স্মৃতিকথা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
স্মৃতিকথা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ভোরের আলোয়।। তমাল রায়

ভোরের আলোয়।। তমাল রায়













আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
বৃষ্টি আসলেই কোথা থেকে এসে ভীড় করে পিঁপড়ের দল। মুখে করে ডিম নিয়েই কি ওরা চলে? সারিবদ্ধ? না’কি কিছু খবর দিতে হবে ওদের অন্য কোথাও,অন্য কোনোখানে? না’কি দেশান্তরে চললো ওরা? হলে গেছিলাম সোনার কেল্লা দেখতে।তার আগে দেখাচ্ছিলো ১৯৪৭। পার্টিশন। দেশভাগ। লোক চলেছে পিঁপড়ের মত,কার মাথায় ঘটি গামলা,হাতে ধরা ছেলে,মেয়ের হাত। ওরা কোথায় যাচ্ছে? মা বসেছিলো পাশেই। বললো দেখ আর্য ওরা কত জোট বেঁধে থাকে দেখ দেখ। আমি হাঁ করে দেখছিলাম। টুপ করে একটা বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ল,আর ওরা মুখে মুখে সে খবর দিয়ে দিলো অন্যদের।আর রুট চেঞ্জড। সত্যিইতো। - মা

আমরা পারিনা ওদের মত? একসাথে থাকতে? মা বলছিলো - ওরা একজোট বলেই তো এতদিন এই পৃথিবীর বুকে টিঁকে গেলো। আমি বললাম – আর আমরা? মা হাসলো,বললো পারতে হবে, নইলে যে হেরে যাবো সোনা আমরা সকলেই। বৃষ্টি ভিজি আর পেছন দিকে হাঁটি। একপাশে শ্মশান আর তারপাশেই গঙ্গা আমাদের ৭০ বছরের পুরনো বাড়িটা থেকে বড়জোর কুড়ি পা হাঁটলেই। রাত দুপুরে আমাদের গলিতে মরা নিয়ে ঢুকে পড়ে শ্মশানযাত্রীরা। বল হরি হরি বোল এ ঘুম ভেঙে যায়। মা আবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ঘুমিয়ে পড়ি। আর লাগাতার বৃষ্টি,উফফ ৭৮ সাল। আমি সাত পেরিয়ে আটে চলেছি, আর বৃষ্টি আসলেই কেমন সব এলোমেলো হয়ে যায় সব।  হরিদাস বাউলের গান,ঝন্টুদার কালো হজমিকে পাশ কাটিয়ে এক ছুট্টে রওয়ানা দিই বোসেদের পানা পুকুরে। গলা অবধি জলে ডুবিয়ে শুনি কচুরিপানাদের গল্প। ওরাও তো সব বন্ধু যেমন আমি অলোক,বাবু,তারক। কেবল কি করে যেন ছিটকে যায় কেউ কেউ, ভুল করে না’কি ঠিক দূরের নদীতে যায়, সে কি আর ফেরে? বাবু যেমন ফেরেনি আর,বআমরা অপেক্ষা করেছিলাম। অপেক্ষাতো করতেও হয়। তাই না? ভীড়ের মাঝে অসুবিধে হয় খুব। পাছে হারিয়ে যাই। তেমনতো কোনো নিজস্বতা নেই। ঠাকুর দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়ে কি ভয় পেয়েছিলাম, যদি ফিরতে না পারি আর! মা পইপই করে বারণ করেছিল। বাবা বলল -যেতে দাও। বড় হচ্ছেতো। পথ ভুল আমার স্বভাব আজও। মার কাছে কি করে ফিরবো, মা। কেঁদে ফেলেছিলাম। 

ফেরা সহজ নয়, ফিরতে লাগে ভয়, আমি তবু যাত্রী হব আজ।
যাত্রী তো সবাই।কেবল যারা দুর্গম কে অতিক্রম করে তারা হয় অভিযাত্রী। আলো টালো আমার ছিল না। ঢ্যাঙা, খেঙরা কাঠির মাথায় আলুরদম, এনিমিক ফর্সা, টিয়া পাখীর মত নাক, আর ইয়া বড় বড় চোখ। বন্ধুরা বলত রসগোল্লা। আকাশী বুশ শার্ট আর নেভি ব্লু হাফ প্যান্টের মাঝে তালপাতার সেপাই, চওড়া কপালে জ্যাবজ্যাবে তেল মেখে এগিয়ে চলতাম স্কুলের দিকে। তেমন দুষ্টু নই যে লাস্ট বেঞ্চার হব। তেমন ভালো ছাত্রও নই যে ফার্স্ট বেঞ্চার হব। আমি মাঝখানে রই। আর জানো, মাঝারিদের কেউ চেনেই না। অনেকটা বাবার মত। ভীড়ে হারালে খুঁজেই পাবে না মা। তাই নিজেকে লুকিয়ে রাখত। গুঁজে রাখতো মুখ বইতে। আমিও তাই। কিন্তু চাইলেই সব হয়? বেঞ্চি ভাঙা কোণের ছেলেটা চালাক বেঞ্চ নাড়িয়ে হাত তুলে নেয়, আমি জন্ম বোকা। শাস্ত্রী স্যার আমায় কালপ্রিট ঠাওরালেন। ডাকলেন। গেলাম।  সপাং সপাং বেত। প্রতিবাদটাও বেরিয়ে এলো না মুখ দিয়ে। কে যেন গলা আটকে রেখেছে। আমি করিনি স্যার। বলতে পারিনি। মা দেখে ছুটে যেতে চেয়েছিল। বাবা আটকালো, বলল এটাও জীবন। জীবনে কিছু অন্যায়কেও ফেস করতে দিতে হয়। তুমি কেন থাকবে সাথে। ওর লড়াই ওর। অভিমান হয়েছিল বাবার ওপর। কথা বলিনি দুদিন। আর মার কোলে মুখ গুঁজে কেঁদেছিলাম খুব। মাও কেঁদেছিল। পরীক্ষার ফল বেরুলে দেখা গেল ফার্স্ট। সবাই বলল শাস্ত্রী স্যারের ডোজ এ ফার্স্ট। আসলে কোনো কিছুতেই আমার কৃতিত্ব নেই। সবই অন্যের। এ কথা বুঝছি যখন মা বলছিল -ঠাকুর বলতেন লোক না পোক,অত কান দিস কেন লোকের কথায়। আমি জানি আমার আর্য পারে। বিশ্বাসটা মা গুঁজে দিচ্ছিল ভেতরে। আর আমি ছাদে বসে তখন শিখে নিচ্ছি, চিনে নিচ্ছি তারাদের।

বিশ্বাসের সে সময় বড়ই আকাল। তবু বিশ্বাসটা রাখতেও শিখতে হয়। সেটাই তো সম্পদ।
তখন আকাশে সূর্য তারা ছিল অপ্রতুল, আজও তাই, তবে দেখার সারল্য তো ভীড়ে ধাক্কা খায়। মা বলতেন বড় হবার কথা, বাবা পাঠক হতে বলতেন। জ্ঞান তেমন বাড়ে কই। তবু পড়তাম জানো, যা পেতাম হাতের কাছে গোগ্রাসে। এলোমেলো কাল বৈশাখী চলে গেলে, শিল পড়ত বৃষ্টির সাথে, আমরা কুড়োতে নামতাম। রুগ্ন ছেলে বলে মা বকত খুব। -ভিজো না জ্বর আসবে। তবু ভিজতাম, জ্বরও আসতো। আর জ্বর হলেই ওই যে মা মাথার কাছে ঠায় বসে, জলপট্টি দিচ্ছে মাথায়.. কি আনন্দ, মা শুধু আমারই। বাবার নয়, দিদিরও। দিদি খুব রাগ করত। বলত - মা কেবল তোকেই ভালোবাসে, আমার কিন্তু শুনে খুব মজা লাগত। বলতামও -মা তো শুধু আমারই, তোর কই! ব্যস আর কি রাগ খাবে না, দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। দিদি কমলা পাড় সাদা শাড়ি, আমি হ্যাফ প্যান্ট, হাফ শার্ট, দিদি সেকেন্ডারি আমি প্রাইমারী। মা বোঝাতো ছোট কত তোমার চেয়ে, অমন হিংসে করতে আছে? দিদি তো দিদিই। আমার দিদি। একটু পর সব ভুলে যেত। এই আর্য কাঁচা আম খাবি, এনেছি। বসে গেলাম পা ছড়িয়ে। কে বলবে দিদি একটু আগে বালিশ পেটা করতে গিয়ে বালিশ ফাটিয়েছে। সারা ঘর জুড়ে তুলো উড়ছে, আর আমরা দুর্গা আর অপু ফুঁ দিয়ে তুলো ওড়াচ্ছি, আর আম খাচ্ছি, এ সময়েই তো বৃষ্টি আসার কথা, আর এলোও। আর সাথে এলো ট্রেন। আমরা চলেছি কু ঝিক ঝিক করে রাঁচি।

