অভিমান ।। দেবরাজ দাশগুপ্ত

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আমাদের প্রথম অপেক্ষা কখন রান্না করার লোক আশা কলিং বেলটা বাজাবে।নিয়ম মেনে আজকেও সাড়ে আটটার দিকে যখন বেলটা বাজল একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে দরজাটা খুলে দেখি সাথে ওর ছেলেটা আজকে আবার এসেছে।
 ‘কি রে মিঠু?’ মা যে ঠিক সময়ে রিপোর্টিং করল তার পুরষ্কার হিসেবে একটু ভাল ব্যাবহার পেল সে।
 উত্তর এল মিঠুর মার কাছ থেকে, ‘তার বুলে পেট ব্যাদনা করের।
  সকালবেলা চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বাবার মুখে জমা অন্ধকার এই অনাহুত চরিত্রটিকে দেখে আরেকটু বেশী গাঢ় হল।দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে আবার মিঠুর মুখের দিকে চেয়ে আশার প্রতি আমার প্রশ্ন ও অভিযোগ,‘তোমারে যে বললাম ওকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য!
 ‘করছি তো।প্রথম কাজ গরম জল বসানো , সেটা করতে করতে আশা উত্তর দিল।
 ‘তাইলে বাহানা ছাড়া আর কিতা।বাবা বললেন, ‘কিতারে, পড়া ভাল না লাগলে খাইবে কি করে?’
 বেঁচে থাকা বা জীবনসংগ্রাম নিয়ে গম্ভীর চিন্তা করার মত সামর্থ্য এখনো আসে নি বলে মিঠু কোন কথা বলল না।মিঠু শব্দটা শুনলে হয়ত মিষ্টই কিছু মনে হয়, কিন্তু ওর মুখ ময়লা,শরীর স্বাস্থ্য ভাল নয়। শরীরে তেমন জ্যোতি নেই।সে সোফায় বসে রইল।
 ‘বই থাক ইখানে।কাজের ফাঁকে আশা একবার এসে বলে গেল।
 আশা আমাদের বাসায় সকালে আসে, যাওয়া একেবারে সন্ধ্যার পর।একেবারে অফিস ডিউটির মতই, তবে ডিউটির সময় যেন একটু বেশীই।দুই হাতে যেন দশ হাত হয়ে উঠতে চাইছে।এক চুলায় ভাত, আরেক চুলায় চা শেষ হলেই ডাল।অনেক বাসন কোসন। সব শেষ করতে হবে বড়দা বৌদিরা উঠার আগেই।ঘুম থেকে উঠার পর বড়দার একটাই কাজ,অফিসের জন্য রেডি হওয়া এবং ঘরে একটা তাড়াহুড়ার পরিবেশ লাগিয়ে দেওয়া। আরেকটা কাজ সে করে, স্নান করে ঠাকুর ঘরে কিছুক্ষণ কাটায়।এটা শুরু হয়েছে বিয়ের পর।
 তাও কোন অসুবিধা ছিল না, যদি বড়দার দেড় বৎসরের ছেলেটার অন্য কোন ব্যবস্থা থাকত।অন্যদিন মিঠুও কিছু সময় খেলে শুভর সাথে।কিন্তু আজ সে একেবারেই মনমরা।
ঘুম থেকে উঠার পর মিঠুর আমাদের বাসায় ওর মার সাথে আসার কারণ নিয়ে আবার এক প্রস্ত আলোচনা হল।
 ‘এর পেটে কৃমি হয়েছে।বড়দা বলল।
হবে না।খালি বাইরের এটা ওটা খেতে চায়।বৌদিও তাকে সমর্থন করল। কয়েকদিন আগে মিঠুকে পাঁচ টাকা দিলে সে বাইরে গলির মুখের দোকান থেকে পুরো টাকাটাই মটর ভাজা খেয়ে সাবাড় করে আসে।
 ‘ইগু এ আমারে জ্বালাইয়া মারতাছে।আশা বলে দুজন শিক্ষিত মানুষের আশংকাকে সত্যি ভাবতে ভাবতে।
 কিন্তু বড়দা কি সিরিয়াসলি বলেছিল কথাটা, নাকি রসিকতা করছে? প্রশ্নটা ভাবাতে লাগল।
 বড়দা একটা রিটেলে কোম্পানিতে আছে।সেখানে হাউসকিপিং এর চাকরি করত আশা ।এদিকে আমাদের বাসায় কাজের মানুষ চলে গেলে সর্বক্ষণের কাউকে না পেলে আশাকেই নিয়োগ দেওয়া হল।
 পৃথিবী রুটিন মাফিক ঘুরতে থাকে আর আমাদের বাসার কাজকর্মও অন্যান্য দিনের মত চলতে থাকে। তবে এটা হয়ত আমার দেখারই দোষ যে মনে হয় এই পরিবারের সব সদস্যরা শুয়ে বসে আছে, নতুবা তাদের কাজকর্মগুলো শুয়ে বসেই করতে হয়। একমাত্র মিঠুর মা শ্রমের মর্যাদা রচনা লেখার উপাদান সৃষ্টি করছে।
  চাকরির প্রস্তুতির পড়াশোনায় একঘেয়েমি চলে এসেছে।কদিন ধরেই ভাবছি কিছু লেখালেখির দিকে এগোব।আজকে তাই এই ঘরটাকে দেখব।মা চলে যাওয়ার পর এই ঘরে কি পরিবর্তন এসেছে বোঝার চেষ্টা করব। প্রথমে আশেপাশের পরিচিত জগত নিয়েই কিছু লেখার চেষ্টা করা ভাল।মা নাই গৃহে যার সংসার অরণ্য তার। একজন সন্তান তার মার কাছে কি চায়, এই ভাবনা মনের মধ্যে এলে মিঠুকে খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করি সে ঘুমিয়ে আছে সোফায়।
   মিঠুর বাবা ,আশার স্বামী মেস্তরীর কাজ করে। আশা আমাদের বাসায় কাজ করে বেতন পায়
তিন হাজার টাকা।সেই তিন হাজার টাকার জন্য সে আমাদের ঘরে সাড়ে আটটায় রিপোর্টিং করে , সন্ধ্যা সাতটার আগে কখনোই বেরোতে পারে না।
 কিছু রান্না করে মিঠুর মা, আবার কিছু বৌদিও, বিশেষ করে বড়দা যা অফিসে নিয়ে যাবে বা যেসব খাবার বড়দার প্রিয়।তখন আশাকে সামালাতে হয় বাচ্চাটাকে।অন্যদিন মিঠু যখন শুভকে সামলে নিয়েছে এই ফাঁকে আশা ঘর ঝাড়ু দিয়ে দিয়েছে। বাসি ঘরে না খেয়ে কিভাবে যাবে? কিন্তু আজ মিঠুর সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই। আশা শুভকে নিয়েই রইল।
খাওয়ার পর বললাম,‘ মিঠুকেও ভাত দিয়ে দাও।
খাইব নি কুনো।জ্বরও আইছে।
 ভেবেছিলাম মিঠু যদি পাতলা পায়খানায় আক্রান্ত না হয় তবে বাবার কাছে রাখা গ্যাসের ওষুধ বা নিজের কাছে রাখা হজমের সিরাপ,যেকোন একটা দেওয়া যাতে পারে ।এখন আবার জ্বর।ডাক্তারি করার ভাবনা পরিত্যাগ করে বলি, ‘ডাক্তারের কাছে লইয়া যাও।
 ‘দেখি।ইখান থাকি যাওয়ার পরে।
 ইখান মানে আমাদের বাসা।মানে অন্তত রাত আটটা।
 সকালে খাওয়া দাওয়ার পর শুভ ঘুমিয়ে পরে। আমিও গলির মুখে ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা মেরে আসি।
 আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম চলার ফাকে ফাকে বৌদি ও আশার কথাবার্তা চলছিল।
 বৌদি বলল,‘বলেছিলাম না, ময়নাকেও আমাদের বাসায় নিয়ে আসার জন্য, আলাপ করে ছিলে ময়নার বাবার সাথে?’
 মেয়েকেও বাসাকাজে লাগানোর প্রস্তাবে আশা আমতা আমতা করে,‘না।করছি,ময়নার বাপে কিণ অখন না।
ওকে তো আলাদা বেতন দেওয়া হবে।ও তো আমাদের শুভকে রাখতেই পারে। বৌদি রান্নার কাজে বাসত।ওর কাজ তো কিচ্ছু না।শুধু শুভর সাথে থাকা একটু,ওর সাথে খেলবে।
 আশা এবারেও আমতা আমতা করে,‘ঘরে পানি তোলা লাগে।
 রান্না ঘরের এসব কথা শুনা যায় আমার রুম থেকে।ময়নাকে এক দুবার এসেছিল আমাদের বাসায়।স্কুলে গেলে ক্লাস সেভেন এইটে পড়ত হয়ত।কিন্তু সে স্কুলে যায় না ।এই কাজটাকে বেবি সিটারের কাজ বলা যেতে পারে।একজনের ইনকাম বাড়বে।আচ্ছা,আশার মেয়েটাকে আমরা পড়াশোনার কথা তেমনিভাবে বলছি না কেন?
 পিচ্চি শুভ হয়েছে আরেকটা। আশার কোল চিনে নিয়েছে। ছোট্ট শিশু তো আর বুঝতে পারে না ঘরের লোক আর কাজের লোকের পার্থক্য। আর আশাও তো একজন নারী ও তিন ছেলে মেয়ের মা।ওর কাছেও মাতৃ সুলভ মমতা পেয়েই হয়ত শুভ বারে বারে চলে আসে।

 দুপুরে খাওয়ার পর মিঠু আবার তার মার সামনে এল। আশা শুভকে নিয়ে খেলছে বাবার রুমে।বাবার রুমে এক্সট্রা চৌকি আছে একটা , সেটাতেই মিঠু শুয়েছিল কিছুক্ষণ। কিন্তু ঘুম থেকে উঠার পরেও এবং তার পর খাওয়া হয়ে গেলেও  মার কোন মনোযোগ না পেয়ে এই অল্পবয়সী চোখ দুটোতেও জমে রাগ।
মাঝেমধ্যে আমি নিজেই নুডুলস বানিয়ে নেই নিজের জন্য।সেটা দেখে মিঠুর রাগটা তার কণ্ঠস্বরে চলে এল,‘নুডুলস কিনে দেবার কথা বলেছিলাম, দিছো নি?’
 আশার মুখ আবার ছোট হয়ে যায়। হয়ত মনে পড়ে তার সংসারের দুখের গল্প।এক প্যাকেট নুডুলস কেনাই যেন তার কাছে বিলাসিতা, সংসারের অন্য খরচ সামলাতেই হাত খালি। বাবার কাছে ওদের কোন আবদার চলে না,বাবু দুইটা জিনিসই চেনেন,বাংলা মাল আর লোকাল গালাগাল।
শুভকে কিছুতেই বাবার কাছে রেখে যেতে পারবে না আশা।কিছুদিন আগেই ধমক খেয়েছে বৌদির কাছে থেকে,‘বুড়া মানুষের কাছে রেখে গেছ?’
পেটে ব্যথা কমেছে কি তার?’জানতে চাইলাম।
  ‘এখন কমেছে কিছু।আশা জবাব দিল। মিঠু মৌনব্রত পালন করছে , যদিও অন্যদিন সে আমার এটা সেটা ফুট ফরমাশ পালন করে। কিন্তু আজ সে অসুস্থ বলেই হয়ত তাকে সস্তা শ্রমিক হিসেবে ভাবতে পারছি না।
কিন্তু বিকালের শুরুতে দেখলাম মিঠু বারবার তার মার পেছনে ঘোরাঘুরি করছে।চোখের জল শুকিয়ে আছে গালে বোঝা যায়।কাঁদলে যে চোখ জল দিয়ে মোছতে হয় সেটা কেউ খেয়াল করেনি।
 ‘কি হয়েছে?’জানতে চাইলাম।
 ‘বাসায় চলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেছে।আশা ছেলেটাকে দোষারোপ করলেও তার মনটাও যে তাই চাইছে তা আমার চোখ এড়াতে পারে না।
 ‘তোমার বৌদিকে বলে আগে চলে যাও।আমি বললাম।
ছুটির পেছনে সাপোর্ট পেয়ে আশার মুখ আশ্বস্ত হলেও আমি চিন্তায় পড়ে যাই ।সে যদি কথাটা এমনভাবে হাজির করে যে আমি বলেছি চলে যাওয়ার জন্য, তখন আরেক ক্যাচাল বাড়বে।
 তবু বোধহয় একবার আশা গিয়ে বলেছে ছুটির কথা। জানি , বৌদি বা বাবা , বা অন্যসময় হলে হয়ত আমিও সহজে ওকে ছুটি দিতাম না।
 সেখান থেকে ফিরে আশা তার ছেলেকে বলল,‘কইলাম তো যামু গি পাঁচটার সময়। একটু সময় অপেক্ষা করতে পারস না।
 সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্তে হঠাৎ মনে হল, আশার যে আমাদের বাসা থেকে বেরোতে দেরী হচ্ছে , যদি তার ছেলের কিছু হয়ে যায় ? বাচ্চা ছেলে , বলা যায় না। হয়ত ফুড পয়জনিং হয়ে গেল!
 ‘নাও তোমার দাদার সাথে কথা বল।বৌদি তার মোবাইলটা ধরিয়ে দিল আশাকে।মোবাইল ফোন লাউড স্পীকারে আছে বলে কথা শোনা যাচ্ছে।
 বড়দা কথা বলল, ‘কমছে না মিঠুর?’
না।
তুমি তারে নিয়া এসে ভুল করেছো। অন্তত ওষুধ খাইলে ভাল অইলো নে।
আশা চুপ।বড়দা বলল,‘আইছা, তুমি ছয়টায় যাইও গিয়া।
আশা কোন কথা বলে না, দেখল, মিঠু বসে আছে সোফায়।ঘড়ির দিকে চাইছে।
 কিন্তু একটু পরেই খবর এল বৌদির বাবার বাড়ীর কয়েকজন আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবেন।ফলে ছয়টায় চলে যাওয়ার ব্যাপারটা অঘোষিতভাবেই ক্যানসেল হয়ে গেল।
 পৌনে ছয়টার দিকে আত্মীয়রা সবাই এসে হাজির হলে ঘর একদম গমগম করে উঠল।শুভ আবার সবার কোলে যায়,নতুন মানুষ দেখে ওদের সাথে খেলায় জড়িয়ে পড়ল।কিন্তু বাচ্চাদের সাথে একনাগাড়ে খেলতে গেলে পরিশ্রম হয়,ওরা একটু খেলেই হাঁপিয়ে উঠে ডাক দেয়, আশা!
 একদিকে শুভর নাচানাচি, আরেকদিকে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা। তার উপর মিঠু আবার তার মার পেছনে পড়েছে।কি মিনমিন করে একটু পরপর গিয়ে তার মাকে বলে আর একটূ একটূ করে কাঁদে।বসার ঘরের দখল যেহেতু অতিথিরা নিয়েছে তাই মিঠু ঘোরাঘুরি করে রান্না ঘরে আরে তার পাশের ব্যালকনিতে।
 অবশেষে একবার আশা বলে উঠে,‘যা, যাইতাম না
উত্তরে মিঠু মুখটাকে আরেকটু বেশী তোম্বা করে।
 এদিকে অভ্যাগতদের নিয়ে সবাই মেতে উঠেছে।বৌদির বোনের বাড়ীর কুটুম বলে একটু বেশী আপ্যায়ন হচ্ছে , এটা আমাদের মান সম্মানের ব্যাপার। হঠাৎ আমারই খেয়াল হল মিঠু নেই।জিগ্যেস করলাম ,‘মিঠুকে দেখি দেখছি না।
 ‘অয়!আমারেও কইছে না কিচ্ছু।আশা বলে,‘বোধহয় গেছে গিয়া।
 ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করার অবসর নেই , নাকি ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা লুকাতে চাইছে বুঝতে পারলাম না।
 বাবার জন্য ঔষধ কিনতে হবে বলে আমাকে বাজারে যেতে হবে । এর মধ্যে আশাও ছুটি পেয়ে গেলে ওকে বললাম আমার সাথেই চলার জন্য।আমাদের বাসা গলির অনেক ভেতরের দিকে। তবে একটা রিকশা পেয়ে যাওয়াতে প্রায় পনেরো মিনিটেই পৌঁছে গেলাম আশাদের বাসার সামনে।
আশা চলে গেলে পাশের দোকান থেকে দুইটা সিগারেট কিনে রিকশার উঠার কয়েক সেকেন্ড পড়েই পেছন থেকে ডাক।
 ‘ছোড়দা!ছোড়দা!
আমি রিক্সাটাকে থামতে বলি। ছুটতে ছুটতে এসে আশা বলল,‘মিঠু তো ঘরে নাই।আপনারা বাসা থাকি তো অনেক আগেই বাইর অইছে। এখনো আইলো না।রাইত তো কম হইছে না।
  মিঠুর মুখখানা মনে করতে আমার কোন অসুবিধা হয় না বিধায় একটু সহমর্মী হওয়ার চেষ্টা করি। কই যাইত পারে?মিঠুর বাবা ঘরে নাই?’
না।
 অপেক্ষা করা ছাড়া তেমন কোন সমাধান সূত্র দিতে পারলাম না।
 মনে পড়ে আজ কিছু লেখালেখি করব বলে ভেবেছিলাম। যদিও এক লাইনও লিখতে পারেনি।
 মনে পড়ে আজ সারা দিন মিঠুর চোখে অভিমান দেখেছি।জানি না, সে কী আজ ফিরে আসবে?

SHARE THIS

Author: