মেহেরুন্নেসা,
এবার
তুষার নেই... আদিগন্ত শুভ্রতায় আমাদের ঢেকে-যাওয়া নেই। সঙ্গীতের যাপন-মুহূর্তটুকু
হয়ে উঠে যেন অলৌকিক। যেন কিছুই আর মর্তে ঘটছে না- এমনই গহণতা গোপন থাকে
মেঘমল্লারে!
ফেব্রুয়ারিতে
হ্যাম্পশায়ারের আকাশ ঘনকৃষ্ণ... আর বৃষ্টি সারাক্ষণ! এরকম বৃষ্টিতে মেঘমল্লার!
জানালার শার্সিতে বৃষ্টি যেন গেঁথে যেতে চাইছে! ঠিক এরকম একটি দিনে,
আচমকা, তোমার সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছিল। দেখো,
এই দেশে মুহূর্তের খেলা... খেলা চলছে মুহুর্মুহু বদলে যাচ্ছে মুখ।
কোথাও কচুপাতার ঝোপ নেই এখানে, আছে শুধু ম্যাগনোলিয়া
স্নান... প্রবল বাতাস ক্লান্ত ওকের ডাল ভালবেসে... পাতাদের কোনও অভিমান নেই আজ।
তারপর একদিন তুমি শমশেরনগরে গেলে... আমার নোটবুকে লিখে রেখেছি তা। শমশেরনগর
স্টেশন! কী অদ্ভুত একটা নাম। আমার স্মৃতির শিকড় ধরে ঠাণ্ডার পরাগ-লাগা বাতাস
নাড়িয়ে দিয়ে যায়- শমশেরনগর, শমশেরনগর। কী তীব্র ডাক! আমিও
ডাকি- হে জন্ম! আরও একবার মুগ্ধ করো। একটা দীর্ঘ জীবনের মত ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে
দাঁড়াক... হ্যুইশ্যল বাজুক। বর্ষিত বৃষ্টি আর শতাব্দী প্রাচীন ধূলিবসনে আমাদের মুখ
ঢেকে যাক, যেন লুকিয়ে ফেলতে পারি কান্না। যে-কান্না মৃতদের
জন্য, যাদের শক্ত হাত ধরে, ছায়া রেখায়,
বর্ণমালা শেখবার আনন্দের মত লোকাল ট্রেনে উঠে ভানু গাছ পার হয়ে
শ্রীমঙ্গলে যাওয়া হবে না আর। দেখো, যখনই সেই দিনটির কথা ভাবি,
সেই আমাদের প্রথম কথার দিন, কতগুলো ফুল ঝরতে
চেয়েও আবার জন্মের আনন্দে হেসেছিল! আমাদের মন মিশে গিয়েছিল হিস্পানি সেই কবির
মরমে। গারসিয়া লোরকা তার নিউইয়র্ক যাপনের কথা বলছিলেন এক বক্তৃতায়, এভাবে- না মেঘমালা, না অহমিকা, কোনও কিছুকে পাত্তা না দিয়ে, তোয়াক্কা না করে
দালানগুলির তীক্ষ্ণ প্রান্তসীমা উঠে গেছে আকাশের দিকে। গথিক স্থাপত্যকলার এইসব কোণ
আর প্রান্তসীমাগুলো যেন মৃত আর কবরস্থানের হৃদয় থেকে তরঙ্গের উচ্ছ্বাসের মত
ধাবমান... না। খুব বেশি আশাবাদী হবার কোনই কারণ নেই পৃথিবীতে, আমাদের। পৃথিবী আদিম, ক্রোর। কবি বলছেন তাঁর
আত্মপোলব্ধি, তাঁর স্মৃতিকথায়, বক্তৃতায়-
যে-বিষয়টা উপলব্ধি করবার জন্য আর মাত্র কয়েকটি দিনের প্রয়োজন, সেই বিষয়টি হল- এই অতিকায় পৃথিবীর কোনও শিকড় নেই, এই
পৃথিবী শিকড়হীন, উম্মুল আর মাত্র কয়েকটি দিন লাগবে এই বিষয়টি
বুঝতে যে- দ্রষ্টা এডগার পো কেন অপার রহস্যময়তাকে আলিঙ্গন করেছিলেন আর শরীরের
শিরায়- উপশিরায়
যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়ার মত পৃথিবীর উন্মত্ততাকে বন্ধুর মমতাময়
দৃষ্টিতে দেখেছিলেন।
এইটুকু
বলার পর, একটু বিরতি নিয়ে লোরকা আবারও বলতে লাগলেন- একজন
পথভ্রষ্ট নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবে আমি আমার শৈশবকালকে এইভাবে স্মৃতিতে জাগিয়ে তুলি...
তীব্র হুইসিলে শমশেরনগরে ট্রেন থামে... আমাদের হারিয়ে যাওয়া কৈশোর জাগতে থাকে।
মাঝে
মাঝে শমশেরনগর উড়ে আসে ফ্রাঙ্কফুর্টের উপর দিয়ে! বিপুল স্মৃতিরা ডাকে- আয়... আমি
দেখি, আমাদের উঠোন জুড়ে কচ্ছপের সংসার! আর বিপুল ফোঁটার
বৃষ্টি! ছোট্ট আমি উঠোনে নেমে পড়ি। বাচ্চাগুলি হাতের তালুতে ধরে রাখি। বাতাসে
মেঘমল্লার... দূরে, নিলুদের বারান্দায় হলদে বাতি জ্বলছে।
দেখি, নিলু আর তার মা বৃষ্টি দেখছেন, কারণ
আর কয়েকটি দিন পর আমার শৈশব-সঙ্গী নিলু কারও সঙ্গে হারিয়ে যাবে... আমি আমার
ভাইটিকে ডাকি। আমার অনেক আগে এই পৃথিবী সে ছাড়বে বলে তার চোখে গভীর ঘুম... আমার
বোনটি কচ্ছপ ধরার এই দৃশ্যটি কখনও দেখবে না। তার জন্ম হতে আরও বেশ কয়েকটি বছর
বাকি! বহু বছর আগে এই কচ্ছপগুলি এসেছিল গিয়াস নগরেও, শ্রীমঙ্গলের
কাছে।
দৃশ্যটি
এখনও আমার কাছে আছে, ঘুম ভাঙলেই তোমার সামনে
মুঠো খুলে ছেড়ে দেব...