কবিতার সাগরে ডুব দেওয়ার গল্প এবং “ছায়াবীথি” নিয়ে কিছু কথা
আমার শৈশব কেটেছে এক বিমুগ্ধ গ্রামে, গ্রামের
বিস্তৃত প্রান্তরে খেলতে খেলতে আমি তার মায়াবী সৌন্দর্যে আবেগাপ্লুত হতাম।শৈশব
থেকে কৈশোরে পদার্পণ করলাম নিরিবিলি গ্রামের সৌন্দর্যকে অবলোকন করতে করতে। আমাকে
পাগল করত শরতের আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘমালা, বিলে-ঝিলে ফুটে ওঠা হাজার হাজার
কাশফুল, হেমন্তের মাঠে মাঠে রাশি রাশি ধানের শীষের দোলা দেখে আমি
কতশতবার মুগ্ধতায় হাবুডুবু খেয়েছি সে কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না কখনো; আমি
চোখে বিস্ময় নিয়ে উপলব্ধি করতাম গ্রীষ্মের ধূধূ প্রান্তর, বর্ষায়
নদীর বান, আরো কত কি!
গ্রামের অবিরাম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তখনো
কিছু ছড়া লিখেছিলাম, সেই থেকেই শুরু হয় কবিতার সাথে আমার গভীর প্রণয়। তখন আমি
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, আমার এখনো মনে পড়ে নবম-দশম শ্রেণির কবিতাবলি হৃদয়ে একরাশ
বিস্ময় রেখে পড়ে যেতাম, যদিও বেশিরভাগই বুঝতাম না।জসীমউদদীনের "কবর"
কবিতাটি যে কতবার পড়েছি, কতবার এই কবিতা পড়ে পড়ে চোখ ভরে জল এসেছিল! মুগ্ধতার
বারিতে সাঁতার কাটতাম কবিগুরুর "সোনার তরী" পড়ে পড়ে।মোটকথা তখন কবিতা
পড়তে আমার খুবই ভালো লাগত। আমার লেখা ছড়াগুলো পড়ে পড়ে শোনাতাম আমার চাচাতো
ভাইকে(সুমন ভাই), উনি আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন, লিখে
যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতেন বারবার। কবিতায় আসার পেছনে উনিই আমার প্রথম প্রেরণা।
আস্তে আস্তে আমি আরো বড় হতে লাগলাম সুনিবিড় গ্রামে।তারপর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে নবম
শ্রেণিতে এসে ভর্তি হলাম শহরের এক নামকরা
স্কুলে। এখানেও থেমে থাকেনি সাহিত্যের পথে হেটে চলা। বড় ভাইয়ের বাসায় থাকতাম তখন,বড়
ভাইয়া খুব বই পড়ত, উনার ছোট একটা বুকশেলফও ছিল,আমি
প্রায়ই ওখান থেকে বই নিয়ে পড়তাম। সেই থেকে বইয়ের সাথে শুরু হলো আমার অনন্ত সম্পর্ক
যা এখনো বলবৎ আছে। আমার জীবনে বড় ভাইয়ার অবদান অনেক বেশি, উনার
সাহিত্যপ্রীতি দেখে আমিও বইপড়ার দিকে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম, যদিও
তখনো সাহিত্যের সুধা জেঁকে বসেনি হৃদয়ে।এভাবেই কেটে গেল বছর দুয়েক। কলেজে ওঠার পর পড়াশোনার চাপে
বই পড়ার সময় খুব কমই পেয়েছি, তবুও
যখনি সময় পেতাম পাবলিকে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়তাম। বই পড়তে পড়তে সময়
যে কোনদিকে চলে যেত বুঝতেই পারতাম না ।কলেজে জীবনে থাকতে বই কেনার কথা
বলতেই ভাইয়া টাকা বের করে দিত,কি যে আনন্দ লাগত তখন। সাহিত্যে আসার পেছনে সবচেয়ে বড়
ভূমিকা রেখেছেন এই বড়
ভাই।
কলেজ জীবনের শেষে জড়িয়ে গেলাম একটি
মায়াবী কন্যার প্রেমে।বই পড়া বন্ধ হল অন্ধ হলে প্রেমে। স্বপ্নের সংসারে আমাদের
দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। প্রেমের জলে ভেসেছিল দুটো রঙিন মাছ।মানুষের জীবনে বসন্ত
বেশিদিন টিকে থাকে না, জীবন আমাদের সুখ সহ্য করল না,আমাদের
বিচ্ছেদ হলো। বিরহের অনলে কেটে গেল অনেকগুলো বছর।
19. Poetry is a language in
which man explores
his own amazement. –
Christopher Fry
যেদিন থেকে মানবীকে ভালোবাসতে শিখলাম
সেদিন থেকেই শুরু হলো শুভ সর্বনাশ। ছায়াবীথিদের কাছ একের পর এক প্রত্যাখ্যাত চিঠি
নিয়ে আমাকে ফিরতে হয়েছে একগুচ্ছ অপ্রাপ্তির ফুলের মালা নিয়ে। এরপর মালা নিয়ে ছটফট
করতে করতে নিঃসঙ্গতাকে ভালোবাসতে শিখলাম।এই নিঃসঙ্গতাই আমাকে নিয়ে গেছে কবিতার
দেশে। নিঃসঙ্গ সময়ের বুকে বেদনার বিন্দু বিন্দু জল দিয়ে দিনের পর দিন রাতের পর রাত
শব্দ নিয়ে খেলা করতে করতে
কখন যে
এই শব্দাবলী কবিতার ছন্দে গেঁথে গেল
বুঝতেই পারিনি। আমার মস্তিষ্কে সময়ে অসময়ে শব্দের রেলগাড়ি চলাচল করতে শুরু করল,কবিতা
হয়ে বহু সাধনায় বের হয়ে আসতে লাগল একেকটি শব্দ,একেকটি লাইন,
কবিতার অন্তরে ঢেলে দিতাম জীবনের যত
প্রেম, যত ব্যথা,যত আশা। কবিতার নদীতে বহুদিন নৌকোর মাঝি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কখনো
কখনো সর্বগ্রাসী বন্যায় ডুবে গেছে নৌকো, সাঁতার জানতাম বলে উঠে এসে আবার
নৌকো বাইতে শুরু করলাম।এভাবে চলতে চলতে কবিতার সাথেই আছি আর দিনে দিনে অনুপ্রেরণা
দিয়ে আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার তাগাদা দিচ্ছে প্রিয় বন্ধুগুলো। হৃদয়ের সমস্ত প্রেম
ছড়িয়ে দিলাম তাদের অনুপ্রেরণার প্রান্তরে।
ছায়াবীথি'র
বেশিরভাগ কবিতাই প্রেমের, তবুও প্রেমের বাইরেও কিছু কবিতা আছে।
কবিতায় বিচ্ছেদে কখনো শিশুহারা মায়ের মতো
কেঁদেছি, কখনো পালন করেছি নির্বাক নিরবতা,কখনো
স্বপ্নে ডেকে এনেছি চোখের মণিকে,কখনো মজনুর মতো বেদনার মরুতে হাজার হাজার বছর ধরে পরিভ্রমণ
করেছি।
কখনো গড়েছি, কখনো
ভেঙেছি, কবিতায় কখনো ইতিহাসের নিষ্ঠুর কাহিনী এনে রাঙিয়েছি তার
অন্দরমহল,কখনো আবার নতুন প্রেমে বিভোর হয়ে একের পর এক স্বপ্নের মালা
গেঁথেছি, কখনো নানা উপমায় সাজিয়েছি ছায়াবীথির সমস্ত অবয়ব, ছায়াবীথির
প্রেমে হারিয়ে গেছি
পৃথিবীর সুন্দরতম স্থানে। অন্তরে লুকোনো যাবতীয় অনুভূতি দিয়ে নতুন ঘরের মতো
সাজিয়েছি ছায়বীথি'র ঘরের প্রতিটি কক্ষ।