চলা এক নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তি নয়, আসলে এক অপরূপ জার্নি। কখনো কু ঝিক ঝিক, কখনো ক্যাঁচর কোঁচড়। কিন্তু চলাই। আকাশে মেঘ দেখি, গাছের সবুজ। দূর দিয়ে কত কি যায় আসে, ভেসে যায়...বড় হয়ে ওঠার একটা সৌরভ আছে, অনেকটা ছাতিমফুলের গন্ধের মত। দেখা যায় না, কিন্তু সুঘ্রাণ আসে, আসতেই থাকে। যেমন ৭৮ এর তুমুল আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। গলি পেরিয়ে গঙ্গার জল এলো আমার বাড়ির উঠোনে। আর বেচারা শিউলি গাছের কি দুরবস্থা। হাঁটু জলে বন্দী। শিউলি হয়, খসে পড়ে। নোংরা জলেই পচে বসে। মা নীচের রান্নাঘর থেকে তুলে সরাচ্ছে সব রান্নার উপকরণ। আমি সাত পেরিয়ে আটে। কাগজের নৌকা ভাসাই জলে। আমাদের উঠোনে নৌকো ভাসে। বৃষ্টির জল পড়ে সে ডুবেও যায়, মন খারাপ। কাকলী আমার বন্ধু, সেও আসে। এক সাথে ভাসাই। ওরটা বেশী দূর যায়। আমারটা কম। ও বলে- মেয়ে মানুষের জান, কইমাছের প্রাণ। পুরুষ আর মহিলা যে আলাদা, সেটা বুঝতে শুরু করছি সবে। বন্ধুরা মিলে এক সাথে খেলতে খেলতে একসাথেই হিসি দিয়ে কাটাকুটি করি। আমারটা দেখতে এলে, আমি লুকিয়ে ফেলি। ওরা বলে তুই কি মেয়ে না’কি। মেয়েদের তাহলে লুকোতে হয়? ছেলেরা বেমক্কা, বিন্দাস! বাপি কাকু গামছা পড়ে গলির মুখে স্নান করে, কেউ কিছুই বলেনা। টুম্পার মা করলে সবাই বলে বেহায়া মেয়েমানুষ। আমি মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি। মা বলেন জগতে পুরুষ আর মহিলার শারীরিক গঠন ছাড়া আর কিছু তেমন তফাৎ নেই। পুরুষ যা পারে, নারীও পারে। সমাজ যারা চালান তারা এসব নিয়ম কানুন চালু করেন। তারা যেঁহেতু পুরুষ তাই বেশীর ভাগ আইন কানুন পুরুষের পক্ষে। বলেই বলেন- তোমার বাবা তো বাড়ির তেমন কাজ করেন না। সেগুলো তো আমিই করি। উনি কেবল বইতে মুখ গুঁজে। তা আমি কম কই তোমার বাবার চাইতে। হ্যাঁ, মা ঠিক। তাই তো। মা অবিভক্ত চব্বিশপরগণার সে আমলে ৮০০ আর ১৫০০ মিটারে ফার্স্ট হত দৌড়ে। এ কথা তো মাকেই মানায়। আর বাবা চাকরি আর বই মুখে গুঁজে সারা দিন। বাবা পড়ত সাদা, বা ক্রিম বা এশ কালারের কলারওয়ালা শার্ট। হাতা কবজি অবধি। আমি বাবার শার্টের মধ্যে ঢুকে গিয়ে বড় হলাম কতটা দেখতাম। বাবার একটা গন্ধ আছে। মারও। কেউ বকল, বা পরীক্ষা ভালো হয়নি, মার শাড়ি নাকের কাছে নিয়ে শুয়ে যেতাম। মা ঠিক টের পেতো। -ওরে দুষ্টু,খারাপ হলেই মার আঁচলে মুখ গোঁজা। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে গল্প বলত -রাজকন্যা আর রাজপুত্তুরের, আর আমি তখন ঘুমের দেশে হাঁটছি একা, রাজকন্যার সাথে। কিন্তু রাজকন্যা তো আর কাকলী হতে পারে না, জয়াও। মার মুখটাই দেখতাম রাজকন্যার মুখের জায়গায় । হাঁটতে হাঁটতে পথ পেরোতাম কত। বনের মাঝে যেই না এসে পড়া, অমনি ফুল ঝরে পড়ছে, অঝোর ধারায়, পাশে নীল রঙের নদী, একটা নৌকো বাঁধা তাতে, চড়ে বসতেই সে নীল জলের ওপর তর তর করে এগিয়ে চলত অনেক। আর আমি সিন্ধবাদ নাবিকের মত তখন দেশ খুঁজছি, এমন একটা দেশ, যেখানে কোনো কষ্ট নেই। মাকে নিয়ে যাবো সেখানে। মার তো খুব কষ্ট। দুপুর হলে আমায় ঘুম পাড়িয়ে পাশের ঘরে বসে মা চোখের জল ফেলে, কার জন্য ,আমার? আমি অনেক পড়ব মা এবার। আর রেজাল্ট খারাপ হবে না দেখো।

মা এক পূর্ণ অস্তিত্ব, সে পুড়তে থাকে। আমরা আলো পাই। খেলনা বাটি আমার খেলা খুব অল্পই হয়েছিল। প্রায়শই হারিয়ে ফেলতাম। খুব অগোছালো। জীবন যেমন যার,আর কি। সকাল বেলা মার ডাকে ঘুম ভাঙতো। শীতের সকালে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতো ধোঁয়া। মুখ চোখ ধুয়ে আবার লেপের তলাতেই, তবে শোয়া নয়, বাবু হয়ে বসা, হাত আর পা লেপের তলায়, মুখস্থ করছি -বচন দুই প্রকার, এক বচন, বহু বচন। পাশের বাড়ির রমেন কাকু পায়রাদের গম ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর রাজ্যের পায়রা ভীড় করেছে। তাদের ফট ফট ডানার শব্দ। আমার কান সেই দিকে। মা বুঝেছে, বলছে যাও দেখে এসে বস। আমি গেলাম, আমাদের বারান্দাতেও কত পায়রা তখন- মা পুষবো পায়রা। মা- না, কৃষ্ণের জীব। আটকে রাখলে, কষ্ট পায়। তোকে আমি এক জায়গায় নিয়ে যাবো, যাবি? -হুম যাবো। খুব সুন্দর জায়গা? কি আছে সেখানে, বল মা। -জায়গা সুন্দর হয় মানুষের গুণে, সব জায়গাই তো সুন্দর আর্য। সেখানকার মানুষ যেমন জায়গাও তেমন।

আচ্ছা তাহলে কি লিলিপুটরা ক্ষুদ্র বলেই ওদের দেশ এমন? আচ্ছা মা’কে জিজ্ঞেস করতে হবে। লিলিপুটের দেশে আমি আগেও এসেছি, গ্যালিভার নিয়ে এসেছিল, সত্যি কি অদ্ভুত দেশ, ওরা যখন গ্যালিভার কে বেঁধে ফেলল, আমার তো কি টেনশন। কি করি, কি করি ভাবি। খুলেই দিচ্ছিলাম, বাবা এসে ডাকলো, ঘুম ভাঙলো। ছোট পিসিমা ডেকেছেন আমায়। দেখতে চান। ছোট পিসিমা বাবার থেকে অনেকটা বড়, কেমন ঠাকুমা যেন আমার। বাবার তো খুব অল্প বয়সে তার মা মারা যায়। বড়পিসিমাও মারা গেছেন আগেই। এই ছোটপিসিমাই বাবার গার্জিয়ান। পিসিমা বসতো নীচ থেকে যে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায় তার মাঝের চাতালে, হামান দিস্তে দিয়ে পান থেঁতো করত, আর খেতো। গেলাম একটু বেলা হলে। বললেন- বস আর্য। বসলাম। পান খাবি? খেলাম। ভালো লাগত পানের রস টা। বললাম -লাল হবে ঠোঁট? তোমার ঠোঁট এমনিতেই খুব লাল।আর লাল করতে যেও না। -মাথা নাড়লাম। এবার আমায় বললেন হাত পাতো। - কেন? পিসিমা চোখ বড় করলেন। জিজ্ঞেস করতে বলেছি? মাথা নীচু আমার। হাত পাতলাম। আমায় দিলেন, পার্কারের একটা কলম। আর কালি। ঠাকুর্দা ছিলো লেখক, সে খবর রাখো তুমি? -আমি না বললাম। বললাম - কিন্তু আমি তো লেখক নই। নও তো কি, হবে। আমার মন বলছে, তুমি লিখে নাম ডাক করবে, আর আমার কাছে রেখে কি হবে, তুমি নাও আর্য। হাতের মধ্যে যেন চাঁদ পেয়েছি। পিসিমার কাছে ছুটি হতেই দৌড়ে দৌড়ে এলাম। মা..মা...তুমি কই? এই দেখো পিসিমা কি দিলো। মাকে বলতেই মা খুশী। অনেক গুলো চুমু দিলো একসাথে। সত্যি হবি তো আর্য? আমি মাথা নেড়ে দিলাম। মা বলল-প্রণাম কর। আর যত্ন করে তুলে রাখো। আর রেডি হও। বেরুবো। - কোথায়? -বলেছিলাম না।মা সেখানে কিসে করে যায়? -পায়ে হেঁটে। কষ্ট না করলে বুঝি কেষ্ট পাওয়া যায়?

সত্যিই কি তাই? কেষ্ট পেতে গেলে,কষ্ট পেতে হয়? সুভাষ স্যার বলেন স্কুলে- পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। তাহলে ঠিক ই বলেন নিশ্চিত। মার সাথে চলেছি, গঙ্গার ধার ধরে মণি মন্দির, কাঁচের মন্দির। ওখান থেকে একটু এগিয়ে একটা গলিতে। মা কড়া নাড়ল। পাঞ্জাবী পরা যে মানুষটি এলো তাকে আমি চিনি। স্বপন মামা। মার স্বপন দা। কেমন একটা জাঠতুতো খুড়তুতো। আমায় দেখা হলেই গাল টেপেন। লজেন্স দেন। স্বপন মামা কোলে নিয়ে উঠে এলো দোতলায়। এসো প্রিন্স।  আমায় যে কেন প্রিন্স বলেন, ওমা কত পাখী, সারা ঘরময়। কোনো খাঁচা নেই। উড়ছে, চলছে, স্বপন মামার কাঁধে বসছে। আমি পাখিদের নিয়ে ব্যস্ত হলাম, আর কত ফুল গাছ। ইয়া বড় বড় ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা। ভাল লাগছে খুব। আমি হাসছি খুব। খেলছি। মা স্বপন মামাকে গান গাইতে বলল। মামা গান ধরল-জূড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই, কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই। ঠান্ডা হয়ে যায় শরীর, গান শুনলেই। আমাকেও তো মা গানে ভর্তি করেছে গৌর জেঠুর কাছে। গান অল্প আমিও বুঝি এখন। দিদিও শেখে গান। আর তবলা বাজাতে আমিতো শিখেছি আগেই। দিদি গায়। আমি বাজাই। মা ধরতাই দেয়। মা নিজেও সেতার বাজান। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। আমি একদিন হাতের ওই টা মির না কি ছাড়া বাজাতে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছি তার। মা কথা বলেনি সারা দিন। কানে এলো কান্নার শব্দ। মা কাঁদছে? উঁকি মেরে দেখি, কাঁদছে মা। আর বলছে- কি লাভ বল এ জীবনে, স্বপন মামা চুপ। আমি পালিয়ে এসেছি। খানিক পর মা বেরুলো, সাথে আমিও। স্বপন মামা দাঁড়িয়ে রইল সারাটা ক্ষণ। যতক্ষণ রাস্তা না বেঁকছে, মামা হাত নাড়ছিল। মাকে বললাম-মা জায়গাটা ভালো আবার খারাপও। মা বলল -কেন?
আমি বললাম-স্বপন মামা তোমায় বকছিলো, তাই না? মা বলল -ছিঃ কক্ষনো উনি বকেন না, অমন বলতে নেই।

বলিনি। সব যে বলতে নেই বুঝতে শুরু করি সেই তখন থেকেই। নইলে কাকলী আর আমি কতবার বর বৌ খেলেছি। ও বলতো তুই জ্যাক আর আমি জিল। আমি কুড়িয়ে আনতাম লতাপাতা, জল, ও রান্না করত। তারপর আমরা পাহাড়ে গেলাম। বালি পাহাড়। আর যেঁহেতু জ্যাক, তাই পড়তেই হল পা পিছলে। কাকলী আমার কাঁধের নীচে হাত রেখে নামাচ্ছিল। আর ভালো লাগছিলো আমার। কিন্তু এবার আর ওকে বলতেই পারিনি - বৌ হবি আমার?

আকাশে তখনো প্রভূত রোদ্দুর, পাতা ঝরা আলো, আর অঝোর ধারায় বৃষ্টি। আকাশের রঙ বদলে যায়,যেমন জীবন। সেই কোন সকালে যাত্রা শুরু করেছিলাম তখনো ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি,কী নীল আকাশ,এক আকাশেই চাঁদ,সূর্য সেই তো অবাক হওয়ার শুরু,বেলা বাড়লে রোদ আসে,পুরু হলুদ রোদ্দুর। কিন্তু কোথায় কি,সারাটাক্ষণ বৃষ্টিই বৃষ্টি। ভিজে যায় চোখের তলা,মা কই তুমি? স্বপন মামা? পিসিমা তো কবেই তারা হয়ে গেছেন,রাতের আকাশ দেখলে মন বড় হয়। মা বলতেন। এই একলা জীবনে আকাশ দেখি আর তারা খুঁজি। চিনে নিতে হবে মা কোথায়,বাবা, একটু দূরে আড়ালে কিন্তু স্বপন মামাও আছেন।  আর আবার বৃষ্টি, বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলে আমি ফিরে যাই সেই অখন্ড শৈশবে আজও। মা সেতার বাজান, দিদি গান, আমি তবলা, বাবা বইয়ে মুখ গুঁজে। টুপ টাপ শিউলি খসে পড়ে, আর বড় হয়ে যেতে থাকি একটু একটু করে, হাফ প্যান্ট থেকে ফুল প্যান্টের পথে যেতে কেবল জেগে থাকে জ্বালা, কি যেন অস্বস্তি স্বপন মামার গানটা মনে পড়ে-জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই...আকাশ কালো হয়ে আসছে, এবার বোধ হয় ঝড় উঠবে।
শোকগাথা ।। এমদাদ রহমান

শোকগাথা ।। এমদাদ রহমান











হে সময় হে অগ্নি হে শিলাস্তর ... তুমি কি শিমুল! এই নাম ধরে কে কাকে তোমায়? এখনও জেগে আছে কেউ? রাজা ইডিপাস? না। একজোড়া ক্ষয়িষ্ণু চোখ! চেয়ে আছে বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদের দিকে। চোখের কুঠরিতে পূর্ণিমার ঢেউ ভেঙে পড়ে যেন জলপতনের ছলাৎ! আর, আত্মজীবনীর একেকটা খসা-পাতায় পত্রপতনশীল বৃক্ষের মতো কয়েকটি লম্বা দাগ : একটু থামো, তোমার দুপায় আজ নূপুর পরাই/তুমি থামো, এক পা তুলে রাখো আমার হাতের ওপর/হাতের তালুর ওপর, রাখো তোমার উদ্যত পা... হে শিলা! আমার জমিয়ে রাখা স্মৃতি! শহর সিলেট। পল্লবী। আখালিয়া। কুমারগাঁও... শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়... সেই একটি ভবিতব্যের গাছ। যে তুমি মহীরুহ হবে, দুনিয়ের বুকে রেখে যাবে স্কেচ... হে অগ্নি হে সময়, নমস্কার! তোমার পায়ে আমার শরণ! শরণার্থী আমি। আজ কতদূর থেকে, জানালার ঝাপসা কাচে তুমি জলছবি! হে সময় সখা... আমি তো তোমার দিকে চেয়ে। এই যে দেখো... লোডশেডিঙের রাত। পূর্ণিমার ঢেউ ভেঙে পড়েছে আমাদের উঠোন জুড়ে। আর সেই অদ্ভুত আলোয় তাকিয়ে দেখি এক অচিন দেশ। গান গাইছি বলে খুন করতে এগিয়ে আসছ তুমি! ভেঙচি কাটছি বলে আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছ তুমি! সন্ধ্যা হয়ে এলো। এখনি ছুটতে হবে জিন্দাবাজার। মোস্তাক আহমাদ দীনের কাছে, বইপত্রে। তুমি নাম ধরে বলে ডাকছ! এমদাদ। এমদাদ। আমি নূপুর পরিয়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। হে অনন্ত, আর বুঝি জেগে নেই কেউ? সবাইকে হত্যা করা হয়েছে? বাহ... কী চতুর শয়তান তুমি! কিন্তু ভেবে দেখো, তুমি কিন্তু একদিন আমাদের সামনে ন্যাংটো হয়ে পড়বে। আসলে কিন্তু তুমি তোমাকেই হত্যা করছ। একদিন তোমার সঙ্গে আমার কত কথা হতো... তোমার 'আউটসাইডার' পড়া চোখ বলত : আর কোনও জ্বলজ্বলে চোখ জানালার শার্সি গলে তাকিয়ে নেই বাইরে?
: আছে। মুখ আছে। বিগত সেই মুখে বাঁশি। বেহুলার গান!
: বেহালা!
: কে বাজায়?
: ওই, ওই তো সেই হাত, বাজাচ্ছে- নখগুলো খসে পড়ে গেছে!
: রাজা!
: তুমিই রাজা ইডি... ঘুরছি। বইপত্র থেকে, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের 'অলীক মানুষ' কিনে, জিন্দাবাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে আম্বরখানা পয়েন্ট। কোথায় চলেছি! তুমি কোথায়? আজ একটি বই দেখে এসেছি। কাল কিনতে যাব আবার। শরণার্থীর ঋতু ও অন্যান্য প্রবন্ধ। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। কতজন আমরা! এক দঙ্গল মুখ। সুবিদবাজার পেরিয়ে মদিনা মার্কেট পেরিয়ে ঢুলতে ঢুলতে ফিরে চলেছি ক্যাম্পাসে।  
: তোমার সামনে পাত্র উপচানো রক্ত। টকটকে লাল। চারপাশে খুন, আর্তের চিৎকার, নয়?
: না, আমি বীণাবাদিনি। সরস্বতী। দেখো, আমার নাভি ঝলসে যাচ্ছে।
: আমি রুগ্ন মানুষের ছায়া নিয়ে শুনি পায়ের আওয়াজ।
: জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে থাকে এইসব। ঘামে শরীর যেমন জবজব করে, চুম্বনের ঘ্রাণ যেমন পৌঁছে যায় ঠোঁট থেকে ঠোঁটে, পরস্পরের প্রাত্যহিক কথোপকথনে, মৃত্যু যেমন দৃশ্যের জন্ম দেয়, ভাঙে, গড়ে আর আমরা...
: আমি-
: আমি চণ্ডাল
: তবে দেখাও তোমার বুক!
: না
: দেখাও, নয় কেন!
: না, এ অসম্ভব আবদার। এ বুকে এ্যাপাচি হেলিকপ্টার রেখে গেছে ক্ষত!
: এসব অলীক, স্বপ্ন, মিথ্যা
: মিথ্যা! মিথ্যা হবে কেন?
: এখন তুমি, বীণাবাদিনি, অদৃশ্য হবে, ক্রমশ এবং ক্রমাগত!
: অর্জুন!
: না, এ অসম্ভব। আমার কবজকুণ্ডুলী নেই। নিঃস্ব। দেখো, চিকচিক করছে লবণাক্ত জল। বৃষ্টি হলে নাকে শুধু হারানো দিনের গন্ধ এসে লাগে। প্রতিদিন তাই এক অপেক্ষা করি, সেই ওম, মাতৃগর্ভের ওম! যদি কোনও ফেরিওয়ালার কাছে পাওয়া যায়!
: মুখের রেখায় দুই-দুইটি যুগের ঘাম, গন্ধ, জন্মাবধি মৃত চোখ-
: জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন জননী ও জনক। নিজেও সিকি শতাব্দী পার করে দিয়েছি।
: অথচ, জন্মমুহূর্তের কান্না!
: সেই কান্না আর কোনোদিন কাঁদতে পারব না।
: অর্জুন!
: অথচ, স্খলন মুহূর্তে চিৎকার করে উঠি- জন্ম, জন্ম। 
: তখন, এই অতলভ্রম কাটানোর জন্য খুঁজি তোমার অট্টহাসি। কিন্তু পেয়ে যাই তার চেয়েও কঠিন কিছু। পাথরের ভাষা। অহল্যা। 
: আজ, এই বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে, মেঘে মেঘে যখন শাদা হাতির পায়চারি, তখন তুমি কোথায়?
: সর্বনাশে।
: দেখো, বৃক্ষগুলো পত্রপতনশীল।
: মৃত।
: কঙ্কালসার।
: আমাদেরই বংশধর!
: বিষাদ?
: বিষাদ... 
: লাইব্রেরি বিল্ডিঙয়ের সামনে কদম গাছটার ঝুমবৃষ্টিতে ভিজতে থাকার এক অসম্ভব দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রায় ফাঁকা হয়ে আসা রাস্তায় আমি একদিন শুধু তোমার হেঁটে যাওয়া  দেখবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব।  
একটি শীতবাগান অথবা দূরের আকাশ ।। মেঘ অদিতি

একটি শীতবাগান অথবা দূরের আকাশ ।। মেঘ অদিতি









বসে আছি জিনিয়া কসমসের সাথে শীতবাগানে। দু'টো ইউক্যালিপটাস থেকে পাতা ঝরছে ঝর ঝর ঝর। শুকনো পাতার স্তূপ, তার নিচ দিয়ে সরসর করে কী একটা দৌড়ে পালালো। সজারু নাকি! বাগানের এদিকটায় রোদ আছে, কিন্তু হুহু হাওয়াও দিচ্ছে খুব.. কী শীত যে করে! হাতের তালু ঘষে ঘষে গরম করি আর দেখি শীতকালে ফুলগুলো কত্ত রঙে ফোটে! ফুলের গায়ে আবার হলদে ডানার প্রজাপতি, লাল-গোলাপি-হলুদ কী যে সুন্দর দেখায় তাদের। সাদা আর গোলাপি কসমস দিয়ে লতিফ ভাই এবার বৃত্তীয় পথের এক বাগান করেছে যার ভেতর কেবল গোলকধাঁধা। একবার ঢোকো যদি সেই বৃত্তে, গাছগুলো দৈর্ঘ্যে তোমার মাথায় মাথায় আর ওরা হাত ধরাধরি করে তোমার দিকে চেয়ে প্রথমেই খুব হাসবে আর তুমি আলতো করে ওদের ছুঁয়ে ঘুরতে থাকবে, ঘুরতেই থাকবে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় অবশ্য প্রথম গাছটার কাছে পৌঁছনো যায় আর একবার কেন্দ্রটা পেয়ে গেলে তখন সেটাই একটা মজার খেলা।

আমি এখন একদম প্রথম গাছটার কাছে মাথা নিচু করে বসে আছি। একটা পাখি ডাকছে টররর-টর। 

শিল্পী, তমাল কেউ  আজ আসেনি। আজ ওদের সাথে এই বৃত্তপথে লুকোচুরি খেলাও নেই। মাঝে মাঝে ওদের এই না আসাটা আমার খারাপ লাগে না। নিজের মত করে একা একা বাগানে ঘোরা যায়। দুপুরগুলো অবশ্য আমার একারই, বেশিরভাগ দুপুর কাটে সুপুরি বাগানে। মাটিতে পড়ে থাকে ছোট ছোট দুর্বল সুপুরি। সেসব কুড়োই তখন। খোসা কেটে ভেতরটা মুখে দিলে কেমন কশকশ নরম। মা দেখলে অবশ্য ধরে নিয়ে পিঠে দু’ ঘা কষায় আর বলে, পাজি মেয়ে সারা দুপুর ঘুম নেই। খালি ঘুরঘুর করা। মা যে কী! একটু এদিকওদিক হলেই বড্ড মারে। কত ব্যথা লাগে, চোখ দিয়ে জল নামে কিন্তু মা অত দেখে নাকি। সময় কই তার, আর দেখলেই কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে সে মানুষ মা নয়, ফলে চুলের মুঠি ধরে পিঠে দু’ ঘা পড়ার যন্ত্রণাকে চোখের জল দিয়ে আর নিজের মন দিয়েই শুশ্রূষা করতে হয়। মনে মনে ভাবি তখন বড় হলে সারা শহর ঘুরে বেড়াব এইসব দুপুর বেলায়। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে ডালিম কুমার এসে হেসে হেসে হাত ধরে বলে, কী গো কন্যে, মা বকলেই অমন ঠোঁট ফুলোতে আছে! আমি তো আছি, মন খারাপ করে না, চলো তোমায় মেঘের বাড়ি ঘুরিয়ে আনি। দুপুরে ঘুমোলেই এই ডালিম কুমার আসে। রাতের ঘুমে কিন্তু কক্ষনো ডালিম কুমার আসে না তখন রাতের স্বপ্নে দেখা মেলে পাতাল ঘরে ঘাপটি মেরে থাকা এক অজানা ভয়কে। এ স্বপ্নের প্রধান চরিত্র সেই পাতাল ঘর। না, ওই ঘরে আর কোথাও কিছু নেই, কেউ নেই, শুধু আছে লাল কমলা মেশানো অদ্ভুত এক আলোর খেলা আর তার ভেতর দিয়ে উড়ে বেড়ানো এক রাশ ভয়। ঘূর্ণনরত প্যানারমিক ভিউ থেকে ভয় গুলো বড় হতে শুরু করে। তাদের প্রসারিত হাতের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর তখন নদীর পাড় ভাঙছে।  ধ্বস নামছে প্রবল আর পাতালঘরের দ্বিতীয়,  তৃতীয়, চতুর্থ দরজা একে একে খুলে যাচ্ছে। 

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ভেঙে যায়। ঘরে ডিমলাইটের ভৌতিক আলো। দেয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছে একা এক টিকটিকি। অকাতরে পাশে ঘুমাচ্ছে আমার সেজদি।

বলছিলাম আজ শিল্পী বা তমাল কেউ আসেনি। তুমি অবশ্য দু’জনের কাউকে চেনো না কিন্তু বুঝে নিয়েছ ওরা আমার বন্ধুই হবে, তাই না! বন্ধুই তো, তমাল আমার এক বছরের বড় মামাত দাদা এবং বন্ধু। আর শিল্পী আমাদের প্রতিবেশী সেই মেয়েটা যার গায়ের শ্যামলা রঙ থেকে অদ্ভুত সবুজ পোখরাজ আভা ঠিকরে বেরোয়। আমরা তিনজন মিলে টিকটিকির ডিম থেকে শুরু করে বালির স্তূপের ভেতর লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট ঝিনুক, ঘুড়ির লেজ থেকে চিতল মাছের কাঁটা কত কিছুই না জমিয়ে রাখি একটা পুরনো ট্রাঙ্কে আর হাত ধরাধরি করে আকাশের নীলে একটানা তাকিয়ে থাকতে গিয়ে দেখি চিলগুলো আকাশপথে বৃত্ত এঁকে ওড়ে। মাঝে মাঝে তমাল বা শিল্পী দুজনের একজন হয়ত থাকে না। কখনও দুজনের কেউই থাকে না, যেমন আজ। ভাবছি আজ আমি ফুলেদের বন্ধু হব। কসমস, জিনিয়া আর বোতাম ফুল  এ কথা বুঝতে পেরে হেসে উঠল আর আমায় ছুঁইয়ে দিল ঠিক তক্ষুনি। রঙের গায়ে এসে পড়ল প্রজাপতি ডানায় ভরা রোদ্দুর। কত যে আলোর ঢেউ উঠেছে তখন। সে ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে কানে ভেসে এলো মন্দ্রস্বর। 

কান পাতলাম। একটানা ভেসে আসছে সে গম্ভীর ডাক। মা বলল, ওই দেখো সমুদ্র। সমুদ্র? কিন্তু কী করে! আমি তো ছিলাম শীতবাগানে জিনিয়া ডালিয়াদের হাত ধরে। তাকিয়ে দেখি মেজদি, সেজদি ঢেউয়ের সাথে আলাপ জুড়েছে মন দিয়ে। বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে দেখছি মস্ত আকাশ মিলেছে দূরে অগাধ জলরাশির সাথে আর সেখান থেকে উঠে আসছে একটানা গম্ভীর সুর.. বুক হুহু করছে সেই ডাকে। ভেতর ভেতর দুমড়ে যাচ্ছে যেন কী.. বালিয়াড়ি ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছে ঢেউ। আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে মা, যেমনটা মা বাইরে কোথাও এলেই করে। বাবা কিন্তু হাত ছেড়ে দেয় বলে একা হাঁটো। নিজে না হাঁটলে কিছু শেখা হয় না।  মা অমন করে ভাবে না, মা ভাবে হাত না ধরলে পথ ভুল হতে পারে। আমি অত বুঝি না, মার হাতে শক্ত করে ধরে রাখা আমার হাতটা টেনে নিজের দিকে ফেরাতে চাই। মা ছাড়ে না, বলে ওই দেখো কত বড় ঢেউ আসছে। একা সামলাতে পারবে না তো। হাত ছেড়ো না। তাকিয়ে দেখি কি সুন্দর সাদা ফেনার মুকুট পরা জল উঠে আসছে আমাদের দিকে। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি। জল কাছে এলে মা আমাকে তুলে ধরার আগেই খানিক জল মুখের ভেতর ঢুকে পড়ে আর আমি অবাক, এ তো জল নয়, কী নুন.. হাত থেকে তক্ষুনি রুমালটা টুপ করে পড়ে জলে আর ঢেউয়ের সাথে দূরে সরতে থাকে দ্রুত। আরে আরে ও তো আমার প্রিয় রুমাল এক, তুমি তাকে কেন টেনে নিচ্ছ নিজের দিকে? জল দ্রুত তাকে নিয়ে ফিরে যায় নিজের বাড়ির দিকে নাকি আকাশের কাছে.. আমি ভাবি গোলাপি  ফুল আর সবুজ  ডাল আর পাতা আঁকা হেমসেলাই দিয়ে চারদিক মোড়া সে রুমালের কথা আজ যে আমায় ফেলে ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে আমায় ফেলে হারিয়ে গেল। প্রিয় কিছু হারাবার যন্ত্রণা সেই প্রথম। বুকে যন্ত্রণা বিদ্ধ হতে হতে কেঁদে ফেললাম শেষে। মা বলল, কী হলো? আমি বললাম রুমাল.. মা বলল চল ফিরতে হবে.. আমি মুখ লুকিয়ে বললাম রুমাল… সমুদ্রের একটানা ডাকে আমার শব্দগুলো কোথাও হারাতে থাকলো। আবার একটা বড় ঢেউ উঠে এলো আর জলের ঝাপটায় আমি হারালাম নিজেকে।

একটা রুমাল দিয়ে হারানো শুরু। তারপর ডাকটিকিট জমাবার খাতা, প্রিয় বই, চুলের গার্টার,  পেন্সিল কত কী  হারিয়ে গেছে। কিন্তু রুমাল হারাবার দুঃখ ঘুচে গেল যখন লতিফ ভাই দুটো পরীর ডানা সেঁটে দিল সেবার বাড়ি ফিরবার পর। তুমি কি দেখতে পাও, সে ডানা দুটো কী করে যেন আজও আমার পিঠে রয়ে গেছে.. ও, হ্যাঁ তুমি জানতে চেয়েছিলে কে এই লতিফ ভাই যার কথা তোমায় আমি প্রায়ই বলি! লতিফ ভাই আসলে আমাদের বাড়ির সমস্ত কিছু দেখাশোনা করত। কোন ছোটবেলা আসাম থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছিল বঙ্গদেশের এক ছোট্ট মফস্বলে আর কবে যেন আমাদের পরিবারে যোগ দিয়ে হয়ে উঠছিল পরিবারেরই একজন। সেদিন আমার পিঠে পরীর ডানা সেঁটে দিতে দিতে লতিফ ভাই  বলল, আজ থেকে তুমি আমাদের পরী। হোক কাগজের আমার কাছে কাগুজে ডানা আর সত্যিকারের ডানার পার্থক্য কই তখন। ডানা আর তার প্রাপ্তিতে আমার তখন কী আনন্দ, কিন্তু পরী না নিজেকে পাখি ভাবতে চাইছি তখন, বাবাকেও বলছি এ ডানায় ওড়া যাবে কি না পাখির মত। পাখির ডানা, পাখির ওড়ার কথায় বাবা এনে দিল ‘আকাশ যারা করল জয়’,  খুলে দেখি উইলভার রাইট আর অরভিল রাইট আমার ঢের ঢের আগেই ওড়াওড়ির কথা ভেবেছিল। আহা উড়োজাহাজ ওতে করে আকাশে ওড়া যায় কী আনন্দ গো!  বাবা বলল শুধু কি উড়বি, বসবি না কোথাও এক দণ্ড! হ্যাঁ তাই তো, লেবুমামার সপ্তকাণ্ড তখন পড়ে আছে উঠোনে বিছানো মাদুরের ওপর। বসিই বরং।  মাথার ওপর ছায়া দেওয়া বেলফুল গাছের ডালগুলো একে অন্যকে জড়িয়ে উঠে যাক আরও অনেকটা আকাশের দিকে। বই বন্ধ করে আমি আবার সেই আকাশ দেখি। ঝকঝকে এক মস্ত আকাশ আমায় দেখে হাসতে থাকে। 

দু’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলি, একদিন ঠিক পাখি হব দেখো, উড়ে বেড়াবো তোমার সমস্ত শরীরে, নীল থেকে দূর আরো দূরের নীলে, পাখি হব আমি, দেখো...

