অনেকদিন পর আম্মাকে
কাঁপা কাঁপা ফুলগুলি- তাদের স্বর
আপাতত হয়ে আছে বোধিশ্বর
যেহেতু কাঙ্খ্যা করে চেয়েছি ওদের
অভিকর্ষ টানে ওরা মজেওছে ঢের।
ভাঁজের ভিতর ভাঁজে বর্ণালি ঢেউ
খুশ দিলে দেখা যাচ্ছে আম্মাকেও।
এক ক্ষণকালে তারা সূর্য পরিধি
ঘুরে এসে আমাকেই বানিয়েছে নিধি।
আমি তো অবাক! হল বন্ধ জবান,
ওরা মুখে ভাষা দিয়ে রাখল প্রমাণ
মিছেমিছি নয় এই কেঁপে-কেঁপে ওঠা
আমার জন্যেই নাকি বিদগ্ধ ফোটা!
ক্রমশ অবাক হই শুনে বহু সূর
এক সঙ্গে কলেমা পড়ে, মদিনা-সুদূর
সুরভিত মালা হয়ে, গায়ত্রী গরিমা
ক্ষণে ক্ষণে অতিক্রমে’ রেখায়িত সীমা।
স্বরগুলি কাঁপা কাঁপা বিবর্ত ফুল
বাগানে বসে থাকা- আম্মা- পারুল!
নুসরাতের জন্য
বলল বাতাস, ‘নুসরাত’, আমি নিরুত্তর।
হত্যাকারীর দেশে বসে চিবাই পান,
হাড় সাজিয়ে বানাচ্ছি প্রতিষ্ঠান,
এনেছি ডেকে ইহুদি কজন ওস্তাগর।
এ্যাই, তোমরা শরীর খোলো- ব্যক্তিবাদ
চালু হচ্ছে ধর্ষে আপন আত্মজা,
দিল্লি থেকে আনিয়েছি মত্ত ষাঁড়
ইলেকট্রিকের তারে বসে বলল চাঁদ।
অশ্বডিম্ব আগলে রাখেন কয় নফর
মিষ্টদ্রব্য বিলি করেন মরণচাঁদ,
এটাই খাঁটি বিয়ের ধর্ম, ও নুসরাত,
সিরাজুদ্দৌলা নিজেই মীরজাফর।
বিকার
কণা ও কণাদ কেন নয় স্থির?
কেন ঘূর্ণি এ ঘৃণার পাঁক দেওয়া ব্যথা
সইতে হচ্ছে? তুমিই সুচেতা,
যদিও শব্দমূলে আর কিছু রয়,
ফুটন্ত ফোনেমের মুহূর্ত-প্রলয়।
তুমি ভাবো বেশ্যা প্রণীত রাত
পবিত্র নয়? উরুস্তম্ভে দাঁত
বসালেই ধরে নিতে হবে হয়ে গেল পাপ?
পূণ্যও কি দ্যাখো নাই বিলাপ-
মাত্র? আদি ও অনাদি একাকার
হয়ে হয়ে গুলঞ্চলতায় ত্রিমুখী বিকার!
প্রেম, তুমি ভাবো চক্রাকারে ঘুরে
তমোঘ্ন তিথিতে থামবে? গত পরশুরে
বর্তমান বানিয়ে ফেনিল তরঙ্গয়
মেঘমধু ঘষে ঘষে দেহটার করবে বিলয়!
বৈকালিকী
বইয়ের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে
মোড়া টেনে বারান্দায় বসল বিকেল,
আইভিলতার ছায়া মদ-রং রোদ্দুরে মেশে
এক চিলতে হাসি যেন হঠাৎ গড়ানো মার্বেল।
গত বৎসর শীতরাত্রি পড়ে গেছে মনে?
একটি হরিণ হিয়া হারিয়ে কাঁদছিল একা
চন্দন গন্ধ গম্ভীর বিধুর কাননে,
কিন্তু তাতে হাসি কেন? কি বলে ফেকাহ্-
শাস্ত্রগুলি এইসব স্ববিরোধী ঘটনা ঘটলে?
তোমাকে বুঝে নি কেউ- উগ্রবাদী সভা,
বুঝ হতে হতে মেদমত্ত গল্প রটলে
তুমিও খোঁপায় পরো নি সামাজিক জবা।
গোপন ঈর্ষার আগুনে তাহলে তুমিও পুড়ো?
ক্লান্তিকর অধ্যাপকের কাছ থেকে ছোট হয়ে আসো?
তাও কি প্রণয়ই নয়? জ্ঞান থাকে গৃহস্থ পশুরো,
এই কি কার্যকারণ যার জন্য মিহি করে হাসো!
প্রতিদিন নয়, আজ হেসে উঠল প্রচ্ছদ সরিয়ে
ইয়োলো অকার ছাওয়া সংক্ষিপ্ত শান্ত বিকেল,
কিছু আনন্দ-বা থাকে দুঃখের অতীত জড়িয়ে
ভেবেছ কি সব কথা বলেছে বুড়ো বাইবেল?
সংসার এমনই- পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিটা বলে
অসাচ্চা বাঁচাই সার মা- আসলে তো পুড়ছ অনলে!
কেনা শেখা
দিন, দুটো টাকা দিন
কিছু কিনে খাই
আপনিও তো কেনেন, কেনেন না?
পরনারীর জন্যে সুবাসিত জাঙ্গিয়া
চর্বিহীন চাঁদের অমেয় সম্ভার
কালও দেখেছি স্বপ্নজঙ্গলের ভিতর একটা হরিণের খাল খুলছেন আপনি
একটা প্রাকৃতিক পোলকা-ডট জ্যাকেট যে তার চাইই চাই
যা থেকে মৃগনাভির খোশবু বেরোবে
জাগিয়ে দেবে আপনার ক্ষমতাধর লোহা
প্রাণপণে চেষ্টা করেছি আরো ঘুমাতে যেন আমার দৃশ্যপর্দার বাইরে
দিনটা কেটে যায় দ্রুত আর নামে রাত্রি আবার অকাল ঘুমের
কিন্তু ঘুমটা চটকে দিয়ে গেল ও
ও মানে! আমি ভুলে গেছি তাও
না খেতে খেতে।
এত গরিবের বাচ্চা আমি ক্ষুধার আগুন লকলকিয়ে ওঠে সূর্যটা উঠতেই
দিন, দুটো টাকা দিন
আপনিও তো কেনেন, কেনেন না?
কবুতরের বুক কেনেন আপনি পারী থেকে
আর খোদ মার্কিন দেশ থেকে কেনেন অধিক আলট্রাথিন কনডম
কালই তো দেখলাম, কাল না পরশু
আপনি একটা বউ কিনলেন প্রথিতযশা নাট্যকারের কাছ থেকে
আমি তো কিছু মনে করি নাই তাতে?
বিশ্ববিতানে থুতু ফেলা হোমোস্যাপিয়ান আমরা
কিছুই যদি না কিনি কেমন দেখায় না?
দিন, দুটো টাকা দিন
কিছু কিনে খাই
খেয়ে কিনি আপনার মতাদর্শটাই
নামপদী ছলনা
ভোর কাটল পার্পলতায়
রাত কাটল নীলে,
পর-স্ব রং নীরবতায়
স্তব্ধ আঁচিলে।
একটু পর- মানুষ হল লাশ।
প্রাচীর উঠল শূন্যজুড়ে
আকাশ সঙ্কুচিত,
আজদাহাটা দাঁড়িয়ে দূরে
ভ্যাবলা অসংস্কৃত।
চৈত্রে এ কি নতুন সর্বনাশ!
সাধের লাউয়ের ডুগডুগিতে
শুধুই প্রবঞ্চনা,
ব্যক্তিসংঘে, জাতীয় গীতে
নামপদী ছলনা।
এসব দেখে কবি খাচ্ছেন সিন্থেটিকের ঘাস!
(আবার)
ভোর কাটল...
সন্দেহবাদ
নিত্য সন্দেহ মনে
যমুনা কি সত্যিই বহে?
কারই বা দুধভরা স্তনে
ঈশ্বর একা একা দহে!
মাটিতে পড়ে থাকা ফুলে
কার স্পর্শ বীজময়?
কে তাকে চড়িয়েছে শূলে,
কার রক্তে হাত ধোয়?
বই খুলি, উত্তর নাই,
আর-কোথা যমুনা বিলীন,
পেকে পচে যায় জলপাই
সমগ্র শূন্যের অধীন।
সাধ
আয়ুষ্কাল ছাড়িয়ে গিয়ে উড়তে গেছে সারস
আবার- আকাশ সীমা লঙ্ঘনের দায় নিতেও রাজি
জানা যায় নি কোথায় পেল এমন দুঃসাহস
নাকি- এও হবে নতুন কোন তত্ত্বীয় কারসাজি!
আর, আমি বসুন্ধরা থেকে গ্রিনরোডে আসতে গিয়েই হাঁপাই
ভুলে গেছি আমারও ছিল ঝালর দেওয়া ডানা
শুধু- আবছা দেখতে পেতাম একজোড়া কৈতর
নিকটতম দূরত্বে দেখেছি মটরদানা
কঁকিয়ে উঠে হতে চাইত শুধুই নৈশর
এসব স্নিগ্ধ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি নিতে আমি এখন হাফ-আখড়াই গাই
সাধ্য নাই, সাধ রয়েছে যুদ্ধে যাব ফের
মধ্যমনি যদিও তুমি হারানো প্রাচ্যের!
স্বাধীনতার উড়ালহীন পাখির গান
পাখির আদল নিয়ে বসে আছে পাখি
কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই, নাই তাকাতাকি,
কম্পুটার পর্দার ঝালরের তলা থেকে আসা
উজবুক লোকদের আহ্লাদের নানাবিধ ভাষা
তর্জমা করে করে ব্যথা হয় চম্পক আঙুল
আর সব ঘাড়-মোটাদের যাবতীয় বানানের ভুল
শুধরে দিতে দিতে মনে পড়ে তার
কোথায় সে পেল গুপ্ত ডানার বাহার?
অথচ উড়াল নাই, আকাশ-গঙ্গার নক্ষত্র-মাছ
ঝিলিক মারে নি কোনদিন, গ্রহের পিশাচ-
গুলি নাস্তানাবুদ রাখে স্বার্থ শিবিরে,
ঠাণ্ডা কফির মধ্যে নুলা এক পোকা সাঁতরায়
হয়ত ভাবছে, বাঁচতে চায় না এই পোড়া দেশে
হয়ত মৃত্যুর ধারনা পেয়ে গেছে ও,
এসব তো এখন প্রত্যহের চ্যানেলিয়া-শো।
পাখি দ্যাখে তাই এক ফাঁকে ঘাড় ব্যথা ক’রে
এমন কি হবে বুঝি কেউ আছে ম’রে
অতলান্ত গহ্বরে তার, তাও- সে কত কত কাল,
সেই থেকে তার আর হয় নাই উড়াল!
কবিরা মস্করা করে: মুক্তি হবে তোর
সে দিন- যে দিন খুঁড়বি নিজ হাতে গোর।
পাখি তবু ভ্রূক্ষেপ করে না, পানপাতা-হাতে
লিখে যায় বাকীদের বেতন বৃদ্ধি, প্রমোশন যাতে
দ্রুত হয় কেননা তাদের ডানা আরো
শক্ত না হলে পার্টি হবে না জম্পেশ, রাত্রির গাঢ়
শাড়িটা হবে না কেনা, পাখিটার সেই ভাবনা নেই
একটু শান্তি হত দুদণ্ড ডানা দুটি মেলতে পারলেই।
একবার ভাবে শুধু কেন পেল পাখির আদল?
কি অভিপ্রায় নিঃসঙ্গ প্রভুর নাকি অন্য কোন ছল
প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি? এই পাখিটাকে
সর্বস্বান্ত করে ফেলে তাকে
রতিশূন্য করতে চান তিনি নিজের সৃজন?
পাখির আদলে পাখি শেষ ক্লান্তি করে উচ্চারণ,
ভাষাহীন ডানাহীন বিদ্যুতিন সভায়
মালিকও ঘাড়ের কাছে এসে সে সুযোগে কটুগন্ধ নিশ্বাস ছড়ায়!
বিভ্রম
হয়ত আমারই ভুল, ও ছিল না উজানের ঢেউয়ে
রূপালি রূপান্তর মৎসোজ্জ্বল উঠে ছিল ধ্বনি-বাঁধা খেউয়ে।
আসলে তাতো না- গরাসিনে কেউ দেখে নাই
চুপিসাড়ে নেমে গিয়েছিল সেই রাতে, যেদিন তেলাই,
তারপর দুদশটা জঙ্গল পেড়িয়ে এই মজা-খালে
জালপাতা ছিল বলে রেহাই পেয়েছে শেষকালে।
এও তো আমার ভুল, নাম থেকে দূর্নাম অবধি,
ও আসলে কিছুই ছিল না- না দুধ না পাতা-দধি।
বস্তাপচা যত গল্প পড়েছি এ দেশে, শেষ পরিচ্ছেদ তার
সাকার আরতি জ্বেলে হয়ে ছিল আমার আহার।
ভুল বটে ভুলই, গাঁয়ের লোকজন বলে, যা ঘুমিয়ে পড়,
টের পেয়েছি রক্তে, ভুল থেকে ভাত হচ্ছে নরকপ্রহর।
কবিতা দেবে না ধরা, এ তো আর শোভাদি না যে
আঁচলের খুঁট মুখে দ্রুত- লুকাবেন কাজে।
এ ভ্রম বিশ্বাস নিয়ে নামি যদি কবরে তোমার,
বলবে পরস্ত্রী করিস? তুই কি নোস্ তোরি মা-র!
যা সেখানে- লাউডগা বাঁক খেয়ে সূর্যের দিকে,
সেই একই বিভ্রমে আমি এখন দুধ দিচ্ছি মাহিকে!
শামসেত তাবরেজী
জন্ম ১৯৬১ সালের ৫ এপ্রিল, ঢাকায়।
লেখা শুরু করেছেন সেই ক্লাশ ফোর-এ পড়বার সময় তদানিন্তন ‘মুকুলের মহফিল’ দিয়ে। প্রথম বই ‘উদ্বাস্তু চিরকুট’, তারপর বেরয়: আবাগাবা, আম্রকাননে মাভৈ: কলের গান, হে অনেক ভাতের হোটেল (নির্বাচিত কবিতা), অবিরাম অরেঞ্জ। সম্পাদনা বলতে, বেনজামিন মলয়েজ- এর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ৩ ঘন্টার মধ্যে একটি কবিতা ফোল্ডার প্রকাশ করেন প্রয়াত বন্ধু কবি শ্যামল সেনকে সঙ্গে নিয়ে। মাও জে দং (মাওসেতুঙ), রাসুল ঝা প্রমুখের কয়েকটি কবিতা তর্জমা করেছিলেন।