কবিদের চোখে কখনো জল থাকতে নেই,কবিদের
চোখের জল মানেই কবিতা।কবিরা কখনো মানুষের সামনে গিয়ে কাঁদেনি,কবিদের
অন্তরের জল শতশত বছর ধরে উদ্ভাসিত হয়েছে তাদের কবিতার প্রতিটি শব্দে।আমিও হৃদয়ে
শব্দের নিঃশব্দ চাষাবাস করি প্রতিদিন।
অপেক্ষা
গর্ভের জগত থেকে মানুষ শুধু অপেক্ষা করেই যাচ্ছে,
যুদ্ধবিধ্ববস্ত মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীর বুকে
আসার আকুল অপেক্ষা,
জন্মের পর থেকে শুরু হয় একপা দুপা করে হাটার অহর্নিশি
অপেক্ষা,
মুখ ফুটে কোনোমতে মা শব্দটি বলার অপেক্ষা,
তারপর মুখে কথার খৈ ফোটার অপেক্ষা।
স্কুলে যাওয়ার অপেক্ষা,
কলেজে যাওয়ার অপেক্ষা,
চিরায়ত প্রেমে পড়ার অপেক্ষা,
কিশোরীর লাজুক ঠোঁটে চুম্বন করার অপেক্ষা,
ভালোবাসাবাসি করে সারাজীবন একসাথে কাটিয়ে দেওয়ার সোনালী
অপেক্ষা।
এরপর একটা ভালো শিক্ষালয়ে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষা,
মোটা অংকের চাকরির অপেক্ষা,
সকল আহ্লাদে বিয়ের পিড়িতে বসার অপেক্ষা,
একটি ফুটফুটে সন্তনের মুখ দেখতে মাবাবার অন্তর্নিহিত
অপেক্ষা।
যৌবনের নদী পেরিয়ে বুড়ো বয়সের হাটে চলার অপেক্ষা,
সব শেষে, সব অপেক্ষাকে পিছনে ফেলে মানবজীবন শেষ হওয়ার অপেক্ষা,
অনন্ত জীবনের পথে যাওয়ার সুমধুর অপেক্ষা।
মানুষের জীবন শত শত অপেক্ষার গল্প,
অপেক্ষা, অপেক্ষা, কেবল অপেক্ষা,
অপেক্ষাকে উপেক্ষা করা যায় না কখনো,
অপেক্ষা কেবল অপেক্ষা করে।
এতটুকু চাইনি কখনো
প্রয়োজন
ফুরিয়েছে, ফুরিয়েছে বেঁচে থাকার অনন্ত স্বাদ,
আবার অন্তরে
পচা রক্ত জমতে আরম্ভ হয়েছে নিঃশব্দে।
সুখের
জানালা দিয়ে লম্বা হাত নিয়ে ঢুকে গেল কষ্টবৃষ্টি,
তুমুল
বৃষ্টির সমীরণে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ভরসার চিলেকোঠা।
অস্থিতিশীল
বাংলার নীলিমায় আমি হাটি, আমি বাঁচি,
আমি বসবাস
করি মধ্যবিত্ত রক্তে।
জেনে রেখো,খুব করে জেনে রেখো, প্রিয়তমা,
আমি আর বেঁচে
নেই এই পৃথিবীর বুকে,
আমার দেহটা
হয়তো পৃথিবী প্রতিদিন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে,
আমার অন্তরদেহ
সেই কবে মরে মিশে আছে মৃত্তিকার সাথে।
শুকনো
কাঠের মতো অহর্নিশি জ্বলতে জ্বলতে
আমি ভস্ম হয়ে পড়ে আছি ছাই হয়ে
আর ছাইয়ের
মতো উড়ে উড়ে আমি গিয়েছি বায়ুমণ্ডলে,
তারপর, বহুদিন
কেটে গেল,
কেটে গেল খণ্ড খণ্ড মেঘলার
বহুরাত,
এরপর ঝরঝর করে ঝরে গেল অবিরাম
বাদলের ধারা।
গর্ভবতী
রমণীর মতো মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে
আমি কোটি কোটি চিরকাল পার করে জন্ম দিয়েছি সুখের শিশু,
ডাকাতরা
ডাকাতি করল তাকে,
কেউ কেউ গলাটিপে
হত্যা করেছে গোপন ক্ষোভে,
কেউ কেউ জাহেলিয়াতের
মতো জীবন্ত কবর দিল।
বস্তাপচা
ভালোবাসা বলে গালি দিল অনেকেই,
ন্যাকামির
উপাধিতে ভরে গেল আমার জীবন,
তবু সর্বনাশ
গ্রহণ করেছি সর্ব আশা বুকে বেঁধে।
এতটুকু
চাইনি কখনো যতটুকু তাবৎ মানব চাই,
চেয়েছি
একটু সুখ, চেয়েছি সামান্য ছোঁয়া,
তাও পলায়ন
করে বেড়ায় সারাটাক্ষণ।
বিভ্রম দুয়ারে দাঁড়িয়ে
জানালার
বাইরে
আসমানি
রঙের দেয়ালটাকে
আকাশ মনে করেছিলাম,
আমি জানতে
পারলাম
আমার মনে হওয়াটা
ভুল ছিল।
নরপিশাচের স্পর্শনীয় পিপাসায়
এই মানবদেহের
ঘরে সমস্ত রাতকে ঘিরে
যন্ত্রণার
হায়েনারা নিপীড়ন করে যায়।
তাজা তাজা লাশ পোড়ে হৃদয়ের
জ্বলন্ত শশ্মানে,
টুসটুস
ভয়ংকর শব্দে কেঁপে ওঠে রাতের আকাশ।
শান্তির
আকাশতলে, শান্তির বাতাসবেগে
চেয়েছিলাম
একটু সুখ, চেয়েছিলাম
একটু স্বস্তি।
শত জনমের
নিত্যবর্তমান সুখের আশায়
ভ্রমণ
করেছি প্রতীক্ষিত রাত জীবনের অগণিত স্টেশন পেরিয়ে।
দেহ চলে দেহের
নিয়মে খুব স্বাভাবিক হয়ে,
অন্তর্দেশ
তবু বুদ্ধের মূর্তির ন্যায় সাড়াশব্দহীন।
হৃদয়ের
দৃশ্যহীন শূনময় কলেবর
মরে গেছে সেই ডিসেম্বরের
শীতল দ্বিপ্রহরে।
যেই আমিকে
সবাই জানত সবার,সবাই চিনত
সেই আমি আর বেঁচে
নেই।
একদিন
রাজ্য ছিল,ছিল আরব্য রজনী,
বিলুপ্ত
নগরী হয়ে আছে রাজার বিশাল পাড়া।
জীবনের
সুখ ছুটি নিয়ে চলে গেছে
না ফেরা কাঠের
পালকির অভিযাত্রী হয়ে মাটির তলায়।
জগতের
এত সুরভিত মায়া আমায় করেনি বলে দয়া
খুলে গেল ডাকাতি
আঘাতে মৃত্যুর দরজা।
জানালার
কাছে অর্থহীন অপেক্ষার দীর্ঘ গরল শর্বরী কাছে ডেকে
জেগে আছে মৃত মানবের
মতো একরাশ থুরথুরে একাকীত্ব,
টেবিলের ‘পরে চিত পড়ে আছে জীবনানন্দের
একগুচ্ছ কবিতার পাণ্ডুলিপি,
জানালার
অন্তঃপুরে বসবাস করে চোখবন্ধ সময়ের না ফেরার স্বপ্নবাড়ি।
যোনির
রঙিন কাননের পথে পথে
কোথাকার
কোন চাষী করে গেছে লাঙ্গলের চাষ,
জন্ম দিয়ে গেছে মুঠোমুঠো
ঝরঝরে ধান।
জাজিমের
খোলামেলা উষ্ণ কায়াজুড়ে
রুয়ে যায় নিয়মপিয়াসী জীব সারি সারি চারাগাছ নিঝুম রজনীবেলা।
অধরের
মুখ খুলে থরে থরে ঢুকে গেল
গরমমুখর
নহরের রাশি রাশি পানি।
চিনিগুড়া
চাউলের ভাতে ভরা ছিল দুটি প্লেট,
খেয়ে গেল নিয়ে গেল সংসারের
বিধিবদ্ধ পাখি।
তার অস্তিমজ্জার
পোশাকে শিহরিত লীলা চলে
দিনরাত
নরপিশাচের স্পর্শনীয় পিপাসায়।
ভালোবাসি সেই তোকে
ইটপাথরের বানানো শহরে জানালার কাছে বসে,
আঁধারের ভিড়ে আশার আলোয় স্বপ্নেরা চোখে ভাসে।
হিসেব করেছি পারব যে নিতে সুখের সংসার হাতে,
অল্প আয়ের অল্প টাকায় দুবেলা পারব খেতে।
পাশে থেকে তুমি প্রেরণা যোগাবে আমার প্রতিটি কাজে,
পরম সুখের বাড়াবাড়ি হবে ঘরসংসারের মাঝে।
দেখতে দেখতে কেটে গেল দিন সোনালি রূপালি
রাত,
ভালোবাসা তবু কখনো কমেনি দেখায়নি অজুহাত।
