“ফড়িং, এই শ্যালা ফড়িং ঘঁচু ফড়িং... রাম চেয়েচে,হুস্কি
দিলি ক্যানো?”
বিন্দাদা’র চিলচিৎকারে দোকান সরগরম। ছোকরা ফড়িং এক্কেরে ল্যাজে গোবরে। দোকানের বাদবাকী খদ্দের’দের গেলাস থেকে চা ‘উথলিয়া
ধায়’। বুড়ো’দা সাত সকালেই আড়াই প্যাঁচ চার্জ করে বুদ্ধ। আমি থ দেখে, সুস্থিত জিভ কোনোমতে নাড়িয়ে বললো,
সেবা’ দা লিকার খায়,
দুধ চা
দেওয়া হয়েছে।
সেবা দা মানে সবিতাব্রত। সবিতাব্রত দত্ত। সেই সাদাকালো চারণ কবি মুকুন্দদাসের উদাত্ত নাটকিয়তা। বুঝলাম, আজ কলির সন্ধিপুজো। সক্কালবেলা বিন্দাদা’র মেজাজ যখন চড়েছে , যতোই কালোসোনা মার্বেল পেটে যাকনা কেন,
সহজে নামবে না। মাঝখান থেকে আমাদের ধারের তেরোটা। এমনকি বয়াম ভাঙা আলমারির পেছনের ইঁদুর অন্ধকারে, ঘেঁষাঘেঁষি উবু হয়ে ব্যোম শঙ্করী উড়ানও বহুত বাম্পি রাইড। আমাদের আব্বুলিস চোখে, ফড়িং তখন, হায় বিছুয়া, ডস্ গ্যায়ো রে!
সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কে এবার একটা ইজিক্যলটু দেওয়া যাক, - বিন্দাদা
মানে বৃন্দাবন,
বৃন্দাবন রক্ষিত। দোকানটা দক্ষিণ কলকাতায় এবং দোকানটা চায়ের। ফড়িং = ফড়িং ; হাফ প্যান্টে একটা বোতাম, বাকী সব ঝুল্ঝুল্। আমি ও আমরা আত্মপক্ষে পরদ্বারেষু এবং বুড়োদা’র আড়াই প্যাঁচ মানে টু
অ্যান্ড হাফ ম্যানড্রেক্স। বিন্দাদা বেচতো না, খেতো না কারণ সে
নাকি স্বয়ং বাবা’র আদেশে, কালাসোনা মানে আফিমে ডুবুরী। আমরা
- একা এবং কয়েকজন, বিড়ি সিগারেটের
প্রাইমারি কেলাস টপকে, গঞ্জিকায় ইন্টার্নশিপ করছি আর মাঝে মধ্যেই ‘দুরু দুরু বক্ষ’ নিয়ে 2আনাড়ুতে ইন্টারভ্যিয়ু দিতে যাই। এ
সবই হয় বিন্দাদা’র চায়ের দোকানের ২৫ মিটার রেডিয়াস ঘিরে। আর
এইসব সাই-ফাই ফিউশনের নিউক্লিয়ার ফল্ -আউট যাতে দোকানের সামাজিক সাইনবোর্ডে টোল খাওয়াতে না পারে, ডবল্ হাফ চা’য়ে লেড়ো বিস্কুট ডোবানো নির্ভেজাল গেরস্ত খদ্দেররা ছোঁকছোঁক সন্দেহ করলেও, কোন প্রাইমা ফেসিয়া এভিডেন্স যাতে না
পায়, তার দিকে লাইটহাউস সতর্কতায় প্রেসিডেন্ট’দা অতন্দ্র। কেন প্রেসিডেন্ট উপাধি, জানা নেই কিন্তু এ প্রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান কন্সটিপেটেড কন্সটিট্যুশানের মতো সধবার একাদশীমূলক নয় বরং পাওয়ারে বিভীষণ স্যামচাচা ‘ম্যারিকা’। যাকে তাকে, সামান্য
বেগড়বাই দেখলেই,
তর্জনী চিহ্নিত করে আড্ডা থেকে বার করে দেওয়া ও
চ্যালেঞ্জহীন থাকার ক্ষমতায় বলীয়ান। এমনকি নিজেকেও। ‘ভোকাট্টা’ বলে, কেৎরে যাওয়া লাট্টুর মতো আধপাক ঘুরে, দোকানের ঝুলকালির মধ্যে নিজেকে গর্ভজাত করার প্রাক্ মুহূর্তে, আঙুল নেড়ে ‘ডিস্পার্স’ ইংগিতে
