পয়লা বৈশাখ করা যাবে কি যাবে না, এই বিতর্ক আজ থেকে দশ বছর আগেও আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নাই। আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নাই মানে যে বিতর্ক ছিল না, তা কিন্তু না। আমার কান কুম্ভকর্ণের কান। দশ বছর আগেও ছুটির দিন আমি বিকেল পর্যন্ত ঘুমাইতাম। আমার বিয়ের আগে আমি হাতে গুণে ২-৩ বার পয়লা বৈশাখ উদযাপনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেছি, এবং প্রতিবারই দিনশেষে প্রেমিকার সাথে আমার সপ্তাহব্যাপী ঝগড়া শুরু হইছে।
কারণ কী? কারণ আমার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না।
কারণ কী? কারণ আমার রোদের মধ্যে ঘর থেকে বের হইতে ইচ্ছা করে না।
কারণ কী? আমার ভিড় ভালো লাগে না।
কারণ কী? কারণ আমার ধুলা ভালো লাগে না।
নানা কারণে আমি পয়লা বৈশাখ উদযাপনে খুব বেশী আগ্রহী কখনই ছিলাম না। দুই-তিনবার যে প্রেমিকার সাথে গেছি, তার একটা বড় সময় সেগুনবাগিচার মোড়ে হুট তুলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হইছে। মাথা থেকে দর দর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে। আর যেহেতু রোদ থেকে বাঁচার জন্য হুড তোলা, সুতরাং আশেপাশের সবাই নাটক দেখার জন্য হুডের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে, তখন মেজাজ আরও চড়া হচ্ছে! এই চরম চড়া মেজাজ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে দেখা গেল মঙ্গল শোভাযাত্রাও অর্ধেক সমাপ্ত, আর মঙ্গল শোভাযাত্রা মিস করে প্রেমিকারও মন খারাপ। তো এই মন খারাপ আর মেজাজ খারাপের মিথষ্ক্রিয়ায় পরের সাত দিন ঝগড়া-বিবাদ।
যাই হোক যে বছরগুলোয় ঘর থেকে সকাল সকাল বের হতাম না, সেই বছরগুলো আমার পয়লা বৈশাখ উদযাপন দারুণ হতো। আব্বা-আম্মা রাতের বেলায় পান্তা ভাতের এন্তেজাম করে রাখতেন। সাথে সরষে-ইলিশ, ভাজি-ভর্তা, নানা খাবার-দাবার। পয়লা বৈশাখের দিন সকাল সকাল অর্থাৎ ১০টার দিকে ঘুম থেকে উঠে প্রিয় হাফপ্যান্টটা পরে, ঘরে এসি ছেড়ে দিয়ে আরাম করে পান্তা ইলিশ খেতে খেতে আমি টিভিতে পয়লা বৈশাখের গান শুনতাম, কনসার্ট দেখতাম আর দেখতাম বর্ণিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। সাথে পত্রিকায় নানা বৈশাখী আয়োজন, টিভিগুলোতে আজগুবি আলোচনা অনুষ্ঠান, কোন কোন চ্যানেলে নিকটবর্তী গ্রাম থেকে সরাসরি বাংলা ঢঙের পয়লা বৈশাখ পালন আমার মনকে উৎফুল্ল করত। বিকেলে সূর্য ঢলে আসলে বন্ধুবান্ধবদের সাথে পাঞ্জাবি পরে ধানমন্ডির দিকে আড্ডা – এই হচ্ছে আমার পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সুখস্মৃতি।
বিয়ের পর ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। আগে তো প্রেমিকার সাথে ঝগড়া হলে সে তার বাড়িতে থাকত, আমি আমার বাড়িতে থাকতাম। রাগ-ক্ষোভ এড়ায় যাওয়া যেত, কিন্তু এখন তো বসবাস একই ঘরে, তার উপর আবার নয়া আবু সাথে। ঝামেলা করার উপায় নাই। রাত সাড়ে ৩টায় ঘুমাতে যেয়ে আবার ভোর সাড়ে ৫টায় ঘুম থেকে উঠে গোসল করে ম্যাচিং পাঞ্জাবি পড়ে রেডি হতাম। বিয়ের পর প্রথম যে পয়লা বৈশাখ উদযাপন, তখনও আমার কোন গাড়ি নাই। রিকশায় করে শ্বশুরবাড়ি মগবাজার। সেখানে বউ-শ্যালিকা আগের থেকে রেডি। অহনাকে শ্বাশুড়ির জিম্মায় রেখে আমরা গেলাম রমনা বটমূলে। টুকটাক গান শুনে, এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে আমার প্রথম পরিপূর্ণ পয়লা বৈশাখ উদযাপন। সত্য বলতে কী; রোদ, ভিড়, ঘাম সব উপেক্ষা করেও সেই পয়লা বৈশাখের উদযাপনটাই এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় পয়লা বৈশাখ। বলছিলাম ২০০৮ সালের কথা।
