ভোরের আলোয়।। তমাল রায়













আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
বৃষ্টি আসলেই কোথা থেকে এসে ভীড় করে পিঁপড়ের দল। মুখে করে ডিম নিয়েই কি ওরা চলে? সারিবদ্ধ? না’কি কিছু খবর দিতে হবে ওদের অন্য কোথাও,অন্য কোনোখানে? না’কি দেশান্তরে চললো ওরা? হলে গেছিলাম সোনার কেল্লা দেখতে।তার আগে দেখাচ্ছিলো ১৯৪৭। পার্টিশন। দেশভাগ। লোক চলেছে পিঁপড়ের মত,কার মাথায় ঘটি গামলা,হাতে ধরা ছেলে,মেয়ের হাত। ওরা কোথায় যাচ্ছে? মা বসেছিলো পাশেই। বললো দেখ আর্য ওরা কত জোট বেঁধে থাকে দেখ দেখ। আমি হাঁ করে দেখছিলাম। টুপ করে একটা বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ল,আর ওরা মুখে মুখে সে খবর দিয়ে দিলো অন্যদের।আর রুট চেঞ্জড। সত্যিইতো। - মা

আমরা পারিনা ওদের মত? একসাথে থাকতে? মা বলছিলো - ওরা একজোট বলেই তো এতদিন এই পৃথিবীর বুকে টিঁকে গেলো। আমি বললাম – আর আমরা? মা হাসলো,বললো পারতে হবে, নইলে যে হেরে যাবো সোনা আমরা সকলেই। বৃষ্টি ভিজি আর পেছন দিকে হাঁটি। একপাশে শ্মশান আর তারপাশেই গঙ্গা আমাদের ৭০ বছরের পুরনো বাড়িটা থেকে বড়জোর কুড়ি পা হাঁটলেই। রাত দুপুরে আমাদের গলিতে মরা নিয়ে ঢুকে পড়ে শ্মশানযাত্রীরা। বল হরি হরি বোল এ ঘুম ভেঙে যায়। মা আবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ঘুমিয়ে পড়ি। আর লাগাতার বৃষ্টি,উফফ ৭৮ সাল। আমি সাত পেরিয়ে আটে চলেছি, আর বৃষ্টি আসলেই কেমন সব এলোমেলো হয়ে যায় সব।  হরিদাস বাউলের গান,ঝন্টুদার কালো হজমিকে পাশ কাটিয়ে এক ছুট্টে রওয়ানা দিই বোসেদের পানা পুকুরে। গলা অবধি জলে ডুবিয়ে শুনি কচুরিপানাদের গল্প। ওরাও তো সব বন্ধু যেমন আমি অলোক,বাবু,তারক। কেবল কি করে যেন ছিটকে যায় কেউ কেউ, ভুল করে না’কি ঠিক দূরের নদীতে যায়, সে কি আর ফেরে? বাবু যেমন ফেরেনি আর,বআমরা অপেক্ষা করেছিলাম। অপেক্ষাতো করতেও হয়। তাই না? ভীড়ের মাঝে অসুবিধে হয় খুব। পাছে হারিয়ে যাই। তেমনতো কোনো নিজস্বতা নেই। ঠাকুর দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়ে কি ভয় পেয়েছিলাম, যদি ফিরতে না পারি আর! মা পইপই করে বারণ করেছিল। বাবা বলল -যেতে দাও। বড় হচ্ছেতো। পথ ভুল আমার স্বভাব আজও। মার কাছে কি করে ফিরবো, মা। কেঁদে ফেলেছিলাম। 