জমায়েত ফাঁকা করে দিতো; যদিও তা কাবুলিওয়ালার বৌ দেখার মতোই অতি দুর্লভ ঘটনা। হ্যালি’র ধূমকেতু কতো বছর বাদে ফিরে ফিরে আসে; এর সঙ্গে নাকি প্রেসিডেন্টের স্বেচ্ছা নির্বাসনের একটা যোগ আছে। ওর ল্যাঙ্গোটিয়া দোস্ত কেল্টুদা, আর টিক্রমবাজ
বিভু সেরকমই প্রবচন ঝাড়ে।
এ হেন প্রেসিডেন্টের আসল নাম খোকনদা,
আরও আসল নাম রেশন কার্ড জানতো। আমরা না। বিন্দাদা’র অটুট আস্থা আর
যাবতীয় ডেটা-বেস্’এর জিম্মাদার ছিলো প্রেসিডেন্ট, পাসওয়ার্ড সমেত । দু’জনের সাংকেতিক চোখাচোখি আর তারপরেই বিন্দাদা’র গলার ঐশ্বর্যশালী কারুকাজ দেখার মানে শোনার মতো। এই খাদ তো ঐ সপ্তক। সামনের যে ব্যক্তি খাদের সম্মুখীন, সে বুঝতো আরও কিছুদিন অন্তত তার দৈন্যতার গোপনীয়তা, গোপনীয়ই
থাকবে আর
ঐ সপ্তক যখন আছড়ে পড়তো,
বুঝে যেতো,
সীতার পাতাল প্রবেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়! এমনকি আমাদের মধ্যেও কেউ যদি চা-ঘুগনি-ডিমভাজা-কড়কড়ে টোস্টের সাপ্তাহিক রেশন না
তুলতো অথবা যে কোন ভাবেই হোক, ৪নং তাম্রলিপি খাতার এক পিঠ ভরিয়ে ফেলতো; প্রেসিডেন্ট সামান্য ভাবে তার অসামান্য দড়ি হাত দাড়িতে বুলিয়ে, ছিলিমটা পাশের জন কে
টপকে দিতো। যে বোঝার, পড়িমরি
উঠে রেস্ত জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। মোদ্দা কথায়,
নেশাড়ু বাবা মহাদেবের দাপটে সন্তান গণেশ যাতে না
ওল্টায়, প্রেসিডেন্ট
এ ব্যপারে গ্রেড- ওয়ান ফিফা রেফারী। থেকে থেকেই হলুদ কার্ড, লাল কার্ড ঝলসে উঠছে, অবিকল ’’৭০ এর ইস্টবেঙ্গল। আজন্ম মোহনবাগানী ভবানীপুরে,
নৈহাটির টোলে ব্রাহ্মদের
জুতো পায়ে মশ্মশিয়ে ঢুকে, আত্মার
স্বরূপ নিয়ে ক্রস-এক্সামিন করার মতোই ব্যাপার। বাঁ হাতের বাঘ থাবায়, সাইকেলের হ্যান্ডল আর ব্রেকের মধ্যবর্তী
গ্যাপ সামলে,
ডান হাতে ছিলিম নিয়ে আকাশের দিকে ধোঁয়া উদগীরণের মতোই একরোখা বুকখোলা মাস্তানি; এখন এইসব মনে পড়লে হাসি পায়, আজকালকার
প্রফেশনালদের মতো না হলেও, হয়তো, বোহেমিয়ানদেরও নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা চালাতে তখন একধাঁচের সিইও’’র দরকার ছিলো। তা সেই সিইও খোকনদা
ওরফে প্রেসিডেন্টের ফী ছিলো, সকালের
তিন-এর পর বিন্দাদার স্পেশাল ঘুঘনী, হাফ রুটি আর
দেড় গেলাস চা। প্রথমটা চার্জের জন্য কোঁৎকোঁৎ, হাফ্টা
চারমিনার ধরিয়ে সিপ্সিপ্।
বিন্দাদা’র চায়ের দোকানের সুখ্যাতি ছিলো কলকাতা-২৫ জুড়েই। প্রধানতঃ পাতা চা; চিনি কম -
তিতকুটে গাঢ় রঙ – পাহাড় পাহাড় গন্ধ আর
যে পাহাড় মানেই লিং। গিরিশ মুখার্জী রোডের আরেক বুড়োদা,তাঁর বিশাল বপু ও
