![]() |
অলংকরণ: নবী হোসেন |
ফুটপাতে বসে সেদিন শুক্রবারের বিকেলকে দেখতে চাইলাম। অনেকদিন দেখিনা ছুটির দিনের ঢাকা কেমন হয়। চাকরির কারণে। এই না দেখার বেদনা আমাকে অনেকটা কাবু করে দেয়। আগের রাতের নাইট শিফটের ডিউটি শেষে সকালে বাসায় ফিরে খুব একটা ঘুম হয়নি। ঘুম ভেঙে শরীর আর চলছে না বুঝতে পারলাম। জানলা দিয়ে দেখলাম দুপুর। তবে রোদের সে তেজ নেই। ভাগিনাটা অসুস্থ, নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। তাকেও দেখতে মন চাইলো। তখন আরো অফিস যেতে ইচ্ছে করলো না। অফিসে জানিয়ে দিলাম। বাচ্চাটাকে দেখে এসে বসে রইলাম শহরের একটা মূল সড়কের পাশের গলিতে। বিকেল তখন শুরু। মনে হলো আজই ঠিকঠাক ভাবে বিকেলটা দেখে নিতে হবে। শুক্রবার। মানুষ বের হচ্ছে নানা কাজে। কিন্তু কম। অধিকাংশই সেজেটেজে বেড়াতে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেলো শৈশবের কথা। শৈশব খুবই চমৎকার। কিন্তু এই সময়ে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। মনে পড়লেই যেনো ভেঙে যাই। এইতো বেশিদিন আগের কথা না, বছর তিনেক আগেও শুক্রবার হলে বেরিয়ে পড়তাম। খুব বেশি দূর যেতাম না। ধানমন্ডি অথবা টিএসসি। বিকেল থেকে সন্ধ্যা শেষে রাত পর্যন্ত আড্ডা। কিছু একটা করতে চাওয়ার আলাপ সবার সাথে। আবার অহেতুক প্রলাপ। আবার কিছু একটা করতে চাওয়ার আলাপ। এভাবে কতোগুলো বছর গেলো। তারও আগে ফিরে গেলে দেখতে পাই শিশুপার্ক, নানার বাসাসহ আরো কতো কিছু। কিন্তু এখন জোর করে সে আনন্দ ফিরিয়ে আনতে চাই। এমন বিকেলে ফোন দিয়ে বলতাম বন্ধু কোথায়। ওপাশ থেকে বন্ধুর জানানো আসছি। আর এখন এমনও হয়, ফোন করেও পাওয়া যায় না। আমাকেও তারা পায় না। পুরনো দিন ফিরে পাওয়া যাবে না যেনেও আগের স্মৃতি নিয়েই এমন ছুটির দিনে রাস্তায় রাস্তায় তাই ঘুরে বেড়ানো।
স্মৃতি কাতরতা একটা রোগ। আমার তেমনই মনে হয়। কিন্তু আগে কী খুব ভালো ছিলো সময়গুলো? হয়তো ছিলো। কিন্তু এখন কী নেই? হয়তো নেই। এখন যারা আমার ঠিক সে বয়সের, তারা হয়তো তাদের সময়টা বেশ আনন্দের সঙ্গেই কাটাচ্ছে। যে যে যার যার মতো করে সময়কে উপভোগ করে। এটাই নিয়ম। কিন্তু আসলেই কী তাই? আমাদের শৈশবে অবশিষ্ট যে ক’টি মাঠ ছিলো, সে মাঠে দেখতাম সবাই খেলতো। আমি খেলতাম না। বাসা থেকে বের হওয়া বারণ ছিলো। তাই বারান্দার গ্রিল ধরে দেখতাম পাড়ার ছেলেদের ক্রিকেট ফুটবল খেলা। আমার মতো এমন অনেকেই এভাবে গ্রিলে ঝুলে খেলা দেখতো। তারপর আর গ্রিলে ঝুলে খেলা দেখাও বন্ধ হলো। গ্রিল থেকে আধা হাত দূরত্বে নতুন বাড়ির দেয়াল উঠলো, খেলাও বন্ধ হলো। তবে গ্রিল ধরে খেলা দেখার যে প্রচলন তা এখনো শেষ হয়নি মনে হয়। মাঠ না থাকুক। যেসব শিশুর বাসার বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায় তারা মাঠের খেলা না দেখলেও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখতে থাকে। আচ্ছা এটাও তো অনেক পুরনো। এখন বারান্দাতেও খুব একটা বাচ্চাদের দেখা যায় না। ট্যাব আর মোবাইলে সবাই বুদ হয়ে আছে। তাই এ কথা সত্য- যে যে যার যার মতো করে তার সময়টাকে উপভোগ করছে।
সময়ের এই উপভোগ করাকে আমরা কিভাবে দেখবো? আমি অনেক দিন পর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে গেলাম। দেখলাম ক্যাম্পাস নামক বাড়িগুলোর সামনে যে জটলা থাকতো তাও এখন আর নাই। চায়ের দোকানে জানতে চাইলাম, গানটান হয় এখন? আড্ডা? উত্তরে কেমন একটা নিরামিষ স্বাদ পেলাম। জানালেন হয়। তবে। এই তবেতে বুঝে নিয়েছি। আবার সময় যে বেশি পার হয়েছে তা না। তবে সবাই সবার মতো। এ অল্প সময়ে অনেক পরিবর্তন। সব কিছু দ্রুত পাল্টাচ্ছে। যে যে যার যার মতো করে সময়টাকে উপভোগ করছে। বই পড়া নিয়ে অনেক গুরুগম্ভীর কথা হয় এই শহরে। কে বেশি পড়লো কে কম। কিন্তু আমার এ তর্ক অনেক বাজে তর্ক মনে হয়েছে সব সময়। আমাদের শৈশবে আমরা আসলে তেমন বই পড়িনি। আমার জেনারেশনের অনেকেই পড়েনি। ফলে অধিকাংশের কথা বিচার করলে আমি বলবো, এ তর্ক বাজে তর্ক। লোক দেখানো তর্ক। উল্টো আমরা প্রচুর কোচিংয়ে গিয়েছি। শুধু কোচিং করেছি। পরে সমাজ বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষের সাথে পরিচয়ের কারণে বইয়ের সাথে পরিচয়। তাই বিচ্ছিন্নতার ধারাবাহিকতায় আমরা আরো বিচ্ছিন্ন হয়েছি। তবে শৈশবে একজন লেখকের বই আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হয় তার জন্য নাকি আমাদের পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। কিন্তু যেহেতু আমরা যে যে যার যার মতো করে সময়কে উপভোগ করছি, সেহেতু উপভোগ সে এক জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এখানে লেখকের ভুল না পাঠকের ভুল আমি জানি না। জানি না এই কারণে, যেখানে বলাই হচ্ছে শৈশবে সে লেখকের বই পড়লে পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় সেখানে এতোগুলো বছরে সে পড়ুয়া জাতির দেখা আমরা পেলাম না কেনো? পড়ুয়া জাতি উগ্র ধর্মান্ধ হয়? বিকৃত রুচির হয়? সব কিছু থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে চায়? অন্যায় দেখে চুপ করে থাকে? দুর্নীতি করে? সব কিছুকে অরাজনৈতিক ভাবে ব্যাখ্যা করে? সে যাই হোক।
স্মৃতি কাতরতায় ভুগতে ভুগতে ভুগতে চলে গেলাম কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলায়। এমন শুক্রবার সকালে যেতাম পেইন্টিং শিখতে। কিন্তু পাশের বাসার ভাবির সন্তান পেইন্টিং শিখলে আমাকেও কেনো শিখতে হবে সে হিসেব আমি মেলাতে পারতাম না। হলো না তাই। এখন শিশুরা পেইন্টিং শেখে ঠিকই কিন্তু পরীক্ষার জন্য। এমনকি শিক্ষকরা এঁকে দেন তারপর শিক্ষার্থী নাম্বার পায়। মা বাবা বিষয়টি অনুমোদন করছে। যেখানে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মা বাবা অনুমোদন করেন, সেখানে পেইন্টিং তো উনাদের কাছে খুব ‘সাধারণ’ একটি বিষয়। তাহলে আমার শৈশব একটি বাজে শৈশব ছিলো ঠিকই, আবার বর্তমান শৈশবকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবো। এই সময়ের একটি শিশু আমার বয়সে এসে কী নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগবে? অথবা আমি এই সময়ে এসে যেভাবে বর্তমানকে আর কোনোভাবে মেনে নিতে না পেরে শৈশবের ঝাপসা কোনো সুখস্মৃতি খুঁজে বেড়াবো সে কী খুঁজবে? অথবা খুঁজলে তার সময়ে তার চারপাশ কী আরো বাজে রকম কিছুকে অনুমোদন দিবে? যেটাতে সে অসহায় বোধ করবে?
