![]() |
ছবি:বিশ্বজিৎ দে |
কখনো কখনো গল্প কবিতার জন্ম দেয়। আবার কখনো কখনো কবিতায় কবিতায় গল্পও গড়ে উঠতে পারে। এই বইটাতে দুটো ব্যাপারই ঘটেছে। বইটির অনেক কবিতাই আছে যা ভিভিন্ন গল্পের কথা বলে। আবার সবগুলো কবিতাও একই সুরে একটা গল্পের উপসংহারের দিকে ছুটে যায়।'
জলফড়িং পাঠকদের জন্য শশী হিমু'র নতুন বই থেকে পাঁচটি কবিতা:
প্রেমিকার সাথে বাক্যালাপ- ১
"তুমি কতো রকম করে চোখে কাজল দিতে পারো?"
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, সে গুনতে গুনতে
সংখ্যার ক্রম হারিয়ে ফেলে। আঙ্গুলের কর শেষ হয়ে যায়;
তার চোখে যেন বিধাতার প্রিয় সৃষ্টি।
যতবার দেখা হয়েছে ততবারই
তার অনুপম চোখের দিকে প্রথমে তাকিয়েছি।
প্রতিবারই ভিন্নভিন্ন ভাবে কাজল আঁকা চোখ দেখেছি।
এমন কখনো হয়নি তার চোখে কাজল নেই।
যেন তার চোখের বয়স বাড়ে না।
আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
"তুমি কতো রকম করে চোখে কাজল দিতে পারো?"
সে কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, কিছু বলল না।
আমিও কিছু বললাম না, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
কিছু সময় এভাবে নিশ্চুপ ও নীরবতার সম্মোহনে কেটে গেল।
এরপর শব্দেরা ডানা মেলল তার কণ্ঠে।
পাল্টা প্রশ্নের জানতে চাইলো,
"তুমি কতোগুলো কবিতা লিখেছো আমার জন্য?
সে জানে,
এই প্রশ্নের উত্তরে আমিও গুনতে গুনতে
সংখ্যার ক্রম হারিয়ে ফেলছি,
আঙ্গুলের কর শেষ হয়ে যায় বার বার।
আমার কবিতাই যেন তার প্রিয় সৃষ্টি।
আমি তার নীরবতা কবলিত কবি,
যতবার একসাথে মিশে গেছি নাগরিক বিকেলে
কবিতার আকুতি দেখেছি চোখে চোখ মিলে গেলে
যেন নীরবতায় চেয়ে নেয় অলিখিত ঋণ।
যতবার একসাথে মিশে গেছি নাগরিক বিকেলে
কবিতার হাহাকারে হাত রেখি হৃদয়ের কাছে,
এমন কখনো হয়নি,কবিতা নেই চিরকুটে।
চোখ বুঁজলেই তুমি আমার
হুটহাট কিছু ছবি সামনে চলে আসে।
তোমাকে দেখার জন্য আমার ছবি দরকার হয়না,
স্মৃতির পাতা হাতড়াতে হয়না ক্যালেন্ডার দেখে।
বাসের জানালার ফাঁকে, ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে,
বারান্দার কোলে, খোলা মাঠে, গাছের পাতার ফাঁকে,
সারিসারি নাগরিক কংক্রিটের মাঝে টুকরো টুকরো
আকাশের দিকে তাকালেই তোমার চিহ্ন দেখি ।
বর্ষা হলেই যেন শুধু তোমারই ধূসর আগ্রাসন,
আর শরতদিনে আকাশ হয়ে ওঠে নাগরিক নীলনদ,
চোখ বুজলেও চোখে কেবল তোমার চোখটাই ভাসে;
চোখ বুঁজলেই তুমি আমার।
কবি ও কর্পোরেট দাসত্ব
আটটা-পাঁচটার রুটিন ছুঁড়ে ফেলে রাস্তায় নামি,
কলারের বোতাম খুলতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়।
বাতাসে তখনো রঙহীন সুর্যোলোক মিলিয়ে যাচ্ছে,
শার্টের হাতার সাথে সাথে গুটিয়ে নেই দাসত্বের ছাপ।
মুঠোফোনে চোখ মেলে দেখি তোমার নির্লিপ্ততার বার্তা,
যান্ত্রিক জীবনের ভিড়েও খুজি তোমার অস্তিত্বের আভাস।
তারপর একটা সন্ধ্যার স্মৃতি পেছন থেকে অনাহুতের মতো
দুহাতে আকড়ে ধরে আমার নির্নিমেষ দুটো চোখ।
আমি একটা লোকাল বাসের জানালা খুঁজতে খুঁজতে,
ইতিহাসের পেছনের চাকায় উঠে যাই। এটোসেটো সিটে
বসে ভাবি, জীবনটা যেন বিরতিহীন পথে লোকাল সার্ভিস।
ইতিহাসের বদ্ধ জানালায় চোখ পড়তেই দেখি নিজের প্রতিবিম্ব,
অপরিচিত যাত্রীরা নেমে গেলে, ব্যক্তিগত সব দুঃখবোধ আর
জীবনের অপূর্ণতা পাশে এসে বসে-একই তো গন্তব্য!
বুকের মধ্যে অক্ষরগুলো মুহুর্মুহু ডানা ঝাপটায়,
কর্পোরেট দাসত্ব অস্বীকার করি কবিতায় কবিতায়।
অভিনয়
তুমি চলে যাবে ভাবতেই আমার দুহাত মুষড়ে পড়ে।
যে হাতে হাতে রেখে তরজমা করেছি যৌথ অনুভূতি,
সে হাত চলে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে - ভাবলেই
কবিতাগুলোর জন্য অসহায় লাগে, নতমুখে
চেয়ে থাকি মাটির দিকে নিস্পলক।
তুমিহীনা ভালবাসার মতো এই অনাথ কবিতাগুলো
নিয়ে কোথায় যাব? এই দুশ্চিন্তায় রাতগুলো নির্ঘুম;
বুকের মধ্যে খাঁখাঁ করতে থাকা একটা বিরান জাগে।
তুমি চলে যাবে ভাবতেই আমার নিঃশ্বাসগুলো
সহসাই দীর্ঘশ্বাস হয়ে ওঠে।
যে চোখে চোখ রেখে জেনেছি হৃদয়ে কাকে বলে
সে চোখ আর কোনোদিন দেখবোনা- ভাবলেই
স্মৃতিগুলো সাদাকালো বায়স্কোপের মতো
দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে বারবার অবিরাম অবিরত।
চাঁদের কলঙ্কের মতো আমাদের অতীত নিয়ে
কোথায় যাব? আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার অভ্যেস
তোমার বুকেও তো জাগাবে ব্যাথার চর, চাঁদ জাগলে!
তোমার অস্তিত্বে আমি বেঁচে থাকার অনন্দ পাই
তুমি চলে গেলে বেঁচে থাকার অভিনয়ে বাঁচি।
বৃ-৫
হিরোশিমা আর নাগাসাকি
হৃদয়ে নিয়ে বিন্দাস ঘুরছি
স্মৃতি
তোমাদের স্মৃতিকাতরতা বড্ড অদূরবর্তী;
বিগত প্রেম, কিম্বা প্রথম প্রেমিকার স্মৃতি হাতরে
সহজেই তোমাদের মাঝে জেগে ওঠে ব্যাথার নদী।
স্মৃতি হাতরে বড়জোর ফিরে যেতে পারো কৈশোরে,
খুব বেশি হলে শৈশবে ফিরে আনন্দ রোমন্থন।
স্মৃতি বলতে আমি ফিরে যাই মাতৃগর্ভে,
ধরিত্রীর বুকে আনন্দ-দুঃখ
কিম্বা পরোকালের স্বর্গ-নরক
কোনটিই আমি অস্বীকার করিনা।
তবুও ওই জঠরকেন্দ্রিক স্মৃতি আমি এড়াতে পারিনা
আমার দুঃখ ছিল না,আনন্দ ছিল না।
ভয় ছিল না, মৃত্যু ছিল না কান্না ছিল না,জীবনের ।