হৃদয় দিয়ে তো বলেই ফেলেছিলো,“বেন্দা তুই অমর হবি রে! দাদা কী
সাধে তোকে
‘চাস্কার’ দিতে চেয়েছিলো ? ” দাদা মানে,
‘কে জানে ক’’ঘণ্টা / পাবে রে জীবনটা’-র’ সেই মোহময় সাদাকালো ম্যাজিক কোমর! বুড়োদা
তস্য ভ্রাতা, তরুণ কুমার। এ সবই ছিলো চায়ের দোকানী বৃন্দাদা’র ক্যাপিটাল।
এর জোরেই সে থিয়েটার সেন্টারে
নবাগত অভিনেতাদের সুস্মিত
জ্ঞান দিতো,
ওইখানটায় একটু কম চাইছিলো না?” এখানেই একদিন থিয়েটার সেন্টারের কর্ণধার তরুণদা(রায়) ধরলেন মোহিতদা(চট্টোপাধ্যায়) কে। মোহিতদা তখন বোধহয় কবিতা আর ছোটগল্পে বাংলাবাজারের ভিত কাঁপিয়ে নাটকের অঙ্গনে এসেছেন আর
সেখানেও ব্যাপক কাঁপাচ্ছেন। বেঁটেখাটো শুচিস্মিত মানুষ। দেখলে মনে হয়, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না। তরুণদা’র কথায়,
এর লুক্-এ গেলে ভিটেমাটি চাটি হবে,
ব্যাটা হারামির হাতবাক্স। মখমল মসৃণ কথা বলার কায়দা, বুঝতেই
পারা যেতো না কখন পিছলে বেরিয়ে গেছেন। তা এই যে মোহিতদা, থিয়েটার সেন্টারের জন্যে একটা নাটক দেবেন বলে কথা দিয়ে ফেলেছেন আর
যায় কোথা! তরুণদা
যতোই একাগ্রচিত্তে ছিপ ফেলে বসেন,
পাকা মাছ চার খেয়ে পালায়। চার মাঝে মধ্যেই লোভনীয় হয়। লোকমুখে খবর যায়,(হায়!মোবাইল) শালার ব্যাটাকে বল্,
ওর বৌদি মাংসের ঘুঘনী করবে, ওমুক দিন যেন আসে।শালার ব্যাটা আসে,
তারিয়ে তারিয়ে ঘুঘনী খায়, বৌদি’র(দীপান্বিতা
রায়) হাতের প্রশংসা করে শতমুখে, আরও দাম্পত্য
খচরামির ইন্ধন জুগিয়ে যায়। যেমন,
তরুণদা’র মত লোকের সঙ্গে ঘর করা কতো শক্ত, বৌদি আপনি বলেই পারছেন ইত্যাদি। পরক্ষণেই ট্র্যাপিজে ব্যালেন্স, আরে তরুণদা, আপনাকে
তো বলাই হয়নি, শম্ভুদা যা একখানা কেলো করেছন না ... বিস্তর হে হে হি হি, আর তারপরেই, এক পেয়ালা কফি
(তরুণদা’র-ই কাজ) দেখে কারা কারা ভেতরে ভেতরে ফ্ল্যাট অথচ মুখে রা কাড়ছেনা,
সেইসব ‘অন্দর কি বাৎ’
রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা। পাবলিক খুশ। উনিও পরিপাটি নীল রুমালে মুখ মুছে,
ওপর থেকে নেমে বেন্দাদা’র চায়ে চুমুক দিলেন। নিটফল,নতুন নাটকের তাগাদাটা আরও এক হপ্তা পিছলো আর আমরা গুটিকয় চৌবাচ্চা, নাটকের
মহীরুহদের বিবিধ হাঁড়ির খবরে সমৃদ্ধ হলাম।
কিছুতেই আর অবাক না হওয়ার বয়েসে এসেছি এখন
,তবু এই
ঘটনাগুলো মনে পড়লে দু’টো বিষয়ে খুব অবাক লাগে বৈকি। প্রথমত: তরুণ রায়ের নাট্যচর্চা সেইভাবে স্বীকৃত হলোনা। হয়তো একটু কংগ্রেসি মনোভাবাপন্ন ছিলেন বলেই,সুদীর্ঘ বাম শাসনে ওনার হাঁটুর তলায় বসারও অযোগ্য লোকজন বিভিন্ন পুরস্কার বা উপাধি বিভূষিত
হয়েছিলেন। অথবা মূল গ্রুপ থিয়েটারের মেধা কেন্দ্র(!) একাডেমী বহির্ভূত
যে প্রফেশনাল স্টেজ, সেখানকার নাট্য প্রচেষ্টাকে হেয় চোখে দেখা। সেদিক থেকে সারকারিনা বা প্রতাপ মঞ্চে চলা নানারকম ব্লো-হট, ব্লো-কোল্ড নাটক বা সমরেশ বসু’র রদ্দি মার্কা উপন্যাসের আরও রদ্দি নাটকগুলো তবু বড়ো হলে ‘হাউস ফুল-’এর সুবাদে, মাঝের পা চুলকানো দর্শকদের কৃপা ধন্য ছিলো। সে সবই ছিলো বাণিজ্যিক থিয়েটার
পাড়ায়। কিন্তু,
দক্ষিণ কলকাতার বেশ ভেতরে, ছোট্ট হলে, তরুণদা
দিনের পর
দিন যেভাবে নিরলস নাট্যচর্চা করেছেন,
তার তুলনা পাইনি। পুরো পরিবারটাই ছিলো নাটক নিবেদিত। স্ত্রী দীপান্বিতা রায়,
পুত্র দেবরাজ রায় তারপরে পুত্রবধূ অনুরাধা রায়, সবাই মিলে স্টেজ মাতিয়ে দিতেন। বিভিন্ন স্বাদের নাটক লিখেছেন উনি, একসময়ে ছদ্মনাম
নিয়েছিলেন, ধনঞ্জয়
বৈরাগী। আজ এই পরিবর্তন-এর বাজারেও কিন্তু কাউকে এইসব নিয়ে কথা বলতে শুনি না। হলটাই তো উঠে গেলো। কী সব
স্টেজ কাঁপানো প্রোডাকশন
ছিলো, ভাবা যায় না! একেবারেই
ছোট্ট হল, মেরেকেটে ১০০ থেকে ১২৫ জনের বসার ব্যবস্থা, বা তারও কম, এতোদিন বাদে ঠিক মনে নেই,
৭৫ ও
হতে পারে। কিন্তু, নাট্য পাগল দর্শক বা
নাট্য প্রেমী স্রষ্টা, কারুরই কোনো পরোয়া ছিলো না। নিয়ম করে অভিনীত হতো -- আগন্তুক, এক পেয়ালা কফি, রজনীগন্ধা, পুড়েও যা
পোড়ে না, রূপালী চাঁদ, বিপ্রদাস, ক্ষুধিত পাষাণ, বিসর্জন
ইত্যাদি মঞ্চ সফল নাটকগুলো। এছাড়া ছিলো সাড়া জাগানো নাটক, ক্যাপ্টেন হুররা। যেটা লেখা নিয়ে মোহিতদা’র সাথে এতো ঝুলোঝুলি। এখন ঠিক মনে পড়ছে না, তরুণদা
বোধহয় বাদল সরকারের সারারাত্তির-ও করেছিলেন।
বাদলদা প্রায়ই আসতেন, আর হা হা হাসিতে ছোট্ট মহলা ঘর
ঝমঝমিয়ে উঠতো।ওখানেই প্রথম দেখা, বীণা দাশগুপ্তকে। কালো ছিপছিপে অসম্ভব মাদকতাময় শরীর। চোখে কী
অপূর্ব টান,
ভাসিয়ে দিতেন সব। প্রায় কোমর ছাপানো খোলা চুলে,
যখন তারাশংকরের
‘‘না’’ করতেন, স্টেজ যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো। পরে তো উনি যাত্রায় চলে গেলেন আর কিংবদন্তী হলেন ।
আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুবই অবাক করেছিলো। মোহিতদা’র লেখা জমা দেওয়ার কথা, উনি দেরী করছেন। তরুণদা তাগাদার পর তাগাদা দিচ্ছেন , সুর চড়াচ্ছেন
আবার নানান ভাবে পারিতোষিকও বিতরণ করছেন। দেরীর স্বপক্ষে বিভিন্ন প্রকার অজুহাত প্রায় শিল্পের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। মানে পাতি ঢপ মারাও যে কতো উন্নত হতে পারে,
তা যেন ঘাড় ধরে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, এ প্রসঙ্গে