তারপর যতদিন দেশে থেকেছি প্রতিবারই পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি। রমনা বটমূলে যাওয়া হয় নাই সত্য, কারণ এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করত না, কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা কখনই মিস করি নাই বলতে গেলে। টরোন্টো আসার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ তেও তুমুল বৈশাখ উদযাপন করেছি। প্রথম দিকে এই উদযাপন করতাম বউয়ের খুশীর জন্য, পরবর্তী মেয়ের বাংলা সংস্কৃতির সাথে মেলবন্ধনটা ধরে রাখার জন্য।
ওই যে বলছিলাম ২০০৭ সালেও পয়লা বৈশাখ নিয়ে তেমন বিতর্কের কথা শুনি নাই। কিন্তু পরবর্তী দশ বছরে ক্রমাগত এ বিষয়ে বিতর্ক বাড়তে দেখেছি। এটি ইসলাম ধর্ম বিরুদ্ধ, বাংলা সংস্কৃতি বিরুদ্ধ এই কথা শুনেছি, নানা যুক্তিও শুনেছি। এই বিষয়ে আমি নিজে একটা আলাদা অবস্থান অনুসরণ করি। যারা বলেন পয়লা বৈশাখ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, তাদের অনেকের কাছেই এই বিষয়ে শক্তিশালী যুক্তি আছে। আবার যারা বলেন এটা বাঙালি সংস্কৃতি না তাদের কাছেও অনেক শক্তিশালী যুক্তি আছে। যখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন নিজের মতের সাথে না মিললেই ব্যাপক চেঁচামেচি করতাম, পারলে হাতাহাতি করতাম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানটাকে বেছে নিয়েছি। অর্থাৎ আমার মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে আমি কারও সাথে সরাসরি confrontation-এ যাই না। আচার-আচরণে বুঝিয়ে দিই, তোমার রাস্তা তোমার, আমার রাস্তা আমার। জীবনের দীর্ঘ পথ হেঁটে বুঝেছি পরিণত মানুষের বিশ্বাসকে পরিবর্তন করা খুব কষ্টকর, তাই সেই চেষ্টা করি না। যার যার বিশ্বাস নিয়ে ততক্ষণ থাকতে দিই, যতক্ষন না সে তার বিশ্বাস বাস্তবায়নের জন্য অন্যের বিশ্বাসকে আক্রান্ত করে।
আমার বাসায় আমার বাবা, মা, বউ তিনজনই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। আমার আব্বা হজ্ব করে এসে পরেরদিনই টিভিতে শ্রীদেবীর নাচ দেখার সময় আমার মার ঝাড়ির মুখে বললেন, ‘আমার অন্তর পরিস্কার, কোন পাপ নাই। নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি, হজ করেছি, ঘুষ খাই নাই, শ্রীদেবীর নাচ দেখলে কোন সমস্যা নাই।‘ আমার বউ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, কোরআন পড়ে কিন্তু পয়লা বৈশাখে শাড়ি পরে ঘুরতে যায়। আমার আম্মা নামাজ-কলমা সবকিছু নিয়মিত করেন কিন্তু তার মতো আধুনিক চিন্তার মানুষ কমই আছে। তাদের কাউকেই পয়লা বৈশাখ বেদাত কিংবা হারাম এমন কথা বলতে শুনি নাই। আর আমি নিজে মানুষটা সবকিছুর পেছনে যুক্তি দেখতে চাই। ধর্ম আমার কাছে পুরাটাই বিশ্বাস আর রাজনীতির মিশেল মনে হয়, তাই আমি ধার্মিক মানুষদের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করি। তারা পয়লা বৈশাখ উদযাপন না করলে সেটাতে আমি বাগড়া দিই না।
আমার কাছে পয়লা বৈশাখ বাঙালির একতাবদ্ধ হবার সবচেয়ে বড় জায়গা। এটি বিদেশী সংস্কৃতি কিনা, সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই। বিশ্বাস করেন এই বিষয়ে আমার বিস্তর পড়ালেখা আছে। পয়লা বৈশাখের উৎপত্তি, ব্যপ্তি, ইতিহাস নিয়ে আমি আপনার সাথে ঘন্টাব্যাপী আলাপ করতে পারব, এবং আলাপ শেষে খুব সম্ভবত আপনি আমার কথা শুনে মুগ্ধও হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু আমি এই কাজটা করব না। আমার অবস্থান সহজ। আপনি যদি এটি পালন না করতে চান, করবেন না। আর যদি উদযাপন করতে চান করবেন। দেখেন, ইংরেজি নববর্ষ, ইদের আগে পরে যেই ধরণের আনন্দ উৎসব, ইদে মিলাদুন্নবী, শবে-বরাতে যে বাহুল্য উদযাপন, তাও আমাদের সংস্কৃতি না, ইসলামের রীতি না। ইউরোপিয়ান ফুটবল, বিয়ের আগে পরে চৌদ্দ রকমের অনুষ্ঠান, বেবি শাওয়ার, বইমেলা, বানিজ্যমেলা, রাতব্যাপী ওয়াজ মাহফিল, মসজিদের সামনে দিয়ে নারীর চলাচল নিষেধ, এইগুলাও বাংলা সংস্কৃতি না, ইসলামী রীতি না। ফুটবল খেলা, ক্রিকেট খেলা, ফেইসবুকে প্রোফাইল খোলা, ইসলামী টিভি, পিস টিভিতে চেহারা মোবারক দেখায়ে মানুষকে আনন্দ, উৎসব, সহিংসতায় উদবুদ্ধ করাও বাংলা সংস্কৃতি না, ইসলামী রীতি না।
আমাদের বেশীরভাগ আনন্দ-উদযাপন, রীতি-নীতি, রঙ-ঢঙ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবসের সাথে সাথে জন্ম নেয় নাই। বহু বছরের ধারাবাহিকতায় এগুলো আমাদের জীবনে এসেছে। পয়লা বৈশাখ উদযাপনও তেমনই একটা ব্যাপার, উৎসব। তারপরও বাঙালির জীবনে এই উৎসবটাকেই আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিই কারণ এটিই আমাদের, বাংলাদেশীদের, বাঙালিদের একমাত্র সার্বজনীন উৎসব। আর কোন উৎসবে সব বাঙালি একসাথে অংশগ্রহণ করতে পারে না। আনন্দ করতে পারে না। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর আর কোন ঘটনা আমাদের এতটা ঐক্যবদ্ধ করে না, যতটা করে বাংলা নববর্ষের আয়োজন।
গতকাল দেশে আব্বা-আম্মার সাথে ফোনে কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের পয়লা বৈশাখের এবছরের প্ল্যান কী? আম্মা কিছুটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, “তোমরা নাই বাবা, আমাদের আর কী প্ল্যান? প্রতিবছর তোমরা সেজেগুজে ঘুরতে যাইতা, রান্না-বান্না করতাম, কত আনন্দ হইতো।” এই যে সাজ সাজ রব, উৎসব, আতিথেয়তা এইটাই আমাদের পয়লা বৈশাখ। এর পেছনে কী ধর্ম আছে, কী ইতিহাস আছে, ইলিশ মাছ খাবেন না মুরগী ভাজা খাবেন, তাতে তেমন কিছু আসে যায় না।
এই যে একটা দিন হৈ হৈ করে সব বাঙালি একসাথে আনন্দে মেতে উঠবে, বাচ্চারা নিজের জাতীয়তাবোধের নির্যাসটুকু বাতাসে ঘ্রাণের মধ্যে নিয়ে বুকে টেনে নেবে, অতটুকুই তো চাই। এই যে তের হাজার কিলোমিটার দূর থেকে চোখ বন্ধ করলেও মনে হবে আমার দেশটা ছেঁয়ে গেছে লাল-সাদার অপূর্ব রূপ-লাবণ্যে – ওইটুকুই পয়লা বৈশাখ, ওইটুকুই আমার বাংলাদেশ।
এই উদযাপন, এই বাংলাদেশ আমার অন্তর থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
শামীম আহমেদ: বাংলাদেশী লেখক। ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোতে পিএইচডি করছেন জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়ন অর্থনীত নিয়ে। কানাডা সরকারের ডক্টরেট স্কলারশীপে গবেষণা করছেন। ৪টি প্রকাশিত কবিতার বই প্রকাশ করেছেন যেগুলো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। একাধিক সংকলিত বইয়ের সম্পাদনা করেছেন। ২০২০ বইমেলায় আসছে চারটি বইঃ কোথাও একটা লুকোনো বিষাদ আছে (উপন্যাস), দূরত্ববিভ্রান্তিতে আছি (উপন্যাস), অদ্ভুত ইঙ্গিত আসে ঈশ্বর থেকে (গল্প), তোমাকে ছুঁয়েছি তাই বিষণ্ণ হলাম (কবিতা)।