মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
তখন আমার বয়স ১২-১৩ বৎসর। ১৯৭১ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে সৈদালী গ্রামসহ বড়তাকিয়া এলাকায় সংগঠিত ঘটনাবলি এখনো স্মৃতিতে অম্লান। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে বলেন। শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও দেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য আহবান করেন।বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশে আরম্ভ হল কৃষক- শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, আনসার পুলিশ, ইপিআর এর প্রতিরোধ। মীরসরাইয়েও বিভিন্ন স্থানে সড়ক মহাসড়ক ছাত্র-জনতা কৃষক-শ্রমিক অবরোধ সৃষ্টি করে লাঠি ছুরি দা সড়কি ইত্যাদি দেশিয় অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বড়তাকিয়া দক্ষিণ বাজারে আবুতোরাব রোড়ের সংযোগ স্থলে গাছের বড় বড় ডাল কেটে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়। লাঠি সোটা দা ছুরি ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রসস্ত্রসহ পাকিস্তানী হায়েনা হানাদারদের প্রতিরোধ এগিয়ে আসেন সৈদালী গ্রামসহ খইয়াছড়া দুয়ারু, মায়ানী ও মগাদিয়ার প্রতিবাদী আপামর জনতা।সম্ভবত দিনটি ছিল ২ এপ্রিল ১৯৭১, শুক্রবার। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে প্রতিরোধ স্পৃহায় প্রতীক্ষা করছিল প্রতিবাদী জনতা। বড়তাকিয়া জামেমসজিদের জুম্মার নামাজ শেষে মোসল্লীগণ বাড়ি ফিরছিল। এসময় কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রাম গামী পাকি হানাদারদের গাড়ির বহর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। আধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লাঠির সোটার আক্রমণ ছিল দুঃসাহসী জীবনবাজী অসম যুদ্ধ। সেদিন 'জয়বাংলা' রণ মন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা অকাতরে জীবন বিসর্জন দিতে এতটুকু কুণ্ঠা বোধ করে নাই। হানাদারের এলোপাথাড়ি গুলিতে হতাহত হল কয়েকজন।দিক্বিদিক ছোটাছুটি করে প্রতিরোধকারীরা সরে গেল নিরাপদ স্থানে।তখনো হায়েনাদের গোলাগুলি চলছিল। ভয়ে আতঙ্কে সৈদালী গ্রামের অনেক নারী পুরুষ আশ্রয় নিলো আমাদের বাড়িতে।সেদিন এই অসম যুদ্ধে মীরসরাইয়ে প্রথম শহীদ হন অকুতোভয়ী বঙ্গবন্ধু সৈনিক মগাদিয়া বদিউলা পাড়ার জনৈক রিকশাচালক। আহতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তদানীন্তন বড়তাকিয়া জামে মসজিদের পেশ ইমাম সৈদালী গ্রাম নিবাসী মরহুম মাওলানা আবু বকর। এর কয়েকদিন পর, তারিখ মনে নেই, গ্রামের কিশোররা আমাদের বাড়ির দক্ষিণে ধান ক্ষেত 'দইনা হাঁতরে' খেলা-ধুলা করছিলাম।আমি ঘুড়ি উড়াইতেছালাম, কেহ ডাণ্ডা গোল্লা, অন্যরা হা ডু ডু খেলছিল। পড়ন্ত বিকেলে আমি ছাড়া সব দুরন্ত কিশোররা যে যার বাড়ি ঘরে ছলে গেল। আমার ঘুড়ি নামাতে,সুতা বান্ডিল করতে সময় ক্ষেপণ হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি একদম নিচ দিয়ে বিকট আওয়াজ করে একটি যুদ্ধবিমান উড়ে যাচ্ছে। তারপর শুনলাম গুলি ও বোমার আওয়াজ। আবার বিমানটি সোঁ সোঁ করে এসে আমার মাথার উপর দিয়ে কয়েক চক্কর গুরে চলে গেল।