লোকে বলে আমি অন্যমনস্ক। প্রাত্যহিক জীবনের চলমান কাজের প্রতি একাগ্র নই। এই ধরুন, ব্রাশে টুথপেস্ট লাগাতে গিয়ে ফেসিয়াল ক্রিম লাগিয়ে ব্রাশ করতে শুরু করি, তখনই বোধোদয় হয়; বাথরুমে যেতে গিয়ে কলপাড়ে চলে যাই, তখনই বোধোদয় হয়; যেটা আনার জন্য অন্দরমহলে ঢুকি, সেটা না নিয়ে কিংবা কিছুই না নিয়ে আবার বেরিয়ে আসি; একই রুমে বসে আছি কাছাকাছি, কেউ ডাকছে বারবার, তবু কর্ণপাত নেই—এমন সব ঘটনা ঘটে রোজ। ছোট বেলায় মা মনে করতেন, আমার কানে কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু না, কিছু দিনের মধ্যেই মা বুঝতে পারেন যে আমার কানে কোনো সমস্যা নেই, শুধু মা না, বাড়ির প্রায় সবাই বুঝতে পারে যে আমি কী যেন ভাবি, কী সব ভাবনায় মশগুল থাকি, কোথায় যেন হারিয়ে যাই! ফলে মার কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই শোনা লাগতো, ‘ডাকলে আমল করস না কা’, ‘আমলহারা হয়ে গেছ’। আজ আমার মনে হয়, সত্যিই আমি মাঝেমধ্যে আমলহারা হয়ে যাই। আমার এক জগৎ আছে, সেখানে নিজের খেয়াল-খুশিমতো ঘুরে বেড়াই। এক নিজেকে প্রতিপক্ষ দাঁড় করে আরেক নিজেই অসি-মসিযুদ্ধে নেমে পড়ি। আকাশের মেঘের লগে, কখনো এই নদী-জল-পাহাড়-মাটি-মানুষ ও ঈশ্বরের লগেও তর্ক করি; হাওয়ায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়ে মারি। মাঝমধ্যে কোন কোন প্রশ্নের উত্তর পাই, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর পাই না। প্রাইমারি স্কুলের হাওয়াও এমনই ছিল। একাই চলতাম, একাই এক বিশাল জগৎ নিয়ে ঘুরতাম।
একার মাঝে সেই হারিয়ে যাওয়ার, ভ্রমণ করার ঘটনা এখনও ঘটে। ভেতরের আমিটি যখনই একটু মুক্তি পায়, তখনই সে আমাকে নিয়ে উড়াল দেয়। নিজেকে খুড়তে ভালো লাগে, যতটা না খেলতে ভালো লাগে। মনে করি, আমার সমস্ত আমিত্ব এই আমার অন্তরেই লুকিয়ে আছে। তাকে খুড়ে বের করা আমারই দায়িত্ব। ফলে আমার অন্দরমহল একা হলেই আমি প্রত্নতাত্ত্বিকের ভূমিকায় নামি। বিশ্বাস, সেখানে অনেক মণি-মরকত, প্রিজমরশ্মির পাতলা পর্দায় ঢেকে আছে। তারা বের হতে চায়। তারা মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় আমারই তাকিয়ে আছে।
মনে হয়, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা আত্মদাগে নিজের স্লেট ভরে শ্বাশত আকাশে ঝুলিয়ে রাখতে পারে, যা অন্য প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়। প্রয়োজন নিজের আত্মাকে ফাটানো। চূর্ণবিচূর্ণ করে তার ভেতরের নির্যাস বের করে আনা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট যেমন বলে প্রতিটি মানুষ আলাদা, তেমনি প্রতিটি মানুষের আত্মার রঙও আলাদা। সেখানে যদি ডুব দেওয়া যায় এক জীবনের নিশ্বাস নিয়ে, তবে নিজের আকাশ তুলে মানুষের দরবারে এনে পতাকার লাহান পতপত করে উড়ানো যায়। মানুষ সেখানে সমবেত হয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ছায়া, মায়া ও প্রেম দেখতে পায়।
আমার অনেক দিনের চেনা রাস্তাও প্রায়শই অচেনা ঠেকে। অতি পরিচিত জায়গাটির নামও হঠাৎ ভুলে যাই। যে এলাকায় বহু বছর ধরে থাকি, সে এলাকায় যেন আমি এইমাত্র এলাম—এমন পরিস্থিতে ফেলে আমার চোখ ও স্মৃতিশক্তি। আনমনা হয়ে পথ চলাই হয়তো এর অন্যতম কারণ কিংবা সত্যি সত্যিই আমার স্মৃতিশক্তির অবস্থা খুবই বাজে, নিম্ন লেভেলে আছে। আমি পথ চলি, পথেরই কোনো একটি বিষয় নিয়ে পথেই হারিয়ে যাই। ফলত পথের পাশের বিষয়বস্তু আর চেনা হয়ে ওঠে না। যে পথে প্রতিনিয়ত কাজে যাই, রোবটের লাহান সে পথেই অচেতন হয়ে চলি—যেন আমি এক অন্ধ, পূর্ব অভিজ্ঞানই আমাকে নিয়ে যায় গন্তব্যে।
একদিন পথ চলতে চলতে মাথায় আসলো ‘গাইবাঁট—ঝরনার বরফ...’ এমন একটি লাইন। মনে হলো, বাহ্, এমন মেটাফর, সুর ও সিনটেক্সে কিছু কবিতা লেখাই যেতে পারে। ওই দিন এ একটা লাইন নিয়ে সারাটা দিন কাটলো। কতভাবে ভেবেছি লাইনটি নিয়ে, কতভাবে নিজেকে মুগ্ধ করেছি। গাইয়ের স্তনের বোঁটা ও জল চুঁইয়ে পড়া বরফের প্রান্তবিন্দু একাকার হয়েছে এ লাইনে, যা আমার ভেতর চিন্তা-দর্শনের ব্যাপন ঘটিয়েছে ব্যাপক। লাইনটির ব্যাখ্যা অনেক বড় করে, অনেক অ্যাঙ্গেল থেকে দিতে পারি। কিন্তু কবির পক্ষে এই ব্যাখ্যা করাটা শোভন মনে করি না।
এই ফর্মে নতুন উদ্দমে একটি পাণ্ডুলিপি দাঁড় করানোর চেষ্টায় কবিতাখেতে নেমে পড়লাম। বেশ কতগুলো কবিতা লেখা হলো। কবিতাগুলোর নাম দিলাম—‘হেজিমনিক পোয়েট্রি’। এমন নামের কারণ হলো কবিতাগুলোর ফর্ম ও সুর। গ্রামসির কালচারাল হেজিমনির ধারণা থেকেই কবিতায় হয়তো এই নামটি এসেছে। মনে হলো লাইনগুলোর অ্যাপ্রোচে আধিপত্যবাদীর আচরণ লক্ষ করা যায়। সুরটাও আনকোরা। ফর্মটাও কেমন অকবিতার-অকবিতার! হয়তো অনেকেই এগুলোকে কবিতা বলতে নারাজ হবে। তা-ই যদি হয়, তবে এ টেক্সটের নাম কী দেওয়া যায়? পৃথিবীতে যা কিছু প্রচলিত, তা একসময় ছিল না, আর্বিভূত হয়ে প্রচলিত হয়েছে সময়ের পরিক্রমায়। আবার এই প্রচলিত ব্যাপারটিও একসময় অপ্রচলিত হয়ে যায় নতুন প্রচলনের ভাঁজে পড়ে অর্থাৎ আমরা দেখতে পাই, অপ্রচলিতকে প্রচলিত করার মধ্য দিয়েই পৃথিবী গতিশীল রয়েছে। আমার একটি লাইন আছে এমন—‘একটি বসন্তকে ঢেকে দিতে পারে কেবল আরেকটি বসন্তই’। ফলে মনে হয়েছে, মানুষ ও অন্য প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হচ্ছে মানুষ প্রতিনিয়ত একটি অর্জনের ওপর দাঁড়িয়ে আরেকটি অর্জন নিয়ে আসে, অপ্রচলিতকে প্রচলিত করে; কিন্তু অন্য প্রাণীরা জিনপ্রাপ্ত গুণে ভর করে একই বৃত্তে ঘুরপাঁক খাচ্ছে, যেখানে নিজের সত্তা টিকিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো অর্জন নেই। মনে করি, পৃথিবীতে মানুষ যা কিছু আবিষ্কার করে নতুন বলে প্রচার করছে, তার মূলমন্ত্র ও নির্যাস এখানেই নিহিত। মানুষ শুধু তার একটি রূপ, শৈলী ও নির্যাস দিয়ে ভিজিবল করছে মাত্র। ফলে এই ভিজিবল অবজেক্ট বা চিন্তাগত বিষয়কে নতুন না বলে আমি বলি অপ্রচলিত। বলি এ কারণে যে এগুলো এখানেই ছিলো, মানুষ জোঁড়াতালি দিয়ে প্রচলিত করছে মাত্র।
বই আকারে প্রকাশের আগে ‘হেজিমনিক পোয়েট্রি’ নামটি পরিবর্তন করে অবশেষে রাখলাম—‘...দুধের গাই—এজমালি বাগান...’ এবং যে ফর্মে কবিতাগুলো লেখা হলো, তার নাম রাখলাম—‘হেজিমনিক ফর্ম’। অন্যত্র এই বইয়ের করণকৌশল ও ফর্ম নিয়ে লিখবো। বইটিতে একটি পঙক্তি আছে, ‘গাভির দুধ—মহান মানুষের নির্ঝর—সাপও খেয়ে যায় রাতেবিরাতে...’। আমার জগতে সাপও গুরুত্বপূর্ণ, উপযোজক। দুধ পেলে সাপেরও বিষ ঝরে না। আরেকটি লাইন এমন, ‘সমস্ত ফুল—জারজ সন্তান—পিতার সন্ধানে নামেনি কোনো দিন...’। সুন্দর নিজেই স্বয়ম্ভু, পিতা তারই কাছে নত, তারই মুখাপেক্ষী। পুরো বইজুড়ে এভাবেই আমি বস্তুজগৎ ও হাওয়ালোককে দেখেছি। পাঠককে বলেতে চেয়েছি, মেয়েটির চিবুকে, ঠোঁটে, নাকে কিংবা বুকের ঠিক ওপরে যে জ্বলজ্বলে তিল দেখতে পাচ্ছো, মূলত এটাই চাঁদ, তুমি বিশ্বাস কর এটাই চাঁদ, নক্ষত্র। এভাবেই হেজিমনি তৈরি হয়েছে এই কবিতাখেতের আলপথ ধরে।
অন্য পাড়ে, অন্য গ্রহে নিজের আত্মার সঙ্গে সংলাপে মশগুল থেকে কবিতায় এক ভিন রঙ দিতে চেয়েছি। সন্দেহ প্রকাশ করেছি, ‘বন্ধ্যা বাগানের পাশে কারা যেন রোজ রোজ ছড়ায় বাজারের ঘ্রাণ...’। ফণাতন্ত্রের আদলে যে ফ্যাসিজমের শির উচিয়েছে, তারই নেমপ্লেটে বসেয়েছি ‘পিল—মীন না জানা এক চিল...’ নামের অশ্রুত পঙক্তি। বিশ্বের যেখানে মানুষের চোখে ফোটে ‘বিবাহদেহ—গম-রঙের ভূমি’, আমি সেখানেই ডাকি, এসো ‘দুধের গাই—এজমালি বাগান...’, আমাকে তোমার সন্তান কর। আমি তোমার প্রতিরূপ দিয়ে পৃথিবী ভরে দেবো, তবেই মুছে যাবে রক্তবাদ ও সমস্ত মানচিত্র। আমরা দলে দলে হয়ে যাব দুধের গাই, হয়ে যাব এজমালি বাগান।
নকিব মুকশি
ফার্মগেট, ঢাকা
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, এক্সিলেন্ট আইডিয়াল স্কুল। বর্তমানে একটি দৈনিক পত্রিকায় কর্মরত।
সম্পাদক, চাতর (সাহিত্য পত্রিকা)
পড়াশোনা:
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
প্রকাশিত বই:
প্রতিশিসে অর্ধজিরাফ, জেব্রাক্রসিং প্রকাশন, বইমেলা-২০১৯।
...দুধের গাই—এজমালি বাগান..., চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, বইমেলা-২০২০