এই সময়ে আসলে সংকট কোথায়? উপরে অনেকটাই আলাপ করেছি। আরো করতে চাই। আমরা একটা নগরকে চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখেছি। এখন ফল ভোগ করছি। নগর ছেড়ে সে ক্ষত গ্রামে গেছে। পুরো দেশ ছেয়ে গেছে। একেকটি দিন যে কী দুর্বিষহ এটা যারা বোঝেন তারা কী ভাবেন? নিশ্চয়ই বারবার পালাতে চান। কিন্তু পালিয়ে কোথায় যাবেন? আপনি পালাতে গেলেও আপনাকে পালাতে দেবে না। কারণ আপনার পালানোর খবরও একটি ‘বিগ ইভেন্ট’। তাতে টিআরপি বেশি। বেচা বিক্রি অনেক। মানুষ বৃষ্টিতে ভেজে, জ্যামে বসে থাকে। অথবা বাহন না পেয়ে পায়ে হেঁটে মাইলকে মাইল চলে যাচ্ছে। আর এ খবর প্রচার হয় বিক্রির উদ্দেশ্যে। জনগণের জন্য যে খবর প্রচার করার সেটি প্রচার করতে হলে অনেক কিছুতেই হাত দিতে হয়। আর সেখানেই ব্যর্থ আমাদের সবগুলো প্রতিষ্ঠান। আপনি সব বাদ দিয়ে যদি শুধু এ শহর নিয়ে ভাবেন তখন আপনার অসহায় না লেগে উপায় নেই। আপনি ব্যাধিগ্রস্ত হবেন। এই অশান্তিকে এড়িয়ে যেতে আপনি শৈশবে ফিরে যাবেন। আপনার অতীতে ফিরে যাবেন। খুঁজবেন কোথায় লুকিয়ে আছে ভুলে যাওয়া কোনো সুখস্মৃতি। তখন তা খুঁজে বের করে আপনি বর্তমানের সাথে মেলাবেন আবার হতাশ হবেন। এভাবেই নস্টালজিয়া আপনার ব্যাধি হিসেবে শরীরে বসত গড়বে। আর কিছু দিন পর আপনি এই শহরে আকাশ দেখতেই পারবেন না। মৃত্যু ভয় নিয়ে চলতে হবে দ্বিতল সড়কের নিচ দিয়ে। আকাশ না দেখতে পেলে আপনার সন্তানের শৈশব শুধু কেটে যাবে ইটের সাথে সন্ধি করে। সেখানে মানবিক বোধ নিয়ে আনা খুব কঠিন। তখন হয়তো সে আমার মতোই চূড়ান্ত হিসেব কষবে- অতীত ছিলো বাজে, বর্তমান তারচেয়ে আর ভবিষ্যৎ আরো ভয়াবহ।