অনুবাদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অনুবাদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
এক গুচ্ছ কবিতা • শার্ল বোদলেয়ার • ভাষান্তর: বুদ্ধদেব বসু

এক গুচ্ছ কবিতা • শার্ল বোদলেয়ার • ভাষান্তর: বুদ্ধদেব বসু

সে-রাতে ছিলাম…

সে-রাতে ছিলাম কদাকার ইহুদিনীর পাশে,
পাশাপাশি দুটো মৃতদেহ যেন এ ওকে টানে ;
ব্যর্থ বাসনা ;পণ্য দেহের সন্নিধানে
সে- বিষাদময়ী রূপসী আমার স্বপ্নে ভাসে।

মনে প’ড়ে গেলো সহজাত রাজভঙ্গি তার,
দৃপ্তললিতে সে-কটাক্ষের সরঞ্জাম,
গন্ধমদির মুকুটের মত অলকদাম-
যার স্মৃতি আনে প্রণয়ের পুনরঙ্গীকার।

ও-বরতনুতে চুম্বনরাশি দিতাম ঢেলে,
শীতল পা থেকে কাল চুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে গভীর সোহাগের মণিরত্ন,-
বিনা চেষ্টায় যদি এক ফোঁটা অশ্রু ফেলে
কোনো সন্ধ্যায়- নিষ্ঠুরতমা হে রূপবতী!-
ম্লান ক’রে দিতে  ঠাণ্ডা চোখের তীব্র জ্যোতি।

শত্রু

আমার যৌবন ছিল শুধু এক আঁধার তুফান,
তির্যক সূর্যেরা যাকে কদাচিৎ করেছে উজ্জ্বল;
বজ্র আর বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত হ’য়ে আমার বাগান
ফলিয়েছে কেবল একটি-দুটি রক্তরঙা ফল।

এদিকে,মনের প্রান্তে,হেমন্ত যে আগত এখনই,
শাবল,কোদাল নিয়ে ব্যস্ত হ’তে হবে এইবার-
তবে যদি রক্ষা পায় ধারাজ্বলে ভেসে-যাওয়া জমি,
ফাটা কবরের মতো খানাখন্দ খুলে আছে যার।

যে-নূতন ফুলদলে স্বপ্ন আমি নিরন্তর দেখি,
সৈকতের মতো সিক্ত এ-মাটিতে, তারা কখনো কি
পাবে সে আলোকপথ্য, যা তাদের শক্তির সঞ্চয়?
-আক্ষেপ,আক্ষেপ শুধু! সময়ের খাদ্য এ-জীবন,

যে-গুপ্ত শত্রুর দাঁতে আমাদের জীবনের ক্ষয়
বাড়ায় বিক্রম তার আমাদেরই রক্তের তর্পণ।

পূর্বজন্ম

সরল স্তম্ভের সারি অলিন্দের বিরাট নির্ভর,
রঞ্জিত সিন্ধুর সূর্যে অন্তহীন রঙিন শিখায়,
সন্ধ্যারাগে কঠিন গুহার মতো-দৃপ্ত, অতিকায়-
আমি সেই মায়ালোকে কাটিয়েছি হাজার বৎসর।

আকাশের চিত্রাবলি তরঙ্গের বেগে ওঠে দুলে,
সে-গূঢ় গম্ভীর ছন্দে মিশে যায় অচিরে আমার
নয়নে প্রতিফলিত  সূর্যাস্তের বর্ণের সম্ভার
পরম  ক্ষমতাময় সংগীতের কলতান তুলে।

সেখানে পেয়েছি আমি ইন্দ্রিয়ের প্রশান্ত বিলাস,
নীলিমার কেন্দ্রে ব’সে, চারদিকে উজ্জ্বলতা, গতি,
আর নগ্ন দাসীদের গন্ধভারে মন্থর প্রণতি-
যাদের অনন্য ধ্যান, অবিরল সেবার প্রয়াস,

তালপত্র সঞ্চালনে,সে- গোপন দুঃখের উদ্ধার
যার তাপে তিলে-তিলে অবসন্ন হৃদয় আমার।

সিন্ধু  ও মানব

স্বাধীন মানব, র’বে চিরকাল সিন্ধুর প্রেমিক!
তোমার দর্পণ সিন্ধু; অন্তহীন আন্দোলনে তার
প্রতিবিম্ব দ্যাখো তুমি তরঙ্গিত আপন আত্মার,
তার তিক্ত, তলহীন পাতালের তুমিও শরিক।

ঝাঁপ দিতে ভালোবাসো আবক্ষ আপন রূপায়ণে;
তার চোখে, বাহুতে তোমার অঙ্গ আলিঙ্গনে মাতে,
হৃৎপিন্ড আপন ছন্দ ভুলে গিয়ে, নিজেকে মেলাতে
চায় মাঝে মাঝে তার দুঃশাসন বর্বর স্বননে।

উভয়ে অপরিমাণ,অন্ধকার,সতর্ক তোমরা ;
মানব,কেউ কি তল খুঁজে পায় তোমার গহ্বরে ?
হে সিন্ধু, কেউ কি জানে কত রত্ন তোমার অন্তরে ?
উভয়ে অসূয়াপন্ন দাও নিজ রহস্যে পাহারা !

আর ইতিমধ্যে হয় অপগত অযুত বৎসর,
নির্দয়,শোচনাহীন,  তবু দ্বন্দ্ব চালাও দু-জনে,
এত সুখ তোমাদের হত্যাকাণ্ডে এবং মরণে,
চিরন্তন দুই মল্ল, ক্ষমাহীন দুই সহোদর।

নরকে ডন জুয়ান

যেদিন ডন জুয়ান,কারনেরে কড়ি গুনে দিতে
নেমে এলো পাতালসলিলে, এক গম্ভীর ভিক্ষুক
আন্তিস্থিনীসের  মত দৃপ্ত চোখে, বলিষ্ঠ বাহুতে
দাঁড়ের কতৃত্ব নিয়ে হ’লো প্রতিহিংসায় উৎসুক ।

ঘোর কালো আকাশে কাৎরে ওঠে মেয়েরা উত্তাস,
ছিন্নভিন্ন গাত্রবাস, উন্মোচিত স্তনগুলি  ঝোলা ;
বিরাট মিছিলে চলে যূপকাষ্ঠে বধ্য পশুপাল,
দীর্ঘায়িত ক্রন্দন পশ্চাতে টানে, ফুরোয় না পালা।

স্‌গানারেল্লে, দেঁতো হেসে , খেসারৎ চায় ফিরে পেতে;
এদিকে ডন লুইস –মৃত যারা ঘোরে এলোমেলো,
তাদের দেখিয়ে দেন, অঙ্গুলির কম্পিত সংকেতে,
যে-পাপিষ্ঠ পুত্র তাঁর শুভ্র কেশে ব্যঙ্গ করেছিলো ।

একদা প্রেমিক,আর তার পরে প্রতারক পতি
যে ছিলো, গা ঘেঁষে তার সাধ্বী, রোগা এলভিরা ঘনায়,
যেন ফের দাবী করে, যে-পরম হাসির আরতি
মন্ত্রঃপূত প্রভাতেরে মেখেছিল কোমল সোনায়।

বর্মধারী, ঋজু এক শিলাময় বিরাট পুরুষ
হাল চেপে ধ’রে চলে কালো জল দুই দিকে চিরে ;
কিন্তু বীর, অসিতে হেলান দিয়ে, নিস্তব্ধ, বেহুঁশ,
বিদীর্ণ জলের রেখা দ্যাখে শুধু, তাকায় না ফিরে।

আলোকস্তম্ভ

রুবেন্স, সুখের শয্যা, তনুমাংসে স্নিগ্ধ উপাধান,
আলস্যের কুঞ্জবন, বিস্মৃতির মধুর নির্ঝর,
প্রেম নেই আছে শুধু অবিরাম আন্দোলিত প্রাণ-
যেমন আকাশে হাওয়া, কিংবা মহাসাগরে, সাগর ;

দা ভিঞ্চি, দর্পণ এক,অন্ধকার,গভীর আকাশ,
ছায়া ফেলে গ্লেসিয়ার, দিগন্তরে পাইনের বন,
সেখানে দেবদূতের অপরূপ হাসির উদ্ভাস
সংকেতে জানিয়ে দেয় অন্তরালে তাদের ভবন ;