আমি জানি খুব মধুর বেদনা বয়ে যায় বারবার,
তবুও তোমাকে হারানোর কথা ভাবিনি একটিবার।
বিয়ের কথার কত প্রস্তাব নাকচ করেছ তুমি,
বলেছ আমাকে মরে যাব সাফ না পেলে তোমায় আমি।
স্বাপ্নিক জোড়া সাজাব বাসর বানিয়ে প্রেমের রাজ্য,
একটি লাইনে লিখব আমরা ভুবনকাপানো কাব্য।
পৃথিবীর সব আদরের ডাকে ডাকব তোমায় নিত্য,
ভালোবাসা দিয়ে প্রমাণ করব চিরকাল তুমি সত্য।
কতদিন আর এই ধরণীতে বাঁচব রে বল পরী,
এক জনমের সোনালি জমিনে ফোটাব গোলাপকুড়ি।
আর বেশিদিন লাগবে না প্রিয় চাকরিটা যদি পেয়ে যাই কোনোমতে,
বধু হয়ে তুমি করবে প্রবেশ দশটি আঙুল আঁকড়ে এই দুহাতে।
হাতের মুঠোয় রাখব দুহাত ছাড়ব না কোনো ঝড়ে,
ভালোবেসে যাই ভালোবাসি আমি ভালোবাসি সেই তোকে।
বিষাক্ত দর্শনের পরিণতি
ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে ফিরে আসে
চেনা মানুষের
মুখ লাখো মানুষের ভিড়ে আচমকা।
হলুদ খামটা
সূর্যাস্তের চিঠি নিয়ে দিনে দিনে
এনেছে
রঙের অন্তহীন খেলা ডাকপিয়নের এই ঠিকানায়।
অনেক বছর দেখা হয়নি যাদের
সাথে
পাওয়া
যেতে তাদের সাক্ষাত কোনো একদিন তবু।
তোমাকে
দেখার ভয়ে খেয়ালের চোখে লাগিয়েছি তাই চির অবনত পর্দা।
কাঁঠালের
মতো নুয়ে পড়ে থাকে চোখদুটো
চলার মাটির
দিকে অপলক।
তোমাকে
যখনি দেখব হঠাৎ আমি
তখন ছড়ানো-ছিটানো
আধারে ভিড় করবে মাছের ঝাঁক।
মানবীর
গন্ধে গন্ধময় হয়ে যাবে অন্তরের সমস্ত বাগানবাড়ি,
সেই গন্ধে
মুছে যাবে হয়তো সেবার
আলোর কলম দিয়ে লেখা কষ্টার্জিত
সুখ।
নয়নের
মণি চাই না দেখতে আর
হারানো
প্রিয়ার অন্তর্ভেদী হলুদ খামের মতো পরিষ্কার মুখখানা।
আমি জানি, রূপসীর
স্তিমিতনেত্রের মাঝে ডুবে ডুবে
কোটি কোটি যুবকের
দল মারা গেছে অনন্ত লগন।
তাই আমার চোখের
মণি
চোখ রাখে চিরচেনা
এই শহরের রাস্তার চরণে,
রাস্তায়
কখনো চোখ তুলে তাকাইনি,
চোখ তুলতেই
যদি তুমি চোখে পড় শুধু সেই ভয়ে,
তুমি চোখে পড়া মানে
সিডরের
অনিশ্চিত ধাক্কায় নিহত হবে সুখের সন্তান।
আমি চাই না কখনো
হঠাৎ তোমার
সাথে আমার আবার দেখা হোক,
তোমাকে
দেখবে যখন চশমাপরা চোখজোড়া
চোখের
বাড়িতে জ্বলবে তখন অনাকাঙ্ক্ষিত অনল।
তাই তোমাকে
দেখার অপ্রস্তুত ভয়ে
আমি দ্রুতবেগে
হেটে চলি কোনোকিছু না দেখার ছলে প্রতিবার
প্রতিটি
রাস্তার প্রতিটি কদমে অসতর্কতাবশত।
আমি রাখতে
চাই না চোখ হাজার চোখের ভিড়ে,
যদি সেই চোখের
মিছিলে বিজয়ীর বেশে তুমি হেটে যাও মলমলে উত্তরীয় গায়ে দিয়ে।
তাহলে
আমি যে আবার মারা যাব প্রতিরাতে,
হিংস্র
আঘাতের চাপে টুকরোটুকরো হয়ে যাবে
অন্তরের
ড্রেসিং টেবিলে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা অমলিন কাঁচের সোনালি গ্লাস,
হায়েনার
মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে দুঃখরাশি।
যে পথেই হাটি সে কথাই ভাবি রাত থেকে দিন
দিন থেকে রাত বারবার,
দেখা হলে শোকের
মিছিলে লাশ হবে আমার হৃদয়দেহ,
বাসা বাঁধবে
নানান বিষাক্ত পোকামাকড়।
দেখা হলে কোনো বিষাক্ত
দর্শনে
ছিঁড়ে
যাবে জীবনাকাশের উড়ে চলা লাল ঘুড়ি।
সিজদার
মতো অবনত চোখে
আমি তাই আমার চোখকে
সারাদিন স্থির করে রাখি তোমার না থাকাজুড়ে।
তোমাকে
দেখলে আবার নিজেকে
ক্ষয়ে
ক্ষয়ে শেষ করে দেব আমি, তা নিশ্চিত।
সেই রূপের
পারিকুটিনে আর জ্বলতে চাই না আমি,
তাই তুমি অদেখার
জ্বালা হয়ে যেন বেঁচে থাকো চিরকাল।
ফেরি
করা মাছবিক্রেতা
বহুদিন ধরে ক্ষুধায় বিধ্বস্ত ভিখারির রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া
পাঁচশো টাকার চকচকে নোট
তোমাকে আমার সহসা দেখার সুখ।
ভিখারির পেট ভরে সাথে আমার হৃদয় ভরে ওঠে।
পেলব বাগানে পৌষের ভোরের সোনাঝরা রোদ এসে
অবলীলায় হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
ডিম ফেটে বাচ্চা হয় মুরগীর,
গ্রাম্য বঁধুর চোখের লাজুকতা বাজে প্রাণে।
নতুন অদিতি দেখি
যবে আমি আর ছায়াবীথি মুখোমুখি,
সুন্দর সুন্দর মাটির ঘরের মতো জন্ম নেয় মেঠো অনুভূতি।
এই কথা সেই কথা,
মিনতির মর্মরিত ভাষা
ফেরি করা মাছবিক্রেতার মতো ডাকে---
এই মাছ আছে মাছ,ইলিশ,কাতলা, রুই।
ছায়াবীথি
আড়ালকারিণী ঢাকে মুখশশী তার
নিসর্গের লজ্জাবতী বৃক্ষসম,
সম্মুখনয়নে বসে জনকলরবহীন রজনীর মতো
সিন্ধুর গহীন তলপেটে নিয়ে আমায় ঘুমিয়ে রাখে তার অগাধ
ভালোবাসার জ্যোছনাবিলাসে।
নিরিবিলি ছায়াবীথি তার মুখখানি,
দেখি না যখন ইচ্ছে হলে, দেখি ঢের বেশি জীবন্তমানবী ছবি।
অধরপল্লবে ফোটে যখন চৈতালি হাসি
ম্লান হয়ে যায় তারকারাজির সমুজ্জ্বল আলো।
তার হাসির শব্দেরা এলে
উনুনের পেটে থালার গরমে
ফুলে ওঠা রুটি হয় নরম রুটির মতো এই মন।
শ্রেষ্ঠ সুখের বিশ্বসংসার প্রলয়হাসির মুখচ্ছটা,
গুনগুন ভ্রমরের শব্দ
সারাঘরজুড়ে মেতে ওঠে আনন্দ-উল্লাসে।
কাজল নয়ন ডুবিয়ে রাখে যে জড়িয়ে আমায়
সারাটি দিনের সারাটি রাতের ঘোরে,
ধ্যানরত লেখিয়েরা যেইরূপে ডুবে থাকে
তাদের অদম্য লেখনশৈলীর গহীন চিন্তায়।
চক্ষুদ্বয়ে কে যেন দিয়েছে ঢেলে প্রাণচোরা মধু,
পান করেছি চোখের আলো,
ফুরিয়ে যায়নি কভু।
তার রূপ নিয়ে,
তার পাখির বাচ্চার মতো রূপ দেখে
মরে যেতে স্বাদ হয় অনিন্দ্য কপোলজুড়ে।
ফুরিয়েছে কতগুলো দিন,
ফুরিয়েছে কতগুলো রাত,
ফুরিয়ে যায়নি কাঁঠালবীথির জানালার ফাঁকে দেখা গোল পেয়ালার
মতো সেই চাঁদ।
আহা ! কি দারুণ সেই মুখ,
যেন বৃষ্টিভেজা দোয়েলের প্রেম জাগানিয়া রূপ।
পারেনি তো এত রূপজ্যোতি ধারণ করতে আঁখিতারা দুটি,
তাই ভেবে নিমীলিত চোখ ঘোষণা দিয়েছে তাকে
গোটা জগতের সেরা শিল্পীর সুচিত্র কর্ম।
সুহাসিনী যখন নিঃশ্বাস ফেলে
কর্ণজোড়া শুনে রাতের নদীর চিরবহমান গভীর শান্তির
কলকলধ্বনি।
আমার পরাধীন জমি
যে জমি ছিল শুধুই আমার
সে জমি এখন অন্যের,
যে জমিতে আমি চাষ করার কথা ছিল
এখন সে জমিতে চাষ করে কোথাকার কোন গেঁয়ো চাষী;
সে জমিতে চাষ করার কথা ছিল
নানা ধরনের শাকসবজি,
নানা ধরনের ফলমূলাদি,
চাষ করার কথা ছিল গোলাপ,চামেলি, বেলী,শিউলি;
তথাকথিত নিয়মপূজারীর কুটিল ষড়যন্ত্রে
আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে
আমার বহু কষ্টের বিনিময়ে পাওয়া জমিটুকু।
দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে
যেটুকু শস্যদানা চাষ করেছি
তারা চক্রান্ত করে সেখানে নিক্ষেপ করে বিষাক্ত ফরমালিন,
নষ্ট করে দেয় আমার বহু সাধনার শস্য,
খোদার গযব পড়ুক তাদের উপর।
ভণ্ড সমাজপতিরা আমাকে করে দেয় জমিছাড়া,
জোর করে ছিনিয়ে নেয় আমার শেষ সম্বলটুকু।
আমার জমি এখন আর আমার জমি নেই,
এখন তা চলে গেছে পরদেশী শত্রুর দখলে।
শোনা গেছে সেদিন ও পাড়া থেকে শোনা গেছে
সে ইচ্ছেমত আমার জমি যত্নহীনভাবে চাষ করছে,
সঠিক সময়ে জমিতে সে পানি দেয় না,
দেয় না কীটনাশক ওষুধপাতি,
গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপে মরে যায় ফলগুলো,
মরে যায় ফুলগুলো,
অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে থাকে পরদেশীর পরিচর্যাহীন জমি।
জমি থেকে ভালো ফলমূল পেতে হলে যে
নিয়মিত তার যত্ন নিতে হয়,
কিছুদিন পর পর আগাছা কেটে পরিষ্কার করে রাখতে হয়,
পতঙ্গনাশক ব্যবস্থা নিতে হয়।
চোখ ভিজিয়ে ভিজিয়ে সবসময় প্রার্থনা করি
ওই কৃষক যেন আমার জমিটার সদ্ব্যবহার করে।
পরিত্যক্ত ঘরের ডাক
দারুণ আঘাতে ব্যাঘাত ঘটে ঘুমের,
দূরদূর করে তাড়িয়ে দেওয়া কঠিন দৃশ্য ভিক্ষুকের চোখে ভেসে
ওঠে প্রতিমুহূর্তে।
নির্জন দেশের সরল মানুষ
কোকিলের সুরে গেয়েছে তোমার অন্তর্নিহিত গান।
পরিত্যক্ত ঘরের মতো এখন পরিত্যক্ত অন্তরের নিবেদন,
কোনো আবেদনে কখনো সাড়া দাওনি,
তবুও শতসহস্র আবেদন ঝুলেছিল তোমার ঘরের দেয়ালে।
যে ভাতের থালাটা তোমার সামনে পড়ে ছিল
তুমি সেখান থেকে স্ব ইচ্ছায় ভাত বেরে খাওনি কখনো।
শিশিরস্নাত ঘাসে প্রথম রোদের সোনালি খেলায়
পৃথিবীর সব পাখি গান গেয়ে গেয়ে নেচেছিল,
কত সহজ সহজ স্বপ্নের নীলিমায়
তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম পাখিদের বিচিত্র সংসারে।
তোমাকে হৃদয়ের খুব কাছে চিরস্থায়ী ধন হিসেবে নিতে
১৮ বছরের যুবতী উঠোন পরিষ্কার করে বসে আছে।
চর্যাপদের যুগ থেকে শুরু করে দুটি চোখ জেগে আছে,
মুখের আলোয় একটি রঙিন ভোর দেখার অপেক্ষায়।