আমাদের এলাকায় আক্রমণ করলনা। আমি ভয়ে একটা গাছের নিছে গর্তের ভেতর আশ্রয় নিলাম। আমার জেঠা এসে আমাকে নিয়ে গেল। পরে জানা গেল পশ্চিমা হানাদার যেখানে যেখানে প্রতিরোধের শিকার হয়েছে, সেখানেই বিমান আক্রমণ করে বহু নিরস্ত্র সাধারণ লোককে হত্যা করে। বিমান আক্রমণ হয়েছে মীরসরাই, মিঠাছড়া, জোরালগঞ্জ সহ বিভিন্ন এলাকায়। সেদিন ছিল মঙ্গলবার, বড়তাকিয়া বাজার হাঁটের দিন। শত শত ক্রেতা বিক্রেতার সমাবেশ ।জনগণের ধারনা বড়তাকিয়া বাজারের অতি নিকটে একজন বড় আউলিয়ার মাজার থাকার কারণে বিমান বার বার চক্কর দেওয়ার পরও বোমা বর্ষণ করা সম্ভব হয় নাই।অজানা আশঙ্কায় সৈদালীবাসী ও বড়তাকিয়া এলাকার জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত।যে কোন সময় ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে।
অবশেষে আসলো সে ভয়ঙ্কর সময়। ২০ এপ্রিল ১৯৭১। মীরসরাই সদর সামান্য দক্ষিণে ফেনাফুনি প্রতিরোধ যুদ্ধে হনাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি সাধিত হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হন দুই জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানী হায়েনাদের অবস্থান ছিল বড়তাকিয়া বাজারে।প্রতিশোধ স্পৃহায় পাকি হানাদার বড়তাকিয়া বাজার ও পার্শ্ববর্তী সৈদালী গ্রামে চালায় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ।গ্রামে ও বাজারে লুটতরাজ চালানো হয়।সৈদালী গণহত্যার শিকার হয় ২৩ জন নিরিহ গ্রামবাসী, ধর্ষণ করা হয় কয়েকজন অবলা রমণীকে। গ্রামের সব বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বিরানভূমিতে পরিণত করা হয়।
খোলা আকাশের নিচে অনেক দিন গ্রামবাসী মানবেতর জীবন যাপন করে। পরবর্তীতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পোড়া টিন আর বাঁশ দিয়ে কোন প্রকার আবাসনের ব্যবস্থা করে জীবন যাপন শুরু করে। জুন মাস থেকে আবারো রাজাকার, মোজাহিদ, আলবদর, বিহারী ও পাঞ্জাবী বাহিনী এক যোগে গ্রামে গ্রামে তল্লাশি অভিযান চালায়। পুরুষ শূন্য হয়ে যায় গ্রাম।বার বার চলে এ অভিযান।নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে ব্যর্থ যুবক ও তরুণদের ধরে নিয়ে হত্যা করত মীরসরাই তালবাড়িয়া স্ট্যাশন রোডের লোহার পোলের তলে। এ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি শুধু আমাদের সৈদালী গ্রামে ছিলনা মীরসরাইর প্রায় সকল গ্রামের একই পরিস্থিতি।
মীরসরাইর অন্যান্য বাজারের মত বড়তাকিয়া বাজার বোর্ড অফিসেও রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।বড়তাকিয়া রেল স্ট্যাশনের পূর্ব পোলমোগরা গ্রামের রাজাকার মোমাদ্দা ও তার দল হাটে মাঠে ঘাটে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।রাত্রি গভীর হলে তারা অনবরত গোলাগুলি করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করত। মুক্তিযুদ্ধে যতনা ক্ষতি করেছে পাকি হানাদার তার ছেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে এসব হানাদার দোসর রাজাকার আলবদর।এরা যদি হানাদারদের সহযোগিতা না করত, পথ চিনিয়ে না দিত তাহলে এত হত্যা, ধর্ষণ, খুন লুটতরাজ, জ্বালাও পোড়াও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত করা কখনো তাদের পক্ষে সম্ভব হতনা। জুলাই মাস থেকে আরম্ভ হল মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ। উদ্দেশ্য হানাদার রাজাকারদের আতঙ্কে রাখা ব্যতিব্যস্ত রাখা।এখন থেকে রাজাকারের দল গ্রামে নামলেই মুক্তিযোদ্ধার গেরিলা আক্রমণের শিকারে পরিণত হত। সম্ভবত আগস্টের শেষের দিকে ৭-৮ জন হানাদারসহ একদল রাজাকার আবুতোরাব বাজার এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের জন্য অভিযানে নামে। তারা চালাতে থাকে হত্যা খুন লুটতরাজ ও ধর্ষণ। তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধার গেরিলা কৌশলী জালে আটকা পরে। আবুতোরাব রোডের উভয় পাশের জমিতে চাষআবাদে ব্যস্ত ছিল কৃষকেরা।মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে নাস্তানাবুদ হয়ে সাধারণ পোশাক পরিহিত কয়েকজন রাজাকার ধরা পড়ে। অন্যরা অস্ত্র ফেলে সাধারণের সাথে মিশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ৭ -৮ জন পোশাক পরিহিত হানাদার প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছিল গেরিলাযোদ্ধার সাথে। গুলি ফুরিয়ে গেলে তারা প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে থাকে। পিছু নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ধান ক্ষেতের কৃষি শ্রমিকের হাতের কাছে ছিল জালাবাই ( ধানচারা বহনে শক্ত মোটা লাঠি) কৃষি শ্রমিকেরাও জালাবাই হাতে হায়েনাদের ধাওয়া দিয়ে ধরে ধোলাই শুরু করল। একজন হানাদার দৌড়াতে দৌড়াতে পশ্চিম খইয়াছরা গ্রামে এক বাড়িতে ঢুকে গেল। তাকেও ধাওয়া দিয়ে ধরে পেললো মুক্তিযোদ্ধা জনতা, তারপর গণধোলাই।দুর্দর্শ গেরিলার এই বীরত্বপূর্ণ পাল্টাঘাতে জনমনে আশা সঞ্চারিত হল, কিছুটা আতঙ্কগ্রস্তও হল এর প্রতিক্রিয়ায় আবার কি ঘটে। ৩ - ৪ দিন পর রাজাকার,আলবদর মোজাহিদ,আর হানাদারের বিরাট বহর একযোগে হামলা চালালো মায়ানী, মগাদিয়া, চরসরত, খেয়ারহাট গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার অবাধ বিচরণ ভূমিতে। কিন্তু গেরিলা কৌশলের কাছে সফল হতে না ফেরে প্রতারণার আশ্রয় নিলো। ৪ জন রাজাকার অস্ত্র লুকিয়ে রেখে সাধারণ জনতার সাথে মিশে গিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে লড়াইরত অস্ত্রধারী এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে দ্রুত হামলা স্থান ত্যাগ করে রাজাকার-হানাদার বহর। এখন থেকে নির্বিঘ্নে গ্রামে নামা রাজাকার হানাদার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যেখানে তাদের অভিযান সেখানেই গেরিলা আক্রমণ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে দিয়েছে। বড়তাকিয়া ১২ নং খইয়াছড়া ইউনিয়ন বোর্ড অফিস রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ। রোজার মাস। সেহেরী খাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত। এমন সময় দড়ম দড়ম বিকট শব্দ। তার পর ব্রাশ ফায়ার। মাত্র ১০ মিনিটের যুদ্ধে বোর্ড অফিস রাজাকার ক্যাম্প পতন। ১৫ - ২০ জন রাজাকার মাত্র ৮ জন বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার গ্রেনেড হামলায় কুপোকাত। সবাই অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল। ক্যাম্পের গুলিগোলা অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের দখলে নিয়ে নিলো মুক্তিযোদ্ধারা।এর পর থেকে বাবার সাথে প্রতিদিনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ জয়ের ঘটনা শুনে শিহরিত হয়ে উঠতাম, আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে যেতাম। এম আর আখতার মুকুলের 'চরম পত্র', রাজু আহাম্মদের ' জল্লাদের দরবার ' শুনে সাহস পেতাম স্বস্তি পেতাম।দুঃখ দুর্দশার মধ্যে থেকেও আনন্দ পেতাম। এইভাবেই ভয়ে- আতঙ্কে,দুঃখ-দুর্দশায় কেটে যাচ্ছিল ৭১' এর অগ্নিঝরা দিনগুলি। আর প্রতীক্ষার প্রহর গুনতাম অদম্য আকাঙ্ক্ষায় জালিমের জুলুম থেকে মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য।
ডিসেম্বরের শুরু থেকে বিবিসি অলইন্ডিয়া রেডিও ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একেকটি অঞ্চল মুক্তির খবর জানাতে লাগল। আমাদের বিশ্বাসও দৃঢ় হতে থাকে, সহসায় আমরাও মুক্ত হতে যাচ্ছি। স্বপ্নের স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
১৯৭১, ডিসেম্বরের ৮ তারিখ। হাড় কাঁপানো শীত। সকাল থেকে উত্তর দিকে দূরের প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম না যুদ্ধ কোথায় হচ্ছে।ধারনা করে গ্রামের মুরব্বীদের কেহ বলে দূ্র্গাপুর- মাতবরহাট, কেহ বলে মিঠানালা- বামনসুন্দর, কেহ বলে মীরসরাই-তালবাড়িয়া ওয়ারলেস। একজন মুরব্বী বললো সর্বাত্মক যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। পাহাড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত এক যোগে লড়ে যাচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। দুপুর ২টার পর আমরা দুরন্ত কিশোররা আরব আলী মেস্তরী বাড়ির সামনে খেলার মাঠে শীতের রোদেলা দুপুরের তাপ উপভোগ করছিলাম। দূরের গোলাগুলির আওয়াজ যেন আরো নিকটে উচ্চস্বরে শোনা যাচ্ছে। প্রথম প্রথম ভয় পেতাম, এখন আর কামানের গোলার আওয়াজও আমরা ভয় করি না আমাদের এখান থেকে স্পষ্ট ঢাকা ট্রাঙ্করোডের চলন্ত যানবাহন দেখা যায়।হানাদারের সামরিক বহর ছাড়া আজকে আর কোন যান বাহন চলতে দেখা যায় নাই। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। শীতের মধুর রোদেলা তাপও ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে পারছি শতশত হানাদার সামরিক গাড়ির বহর একটার পর একটা লাইন ধরে চট্টগ্রাম শহরে দিকে চলে যাচ্ছে। এরা কি টহল দিচ্ছে নাকি স্থান পরিবর্তন করছে নাকি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে পালিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলামনা।ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির শব্দের আরো উচ্চতর আওয়াজ এবং তার সাথে সাথে হাজারো মানুষের গগনবিদারী কণ্ঠের সম্মিলিত শ্লোগান। এই গগনবিদারী কণ্ঠ যতই কাছে আসতেছে ততই আওয়াজ বড় ও স্পষ্টতর হচ্ছে । কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিনা, একি আর্তনাদ নাকি জয়গান ? আমাদের সাথে ছিল মেস্তরী বাড়ির 'ননী'।হঠাৎ সে "জয়বাংলা"বলে চিৎকার করে উঠল।আমরা হতবাক, ভালো করে লক্ষ্য করে শোনতে লাগলাম ঐ গগনবিদারী শ্লোগানের মর্মকথা। ননী আবার বলে উঠল, ঐ ; ঐতো 'জয়বাংলা' 'জয় বঙ্গবন্ধু'। আমরাও তার সাথে জয়বাংলা - জয় বঙ্গবন্ধু বলে চিৎকার শুরু করলাম।মেস্তরী বাড়ির মুরব্বী 'কালা কাকু' ধমক দিয়ে বললো, " থাম,থাম অডা। ডর ভয় নাই। এত চিল্লসকা। তোরগোর লাই গেরামেত্তে আবার রাজাকার হান্দাইব "। না-এবার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, ঐ হাজার কণ্ঠের গগনবিদারী আওয়াজ, আর্তনাদ নয় জয়গান।" জয়বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু " শ্লোগান তুলে আমরাও এগিয়ে যেতে লাগলাম ঐ বিজয়ের আনন্দ মিছিলে। আমাদের সাথে একত্রিত হল গ্রামের আরো অনেক শিশু, কিশোর, তরুণ বৃদ্ধ যুবক।বড়তাকিয়া বাজারে ঢাকা ট্রাঙ্করোডে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার আগত বিরাট বিজয় মিছিলকে স্বাগত জানিয়ে আমরাও যোগ দিলাম বহুল আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির মিছিলে, স্বাধীনতার বিজয় মিছিলে।মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিন গানের গুলি ছুড়ে জানান দিতে লাগল আজ হতে আমরা মুক্ত-স্বাধীন। মিছিল চলে গেল আবুতোরাব বাজারের দিকে। আমি বেশি দূর যেতে পারি নাই। কনকনে ঠাণ্ডা, শীতের সন্ধ্যা। আবুতোরাব রোডে আবু বকর মৌলভী বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে 'দইনা হাঁতর' পেরিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসি।রাত্রেই শোনা গেল বড়তাকিয়া এলাকার ত্রাস মোমাদ্দা রাজাকার ধরা পড়ল মুক্তিযোদ্ধা জনতার হাতে। গভীর রাত পর্যন্ত চাচাত জেঠাত ভাই বোন, চাচা-চাচী,জেঠা-জেঠি বাড়ির সবাই মিলে হৈ হল্লোল আর আনন্দ উৎসবে মেতে থাকলাম। আজ বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আশেক এলাহি কে মনে পড়ছে বার বার। জানিনা সে কোথায় আছে।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সে একবার গভীর রাতে এসেছিল, ভোর হবার পূর্বে আবার চলে যায়। কিছুতেই আজ ঘুম আসছেনা। উৎসাহ ও উত্তেজনা নিয়ে ভোরের অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটালাম। ভোরে বিছানা থেকে উঠে দেখি কালো পোশাক পরিহিত বীর মুক্তিযোদ্ধা রাব্বান মামা আমাদের বাড়িতে। তাঁর থেকে প্রথম জানতে পারলাম রাত ২ টার পর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বড়তাকিয়া এলাকায় অবস্থান নিয়েছে।তিনি ওয়ারল্যাস অপারেটর হিসাবে তাদের সাথে এসেছেন।সামান্য নাস্তা সেরে উনি দ্রুত চলে গেলেন। আমরাও মামার সাথে বেরিয়ে পড়লাম।মামা গেলেন বড়তাকিয়ায় আর আমরা গেলাম দক্ষিণ দিকে আবু বকর মৌলভী বাড়িতে। ঐবাড়িতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শতশত সেনা সদস্য অবস্থান নিয়েছে। বাড়ির সামনে খেলার মাঠ, পুকুর পাড়ে মাটি খুঁড়ে তারা বাঙ্কার তৈরি করছে।বাজারে এসে দেখলাম মিত্রবাহিনীর শত শত গাড়ি ভারী অস্ত্র-নিয়ে প্রস্তুত হাজার হাজার শিখ সেনা।তেলি পুকুর মঙ্গলা পুকুর পাড়সহ আরো অনেক জাগায় বাঙ্কার তৈরি করছে তারা। মুক্তিযোদ্ধা জনতা তাদের সহযোগিতা করছে। গ্রামের ছেলে-মেয়ে, শিশু কিশোর, পুরুষ-মহিলা কারো মনে আজ ভয়-আতঙ্ক নেই। সবাই মুক্তির আনন্দে আত্মহারা।৯ মাসের বন্দীশালার দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে আমাদের সৈদালী গ্রামসহ পুরো মীরসরাই।মীরসরাই হানাদার মুক্ত করতে গিয়ে এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহবানে লাল সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশের বিজয় চিনিয়ে আনতে যারা অকাতরে তাজা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাঁদের মীরসরাই হানাদার মুক্ত দিবসের দিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জানাচ্ছি সালাম ও শুভেচ্ছা।