ছেলেটা, শেরশাহ ও আরিফ ভাই ।। অপরাহ্ণ সুসমিতো

ছেলেটা, শেরশাহ ও আরিফ ভাই ।। অপরাহ্ণ সুসমিতো












প্রথমা :

সাত বছরের ছোট্ট একটা ছেলে। হাফ প্যান্ট পরে। বাসার পাশেই মাঝারি আকৃতির এক পাহাড়। লোকজন ‘টিলা’বলে। ঝোপ ঝাড়ের পাশে সারাদিন হৈ চৈ। স্কুলের লাইব্রেরী থেকে নিয়ে আসা লেবু মামার সপ্ত কাণ্ড, মামার বিয়ের বরযাত্রী পড়ে। পাঠ্য বইয়ে দারুণ অনীহা। সকাল বেলার মক্তবের হুজুরকে আরো ভয়। তেল মাখানো কচকচে জালি বেতের ভয়। মুশকিল হচ্ছে নিজের মার খাওয়ার জন্য নিজেকেই বেত এনে দিতে হয় হুজুরকে। ছেলেটার স্কুলে খাদিম স্যার বাংলা পড়ায়। বাংলা পড়ানোর মাঝখানে হঠাৎ হঠাৎ কি যেন বলতেন স্যার, ওটা কি ভাষা ওরা বুঝত না। কঠিন, অন্যরকম। ক্লাসের ছেলেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত, কি বলে খাদিম স্যার? মোটাসোটা তেলতেলে দেখতে খাদিম স্যার। সারাদিন মুখে চোখে বিরক্তি, যেন চিরতার পানি খেয়ে এলো এই মাত্র। ক্লাসের পড়া না পারলে জুলফি ধরে বেমক্কা টান, ব্যথায় ককিয়ে উঠত ওরা।

মুখে বলতেন স্যার: বল পাকিস্তান।
খাদিম স্যারের বিরক্ত মুখে তখন কী হাসি!
আগস্ট মাস এলেই সারা স্কুলে সাজ সাজ রব। কত রিহার্সাল। মাখন ভাই স্কুলের স্কাউট লিডার। কোমরের কোন জায়গায় পতাকার স্ট্যান্ড ঠেকিয়ে পতাকা ধরবে, কি ভাবে সবাই লেফট-রাইট করবে, খাদিম স্যার সবার সামনে থাকবেন। কুচকাওয়াজ করতে করতে সবাই সার কারখানার প্রধান অফিসের সামনে যাবে। কোরাস গাইবে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’। কারখানার মহা-ব্যবস্থাপক পতাকা উত্তোলন করবেন। পরে সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো হবে। স্কুল ছুটি। রাতে স্কুলের মাঠে ক্যাম্প ফায়ার। মাখন ভাই তখন একদম হিরো। তখন কী দাম তার! মাখন ভাই পুরো স্কুলের লিডার। মাখন ভাই স্কুলের যে কোনো ছেলেকে যদি ডেকে বলে: শোন তাড়াতাড়ি পকেট থেকে দশ পাই বের করে দে। স্কুলের যে কোন ছেলে সে আদেশ পালন করতে পারলে ধন্য। আহ, মাখন ভাই আমাকে চেনে।

দুপুর বেলাটা খুব গরম। সারাদিন চিনচিন করে ঘাম। স্কুলের শুকনো কদম গাছটার নীচে পকেট ভর্তি মারবেল নিয়ে খেলা। হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ দিয়ে দিলেন হেড স্যার মানে রাজ্জাক স্যার। তার আগে ক্লাসে ইয়াহিয়া স্যার কি যে বললেন মনে নেই, যেটুকু বলা হলো তার মানে কাল থেকে স্কুল ছুটি, আসতে হবে না। কবে খুলবে পরে জানিয়ে দেবে। কী খুশি সবাই, পড়াশুনা নেই, বাড়ির কাজ নেই, খাদিম স্যারের জুলফি টানা নেই। ‘পাকিস্তান’ বলতে হবে না। আহ!

বাসায় এসে ছেলেটার মন খারাপ হয়ে যায়, লাইব্রেরীও বন্ধ থাকবে। গল্পের বই পাবে কোত্থেকে? সাত্তার স্যারকে জিজ্ঞেস করতে হবে তো। সন্ধ্যায় ঘুমে আর চোখ ঢুলে আসে না। পড়া নেই। বাবা ঘরে ফিরলে গম্ভীর গম্ভীর লাগে। মা বা বাবা কেউ পড়তে বলছে না। বড়দার থাপ্পড় নেই আজ অংক ভুল করলে। হঠাৎ অনেক রাতে কিসের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। কিসের শব্দ? কোথায় যেন রেডিও বাজে। কান পেতে শোনার চেষ্টা। ওদের বাসায় তো কখনো রাতে রেডিও বাজে না পড়াশুনার ব্যাঘাত হবে বলে। বাবা কি যেন শোনার চেষ্টা করছে রেডিও’র নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। হঠাৎ পেছনের দরজায় জোরে জোরে শব্দ । ফয়েজ কাকা’র গলার শব্দ। বিরাট গলা : মতিউর সাহাব, হে মতিউর সাহাব।
বাসার সবার ঘুম ওখানেই শেষ। ফয়েজ কাকা’র কথা স্পষ্ট বোঝা যায় না। কি রকম অদ্ভুত করে কথা বলেন, খাদিম স্যারের মতো। ফয়েজ কাকা’র ছেলে শেরশাহ খান ছেলেটার সহপাঠী। শেরশাহ’র সারা আঙ্গুলে পাঁচড়া আর নাক ভর্তি সর্দি। শেরশাহ ছেলেটাকে প্রায়ই বলে :
হাম শেরশাহ খান, তু টিপু মিয়া। হাম বিহারী, তু বাঙ্গাল। আয় মারামারি করি।
ছেলেটা ওর হাতের খোস পাঁচড়া দেখে মারামারি করতে যেত না, অবশ্য শেরশাহের সাথে হেরে যাবার সম্ভাবনাও আছে।
ফয়েজ কাকা বললেন অত রাতে বাসায় এসে: মোকাম মে পাকিস্তানী ঝাণ্ডা হ্যায় ?
বাবার মুখটা খুব চিন্তিত: না, নেই।
: কুছ পরোয়া নেহি। আপলোক সব হামার বাসায় চলে আসেন। ঘাবড়াও মাত।

সবাই ফয়েজ কাকাদের বাসায় যাবার জন্য রেডি হলেও ছেলেটার মনে হলো ফয়েজ কাকা’র মুখে কোথা থেকে যেন খাদিম স্যারের তেলতেলে মুখ এসে মিশে গেছে। বাসায় ওকে একা পেলেই ওর জুলফি টেনে ধরে বলবে: বল পাকিস্তান।

ছেলেটা মার্চ মাসের শেষের দিকে অনেক রাতের গভীরে বিহারী ফয়েজ কাকা’র বিশাল শরীরের সামনে বলে উঠল: না যাব না।

মধ্যমা:

কি ঠাণ্ডা। লেপের মধ্যে কি যে আরাম। উঠতে ইচ্ছে করে না। কাছে দূরে গোলার শব্দ। বন্দুকের গুলির শব্দ। শব্দে ছেলেটার ঘুম ভেঙ্গে যায় পুরোপুরি। চোখ খুলে যে প্রথম ছবিটা সে দেখতে পায় সেটা হলো একটা বিরাট গোঁফওয়ালা মানুষের ছবি। ছেলেটা গোঁফের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোত্থেকে এত শব্দ? বিছানার উপর উঠে বসে। বাবা জোরে রেডিও ছেড়ে দেন। কী সুন্দর গান বাজছে। এত সকালে এত জোরে ওদের বাসায় কখনো রেডিও বাজতে শোনেনি। বাসার সবাই পিটপিট করে জেগে ওঠে বড়দা, স্বপন, সোহেল। মনি তখন খুব পিচ্চি। সবার চেঁচামেচিতে মনিটা ক্যাঁক্যাঁ করে কাঁদে গলা ফাটিয়ে। ভীতু স্বপন ওর দুধের বোতল খুঁজতে লেগে যায়। বাবা সবাইকে জিজ্ঞেস করে, চোখে মুখে কি খুশি!
: কি খাবি তোরা আজ?
: মাছ খাব।
সবাই সমস্বরে বলে ওঠে। মাছ খাবি তোরা? বাবা হতভম্ব। বাবা জামা গায়ে ছুটে যান ফয়েজ কাকার বাসায়। ছেলেটাও পিছু পিছু। বাবা বলছেন ফয়েজ কাকাকে
: আপনাদের বাসায় বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ আছে?
: না-ফয়েজ কাকা’র ভীতু উত্তর।
: আমাদের বাসায় সবাই চলে আসুন। বাবা খুশি খুশি হয়ে বলেন। ছেলেটার বলতে ইচ্ছা করে শেরশাহ খানকে -
: আমি টিপু, তুই শেরশাহ। আমি বাংলা, তুই পাকিস্তান । আয় মারামারি করবি?

সমাপ্তি :

হুমায়ুন কবির আরিফ ছেলেটার খালাতো ভাই। বয়সের বিশাল পার্থক্য থাকলেও দু’জনের অন্যরকম বন্ধুত্ব। অসম বন্ধুত্ব। আরিফ ভাই ওকে উদয়ন পত্রিকা দিয়ে বইয়ের মলাট দিয়ে দিত। রুশ দেশের বিখ্যাত লোকদের ভিউকার্ড দিতেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের গল্প শোনাতেন। ঘোড়াড্ডিম, ছেলেটার মাথায় এত কিছু ঢোকে না।

বড়দা ছেলেটা এক ক্লাস উপরে নীচে। দেশ স্বাধীন হলে ওরা দু’জনেই পরীক্ষা ছাড়াই পরের ক্লাসে প্রমোশন পেয়ে যায়। বাজারে নতুন বই নেই, থাকলেও ছেলেটার কপালে নেই। ও বড়দার এক ক্লাস নীচে দেখে সবসময় বড়দা’র পুরনো বই পেত। কখনো নতুন বই পেত না। কী যে মন খারাপ তাতে!

আরিফ ভাইয়ের সে কি আগ্রহ, বইয়ে যেখানে যেখানে পাকিস্তান লেখা সেখানে কেটে কেটে বাংলাদেশ লিখছে। কী উৎসাহ আরিফ ভাইয়ের। ছেলেটা খুব মিষ্টি খেত। একদিন দুপুরবেলা সবাই ঘুমিয়ে, আরিফ ভাই ওকে বললেন: টিপু মিষ্টি খাবি? ওকে আর পায় কে? আরিফ ভাই গম্ভীর মুখে যা বললেন তার অর্থ এই যে এজন্যে হাঁটতে হবে অনেক দূর। ছেলেটা তবু রাজী। হাঁটতে থাকে ঢালু সড়ক বেয়ে। রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ একটা দুইটা গাড়ী হুঁশ করে চলে যায়। জামশেদ কাকার দুটো বউ। দুপুরের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে ভেঙ্গে বড় বউয়ের ছেলে শামীমকে পেটায় জামশেদ কাকা। শামীমের সে কি আর্ত চিৎকার। চিৎকার ছাপিয়ে কারখানার শিফট বদলের সাইরেন বেজে ওঠে। একটা মাঝ বয়সী লোক দুটো গরু পিটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইন্দানগর চা বাগানের দিকে, গরু খোঁয়াড়ে দেবে বলে। খাদিম স্যারের বাসার পাশ গলে আরিফ ভাই আর ও হাঁটতে থাকে। স্যারের বাসায় বিরাট এক তালা। ছায়ানীড় সিনেমা হলে ম্যাটিনি শো শুরু হবে হবে করছে। মাইকে জোরে গান বাজছে “নীল আকাশের নীচে আমি / রাস্তায় চলেছি একা”।

পেট ভরে মিষ্টি খায় ওরা দু’জন কলা মিয়ার মিষ্টির দোকানে। মাছি উড়ছে টেবিলে টেবিলে। দুপুর বেলাটা উড়তে উড়তে চলে যায় কালো ওড়নার মতো সন্ধ্যার দিকে। আরিফ ভাই চলে যান অস্ত্র জমা দিতে, তার আগে লম্বা চুল কেটে ফেলেন নিরঞ্জনদা’র দোকানে। সেই যে অস্ত্র জমা দিতে গেলেন আর ফিরলেন না।

জীবনটাও জমা দিয়ে বেঁচে থাকলেন স্মৃতিতে। এখনো।

চ্যাবর চ্যাবর ।। প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়

চ্যাবর চ্যাবর ।। প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়









ফড়িং, এই শ্যালা ফড়িং ঘঁচু ফড়িং... রাম চেয়েচে,হুস্কি দিলি ক্যানো?” বিন্দাদা চিলচিৎকারে দোকান সরগরম। ছোকরা ফড়িং এক্কেরে ল্যাজে গোবরে। দোকানের বাদবাকী খদ্দেরদের গেলাস থেকে চাউথলিয়া ধায় বুড়োদা সাত সকালেই আড়াই প্যাঁচ চার্জ করে বুদ্ধ। আমি দেখেসুস্থিত জিভ কোনোমতে নাড়িয়ে বললো, সেবাদা লিকার খায়, দুধ চা দেওয়া হয়েছে।
সেবা দা মানে সবিতাব্রত। সবিতাব্রত দত্ত। সেই সাদাকালো চারণ কবি মুকুন্দদাসের উদাত্ত নাটকিয়তা। বুঝলাম, আজ কলির সন্ধিপুজো। সক্কালবেলা  বিন্দাদা মেজাজ যখন চড়েছে , যতোই কালোসোনা মার্বেল পেটে যাকনা কেন, সহজে নামবে না। মাঝখান থেকে আমাদের ধারের তেরোটা। এমনকি বয়াম ভাঙা আলমারির পেছনের ইঁদুর অন্ধকারে, ঘেঁষাঘেঁষি উবু হয়ে ব্যোম শঙ্করী উড়ানও বহুত বাম্পি রাইড। আমাদের আব্বুলিস চোখে, ফড়িং তখনহায় বিছুয়া, ডস্‌ গ্যায়ো রে

সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কে এবার একটা ইজিক্যলটু দেওয়া যাক, - বিন্দাদা মানে বৃন্দাবন, বৃন্দাবন রক্ষিত। দোকানটা দক্ষিণ কলকাতায় এবং দোকানটা চায়ের। ফড়িং = ফড়িংহাফ প্যান্টে একটা বোতাম, বাকী সব ঝুল্‌ঝুল্‌। আমি আমরা    আত্মপক্ষে পরদ্বারেষু এবং বুড়োদা আড়াই প্যাঁচ মানে টু অ্যান্ড হাফ ম্যানড্রেক্স। বিন্দাদা বেচতো না, খেতো না কারণ সে নাকি স্বয়ং বাবা আদেশে, কালাসোনা মানে আফিমে ডুবুরী। আমরা - একা এবং কয়েকজন, বিড়ি সিগারেটের প্রাইমারি কেলাস টপকে, গঞ্জিকায় ইন্টার্নশিপ করছি আর মাঝে মধ্যেইদুরু দুরু বক্ষনিয়ে 2আনাড়ুতে ইন্টারভ্যিয়ু দিতে যাই। সবই হয়  বিন্দাদা চায়ের দোকানের ২৫ মিটার রেডিয়াস ঘিরে। আর এইসব সাই-ফাই ফিউশনের নিউক্লিয়ার ফল্‌ -আউট যাতে  দোকানের সামাজিক সাইনবোর্ডে টোল খাওয়াতে না পারে, ডবল্‌ হাফ চায়ে লেড়ো বিস্কুট ডোবানো নির্ভেজাল গেরস্ত খদ্দেররা ছোঁকছোঁক সন্দেহ করলেও, কোন প্রাইমা ফেসিয়া এভিডেন্স যাতে না পায়, তার দিকে লাইটহাউস সতর্কতায় প্রেসিডেন্টদা অতন্দ্র। কেন প্রেসিডেন্ট উপাধি, জানা নেই কিন্তু প্রেসিডেন্ট  ইন্ডিয়ান কন্সটিপেটেড কন্সটিট্যুশানের মতো সধবার একাদশীমূলক নয় বরং পাওয়ারে বিভীষণ স্যামচাচাম্যারিকা যাকে তাকে, সামান্য বেগড়বাই দেখলেই, তর্জনী চিহ্নিত করে  আড্ডা থেকে বার করে দেওয়া চ্যালেঞ্জহীন থাকার ক্ষমতায় বলীয়ান। এমনকি নিজেকেও।ভোকাট্টাবলে, কেৎরে যাওয়া লাট্টুর মতো আধপাক ঘুরে, দোকানের  ঝুলকালির মধ্যে নিজেকে গর্ভজাত করার প্রাক্‌ মুহূর্তে, আঙুল নেড়েডিস্‌পার্স’  ইংগিতে জমায়েত  ফাঁকা করে দিতোযদিও তা কাবুলিওয়ালার বৌ দেখার মতোই অতি দুর্লভ ঘটনা। হ্যালি  ধূমকেতু কতো বছর বাদে ফিরে ফিরে আসে; এর সঙ্গে নাকি প্রেসিডেন্টের স্বেচ্ছা নির্বাসনের একটা যোগ আছে। ওর ল্যাঙ্গোটিয়া দোস্ত কেল্টুদা, আর টিক্‌রমবাজ বিভু সেরকমই প্রবচন ঝাড়ে।

হেন প্রেসিডেন্টের আসল নাম খোকনদা, আরও আসল নাম রেশন কার্ড জানতো। আমরা না। বিন্দাদা অটুট আস্থা আর যাবতীয় ডেটা-বেস্‌এর জিম্মাদার ছিলো প্রেসিডেন্ট, পাসওয়ার্ড সমেত দুজনের সাংকেতিক চোখাচোখি আর তারপরেই বিন্দাদা গলার ঐশ্বর্যশালী কারুকাজ দেখার মানে শোনার মতো। এই খাদ তো সপ্তক। সামনের যে ব্যক্তি খাদের সম্মুখীন, সে বুঝতো আরও কিছুদিন অন্তত তার দৈন্যতার গোপনীয়তা, গোপনীয়ই থাকবে আর সপ্তক যখন আছড়ে পড়তো, বুঝে যেতো, সীতার পাতাল প্রবেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়এমনকি আমাদের মধ্যেও কেউ যদি চা-ঘুগনি-ডিমভাজা-কড়কড়ে টোস্টের সাপ্তাহিক রেশন না তুলতো অথবা যে কোন ভাবেই হোক, ৪নং তাম্রলিপি খাতার এক পিঠ ভরিয়ে ফেলতোপ্রেসিডেন্ট সামান্য  ভাবে তার অসামান্য  দড়ি হাত দাড়িতে বুলিয়ে, ছিলিমটা পাশের জন কে টপকে দিতো। যে বোঝার, পড়িমরি উঠে রেস্ত জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। মোদ্দা কথায়, নেশাড়ু বাবা মহাদেবের দাপটে সন্তান গণেশ যাতে না ওল্টায়, প্রেসিডেন্ট ব্যপারে গ্রেড- ওয়ান ফিফা  রেফারী।  থেকে থেকেই হলুদ কার্ডলাল কার্ড ঝলসে উঠছে, অবিকল ’’৭০ এর ইস্টবেঙ্গল। আজন্ম মোহনবাগানী ভবানীপুরে, নৈহাটির টোলে  ব্রাহ্মদের জুতো পায়ে মশ্‌মশিয়ে ঢুকে, আত্মার স্বরূপ নিয়ে ক্রস-এক্সামিন করার মতোই ব্যাপার।     বাঁ হাতের বাঘ থাবায়সাইকেলের হ্যান্ডল আর ব্রেকের মধ্যবর্তী গ্যাপ সামলে, ডান হাতে ছিলিম নিয়ে আকাশের দিকে ধোঁয়া উদগীরণের মতোই একরোখা বুকখোলা মাস্তানি; এখন এইসব মনে পড়লে হাসি পায়, আজকালকার প্রফেশনালদের মতো না   হলেওহয়তোবোহেমিয়ানদেরও নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা চালাতে তখন একধাঁচের সিইও’’ দরকার ছিলো।  তা সেই সিইও  খোকনদা ওরফে প্রেসিডেন্টের ফী ছিলো, সকালের তিন-এর পর বিন্দাদার স্পেশাল ঘুঘনী, হাফ রুটি আর দেড় গেলাস চা। প্রথমটা চার্জের জন্য কোঁৎকোঁৎ, হাফ্‌টা চারমিনার ধরিয়ে সিপ্‌সিপ্‌।

বিন্দাদা চায়ের দোকানের সুখ্যাতি ছিলো কলকাতা-২৫ জুড়েই। প্রধানতঃ পাতা চাচিনি কম - তিতকুটে গাঢ় রঙপাহাড় পাহাড় গন্ধ আর যে পাহাড় মানেই লিং। গিরিশ মুখার্জী রোডের আরেক বুড়োদা,তাঁর বিশাল বপু হৃদয় দিয়ে তো বলেই ফেলেছিলো,“বেন্দা তুই অমর হবি রে! দাদা কী সাধে তোকেচাস্কারদিতে চেয়েছিলো ? ”  দাদা মানে, ‘কে জানে ’’ঘণ্টা / পাবে রে জীবনটা’-সেই মোহময় সাদাকালো ম্যাজিক কোমর! বুড়োদা তস্য  ভ্রাতা, তরুণ কুমার।  সবই ছিলো চায়ের দোকানী বৃন্দাদা ক্যাপিটাল। এর জোরেই সে থিয়েটার সেন্টারে নবাগত অভিনেতাদের সুস্মিত জ্ঞান দিতো, ওইখানটায় একটু কম চাইছিলো না?” এখানেই একদিন থিয়েটার সেন্টারের কর্ণধার তরুণদা(রায়) ধরলেন মোহিতদা(চট্টোপাধ্যায়) কে। মোহিতদা তখন বোধহয় কবিতা আর ছোটগল্পে বাংলাবাজারের ভিত কাঁপিয়ে নাটকের অঙ্গনে এসেছেন আর সেখানেও ব্যাপক কাঁপাচ্ছেন। বেঁটেখাটো শুচিস্মিত মানুষ। দেখলে মনে হয়, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না। তরুণদা কথায়, এর লুক্‌- গেলে ভিটেমাটি চাটি হবে, ব্যাটা হারামির হাতবাক্স। মখমল মসৃণ কথা বলার  কায়দা, বুঝতেই পারা যেতো না কখন পিছলে বেরিয়ে গেছেন। তা এই যে  মোহিতদা, থিয়েটার সেন্টারের জন্যে একটা নাটক দেবেন বলে কথা দিয়ে ফেলেছেন আর যায় কোথাতরুণদা যতোই একাগ্রচিত্তে ছিপ ফেলে বসেন, পাকা মাছ চার খেয়ে পালায়। চার মাঝে মধ্যেই লোভনীয় হয়। লোকমুখে খবর যায়,(হায়!মোবাইল) শালার ব্যাটাকে বল্‌, ওর বৌদি মাংসের ঘুঘনী করবেওমুক দিন যেন আসে।শালার ব্যাটা আসে, তারিয়ে তারিয়ে ঘুঘনী খায়, বৌদি(দীপান্বিতা রায়) হাতের প্রশংসা করে শতমুখে, আরও দাম্পত্য খচরামির ইন্ধন জুগিয়ে যায়। যেমন, তরুণদা মত লোকের সঙ্গে ঘর করা কতো শক্ত, বৌদি আপনি বলেই পারছেন ইত্যাদি। পরক্ষণেই ট্র্যাপিজে ব্যালেন্স, আরে তরুণদা, আপনাকে তো বলাই হয়নি, শম্ভুদা যা একখানা কেলো করেছন না ... বিস্তর হে হে হি হি, আর তারপরেই, এক পেয়ালা কফি (তরুণদা- কাজদেখে কারা  কারা ভেতরে ভেতরে ফ্ল্যাট অথচ মুখে রা কাড়ছেনা, সেইসবঅন্দর কি বাৎরসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা। পাবলিক খুশ।  উনিও পরিপাটি নীল রুমালে মুখ মুছে, ওপর থেকে নেমে বেন্দাদা চায়ে চুমুক দিলেন। নিটফল,নতুন নাটকের তাগাদাটা আরও এক হপ্তা পিছলো আর আমরা গুটিকয় চৌবাচ্চা, নাটকের মহীরুহদের বিবিধ হাঁড়ির খবরে সমৃদ্ধ হলাম।

কিছুতেই আর অবাক না হওয়ার বয়েসে এসেছি এখন ,তবু এই ঘটনাগুলো মনে পড়লে দুটো বিষয়ে খুব অবাক লাগে বৈকি।  প্রথমত: তরুণ রায়ের নাট্যচর্চা সেইভাবে স্বীকৃত হলোনা। হয়তো একটু কংগ্রেসি মনোভাবাপন্ন ছিলেন বলেই,সুদীর্ঘ বাম শাসনে ওনার হাঁটুর তলায় বসারও অযোগ্য লোকজন বিভিন্ন পুরস্কার বা উপাধি  বিভূষিত হয়েছিলেন।  অথবা মূল গ্রুপ থিয়েটারের মেধা কেন্দ্র(!) একাডেমী বহির্ভূত যে প্রফেশনাল স্টেজ, সেখানকার নাট্য প্রচেষ্টাকে হেয় চোখে দেখা। সেদিক থেকে সারকারিনা বা প্রতাপ মঞ্চে চলা নানারকম ব্লো-হট, ব্লো-কোল্ড নাটক বা সমরেশ বসু রদ্দি মার্কা উপন্যাসের আরও রদ্দি নাটকগুলো তবু বড়ো হলেহাউস ফুল-’এর সুবাদে, মাঝের পা চুলকানো দর্শকদের কৃপা ধন্য ছিলো।  সে সবই ছিলো বাণিজ্যিক  থিয়েটার পাড়ায়। কিন্তু, দক্ষিণ কলকাতার বেশ ভেতরে, ছোট্ট হলে, তরুণদা দিনের পর দিন যেভাবে নিরলস নাট্যচর্চা করেছেন, তার তুলনা পাইনি। পুরো পরিবারটাই ছিলো নাটক নিবেদিত। স্ত্রী দীপান্বিতা রায়, পুত্র দেবরাজ রায় তারপরে পুত্রবধূ অনুরাধা রায়, সবাই মিলে স্টেজ মাতিয়ে দিতেন। বিভিন্ন স্বাদের নাটক লিখেছেন উনি, একসময়ে ছদ্মনাম নিয়েছিলেন, ধনঞ্জয় বৈরাগী। আজ  এই পরিবর্তন-এর বাজারেও কিন্তু কাউকে এইসব নিয়ে কথা বলতে শুনি না।  হলটাই তো উঠে গেলো। কী সব স্টেজ কাঁপানো  প্রোডাকশন ছিলো, ভাবা যায় নাএকেবারেই ছোট্ট হল, মেরেকেটে ১০০ থেকে ১২৫ জনের বসার ব্যবস্থা, বা তারও কম, এতোদিন বাদে ঠিক মনে নেই, ৭৫ হতে পারে। কিন্তু, নাট্য পাগল দর্শক বা নাট্য প্রেমী স্রষ্টা, কারুরই কোনো পরোয়া ছিলো না। নিয়ম করে অভিনীত হতো -- আগন্তুক, এক পেয়ালা কফি, রজনীগন্ধাপুড়েও যা পোড়ে না, রূপালী চাঁদবিপ্রদাস, ক্ষুধিত  পাষাণ, বিসর্জন ইত্যাদি মঞ্চ সফল নাটকগুলো। এছাড়া ছিলো সাড়া জাগানো নাটক, ক্যাপ্টেন হুররা। যেটা লেখা নিয়ে মোহিতদা সাথে এতো ঝুলোঝুলি। এখন ঠিক মনে পড়ছে না, তরুণদা বোধহয় বাদল সরকারের সারারাত্তির-  করেছিলেন। বাদলদা প্রায়ই আসতেন, আর হা হা হাসিতে ছোট্ট মহলা ঘর ঝমঝমিয়ে উঠতো।ওখানেই প্রথম দেখা, বীণা দাশগুপ্তকে। কালো ছিপছিপে অসম্ভব মাদকতাময় শরীর। চোখে কী অপূর্ব টান, ভাসিয়ে দিতেন সব। প্রায় কোমর ছাপানো খোলা চুলে, যখন তারাশংকরের ‘‘না’’ করতেন, স্টেজ যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো। পরে তো উনি যাত্রায় চলে গেলেন আর কিংবদন্তী হলেন

আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুবই অবাক করেছিলো। মোহিতদা লেখা জমা দেওয়ার কথা, উনি দেরী করছেন। তরুণদা তাগাদার পর তাগাদা দিচ্ছেন , সুর চড়াচ্ছেন আবার নানান ভাবে পারিতোষিকও বিতরণ করছেন। দেরীর স্বপক্ষে বিভিন্ন প্রকার অজুহাত প্রায় শিল্পের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। মানে পাতি ঢপ মারাও যে কতো উন্নত হতে পারে, তা যেন ঘাড় ধরে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, প্রসঙ্গে পরে আসছি। কিন্তুএই যে অহেতুক দেরী, বারবার বলছিলেন তরুণদা, ওরে স্টেজ জ্যাম হয়ে যাচ্ছে, নতুন কাজ চাই -; তা সত্ত্বেও কোন অবমানকর শব্দ উচ্চারিত হতে শুনিনি কোনদিন। মোহিতদা সবাইকেই ঝোলাতেন বলে শুনেছি , কিন্তু তারপর ঝুলি থেকে যেটা বেরতো, তার গুণমান নিয়ে কাউকেই খুব একটা সন্দেহ করতে শুনিনি। তা হলেও, দেরীর একটা সীমা থাকে। কিন্তু, কেউই কাউকে এড়িয়ে যেতেন না , উধাও হতেন না। আসছেনদেখা হচ্ছে, নরমে গরমে তাগাদা আর দিচ্ছি দেবো ইত্যাদির পর বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। অজুহাত কি রকম শিল্প হতে পারেএক পিস পেশ--খিদমৎ, সেদিন মোটামুটি ঠিক, তরুণদা মোহিতদা কে ছাড়বে না, দরকার হলে বাড়ি অবধি ধাওয়া করবে। আর মোহিতদাও যেন আগেভাগে বুঝতে পেরে কী করুণ মুখ করে হাজির,  ‘তরুণদা, বৃথাই নাটক নিয়ে খেটে মরছি আমরাজীবন অনেক বড়ো নাট্যকার!’ মোহিতদা মুখে এরকম  দার্শনিক সংলাপ শুনে, একটু থমকে সবাই। স্পষ্ট দেখতে পাইমঞ্চের ওপর থেকে আলো এসে পড়ে এক বৃত্ত রচনা করেছে, সেখানে নায়ক মোহিত মাথায় হাত দিয়ে মুখ নিচু করে বসে। পুরো প্রেক্ষাগৃহ থমথম আবেগে টানটানকী অমোঘ সংলাপ বা অভিব্যক্তি এরপরে প্রকাশ পাবেলিকার ঢেলে, দুধ চিনি মেশাবার পরগ্লাসে বিন্দাদা চামচ ধাবমান ট্রেনের নীচে রেললাইন হয়ে যায়। এখন সেখানে জলে বৈঠার ছপছপ। আড়চোখে দেখি , বিন্দাদাও ঘাড় এমন বাঁকিয়ে, সন্তর্পণে চামচ নাড়ছে যাতে বাইরের কোন শব্দ আর ভেতরের শব্দ কাটাকুটি খেলে অশ্রুত না থাকে। আমার বাঁ চোখের ফ্রেমে যখন বিন্দাদা চামচ নাড়ার নতুন কৌশল, ডান চোখ যেন অলৌকিক ভাবেই তরুণ দা কে দেখে ফ্যালে।   স্থির মুখ আর  ধারালো চোখে মোহিতদা দিকে তাকিয়ে। ভাবখানা এরকমদ্যাখো হে ছোকরা, ধরে ফেলেছি তোমার ঢপ। কিন্তু, তুমি যেহেতু নাটক অন্ত প্রাণ, তাই তোমারই রচিত এই নাট্য মুহূর্তে আমি এখন দর্শক। দ্যাখো, কী উপযোগী আবহ তৈরি হয়েছে। দ্যাখাও তোমার কেরামতি। শানাও সংলাপ। দেখি কেমন ক্লাইম্যাক্সে টেনে ধরতে পারো স্নায়ু স্নবারি। আগের বিমূঢ় অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে মোহিতদা যেন  ধাতস্থ হচ্ছেন। ধুতির খুঁটে চশমা মুছছেন, সময় নিয়ে। তারপরেই  তরুণদা দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘জানেন তরুণদা, ক্যাপ্টেন হুররা নাটকটা প্রায় গুছিয়ে এনেছি মাথায়। চরিত্র  বসানো প্রায় শেষ। ক্যাপ্টেন হুররা ছাড়াও, ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট গুগলু।একজোড়া তরুণ তরুণী সুনীল আর ইরা। চৌধুরী মশায় ...’

পর্যন্ত বলতেই তরুণদা প্রায় ফেটে পড়েন আর কি! ‘শালাআমায় চৌধুরী মশায় দেখাচ্ছিস?’  বলা ভালো, কলকাতা তথা বাংলা তখন উত্তাল। চৌধুরী মশাই নামের মধ্যেই একটা প্রোটোটাইপ জোতদার আরোপিত হয়ে আছে। তরুণদা ভাবলেন, কংগ্রেসি বলে বাম মোহিত তাঁকে ব্যঙ্গ করছেন। অন্য সময়ে হলে মোহিতদা ড্যামেজ কন্ট্রোল করতেন হয়তো। কিন্তু, এখন যেন হেলদোল নেই। একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে, একই টোনে বলে যেতে থাকলেনকিন্তুসব গণ্ডগোল হয়ে গেলো। এসপ্ল্যানেডে এসে, সব গুলিয়ে গেলো। যা দেখলাম! কোথায় লাগে আমাদের সাজানো নাটক। তরুণদা সব গণ্ডগোল হয়ে গ্যালো আমার...’ শেষের লাইনটায় যেন গিরীশ বাবুর হতাশ্বাস আবেগসাজানো বাগান শুকিয়ে যাবার। তরুণদা যে তরুণদাসেও দেখলামটলে গেছে। তড়িঘড়ি মোহিতদা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে, বলে উঠলেন –‘ কী হয়েছে রে?’  গলায় গভীর পিতৃ উদ্বেগ। মোহিতদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে, একটু অদ্ভুত গলায় বলে উঠলেন – ‘বামন দেখেছেন তরুণদা?’
মানে?’
মানে -কতো বেঁটে মানুষ দেখেছেন আপনি?’
 তরুণদা এইবার শিওর বুঝে ফেলেছেন খেলাটা।শালা,বামন চেনাচ্ছিস? অবতার বাদদ্যাখ গে, একবালপুর মোড় থেকে ভেতরে ঢুকেজ্ঞানচন্দ্র পলিটেকনিকে ল্যাংড়ার ঠেকদুটো বামন ভাই আছে। একটা প্যান্ট-লেন্স কাপড়ে  দুজনের  স্যুট হয়ে যায়।
 ‘হা হা হা হা – (হাসিতে মোহিত যেন অক্ষম অজিতেশ) দেখেছেন কী এমন বামন? যে এসপ্ল্যানেডের ফুটপাথে বসে পা দোলায়?’ 
গ্লাস ভাঙলে বিন্দাদা টাকা করে নিতো। পরে বলেছে, সেই রাত্তিরে নাকি তরুণদা ৩০ টাকা দিয়েছিলো।
সব কটাই লক্ষ্যভ্রষ্ট।

চায়ের দোকান তৎসন্নিহিত নেশার আবহ থেকে অনেক দূরে চলে গেলাম এটাই দেখাতে।  দশক ৭০-এর উত্তাল সময়ে, দক্ষিণ কলকাতা যখন মোটামুটি নপুংসক অবস্থানে, তখন একটা পেশাদারি থিয়েটার গ্রুপএকটা চায়ের দোকান ঘিরে কিছু বোহেমিয়ান মানুষ, মানতে না পারা মানুষ, কিভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতো। বোহেমিয়ান মানেই বিট।  আমাদের ঘরে ঘরে বাজছে, বিটলস, ডিলান, জ্যাপলিন, ফ্লয়েড, ট্রাফিক, ডরস, নির্ভানা, জেথ্রো টাল  ইত্যাদি ইত্যাদি। কোল্ট্রিনের  কান্নায় আমরা অভিভূত। নীল মানেই ইয়াং হাক্সলে, টিমুথ্যিলিয়ারি হয়ে  কেরুয়াক,কেসি ভায়া তিমির তলপেটে, শেষ নৌকা...আমরা  খুঁজতে বেরিয়েছি। আমাদের ছটফটে  তলপেট তখন রাসবিহারী মোড়  থেকে ডিবি (দেশ ব্রতী) তুলে হাজরা মোড়ে পৌঁছে দেবার অ্যাডভেঞ্চারে গুড়গুড়। তার মধ্যেই কেউ রোমান হলিডে মার্কা লাইটার জ্বালালও... ওহমুখ চিনে নেবার খেলা। আর এই মুখ চিনতে চিনতেই আলাপ, সোনা সাথে। সোমনাথ  বসুঠাকুর।সাউথ ক্যাল বিট।  বুবু দত্ত একান্ত শিক্ষানবিশ। তুষার দা নাকি ওর বাওয়াল ক্ষমতা কে ভয় পেতো ! আমার  পাড়ায়  তখন ম্যান্ড্রেক্স বেচতো বাঙালদা। ক্যানসারের পেইন কিলার হিসেবে পিডি (প্রোড্রম)এর নাম ফাটার পর, বাঙাল দা ব্যবসা- ইন লিপ্‌স এন্ড বাউন্ডস্‌। 
আহা পিডি বাহা পিডি / পিডি মচৎকার।
বেস্‌ হিসেবে দুইখান টপকাইতং। তারপর, সব অরণ্যই বেতলা। সব বাসে নামা ওঠাই দোতলা। সব জুতোর ক্ষয়ে যাওয়া সুকতলা কেননা নো কর্মখালি ইন ধর্মতলা। 

চ্যাবর চ্যাবর করতে করতেএকটা চায়ের দোকান, কিছু নেশাড়ু মানুষ আর থিয়েটার কেন্দ্রিক কিছু চরিত্র, অবধিই আসা গেলো। ফড়িং থেকে শুরু হয়ে যে চরিত্র খোঁজা, তা এখানে থামলো এসে সোনায়। সোমনাথ বসুঠাকুরকে নিয়ে লিখতে গেলে আরও সাড়ে-তিন ফর্মা লাগবে। পর্যন্ত আসতেই সম্পাদক মহাশয়ের লাল থুড়ি থুড়ি নীল সাদা চোখের শাসানি টের পাচ্ছি। বলার কথা একটাই, একটা সময়ের আস্তর শুধু মিছিল মিটিং দেওয়াল লিখলেই টের পাওয়া যায় না। দক্ষিণ কলকাতার এই ঘেরাটোপের মানুষজনের নপুংসকতার পাপ স্খলন করতেই যেন ওই চায়ের দোকানের কিছু ক্ষয়ে যাওয়া, না-মানা মানুষগুলো ইতিহাসের এক দূর নিয়ন্ত্রিত সংবেগে হাজির হয়েছিলো। পাঁঠার মাংস-রক্তে মুখ ধুয়ে যে ভদ্দর লোকেরা আপিস বাড়ি আর অনতিদূরের বেলতলা রোড নিবাসী বেজন্মা সিদ্ধার্থ রায়ের শত আয়ু কামনা করতো অথচ  দেখেশুনে  আদ্যন্ত কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন একজন নাট্য পাগল মানুষ তাঁর নিজের মতো করে প্রতিবাদ করবেন বলেই, প্রভূত ঝুঁকি নিয়েসারারাত্তিরমঞ্চস্থ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন- এনেছিলেন নতুন আঙ্গিক।
আর আমরা? কোথাও কি ছিলাম? নাকি বাহান্ন তাসের পর যে এক্সট্রা জোকার, সেগুলোই আমরা?
প্রেসি  যেভাবে সাইকেল চালাতে চালাতে মুখ থুবড়ে ট্রাম লাইনের ওপর পড়ে, হঠাৎ মরে গেলোসেরকম ঘাতক ট্রামলাইন কি দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে আমরা এর আগেও দেখিনি?
আমরা কি ছিলাম নাকি আছি!
আজ বিন্দাদা চায়ের দোকান ভেঙে যে বহুতল, তার নীচে মাঝে মাঝেই একটু দাঁড়াই, বহুদিন গাঁও ছাড়া কোনো  রিকশাওয়ালার বিন্দাস টলোমলো পায়ে যখন সুমনের বাঁশি ওয়ালার কান্না ভেসে আসেকোথা থেকে যেন লাফ দিয়ে   হাজির হয় মেহের আলী আর বহু বিস্মৃত সেই আর্ত চিৎকার চিরে দেয় দক্ষিণ কলকাতার একটা জনপদের আপাত  নিশ্চিন্ত স্থিতিস্থাপকতা।

সব ঝুট হ্যাঁয়... সব ঝুট হ্যায় ...