ভোরে
চোখ মেললেই পাহাড়ের মায়া।হাতছানি দিয়ে ডাকে।কোথায় যেন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। পৌষের
সোনা।কী যে মোহন সোনালি তার আভা।সব শীতলতা যেন সরে সরে রয় তারই সোনা সোনা আলোর তলে।নিচে
পাহাড়ের পায়ের কাছে রাতভর ঝরে পড়া শিউলির সুঘ্রাণ।পাগল করে রাখে সারাটা রাত।হঠাৎ চোখে
ঘুম নেমে আসলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একেবারে সমতলে নেমে আসে একটা বাঘডাস।মধ্যরাতে তার গুরু
গম্ভীর ডাকে ঘুম ভেঙে যায়।দূর বনে একটানা ডেকে যায় একটা তক্ষক।কখনো মাঝরাতে ধানের ক্ষেতে
একসাথে ডেকে ওঠে ঝাঁকে ঝাঁকে খেঁকশিয়াল।হুক্কা হুহ হুয়া হুয়া।মাকে জড়িয়ে ধরি ভয় পেয়ে।আর
ঐ যে খেজুরের গাছে ঝুলানো মাটির কলস।সারাদিন দেখি শুভ্র দাড়িওয়ালা কলোনির সবার নানা
কোমরে দড়ি বেধে কি অদ্ভুত ভঙ্গীতে মাঝ গাছে দাঁড়িয়ে একটানা কেটে যাচ্ছে খেজুর গাছে
রসের খনি! আমারও অমনি নিজেকে দড়িতে বেঁধে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে।দেখতে ইচ্ছে করে সারাটা
রাত বসে ঐ একটু একটু বিন্দু বিন্দু রসে কেমন করে জমতে থাকে রস আর ভরে ওঠে সিন্ধু কলস।কখন
ভরে উঠবে কলস রসে!সারাটা রাত এইসব ভেবে ভেবে ঘুম আমার বন্দী রুপোর কৌটোয়।ভোর হতেই ছুটি
সবুজের মাঠে।পায়ে শিশিরের কণা।আহা কী আলতো তার পরশ।এমনও হতে পারে স্পর্শের সুখ। আমি
এক দৌড়ে ছুটে যাই তার কাছে।সবুজের বুকে পা ফেলে ফেলে উঠে পড়ি খাড়ি পথ বেয়ে লালমাই এর
টিলায়।টিলার সবচেয়ে উঁচুতে, ছোট্ট এক মাটির ঘরে বাস করেন একজন একাকী মানুষ।প্রতিদিন
ঝাড়পোছ করেন তার ছোট্ট ঘরখানি।আমি একছুটে দেখে আসি তাকে।তারপর ছুট দেই পাহাড়ের অলিগলিতে।ছোট
ছোট কত যে বন পেয়ারার গাছ।তারই মাঝে হাজারো কচি সবুজ পেয়ারার ঝাড়।পেড়ে নেই দু’একটা।কচি সবুজের বুকের ভেতর হালকা গোলাপি শ্বাস।মোহন
তার রূপ।পৃথিবীর পথে পথে। জলে বাতাসে।ঘাসে।আর নেমে আসবার পথে মাড়িয়ে দেই কতকটা লজ্জাবতীর
পাতা।ঈশ কী যে লাজ রাঙা সেই গোলাপি মোহন।
সে
এক বিস্তৃত দিনের সোনালি কথন।এখনও জীবন কি জীবন মাইল কি মাইল ছড়িয়ে আছে যার বিস্তার।বাইরে
তাকালেই দিগন্ত বিস্তৃতি।কী যে সবুজ।অপরূপ তার মোহ আর মায়া। আমি মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখি
শীতের বিকেল।ধীরে বাদুর পাখা মেলে।তার পাখায় আঁধার বয়ে নিয়ে আসে।নামিয়ে দিয়ে যায় আঁধার
সেই বন পাহাড়ে।তাতেই সন্ধ্যা নামে লালমাইয়ের পায়ের কাছে।তারপর উড়ে যায় পেয়ারা বনের
দিকে।সে জানেনা আমিও জানিনা।একটি রাতের পরেই দেখা হবে তার সাথে আমার অন্য ব্যথায়।সত্যিই,
ভোরে ঘুম ভেঙেই দেখতে পাই সন্ধ্যাওয়ালি ঝুলে আছে তার সবটুকু মৃত দেহ মেলে দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটির
তারে ।
তেমনি
এক সন্ধ্যেয় কে যেন এলো এক আগন্তুক।ঘরে কড়া নাড়ে।দরজা খুলে দেই আমরাই।বাড়ির ছোট দু’তিনজন।কনিষ্ঠ সদস্য।
-মিমি
এসেছে?
প্রশ্ন
শুনে অবাক তাকাই।
-কে
মিমি?
প্রশ্ন
করতে করতে মা দৌড়ে আসেন।
-কে
মিমি?
-মিমি
কে?
কেউ
চিনিনা।অতবড় কলোনিতে কতজনকে আর চিনে রাখা যায়।বিকেলে মাঠে খেলতে নামি।যারা কাছাকাছি
থাকি একসাথে খেলি তারাই শুধু একে অপরকে চিনি।যারা দূরে থাকে তাদের সাথে কোনদিনও দেখা
হয়না।বা হলেও চেনাজানা হয়না খুব বেশি।মিমি নামটা মা চিনতে পারেননা। আমারও অচেনা লাগে।একজন
নারী এসেছেন।মিমিরই খোঁজে।আপাদমস্তক ঢাকা পর্দানশীন এক নারী।শুধু চোখ দু’টো দেখা যায়।তিনিই প্রশ্ন করছেন।মিমির মা।
-সকালে
বেরিয়েছিল স্কুলে।আর ফেরেনি।
মা
তাজ্জব বনে যান।
-কোন
ক্লাস পড়ে?
-ক্লাস
ওয়ানে।
-কি
কথা কি কথা।স্কুল ছুটি হয় সেই সকাল ১০ টায়।আর এখন বাজে সন্ধ্যে ছ’টা।এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?অত ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে!
-না
না। আমি বসে থাকিনি।বিশ্বাস করুন।
মিমির
মা’র কথায় কেমন যেন অপরাধীর সুর।
-সারাদিন
ধরেই খুঁজছি।কলোনির সবগুলো বিল্ডিং খুঁজতে খুঁজতে এত বেলা।কোথাও নেই। কারো ঘরেও নেই।কোনই
খোঁজ পাচ্ছিনা মেয়ের।
দারুণ
স্থিত ধীর একজন নারী।ভীষণ শান্ত শব্দে এক নিঃশ্বাসে বলে যান কথাগুলো।
-মিমির
বাবা কোথায়?
-তিনি
জামাতে গেছেন।
-তাকে
খবর দিয়েছেন?
-লোক
পাঠিয়েছি।কাল ভোর নাগাদ খবর পেয়ে যাবেন।
বুঝে
গেছেন এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করা আর ঠিক হবে না।তিনি আর দেরী করেননা।শুধু
তার যাবার তড়িঘড়িতে হঠাৎ ছলকে ওঠে বুকের ভেতরের একটা চাপা শঙ্কা।আর কিছু নয়।
সেই
সন্ধ্যায় আমি দৌড়ে এসে বেলকনিতে ঝুঁকে পড়ি।দেখি নিচে খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে চলে যাচ্ছেন
মিমির মা।ত্রস্ত।তার হাঁটার গতি জানিয়ে যায় খুঁজতে থাকা সন্তানের জন্য কি জানি কি শঙ্কা
নাকি ভয় নাকি নিশ্চিত জেনে যাওয়া কোন বীভৎস সত্যের আতঙ্ক।উপরে তাকাতেই দেখি অনেকগুলো
চিল অধরা আকাশে কেমন মাতালের মতো ঘুরপাক খায়।আমার বুকের গভীরেও এক ভীষণ শূন্যতা টের
পাই।সেখানে চিলগুলো আরো এক অজানা অনামা হারানোর সুর তীক্ষ্ণ ছুড়ির ফলার মতো গেঁথে দিয়ে
ডেকে ওঠে চি—চি---চি—
সে
রাতে আর পড়ায় মন বসেনা।একটা গল্পের বই নিয়ে বসি।তাতেও মন বসেনা।মনের ভেতর না দেখা রাজকন্যার
ছবি আঁকি।কেমন সে?কত লম্বা?কেমন গায়ের রং?কোথায় হারালো?এই বন পাহাড়ের রাত একা একা কি
করে কাটাবে রাজকন্যা।যখন মধ্যরাতে বাঘডাস ডাকবে, তক্ষক চেঁচাবে, শেয়াল ডাকবে তখন সে
কার বুকে মুখ লুকবে।মায়ের মুখ থমথমে।কোন কাজে বুঝি তারও মন লাগেনা।শাশ্বত মায়ের বুকেও
বি এক অদ্ভুত সন্দেহ দানা বাধতে থাকে।বাকি রাতের কথা কিছু জানিনা।এমন অদ্ভুত ভয় ধরানো
রাত এমন শঙ্কা জড়ানো রাত আর কখনো লালমাইয়ের বুকে নেমেছিল মনে করতে পারিনা।বুকে একটা
কষ্ট গেঁথে থাকা রাত।সে রাতে আমি শিউলির ঘ্রাণ পাইনা।সে রাতে আমি বাঘডাসের ডাক শুনিনা।সে
রাতে আমি খেজুরের রসে মাটির কলস ভরে উঠবার আশায় থাকিনা।
ভোর
হয়।সোনালী রোদ ওঠে বনের কিনারে।দূর পাহাড়ে, বনপথে নতুন পেয়ারা ধরে।টিলার উপর ছোট্ট
ঘরটাও ঝারপোছ হয়।জানালা দিয়ে দূরে দেখা যায় তালগাছ তখনো একপায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি দেয় আকাশে।দুপুরে পুকুরে যেতে ইচ্ছে করেনা।এ তো যে সাধের এপার ওপার করা পুকুর।
উথালপাথাল দুপুর।মন্থর পড়ে থাকে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল।ঘাসের মাঠে খেলতে নামি।হঠাৎ মাঠ
থেকে সবাই কোথায় কি উদ্দেশ্যে যেন দৌড়োতে থাকে।ছোট বড় সবাই।কিছু না বুঝে আমিও দৌড় দেই
সেদিকে।সেখানে গিয়ে থেমে যায় সব অন্বেষণ সব ভয় সব সন্দেহ।দেখি দিনের শেষে যেখানে সূর্য
শুয়েছে পৃথিবীর সিথান জুড়ে।সেখানে শুয়ে আছে মিমি রাজকন্যা।কী সুন্দর তার শরীর।দুধে
আলতা গায়ের রং।পূরবীর রাগে যেন আরো বেশি আরক্ত।মৃত্যু!
সবগুলো
পুকুরে জাল ফেলে পাওয়া যায়নি সে রাজকন্যাকে।অন্য আর এক পৃথিবীর ঘোলা জলে ডুবে গিয়েছিল
যে সে।স্কুল ছুটির পর চলে গিয়েছিল একলা গহন পথে।কাঁঠালের মুচি পাড়তে লাফ দিয়েছিল।সাথে
সাথে পড়ে গিয়েছিল এক ঘোর লাগা জলের অতলে।যেখানে যায় না কেউ, যেখানে ভাবেনা কেউ আর যেখানে
খোঁজেও না কেউ।এমনকি মাও না।আর আমি আজো মেনে নিতে পারিনা এ মৃত্যু!আমি যে দেখেছিলাম
তার আধো বোজা চোখ। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নাতুর।
তখনো
আকাশে উড়ছে কিছু কাক আর চিল।ঐ তো বাদুর পাখা মেলেছে আজও।পাখায় তার আছে আরো এক মনমোহিনী
সন্ধ্যা। যার ঐ পাড়ে, আমি নিশ্চিত জানি, দেখা হবে তার সাথে আমার অন্য আরো এক মৃত্যুর
সংবাদে…