মিসিংরা
আগে মিরি নামেই বিখ্যাত ছিল। অসম বুরঞ্জিতে, প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থে নৃতত্ত্ব বিষয়ক
গ্রন্থ এবং সরকারি নথিপত্রেও 'মিরি' বলেই উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও মিরিরা নিজেকে মিসিং
বলেই অন্য সমাজে পরিচয় দিয়ে থাকে। এই নর্ঘাত সত্যটা প্রথমে বহির্জগতের কাছে তুলে
ধরেন ব্রিটিশ রাজ কর্মচারী ও লেখক জে. এফ নিডহ্যাম সাহেব।
--
লিখেছেন কনক কুলি।
যোগিনী
তন্ত্রে প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের চারসীমা সম্পর্কে এভাবে উল্লিখিত হয়েছে -
"নেপালস্য
কাঞ্চনাদ্রিং ব্রহ্মপুত্র সংগমম
করতোয়াং
সমাশ্রিতা যাবদ দিক্কর বাসিনীম।"
কামরূপ
রাজ্যকে আবার চারটা পীঠে ভাগ করা হয়েছিল। যেমনঃ ১. কামপীঠ, ২. স্বর্ণপীঠ, ৩. রত্নপীঠ,
৪. সৌমারপীঠ। রাজধানী ছিল প্রগজ্যোতিষপুর। সেকালে এখানে রাজা মহারাজাদের বংশ কিরাত,
স্লেচ্ছ, অসুর, দৈত্য - দানব ইত্যাদি নামে চিহ্নিত হত। কিরাত রাজা ভগদত্ত মহাভারতের
যুগ থেকেই কামরূপের আদিম স্থানীয় জনগোষ্ঠী। এই জাতি - জনজাতিদেরকেই পরে 'মংগোলয়েড'
বলে পণ্ডিতগণ বর্গীকরণ করেছেন। ডঃ প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্যের মত, "আদিম কালেই
নার্বিক (আর্য), মংগোলয়ড (কিরাত), মেডেটেরেনিয়ান (দ্রাবিড়), প্রটো অস্ট্রলয়ড (অস্ট্রিক)
ও নেগ্রিটো ইত্যাদি পাঁচটি মানব প্রজাতির সংমিশ্রণে অসম ও বর্তমানের উত্তর পূর্বাঞ্চলের
লোক সমষ্টির সৃষ্টি হয়েছে। ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি বহু পণ্ডিত লক্ষ্য
করেছেন যে মিরি বা মিসিং রা তিব্বতবর্মী জাতি- জনগোষ্ঠীর বংশধর। এই জাতি জনগোষ্ঠীরর
পূর্ব পুরুষগণ পূর্বে মহাচীনের দক্ষিণাঞ্চলে থাকা ইয়াংসিকিয়াং ও হোয়াংহো নদীর উৎসস্থলে
আস্তানা গড়েছিল। তাদের প্রথম তিব্বতি হিমালয় দলটি তিব্বত ও হিমালয় পাহাড় অঞ্চলে
থেকে গেল। দ্বিতীয় অসম বার্মা দলটি অসমের ভৌগলিক সীমা ছেড়ে বার্মা ও তার আশেপাশে
থাকা অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তৃতীয় উত্তর অসম দলটি অসমের উত্তর পূর্বে অবস্থিত
পর্বতমালায় প্রবেশ করেছিল। এই উত্তর অসম দলটিতে আবর (আদি), মিরি (মিসিং), ডফলো (নিচি)
ও মিসমায়া অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আবার জনগোষ্ঠীর দিক থেকে পাচি, পাদাম, মিঞং, গানং,
রাগিন, পাইলির, পাকতে, রামুগাচি, মিরি ইত্যাদি বেশ কিছু ছোট- বড় দল আছে। মিরিং বা
মিসিং তাদেরই একটি অংশ। মিসিংরা প্রকৃতপক্ষে পাদাম - মিঞং জনগোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে আসা
জনগোষ্ঠী, এটা অনেকেই বলতে চান। মিসিংকো ভাষার সঙ্গে আদি, পাদাম, মিঞং, মিলাং ভাষার
সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। এর জন্যই মিসিংকে আদি রক্ত- মাংসের সম্বন্ধযুক্ত দাদা-ভাই বলেই
আদি লেখক তালম রুকব নির্দেশ করেছেন। এই জনগোষ্ঠীগুলো নিজেকে 'আনৌ দঞি ও আর পঃল' অর্থাৎ
সূর্য - চন্দ্রের বংশের বংশধর 'ছেঃদি-মেঃল' এর সন্তান সন্ততি বলে পরিচয় দেয়। 'পনদং
আনৌ' ও 'আবু তানি' নামক জনৈক মাতৃ ও পিতৃ পুরুষ থেকে জাত বলেই এই জনগোষ্ঠীগুলোকে তানি
জনগোষ্ঠী বলা হয়। এবং তাদের বলা ভাষাটাকে বর্তমান 'তানি আগম' অর্থাৎ মানব ভাষা বলে
বর্গীকরণ করা হয়েছে।
বর্তমানে
অসমে বসবাস করা ছোট-বড়, জাতি-জনজাতি যেমন - চুতিয়া, আহোম, খামতি, ফাকিয়াল, তুরাং, আইতন,
খাময়ান, বরো, গারো, রাভা, তিওয়া, ডিমাসা, বরাহি, মরান, মটক, সোনোয়াল, কছারি, দেউরি,
মিরি অথবা মিসিংরা মংগোলয়ড প্রজাতির বংশধর বলে চিহ্নিত। এই ছোট-বড়, জাতি-জনজাতিরা কামরূপ
বা অসমের মাটিতে অতীতের বন-জঙ্গল, পরিষ্কার করে গ্রাম, নগর, শহর পেতে স্থানীয়, ভাষায়,
নদ-নদীগুলোর নিজস্ব নাম দিয়েছিল। এই নদী পারেরই মিরি অথবা মিসিংরা কোথা থেকে কখন এসে
বহ্মপুত্রের পারে আস্তানা গড়ে তুলল জানা যায় না। তদুপরি তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক,
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় রীতি নীতি, আচার ব্যবহার সম্পর্কে লিখিত প্রমাণেরও অভাব
দেখা যায়। মিরি বা মিসিংদের নিজস্ব কোনও লিখিত বুরঞ্জি (ইতিহাস) সাহিত্য ছিল না। তাদের
নিজস্ব সমৃদ্ধশালী এক জীবন্ত ভাষা আছে যদিও লিপি ছিল না। লিপি না থাকার জন্যে তাদের
মধ্যে সাহিত্যচর্চাও ছিল না। তারা সবাই মৌখিকভাবে কথা বলে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে মৌখিক
সাহিত্যকে বুরঞ্জির (ইতিহাসের) শাখায় নেওয়া যায় না। ফলে একটা সত্য কথাও মিথ্যে অনুমান
হয়ে দাঁড়ায়। তবুও পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু যেমন বলেছেন, 'খুঁজতে জানলে ছোট ছোট নুড়িও
আদিম পৃথিবী সৃষ্টির আদিম ইতিহাসের কথা বলতে পারে।' ওভাবে বললে মিরি বা মিসিং জনগোষ্টীর
মধ্যে প্রচলিত লোকবিশ্বাস, সামাজিক পরম্পরা, রীতিনীতি, ভাষাতত্ত্ব বিচার, কৃষ্টি-সংস্কৃতি
ও ধর্মীয় লোকাচার ইত্যাদির ওপর নির্ভর করা কামরূপ বা অসমে আসা দেশি বিদেশি পরিব্রাজকের
লিখে যাওয়া টীকা, পুরনো পুথি- পাঁজি, সংস্কৃত ভাষায় লেখা কাব্যগ্রন্থ, তাই ভাষায় লেখা
বুরঞ্জি, অসম বুরঞ্জি, ভারত বুরঞ্জি এবং শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের লেখা কীর্তনগ্রন্থ ইত্যাদির
ওপর ভিত্তি করে মিরি বা মিসিংরা কোথা থেকে কখন এসে এই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে স্থানীয়ভাবে
বসবাস করতে শুরু করেছিল, এই কথার কিছু অনুমান পেতে পারি।
মিসিংরা
আগে মিরি নামেই বিখ্যাত ছিল। অসম বুরঞ্জিতে, প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থে নৃতত্ত্ব বিষয়ক
গ্রন্থ এবং সরকারি নথিপত্রেও 'মিরি' বলেই উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও মিরিরা নিজেকে মিসিং
বলেই অন্য সমাজে পরিচয় দিয়ে থাকে। এই নর্ঘাত সত্যটা প্রথমে বহির্জগতের কাছে তুলে
ধরেন ব্রিটিশ রাজ কর্মচারী ও লেখক জে. এফ নিডহ্যাম সাহেব. তাঁর লেখা গ্রন্থ
Outline Grammer of the sayang Miri Language- এ এইভাবে উল্লেখ করেছেন - 'শদিয়ার আশেপাশে
ব্রহ্মপুত্র, দিহং নদীর পারে বসবাস করা মিরিরা নিজেকে 'মিসিং' বলে। মিসিংদেরকে সমতলে
মিরি বলে সম্বোধন করে অ-মিসিংরা।
আগেই
উল্লেখ করে এসেছি যে কামরূপ রাজ্যের শেষ সীমা ছিল 'দিক্কর নদী'। ঐতিহাসিক পণ্ডিতগণ
দিক্কর নদীকে দিক্রং নদী বলেই মনে করতেন। দিক্কর বা দিক্রং শব্দটিও আসলে 'তানি' জনগোষ্টী
মিরি বা মিসিং ভাষার এক ছন্দময় শব্দের সম্ভারেই গঠিত। যেমন, (দিতৌ আচি + চিকর + বিতকর)
দিক্কর বা (দিতৌ আচি + চিকর + বিতকরং) দিক্রং শব্দের উৎপত্তি। এরা অসমিয়া অর্থ হল শিলাময়
পাহাড়ের গভীর অন্তর্ভাগ ভেদ করে নিজে নিজে বহে আসা নির্মল জলধারা। এই 'দিক্কর' শব্দটি
সম্ভবত সংস্কৃত ভাষার বেদব্যাস কর্তৃক লিপবদ্ধ হওয়া তানি ভাষায় লিপিবদ্ধ হওয়া তানি
ভাষার প্রথম লিখিত শব্দের রূপ বা নদীবাচক নাম বলে ধরে নিতে পারি। এই নদীটি বর্তমানে
অসমের লখিমপুর জেলায় প্রবাহিত। স্মরণীয় যে দিক্কর বা দিক্রং নদী থেকে শদিয়ার ব্রহ্মকুণ্ড
পর্যন্ত উত্তরকূলের নদ নদীগুলো 'তানি' জনগোষ্টী মিসিং ভাষার ছদোময় শব্দের সম্ভারে নামাঙ্কিত
করাটা, এইসব নদীর পারে মিরি বা মিসিংরা যে অতীতে বাস করেছিল তারই প্রমাণ দেয়। 'তানি'
ভাষায় দি বা দৃ শব্দ জলকে বোঝায়।
তানি
মিসিং ভাষার তুষার বা হ্রদকে সিয়েং বলে। মিসিংদের জনপ্রবাদ মতে, 'কঃজে সিয়েং' থেকে
কিছু দূরে অবস্থিত একটি চির তুষার খাদ থেকে বেরিয়ে পূর্বদিকে বইয়ে যাওয়া নদীটিকে 'সাংপু'
নদী বলে। 'সাংপু' শব্দটিকে অনেকে তিব্বতী শব্দ বলতে চান। যদিও এই শব্দটি আসলে মিসিং
ভাষা থেকেই সৃষ্টি। মিসিং ভাষার 'চিয়েং আচি + বিত্চাং + কাম্পু সিচাংপু' থেকেই 'সাংপু
শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ সিয়েং মানে তুষার, আচি মানে জল, বিত্চং মানে বয়ে আসা বা উৎস
এবনফ কাম্পু মানে রূপ বা শুভ্রতা। এই সাংপু নদীর গতিপথকে কেন্দ্র করেই যে তিব্বতের
বমিয়ান প্রদেশ থেকে মিরি বা মিসিং লোকেরা পূর্বদিকে অগ্রসর হয়েছিল এই কথারই পরোক্ষ
প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ অরুণাচল প্রদেশের পাসিঘাটে এই নদীকে সিয়াং নদী বলে। সিয়াং নদী
পার হওয়া সম্পর্কে মিবু আঃবাং (লোকগীত)- এ এভাবে উল্লিখিত আছে-
'পৌচিনৌ
পোত্তাং অৌঃম্মায়া
চিয়াঙৌ
বেরকং অৌঃমায়া।'
অর্থাৎ
বনমোরগের ঝাঁপ দিয়ে পার দেওয়ার মতো তৎক্ষণাৎ সিয়াং নদী পার হয়েছিল। এবং 'বমি আমং' ছিল
নাকি মিসিংদের আদি বাসস্থান। এই 'বমি আমং' কেউ বলেন তিব্বতের বমিয়ান প্রদেশ। আবার কেউ
বলেন পাসিঘাটের আশেপাশে থাকা 'বমি রৌমকু'। এছাড়া লোক কথা অনুসারে মিসিংদের বাসস্থানের
কথা জানা যায়, যেমন- ১। কিঃলিং কাংগৌ বা কিঃলিং লৌঃ তৌ (একটি পাহাড়ি অঞ্চলের নাম),
২। তাপাম দুমবৃন (চিরতুষার আবৃত উঁচু জায়গা বা পর্বত), ৩। তাচৃগ দুমবৃন অর্থাৎ 'তাঃচুপ'
নামক পাখির বিচরণ ভূমি বা পর্বত, ৪। মিরি পাদম, ৫। রৌগৃ-রৌগাম, ৬। ছেঃদি আমং মঃমাং
সাদিয়াং ইত্যাদি নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও চিরকি দিতৌ আদি আমং, পেগু চিয়েং, দাম্র
চিমং, কৃরলে মংকু, দঃলংদিরি, রৃগ্নু আমং রৃগাং যাকে অসমিয়া ভাষায় 'মাজুলি' বলে; ইত্যাদি
অঞ্চলেই ছিল নাকি মিসিংদের আদি বাসস্থান। রৃগ্নু শব্দ থেকেই অসমিয়া পুর শব্দ যোগ হয়ে
রৃগনুপুর, রত্নপুর, রতনপুর হতে পারে। এখনও মাজুলিতে রতনপুর মিরিগাঁও বলে বৃহৎ এলাকার
মিরি গ্রাম দেখা যায়। মাজুলির বৃহৎ সংখ্যক বাসিন্দাই হল এই মিরি বা মিসিং লোকেরা। তা
ছাড়া কামরূপের মধ্যস্থলে দরং জেলার ব্রহ্মপুত্র ও বরগাং নদীর সঙ্গমস্থলকে মিসিং ভাষায়
'গাম আমং' বলে। এই গাম আমং শব্দ থেকেই 'গাংমৌ' শব্দের উৎপত্তি হতে পারে যেখানে মহাপুরুষ
শঙ্করদেব আনুমানিক ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে মিরিকুলের পরমানন্দ মিরিকে
নামধর্মে দীক্ষিত করে 'আতা'র (ধর্মাচার্য) দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। পরমানন্দ জাতিতে
মিরি ছিলেন।
মুসলমান
পরিব্রাজক ইবন বতুতার 'সফরনামা, গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে ক্রিস্টিয় চতুর্দশ শতাব্দী তে
সুবনশিরি নদীর দুই পারে 'হাবুং' নামে একটি জনজাতীয় রাজ্য ছিল। ঐতিহাসিক রাজমোহন নাথ
তাঁর 'Background of Assamese Culture নামক গ্রন্থে হাবুং সম্পর্কে এইভাবে উল্লেখ করেছেন-
'Bodos
called Habung or vast land ( Ha - land, Bang - Plenty, Vast) kingdom was called
Habang or habung. The kingdom extended to the west up to the subansiri river.'
হাবাং
রাজ্যটি রত্নপুর থেকে সুবর্ণশ্রী নদীর পাদদেশ পর্যন্ত বৃহৎ এলাকাজুড়ে ছিল এবং হাবুং
রাজ্যটি আসলে মিসিং জনগোষ্ঠীর 'আবু তানিকৌ' রাজ্যটিকে 'হাবু' নামে লিপিবদ্ধ করেছিল
বলে ভাবার অবকাশ আছে। কারণ মিসিং ভাষায় 'আ' শব্দটিকে মাটিকে বোঝায় এবং আবু আমং শব্দটি
উর্বর জলাভূমিকে বোঝায়। এবং উর্বর জলাভূমিতে যে তারা অতীতকাল থেকেই বাস করে এসেছিল
এ কথার প্রমাণ নিচের অসমিয়া বনগীতের পঙক্তিটি থেকেই বোঝা যায়-
'বরনৈ
বাঢ়িলে চাপরি বুরিলে
মিরিয়নী
কান্দিলে চাঙত।'
(অর্থাৎ
বড় নদীতে বান আসলে, চর ডুবে গেল। মিরি রমণী চাঙে বসে কাঁদছে।)
অন্যদিকে
মিসিং লোকগীতে 'অবনরি রৃগনু আমং' সম্পর্কে পাওয়া যায় -
'অরনরি
আঃনৌচৌ আআৃন-মরকং আঃনৌবং
চুল্লি
পত্তা- পত্তাঃদ আআৃন-মরকং বুত্লেনদাগ।'
অরনরি
নদীটি সুবর্ণশিরি নদী। তার বালিতে বালিতে স্বর্ণরেণু পাওয়া যায়। সুবনশিরি নদীর মিসিং
ভাষার স্থানীয় নাম অবনরি তা আগেই উল্লেখ করে এসেছি। বরো ভাষায় এই নদীর নাম পাওয়া যায়
নি। এই দিক থেকে বলা যে বরোরা সুবনশিরির পারে অতি সাম্প্রতিককালেই যেন প্রবেশ করেছে।
অরনবির পাড়ে থাকা মিংমা>কেমৃন, পাপুম্পারে ইত্যাদি শব্দগুলি তানিমূলীয় ভাষার শব্দ।
এই শব্দগুলি তানিগোষ্ঠী মিসিংদের অতীত ইতিহাসই তুলে ধরে।
বুরঞ্জবিদ
হিতেশ্বর বরবরুয়া রচিত 'আহোমের দিন' নামক বুরঞ্জপুথিতে মিরি সম্পর্কে এইভাবে উল্লেখ
করা হয়েছে - ১২০৩ শকে ইংরেজি ১২৮১ সালে চুবিনফা রাজা হলেন। ইতি চুতেইফা মহারাজের প্রথম
রাজকুমার। পূর্বে চুকাফা রাজার সঙ্গে আসা কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই নিয়ম করেছে।
উদাহরণঃ বালটাপারের কাছে চাওপাংবন্ডুক বলে মিরি লোকের একটি ঘর পেয়েছে। চাওপাংবন্ডুকের
পুত্র ত্যাওকাংবন্ডুক, তার কন্যা হিংগুলি। হিংগুলিকে এনে মহারাজা মহামহিষী করে নিলেন।
এই হিংগুলিই হল আহোম এবং মিরি বা মিসিংদের মধ্যে স্মন্বয়ের সাঁকো গড়ে তোলা প্রথম মিরি
কন্যা এবং হিংগুলির মিরি নাম হল রকমে ওরফে রহিলাং। রহিলার দিন থেকে রইলা নিয়মের উৎপত্তি।
তদুপরি
মহারাজ সাক্ষাৎ করে হিংগুলির পিতৃ চাওপাংবন্ডুকে 'বরগোহাঞি'র দায়িত্ব অর্পণ করেন। এবং
এই মিরি বরগোহাঞি ১২০৩ শক বা ইংরেজি ১২৮১ সাল থেকে ১২৮৬ শক বা ইংরেজি ১৩৬৪ সাল অর্থাৎ
চুতুপা রাজার আমল পর্যন্ত বরগোহাঞির পদে ব্রত ছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই পরিবার
মিরি বরগোহাঞি নামে খ্যাত।
আনুমানিক
১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে বৈষ্ণব গুরু শ্রীমন্ত শঙ্করদেব আবুতানির আবু আমং বা আবু রাজ্যে এসে
আতা (আচার্য) পরমানন্দ মিরি কে একশরণ নামধর্মে দীক্ষিত করেন। অধিকন্তু মিরি লোকেদের
মধ্যে এই ধর্ম প্রচার করার কথা তাঁরই রচিত গ্রন্থ দশম স্কন্ধে এভাবে উল্লেখ করেছেন
-
'কিরাত
কছারি গারো মিরি
কুবাছ
স্লেচ চন্ডাল।'
এখানে
ব্যবহৃত কছারি শব্দটি কছারি রাজ্যকে,গারো শব্দটি গারো রাজ্যকে এবং মিরি শব্দটি আবুতানির
আবু রাজ্যের মিরি লোককে বুঝিয়েছে বলে অনুমান করা যেতে পারে। আবু রাজ্যের উর্বর ভূমি
ভাগ মিরি ভাষায় 'রৃগনু' অর্থাৎ 'মাজুলি' বলে সেই কথা আগেই উল্লেখ করে এসেছি।
মাজুলির
গরিষ্ঠসংখ্যক বাসিন্দাই ছিল এই মিরি সমাজের লোক। আর মাজুলিতে শঙ্করদের মিরি লোকেদের
ঐনিতম, লাস্যময়ী অপ্সরা যুবতী, নৃত্যরত লাস্যবিলাসের ভঙ্গিমা এবং মিরিদের চাংঘর তথা
মুরং ঘরের নকসা দেখে আনন্দে অভিভূত হয়েছিলেন এবং অতুলনীয় বলে প্রশংসাও করেছিলেন।
সূর্যকুমার
ভূঞা সম্পাদিত 'দেওধাই অসম' অনুযায়ী স্বর্গদেব চুহুংমুঙের রাজত্বকালে (১৪৯৭- ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ)
মিরিদেরকে আহোম রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হল। ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে - 'অবশেষে রাজা আগের
দিনে দিহিরে এসে লাংক্লি খুতচান শকত ত্যাওচুংলুং কুংরিণকে খাওমুং মুংতাও নাম দিয়ে সবার
সামনে বসতে দিলেন। এই পরিবারটিও জাতিতে 'মিরি'।
ব্রহ্মপুত্র
নদীর উত্তর-দক্ষিণে অবস্থিত জায়গার নামগুলো মিসিং ভাষার শব্দ দিয়ে তৈরি। এটা প্রমাণ
করে একটা সময়ে মিসিং লোক এইসব অঞ্চলে বসবাস করত। যেমন - ডিব্রুগড় জেলার ডিবুরু (দিরু
আচি + বুরু-ব্রা) মাকুম, দিকম, তালাপ, অবস্থিত মিরিপাথার, গোলাঘাট জেলার ঘিলাধারি মরঙি
অঞ্চলে থাকা মিরি পাথার, ধানশিরি নদীর পারে থাকা কমারগাঁয়ের মিরি পাথার, নামরূপের নিকটে
অবস্থিত মিরিপাথার, ডিবরু নিকটে অবস্থিত মিরিপাথার, কার্বিংআংলং জেলার হামরেন মহকুমার
অন্তর্গত মিরিংকু (মিরি+দুংক) প্রভৃতি। একইভাবে ধেমাজি শব্দটিও মিরি ভাষার শব্দ - যেমন,
(দিমাং +আচি > দিমাচি>দিমাজি>ধেমাজি হয়েছে বলে বলা যায়। দিমাংআচি মানে স্রোতের
জল বা ঢল ঢেউ খেলানো জায়গা।
দেখা যায় যে যোগিনীতন্ত্রে
উল্লেখিত থাকা 'দিক্কর' শব্দ থেকে সাংপু পর্যন্ত , সাংপু থেকে চিয়াং পর্যন্ত, চিয়াং
থেকে কামরূপের সৌমার, সৌমারখন্ডের চুতিয়া রাজ্য পর্যন্ত এবং চুতিয়া রাজ্য থেকে আহোম
রাজ্য পর্যন্ত , আহোম রাজ্য থেকে বর্তমান মিসিংরা কামরূপ বা অসমে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ
করে এসেছে এবং অসমিয়া ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি সংস্কৃতি তথা অসমিয়া জাতির এক অবিচ্ছেদ্য
অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। এখনও অসমিয়া ভাষা মিসিংদের দ্বিতীয় প্রাণের ভাষা। অসমিয়া
জাতির পৈতৃক সম্পত্তি বহাগ বিহু ( রঙালি বিহু ) , কাতি বিহু ও মাঘ বিহু মিসিংদেরও এক
কৃষিমূলক জাতীয় উৎসব। ঢোল, তাল, পেঁপা-গগনা , বনগীত, বিহুগীত , আইনাম, বিয়ানাম , বরগীত
, কীর্তন-ভাগবত , ভাওনা-সবাহ ( পৌরাণিক পালা অভিনয় বিশেষ ) , অই নিঃতম বলতে আটখানা
হওয়া এই বর্ণাঢ্য ও অতিথিপরায়ণ জাতিটি প্রাগৈতিহাসিক দিন থেকে কামরূপের সৌমারখন্ডে
এক বর্ণিল, স্থানীয় জনগোষ্ঠী হিসাবে বসবাস করে এসেছে এবং বসবাস করতে থাকবে।