গত
বছর যখন দেশে গেলাম, পৌঁছানো
থেকেই শুনছি,
যেদিন কানাডা ফিরব তার দু’একদিন পর
থেকেই রোজা শুরু হবে। কাজেই ভাইবোনেরা জোরেশোরে ঈদ
পর্যন্ত থেকে যাবার আবদার করল। কিন্তু তাতো হবার নয়, দিনক্ষণ তারিখ সব কিছু হিসাব-নিকাশ করে তবেই পারি দিতে হয় এই
দূর পরবাস ভেঙে। তাই ইচ্ছে থাকলেও মনকে বুঝাই-
এভাবেই অনেক রোজা আসবে, রোজা শেষে ঈদের চাঁদ দেখার মাতামাতির মাঝে ঈদও আসবে,
কিন্তু তোমার তো থাকা হবে না বাছা!
কারণ তুমি বেছে নিয়েছ দীর্ঘ পরবাস। তাই দেশের মাটির অনেক উৎসব থেকেই বঞ্চিত হবে। আত্মীয় পরিজন বন্ধু-বান্ধব ঘেরা উৎসবের মাঝে হয়তো তোমার অনুপস্থিতর কথা উচ্চারিত হবে, শুধু তুমিই থাকবে না সশরীরে!
সুতরাং বাড়ির সবার আবদার একপাশে সরিয়ে যথা সময়ে উড়াল দিলাম। পিছনে পড়ে রইল আপনজনদের সামান্য দাবি-
আর কটা দিন থেকে গেলেই পারতি, এবারে ঈদটা একসঙ্গে করলে কতো না ভালো লাগত আমাদের! আমারও তো ভালো লাগত, কিন্তু থাকা হয় না।
কানাডায় ফিরে এলাম, তখন রোজা শুরু হয়ে গেছে। টরন্টো পৌঁছে খুব মন
ভার। এক, প্রিয়জনদের ছেড়ে দূরদেশে ফিরে আসার পর যে অনুভূতি
গ্রাস করে,
তাকে ডিপ্রেশন বললেও কম বলা হয়। দুই, দীর্ঘ বিমান যাত্রার কারণে ‘জেট ল্যাগ’ পেয়ে বসে। তিন, কতদিন হয়ে গেছে দেশের ঈদের স্বাদ পাইনি,
কিন্তু টিকিটের মেয়াদও বাড়াতে পারলাম না।
ঈদ
আমার কাছে ধর্মীয় কারণের চেয়ে শতগুণ বেশি আকর্ষণীয় উৎসবের আমেজের জন্যে। প্রবাসে ঈদের আমেজ সেভাবে খুঁজে পাই না। প্রতি বছরই ঈদের দিনে ঈদ উদযাপন
করা হয়
না- কারণ, এদেশে বড়োদিন ছাড়া আর কোনো ধর্মীয় উৎসবে সরকারি ছুটি নেই। তাই অপেক্ষায় করতে হয়
পরবর্তী উইকেন্ড শনি, রবিবারে ঈদ উৎসব পালন করার।
এখানে আমার ঈদের দিন খুব বিষণ্ণ লাগে। বারবার মনে পড়ে শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি, অনেক হারিয়ে যাওয়া খেয়ালি দিনের ছবি। নতুন পোশাক,
ঘুরে বেড়ানো আর তার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার
বিষয়টি। আসলে
‘খাওয়া-দাওয়া’ উৎসবের প্রাণ ভ্রমর হয়ে সবার উপরে স্থান পায়। বাংলাদেশের যে কোনো উৎসবের সঙ্গে খাবারের যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য। ছেলেবেলা থেকেই জেনে এসেছি,
খাওয়া ছাড়া আবার কোনো আমন্ত্রণ,
উৎসব বা
আয়োজন হয়
নাকি! তবে উৎসব বা
পালা-পার্বণ
বুঝে এক
এক অনুষ্ঠানের এক এক ধরনের খাবারের আয়োজন। তাই হয়তো তাদের আবেদনও ভিন্ন ভিন্ন এবং আকর্ষণীয়। ঈদ, পুজো, পহেলা বৈশাখ,
জন্মদিন এক-একটি এক-এক রকমের ভোজন সমারোহে সাজানো হয় বলেই, প্রতিটি
উৎসব আলাদা,
অপূর্ব ও
ভিন্নস্বাদের। কিন্তু একটি অভিন্ন সুর সবগুলোতেই পেয়েছি, এক কথায় যার নাম ‘আনন্দ’। সেই আনন্দের
বন্যায় ভেসে গেছে আমাদের ছেলেবেলা,
বেড়ে ওঠা এবং বোধান্বেষণের দিনগুলো।
ঈদ
সকালে তাড়াতাড়ি গোসল সেরে মায়ের হাতে তৈরি নতুন কাপড় পরে রেডি আমরা। বাবা ঈদের নামাজ শেষ করে ঘরে ফিরলেই পা
ছুঁয়ে সালাম করার ধুম লেগে যেত। কারণ মন
তখন অপেক্ষায় আছে ঈদ-সেলামির