পরে আসছি। কিন্তু, এই যে অহেতুক দেরী, বারবার বলছিলেন
তরুণদা, ওরে স্টেজ জ্যাম হয়ে যাচ্ছে, নতুন কাজ চাই
-; তা সত্ত্বেও কোন অবমানকর শব্দ উচ্চারিত হতে শুনিনি কোনদিন। মোহিতদা সবাইকেই ঝোলাতেন বলে শুনেছি
, কিন্তু তারপর ঝুলি থেকে যেটা বেরতো, তার গুণমান
নিয়ে কাউকেই খুব একটা সন্দেহ করতে শুনিনি। তা
হলেও, দেরীর একটা সীমা থাকে। কিন্তু, কেউই কাউকে এড়িয়ে যেতেন না , উধাও হতেন না। আসছেন, দেখা হচ্ছে, নরমে গরমে তাগাদা আর দিচ্ছি দেবো ইত্যাদির পর
বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। অজুহাত কি
রকম শিল্প হতে পারে? এক পিস পেশ-এ-খিদমৎ, সেদিন মোটামুটি ঠিক, তরুণদা মোহিতদা
কে ছাড়বে না, দরকার হলে বাড়ি অবধি ধাওয়া করবে। আর
মোহিতদাও যেন আগেভাগে বুঝতে পেরে কী করুণ মুখ করে হাজির, ‘তরুণদা,
বৃথাই নাটক নিয়ে খেটে মরছি আমরা – জীবন অনেক বড়ো নাট্যকার!’
মোহিতদা’র মুখে এরকম দার্শনিক
সংলাপ শুনে,
একটু থমকে সবাই। স্পষ্ট দেখতে পাই – মঞ্চের ওপর থেকে আলো এসে পড়ে এক
বৃত্ত রচনা করেছে, সেখানে নায়ক মোহিত মাথায় হাত দিয়ে মুখ নিচু করে বসে। পুরো প্রেক্ষাগৃহ থমথম আবেগে টানটান – কী অমোঘ সংলাপ বা অভিব্যক্তি এরপরে প্রকাশ পাবে ! লিকার ঢেলে,
দুধ চিনি মেশাবার পর, গ্লাসে বিন্দাদা’র চামচ ধাবমান ট্রেনের নীচে রেললাইন হয়ে যায়। এখন সেখানে জলে বৈঠার ছপছপ। আড়চোখে দেখি , বিন্দাদাও ঘাড় এমন বাঁকিয়ে, সন্তর্পণে
চামচ নাড়ছে যাতে বাইরের কোন শব্দ আর ভেতরের শব্দ কাটাকুটি খেলে অশ্রুত না থাকে। আমার বাঁ চোখের ফ্রেমে যখন বিন্দাদা’র চামচ নাড়ার নতুন কৌশল,
ডান চোখ যেন অলৌকিক ভাবেই তরুণ দা কে
দেখে ফ্যালে। স্থির মুখ আর ধারালো চোখে মোহিতদা’র দিকে তাকিয়ে। ভাবখানা এরকম – দ্যাখো হে ছোকরা, ধরে ফেলেছি তোমার ঢপ। কিন্তু, তুমি যেহেতু নাটক অন্ত প্রাণ, তাই তোমারই রচিত এই নাট্য মুহূর্তে
আমি এখন দর্শক। দ্যাখো, কী উপযোগী আবহ তৈরি হয়েছে। দ্যাখাও তোমার কেরামতি। শানাও সংলাপ। দেখি কেমন ক্লাইম্যাক্সে টেনে ধরতে পারো স্নায়ু ও
স্নবারি। আগের বিমূঢ় অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে মোহিতদা যেন ধাতস্থ
হচ্ছেন। ধুতির খুঁটে চশমা মুছছেন,
সময় নিয়ে। তারপরেই তরুণদা’র দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
‘জানেন তরুণদা,
ক্যাপ্টেন হুররা নাটকটা প্রায় গুছিয়ে এনেছি মাথায়। চরিত্র বসানো প্রায় শেষ। ক্যাপ্টেন হুররা ছাড়াও,
ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট গুগলু।একজোড়া
তরুণ তরুণী সুনীল আর ইরা। চৌধুরী মশায় ...’
এ পর্যন্ত বলতেই তরুণদা প্রায় ফেটে পড়েন আর
কি! ‘শালা – আমায় চৌধুরী মশায় দেখাচ্ছিস?’ বলা ভালো,
কলকাতা তথা বাংলা তখন উত্তাল। চৌধুরী মশাই নামের মধ্যেই একটা প্রোটোটাইপ জোতদার
আরোপিত হয়ে আছে। তরুণদা ভাবলেন,
কংগ্রেসি বলে বাম মোহিত তাঁকে ব্যঙ্গ করছেন। অন্য সময়ে হলে মোহিতদা ড্যামেজ কন্ট্রোল করতেন হয়তো। কিন্তু, এখন যেন হেলদোল নেই। একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে, একই টোনে বলে যেতে থাকলেন –কিন্তু, সব গণ্ডগোল হয়ে গেলো। এসপ্ল্যানেডে এসে, সব গুলিয়ে গেলো। যা দেখলাম!
কোথায় লাগে আমাদের সাজানো নাটক। তরুণদা সব গণ্ডগোল হয়ে গ্যালো আমার...’
শেষের লাইনটায় যেন গিরীশ বাবুর হতাশ্বাস আবেগ –সাজানো
বাগান শুকিয়ে যাবার। তরুণদা যে
তরুণদা; সেও দেখলাম, টলে গেছে। তড়িঘড়ি মোহিতদা’র পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে, বলে উঠলেন –‘ কী হয়েছে রে?’ গলায় গভীর পিতৃ উদ্বেগ। মোহিতদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে, একটু অদ্ভুত গলায় বলে উঠলেন – ‘বামন দেখেছেন তরুণদা?’
‘মানে?’
‘মানে -কতো বেঁটে মানুষ দেখেছেন আপনি?’
তরুণদা
এইবার শিওর । বুঝে ফেলেছেন
খেলাটা। ‘শালা,বামন চেনাচ্ছিস?
অবতার বাদ? দ্যাখ গে, একবালপুর
মোড় থেকে ভেতরে ঢুকে, জ্ঞানচন্দ্র পলিটেকনিকে ল্যাংড়ার
ঠেক, দুটো বামন ভাই আছে। একটা প্যান্ট-লেন্স কাপড়ে দুজনের স্যুট হয়ে যায়।
‘হা হা হা
হা – (হাসিতে
মোহিত যেন অক্ষম অজিতেশ) দেখেছেন
কী এমন বামন? যে এসপ্ল্যানেডের ফুটপাথে বসে পা
দোলায়?’
গ্লাস ভাঙলে বিন্দাদা ২ টাকা করে নিতো। পরে বলেছে, সেই রাত্তিরে
নাকি তরুণদা ৩০ টাকা দিয়েছিলো।
সব কটাই লক্ষ্যভ্রষ্ট।
চায়ের দোকান ও
তৎসন্নিহিত নেশার আবহ থেকে অনেক দূরে চলে গেলাম এটাই দেখাতে। দশক ৭০-এর উত্তাল সময়ে, দক্ষিণ কলকাতা
যখন মোটামুটি নপুংসক অবস্থানে, তখন একটা পেশাদারি থিয়েটার গ্রুপ, একটা চায়ের দোকান ঘিরে কিছু বোহেমিয়ান মানুষ, মানতে না পারা মানুষ, কিভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতো। বোহেমিয়ান মানেই বিট। আমাদের
ঘরে ঘরে বাজছে, বিটলস, ডিলান, জ্যাপলিন, ফ্লয়েড, ট্রাফিক, ডরস, নির্ভানা, জেথ্রো
টাল ইত্যাদি ইত্যাদি। কোল্ট্রিনের কান্নায়
আমরা অভিভূত। নীল মানেই ইয়াং । হাক্সলে, টিমুথ্যিলিয়ারি হয়ে কেরুয়াক,কেসি ভায়া তিমির তলপেটে, শেষ নৌকা...আমরা খুঁজতে
বেরিয়েছি। আমাদের ছটফটে তলপেট তখন রাসবিহারী মোড় থেকে ডিবি (দেশ ব্রতী) তুলে হাজরা মোড়ে পৌঁছে দেবার অ্যাডভেঞ্চারে গুড়গুড়।
তার মধ্যেই কেউ রোমান হলিডে মার্কা লাইটার জ্বালালও...
ওহ ! মুখ চিনে নেবার খেলা। আর
এই মুখ চিনতে চিনতেই আলাপ,
সোনা’র সাথে। সোমনাথ বসুঠাকুর।সাউথ ক্যাল বিট। বুবু দত্ত’র একান্ত শিক্ষানবিশ। তুষার দা’ও নাকি ওর বাওয়াল ক্ষমতা
কে ভয়
পেতো ! আমার পাড়ায় তখন ম্যান্ড্রেক্স বেচতো বাঙালদা। ক্যানসারের পেইন কিলার হিসেবে পিডি’র (প্রোড্রম)এর নাম ফাটার পর, বাঙাল দা’র ব্যবসা- ইন লিপ্স এন্ড বাউন্ডস্।
আহা পিডি বাহা পিডি / পিডি মচৎকার।
বেস্ হিসেবে দুইখান টপকাইতং। তারপর, সব অরণ্যই বেতলা। সব বাসে নামা ওঠাই দোতলা। সব জুতোর ক্ষয়ে যাওয়া সুকতলা কেননা নো কর্মখালি ইন ধর্মতলা।
চ্যাবর চ্যাবর করতে করতে, একটা চায়ের দোকান,
কিছু নেশাড়ু মানুষ আর থিয়েটার কেন্দ্রিক কিছু চরিত্র,
এ অবধিই আসা গেলো। ফড়িং থেকে শুরু হয়ে যে চরিত্র খোঁজা, তা এখানে থামলো এসে সোনায়। সোমনাথ বসুঠাকুরকে নিয়ে লিখতে গেলে আরও সাড়ে-তিন ফর্মা লাগবে। এ
পর্যন্ত আসতেই সম্পাদক মহাশয়ের লাল থুড়ি থুড়ি নীল সাদা চোখের শাসানি টের পাচ্ছি। বলার কথা একটাই, একটা সময়ের আস্তর শুধু মিছিল মিটিং দেওয়াল লিখলেই টের পাওয়া যায় না। দক্ষিণ কলকাতার এই
ঘেরাটোপের মানুষজনের নপুংসকতার পাপ স্খলন করতেই যেন ওই
চায়ের দোকানের কিছু ক্ষয়ে যাওয়া,
না-মানা মানুষগুলো ইতিহাসের এক দূর নিয়ন্ত্রিত
সংবেগে হাজির হয়েছিলো। পাঁঠার মাংস-রক্তে মুখ ধুয়ে যে ভদ্দর লোকেরা আপিস বাড়ি আর অনতিদূরের বেলতলা রোড নিবাসী বেজন্মা সিদ্ধার্থ রায়ের শত
আয়ু কামনা করতো অথচ দেখেশুনে আদ্যন্ত কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন একজন নাট্য পাগল মানুষ তাঁর নিজের মতো করে প্রতিবাদ করবেন বলেই,
প্রভূত ঝুঁকি নিয়ে ‘সারারাত্তির’ মঞ্চস্থ
করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন-এ এনেছিলেন নতুন আঙ্গিক।
আর আমরা? কোথাও কি ছিলাম?
নাকি বাহান্ন তাসের পর যে
এক্সট্রা জোকার,
সেগুলোই আমরা?
প্রেসি যেভাবে
সাইকেল চালাতে চালাতে মুখ থুবড়ে ট্রাম লাইনের ওপর পড়ে, হঠাৎ মরে গেলো; সেরকম ঘাতক ট্রামলাইন কি দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে আমরা এর আগেও দেখিনি?
আমরা কি ছিলাম নাকি আছি!
আজ বিন্দাদা’র চায়ের দোকান ভেঙে যে বহুতল,
তার নীচে মাঝে মাঝেই একটু দাঁড়াই, বহুদিন গাঁও ছাড়া কোনো রিকশাওয়ালার
বিন্দাস টলোমলো পায়ে যখন সুমনের বাঁশি ওয়ালার কান্না ভেসে আসে; কোথা থেকে যেন লাফ দিয়ে হাজির হয় মেহের আলী আর বহু বিস্মৃত সেই আর্ত চিৎকার চিরে দেয় দক্ষিণ কলকাতার একটা জনপদের আপাত নিশ্চিন্ত স্থিতিস্থাপকতা।
সব ঝুট হ্যাঁয়... সব ঝুট হ্যায় ...