বিষণ্ন হাসপাতাল, রেমব্রান্ট, দীর্ঘশ্বাসে ভরা,
অতিকায় ক্রুশকাষ্ঠে একমাত্র অলংকার ধরে,
বিষ্ঠায় উদ্গত কান্না,প্রার্থনার সজল পসরা-
একটি শীতের রশ্মি অকস্মাৎ তাকে দীর্ণ করে ;

বিস্তীর্ণ অস্পষ্ট দেশ, অনির্ণেয় : মিকেলাঞ্জেলো :
খ্রিষ্ট আর অসুর সেখানে মেশে, প্রখর বিক্রমে
উদ্ধত প্রেতের দল ভ’রে দেয় গোধূলির আলো,
ছিন্ন করে শবাচ্ছাদ নখরের ভীষণ উদ্যমে ;

মল্লের আরক্ত রোষ, কিন্নরের উল্লোল নয়ন,
চোর,গুণ্ডা, পাণ্ডুরোগী, মদস্ফীত হৃদয় বিরাট-
এদেরই অন্তর ছেনে করেছেন সৌন্দর্যচয়ন
প্যুজে সব কয়েদির মন:ক্ষুন্ন, বিধুর সম্রাট ;

ওয়াতো, মদনোৎসব ; খ্যাতিমান হৃদয় কত না
আলয় হারিয়ে পথ দগ্ধ হয় পতঙ্গ-প্রথায়,
চটুল, মোহন দৃশ্যে উদ্ভাসিত দীপের দ্যোতনা
ঘূর্ণিত নৃত্যেরে আরও গূঢ়তার আবেশে মাতায় ;
দারুণ দু:স্বপ্ন, গইয়া, অজানার নিপট সঞ্চয়,
ভ্রুণমাংসে অন্নপাক দাকিনীর পূজার থালায়,
দর্পণে নিবদ্ধ বৃদ্ধা, বালিকার নগ্ন অভিনয়
পা তুলে, মোজার বন্ধে, পিশাচের লালসা  জ্বালায় ;

ভ্রষ্ট দেবতার বাসা, দ্যালাক্রোয়া, শোণিতের হ্রদ,
চিরশ্যাম তরুশ্রেণী তাকে রাখে ছায়াচ্ছন্ন ক’রে,
অসুখী আকাশ থেকে ঝ’রে পড়ে ধ্বনির সম্পদ
অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসে, হ্বেবারের অদ্ভুত ঝংকারে ।

এই সব অভিশাপ, অবিশ্বাস, নারকী শপথ,
পুলক, চীৎকার,কান্না,অনুতাপ,উন্মাদ বন্দনা,
পার হ’য়ে প্রতিধ্বনি-পরিকীর্ণ অন্তহীন পথ
এনে দেয় মর প্রাণে আফিমের স্বর্গীয় সান্ত্বনা !

হাজার শাস্ত্রীয় কন্ঠে এই বাণী আবার উত্তাল,
হাজার তূর্যের মুখে পুনরুক্ত এক অভিযান,
হাজার দুর্গের ‘পরে অনির্বাণ প্রোজ্জ্বল মশাল,
বিরাট অরণ্যে লুপ্ত শিকারির উদাত্ত আহ্বান !

আর কী প্রমাণ আছে? ভগবান,এই তো পরম,
এ-ই তো নির্ভুল সাক্ষ্য আমাদের দীপ্ত মহিমার,
এই যে আকুল অশ্রু যুগে-যুগে করে পরিশ্রম
অবশেষে লীন হ’তে অসীমের সৈকতে তোমার !

দুরদৃষ্ট

সিসিফাস, তোর সাহসের সর্বস্ব
হার মানে এই বিরাট বোঝার কাছে!
একান্ত মনে যতই লাগি না কাজে
শিল্প বিশাল, আয়ু অতিশয় হ্রস্ব ।

বিখ্যাত স্মৃতিফলকের দূরবর্তী
পরিত্যক্ত কবর আমাকে ডাকে,
শবযাত্রায়, চাপা শব্দের ঢাকে,
তাল দিয়ে চলে হৃৎস্পন্দের আর্তি।

-তথাপি আমার তন্দ্রাবিলীন খনি
বুকে ঢেকে রাখে কত বিস্মৃত মণি,

খন্তা, কোদাল কখনো পায় না জানতে;
এবং অনেক ফুল্ল কুসুমদল
গোপনে বিলায় খেদময় পরিমল
রিক্ত,গভীর নির্জনতার প্রান্তে।

আত্মস্থতা

হে আমার দুঃখ, তুমি প্রাজ্ঞ হও, স্থৈর্য নাও শিখে।
চেয়েছিলে সন্ধারে;আসন্ন সে যে, এই তো আগতঃ
ধুমল মণ্ডল এক নগরীকে ক্রমে দেয় ঢেকে,
শান্ত কারো মন, আর অন্য কেউ দুশ্চিন্তায় নত।

এখনই ছুটুক ওরা- ক্ষমাহীন জল্লাদ,প্রমোদ,
চালায় চাবুক মেরে যে-কুৎসিত, ক্লিন্ন জনগণে,
ফুর্তির গোলামি ক’রে অনুতাপে তার প্রতিশোধ
দিক তারা ;- দুঃখ,এসো,হাত রাখো হাতে।   চলো দুইজনে
যাই বহুদূরে।  চেয়ে দ্যাখো, আকাশের বারান্দায়
নিঃশেষ বৎসর সব ঝুঁকে আছে প্রাচীন সজ্জায়;

দন্তময় মনস্তাপ জল থেকে ধীরে তোলে মাথা;
এদিকে মুমূর্ষু সূর্য শয্যা নেয় মেঘের তোরণে;
আর, যেন পূর্বাকাশে দীর্ঘায়িত শবাচ্ছাদ পাতা,
সেইমতো, শোনো প্রিয়, রাত্রি নামে মধুর চরণে।

অনুকম্পায়ী ত্রাস

অস্থির, তোর ভবিতব্যের মতো,
এবং ভয়াল, পাংশু গগন-তল
তোর ও শুন্যে নামায় অনবরত
সে কোন চিন্তা? লম্পট, কথা বল!
-তৃষ্ণা আমার তৃপ্তি আজো না শেখে,
অনিশ্চয়ের আঁধারেই আনাগোনা,
বঞ্চিত হয়ে লাতিন স্বর্গ থেকে
ওভিদের মতো কোনদিন কাঁদবো না।

ছিন্ন আকাশে সৈকত অনুমান,
তোমাতেই দেখি আমার অহংকার ;
তোমার মেঘের বিষণ্ণতার ভার
সে যেন আমারই স্বপ্নের শবযান,
এবং তোমার রশ্মিতে তারই ভাষা
যে- নরকে আমি বেঁধেছি সুখের ভাষা।

শয়তান স্তোত্র

হে তুমি, দেবদূত, জ্ঞানীর শিরোমণি, রূপের নেই যার তুলনা,
দেবতা, যার ভাগে জোটে না বন্দনা, নিয়তি দেয় শুধু ছলনা,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
রাজ্যহারাদের হে যুবরাজ, তুমি সয়েছো অন্যায় অপমান,
এবং হেরে গিয়ে আবার দাঁড়িয়েছো নতুন তেজে আরও বলীয়ান