জন্য। ওটা ছিল ছোটোদের জন্য দারুণ একটা মজার ইনকাম এবং বেশ সহজই! ঈদ-উৎসব বলে কথা। তারপর বন্ধুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরা। কিন্তু মায়ের নির্দেশ ছিল, সারাদিনের জন্য বেরিয়ে যাবার আগে বাড়ির রান্না খেয়ে তারপর বের হতে হবে। তাই হত। আমরা ঈদের দিন প্রথমে মায়ের হাতের খাবার খেয়ে খুশি মনে নাচতে নাচতে বেরিয়ে যেতাম। কখন ফিরব জানি না।
প্রতি ঈদেই মায়ের ব্যস্ততা,
রকমারি খাওয়া আর তৎপরতার কথা ঘুরে ঘুরে মনে পড়ছে। কোনোদিনও ভাবিনি, সেই দিনগুলো
হারিয়ে যাবে। ঈদ সকালের লুচি ও রেশমি রুটির সঙ্গে দুধ সেমাই, জর্দা, ফিরনি, হালুয়ার বরফি আর কষানো মুর্গির
মাংস। দুপুরে পোলাও কোর্মা, কাবাব, রেজালার দীর্ঘ মেনুর কথা না
হয় নাই মনে করলাম। ভোরের নাস্তা দিয়ে শুরু করেই বাড়িতে ঈদ
ঈদ ভাব-তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। সকালবেলা বাবা এবং ভাইয়েরা গেছেন ঈদগাহে, ঈদের নামাজ আদায় করতে। এখন অবশ্য মেয়েরাও ঈদের নামাজ পড়তে যায়, তখন খুব একটা যেতে দেখিনি। সারাদিন বাড়িতে মেহমানের আসা-যাওয়া। ক্লান্তিহীন আপ্যায়ন
আর আতিথ্যে মা আমাদের জানিয়ে
গেছেন উৎসব-আনন্দের রহস্যামৃত।
এদিকে প্রায় ঈদেই ঈদগাহ থেকেই আমার বাবা উধাও হয়ে যেতেন ভক্তকূলের অনুরোধ রক্ষা করতে। সকলেই ডাক্তার সাহেবকে ভালোবাসেন,
সকলেই তাঁদের বাড়ি নিয়ে যেতে চান। আর আমার অমায়িক বাবা কাউকেই না করতে পারেন না। তার উপরে আজকে যখন ঈদের দিন, তখন কী করে না বলবেন! বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেমাই জর্দা খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়তেন। বড্ড ক্লান্ত! শুধু যে সেমাই খেয়েছেন তাতো নয়, সাথে পোলাও কোর্মাও যথেষ্ট হত, তা না বললেও সহজে অনুমান করে নেয়া যায়।
ঈদের নতুন জামা। সে
যেন প্রতি বছর নতুন নতুন সারপ্রাইজ। রোজার প্রথম থেকেই শুরু হয়ে যেত নতুন জামার প্রস্তুতি। কিন্তু বন্ধুরা কেউ কাউকে জানতে দিতাম না এবার ঈদে কী ধরনের বা কী রঙের জামা নিচ্ছি। কারণ বলে দিলেই তো পুরানো হয়ে গেল! তাহলে ঈদের নতুন জামার আনন্দ আর
থাকল কই! আমি অবশ্য এসব লুকোচুরির মাঝে থাকতে চাইতাম না। কিন্তু ছোটোবোনের মুখ চেয়ে আমাকেও চুপ থাকতে হতো। কারণ,
মা আমাদের দুজনার জন্য একই কাপড় কিনে আনতেন। একই রকমের জামা বানিয়ে দিতেন। তখন মায়েরা হাত চালানো সেলাই-মেশিন চালিয়ে বাচ্চাদের জন্য জামা-কাপড় তৈরি করতেন, আর বাচ্চাগুলোও
বিনা প্রশ্নে সেসব গায়ে দিয়ে দিব্বি তৃপ্তির হাসি হেসে মাকে খুশি করে দিত। এটাই যেন নিয়ম ছিল। ঘরে ঘরে মায়েদের একটি করে সেলাই মেশিন। যাকে আমরা সিঙ্গার মেশিন বলতাম। যেন সেলাই মেশিন মানেই সিঙ্গার মেশিন। তো ঈদের পোশাকের
এই লুকোছাপা এতটাই সতর্কতার সঙ্গে করা হতো যে
সামান্য কাটা সুতো বা ছাঁটকাপড় পর্যন্ত দরজার বাইরে যেতে পারত না। ঈদ সকালে আনকোরা
নতুন জামা গায়ে দিয়ে বন্ধুদের চমক দেবার প্রতীক্ষায় থাকতাম।
কতকাল কেটে গেছে ঈদ
উপলক্ষে কোনো নতুন পোশাক কিনিনি। কত ঈদ কেটে গেছে বৈষয়িক দায়িত্ব পালনে। প্রবাসের ঈদ আমাকে প্রতিবার
দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অতীতের মুখোমুখি। আমি আজও স্পষ্ট অনুভব করি, ঈদ সকাল, নতুন জামা গায়ে মা-বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছেন তাঁরা।