচেতন-গোরস্তানের প্রস্ফুটন শুধু
আর দিকে দিকে নূতন নূতন মৃত্যুর কেতন।
সেই থেকে ময়ূরী মানে একপ্রকার নিঠুর রাগিণী।
চিত্ররূপ
সবুজ শস্যের চাষি হয়েও
জীবনভর এড়ানো যায় নি
নীলনদ।
তার টলটলে জলে
আমার সোনার তরী
ভাসাতে গিয়ে দেখি
প্রাকপুরাকাল থেকে
দুধ-ধবল স্বপ্নের তটে
ঝিকমিক করছো তুমি;
কালরাত্রিশিখা।
সান্ধ্য
তোমাকে ছেড়ে যাই
শেয়ালসিন্ধুর তটে।
মরণের রূপ লাগি
আঁখি যেথা ঝুরঝুর।
ফিরে আসি।
ইতিহাসের পোড়োবাড়ি থেকে
হঠাৎ জেগে ওঠে নবাব-নায়েব
ছুটে আসে হৈ হৈ আমার দিকে
লোভ দেখায় মৃত নাচমহলের।
মৃত্যুর বিপুল তোপে অতঃপর
আবার ঢুকে পড়ি মাতৃগর্ভে।
গিয়ে দেখি আসন্ন ভ্রƒণসব
কবরশোভিত।
এমন জন্ম আর মৃত্যুমাঝে
এক ত্রিশঙ্কুজাতক
বসে বসে ভাবে
বসন্ত তো সমাগত।
এত এত ঝরা ঋষভ
আমি কুড়াব কখন!
প্রবাহ
এই কানন ঋতুহারা।
হিম ও মেঘের বিদ্যুতে বিদ্যুতে
একাকার
তীর্থতোরণ, রসাতল কিংবা
কালো কালো নক্ষত্রের ঢেউ।
এমন দৃশ্যের নেপথ্যে
আমার খাতায় চলে
সমুদ্ররচনা।
রুপারং জলের সিঁড়িতে বসে
বীজ বুনি মনে মনে;
সোনাঝরা অগস্ত্যের...
নিঃসুর
খুনের তরঙ্গ তুলে
ভেতরে বয়ে গেল যে নদী
তার জলে
তোমার স্বপ্ন সব শ্বাস নেয়।
রাতদিন। দিনরাত।
জনম জনমের নিঠুর মঞ্জীর
পূর্ণিমার আকারে ঝরে পড়ে গেছে
দূর জলরেখায়।
মাটি না পেয়েও তাই
মরণফুলের জেগেছে বাগান।
মালঞ্চ এমন;
হাওয়ায় ছড়ানো তার সুবাসে
জীবন ও মৃত্যু
পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করে।
চিত্রকলা
ঘুমায় সে।
গহীন তার
নিদ্রাধারায়
আমার সব
তেলরং
জলরং
আর
মিশ্রমাধ্যম
ভেসে যায়।
মধুকোষ
গোধূলিসাঁতার শেষে
পক্ষিরাজ বসেছে এই
নিদ্রার ডালে।
দিগন্তভ্রমণের নিশান
পুঁতে যেন জাগাবে
ঘুমন্ত আমাকে।
জানে না সে
পাতালপুরীর পথে পথে
মৃত কত পক্ষিরাজের
সমাধিফুল থেকে
দস্যু আমি; লুট করে এনেছি
চিরনিদ্রার থোকা থোকা ভ্রƒণ।
অমলজীবন
চিঠি আসে
লালসবুজনীল
কত রং খামের।
সুধাময় একটি
চিঠির প্রতীক্ষায়
বুড়ো ডাকঘর আমি;
এখনও
ঘুমোইনি।
হিরণ্ময়
ফুটেছে থোকা থোকা
মরীচিকা ফুল।
সেই সোনালি ভ্রান্তির দিকে
তোমাকে অম্লান দেখে
ঝাঁপ দিলাম।
তিরিশ বসন্তের আবহমান দুঃস্বপ্ন
ফ্ল্যাশ করে বসেছি উপকূলে।
এই খরাজীবনে
একমাত্র মৃত্যুর স্বপ্নই আমাকে
দীপ্ত জোয়ারের স্বাদ দিয়ে গেল।
শিল্পী
কাকভোরে ঘুম ভেঙে যায় মার
সেই সকাল থেকে শুরু হয়
তার শিল্পকলার আয়োজন।
গনগনে উনুনের আঁচ সইতে সইতে
আর নাশতার টেবিল সাজানোর মধ্য দিয়ে
তিনি রচনা করেন অনুপম ভৈরবী।
দুপুরের দিকে এই গীত
আরো ঘন হয়
মধ্যাহ্নভোজের চকমকি বাহারে।
সূর্য ডুবতে না ডুবতেই
আবার তার ওপর ভর করে
রন্ধন-পূরবী।
রাতের খাবার শেষে
আমরা টের পাই
দিনভর মায়ের গেঁথে তোলা গানটার
সম্পূর্ণ সুর-তাল-লয়।
আজন্ম দেখছি
মায়ের এমন নিবেদিত সাধনা।
এখন আর কাউকে
তার চেয়ে বড় শিল্পী মনে হয় না।
তারায় পাওয়া
স্বপ্নের ভেতর কত জলাভূমি, দাহপথ।
বিজন স্বপনমহলে নিত্য আসা-যাওয়া
তবু পাইনি অগ্নি
পাইনি ভেলা
খিড়কি আর সিংহদরোজায় দিনরাত বাঁধা থাকে
শুধু এক রক্তরথ।
এই উড়ন্ত নাও দিগি¦দিক ঘুরেফিরে থামে যেখানে
তা তো নীলিমার রেশমি সমাধি।
সে সমাধির এককোণে ফুটে আছি ফুল;
বাস্তুচ্যুত, স্বপ্নহীন।
দূর সমুদ্রও ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না
আমার অপজন্মের ঢেউ।
বীতশোক
চন্দ্রগ্রস্ত তরু যত
তারামুকুল ভারানত।
ওরা সব
বিগত সকালের
রক্তভৈরবীর ঝুলমান স্মৃতি।
কত আশাবরী
উড়ে যায়, উড়ে আসে
হাওয়ায় হাওয়ায়।
করুণ আলোয়
হারিয়েছিলাম এত কাল।
এখন গোধূলিসমুজ্জ্বল;
ঐ দেখা যায় আমাকে।
কূজন
মেঘ ও রৌদ্রের গ্রন্থিমূলে বয়ে যায়
কত কবরদ্যোতনা।
সে হাওয়ার কূলেই তো
যাবতীয় কৃষ্ণ জাগরী,
স্বপ্নের দিগ¦লয়।
ইমনকল্যাণ এমন, বসন্তভৈরবী!
তবু রাত্রিদুপুরের রাগ
ঐ তো আমার
অনন্ত নিদ্রাবেদিতে।
কাননে কাননে জলকরবীর ঢেউ;
পুষ্পবহ্নি বেজে ওঠে
কারো সুবাসিত করতলে
বন্দরে ভিড়ল তবে
রক্তমুখী চাঁদনি।