মিছিল খন্দকার এর কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘ সমান্য হাসো’ থেকে ১২টি কবিতা

মিছিল খন্দকার এর কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘ সমান্য হাসো’ থেকে ১২টি কবিতা

দুঃখ থেকে সটকে পড়ার কৌশল

যে কোনো মেঘলা সন্ধ্যায় আমি পৃথিবীর সব থেকে দুঃখী কবিতাটি লিখব নিশ্চিত! যা পাঠে বৃক্ষরা বনভূমি ছেড়ে ছমাইল হেঁটে এসে উঁকি দেবেকবির তন্দ্রাভুখ জানালায়। দুঃখকে জলের খনি ভেবে শুকনো নদীরাও ছুটবেহৃত যৌবন পুনরুদ্ধারের আশায়। সমুদ্র পা টিপে এসে ঠায় বসে থাকবে অদূরেদরজার কাছে। চাটগাঁয়ের ছোট ছোট টিলারাঙামাটি ও বান্দরবানের পাহাড় এ খবরে দ্রুত রওনা হবে বাসে। চাঁদ এসে বসবে উড়ে বারান্দার গ্রিলে। প্রিয় সব বন্ধুরা দুঃখকে বদপাখি ভেবেতাড়িয়ে দিতে চাইবে ঢিলে। এবং দুঃখ দেখতে দলে দলে উৎসুক নারীর দঙ্গল এসেউঁকি মারবে বাড়ির পাঁচিলে।
আমি তখন দুঃখ রেখে ফাঁক বুঝে সটকে পড়বএত সবের মিছিলে।

মাতব্বর

নদী সংলগ্ন বাড়ি
              ঘর,
     চরেই আবাদ
        বর্গা চাষি।

গেলোবার ফলন ভালো ছিল
                তাই পেটে ভাত,
       মুখে বিস্তীর্ণ ছিল হাসি।

 এ বছর ভাঙনের কবলে
            ফসলি জমি,
             বাড়ি-ঘর।

  এ গাঁয়ে নদীই মাতব্বর!

নাম
(নিশাকে)

লেবু ফুল ব্যঞ্জনাহীন কিছু নয়। অভিধান থেকে মুছে দিলে সে হবে মর্মার্থহীন অনস্তিত্বÑ বিষয়টা এমন আক্ষরিকও নয়।

ঘ্রাণেন্দ্রিয় সব থেকে ভালো জানে লেবু ফুলের আলোড়ন। নাম নিতেই কেঁপে ওঠে পশ্চিমে ঝুঁকে পড়া দিনের চিবুক। বাগানে বাতাসও মুখরা হয়ে ওঠেবন্ধ জানালা নিজ থেকেই খুলে যেতে চায়! বোজা চোখেও ঢুকে পড়েঘাসের মলাটে সাদা সাদা শীতল স্ফুলিঙের হাসি। আর লেবু ফুলের নাম যদি বুলে ফুল হতোতবে বুলেই হতো এমনতরো দৃশ্যমুগ্ধ ঘ্রাণের অবতারণা।

সেরকম যে নামেই ডাকা হোক তাকেসেতো সে-ই! তার মধ্যে লুকানো রয়েছে রাশি রাশি নামের শরৎকাল। হয়তো তার সামান্য নদীঅনেকটা বনভূমিঅংশত পাহাড়বৃষ্টির ছাঁটও কি নয়!

প্রকৃত রাত্রির বাগানে সে কিছুটা লেবু কিংবা বুলে ফুলের উপস্থিতি! মাঝে মাঝে অসাবধান অগ্নিশিখা মনে হয়!

হৃৎপিণ্ড

যতটা নীল ভাবততটা নীল নয়
কিছুটা বিভ্রমচোখেতো লেগে রয়।

দূরেরও চাওয়া থাকেদেখবে কাছ থেকে
অতটা বাঁকা নয়যতটা গেছি বেঁকে।

সে ভালো বেঁকে যাওয়াবৃত্ত হতে গেলে
ঘুরব চারপাশেকেন্দ্রে তাকে পেলে।

সে ঠিক আমি নয়আমিও নয় সে
এ টান চোরাটানবুঝেছি বয়সে।

যা দেখি আসলে তো সবটা দেখা নয়
আমি যা ঠিক দেখিতার তা ভুল হয়।

ভুলকে ভুল বলাকতটা ভুল-ঠিক?
আমার মাঝেই সে চলছে টিকটিক।


মিথ্যাবাদী

এই যে ঘষটাতে ঘষটাতে চলা
    রাত দুপুরে শরীর য ফলা,
   বুকের মধ্যে হৃদয় মিথ্যাবাদী
     বিষরে বলেদারুণ ঔষধি!