ফেরা সহজ নয়, ফিরতে লাগে ভয়, আমি তবু যাত্রী হব আজ।
যাত্রী তো সবাই।কেবল যারা দুর্গম কে অতিক্রম করে তারা হয় অভিযাত্রী। আলো টালো আমার ছিল না। ঢ্যাঙা, খেঙরা কাঠির মাথায় আলুরদম, এনিমিক ফর্সা, টিয়া পাখীর মত নাক, আর ইয়া বড় বড় চোখ। বন্ধুরা বলত রসগোল্লা। আকাশী বুশ শার্ট আর নেভি ব্লু হাফ প্যান্টের মাঝে তালপাতার সেপাই, চওড়া কপালে জ্যাবজ্যাবে তেল মেখে এগিয়ে চলতাম স্কুলের দিকে। তেমন দুষ্টু নই যে লাস্ট বেঞ্চার হব। তেমন ভালো ছাত্রও নই যে ফার্স্ট বেঞ্চার হব। আমি মাঝখানে রই। আর জানো, মাঝারিদের কেউ চেনেই না। অনেকটা বাবার মত। ভীড়ে হারালে খুঁজেই পাবে না মা। তাই নিজেকে লুকিয়ে রাখত। গুঁজে রাখতো মুখ বইতে। আমিও তাই। কিন্তু চাইলেই সব হয়? বেঞ্চি ভাঙা কোণের ছেলেটা চালাক বেঞ্চ নাড়িয়ে হাত তুলে নেয়, আমি জন্ম বোকা। শাস্ত্রী স্যার আমায় কালপ্রিট ঠাওরালেন। ডাকলেন। গেলাম।  সপাং সপাং বেত। প্রতিবাদটাও বেরিয়ে এলো না মুখ দিয়ে। কে যেন গলা আটকে রেখেছে। আমি করিনি স্যার। বলতে পারিনি। মা দেখে ছুটে যেতে চেয়েছিল। বাবা আটকালো, বলল এটাও জীবন। জীবনে কিছু অন্যায়কেও ফেস করতে দিতে হয়। তুমি কেন থাকবে সাথে। ওর লড়াই ওর। অভিমান হয়েছিল বাবার ওপর। কথা বলিনি দুদিন। আর মার কোলে মুখ গুঁজে কেঁদেছিলাম খুব। মাও কেঁদেছিল। পরীক্ষার ফল বেরুলে দেখা গেল ফার্স্ট। সবাই বলল শাস্ত্রী স্যারের ডোজ এ ফার্স্ট। আসলে কোনো কিছুতেই আমার কৃতিত্ব নেই। সবই অন্যের। এ কথা বুঝছি যখন মা বলছিল -ঠাকুর বলতেন লোক না পোক,অত কান দিস কেন লোকের কথায়। আমি জানি আমার আর্য পারে। বিশ্বাসটা মা গুঁজে দিচ্ছিল ভেতরে। আর আমি ছাদে বসে তখন শিখে নিচ্ছি, চিনে নিচ্ছি তারাদের।

বিশ্বাসের সে সময় বড়ই আকাল। তবু বিশ্বাসটা রাখতেও শিখতে হয়। সেটাই তো সম্পদ।
তখন আকাশে সূর্য তারা ছিল অপ্রতুল, আজও তাই, তবে দেখার সারল্য তো ভীড়ে ধাক্কা খায়। মা বলতেন বড় হবার কথা, বাবা পাঠক হতে বলতেন। জ্ঞান তেমন বাড়ে কই। তবু পড়তাম জানো, যা পেতাম হাতের কাছে গোগ্রাসে। এলোমেলো কাল বৈশাখী চলে গেলে, শিল পড়ত বৃষ্টির সাথে, আমরা কুড়োতে নামতাম। রুগ্ন ছেলে বলে মা বকত খুব। -ভিজো না জ্বর আসবে। তবু ভিজতাম, জ্বরও আসতো। আর জ্বর হলেই ওই যে মা মাথার কাছে ঠায় বসে, জলপট্টি দিচ্ছে মাথায়.. কি আনন্দ, মা শুধু আমারই। বাবার নয়, দিদিরও। দিদি খুব রাগ করত। বলত - মা কেবল তোকেই ভালোবাসে, আমার কিন্তু শুনে খুব মজা লাগত। বলতামও -মা তো শুধু আমারই, তোর কই! ব্যস আর কি রাগ খাবে না, দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। দিদি কমলা পাড় সাদা শাড়ি, আমি হ্যাফ প্যান্ট, হাফ শার্ট, দিদি সেকেন্ডারি আমি প্রাইমারী। মা বোঝাতো ছোট কত তোমার চেয়ে, অমন হিংসে করতে আছে? দিদি তো দিদিই। আমার দিদি। একটু পর সব ভুলে যেত। এই আর্য কাঁচা আম খাবি, এনেছি। বসে গেলাম পা ছড়িয়ে। কে বলবে দিদি একটু আগে বালিশ পেটা করতে গিয়ে বালিশ ফাটিয়েছে। সারা ঘর জুড়ে তুলো উড়ছে, আর আমরা দুর্গা আর অপু ফুঁ দিয়ে তুলো ওড়াচ্ছি, আর আম খাচ্ছি, এ সময়েই তো বৃষ্টি আসার কথা, আর এলোও। আর সাথে এলো ট্রেন। আমরা চলেছি কু ঝিক ঝিক করে রাঁচি।