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে- তুমি রসাতলে বিরাজো মহীপাল, কিছুই নেই যার অজানা,
বৈদ্য পরিচিত, জীবন-দুর্ভোগে আনো আরোগ্যের নিশানা,
মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে- তুমি সমতায় বিলাও বর, একই রতির লিপ্সায় পেতে ফাঁদ,
অধম চণ্ডাল, কুষ্ঠরোগীকেও ক্ষণিক স্বর্গের আস্বাদ,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
মরণ,যে তোমার বৃদ্ধা প্রণয়িনী, অথচ ক্ষমতায় দুর্জয়,
জন্ম দিলে তার গর্ভে আশা, যার মোহন মূঢ়তার নেই ক্ষয়!
মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যখন ফাঁসিকাঠ তৈরি, জমে ভিড়, যে-তুমি আসামির দৃষ্টি,
শান্ত নির্ভয়ে জ্বালিয়ে, অভিশাপ করো সে-জনতায় বৃষ্টি,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
ঈর্ষাপরায়ণ ব্যাপ্ত বসুধায়, যে-তুমি জানো সব সন্ধান,
রত্নমণি কোন গহন অগোচরে লুকিয়ে রেখেছেন ভগবান,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
দীপ্ত চোখ মেলে যে-তুমি দেখে নাও গভীর সেই সব ভাণ্ডার,
সুপ্ত রয় যেথা কবরে সমাহিত ধাতুর বহুরূপী সম্ভার,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
এড়িয়ে গহ্বর, বিশাল হাতে তুমি তাদেরও নিয়ে যাও চালিয়ে
স্বপ্নে, ঘুমে যারা ছাদের কার্নিশে বেড়াতে চ’লে আসে পালিয়ে,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে-তুমি মাতালের অবশ বুড়ো হাড় নম্য করো জাদুবিদ্যায়
যখন রাজপথে ঘোড়ার খুর তাকে মাড়িয়ে দিয়ে বুঝি চ’লে যায়-

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
মানুষ ক্ষীণ আর  দুঃখী ব’লে, তাকে পরম সান্ত্বনা জানাতে
লবণ গন্ধক মিশিয়ে কৌশলে শেখালে গোলাগুলি বানাতে,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে তুমি বেছে নাও কুবের যত আছে করুণাহীন আর ঘৃণ্য,
ললাটে এঁকে দিতে , হে কূট সহযোগী, তোমার তিলকের চিহ্ন

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
যে তুমি মেয়েদের নয়ন আর মন এমন ক’রে পারো জাগাতে,
নিছক জঞ্জালে বিলিয়ে ভালোবাসা, আরতি করে তারা আঘাতে-

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
বাস্তুহারাদের যষ্টি তুমি, আর আবিষ্কারকের দীপালোক,
ফাঁসিতে ঝোলে  ষড়যন্ত্রী যারা, হয় তোমারই মন্ত্রে বীতশোক,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!
সকলে তারা মানে তোমাকে পিতা ব’লে, যাদের স্বর্গের উদ্যান
অন্ধ আক্রোশে পৃথিবী পার ক’রে দিলেন আদি পিতা ভগবান,

মহান শয়তান, করুণা করো তুমি আমার শেষহীন দুঃখে!

প্রার্থনা

ধন্য হোক নাম তোমার, শয়তান, ধন্য আকাশের শিখরে
যেখানে ছিলে তুমি রাজার মতো, আর এখন নরকের বিবরে
স্বপ্ন দ্যাখো নিঃশব্দে, পরাজিত, ধন্য সেখানেও হোক নাম!
আমার আত্মাকে এ-বর দাও, যেন সেখানে হয় তার বিশ্রাম,

যেখানে জ্ঞানতরু তোমাকে ছায়া দেয় এবং উন্নত,গম্ভীর
তোমার ভালে আমি ছড়াই ডালপালা নতুন যেন এক মন্দির।

স্তোত্র

প্রিয়তমা, সুন্দরীতমারে,
যে আমার উজ্জ্বল উদ্ধার-
অমৃতের দিব্য প্রতিমারে,
অমৃতেরে করি নমস্কার।

বাতাসের সত্তার লবণে
বাঁচায় সে জীবন আমার,
তৃপ্তিহীন আত্মার গহনে
গন্ধ ঢালে চিরন্তনতার।

শাশ্বত সৌরভ মাখে হাওয়া
কৌটো থেকে, কোন প্রিয় ঘরে;
সংগোপনে, কোনো ভুলে-যাওয়া
ধূপদানি জ্বলে রাত্রি ভ’রে।

কেমনে, অম্লেয় প্রেম, ধরি
ভাষায় তোমাকে অবিকার,
এক কণা অদৃশ্য কস্তূরী
অসীমের গহ্বরে আমার।

সে-উত্তমা,সুন্দরীতমারে,
স্বাস্থ্য আর আনন্দ আমার-
অমৃতের দিব্য প্রতিমারে,
অমৃতেরে করি নমস্কার।

প্যাঁচারা

ইউ গাছের কালো ছায়ার খাপে
কোন বিদেশের দেবতা, প্যাঁচার দল,
ঘুরিয়ে লাল চক্ষু অবিরল
ফুলকি ছড়ায়। তারা কেবল ভাবে।

নিথর তারা অসাড় হ’য়ে কাটায়,
যতক্ষণে বিষণ্ণ সেই যাম
হারিয়ে দিয়ে রবির সংগ্রাম
অন্ধকারের রাজত্ব না রটায়।

জ্ঞানীর চোখ, তা দেখে যায় খুলে,
হাতের কাছে যা আছে নেয় তুলে,
থামায় গতি, অবুঝ আন্দোলন;
হায় মানুষ, ছায়ার মোহে পাগল,
শাস্তি তার এ-ই তো চিরন্তন-
কেবল চায় বদল, বাসা-বদল!


ভ্রমণ
ম্যাক্সিম দ্যু কাঁ-কে



পঞ্জিকা,রঙিন ছবি ,বালকের হৃদয়লুন্ঠন,
দেখায় বিশ্বেরে তার অতিকায় ক্ষুধার সমান;
যে বিশ্ব বিরাট হ’য়ে দীপ্ত করে সন্ধ্যার লন্ঠন,
স্মরণের দৃষ্টিকোণে কত ক্ষুদ্র তার পরিমাণ!

একদা প্রভাতে যাত্রা ; মস্তিষ্কের বিবরে অনল,
হৃদয়ে বিদ্বেষ, না কি তিক্ত কাম, কে করে যাচাই!
তরঙ্গের ছন্দের পিছনে ছুটে, হিল্লোলে চঞ্চল,
আমাদের অসীমেরে সমুদ্রের সীমায় নাচাই।

কেউ ছোটে দূষিত স্বদেশ ছেড়ে মোহন অয়নে,
শৈশবের বিভীষিকা পার হ’তে উৎসুক অন্যেরা,
ক্বচিৎ জ্যোতিষী কেউ ডুবে মরে নারীর নয়নে-
মদমত্তা কির্কী এক, মারাত্মক অনুবাসে ঘেরা।

জান্তব রূপান্তরে পরিণতি সভয়ে ঠেকাতে
তারা হয় মাতাল আকাশ, আলো, দীপ্ত নীলিমায়;
তুষারের  তীক্ষ্ণ হুল, তামা-জ্বলা রৌদ্রের রেখাতে
ক্রমশ চুম্বনচিহ্ন লুপ্ত হয় দিগন্তসীমায়।

কিন্তু শুধু তারাই যথার্থ যাত্রী, যারা চ’লে যায়
কেবল যাবারই জন্য,হালকা মন, বেলুনের মতো,
নিশিত নিয়তি ফেলে একবার ফিরে না তাকায়,
কেন,তা জানে না, শুধু ‘চলো,চলো’ বলে অবিরত।

তাদের বাসনা পায় মেঘপুঞ্জে উজ্জ্বল বিন্যাস;
স্বপ্নে হানা দিয়ে যায়- সৈনিকেরে যেমন কামান-
পরিবর্তনীয় দেশ, মহাশুন্যে ইন্দ্রিয়বিলাস,
যার নাম কখনো জানেনি কোনো মানবসন্তান।

২, ৩

কী বিকট! লাটিম,বলের মতো ভাল্‌জের  তালে
উল্লোল আবেগে নাচি; কৌতূহল –প্রমত্ত বিদ্যুৎ-
ঘুমের ঘোরেও তার যন্ত্রণার আন্দোলন ঢালে,
সূর্যেরে চাবুক মারে ক্ষমাহীন কোন দেবদূত।

খেয়ালের খেলা, যার লক্ষ্য শুধু পিচ্ছিল প্রমাদ,
কোথাও তা নেই, তাই মনে হয় নেই কোনখানে!
মানুষ, হৃদয়ে যার দুরাশার নেই অবসাদ,
অবিরাম উন্মাদের মতো ছোটে শান্তির সন্ধানে।

আমাদের প্রাণ তার ইকারির এষণে আকুল
ডাকাত- নৌকোর মত। তক্তা কাঁপে –‘ খোলো, খোলো চোখ!’
উন্মাদ উত্তপ্ত কণ্ঠে হেঁকে ওঠে উল্লম্ব মাস্তুল,
‘প্রেম…  কীর্তি… পুরস্কার!’ ঠেকে চরে- সে-ই তো নরক।

মাল্লার বিহ্বল চোখে প্রতি ক্ষুদ্র দ্বীপের আভাস
হ’য়ে ওঠে আরেক এলদোরাদো,নিয়তিপ্রদীপ
ব্যাভিচারী কল্পনার উচ্ছৃঙ্খল, উন্নিদ্র উল্লাস
ভোরের আলোয় দ্যাখে শুধু বন্ধ্য পাথরের দ্বীপ।

হায় রে সিন্ধুর পারে রূপকথা রাজ্যের প্রেমিক!
বেড়ি বেঁধে জলে তাকে ফেলে দাও-এই তো সময়!
উদার আমেরিকার উদ্ভাবক মাতাল নাবিক,
যার স্বপ্ন তরঙ্গরে ক’রে তোলে আরো বিষময়।

এই বুড়ো বাউন্ডুলে,পায়ে ঠেলে কাদার ফাগুয়া,
উন্নাসিক, তৃপ্তিহীন,স্বপ্ন তার অপ্সরীর দিঠি,
মন্ত্রমুগ্ধ চোখে চেয়ে দ্যাখে তবু ভাস্বর কাপুয়া
যেখানেই বস্তির ধোঁয়াটে বাতি জ্বলে মিটিমিটি।

অদ্ভুত যাত্রীর দল! তলহীন,সমুদ্রের মতো,
বিলোল নয়ন ভ’রে নিয়ে এলে প্রোজ্জ্বল কাহিনী,
স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে দেখাও, সেখানে আছে কত
নীলিমার, নক্ষত্রের মনিহার,মুকুট, কিঙ্কিণী।

আমরাও যাবো দূরে,বিনা পালে, বায়ুব্যতিরেকে-
আমরা আজন্ম বন্দী, বক্ষে চাপা নির্বেদের ভার,
অকস্মাৎ উন্মোচিত আত্মার বনাতে দাও এঁকে
দিগন্তের চালচিত্রে পুলকিত স্মৃতির সম্ভার।

বলো, বলো, কী দেখেছো, বলো!



‘দেখেছি অপরিমেয়
আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ,বালুতট তরঙ্গপ্রহত;
এবং অচিন্তনীয় প্রলয়ের সংঘাত সত্ত্বেও
মাঝে-মাঝে হৃদয় হয়েছে ক্লান্ত, তোমাদেরই মতো।

বেগনি-রঙা সমুদ্রে মহান সূর্য কেলিপরায়ণ,
গরীয়ান অস্তরাগ নগরের উচ্ছল বিলাসে,
দেখে দেখে চেয়েছে আবেগদীপ্ত শান্তিহীন মন
ডুবে যেতে লোভন বিচ্ছুরণে রঙ্গিল আকাশে।

রমণীয় বনপথে, নগরের সমৃদ্ধ প্রাসাদে
কখনো স্পর্শেনি সেই রহস্যের গম্ভীর আবেগ
যা পেয়েছি পুঞ্জিত মেঘের মধ্যে, দৈবের প্রসাদে;
আর ছিলো হৃদয়ে অনবরত কামের উদ্বেগ!

-পুলকের অভ্যুদয় কামনার বাড়ায় ক্ষমতা।
হে কাম, প্রাচীন বৃক্ষ, সুখময় তোমার প্রান্তর,
যদিও বল্কলে বাড়ে দিনে-দিনে কঠিন ঘনতা
ডালপাখা ঊর্ধ্বে উঠে সূর্যেরেই খোঁজে নিরন্তর।

বনস্পতি, বৃক্ষরাজ, সাইপ্রেসের চেয়ে দীর্ঘজীবী,
অনন্তবর্ধিষ্ণু তুমি? –যত্নে তবু করেছি চয়ন
ক্ষুধাতুর তোমার পুঁথির যোগ্য কতিপয় ছবি,
আমরা, দূরত্বমুগ্ধ, সৌন্দর্যপিয়াসী ভ্রাতৃগণ।

দেখেছি অবাক চোখে শিং তোলা বিরাট প্রতিমা,
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো সিংহাসনে রত্নের বিলাস,
উৎকীর্ণ প্রাসাদ, যার জাদুকর কান্তির গরিমা
জোগাতে, ধনপতির অচিরাৎ হবে সর্বনাশ;

বসন, দর্শন মাত্রে, ব্যাপ্ত করে মদির আবেশ,
মোহিনী রমণীদের বর্ণলিপ্ত নখর, দশন,
সাপুড়ের কণ্ঠ ঘিরে সাপিনীর নিবিড় আশ্লেষ।’



তারপর, বলো, তারপর ?



‘হায় রে অবোধ মন !
সার কথা শোনো তবে, সনাতন, অবিস্মরণীয়,
ঊর্ধ্বে, নিম্নে সোপানের যত আছে মারাত্মক ধাপ,
সর্বত্র দেখেছি শুধু –সাধ ক’রে খুঁজিনি যদিও-
ক্লান্তিহীন মঞ্চে খেলে ক্লান্তিকর, মৃত্যুহীন পাপঃ

রমণী,আজন্ম দাসী,হাস্যহীন, দাম্ভিক,নির্বোধ
কিছুতে ন্যক্কার নেই- আত্মরতি,আত্মোপাসনায় ;
পুরুষ,লম্পট, লুব্ধ, অত্যাচারে নেয় প্রতিশোধ,
দাসীর দাসত্ব করে নর্দমার ক্লেদাক্ত ফেনায়।

শহীদ, ক্রন্দনে রত ; আনন্দিত,সপ্রেম ঘাতক,
রক্তের সৌরভ-মাখা উৎসবের মত্ত আয়োজন,
শক্তির কুটিল বিষে অবসন্ন লোকাধিনায়ক,
চাবুকের আকাঙ্ক্ষায় জনগণ নতিপরায়ণ;

অনেক আশ্রম,সিঁড়ি ভেঙে স্বর্গে ধাবমান,
আমাদেরই অনুরূপ; যাকে বলে পুণ্যের প্রভাব,
তাও, যেন ভোগক্লান্ত পালকের শয্যায় শয়ান,
কণ্টকিত চটেও প্রকট করে কামুক স্বভাব।

প্রগলভ মানুষ, তার প্রতিভার পীড়নে মাতাল-
সঙ্গী তার অচিকিৎস্য, চিরায়ত চিত্তের বিকার-
বিধাতারে জানায় যন্ত্রণা,ক্ষোভ ,আক্রোশে উত্তালঃ
“তবে নাও অভিশাপ, প্রভু আর প্রতিভূ আমার!”

আর যারা কিঞ্চিৎ  সজ্ঞান, তারা কঠিন সাহসে
জাড্যেরে জানায় প্রেম; অদৃষ্টের শৃঙ্খলে নাচার,
ডোবে, গড্ডলিকা ছেড়ে, আফিমের বিশাল প্রদোষে

-আদ্যন্ত জগৎময় চিরন্তন এ-ই সমাচার।’



অতি কটু সেই জ্ঞান, চঙ্ক্রমণে যাকে যায় পাওয়া,
এক্তাল,সঙ্কীর্ণ  এ-পৃথিবীর আকাশে, বায়ুতে
আজ, কাল, চিরকাল খেলে শুধু আমাদেরই ছায়া,
আতঙ্কের মরূদ্যান নির্বেদের বিস্তীর্ণ মরুতে।

গতি? না বিরাম চাও?  যদি পারো ঘরে থাকো, আর
যদি না-গেলেই নয়, যাও ছোটো,কিংবা দাও হামা,
ফাঁকি দাও শত্রুকে, নিস্পন্দ চোখে যে করে সংহার-
সময়! হায় রে যাত্রী, ধাবমান, নেই তার থামা,
অস্থির ইহুদি যেন, কিংবা পীর ধর্মের যাজক,
কিছুই পাথেয় নেই, অশ্ব , রথ,কিংবা জলযান,
এ-কুৎসিত মল্লেরে পলাবে ব’লে নিয়ত ব্রাজক;
অন্য কেউ আঁতুড়েই শিখে নেয় তার মৃত্যুবাণ।

অবশেষে যখন পা দিয়ে চেপে,  ছিঁড়ে নেবে টুঁটি,
সাধ্যে তবু কুলোবে আসার বাণীঃ  হও আগুয়ান!
যেমন ভেসেছিলুম, পুরাকালে, উপড়ে ফেলে খুঁটি,
সুদূর চৈনিক তটে,স্রস্ত কেশ, নিবদ্ধ নয়ান।

এবার তাহ’লে যাত্রা তমসার অতল সাগরে
সদ্য-পথিকের মতো পুলকিত হৃদয় উধাও,
শোনো, কারা শবযাত্রী গান গায় মোহময় স্বরেঃ
‘এদিকে,এদিকে এসো, যদি কেউ  স্বাদ নিতে চাও
মদগন্ধ কমলের।  এই হাটে তাকে যায় কেনা,
অলৌকিক সেই ফল, যার জন্যে হৃদয় ক্ষুধিত;
এখানে প্রদোষ নেই, অপরাহ্ণ আর ফুরোবে না,

এসো না, অদ্ভুত তার মাধুরিতে হবে আমোদিত!’
ওপারে বাড়ায় বাহু পিলাদেস, এখনো তেমনি,
প্রেতেরে চিনিয়ে দেয় পুরাতন গানের গুঞ্জন।

‘সাঁৎরে ধর এলেক্‌ত্রাকে,সে-ই তোর বিশল্যকরণী!’
বলে সে, একদা যার জানুতট করেছি চুম্বন।



হে মৃত্যু, সময় হলো!   এই দেশ নির্বেদে বিধুর।

এসো, বাঁধি কোমর, নোঙর তুলি, হে মৃত্যু প্রাচীন!
কাণ্ডারী ,তুমি তো জানো, অন্ধকার অম্বর,সিন্ধুর
অন্তরালে রৌদ্রময় আমাদের প্রাণের পুলিন।

ঢালো সে-গরল তুমি, যাতে আছে উজ্জীবনী বিভা!
জ্বালো সে-অনল, যাতে অতলান্তে খুঁজি নিমজ্জন!
হোক স্বর্গ,অথবা নরক, তাতে এসে যায় কী-বা,
যতক্ষণ অজানার গর্ভে পাই নূতন-নূতন!


শার্ল বোদলেয়ার (পুরো নাম - Charles-PierrBaudelaire; উচ্চারণ শার্ল-পিয়ের বোদলেয়ার; জন্ম - ৯ই এপ্রিল, ১৮২১ পারিতে)
ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম কবি ও অনুবাদক। প্রাবন্ধিক ও শিল্প-সমালোচক হিসেবে তাঁর কাজও উল্লেখের দাবি রাখে। ফরাসিতে এডগার অ্যালান পোর অন্যতম প্রথম অনুবাদক ছিলেন তিনি। ফরাসী সাহিত্য অঙ্গনে বোদলেয়ার একটি উজ্জ্বল নাম ফ্রান্সের সমাজে উনিশ শতকের শুরুর দিকে যেরকম কবিতা লেখা হত শার্ল বোদলেয়ার ওগুলো থেকেই কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। একজন মানুষের মধ্যে আসা রোমান্টিকতাকে কিভাবে আরো ব্যাপ্তিময় এবং সৌন্দর্যমন্ডিত করা যায় সেটা শার্ল ভাবতেন। তার কবিতায় শৈল্পিকতা পাওয়া যায়, তিনি প্যারিস নগরীকে তার কবিতায় অনেকবার স্থান দিয়েছেন, ফরাসী কবিতা পাঠকেরা তার কবিতা পড়ে এক অন্য জগতে চলে যেত।
সমকালীন বিশ্বসাহিত্য । কবিতা সংখ্যাঃ প্রথম পর্ব । অতিথি সম্পাদক: কালপুরুষ

সমকালীন বিশ্বসাহিত্য । কবিতা সংখ্যাঃ প্রথম পর্ব । অতিথি সম্পাদক: কালপুরুষ

অলংকরণ: রাজিব দত্ত

রেইনালদো আরেনাস


কিউবান কবি, ঔপোন্যাসিক ও নাট্যকার রেইনালদো আরেনাস (Reinaldo Arenas) জন্ম নেন ১৬ জুলাই ১৯৪৩ সনে। যৌবনের শুরুতে ফিদেল কাস্ত্রোর জন্য আন্দোলনে শরিক হন এবং পরবর্তিকালে সমকামীতা ও কাস্ত্রো সরকারবিরোধী সাহিত্যের অভিযোগে গ্রেফতার হন। জেলে অমানুষিক অত্যাচার থেকে তিনি রক্ষা পান সমুদ্রপথে আমেরিকা পাড়ি জমিয়ে। কবিতার পাশাপাশি তার সর্বাধিক বিখ্যাত কাজ পাঁচটি উপন্যাসে সমন্নিত Pentagonia সিরিজ। আরেনাসের সাহিত্যে ঘুরে ফিরে এসেছে কিউবার মাটি ও জলের ঘ্রাণ, জীবনের স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, বঞ্চনা। মারণব্যাধি এইডসের সঙ্গে যুদ্ধক্লান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন ১৯৯০ সনের ৭ই ডিসেম্বর। সংক্ষিপ্ত ও প্রায় বিক্ষুব্ধ-অশান্ত জীবন সত্ত্বেও রেইনালদো আরেনাসের রেখে যাওয়া সাহিত্যকর্মের পরিমাণ ঈর্ষণীয়।
অলংকরণ: নবী হোসেন

হে সমুদ্র
প্রেমিক আমার
ভাষান্তর: এনামুল রেজা


আমি সেই কুৎসিত শিশু
সমস্ত মিলিয়ে যে তোমাকে শুধু বিরক্ত করবে
"তুমি কি একটু স্থান দেবে?"

আমি কদাকার সেই শিশু
সংশয়াতীত অনাকাঙ্ক্ষিত
সেই উজ্জ্বল গাড়ী যেখানে অন্য শিশুরা হাসি ও আনন্দে নৃত্যরত
তার থেকে অনেক অনেক দূরের কেঊ

আমি সেই কদাকার অপ্রিয় শিশু
নিশ্চিত অবাঞ্চিত
যার সামনে রাস্তার দৈত্যাকৃতি আলোরা ক্রোধে জ্বলে ওঠে
এমনকি কোন বৃদ্ধা রমণীর স্নেহের ছায়াও সরে যায়
অথবা ছোট্ট বালিকারা যাদের শূন্যে ছুঁড়ে মারলে খুশি হত
তার কদর্যতা ওদেরও অপমানিত করে

আমি চিরকালের সেই রাগী এবং নিঃসঙ্গ শিশু,
যার বয়ে বেড়ানো ক্রোধ তোমায় অপমান
আর হুঁশিয়ারী দেয়:
যদি উন্মাদনায় আমার মাথায় চাঁটা মারো
সে সুযোগে তোমার পকেট মেরে দিতে পারি।

আমি সেই শিশু যে চিরকাল
দাঁড়িয়ে আছি বিস্তৃত সমাসন্ন আতঙ্ক,
আসন্ন কুষ্ঠআসন্ন মহামারী,
সমস্ত পাপ ও সমাগত অপরাধের কারণ হিসেবে,
আমি সেই ঘৃণ্য শিশু
যে এক প্রাচীন কার্ডবোর্ডে নিজের বিছানা বানিয়ে করে অপেক্ষা করছি,

এ নিশ্চয়তায় যে শুধু তুমিই আমার আশ্রয় হতে পারো।



পেট্রিশিয়া লকউড

পেট্রিশিয়া লকউড একজন নারীবাদী কবি যিনি ভালোবাসেন খুব কঠিন এবং বাস্তব বাস্তবতা। যৌনতা ও ঠাট্টার ছলে বলে ফেলতে জটিল সব কথা। কিন্তু গভীরতা হারান না মোটেও।
তিনি পরিচিত হয়েছেন রেপ জোক” কবিতাটি দিয়ে। জাতীয়তায়  আমেরিকান
অলংকরণ: নবী হোসেন

একজন হিপনো ডোমির বলে যাওয়া কথারা
ভাষান্তর: জোনায়েদ আহমেদ রাহাত

আমি জন্মেছি
নারী হয়ে,
আমি কথা বলতে বলতে আপনাকে নিয়ে যাবো মৃত্যুর কাছে,
অথবা বন্ধ করুন আপনার কানঅথবা ঘুমিয়ে পড়ুন।
কী আছে আমার কাছেপৃথিবীর সকল সময় এবং একটি কণ্ঠ  যা আগে পিছে ঘুরতে থাকে আপনি তা শুনতে পারবেন এবং আপনার চেহারার একটি অংশ যেখানে আমার থাকার কথা।
কী আছে আমার কাছেআছে নিশ্চিত ক্ষমতা এবং আমি যা চাই তা হলো আপনার অর্থ
এবং আপনার মন এবং আপনার মাঝে আমাকে বিষাক্ত সাপ মনে করার চিন্তা
এবং ঘাসের মাঝে একটি সাপ।
সে সাপের প্রতিটি হাড়ই নিতম্বের হাড়তার প্রতিটি অংশই নিতম্ব।
আমার প্রথম শব্দ নীরবতাতারপর হিসসসসস
আমার বলা প্রথম শব্দ শুনুন
ভেড়া-পালক এবং হিসাবরক্ষকদের মোহিত করা কঠিন কাজ
এবং নাবিকেরা তোমরা যারা সমুদ্র দেখো,
এবং যেই কিশোরেরা কাট কাট কাট কাট করে ঘাস কাটে
সতর্ক হও
লেখকেরা যারা লেখে নতুন নতুন কাব্য এবং যারা বার বার লিখে
একই
যারা হীরে কেটে বেড়ায় তারা হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসবে
এবং অনুরোধ করবে তাদের মোহিত করার জন্য
এবং আমি তাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠবো অনেক উজ্জ্বল,
তারা আমার কথা শুনবে এবং আমারই কথা শুনবেআমি তাদের বলবো,
নিজের বয়স গুনো উলটো করে এবং আমি তাদের বলবো শ্বাস নেয়ায় সতর্ক হও
এবং আমার নিশ্বাস নেও যা থেকে যাবে চিরতরে।
মেনে নাও তুমি একজন শিশুআমি যতদিন না তোমাকে প্রাপ্ত বয়স্ক বলি,
তারপর মেনে নাও তুমি একজন পুরুষ যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি তোমাকে
বলছি তুমি নর্দমা।
যখন তুমি একটি গুলির শব্দ শুনবে পড়ে থাকবে মৃতের মতো
যখন তুমি শুনবে “ শ্বাস চলছে” উঠে দাঁড়াবে,
কুকুরদের শ্রেষ্ঠ ভাষা হ্যা” এবং নিরাপত্তা দেয়া।
সাদা-কালো কুকুরেরও শ্রেষ্ঠ ভাষা হ্যা” এবং সে পিছে পিছে যায় সব জায়গায়
এবং তুমিও সেখানেই যাবে যেখানে আমি বলবো।
আমি কেন করিএটা সহজআমি এখনো স্কুল পার করছি
আমাকে অর্থ দাও আধুনিকতার জন্য এবং এরপর যা আসবে সব কিছুর জন্য
যখন তুমি বুঝে উঠবে তোমার দেহ আছে তুমি বুঝে উঠবে তা আর বেশিদিন তোমার নয়।
যখন তুমি বুঝে উঠবে এবং পড়বে কঠিনঅথবা না বুঝতে পারা কঠিন অথবা অবোধ্য কবিতা
তুমি আমার কাছে আসবে ।
যখন তুমি বইটি রেখে আমার কাছে আসবে তুমি শুনবে শব্দগুলো বই থেকে বেড়িয়ে পড়েছে
যখন তুমি আসবে

তুমি শুনবে



জয়ন্ত মহাপাত্র

জয়ন্ত মহাপাত্র (জন্ম: ২২শে অক্টোবর১৯২৮) ওড়িশার কটকে জয়ন্ত মহাপাত্রের জন্ম হয় এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। পদার্থবিদ্যায় মাস্টার ডিগ্রী লাভ করে তিনি ওড়িশার নানান সরকারী কলেজে অধ্যাপনার কাজ করেন। ৩৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করে আজ অবধি তিনি ১৮ টি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন যাদের মধ্যে "Close the Sky", Ten by Ten" ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর একমাত্র গদ্যের বই "The Green Gardener" ছিল ছোটগল্পের সংকলন। ইংরাজিতে লেখালেখি তাঁকে ভারতীয়-ইংরাজি কবিতার জগতে অনন্য করে তুলেছে। জয়ন্ত মহাপাত্র ভারতের একমাত্র সাহিত্যিক যিনি ইংরাজিতে লিখে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পান। "Relations" নামক তাঁর দীর্ঘ কবিতাটির জন্য তাঁকে এই পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। ইতিমধ্যেই তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়েছে।
অলংকরণ: নবী হোসেন
ভালো স্ত্রী
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

আমার বিছানায় শুয়ে থাকে
সারাটা দীর্ঘ বিকেল জুড়ে;
এখনো স্বপ্ন দেখেঅক্লান্ত
তীব্র অন্ত্যেষ্টি চিতাদের গর্জনে।


অলংকরণ: নবী হোসেন
তার হাত
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

আঁধার দিয়ে তৈরী বাচ্চা মেয়েটির হাত
আমি কিভাবে ধরি?

স্ট্রীটল্যাম্পগুলো ঝুলে আছে কাটা মাথার মত
রক্ত খুলে দেয় আমাদের মাঝের ভয়াবহ দরজাটা

দেশের ছড়ানো মুখ যন্ত্রণায় আবদ্ধ
যখন তার দেহ পেরেকের বিছানায় মোচড় খায়

এই বাচ্ছা মেয়েটির তার ধর্ষিতা শরীর আছে
আমার জন্য তার কাছে পৌঁছাতে

আমার দোষের ভার অসমর্থ
তাকে আলিঙ্গন করার বাধা পেরোতে

অলংকরণ: নবী হোসেন
প্রধান মন্দির সড়ক
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

খোঁড়া মানুষ আর সঙ্গমরত খচ্চরের দিকে
হাসতে থাকেমাটির মত বাদামীশিশুরা
তাদের নিয়ে কেউ ভাবেনা

বিরামহীন ছন্দের দিকে নির্দেশ করে মন্দিরটি

চাঁছা মাথা-রঙের ধুলোময় রাস্তার ওপর
কিছু জিনিস সবসময় নড়ছে
অথচ কোনোকিছুই দৃষ্টির বাইরে যাচ্ছেনা

উত্তাপে নিদ্রালু হয়ে আসা ক্ষতেরা

আর ঐ যে ওখানে আকাশ,
পবিত্র কর্তৃপক্ষের দ্বারা অধিকৃত
শক্ত করে নীরবতার যষ্ঠি ধরে থাকে

অলংকরণ: নবী হোসেন
গ্রীষ্ম
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

তবুও নয়।
আমগাছের তলায়
পরিত্যক্ত আগুনের শীতল ছাই।

কার ভবিষ্যত দরকার?

একটি দশ বছরের বালিকা
তার মায়ের চুল আঁচড়ে দেয়,
যেখানে প্রতিযোগিতার কাকেরা
শান্তিতে বাসা বেঁধেছে।

সেই ঘর কোনোদিনই
তার হবেনা

তার মনের এককোণে
একটা জীবিত সবুজ আম
মাটিতে ঝরে পড়ে আলতোভাবে। 

অলংকরণ: নবী হোসেন
একটি গ্রীষ্ম কবিতা
ভাষান্তর: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

সোঁ সোঁ করা বিষণ্ণ বাতাসের ওপর
পুরোহিতেরা উচ্চতম কণ্ঠে স্তব করে;
খুলে যায় ভারতবর্ষের মুখ।

কুমীরেরা ঢোকে গভীরতর জলে।

উত্তপ্ত গোবরগাদার সকাল
রোদের তলায় ধোঁয়া

হোশাং মার্চেন্ট

হোশাং মার্চেন্ট (জন্ম:১৯৪৭) হোশাং মার্চেন্ট ভারতীয়-ইংরাজি কাব্যজগতের এক উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মুম্বইয়ের এক পার্সি পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। মুম্বইলস এঞ্জেলস ইত্যাদি জায়গায় নিজের শিক্ষালাভ শেষ করে তিনি হেইডেলবার্গজেরুজালেম এবং ইরানে থাকা এবং শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। আশির দশকের মাঝ থেকে তিনি হায়দ্রাবাদে বসবাস শুরু করেন যেখানে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ হায়দ্রাবাদে ইংরাজীর অধ্যাপকের কাজ করেন। এখনো অবধি তাঁর ২০টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে যাদের মধ্যে "Flower to Flame", "Stone to Fruit", "Homage to Jibanananda Das" ইত্যাদি তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য বই। নিজেকে "সমকামী" বলে প্রকাশ্যে দাবী করা এই কবি ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম সমকামিতার বই,  "Yaarana: Gay Writings from India" প্রকাশ করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।
অলংকরণ: নবী হোসেন

সিন্দ
ভাষান্তর: সুমন্ত চ্যাটার্জী

"আমি পাপ করেছি"  : নেপিয়ার

এক সিন্ধি বালকের মধ্যেই প্রেম খুঁজে পেয়েছিলাম প্রথমবার
সে প্রেম অনুভব করলেও বালক হওয়াতে আমাকে পিছন থেকে নিয়েছিল
যেভাবে পবিত্র আত্মা ঈশ্বরের খাড়াই সিঁড়িতে সেইন্ট জন'কে নিয়েছিল একরাতে

শীতল রাত ছিল
ট্রেনটা ছিন্নভিন্ন করে চলেছিল হিন্দুস্তানের হৃদয়
আর একটা স্টেশনে এসে থামলে
ফাঁস হয়ে গেছিল ভোর আর আমাদের প্রেম

যখন ইন্দুসেরা সমুদ্রকে দেখেছিল
তারা ভুলে গেছিল সে তুষারের শীতল কন্যা
সে উষ্ণ আর অগভীর হয়ে উঠেছিলবালিতে হারিয়ে
এই বালির দেশকে
তারা সিন্দ বলে ডেকেছিল

আর আরবেরা এসেছিল
আর সেখানে হিন্দুদের খুঁজে পেয়ে
তারা এই চোরাবালির দেশকে বলেছিলহিন্দুস্তান

বালকেরা শীঘ্রই তুর্কে পরিণত হয়েছিল
চোখেরা আয়না হয়ে উঠেছিল অন্য দেবতাদের প্রতিফলিত আলোর জন্য
উষ্ণ প্রেমকে চটকানো হয়েছিল গুরু আর শিষ্যের মাঝে সুরার মত

মানুষেরা তাদের নাম ভুলে যায়
তারা মনে রাখে সেইসব নাম
যা শীঘ্রই তারা ভুলে যাবে: তোমরা নাম জানতে চাও কেন?
তারা শুধু জেনেছিল আর মনে রেখেছিল ভালোবাসা

একজন রাখাল বাঁশি বাজিয়েছিল
একজন রাজা তাকে অনুসরণ করেছিল জঙ্গল অবধি
একজন মুঘল সন্তান কাবুল জয় করার পথে
পারসিক ভাষায় লিখে নিয়েছিল হিন্দু দেব-দেবীদের

আর সময় বন্য হলে আফিম সাহায্য করেছিল উত্তরাধিকারীদের যন্ত্রণাহীন মরতে
ভাইয়েরা শত্রু হয়ে উঠলে মৃত্যুই হয়ে যায় একমাত্র বন্ধু
কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া...আফিম ব্যতীত?
কিংবা জীবনের মুখোমুখি...কবিতা ব্যতীত?

নদীটা লাল হয়ে বয়ে গেছিল সেদিন
মহিলারা রেকাবে তাদের স্তন বয়ে এনেছিল ধর্ষণকারীদের জন্য
পুরুষেরা হাতে করে তাদের মাথা নিয়ে এসেছিল বিজয়ীদের জন্য

আর কবিতারা যারা এইসব ধ্বংসের উল্লেখ করে
এখন রেলস্টেশনে ধুলো জমিয়ে চলেছে
কিন্তু সজলের দুধরুমির মদিরা
মৃদুমন্দ বাতাসের নি:শ্বাস বয়েছিল "না"-এর ভেতর দিয়ে
বলেছিল: সে!

যতটুকু ভাবতে পারি যার হাতে মারা গেছিলাম
চিন্তারা থেমে গেছিল সেই রাত-ট্রেনের মত

আর আমার হৃদস্পন্দন হয়ে উঠেছিল একটি প্রকাশ্য ঘটনা। 



মরগান পার্কার
অলংকরণ: নবী হোসেন

হটেনটট ভেনাস
ভাষান্তরঃ আকাশ আহমেদ

বড় ইচ্ছে হয়-
আমার যোনীটা অম্লান থেকে অযথাই পাচ্ছে স্বীকৃতি
আমি কি তোমাদের ধন্যবাদ জানাবো?
ব্যবসায়ী চোখ ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমাকে কেউ আর
ভালবাসে নাযেভাবে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম
এক প্রাণচঞ্চলে শীত: আঘাত কিংবা সহানুভূতির
মদ্যপ সমন্বয়।

সূর্য উঠতেই আমার অপহরণকারীদের কেউ কেউ পান করে
আফ্রিকান গোলাপ পানীয়তারা আমাকে ব্যবহার করেছে
রাজকীয় ধৈর্যশীল খাবারের মতন যেহেতু আমি আসলে কিছুই না
মানুষও নাযতটুকু মনে পড়ে আমাকে ভোগ করে এক পুরুষ বলেছিলো
আমি কখনোই নারী হতে পারবো নাএটিই আমার নিয়তি।

এখন আমি বুঝতে পারি আমাকে নিয়ে কেউ দুশ্চিন্তা করছে না
কেননা আমি যথেষ্ট উপার্জন করছিএখানে এসেছি তোমাকে দেখাতে
কে তুমিতোমার মোটা মাথা বুকে নিয়ে জানিয়ে দিই তুমিই নিষ্কলঙ্ক
মা আমেরিকাছেড়ে দাও তোমার সন্তানদের-

তোমার সবকিছুই সুন্দর।

ডেভিড ব্রুকস

(১২ জানুয়ারি১৯৫৩- বর্তমান)

অস্ট্রেলিয়ান কবিঔপন্যাসিকপ্রাবন্ধিক। কবিতাগ্রন্থসমূহ : The Cold Front (1983); Walking to Point Clear (2005); Urban Elegies (2007); The Balcony (2008); Open House (2015)
অলংকরণ: নবী হোসেন

মাঠ
অনুবাদঃ রনক জামান

তোমাকে চলে যেতে

দেখলামচোখের কিনার হতেবাইরে,

বেরিয়ে গেলে, আর আমিও

পেছনে পেছনেযতটা সম্ভব দ্রুত,

অথচ ততক্ষণে, তুমি হয়ে গেছ :

এক বিস্তৃত মাঠ,

একটি আপাত সন্ধ্যা,

এক অচেনা পাখির কান্না।
অলংকরণ: নবী হোসেন
ব্যালকনি-৫
অনুবাদঃ রনক জামান

রাত ১০ টা,
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায়,
আবার আমরা দুজন
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুমু খেতে থাকি।
রাস্তায় মানুষ ছিলদেখে শিস বাজালো,
আরো কিছু লোকজন জড়ো হয় পথের ধারে।
কেউ বিদ্রুপ করছিল হেসে,
কেউ উল্লাসে দিশেহারা হলো। কেউ কেউ সাধুবাদ জানাচ্ছিল।
কেউ ট্যাক্সিতে আসে,
একটা বাস তার
সবকটা জানালাই খুলে দিয়ে
মাঝরাস্তায়বেমালুম থমকে দাঁড়ায়।
কয়েক মুহূর্ত পর
বিদ্রুপসাধুবাদহৈ চৈ
চুপ করে যায়। নীরবে দাঁড়িয়ে সব আমাদের দেখতে থাকে।
চুমু শেষে আমরা বাইরে তাকাই
দেখিকেউ নেই
ফিরে গেছে সবশুধু গাছের পাতাগুলো
পড়ে আছে পথের উপর
আর কোয়েল ও পরিযায়ী পাখিরা
উড়ে চলে গেছে তারা অনেক আগেই;
সংবিৎ ফিরে দেখিশীতকাল চারিদিকেশীত এসে গেছে।

ম্যাট রাসমিউসেন

আমেরিকান তরুণ কবিবার্ডস এলএলসি পাবলিশিং হাউজের প্রতিষ্ঠাতা। এমারসন কলেজ ও গুস্তাভান এডলফাস কলেজ থেকে ডিগ্রি লাভ করেন এবং বর্তমানে সেখানেই শিক্ষকতা করছেন। 'Black Aperture' তার ভাইয়ের আত্মহত্যার বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থটি খ্যাতি এনে দেয় তাঁকে। বইটি ২০১৩ তে ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড ফাইনালিস্ট হিসেবে মনোনীত হয় ও ২০১৪ সালে মিনেসোটা এওয়ার্ড লাভ করে। এছাড়া ২০১২ সালে সেরা তরুণ কবি হিসেবে ম্যাট রাসমিউসেন লাভ করেন ওয়াল্ট হুইটম্যান এওয়ার্ড।
অলংকরণ: নবী হোসেন

চাঁদ
অনুবাদঃ রনক জামান

লিখিত-শব্দবিহীন এক প্রামাণ্য নথি।
ঐ দিগন্তের টেবিলের ধারে পিছলে গেলে

আমাদের রেখে যায়
সংজ্ঞায়নে ব্যর্থ কিছু মূর্খের মতো।

দৃশ্য মুছে গিয়ে দুটো মেঘখণ্ড
সংঘর্ষের শব্দ শোনায়,

আরপরস্পর টুকরো টুকরো করে
নিজেরাই ছড়িয়ে পড়ে

হয়ত সেসবদৃশ্যত অন্য গ্রামের অধীন,
বাহয়ত নিজেরই অধীনেঅদৃশ্যত

ফুল ফুটবার মতো যুদ্ধ দামামা বেজে
ওঠেঅনুভবেবোধে

আর মেঘগুলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
গোধূলীর রক্তাক্ত রণক্ষেত্র পেরিয়েআকাশে

ঝুলে আছে জাতীয় পতাকার ন্যায় : নিরেট,
প্রেরণাদায়ক ঘননীল...
অলংকরণ: নবী হোসেন
এবং ঈশ্বর বললেন
অনুবাদঃ রনক জামান

আকাশকে জলে রূপান্তর করো।
সমস্ত প্রাণিকূল একত্র হয়ে ভাবলোতবে তো ডুবে যাবে সব।

ওরা কান্না জুড়ে দিলআর মহাসমুদ্র গড়ে উঠল তাতেসে জলে।
কিন্তু আকাশকে তো সমুদ্র করোনিবলেন ঈশ্বর।

...এক আকাশ জল তো করেছি
সেখানে পাখিদের ওড়ার ভঙ্গিতেমাছেরা সাঁতার কাটে।

নেহাতই দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়জানায় এক পশু।
আর ঈশ্বরযিনি আটকে গেছেন আকাশেতার বেরুবার পথ দরকার।

নিচে তাকালেই তাঁর নিজস্ব নীলাভ বিম্ব। তিনি বিব্রত হন।
পর্বতের দিকে তাকালেদৃশ্যত সেওভূমি সমান্তরাল।

এবং ঈশ্বর বললেনএবার কেঁদে কিছু শুকনো মাঠ তৈরি করো।
প্রাণিকূল একত্র হলো ফের কান্না জুড়ে দিলএতটাই যে আগে কাঁদেনি।

ঈশ্বর জানতেনসামান্য বেশিই চাওয়া হয়ে গেছে।
রাগে-ক্ষোভে তিনি নিজেকে ছুঁড়ে দেন সূর্যের পেটে।

পুড়ে ছাইউড়ে উড়ে আকাশ হতে ঝরেঢেকে দিল পর্বতমালা।

আর প্রাণিকূল একত্র হলোবরফ-পানি খেলাচ্ছলে নাম দিলো "বরফ"।



রবিন কোস্তা লুইস


রবিন কোস্তা লুইস জাতিগতভাবে একজন আমেরিকান কবি। তিনি পরিচিতি পান তার বিখ্যাত বই "Voyoga of the sable venus" এর জন্য। যা ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। এবং এই বইটির জন্য তিনি "ন্যাশনাল বুক এ্যাওয়ার্ড" লাভ করেন। লুইস জন্মগ্রহন করেন ক্যালফর্নিয়ার কোম্পটনে। তিনি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থাকে 'Master's of fine arts' ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তিতে হাভার্ড ডিভাইনিটি স্কুল থেকে 'সংস্কৃত ও তুলনামুলক ধর্মিয় সাহিত্যএর ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তার বিখ্যাত কবিতাগুলোর মাঝে অন্যতম হলো- Art and Craft, Mother Church No, The Mothers, Summer ইত্যাদি।

অলংকরণ: নবী হোসেন
আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট
সৌরভ মাহমুদ

প্রথমত আমার চিন্তা করা উচিৎ সমস্ত সঠিক উত্তর সম্পর্কে,
অতঃপর এর মাঝে কিছু চিহ্নিত করতে হবে ভুল।
যদি একটি কুইজে দশটি সমস্যা থাকেআমি বাতিল করে দেবো
যে কোনো একটি। যখন এটা বিশ হয়ে যাবেকামড়ে ধরবো নিজের জিহ্বা।

অতএব দু’টো প্রশ্ন ফাঁকা ছেড়ে দেওয়া হবে—
দ্বিতীয়টি উত্তম ছিলোকিন্তু প্রথমটি ছিলো সর্বোত্তম।
তাদের উচিৎ তোমার পোঁদে লাথি মারাডাকো তোমার বড় বোনকে
ধীরেতারাপর তাকাও তোমার টেবিলেযেনো তোমার তাকানোই উচিৎ

একটি সাঁপ বেরিয়ে আসলো ভিন্ন গর্ত থেকে। জেনে
চিন্তা করবো দ্রুত ব্যাখ্যা করার কথা সমাজের কাছে
অধিক সততার সাথেএ-কা-এ-কা।
শিল্প ও ব্যাবসায়বিদ্যার সময়যখন সম্মতি দেবেন মিস লারসন

কাঁচিটা বের করেআমার কেটে ফেলা উচিৎ এক জোড়া ছিঁচকে চোর,
অতঃপর কেটে ফেলতে হবে আমার চুলও

আমাকে আরও দীর্ঘ হওয়া থেকে থামানোর জন্যে।

রুথ স্টোন


অলংকরণ: নবী হোসেন
শব্দমালা
অনুবাদঃ মীর নিশাত তাসনিম তানিয়া

ওয়ালেস স্টিভস্ বলেন-
"একজন কবি পৃথিবীকে ঠিক সেভাবেই দেখে-
যেভাবে একজন পুরুষ দেখে একজন নারীকে।"

আমি কখনোই বুঝে উঠতে পারি না-
একজন পুরুষ একজন নারীর গভীরে মূলত কী খোঁজে?

আদৌতে সেটা-একটা মোহর সেঁটে দেয়া জগৎ।

বুজকুড়ির অবতলপৃষ্ঠ, যা সবকিছুকে টেনে নেয় অসীমের দিকে।

কালো শীর্ষযুক্ত গাছগুলোকে দেখে মনে হয় বৃদ্ধের শ্মশ্রু-
সারি সারি ঝিমুতে থাকা কমলালেবু গাছ দুলছে, যেন-সজ্জিত ধূসর দাড়ি,
তাদের বয়স্ক দাড়িগুলো কেটে ছিন্ন করছে-যাযাবর স্ত্রী মথ।

সবকটা কমলালেবু গাছ- গেঁথে যায় এই প্রতিমায়।

"একজন কবি পৃথিবীকে ঠিক সেভাবেই দেখে-

যেভাবে একজন পুরুষ দেখে একজন নারীকে।"