যেন বাংলাদেশ

হয়তো বৃষ্টি নামবে
ধুয়ে যাবে তোর মুখের ঘামদগ্ধ দাগ।
হয়তো প্রেমিক এক প্রাচীন বেকার
তার হাত ধরে রিকশার চড়ে
               ভিজবি খুব,
খুব ভিজবি!
সাথে তোর ভিজবে
আজন্মই ভিজতে থাকা
এ দেশের কোনো এক রিকশাচালক।

হয়তো বিকেলেই বৃষ্টি নামবে
         প্রত্ন প্রতীক্ষার বৃষ্টি।
হয়তো ফুটপাতের ঘর-সংসার গুটিয়ে
কোনো এক দম্পতি গিয়ে
         অসহায় দাঁড়াবে,
    মেডিকেলের বারান্দায়।

যেন বাংলাদেশ!

চিঠি

খামে ভরে বননিভৃত গ্রাম
শহরের মেয়ে তোকে পাঠালাম।


কুয়াশা

গ্রামের গলুইয়ে কারা গোল হয়ে বসে
বারুদে উস্কে দিয়েছে ঝরা পাতার হৃদয়,
আর তাতে হালকা আঁচে সেঁকে নিচ্ছে পৃথক শরীর।

তাদের মুখ থেকে বেরুচ্ছে ধোঁয়া,
যেন ভেতরের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে নির্বিকার
                   গল্প করছে তারা।

এখানে হিম রাত,
পাতিলে ঠান্ডা ভাত
সবজি-সালুন পড়ে আছে।
বাতাসে বুড়ো বাড়ির জানালার হাড়ে ঠকঠক,
আর শৈত্যপ্রবাহে কার বিছানায় কে যে মমি হয়ে আছে?
গাছেরও ফেটেছে হাত-পা।

ও খয়েরি পাতা,
বাসন মাজা হাত,
এখন কি শীতকাল?
কার চাদর টেনে শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে বাড়িটা!


মন খারাপ

সুহৃদ তুলসী পাতালেবু ফুল,
বারান্দায় ঢুকে পড়া ঘ্রাণ,
নির্ভুল বাতাসে ঝরা আমলকিÑ
কেউই মান বা না মান।
নিশ্চয়ই কোথাও মানুষ
           খুব কষ্টে আছে,
না হলে আজ আমার এত
  মন খারাপ হবে কেন!


বায়বীয় ছায়া

আমাদের বাগানের স্কুলে
যে সব সুদর্শন গাছ
দুই যুগ ধরে
শিক্ষিক হিসেবে নিয়োজিত,
পুকুরের আয়নায় তাদের ছায়া
   বাতাসে যখন দোল খায়;
 অবাক চোখে তাকায় মাছেরা
 ছায়ার রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে।

প্রকৃত অর্থেগাছকে তখন তারা
      বায়বীয় ছায়া মনে করে!


মায়ের কবর

গাঢ় শীত রাতে আমি কবরস্থানের দিকে বয়ে যেতে থাকি।
ভাবিযে কোনো ভাঙা কবরে ঢুকে দেব নিরীহ ঘুম
কিংবা আদতে ঘুমাতে পারি কিনাদেখি।

পথে ভাবনার দিক বদলায়।
আর পরিজন হাওয়াÑ কেমন ঠান্ডা হাত তার,
যেন ইয়ার্কি করে তার ভেজা হিম করতল
                    শরীরে ঢুকিয়ে দেয়।
আর গাছে গাছে শিরশির করে ওঠে পাতা।
এসব গাছ সব মৃতদের সুহৃদ
কবরের আশপাশে সন্ত ভূমিকায় দাঁড়ানো।

যে কোনো কবরের পাশে গাছের লাইনে দাঁড়িয়ে আমি,
পাঠ করি নিজের কিংবা পছন্দসই যে কারও কবিতা।
কার যে কলধ্বনি আমার ভেতরে তখন হু হু করে বাজে,
                 সামান্য পরিচিত লাগে কিংবা লাগে না,
                              নাকি বাতাসের কারসাজি
                             দূরাগত যে কোনো সংকেত?

যে কোনো কবরকে আমার আসলে
           মায়ের কবর মনে হয়!


খরাদগ্ধ মুখ

১.
কৃষাণির কুলা হাতে
ধান থেকে উড়িয়ে দিতে দেখেছি চিটা।
চিটার মর্মমূলে কোন সে ব্যথা
                 কার দোষে
মাটিতে লুটালে মন টের পাবে কি?
         তুমিও তো মাটির সন্তান।

কুটিলতা বড় ভয় পাই,
যুবা বয়সী আধাপাকা বুদ্ধিতে।
সরলের সংজ্ঞা খুঁজি
ও সরলকীভাবে বুঝব তুমি কে?
তবে কি ফিরে যেতে হবে শৈশবে,
            সুপুরির খোলে চড়ে?
কে তবে টেনে টেনে নেবে?
খোল তো গাছের দানযন্ত্রে চলে না।

আর শৈশব-
একটা স্মৃতি ছাড়া সবই বিস্মৃত।
সেটা বড় ভয়ানক!
তখনও মাছ হতে শিখিনি
কেননা জানি না সাঁতার।
নৌকায় চড়েছি দুজন-
        বন্ধু আর আমি,
যখন মাঝ নদীতে
দেখি নৌকা ফুটা
যত সেঁচি তারও চেয়ে বেশি ওঠে পানি!

সে যাত্রায় কীভাবে বেঁচেছি
      তা আজ বাদ থাক।
শুধু বলি,
ইদানীং সে রকম ভয়ানক আতঙ্ক নিয়ে চলি!
কেনইবা নয়,
যতটা জেনেছি তাতে
পাঁজরের ইঁদুরে কাটে
প্রত্যেকের নিজস্ব হৃদয়!

(পাদটীকা :
আমার সে বন্ধু এখন
          আস্ত মৃগেল,
চাতুর্যও শিখেছে ঢেড়!
প্রায়শই বলে শুনি,
মাছ হলে হতে হয়
       গভীর জলের।)

২.
অগ্নি উদ্গিরণ কালে
কোনো অগ্নিগিরির জ্বালামুখে,
বৃত্তাকার পরিভ্রমণ করে
হিংস্র-কুটিল লাভায় হয়েছি উজ্জ্বল।
আমার দারুণ অভিলাষ
তোমাকে দেখাই এই মুখ,
কতটা প্রাত সূর্যের মতো লাল!

পরিশিষ্ট সময়ে সে আগুন
           চর্ম-মাংস খুলে
আমাকে করেছে নরকংকাল।
এবার হাড়ের ঝংকারে
দীর্ঘপথ পদব্রজের শেষে
যদি তোমার,
তোমাদের নিকটে ফিরে আসি,
তুমি বা তোমরাওতো চিনবে না।
আঁতকে উঠবেভূত! ভূত!!

তবে কি আমার স্বতন্ত্র পরিচয়
ডাকাতি করবে অগ্নিগিরি?
তুমিইতো প্রকৃত সুহৃদরে নারী!
কতবার তুলেছো আলতো
     আদিবাসী ঘুম থেকে,
টেনে নিয়েছ আরণ্যিক প্রেমে।
অনাহূত মেঘে হারিয়ে গেলে চাঁদের চেরাগ,
                ছুঁয়ে ছুঁয়ে চিনেছ সঠিক!

যে সময় আমাকে ঠেলে দিয়েছে আগুনে
                     করেছে গোত্রহীন,
       তুমিতো নও তার দলেপ্রতিনিধি।

তাই বলি-
যে কোনও প্রবাহে নিকটে ফিরে এলে
                     পাশে দাঁড়িও।
সময়কে বিবাদি করে
নিয়ো মামলার প্রস্তুতি।
আর একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে জেনে নিয়ো,
   রক্ত-মাংস জুড়ে করে দিতে পারবে কিনা সার্জারি!

মেঘ সামান্য হাসো
প্রথম প্রকাশ
ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
প্রকাশক: ঐতিহ্য
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মিছিল খন্দকার
জন্ম: ২০ ডিসেম্বর, ১৯৮৫

খেজুরা, ভরপাশা, বাকেরগঞ্জ
বরিশাল।
ই-মেইল: 
kmisil85@gmail.com

SHARE THIS

Author: