মুক্তগদ্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
মুক্তগদ্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কবি মৃদুল দাশগুপ্তের সাথে একটি বিকেল: সূর্যসেনের দেশ থেকে মঙ্গলপাণ্ডের দেশে • জিললুর রহমান

কবি মৃদুল দাশগুপ্তের সাথে একটি বিকেল: সূর্যসেনের দেশ থেকে মঙ্গলপাণ্ডের দেশে • জিললুর রহমান


২২ জানুয়ারী ২০১৮। কোলকাতায় নেমেই ছুটলাম হাওড়া রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। হুড়াহুড়ি করে টিকেট কেটে বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়াতে হবে। তড়িঘড়ি করে পৌঁছে দেখি কবি মৃদুল দাশগুপ্ত এসে দাঁড়িয়ে আছেন। বলেছিলাম, ট্রেনের ব্যাপারগুলো আমার জটিল লাগে। তাই শ্রীরামপুরে নিয়ে যাবার জন্যে সশরীরে এসে হাজির। চেপে বসলাম লোকাল ট্রেনে। মুড়িভাজা আর গজা চিবাতে চিবাতে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কথার শুরুতেই বললাম পশ্চিমবঙ্গের এই দিকটা আমার দেখা হয়নি। তখন দক্ষ ঐতিহাসিকের মত মৃদুলদা বলে গেলেন কিভাবে ডেনিস কলোনীর এই অঞ্চলটি ভারতীয় ফেডারেশনে যোগ দেয়। জানতে পেলাম ফরাসি অধ্যুষিত চন্দন নগরে গণভোটে ৯% লোক ফরাসি নিয়ন্ত্রণ থেকে ভারতীয় ফেডারেশনে সংযুক্ত হবার বিপক্ষে ভোট দিলে, তারা বংশপরম্পরায় ফরাসি নাগরিক সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের মধ্যে একজন মৃদুলদা’র বন্ধুও আছেন। জানতে পেলাম, এখানকার ইন্দুবতী ভট্টাচার্য বুদ্ধদেব বসুর আগেই সরাসরি ফরাসি থেকে বোদলেয়র অনুবাদ করেছিলেন, যিনি পরে কংগ্রেসের সাংসদ হন। তিনি দেখতে ছিলেন অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মতো। পরে জেনেছি এই ইন্দুমতী ভট্টাচার্য প্রকৃত-অর্থে বিদুষী। উনি চন্দননগরের প্রবর্তক নারীমন্দির নামে এক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা ছিলেন। তিনি কেবল ফরাসি নয় , কিছুটা স্প্যানিশও জানতেন।

আলাপ চলতে চলতে লিলুয়া, বালি, উত্তরপাড়া, রিষড়া পার হয়ে শ্রীরামপুর থামলাম। শ্রীরামপুর শহরের বুক চিরে রেললাইন দূরে ছুটে চলে যায়। রেললাইনের একপাশে গঙ্গার তীরে প্রাচীন শহর, যার পুরনো বাড়িঘর সব ডেনিস গথিকে তৈরি। কিছু ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে, কিছু সংস্কার করা হয়েছে, আবার কিছু ভবনের পলেস্তারা খসে ভেতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু নিশ্চিত বুঝা যায়, এসব বাড়িঘর ব্রিটিশ গথিকের নয়। রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরলাম গঙ্গার উল্টো দিকের পাড়ে গড়ে ওঠা নতুন শহরের দিকে। এদিকের বাড়িগুলো গত ৬০-৭০ বছরে উঠেছে। রেলস্টেশনের খুব কাছেই মৃদুলদা’র বাড়ি। বৌদি দরজা খুলে দিলেন, চায়ের আয়োজন করলেন। তারপর বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে।

প্রথমেই গেলাম প্রাচীনতম ডেনিস চার্চের সামনে। এই গির্জার প্রধান ফটক, তার কড়িবরগা, এমনকি ঝুলন্ত বাতিও ডেনিশ। গির্জার সামনেই একটি ছোটমতন পার্ক। তাতে সাজিয়ে রাখা সাতটি কামান দেখিয়ে মৃদুলদা জানালেন কৈশোরে দেয়ালে বসে বসে তিনি দেখেছেন ডেনিস রাজকুমারী কামানগুলো রং করতে। সেই শিশু রাজকুমারী পরে ডেনমার্কের রাণী হয়েছিলেন। আরো জানা গেল, সিরাজউদ্দৌল্লা যখন ডেনিশদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তখন এই ক’টা কামান নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে পারা যাবে না বুঝে ডেনিশরা সিরাজকে সাহায্য করেননি। সিরাজ এতে বেশ মনক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। এর পরে এগিয়ে গেলাম আদালতভবনের দিকে। পরিত্যক্ত আদালতভবনের স্তম্ভের দিকে তাকালেই তার বুনন যে ব্রিটিশ আদলে নয়, তা পরিষ্কার বুঝা যায়। 

বলা হয়নি, ২২ জানুয়ারি ছিল সরস্বতী পূজা। এখানে এইদিনে ভ্যানেনটাইন দিবসের মতো তরুণ তরুণীরা ঘুরে বেড়ায়। মৃদুলদা’র বাড়িতে ঢুকার মুখেই একটি পূজামণ্ডপ দেখলাম। যে মেয়েটি মণ্ডপের রক্ষণাবেক্ষণ করছে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানলাম সে বাঙালি হয়ে যাওয়া অবাঙালি। আমার বিস্ময় দেখে, মৃদুলদা আবার খুলে ধরলেন ইতিহাসের ঝাঁপি। শ্রীরামপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার ওপারেই সিপাহীবিদ্রোহ খ্যাত ব্যারাকপুর। এখনো সেখানে সেনানিবাস আছে। সিপাহীবিদ্রোহের সময় অবাঙালি সৈনিকদের পরিবার পরিজন পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এখানে। পরে ব্রিটিশ সরকার তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে যখন জুটমিল স্থাপন করে তাদের কর্মসংস্থান করে তারা এখানেই থেকে যায়। ১৫০ বছরের সময়বিবর্তনে তারা ধীরে মিশে যায় বাংলার আচার সংস্কৃতির সাথে। তারা বাংলায় ভাবে, বাংলায় কথা বলে, এমনকি বাংলার পূজাপার্বণে মেতে ওঠে উৎসবে। তাই যতই বেলা গড়াচ্ছে তরুণীরা সেজেগুজে বেরিয়ে আসছে তরুণদের সাথে সরস্বতী পূজার আনন্দমুখরতায়। তাই কোলকাতা শহরের কেন্দ্রে মাড়োয়ারিদের হিন্দি বাৎচিতে যারা মনে করেন বাংলা ভাষা এখানে বিপন্ন তাদের জানিয়ে রাখতে পারি — যেমন করে মৃদুলদাও বলেন যে, উন্নত সাহিত্য সংস্কৃতির বাংলা কখনো হিন্দির কাছে বিপন্ন হতে পারে না। বরং যেসব অবাঙালি আগে বা পরে বাংলায় আশ্রয় নিয়েছে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যারা থাকছে তারা বাঙালি হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

তাই দেখছি সারাদিন কলেজ পেরুনো কী কলেজ পড়ুয়া তরুণ তরুণীরা জোড়া বেঁধে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের অধিকাংশই বাঙালি বনে যাওয়া অবাঙালি সিপাহীদের বংশধর। 

ঘুরতে ঘুরতে আদালত পাড়া থেকে গঙ্গার ধার দিয়ে আবার শহরের উপকণ্ঠে নিয়ে এলেন কবি। বাড়িতে সরস্বতী দিবস উপলক্ষে নিরামিষ আয়োজন থাকাতে আমাদের নিয়ে গেলেন চমৎকার এক রেস্টুরেন্টে। রেস্তোরাঁ মালিক কর্মচারী সকলেই কবিকে খুব ভালবাসেন। এলাকায় তাঁকে সবাই খুব সম্মান ও খাতির করেন, বুঝা যায়। বেশ উপাদেয় খাবার খেয়ে আমরা আবার এগিয়ে গেলাম গঙ্গার ধার ধরে। আগে ইউরোপের মতো করে গঙ্গার ধারে বাগান করা ছিল। এখনো ২০০ বছরের পুরনো ভাঙা রেলিংয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তবে সে ফুলের বাগান অযত্নে মরে আগাছায় ভরে আছে। 


এই শ্রীরামপুরকে বাঙালি ভুলতে পারে না। এখানেই ভারতবর্ষের প্রথম ছাপাখানার বিকাশ। একসময় বাংলাসহ ভারতের সব ভাষায় ছাপার জন্যে শ্রীরামপুরের উপর নির্ভর করতে হতো। কাঠ কেটে কেটে হরফ বানানো হতো। আমরা যারা লেটার প্রেসে কাজ করেছি, সীসার হরফ দেখেছি—তারা নিশ্চয় বুঝতে পারবেন কাঠ খোদাই করে “ক্ষ” কিংবা “জ্ঞ” জাতীয় যুক্ত বর্ণের ছাঁচ তৈরি করা কতোটা দুরূহ। আজকের কম্পিউটার প্রিন্ট যুগের তরুণেরা কখনোই বুঝবে না ছাপানোর কাজ সে-যুগে কতো বড় বিপ্লবাত্মক ব্যাপার ছিল। 


এসব কথা ভাবতে ভাবতে জুটমিলের চৌহদ্দি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম এক বিশাল সুপরিসর গাছপালায় ঘেরা বিদ্যায়তনের সামনে। দূর থেকে দেখে মনে হলো যেন দাঁড়িয়ে আছি ইউরোপের কোনো রাজভবনের সামনে। ভাবতে পারেন? আজ থেকে ২০০ বছর আগে ১৮১৮ সনে এই শ্রীরামপুর কলেজ স্থাপন হয়। আর এই কলেজের কারিগর স্বয়ং উইলিয়াম কেরি। এই কলেজ বাংলা তথা ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। সেসময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে কেবল স্নাতক ডিগ্রী দেওয়া হতো। আর এই শ্রীরামপুর কলেজ থেকে থিয়োলজিতে মাস্টার্স ডিগ্রী দেওয়া হতো সে যুগের ডেনমার্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে। এর প্রধান ফটকটি উপহার দিয়েছিলেন ডেনমার্কের রাজা। সেকালে পুরো ঢালাই লোহার তৈরি ফটকটি বানাতে খরচ পড়েছিল ১০০০০ টাকা। কলেজটির প্রাঙ্গণে যখন প্রবেশ করি দেখি নানারকম অচেনা বৃক্ষের ছায়ায় এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে। মৃদুলদা বললেন, কেরি ছিলেন একজন বোটানিস্ট, তারও উপরে এক অসাধারণ সংগ্রাহক। তিনি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসব গাছ সংগ্রহ করে এখানে লাগিয়েছিলেন। এখানে নাকি ইউরোপ আফ্রিকা মালয়েশিয়াসহ নানাদেশের গাছ রয়েছে। প্রথমদিকে এসব গাছের নাম ও বৈজ্ঞানিক নাম লাগানো থাকলেও এখন আর তার চিহ্ন দেখলাম না। আহা, আমাদের রোবেন থাকলে ধরে ধরে গাছগুলোর নাম হয়তো জেনে নিতে পারতাম। মৃদুলদা তো যুউলজির ছাত্র। মজার ব্যাপার হলো, সাহেবরা ‘শ্রীরামপুর’ উচ্চারণ পারতেন না। তাই শ্রীরামপুর ইংরেজিতে Serumpore হয়ে গেল।

শ্রীরামপুর কলেজের বৃক্ষশোভিত প্রান্তর ছেড়ে যখন আবার গঙ্গার ধার ধরে ফিরছিলাম তখন কিছুটা ঠাণ্ডা লাগছিল। সোয়েটার মাফলার এনেছিলাম

ঠিকই, তবে তা মৃদুলদা’র বাড়িতে রেখে এসেছি। দাদা টের পেয়ে নিজের গা থেকে জ্যাকেট খুলে পরতে দিতে চাইলেন। এতো আন্তরিক সে আহবান। তবে অবশ্য তাঁর ঠাণ্ডা লাগার সম্ভাবনা হেতু আমি জ্যাকেট নিলাম না। দাদা দেখালেন গঙ্গার ওইতীরে বৃক্ষাচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ব্যারাকপুর সেনানিবাস। মনে পড়ে, ১৮৫৭ সালে এখানেই দানা বেঁধেছিল সিপাহী বিদ্রোহ। আমরা এগিয়ে যেতে যেতে মনে পড়তে লাগল সেইসব কথা। মনে পড়ল মঙ্গল পাণ্ডে ও তার ফাঁসীর কাহিনী। কার্তুজে শুকর ও গরুর চর্বি ব্যবহারের অভিযোগ ইত্যাদি অনুষঙ্গ টেনে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল এই ব্যারাকপুরে অল্প সময়ের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ভারতে। মৃদুলদা’র কাছে জানলাম তাঁর শৈশবে ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁদের মাথার উপর দিয়ে বাড়ির উপর দিয়ে ছুটে যাওয়া গোলাগুলির রোমহর্ষক সব কাহিনী। তিনি নিজ চক্ষে দেখেছেন ভূপাতিত পাকিস্তানী বিমানের টুকরো যার গায়ে চাঁদতারা সুসজ্জিত। শুনতে শুনতে ফেরি পারাপারের টিকিট কেনা হয়ে গেল। আমাদের ফেরি যখন গঙ্গা অতিক্রম করছে তখন মৃদু বাতাস থাকলেও তেমন শীত অনুভব করলাম না। যেন মঙ্গল পাণ্ডে আর সিপাহী বিদ্রোহের উত্তাপ গায়ে এসে লাগছিল। যখন ব্যারাকপুরে ফেরি ভিড়েছে, ততক্ষণ সন্ধ্যা হয়েছে। অন্ধকারে যেন ভূতুরে আলোয় ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সেই বহু প্রতীক্ষিত স্তম্ভের দিকে। যাতে লেখা আছে মঙ্গল পাণ্ডের নাম। এখানেই ফাঁসীতে ঝুলানো হয়েছিল সেদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী মঙ্গল পাণ্ডেকে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ বাক্যরহিত হয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর সম্বিত ফিরতে দেখি দাদা ডাকছেন। সিপাহীবিদ্রোহের সূতিকাগারে পা পড়লো আজ সূর্যসেনের দেশের এক সন্তানের। এ আমার পরম অর্জন। ফাঁসীস্তম্ভের প্রতি নীরব স্যালুট জানিয়ে মৃদুপায়ে হেঁটে গেলাম লোকালয়ের দিকে। গাঢ় গভীর বৃক্ষছায়ায় বাড়িঘর গুলো নিরিবিলি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবগুলো সেনানিবাসের ঘর—হয়তো কোয়ার্টার বা বাসা, হয়তো অফিস ঘর। বাইরে থেকে বুঝার জো নেই। প্রধান সড়ক দিয়ে লোক চলাচলে কোনো বাধা নেই। কিছুদূর গিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

সেই মধ্যদুপুর থেকে আমার জন্যে শ্রীরামপুর থেকে হাওড়া হয়ে আবার শ্রীরামপুরে এসে সারা শহর চক্কর দিয়ে ব্যারাকপুর পর্যন্ত ঘুরে কিছুটা ক্লান্ত নিশ্চয় মৃদুলদা। কিন্তু তার কোনো প্রকাশ তার মুখভঙ্গিতে নেই। তবু জানতে পেলাম, চারবছর আগে তাঁর হৃৎপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয়েছে। তবে তিনি সেসব ভুলে গিয়ে ক্রমাগত ধূম্রসেবন করে চলেছেন। যুক্তি দিতে লাগলেন— ধূমপানে ক্যান্সার হবার প্রত্যক্ষপ্রমাণ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর অসুস্থ হবার যে কাহিনী শুনলাম তা যেন সরলা এরেন্দিরার শতবর্ষের নির্জনতার কোনো অতীন্দ্রিয় গল্প। একদিন তিনি হেঁটে চলেছেন কোথাও কোনো কাজে। হঠাৎ মনে হলো তিনি অনেক তারা দেখতে পেলেন চোখে। সেই তারা দেখতে দেখতে তিনি হেঁটে চলেন সামনের দিকে। তাঁর মনে হতে লাগলো তিনি কোনো ঘন গাঢ় তরলের মধ্যে নেমে যাচ্ছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে গভীর ঘন তরলে যেন ডুবে যান। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একসময় তিনি কোনো সিঁড়ির ধাপ ভেঙে উঠে এলেন উপরে। তখন তাঁর মাথা টলছে, লোকজন চারদিকে জড়ো হয়ে তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন। সবাই জানতে চাইল আপনি এভাবে হেঁটে হেঁটে নর্দমার ভেতরে ঢুকে গেলেন কেন? তিনি জানালেন যে তিনি কোনো মদ্যপান করেননি। তাঁর কেমন যেন মাথাটা ঘুরে উঠেছিল। এরপরে লোকজন তাঁকে একটি বাড়িতে নিয়ে স্নান করিয়ে তারপর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। 
এই কাহিনী শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম ফেরিঘাটে। মৃদুলদা’র হাতে সিগারেট। টিকেট চেকার সিগারেট ফেলে দিতে বললেন। ভাবছি, কতো কতো ফেরিঘাটেই না ঘুরলাম। সব জায়গায় দেখেছি এসব অঞ্চলে লোকজন প্রচুর ধূমপান করে। কিন্তু যুগ পাল্টাচ্ছে। মৃদুলদা মৃদু হেসে ফেলে দিলেন ধূম্রশলাকা। তারপর আবার ভেসে যাওয়া গঙ্গার বুকে। ফিরে আসি শ্রীরামপুর—যেন চিরচেনা পথঘাট। কেবল বর্তমান নয়, এ শহরের রাস্তাঘাট বাড়িঘরের সাথে জ্যান্ত হয়ে ওঠে শতবর্ষের ইতিহাস।

ফিরে আসি মৃদুলদা’র ঘরে। চা খেয়ে যখন বৌদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেলস্টেশনের দিকে এগুলাম, কেমন বিষণ্ণতা ভিড় করে আসে মনে। মৃদুলদা’র সাথে গল্প করতে করতেই ট্রেন এসে গেল। তাড়াহুড়া করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। ভিড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার পেছনে। আমি আর মৃদুলদা’র কাছে সৌজন্যের বিদায় নিতে পারলাম না; পারলাম না একবার হাতটিতে হাত মেলাবার। হলো না বিদায়ের আলিঙ্গন। 



জিললুর রহমান
জন্ম ১৬ নভেম্বর, ১৯৬৬; চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, উত্তর আধুনিক নন্দনতত্ত্ব চিন্তক জিললুর রহমান। আশির দশকের শেষার্ধ থেকে লেখালেখি করেন। পেশায় চিকিৎসাবিজ্ঞানী। শিক্ষা : এমবিবিএস, এমফিল (প্যাথলজি), পিএইচডি। পেশা : সহযোগী অধ্যাপক, প্যাথলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। প্রকাশিত বই : অন্যমন্ত্র [কাবিতা, লিরিক, ১৯৯৫] শাদা অন্ধকার [কবিতা, লিরিক, ২০১০], ডায়োজিনিসের হারিকেন [কবিতা, ভিন্নচোখ ২০১৮], আত্মজার প্রতি [দীর্ঘকবিতা, বাঙময় ২০১৭], শতখণ্ড [দীর্ঘকবিতা, বাঙময় ২০১৭], উত্তর আধুনিকতা : এ সবুজ করুণ ডাঙায় [প্রবন্ধ, লিরিক, ২০০১, পরিবর্ধিত ২য় সংস্করণ খড়িমাটি ২০১৯], অমৃত কথা [প্রবন্ধ, লিরিক, ২০১০], আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব : কয়েকটি অনুবাদ [অনুবাদ, লিরিক, ২০১০], নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ [অনুবাদ, বাতিঘর ২০১৮], এমিলি ডিকিনসনের কবিতা [অনুবাদ, চৈতন্য ২০১৮]।
সম্পাদনা : তরঙ্গ (১৯৯০, ১৯৯১) ‘লিরিক’ বুলেটিন (১৯৯৫), যদিও উত্তরমেঘ (২০১৭)। 
সম্পাদনা পরিষদ সদস্য— ‘লিরিক’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা ‘লিরিক’ উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যা ১,২,৩,৪। ই-মেইল : drzillur@gmail.com
বাংলার পয়লা বৈশাখ: বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখ | শামীম আহমেদ

বাংলার পয়লা বৈশাখ: বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখ | শামীম আহমেদ


পয়লা বৈশাখ করা যাবে কি যাবে না, এই বিতর্ক আজ থেকে দশ বছর আগেও আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নাই। আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নাই মানে যে বিতর্ক ছিল না, তা কিন্তু না। আমার কান কুম্ভকর্ণের কান। দশ বছর আগেও ছুটির দিন আমি বিকেল পর্যন্ত ঘুমাইতাম। আমার বিয়ের আগে আমি হাতে গুণে ২-৩ বার পয়লা বৈশাখ উদযাপনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেছি, এবং প্রতিবারই দিনশেষে প্রেমিকার সাথে আমার সপ্তাহব্যাপী ঝগড়া শুরু হইছে।

কারণ কী? কারণ আমার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না। 

কারণ কী? কারণ আমার রোদের মধ্যে ঘর থেকে বের হইতে ইচ্ছা করে না। 
কারণ কী? আমার ভিড় ভালো লাগে না। 
কারণ কী? কারণ আমার ধুলা ভালো লাগে না।

নানা কারণে আমি পয়লা বৈশাখ উদযাপনে খুব বেশী আগ্রহী কখনই ছিলাম না। দুই-তিনবার যে প্রেমিকার সাথে গেছি, তার একটা বড় সময় সেগুনবাগিচার মোড়ে হুট তুলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হইছে। মাথা থেকে দর দর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে। আর যেহেতু রোদ থেকে বাঁচার জন্য হুড তোলা, সুতরাং আশেপাশের সবাই নাটক দেখার জন্য হুডের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে, তখন মেজাজ আরও চড়া হচ্ছে! এই চরম চড়া মেজাজ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে দেখা গেল মঙ্গল শোভাযাত্রাও অর্ধেক সমাপ্ত, আর মঙ্গল শোভাযাত্রা মিস করে প্রেমিকারও মন খারাপ। তো এই মন খারাপ আর মেজাজ খারাপের মিথষ্ক্রিয়ায় পরের সাত দিন ঝগড়া-বিবাদ। 
যাই হোক যে বছরগুলোয় ঘর থেকে সকাল সকাল বের হতাম না, সেই বছরগুলো আমার পয়লা বৈশাখ উদযাপন দারুণ হতো। আব্বা-আম্মা রাতের বেলায় পান্তা ভাতের এন্তেজাম করে রাখতেন। সাথে সরষে-ইলিশ, ভাজি-ভর্তা, নানা খাবার-দাবার। পয়লা বৈশাখের দিন সকাল সকাল অর্থাৎ ১০টার দিকে ঘুম থেকে উঠে প্রিয় হাফপ্যান্টটা পরে, ঘরে এসি ছেড়ে দিয়ে আরাম করে পান্তা ইলিশ খেতে খেতে আমি টিভিতে পয়লা বৈশাখের গান শুনতাম, কনসার্ট দেখতাম আর দেখতাম বর্ণিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। সাথে পত্রিকায় নানা বৈশাখী আয়োজন, টিভিগুলোতে আজগুবি আলোচনা অনুষ্ঠান, কোন কোন চ্যানেলে নিকটবর্তী গ্রাম থেকে সরাসরি বাংলা ঢঙের পয়লা বৈশাখ পালন আমার মনকে উৎফুল্ল করত। বিকেলে সূর্য ঢলে আসলে বন্ধুবান্ধবদের সাথে পাঞ্জাবি পরে ধানমন্ডির দিকে আড্ডা – এই হচ্ছে আমার পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সুখস্মৃতি।

বিয়ের পর ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। আগে তো প্রেমিকার সাথে ঝগড়া হলে সে তার বাড়িতে থাকত, আমি আমার বাড়িতে থাকতাম। রাগ-ক্ষোভ এড়ায় যাওয়া যেত, কিন্তু এখন তো বসবাস একই ঘরে, তার উপর আবার নয়া আবু সাথে। ঝামেলা করার উপায় নাই। রাত সাড়ে ৩টায় ঘুমাতে যেয়ে আবার ভোর সাড়ে ৫টায় ঘুম থেকে উঠে গোসল করে ম্যাচিং পাঞ্জাবি পড়ে রেডি হতাম। বিয়ের পর প্রথম যে পয়লা বৈশাখ উদযাপন, তখনও আমার কোন গাড়ি নাই। রিকশায় করে শ্বশুরবাড়ি মগবাজার। সেখানে বউ-শ্যালিকা আগের থেকে রেডি। অহনাকে শ্বাশুড়ির জিম্মায় রেখে আমরা গেলাম রমনা বটমূলে। টুকটাক গান শুনে, এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে আমার প্রথম পরিপূর্ণ পয়লা বৈশাখ উদযাপন। সত্য বলতে কী; রোদ, ভিড়, ঘাম সব উপেক্ষা করেও সেই পয়লা বৈশাখের উদযাপনটাই এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় পয়লা বৈশাখ। বলছিলাম ২০০৮ সালের কথা।

তারপর যতদিন দেশে থেকেছি প্রতিবারই পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি। রমনা বটমূলে যাওয়া হয় নাই সত্য, কারণ এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করত না, কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা কখনই মিস করি নাই বলতে গেলে। টরোন্টো আসার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ তেও তুমুল বৈশাখ উদযাপন করেছি। প্রথম দিকে এই উদযাপন করতাম বউয়ের খুশীর জন্য, পরবর্তী মেয়ের বাংলা সংস্কৃতির সাথে মেলবন্ধনটা ধরে রাখার জন্য। 
ওই যে বলছিলাম ২০০৭ সালেও পয়লা বৈশাখ নিয়ে তেমন বিতর্কের কথা শুনি নাই। কিন্তু পরবর্তী দশ বছরে ক্রমাগত এ বিষয়ে বিতর্ক বাড়তে দেখেছি। এটি ইসলাম ধর্ম বিরুদ্ধ, বাংলা সংস্কৃতি বিরুদ্ধ এই কথা শুনেছি, নানা যুক্তিও শুনেছি। এই বিষয়ে আমি নিজে একটা আলাদা অবস্থান অনুসরণ করি। যারা বলেন পয়লা বৈশাখ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, তাদের অনেকের কাছেই এই বিষয়ে শক্তিশালী যুক্তি আছে। আবার যারা বলেন এটা বাঙালি সংস্কৃতি না তাদের কাছেও অনেক শক্তিশালী যুক্তি আছে। যখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন নিজের মতের সাথে না মিললেই ব্যাপক চেঁচামেচি করতাম, পারলে হাতাহাতি করতাম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানটাকে বেছে নিয়েছি। অর্থাৎ আমার মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে আমি কারও সাথে সরাসরি confrontation-এ যাই না। আচার-আচরণে বুঝিয়ে দিই, তোমার রাস্তা তোমার, আমার রাস্তা আমার। জীবনের দীর্ঘ পথ হেঁটে বুঝেছি পরিণত মানুষের বিশ্বাসকে পরিবর্তন করা খুব কষ্টকর, তাই সেই চেষ্টা করি না। যার যার বিশ্বাস নিয়ে ততক্ষণ থাকতে দিই, যতক্ষন না সে তার বিশ্বাস বাস্তবায়নের জন্য অন্যের বিশ্বাসকে আক্রান্ত করে। 

আমার বাসায় আমার বাবা, মা, বউ তিনজনই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। আমার আব্বা হজ্ব করে এসে পরেরদিনই টিভিতে শ্রীদেবীর নাচ দেখার সময় আমার মার ঝাড়ির মুখে বললেন, ‘আমার অন্তর পরিস্কার, কোন পাপ নাই। নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি, হজ করেছি, ঘুষ খাই নাই, শ্রীদেবীর নাচ দেখলে কোন সমস্যা নাই।‘ আমার বউ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, কোরআন পড়ে কিন্তু পয়লা বৈশাখে শাড়ি পরে ঘুরতে যায়। আমার আম্মা নামাজ-কলমা সবকিছু নিয়মিত করেন কিন্তু তার মতো আধুনিক চিন্তার মানুষ কমই আছে। তাদের কাউকেই পয়লা বৈশাখ বেদাত কিংবা হারাম এমন কথা বলতে শুনি নাই। আর আমি নিজে মানুষটা সবকিছুর পেছনে যুক্তি দেখতে চাই। ধর্ম আমার কাছে পুরাটাই বিশ্বাস আর রাজনীতির মিশেল মনে হয়, তাই আমি ধার্মিক মানুষদের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করি। তারা পয়লা বৈশাখ উদযাপন না করলে সেটাতে আমি বাগড়া দিই না।

আমার কাছে পয়লা বৈশাখ বাঙালির একতাবদ্ধ হবার সবচেয়ে বড় জায়গা। এটি বিদেশী সংস্কৃতি কিনা, সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই। বিশ্বাস করেন এই বিষয়ে আমার বিস্তর পড়ালেখা আছে। পয়লা বৈশাখের উৎপত্তি, ব্যপ্তি, ইতিহাস নিয়ে আমি আপনার সাথে ঘন্টাব্যাপী আলাপ করতে পারব, এবং আলাপ শেষে খুব সম্ভবত আপনি আমার কথা শুনে মুগ্ধও হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু আমি এই কাজটা করব না। আমার অবস্থান সহজ। আপনি যদি এটি পালন না করতে চান, করবেন না। আর যদি উদযাপন করতে চান করবেন। দেখেন, ইংরেজি নববর্ষ, ইদের আগে পরে যেই ধরণের আনন্দ উৎসব, ইদে মিলাদুন্নবী, শবে-বরাতে যে বাহুল্য উদযাপন, তাও আমাদের সংস্কৃতি না, ইসলামের রীতি না। ইউরোপিয়ান ফুটবল, বিয়ের আগে পরে চৌদ্দ রকমের অনুষ্ঠান, বেবি শাওয়ার, বইমেলা, বানিজ্যমেলা, রাতব্যাপী ওয়াজ মাহফিল, মসজিদের সামনে দিয়ে নারীর চলাচল নিষেধ, এইগুলাও বাংলা সংস্কৃতি না, ইসলামী রীতি না। ফুটবল খেলা, ক্রিকেট খেলা, ফেইসবুকে প্রোফাইল খোলা, ইসলামী টিভি, পিস টিভিতে চেহারা মোবারক দেখায়ে মানুষকে আনন্দ, উৎসব, সহিংসতায় উদবুদ্ধ করাও বাংলা সংস্কৃতি না, ইসলামী রীতি না। 

আমাদের বেশীরভাগ আনন্দ-উদযাপন, রীতি-নীতি, রঙ-ঢঙ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবসের সাথে সাথে জন্ম নেয় নাই। বহু বছরের ধারাবাহিকতায় এগুলো আমাদের জীবনে এসেছে। পয়লা বৈশাখ উদযাপনও তেমনই একটা ব্যাপার, উৎসব। তারপরও বাঙালির জীবনে এই উৎসবটাকেই আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিই কারণ এটিই আমাদের, বাংলাদেশীদের, বাঙালিদের একমাত্র সার্বজনীন উৎসব। আর কোন উৎসবে সব বাঙালি একসাথে অংশগ্রহণ করতে পারে না। আনন্দ করতে পারে না। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর আর কোন ঘটনা আমাদের এতটা ঐক্যবদ্ধ করে না, যতটা করে বাংলা নববর্ষের আয়োজন। 

গতকাল দেশে আব্বা-আম্মার সাথে ফোনে কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের পয়লা বৈশাখের এবছরের প্ল্যান কী? আম্মা কিছুটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, “তোমরা নাই বাবা, আমাদের আর কী প্ল্যান? প্রতিবছর তোমরা সেজেগুজে ঘুরতে যাইতা, রান্না-বান্না করতাম, কত আনন্দ হইতো।” এই যে সাজ সাজ রব, উৎসব, আতিথেয়তা এইটাই আমাদের পয়লা বৈশাখ। এর পেছনে কী ধর্ম আছে, কী ইতিহাস আছে, ইলিশ মাছ খাবেন না মুরগী ভাজা খাবেন, তাতে তেমন কিছু আসে যায় না।

এই যে একটা দিন হৈ হৈ করে সব বাঙালি একসাথে আনন্দে মেতে উঠবে, বাচ্চারা নিজের জাতীয়তাবোধের নির্যাসটুকু বাতাসে ঘ্রাণের মধ্যে নিয়ে বুকে টেনে নেবে, অতটুকুই তো চাই। এই যে তের হাজার কিলোমিটার দূর থেকে চোখ বন্ধ করলেও মনে হবে আমার দেশটা ছেঁয়ে গেছে লাল-সাদার অপূর্ব রূপ-লাবণ্যে – ওইটুকুই পয়লা বৈশাখ, ওইটুকুই আমার বাংলাদেশ। 

এই উদযাপন, এই বাংলাদেশ আমার অন্তর থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। 



শামীম আহমেদ: বাংলাদেশী লেখক। ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোতে পিএইচডি করছেন জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়ন অর্থনীত নিয়ে। কানাডা সরকারের ডক্টরেট স্কলারশীপে গবেষণা করছেন। ৪টি প্রকাশিত কবিতার বই প্রকাশ করেছেন যেগুলো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। একাধিক সংকলিত বইয়ের সম্পাদনা করেছেন। ২০২০ বইমেলায় আসছে চারটি বইঃ কোথাও একটা লুকোনো বিষাদ আছে (উপন্যাস), দূরত্ববিভ্রান্তিতে আছি (উপন্যাস), অদ্ভুত ইঙ্গিত আসে ঈশ্বর থেকে (গল্প), তোমাকে ছুঁয়েছি তাই বিষণ্ণ হলাম (কবিতা)।
নস্টালজিয়া আর শহর ।  ফারহান হাবীব

নস্টালজিয়া আর শহর । ফারহান হাবীব

অলংকরণ: নবী হোসেন
ফুটপাতে বসে সেদিন শুক্রবারের বিকেলকে দেখতে চাইলাম। অনেকদিন দেখিনা ছুটির দিনের ঢাকা কেমন হয়। চাকরির কারণে। এই না দেখার বেদনা আমাকে অনেকটা কাবু করে দেয়। আগের রাতের নাইট শিফটের ডিউটি শেষে সকালে বাসায় ফিরে খুব একটা ঘুম হয়নি। ঘুম ভেঙে শরীর আর চলছে না বুঝতে পারলাম। জানলা দিয়ে দেখলাম দুপুর। তবে রোদের সে তেজ নেই। ভাগিনাটা অসুস্থ, নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। তাকেও দেখতে মন চাইলো। তখন আরো অফিস যেতে ইচ্ছে করলো না। অফিসে জানিয়ে দিলাম। বাচ্চাটাকে দেখে এসে বসে রইলাম শহরের একটা মূল সড়কের পাশের গলিতে। বিকেল তখন শুরু। মনে হলো আজই ঠিকঠাক ভাবে বিকেলটা দেখে নিতে হবে। শুক্রবার। মানুষ বের হচ্ছে নানা কাজে। কিন্তু কম। অধিকাংশই সেজেটেজে বেড়াতে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেলো শৈশবের কথা। শৈশব খুবই চমৎকার।  কিন্তু এই সময়ে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। মনে পড়লেই যেনো ভেঙে যাই। এইতো বেশিদিন আগের কথা না, বছর তিনেক আগেও শুক্রবার হলে বেরিয়ে পড়তাম। খুব বেশি দূর যেতাম না। ধানমন্ডি অথবা টিএসসি। বিকেল থেকে সন্ধ্যা শেষে রাত পর্যন্ত আড্ডা। কিছু একটা করতে চাওয়ার আলাপ সবার সাথে। আবার অহেতুক প্রলাপ। আবার কিছু একটা করতে চাওয়ার আলাপ। এভাবে কতোগুলো বছর গেলো। তারও আগে ফিরে গেলে দেখতে পাই শিশুপার্ক, নানার বাসাসহ আরো কতো কিছু। কিন্তু এখন জোর করে সে আনন্দ ফিরিয়ে আনতে চাই। এমন বিকেলে ফোন দিয়ে বলতাম বন্ধু কোথায়। ওপাশ থেকে বন্ধুর জানানো আসছি। আর এখন এমনও হয়, ফোন করেও পাওয়া যায় না। আমাকেও তারা পায় না। পুরনো দিন ফিরে পাওয়া যাবে না যেনেও আগের স্মৃতি নিয়েই এমন ছুটির দিনে রাস্তায় রাস্তায় তাই ঘুরে বেড়ানো।

স্মৃতি কাতরতা একটা রোগ। আমার তেমনই মনে হয়। কিন্তু আগে কী খুব ভালো ছিলো সময়গুলো? হয়তো ছিলো। কিন্তু এখন কী নেই? হয়তো নেই। এখন যারা আমার ঠিক সে বয়সের, তারা হয়তো তাদের সময়টা বেশ আনন্দের সঙ্গেই কাটাচ্ছে। যে যে যার যার মতো করে সময়কে উপভোগ করে। এটাই নিয়ম। কিন্তু আসলেই কী তাই? আমাদের শৈশবে অবশিষ্ট যে ক’টি মাঠ ছিলো, সে মাঠে দেখতাম সবাই খেলতো। আমি খেলতাম না। বাসা থেকে বের হওয়া বারণ ছিলো। তাই বারান্দার গ্রিল ধরে দেখতাম পাড়ার ছেলেদের ক্রিকেট ফুটবল খেলা। আমার মতো এমন অনেকেই এভাবে গ্রিলে ঝুলে খেলা দেখতো। তারপর আর গ্রিলে ঝুলে খেলা দেখাও বন্ধ হলো। গ্রিল থেকে আধা হাত দূরত্বে নতুন বাড়ির দেয়াল উঠলো, খেলাও বন্ধ হলো। তবে গ্রিল ধরে খেলা দেখার যে প্রচলন তা এখনো শেষ হয়নি মনে হয়। মাঠ না থাকুক। যেসব শিশুর বাসার বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায় তারা মাঠের খেলা না দেখলেও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখতে থাকে। আচ্ছা এটাও তো অনেক পুরনো। এখন বারান্দাতেও খুব একটা বাচ্চাদের দেখা যায় না। ট্যাব আর মোবাইলে সবাই বুদ হয়ে আছে। তাই এ কথা সত্য- যে যে যার যার মতো করে তার সময়টাকে উপভোগ করছে।

সময়ের এই উপভোগ করাকে আমরা কিভাবে দেখবো? আমি অনেক দিন পর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে গেলাম। দেখলাম ক্যাম্পাস নামক বাড়িগুলোর সামনে যে জটলা থাকতো তাও এখন আর নাই। চায়ের দোকানে জানতে চাইলাম, গানটান হয় এখন? আড্ডা? উত্তরে কেমন একটা নিরামিষ স্বাদ পেলাম। জানালেন হয়। তবে। এই তবেতে বুঝে নিয়েছি। আবার সময় যে বেশি পার হয়েছে তা না। তবে সবাই সবার মতো। এ অল্প সময়ে অনেক পরিবর্তন। সব কিছু দ্রুত পাল্টাচ্ছে। যে যে যার যার মতো করে সময়টাকে উপভোগ করছে। বই পড়া নিয়ে অনেক গুরুগম্ভীর কথা হয় এই শহরে। কে বেশি পড়লো কে কম। কিন্তু আমার এ তর্ক অনেক বাজে তর্ক মনে হয়েছে সব সময়। আমাদের শৈশবে আমরা আসলে তেমন বই পড়িনি। আমার জেনারেশনের অনেকেই পড়েনি। ফলে অধিকাংশের কথা বিচার করলে আমি বলবো, এ তর্ক বাজে তর্ক। লোক দেখানো তর্ক। উল্টো আমরা প্রচুর কোচিংয়ে গিয়েছি। শুধু কোচিং করেছি। পরে সমাজ বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষের সাথে পরিচয়ের কারণে বইয়ের সাথে পরিচয়। তাই বিচ্ছিন্নতার ধারাবাহিকতায় আমরা আরো বিচ্ছিন্ন হয়েছি। তবে শৈশবে একজন লেখকের বই আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হয় তার জন্য নাকি আমাদের পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। কিন্তু যেহেতু আমরা যে যে যার যার মতো করে সময়কে উপভোগ করছি, সেহেতু উপভোগ সে এক জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এখানে লেখকের ভুল না পাঠকের ভুল আমি জানি না। জানি না এই কারণে, যেখানে বলাই হচ্ছে শৈশবে সে লেখকের বই পড়লে পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় সেখানে এতোগুলো বছরে সে পড়ুয়া জাতির দেখা আমরা পেলাম না কেনো? পড়ুয়া জাতি উগ্র ধর্মান্ধ হয়?  বিকৃত রুচির হয়? সব কিছু থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে চায়? অন্যায় দেখে চুপ করে থাকে? দুর্নীতি করে? সব কিছুকে অরাজনৈতিক ভাবে ব্যাখ্যা করে? সে যাই হোক।

স্মৃতি কাতরতায় ভুগতে ভুগতে ভুগতে চলে গেলাম কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলায়। এমন শুক্রবার সকালে যেতাম পেইন্টিং শিখতে। কিন্তু পাশের বাসার ভাবির সন্তান পেইন্টিং শিখলে আমাকেও কেনো শিখতে হবে সে হিসেব আমি মেলাতে পারতাম না। হলো না তাই। এখন শিশুরা পেইন্টিং শেখে ঠিকই কিন্তু পরীক্ষার জন্য। এমনকি শিক্ষকরা এঁকে দেন তারপর শিক্ষার্থী নাম্বার পায়। মা বাবা বিষয়টি অনুমোদন করছে। যেখানে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মা বাবা অনুমোদন করেন, সেখানে পেইন্টিং তো উনাদের কাছে খুব ‘সাধারণ’ একটি বিষয়। তাহলে আমার শৈশব একটি বাজে শৈশব ছিলো ঠিকই, আবার বর্তমান শৈশবকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবো। এই সময়ের একটি শিশু আমার বয়সে এসে কী নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগবে? অথবা আমি এই সময়ে এসে যেভাবে বর্তমানকে আর কোনোভাবে মেনে নিতে না পেরে শৈশবের ঝাপসা কোনো সুখস্মৃতি খুঁজে বেড়াবো সে কী খুঁজবে? অথবা খুঁজলে তার সময়ে তার চারপাশ কী আরো বাজে রকম কিছুকে অনুমোদন দিবে? যেটাতে সে অসহায় বোধ করবে?


এই সময়ে আসলে সংকট কোথায়? উপরে অনেকটাই আলাপ করেছি। আরো করতে চাই। আমরা একটা নগরকে চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখেছি। এখন ফল ভোগ করছি। নগর ছেড়ে সে ক্ষত গ্রামে গেছে। পুরো দেশ ছেয়ে গেছে। একেকটি দিন যে কী দুর্বিষহ এটা যারা বোঝেন তারা কী ভাবেন? নিশ্চয়ই বারবার পালাতে চান। কিন্তু পালিয়ে কোথায় যাবেন? আপনি পালাতে গেলেও আপনাকে পালাতে দেবে না। কারণ আপনার পালানোর খবরও একটি ‘বিগ ইভেন্ট’। তাতে টিআরপি বেশি। বেচা বিক্রি অনেক। মানুষ বৃষ্টিতে ভেজে, জ্যামে বসে থাকে। অথবা বাহন না পেয়ে পায়ে হেঁটে মাইলকে মাইল চলে যাচ্ছে। আর এ খবর প্রচার হয় বিক্রির উদ্দেশ্যে। জনগণের জন্য যে খবর প্রচার করার সেটি প্রচার করতে হলে অনেক কিছুতেই হাত দিতে হয়। আর সেখানেই ব্যর্থ আমাদের সবগুলো প্রতিষ্ঠান। আপনি সব বাদ দিয়ে যদি শুধু এ শহর নিয়ে ভাবেন তখন আপনার অসহায় না লেগে উপায় নেই। আপনি ব্যাধিগ্রস্ত হবেন। এই অশান্তিকে এড়িয়ে যেতে আপনি শৈশবে ফিরে যাবেন। আপনার অতীতে ফিরে যাবেন। খুঁজবেন কোথায় লুকিয়ে আছে ভুলে যাওয়া কোনো সুখস্মৃতি। তখন তা খুঁজে বের করে আপনি বর্তমানের সাথে মেলাবেন আবার হতাশ হবেন। এভাবেই নস্টালজিয়া আপনার ব্যাধি হিসেবে শরীরে বসত গড়বে। আর কিছু দিন পর আপনি এই শহরে আকাশ দেখতেই পারবেন না। মৃত্যু ভয় নিয়ে চলতে হবে দ্বিতল সড়কের নিচ দিয়ে। আকাশ না দেখতে পেলে আপনার সন্তানের শৈশব শুধু কেটে যাবে ইটের সাথে সন্ধি করে। সেখানে মানবিক বোধ নিয়ে আনা খুব কঠিন। তখন হয়তো সে আমার মতোই চূড়ান্ত হিসেব কষবে- অতীত ছিলো বাজে, বর্তমান তারচেয়ে আর ভবিষ্যৎ আরো ভয়াবহ।


ক্ষতচিহ্নগুলোই কথা হয়ে ওঠে ।। নৈরিৎ ইমু

ক্ষতচিহ্নগুলোই কথা হয়ে ওঠে ।। নৈরিৎ ইমু



স্মার্ট লাইন থেকে আপনারা ছুড়ে ফেলছেন সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, থিরথির কাঁপতে থাকা পাতার দিকে তাকিয়ে মনে পড়বে বহুদিন আকাশ দেখেন নি। আকাশের ভেতর অনেক আকাশ জানে না রেনকোট কী। তবু এই বৃষ্টিনগরীতে নেকাব পরে হাসতে থাকুন। নো ম্যানার'স জোন থেকে আপনাদের দেখাতে পারি পর্দানশীন নারী। পকেটের চিরুনি সামলে রাখুন, চুলবুল পাণ্ডের মতো কলারের পেছনে ঝুলান সানগ্লাস। সন্দিগ্ধ চোখ হয়ে ওঠে রোমান্স সৈকত। আসুন, প্রাক্তন পুষ্পবিশারদের কাছে যাই। টগর ব্যবচ্ছেদ করে যিনি পেয়েছিলেন হিংসাপরায়ণ মুখ। সুতরাং আরও দাউদাউ জ্বলুক টগর-বাগান। প্রসঙ্গক্রমে কোন দমকল কর্মী প্রেমিক হতেই পারে। আমরা তাকে স্মরণ করতে পারিতিনিই পৃথিবীর প্রথম স্তৈন।

জেলাস একধরনের সংকট। জেলাসে আক্রান্ত মানুষ ভিন্ন ভিন্ন কমলার কোষের মতো, অথচ একই স্থানে সংযুক্ত। দর্শন বলতে যত্ন করে তুলে রাখা ঘাগরার কথা ভাবতে পারেন, পছন্দের রঙে। হঠাৎ কোন ল্যাভেন্ডার দেখলে, চীনাদের মতো প্রণাম ইচ্ছা জাগতেই পারে। প্রচণ্ড সুগন্ধিকে ভাবুন নিজ নিজ ধর্মের অতি-আবশ্যক উপাদান। দেখুন, ল্যাভেন্ডার গাছের ছায়ায় কতক মানুষের কমলা ছিলার দৃশ্য।

আপনাদের মানিব্যাগে রাখা সাদাকালো ছবিটি সহজেই হয়ে উঠতে পারে দুর্ধর্ষ ডাকিনী। যার জন্য কেটে ফেলা শিরা এখনো কাতরাচ্ছে তুমুল। অতিথি বন্ধুর প্রতি সর্বোত্তম শীতল হাসি, সে হাসির সময়কাল নির্ধারণ করবে ঘড়ির বদলে ব্যবহৃত বারোটা টিকটিকি। তারা জানে, নীরবতার চেয়ে বিরহী বাজনা ভালো।

আসুন, উড়িয়ে দিই বনভোজনের পাখি। নখের সাথে কেটে ফেলি আমাদের খামচিগুলোও। আদতে মুখনাট্যে তেমন কোন মুখের দেখা পাওয়া যায় না, যা শুধুই হৃৎ-সংকোচনের উপসর্গ মাত্র। পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে শুঁকতে পারেন পুরনো রুমালের গন্ধ, কেননা আগামীকাল গোমরামুখো মথের মতো।

হাতের তালুতে দেখুন, বৃত্তাকার ফুলের মতো রেখাগুলো কত অপূর্ব ফুটে আছে। সেইসব রেখাধরে কেউ মাতালের মতো হাঁটছে, যিনি মাতাল তিনিই আপনাদের টলমল ভাগ্য হয়ত। তাকে গান শুনান। বলুন, এভরিথিং ইস ফাইন। ক্ষুধা লাগলেও এখন গন্ধম খেতে কোন বাঁধা নাই। যদি'না মানুষ হুর গ্রহণেচ্ছায় মৃত্যুকে ভেবে বসছে প্রয়াত হাসি।

মন জিনিসটা মানি-প্ল্যান্টের লতার মতো এবং কী প্রচণ্ড সবুজ! আপনারা একটি সকাল এ নিয়ে বিস্তারিত চিন্তা করতে পারেন। কারণ এই সবুজপত্রে বসবাসরত পড়শিটিকে প্রশ্রয় দিতেই ভালোবাসেন। তার সাথেই ম্যানার'স জোনের উচ্চতম ব্রিজে পা-ঝুলিয়ে বসে কফি পানের ইচ্ছা আছে। খুব দুঃখিত, এন্টিসেপটিক নেই। এখানে বরং একটা সিঁড়িপথ ভাবা যাক, আলাদা আলাদা আপনি তার শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আছেন। আসলে আপনাদের হাতে বিস্ফোরিত ডালিম, যেটা সাক্ষ্য দিচ্ছে হৃৎপিণ্ডের অবস্থা। চোখ বন্ধ করুনফ্ল্যাশব্যাক যে উজ্জ্বল তরুণীটি হাসছে তাকে অবশ্যই চিনেন।


আপনাদের সাধের সাইকেল (সম্ভবত পনিক্স) এখন আর যাদুঘরেও রাখার কথা না। কারণ সেখান থেকেই বেয়ারিং খুলে কোন শিশু আর বানাচ্ছে না আনন্দ-ঠেলাগাড়ি। কোন দ্রুতগামী ট্রেনের শেষ কামরায় বসে আপনারা হয়ে উঠছেন গোল্ডফিস। পাঁচ মিনিট আগের স্মৃতিও মনে পড়ছে না। তবু কিপ ইন টাচ বলে একে-অপরের বিদায়। মাঝে মাঝে আত্মহত্যাকেও কবিতার মতো লাগে!
দেহ ও মনে প্রশান্তি দেয় গাঁজা! • সাইফুল বিন হানিফ

দেহ ও মনে প্রশান্তি দেয় গাঁজা! • সাইফুল বিন হানিফ

কি বন্ধুরা মন ভালো তো ? আশা করি সকলেই খুব ভালো আছেন। আজ গাঁজা নিয়ে ভালোচনা করে জেনে নিবো কি এর উপকারিতা। অনেকেই ভাববেন যে গাঁজার আবার কি ভালো গুণ আছে, ওটা তো একটা নেশার জিনিস আর খুব খারাপ জিনিস। আবার অনেকেই হয়তো হাসবেন আর বলবেন যে গাঁজার আবার ভালো জিনিস হয় নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বন্ধুরা একটা কথা বলবো যে বেশিরভাগ জিনিসেরই ভালো দিক আর মন্দ দিক আছে। কিন্তু আমরা সেটাকে জানার চেষ্টা করিনা বা জানিও না। হ্যাঁ বন্ধুরা একথা কিন্তু সত্যি যে গাঁজার মধ্যে আছে বেশ কিছু উপকারিতা যে আপনি জানলে চমকে যাবেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক নেশাগ্রস্থ জিনিস আছে যেটার মধ্যে আছে উপকারিতা। কিন্তু বন্ধুরা কোনো নেশার জিনিস যে বেশি বা রোজ একদম ভালো নয়, তাতে আপনার শরিরের ক্ষতি হতে পারে। আপনি যেই নেশার জিনিস গ্রহণ করবেন না কোনো একটু তার ব্যাপারে জেনে নিয়ে করা ভালো। পরিমাণ মত খাওয়া ভালো, মনে রাখবেন- অতিরিক্ত সব জিনিসই খারাপ। 
গাঁজা ( Cannabis) মূলত সপুষ্পক উদ্ভিদের গণ, যেখানে সাতিভা গাঁজা, ইন্ডিকা গাঁজা, এবং রুডের্লাসাইস গাঁজা। এই তিন’টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি অন্তভুর্ক্ত রয়েছে। এটি মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার স্থায়ীয় প্রজাতি। গাঁজা দীর্ঘকাল ধরে বীজ ও বীজতেল, ঔষধি উদ্দেশ্যে এবং একটি বিনোদনমূলক ড্রাক হিসেবে শণ আঁশের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 
আঁশের উত্পাদন বৃদ্ধি নির্বাচন করতে বাণিজ্যিক শণ পণ্যসমূহ গাঁজা গাছ থেকে তৈরি করা হয়। 
ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন দেশে এর বিস্তার। গাঁজা গাছের শীর্ষ পাতা, ডাল এবং ফুল যা এই উপমহাদেশে গাঁজা নামে পরিচিত একই জিনিস পশ্চিমা দেশ গুলোতে মারিজুয়ানা বা মারিহুয়ানা নামে পরিচিত। গাছের পাতা বা ডালের আঠালো কষ দিয়ে তৈরী এ অঞ্চলের চরস নামের জিনিসটিই পশ্চিমা দেশের হাশিশ। এছাড়াও ভাং, সিদ্ধি, পাট্টি, সব্জি, গ্রাস, মাজুন নানা নামে ডাকা হয়। 
অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও প্রচুর গাঁজা সেবনকারি আছে। যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিল ২০১৮ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এই আইনের ৯ ধারায় বলা আছে, অ্যালকোহল ব্যতীত অন্যান্য মাদকদ্রব্যের উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহার হয় এমন কোনো দ্রব্য বা উদ্ভিদের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন বা পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি করা যাবে না। আরও বলা হয়েছে এ জাতীয় মাদক সরবরাহ, বিপণন, কেনা-বেচা, হস্তান্তর, গ্রহণ-প্রেরণ, লেনদেন, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ ও প্রদর্শন করা যাবে না। সেবন অথবা ব্যবহারও করা যাবে না। 
আইনের ৯ ধারা লঙ্ঘনে কী ধরনের সাজার বিধান রয়েছে সে সম্পর্কে আইনের ৩৬ ধারায় বিশদ বলা হয়েছে। 
জাতীয় জনমত জরিপে ৭০% ক্যানাডিয়ানদের গাঁজাকে আইনসিদ্ধ করার পক্ষে দেখা যায় । ফলে ২০১১ সাল থেকে ক্যানাডা সরকার গাঁজার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ফলে এখন ক্যানাডায় গাঁজা বৈধ। যদিও গাঁজা সেবন করার ফলে ও গাঁজা আইনসিদ্ধ করার ফলে যেসব সমস্যা তৈরি হতে পারে, তা দূর করার লক্ষ্যে ক্যানাডার সরকার বড় ধরনের প্রচারাভিযান শুরু করেছে। 
আমরা এবার জেনে নিবো গাঁজা খেলে শরির ও মনে কেমন প্রভাব বিস্তার করে- 

১. গাঁজায় আছে টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনোল (টিএইচসি)। এটা মস্তিষ্কে এমন এক অংশে কাজ করে যে অংশটি সুখকর অনুভূতির সৃষ্টি করে। কাজেই পেটপুরে খাওয়া বা সেক্সের মতোই সুখ দেয় গাঁজা। 

২. গাঁজা সেবনের পর হৃদস্পন্দন প্রতি মিনিটে ২০-৫০টি বেড়ে যায়। এ অবস্থা ২০ মিনিট থেকে ৩ ঘণ্ট পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। 

৩. গাঁজায় আরো আছে ক্যানাবিডিওল (সিবিডি)। এটি থেরাপির কাজ করে। বিশেষ ধরনের ব্যথানাশক হিসাবে দারুণ কাজের এটি। শিশুকালে কারো মৃগীরোগ থাকলে উপকার মেলে। 

৪. বেশ কিছু ক্ষুদ্র গবেষণায় দেখা গেছে, বেশ কিছু অস্বাস্থ্যকর বিষয় থেকে মুক্তি দেয় গাঁজা। দেহের প্রদাহ বিনাশ করে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো যন্ত্রণাদায়ক রোগ উপশমে কার্যকর ভূমিকা রাখে। 
৫. কয়েকটি গবেষণায় বলা হয়, ক্রোন বা আলসারেটিভ কলিটিসের মতো প্রদাহপূর্ণ পেটের অসুখে গাঁজা উপকারী। তবে আরো বেশ কিছু গবেষণায় বলা হয়, গাঁজা এতে কাজ করে না। ২০১৪ সালের এক গবেষণায় ক্রনিক ক্রোনের ক্ষেত্রে এক দল রোগীকে গাঁজা ও অন্য একটি দলকে প্লেসবো দেওয়া হয়। প্রথম দলটি দারুণ উপকৃত হয়। 

৬. ছোটকালে যাদের মৃগীরোগ দেখা দেয় তাদের জন্যে বহুল ব্যবহৃত ওষুধটি হলো এপিডিওলেক্স। এতে আছে ক্যানাবিডিওল যা গাঁজা থেকে সংগৃহিত হয়। এটা আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক অনুমোদিত প্রথম ওষুধ। 

৭. সেরেবেলাম এবং বাসাল গ্যাংলিয়া মস্তিষ্কের দুটি অংশ যা দেহের ভারসাম্য রক্ষা, সমন্বয় সাধন, প্রতিক্রিয়া এবং অঙ্গবিন্যাসের ক্ষেত্রে কাজ করে। 

৮. গাঁজার একটি বিশেষ প্রভাব হলো, সময় খুব দ্রুত বয়ে যায় বা সময় কাটতেই চায় না এমন অনুভূতি হওয়া। ২০১২ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, গাঁজা সেবনকারীরা ৭০ শতাংশ সময় সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না। ১৯৯৮ সালের আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, গাঁজা মস্তিষ্কের সেরেবেলাম অংশে রক্ত চলাচলে প্রভাববিস্তার করে। এমআরআই পরীক্ষায় দেখা গেছে, এতে সময়জ্ঞান কাজ করে না।
৯. গাঁজা দেহের রক্তনালীকে প্রসারিত করে। এর লক্ষণ প্রকাশ পায় চোখে। এ সময় চোখ দুটো লাল হয়ে যায়। 

১০. যারা মাঝে মাঝে বা সব সময় গাঁজা খেয়ে থাকেন, তাদের ক্ষুধা বেড়ে যায়। গাঁজা মস্তিষ্কের এমন একটি অংশকে প্রভাবিত করে যা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। সম্প্রতি ইঁদুরের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য দেওয়া হয়। 

১১. মস্তিষ্কে যে প্রক্রিয়ায় স্মৃতিশক্তি সঞ্চয় করে, তাতে বাঁধ সাধে গাঁজা। বেশ কিছু গবেষণায় বলা হয়, স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দেয় গাঁজা। তবে অনেকের মতে, এর সঙ্গে গাঁজার কোনো সম্পর্ক নেই। 

১২. বৈজ্ঞানীক গবেষণায় বলা হয়নি যে, গাঁজা বিষণ্নতা আনে বা বিষণ্ন মানুষ গাঁজায় আসক্ত হয়। তবে নেদারল্যান্ডসের এক গবেষণায় বলা হয়, যারা বিষণ্নতায় ভোগেন, গাঁজা তাদের এ সমস্যা আরো বৃদ্ধি করতে পারে। 
আমরা এবার জেনে নিবো চিকিৎসা ক্ষেত্রে কি কি রোগের ঔষধ হিসেবে গাঁজা’কে ব্যবহার করা হয়- 
মৃগীরোগ কমায়: যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২০১৩ সালেই জানিয়েছেন, মারিজুয়ানা বা গাঁজা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিলে মৃগী বা এ ধরণের কিছু স্নায়ুরোগ থেকে দূরে থাকা যায়। বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী জার্নাল অফ ফার্মাকোলজি অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল থেরাপিউটিক্স-এ ছাপাও হয়েছে তাদের এই গবেষণালব্ধ তত্ত্ব। 
গ্লুকোমা দূরে রাখতে সহায়তা করে: যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আই ইন্সটিটিউট জানিয়েছে, মারিজুয়ানা গ্লুকোমার ঝুঁকিও কমায়। গ্লুকোমা চোখের এমন এক রোগ যা চির অন্ধত্ব ডেকে আনে। 
আলৎসহাইমার শত্রু: দ্য জার্নাল অফ আলৎসহাইমার’স ডিজিজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মারিজুয়ানা মস্তিষ্কের দ্রুত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়াও রোধ করে। আর এভাবে আলৎসহাইমার ঝুঁকিও কমাতে পারে মারিজুয়ানা। তবে মারিজুয়ানা ‘ওষুধ’ হলেই রোগ সারাবে, কারো নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তির পণ্য হলে নয়। 
ক্যানসার প্রতিরোধ: এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবেই স্বীকার করেছে। ২০১৫ সালে সে দেশের ক্যানসার বিষয়ক ওযেবসাইট ক্যানসার অর্গ-এ জানানো হয়, মারিজুয়ানা অনেক ক্ষেত্রে টিউমারের ঝুঁকি কমিয়ে ক্যানসার প্রতিরোধকেরও ভূমিকা পালন করে। 
কেমোথেরাপির ক্ষতি কম: ইউএস এজেন্সি ফর ড্রাগ জানিয়েছে, মারিজুয়ানা ক্যানসার রোগীর রোগযন্ত্রণা অন্যভাবেও কমায়। ক্যানসার রোগীকে এক পর্যায়ে কেমোথেরাপি নিতে হয়। কেমোথেরাপির অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। মারিজুয়ানা কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত অনেক ক্ষতি লাঘব করে। 
স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়: এটি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহ্যামের গবেষকদের উদ্ভাবন। তারা গবেষণা করে দেখেছেন, মারিজুয়ানা মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতেও সহায়তা করে। ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। 
মাল্টিপল সক্লেরোসিসবিরোধী: মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে একটি বিশেষ স্তর ক্ষতিগ্রস্থ হলে ‘মাল্টিপল সক্লেরোসিস’ বা এমএস নামের এক ধরণের স্নায়ুরোগ হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মারিজুয়ানা সেবন করলে এই রোগের ঝুঁকিও কমে। 
ব্যথা নিরোধ: ডায়াবেটিস চরম রূপ নিলে রোগীদের অনেক সময় হাত-পা এবং শরীরের নানা অংশে জ্বালা-যন্ত্রণা হয়। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা বলছেন, ক্যানাবিস সেই যন্ত্রণা লাঘব করতে সক্ষম। 
হেপাটাইটিস’সি-র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমায়: হেপাটাইটিস সি-র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কমায় মারিজুয়ানা। নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধের মতো গাঁজা সেবন করিয়ে দেখা গেছে এই রোগে আক্রান্তদের শতকরা ৮৬ ভাগেরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক কমেছে। 
এবার আমরা জেনে নিবো মদ (Wine) কি? 
মদ বা এলকোহলযুক্ত পানীয় ধরনের পানীয় যাতে ইথাইল অ্যালকোহল (ইথানল) থাকে। ইথানল একটি স্নায়ু সংবেদনশীলতা অবদমক। এটি অল্প পরিমাণে গ্রহণ করলে মনে উৎফুল্ল ভাব সৃষ্টি হয়, দুঃশ্চিন্তা কমে যায় এবং সামাজিকভাবে মেলামেশা করার ইচ্ছা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে কেউ যদি মদ মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করে তাহলে তার নেশা হয়, মোহ বা মৌজ বা ঢুলুঢুলু ভাব ধরে এবং জ্ঞানও হারাতে পারে। বহুদিন ধরে মদপান করলে মদের অপব্যবহার ঘটে, শারীরিক নির্ভরশীলতা ও মদ্যপানে আসক্তি সৃষ্টি হয়। 
অনেক সংস্কৃতিতে মদ্যপান গুরুত্বপূর্ব সামাজিক ভূমিকা পালন করে। বেশিরভাগ দেশে মদের উৎপাদন, বিক্রয় এবং পান নিয়ন্ত্রণকারী আইন ও বিধিমালা আছে। কিছু দেশে মদ্যপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলেই মদ্যপান আইনসিদ্ধ। ২০১৪ সালে বিশ্বে মদ্য উৎপাদন ব্যবসায় অর্থের পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। 
বাংলাদেশেও মদ ব্যবসা ও সেবনকারীদের থেকে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়। 
মদের মত যদি গাঁজাকেও বৈধ করে দেয়া হয় তাহলে যেকোন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও রাজস্ব আয় বেড়ে যাবে। গাঁজাকে কেন্দ্র করে উৎপাদন, বণ্টন ও পরিবেশনের কাজে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। ডাক্তারগণ উক্ত জটিল রোগের জন্য গাঁজাকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহারের জন্য তা প্রেসক্রিপশনে লিখতে পারবে ফলে রোগীরা আরামবোধ করবে। 
সরকার কর্তৃক গাঁজা সেবন বৈধ হলে- 
গাঁজা সেবককারির জন্য সরকার নির্ধারিত নিদিষ্ট ফ্রি দিয়ে কার্ড নিতে হবে। বারের মত নিদিষ্ট স্থানে গাঁজা সেবন ও সংগ্রহ করা যাবে। 
আঠারো বছরের নিচে কেউ গাঁজা সেবন করতে পারবে না। যদি ডাক্তার কোন রোগের জন্য ঔষধ হিসেবে প্রেসক্রিপশনে লিখে দেয় তাহলে যেকোন বয়সের লোকই পরিমাণ মত গাঁজা সেবন করতে পারবে। 
উল্লেখ্য যে, ১৮৬১ সালের বৃটিশ পাকিস্তানি আইন দিয়ে যেমন দেশ পরিচালিত হচ্ছে, তেমনি আমাদের মন মানসিকতাও ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণার। এটা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রয়োজন স্বাধীনদেশ উপযোগী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন ও একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য যোগপযোগী শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন। যেখানে কোন বৈষম্য থাকবে না। 

মানুষ হবে মানুষের জন্য ভাববে। মানুষ প্রাণ খুলে হাসবে। উদার চিত্তে সবাই সবাইকে ভালোবাসবে। তাহলেই মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা একধাপ এগিয়ে যাবে।

এসো বন্ধু,

প্রাণ খুলে হাসি

এক সাথে বাঁচি।।


সাইফুল বিন হানিফ

বাঙ্গালি কবি, প্রাবন্ধিক ও কণ্ঠশিল্পী। জন্ম ১৯৯০ সালের জুন মাসে শুক্রবারে। শৈশবে বেড়ে উঠেছেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার থোড়া গ্রামে। রাষ্ট্রনীতিক সচেতন হলেও দলীয় রাষ্ট্রনীতিতে তিনি সম্পৃক্ত নন। তিনি দাদাইজম ও মার্ক্সবাদের অনুসারি হিসেবে পরিচিত। তাই অনেকে তাঁকে দাদাভাই বলে ডেকে থাকেন। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ও পোর্টালে তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ‘মিউজিক থেরাপি এন্ড মাইন্ড ডেভেলপমেন্ট’ নিয়ে গবেষণা করছেন।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত ছোট পত্রিকা ‘কবিতা’অলা’র সম্পাদক এবং অন্তর্ধবনি সংস্কৃতি চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি’র দায়িত্বে আছেন। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙ্গালিদের বৃহৎ প্লাটফর্ম ‘সাউথ এশিয়ান ফোরাম’ এর বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক। তিনি স্বপ্ন দেখেন ও অন্যকে দেখান। তাই তাঁর লেখায় প্রকাশ পায় সমাজ সচেতন মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের ধারণা। বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।
গল্পকথা! ।। নুরেন দূর্দানী

গল্পকথা! ।। নুরেন দূর্দানী



ঝিলমিল একটা কার্ড আর কিছু ফুল নিয়ে বিশাল একটা সারপ্রাইজ হয়ে যাবে এবার। বইটই দিয়ে কি হবে পড়বার সময় কোথায় ওতসব বুঝে কে, ঝামেলা। আর চিঠির চাইতে একটা এসএমএস ভালো নয় কি? লং ড্রাইভ আর হুম সেলফি ফটোর সাথে স্ট্যাটাস দিয়ে উইশ করলেই তো হলো। ট্রিট তো প্ল্যানিংই আছেই, সো এইবার হয়ে যাক!

___মেনে___নিয়ে___প্রেম______প্রেমিক___মেনে___নিয়ে___প্রেম______প্রেমিকা___জমা হচ্ছে প্রত্যেকদিন মিউজিক্যাল টপ চার্ট। আজ আড্ডা, আগামীতে ফুচকা কিংবা ফ্রাইড চিকেন। নেটওয়ার্ক আর নতুন নতুন গ্যাজেড নিয়ে ব্যস্ততায়। আধুনিক প্রেম হয়ে উড়ছে অদৃশ্য শর্ত...

একটা ছায়া ঘুমের ওম দিলো। আমি কেমন দুলতে লাগলাম তোমার কাঁধে মাথা রেখে। মেঘবালিকে পিছনে ফেলে সূর্যাস্ত হচ্ছে। তুষার উড়ছে দেখো... ভালোবাসি তুষার। স্বপ্ন স্বপ্ন, নাহ। গোলাপের ঘ্রাণ ফুরিয়ে, আকাশ রেখায় এঁকে যাচ্ছে ঘুম সবুজ । আমি চাই তোমাকে এই তুষারে জোনাকির গল্প বলতে, যেখানে তোমার পিছু নিয়েছিল হুল বিড়ালটা। ইলিশ মাছটা প্লেটে রয়ে গেলো। জন্মের ভেতর প্রেম আছে। একক অংশের দাবীতেই তো তুমি থেকে, আমি থেকে আমরা হয়ে উঠেছি!

পৃথিবীতে তখন ঝুম বৃষ্টির আয়োজন। তখনো ঘুমায়নি অহর্নিশি বই, বাতি জ্বালানো জানলা। প্রেম হয়েছে বহুবার অথচ একই ছাঁদনাতলায় অপরিচিত ক্ষতের ভেতর মৃত। বিগত অসুখের মন গভীরের ভেতর যে শরীর খাদ হয়েছে, কেউ কাউকে চিনতে পারেনি, ছুঁয়ে দেখেনি বরং ঘুমপাড়ানির গান হয়ে গেছে এক একটা ভোর। কে কখন কিভাবে কেঁদেছিল কেউ জানেনি। শুধু মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে অর্ধ সিগারেট, টুকরো কাগজ। ল্যাম্প জোনের পাশে কবিতার বই আর পুরোনো এ্যালবাম। সদ্যই ছায়া শরীর হয়ে শীতল হচ্ছে মস্তিষ্ক। রাত স্নান করলো, একাকিত্বতায়।


স্রষ্টা যেমনটাই সাজিয়ে রাখে, দৃশ্যের ধার করে বেড়ায় কেউ না কেউ। শতাব্দীকাল কেটে যাবে এই মন্ত্রে। মায়া বাড়ে প্রত্যেক শূন্যস্থানের আগে। অথচ নিয়ম করেই ট্রেন আসে রোজ। নীলে ট্রেনের সাথে মিলিয়ে গেছে গর্ভের ঘুমন্ত নীল চোখ। আকাশে সূর্য এঁকে যাবতীয় বোধ জেনেছে কি পৃথিবী পথ বন্ধুর বলে ট্রেন শরীর মেপে চলে নির্দিষ্ট শহর!