চলা এক নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তি নয়, আসলে এক অপরূপ জার্নি। কখনো কু ঝিক ঝিক, কখনো ক্যাঁচর কোঁচড়। কিন্তু চলাই। আকাশে মেঘ দেখি, গাছের সবুজ। দূর দিয়ে কত কি যায় আসে, ভেসে যায়...বড় হয়ে ওঠার একটা সৌরভ আছে, অনেকটা ছাতিমফুলের গন্ধের মত। দেখা যায় না, কিন্তু সুঘ্রাণ আসে, আসতেই থাকে। যেমন ৭৮ এর তুমুল আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। গলি পেরিয়ে গঙ্গার জল এলো আমার বাড়ির উঠোনে। আর বেচারা শিউলি গাছের কি দুরবস্থা। হাঁটু জলে বন্দী। শিউলি হয়, খসে পড়ে। নোংরা জলেই পচে বসে। মা নীচের রান্নাঘর থেকে তুলে সরাচ্ছে সব রান্নার উপকরণ। আমি সাত পেরিয়ে আটে। কাগজের নৌকা ভাসাই জলে। আমাদের উঠোনে নৌকো ভাসে। বৃষ্টির জল পড়ে সে ডুবেও যায়, মন খারাপ। কাকলী আমার বন্ধু, সেও আসে। এক সাথে ভাসাই। ওরটা বেশী দূর যায়। আমারটা কম। ও বলে- মেয়ে মানুষের জান, কইমাছের প্রাণ। পুরুষ আর মহিলা যে আলাদা, সেটা বুঝতে শুরু করছি সবে। বন্ধুরা মিলে এক সাথে খেলতে খেলতে একসাথেই হিসি দিয়ে কাটাকুটি করি। আমারটা দেখতে এলে, আমি লুকিয়ে ফেলি। ওরা বলে তুই কি মেয়ে না’কি। মেয়েদের তাহলে লুকোতে হয়? ছেলেরা বেমক্কা, বিন্দাস! বাপি কাকু গামছা পড়ে গলির মুখে স্নান করে, কেউ কিছুই বলেনা। টুম্পার মা করলে সবাই বলে বেহায়া মেয়েমানুষ। আমি মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি। মা বলেন জগতে পুরুষ আর মহিলার শারীরিক গঠন ছাড়া আর কিছু তেমন তফাৎ নেই। পুরুষ যা পারে, নারীও পারে। সমাজ যারা চালান তারা এসব নিয়ম কানুন চালু করেন। তারা যেঁহেতু পুরুষ তাই বেশীর ভাগ আইন কানুন পুরুষের পক্ষে। বলেই বলেন- তোমার বাবা তো বাড়ির তেমন কাজ করেন না। সেগুলো তো আমিই করি। উনি কেবল বইতে মুখ গুঁজে। তা আমি কম কই তোমার বাবার চাইতে। হ্যাঁ, মা ঠিক। তাই তো। মা অবিভক্ত চব্বিশপরগণার সে আমলে ৮০০ আর ১৫০০ মিটারে ফার্স্ট হত দৌড়ে। এ কথা তো মাকেই মানায়। আর বাবা চাকরি আর বই মুখে গুঁজে সারা দিন। বাবা পড়ত সাদা, বা ক্রিম বা এশ কালারের কলারওয়ালা শার্ট। হাতা কবজি অবধি। আমি বাবার শার্টের মধ্যে ঢুকে গিয়ে বড় হলাম কতটা দেখতাম। বাবার একটা গন্ধ আছে। মারও। কেউ বকল, বা পরীক্ষা ভালো হয়নি, মার শাড়ি নাকের কাছে নিয়ে শুয়ে যেতাম। মা ঠিক টের পেতো। -ওরে দুষ্টু,খারাপ হলেই মার আঁচলে মুখ গোঁজা। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে গল্প বলত -রাজকন্যা আর রাজপুত্তুরের, আর আমি তখন ঘুমের দেশে হাঁটছি একা, রাজকন্যার সাথে। কিন্তু রাজকন্যা তো আর কাকলী হতে পারে না, জয়াও। মার মুখটাই দেখতাম রাজকন্যার মুখের জায়গায় । হাঁটতে হাঁটতে পথ পেরোতাম কত। বনের মাঝে যেই না এসে পড়া, অমনি ফুল ঝরে পড়ছে, অঝোর ধারায়, পাশে নীল রঙের নদী, একটা নৌকো বাঁধা তাতে, চড়ে বসতেই সে নীল জলের ওপর তর তর করে এগিয়ে চলত অনেক। আর আমি সিন্ধবাদ নাবিকের মত তখন দেশ খুঁজছি, এমন একটা দেশ, যেখানে কোনো কষ্ট নেই। মাকে নিয়ে যাবো সেখানে। মার তো খুব কষ্ট। দুপুর হলে আমায় ঘুম পাড়িয়ে পাশের ঘরে বসে মা চোখের জল ফেলে, কার জন্য ,আমার? আমি অনেক পড়ব মা এবার। আর রেজাল্ট খারাপ হবে না দেখো।

মা এক পূর্ণ অস্তিত্ব, সে পুড়তে থাকে। আমরা আলো পাই। খেলনা বাটি আমার খেলা খুব অল্পই হয়েছিল। প্রায়শই হারিয়ে ফেলতাম। খুব অগোছালো। জীবন যেমন যার,আর কি। সকাল বেলা মার ডাকে ঘুম ভাঙতো। শীতের সকালে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতো ধোঁয়া। মুখ চোখ ধুয়ে আবার লেপের তলাতেই, তবে শোয়া নয়, বাবু হয়ে বসা, হাত আর পা লেপের তলায়, মুখস্থ করছি -বচন দুই প্রকার, এক বচন, বহু বচন। পাশের বাড়ির রমেন কাকু পায়রাদের গম ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর রাজ্যের পায়রা ভীড় করেছে। তাদের ফট ফট ডানার শব্দ। আমার কান সেই দিকে। মা বুঝেছে, বলছে যাও দেখে এসে বস। আমি গেলাম, আমাদের বারান্দাতেও কত পায়রা তখন- মা পুষবো পায়রা। মা- না, কৃষ্ণের জীব। আটকে রাখলে, কষ্ট পায়। তোকে আমি এক জায়গায় নিয়ে যাবো, যাবি? -হুম যাবো। খুব সুন্দর জায়গা? কি আছে সেখানে, বল মা। -জায়গা সুন্দর হয় মানুষের গুণে, সব জায়গাই তো সুন্দর আর্য। সেখানকার মানুষ যেমন জায়গাও তেমন।

আচ্ছা তাহলে কি লিলিপুটরা ক্ষুদ্র বলেই ওদের দেশ এমন? আচ্ছা মা’কে জিজ্ঞেস করতে হবে। লিলিপুটের দেশে আমি আগেও এসেছি, গ্যালিভার নিয়ে এসেছিল, সত্যি কি অদ্ভুত দেশ, ওরা যখন গ্যালিভার কে বেঁধে ফেলল, আমার তো কি টেনশন। কি করি, কি করি ভাবি। খুলেই দিচ্ছিলাম, বাবা এসে ডাকলো, ঘুম ভাঙলো। ছোট পিসিমা ডেকেছেন আমায়। দেখতে চান। ছোট পিসিমা বাবার থেকে অনেকটা বড়, কেমন ঠাকুমা যেন আমার। বাবার তো খুব অল্প বয়সে তার মা মারা যায়। বড়পিসিমাও মারা গেছেন আগেই। এই ছোটপিসিমাই বাবার গার্জিয়ান। পিসিমা বসতো নীচ থেকে যে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায় তার মাঝের চাতালে, হামান দিস্তে দিয়ে পান থেঁতো করত, আর খেতো। গেলাম একটু বেলা হলে। বললেন- বস আর্য। বসলাম। পান খাবি? খেলাম। ভালো লাগত পানের রস টা। বললাম -লাল হবে ঠোঁট? তোমার ঠোঁট এমনিতেই খুব লাল।আর লাল করতে যেও না। -মাথা নাড়লাম। এবার আমায় বললেন হাত পাতো। - কেন? পিসিমা চোখ বড় করলেন। জিজ্ঞেস করতে বলেছি? মাথা নীচু আমার। হাত পাতলাম। আমায় দিলেন, পার্কারের একটা কলম। আর কালি। ঠাকুর্দা ছিলো লেখক, সে খবর রাখো তুমি? -আমি না বললাম। বললাম - কিন্তু আমি তো লেখক নই। নও তো কি, হবে। আমার মন বলছে, তুমি লিখে নাম ডাক করবে, আর আমার কাছে রেখে কি হবে, তুমি নাও আর্য। হাতের মধ্যে যেন চাঁদ পেয়েছি। পিসিমার কাছে ছুটি হতেই দৌড়ে দৌড়ে এলাম। মা..মা...তুমি কই? এই দেখো পিসিমা কি দিলো। মাকে বলতেই মা খুশী। অনেক গুলো চুমু দিলো একসাথে। সত্যি হবি তো আর্য? আমি মাথা নেড়ে দিলাম। মা বলল-প্রণাম কর। আর যত্ন করে তুলে রাখো। আর রেডি হও। বেরুবো। - কোথায়? -বলেছিলাম না।মা সেখানে কিসে করে যায়? -পায়ে হেঁটে। কষ্ট না করলে বুঝি কেষ্ট পাওয়া যায়?

সত্যিই কি তাই? কেষ্ট পেতে গেলে,কষ্ট পেতে হয়? সুভাষ স্যার বলেন স্কুলে- পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। তাহলে ঠিক ই বলেন নিশ্চিত। মার সাথে চলেছি, গঙ্গার ধার ধরে মণি মন্দির, কাঁচের মন্দির। ওখান থেকে একটু এগিয়ে একটা গলিতে। মা কড়া নাড়ল। পাঞ্জাবী পরা যে মানুষটি এলো তাকে আমি চিনি। স্বপন মামা। মার স্বপন দা। কেমন একটা জাঠতুতো খুড়তুতো। আমায় দেখা হলেই গাল টেপেন। লজেন্স দেন। স্বপন মামা কোলে নিয়ে উঠে এলো দোতলায়। এসো প্রিন্স।  আমায় যে কেন প্রিন্স বলেন, ওমা কত পাখী, সারা ঘরময়। কোনো খাঁচা নেই। উড়ছে, চলছে, স্বপন মামার কাঁধে বসছে। আমি পাখিদের নিয়ে ব্যস্ত হলাম, আর কত ফুল গাছ। ইয়া বড় বড় ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা। ভাল লাগছে খুব। আমি হাসছি খুব। খেলছি। মা স্বপন মামাকে গান গাইতে বলল। মামা গান ধরল-জূড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই, কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই। ঠান্ডা হয়ে যায় শরীর, গান শুনলেই। আমাকেও তো মা গানে ভর্তি করেছে গৌর জেঠুর কাছে। গান অল্প আমিও বুঝি এখন। দিদিও শেখে গান। আর তবলা বাজাতে আমিতো শিখেছি আগেই। দিদি গায়। আমি বাজাই। মা ধরতাই দেয়। মা নিজেও সেতার বাজান। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। আমি একদিন হাতের ওই টা মির না কি ছাড়া বাজাতে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছি তার। মা কথা বলেনি সারা দিন। কানে এলো কান্নার শব্দ। মা কাঁদছে? উঁকি মেরে দেখি, কাঁদছে মা। আর বলছে- কি লাভ বল এ জীবনে, স্বপন মামা চুপ। আমি পালিয়ে এসেছি। খানিক পর মা বেরুলো, সাথে আমিও। স্বপন মামা দাঁড়িয়ে রইল সারাটা ক্ষণ। যতক্ষণ রাস্তা না বেঁকছে, মামা হাত নাড়ছিল। মাকে বললাম-মা জায়গাটা ভালো আবার খারাপও। মা বলল -কেন?
আমি বললাম-স্বপন মামা তোমায় বকছিলো, তাই না? মা বলল -ছিঃ কক্ষনো উনি বকেন না, অমন বলতে নেই।

বলিনি। সব যে বলতে নেই বুঝতে শুরু করি সেই তখন থেকেই। নইলে কাকলী আর আমি কতবার বর বৌ খেলেছি। ও বলতো তুই জ্যাক আর আমি জিল। আমি কুড়িয়ে আনতাম লতাপাতা, জল, ও রান্না করত। তারপর আমরা পাহাড়ে গেলাম। বালি পাহাড়। আর যেঁহেতু জ্যাক, তাই পড়তেই হল পা পিছলে। কাকলী আমার কাঁধের নীচে হাত রেখে নামাচ্ছিল। আর ভালো লাগছিলো আমার। কিন্তু এবার আর ওকে বলতেই পারিনি - বৌ হবি আমার?

আকাশে তখনো প্রভূত রোদ্দুর, পাতা ঝরা আলো, আর অঝোর ধারায় বৃষ্টি। আকাশের রঙ বদলে যায়,যেমন জীবন। সেই কোন সকালে যাত্রা শুরু করেছিলাম তখনো ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি,কী নীল আকাশ,এক আকাশেই চাঁদ,সূর্য সেই তো অবাক হওয়ার শুরু,বেলা বাড়লে রোদ আসে,পুরু হলুদ রোদ্দুর। কিন্তু কোথায় কি,সারাটাক্ষণ বৃষ্টিই বৃষ্টি। ভিজে যায় চোখের তলা,মা কই তুমি? স্বপন মামা? পিসিমা তো কবেই তারা হয়ে গেছেন,রাতের আকাশ দেখলে মন বড় হয়। মা বলতেন। এই একলা জীবনে আকাশ দেখি আর তারা খুঁজি। চিনে নিতে হবে মা কোথায়,বাবা, একটু দূরে আড়ালে কিন্তু স্বপন মামাও আছেন।  আর আবার বৃষ্টি, বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলে আমি ফিরে যাই সেই অখন্ড শৈশবে আজও। মা সেতার বাজান, দিদি গান, আমি তবলা, বাবা বইয়ে মুখ গুঁজে। টুপ টাপ শিউলি খসে পড়ে, আর বড় হয়ে যেতে থাকি একটু একটু করে, হাফ প্যান্ট থেকে ফুল প্যান্টের পথে যেতে কেবল জেগে থাকে জ্বালা, কি যেন অস্বস্তি স্বপন মামার গানটা মনে পড়ে-জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই...আকাশ কালো হয়ে আসছে, এবার বোধ হয় ঝড় উঠবে।

SHARE THIS

Author: