প্রত্যেক কবির কবিতায় একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর থাকে, আর সেই কবি যদি হন বড় মাপের কবি তাহলে তার সেই স্বাতন্ত্র্য বুঝে নিতে সচেতন পাঠক বা সমালোচকের কোনোই অসুবিধা হয় না। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, প্রত্যেকটি মানুষ যেমন ব্যক্তি হিসেবে ভিন্ন, তার চেহারা, তার রুচি ভিন্ন, তার কণ্ঠস্বর ভিন্ন, সেহেতু তার রচিত কবিতাও ভিন্ন হতে বাধ্য। শিল্পের বিচারে এবং কণ্ঠস্বরের স্বাতন্ত্র্যে ভিন্ন ভিন্ন কবি’রা তাই যুগ যুগ ধরে রাজ করে যাচ্ছেন বাঙলা কবিতায়।
আমার আজকের আলোচ্য সূচিতে বিশেষ এক কবির কবিতাই প্রাধান্য পাচ্ছে, এই কবি পরিণত বয়সের কবি, এই কবি সকলের থেকে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের অধিকারী; কারণ তিনি নবযৌবনের শুরুতে কবিতা লেখা শুরু করলেও, পরিণত বয়সে এসে তার আত্মজ কবিতাগুলোকে মলাটবদ্ধ করেছেন। এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ‘মন খারাপের গাড়ি’র কবি, মাহবুবুল হক শাকিল।
শাকিল কবিতা লেখেন পরিণত শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে, কিন্তু তিনি রাজনীতির সাথে পারিবারিকসূত্রে জড়িয়ে আছেন সেই বাল্যকাল থেকেই; রাজনীতির ঘোরটোপে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে শাকিলের কবি পরিচয় অনেককাল লুকিয়ে ছিলো বাঙলা কবিতার পাঠকদের কাছে; কবি পরিচয়ের বাইরে রাজনীতিক হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। শাকিলের খুব কাছের মানুষ ছাড়া তেমন কেউ জানতেন না তার কবিতাচর্চার কথা।
শাকিলের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে। অনেককাল আগে থেকেই শাকিল নিভৃতে কবিতা লিখলেও গ্রন্থভুক্ত কবি হিসেবে তার সরব উপস্থিতি সম্প্রতিকালে বোদ্ধা মহলে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হিসেবে কাজ করেছে। তিনি এখন সকলের কাছে একজন রাজনীতিকের পাশাপাশি কবি হিসেবেও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন।
আসলে কবিতা হচ্ছে ছাইচাপা তুষের আগুনের মতো। কারো কারো ক্ষেত্রে আগ্নেয়গিরির আগুনের মতো; জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ করেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
শাকিলের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে। অনেককাল আগে থেকেই শাকিল নিভৃতে কবিতা লিখলেও গ্রন্থভুক্ত কবি হিসেবে তার সরব উপস্থিতি সম্প্রতিকালে বোদ্ধা মহলে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হিসেবে কাজ করেছে। তিনি এখন সকলের কাছে একজন রাজনীতিকের পাশাপাশি কবি হিসেবেও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন।
প্রকৃতপক্ষে কবি হিসেবে শাকিলের এই গ্রন্থভুক্ত উত্তরণ অনেককেই কিছুটা বিস্মিত করেছে। আমি মনে করি দেরিতে বিস্ফোরণ ঘটায় তা শাকিলের জন্য শাপে-বর হয়েছে। তিনি পরিণত বয়সে যেহেতু তার কবিতার গ্রন্থভুক্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেহেতু আটঘাট বেঁধে এই পথে নামার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে অনেকগুলো বিষয় তাকে মাথায় রাখতে হয়েছে। যদি তার প্রথম দিককার কবিগুলো পাঠ করা হয় তাহলে ধাপে ধাপে পরিণত কবি শাকিলের উত্তরণটি সহজেই চোখে পড়বে। এটা শুধু শাকিলের ক্ষেত্রেই নয়, সকল কবির ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে; প্রথম দিককার কবিতাকে ছাপিয়ে পরিণত হয়ে ওঠেন কবি।
রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দের মতো কবিদের কথাই যদি ধরি, তাহলে তাদের পরিণত বয়সের প্রাজ্ঞতা কি প্রথম বয়সের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যাবে? রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যাসংগীত’ এবং ‘প্রভাতসংগীত’-এর কবিতার সঙ্গে তাঁর পরবর্তীকালের কবিতার তুলনা করা যাবে? অথবা জীবনানন্দ দাশের ‘ঝরাপালক’-এর মতো কাব্যগ্রন্থকে কি পরবর্তীকালের কাব্যগ্রন্থসমূহের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে? ‘ঝরাপালক’-এর পরবর্তীকালের কাব্যগ্রন্থগুলোর কবিতাসমূহের মধ্যে যে বিপ্লবাত্মক বাঁকবদল, তা বাঙলা সাহিত্যে একটি বিস্ময়কর ঘটনা বলেই বোদ্ধা মহলকে স্বীকার করে নিতে হয়েছে। জীবনানন্দের বাঁকবদলের সেইসব কবিতায় একজন পরিণত কবির আবির্ভাবের সম্ভাবনার বিদ্যুৎঝলক কারও দৃষ্টির অগোচর থাকেনি। এই আলোকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে কবিতার জগতে শাকিলের পরিণত আবির্ভাবের সম্ভবনাও তার প্রথমদিকের কবিতায় আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি।
মাটির সানকি মানেই ছুঁয়ে যাওয়া প্রেম, দেশ
কিংবা প্রবাস, বাল্যস্মৃতির জানালা।
এক টুকরো লেবু, কাঁচা লঙ্কার সবুজ
ভাইয়ের ভালোবাসার মতো পাতের পাশে
একদলা সাদা নুন।
[ভুলে ভরা গল্প, (মন খারাপের গাড়ি)]
এই কবিতা পড়ে কি মনে হচ্ছে না, একজন সম্ভবনাময় পরিণত কবির আবির্ভাবের আভাস আমরা টের পাচ্ছি? আসলে কবি এভাবেই সামনের দিকে আগায়। কবিতা যদি একজন কবির জীবনচর্চার আঁধার হয়, ধ্যানের বিষয় হয়, তাহলে সেই কবির পক্ষে ক্রমপরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া সাফল্যের সঙ্গেই সম্ভব।
রাজনীতির পাশাপাশি যখন একজন কবি কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন তিনি অন্য কবিদের থেকে অনেক বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে ওঠেন। কবিরা যা দেখেন কল্পনায়, রাজনীতিবিদ তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকেন বলেই কল্পনা ও বাস্তবের মিশেলে একটি ঘনঘোর আবহ সৃষ্টি করে কবিতাকে ঊচ্চমার্গে পৌঁছে দেওয়া রাজনীতিবিদ কবিদের পক্ষে অনায়াসেই সম্ভব হয়। আর তাই তাদের কবিতা অনিবার্যভাবেই হয়ে ওঠে অন্তর্গতভাবে সুদূরপ্রসারী। আমরা যদি অক্টাভিও পাস কিংবা পাবলো নেরুদার কথা ভাবি, তাহলে দেখবো চেতনার অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্তিত্বের বিপুল অাঁধার সঞ্জীবিত থাকলেও তাকে গভীর ও গূঢ়তর কবিতা করে তুলতে এই দু’জনের কারোরই কোনো কষ্ট হয়নি। যদিও অক্টাভিও পাস একটি সময়ের পরাবাস্তব আন্দোলনের এক ধরনের মোহাবিষ্ট ধাঁধার মধ্যে নিজের কবিতাকে সংশ্লিষ্ট করেছেন, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তাঁর কবিতা যে মানবিকীকরণের এক ধরনের গূঢ় অহঙ্কারের অাঁধার হয়ে উঠেছে; এটা অস্বীকার করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আর পাবলো নেরুদা তো ছিলেন রাজনীতিরই লোক, তাঁর কবিতা রাজনীতির সংশ্লেষে অন্যদের কবিতার চেয়ে একটি গভীর তাৎপর্য নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে সমাদৃত হয়েছে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এত কথা বলার মূল কারণ, মাহবুবুল হক শাকিল তার কাব্যিক মনোভূমিতে নিজেকে যে ক্রমাগত সম্প্রসারিত ও পরিণত করে তুলেছেন, তা তার আলোচিত কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করলে সহজেই অনুমান করা যাবে। কয়েকটি কবিতাংশের উদাহরণ না টেনে পারছি না:
উজ্জ্বল দুপুরজুড়ে পিঁড়ি পেতে বসে মধ্যসূর্যের আলো;
অন্ধকার ফিরে যায় বৃদ্ধ সন্তের মতো ন্যুব্জমান
পাড়ি দেয় ভাঙা সাঁকো, মেঠোপথ।
ফিনকি দিয়ে রক্ত নামে, লাল, ইমপ্রেশনিস্ট ক্যাম্পাসে;
রঙের মেলায় সবাই নাচে নিজের মতো করে
ঢাকির জাদুকরী কাঠি বাজে, ঢেকে ফেলে পতনের শব্দ।
[আলো কিংবা নাচের মুদ্রায়, (মন খারাপের গাড়ি)]
খুব বেশি দেখতে নেই ভালোবাসা, জানতে নেই কত বেশি
জীবনের ভুল। মাঝরাতে খুঁজে ফিরি ভুল কবিতা, বিষণ্ন অনুবাদ
মন খারাপের গাড়ি অভিমানের এভিনিউয়ে খুঁজে ফেরে দূর সমুদ্দুর।
[মন খারাপের গাড়ি, (মন খারাপের গাড়ি)]
তুমি চলে গেলে মন পুড়ে যায়, পুড়ে যায় বন
পুড়ে যায় প্রজাপতি, ঘাস, উড়ে যায় বাউল বাতাস
পুড়ে যায় স্বপ্নচুম্বী জয়রথ, রয়ে যায় বিষণ্ন বিলাপ।
[অন্য পাড়ায় বাড়ি, (মন খারাপের গাড়ি)]
মরে যাওয়া মানুষ তুমি আর কতদূর যাবে?
খাটিয়ার গতি কি ছুঁতে পারে জীবনের সাম্পান?
[অগস্ত্য যাত্রা, (মন খারাপের গাড়ি)]
রোদ ছিল না এক রত্তি, আকাশজুড়ে কান্না
গ্রিক পুরাণের পাখির মতো আপনি ফিরে এলেন
নির্বাসনের অশ্রু পেরিয়ে, পিতার শ্যামল মাটিতে।
তেরো শত নদীজুড়ে বয়ে গেল স্রোত
ধানশালিকের উদ্দাম ওড়াউড়ি।
[শেখ হাসিনা, আপনি এলেন (মন খারাপের গাড়ি)]
জুড়ে থাকে ভালোবাসা, অভিশাপ, বিষাদ,
মৃত্যু এবং প্রেমের রাত, স্বপ্ন-টলোমল করিডর
জুড়ে চান্দের সাম্পান, অপবাদের নষ্ট জল।
[ভালোবাসার সাদাবাড়ি, (মন খারাপের গাড়ি)]
এই ধরনের কবিতা লিখতে গিয়ে কবি হিসেবে রাজনীতিক শাকিলের তেমন কোনো দ্বৈরথ তৈরি হয়নি। তার আত্মদর্শন কিংবা তার তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় সাধন করে তিনি কবিতাকে একটি গভীর ও গূঢ়তর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে সাঙ্গীকৃত করতে পেরেছেন, কবি হিসেবে এখানেই তার ভিন্নতা এবং সার্থকতা। শাকিলের কবিতাকে বুঝতে গেলে ব্যক্তি শাকিলকেও বোঝার দরকার আছে। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন, ‘কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে’; কিন্তু আমার মনে হয় কবির কবিতাকে সূক্ষ্মভাবে বোঝার জন্য কবির ‘জীবনচরিত’ বোঝাও খুবই প্রাসঙ্গিক।
শাকিলের ‘মন খারাপের গাড়ি’তে বিস্মিত হয়েছি এই জন্য যে, তিনি তার কবিতার পরিণতির জন্য যেই কয়টি অনিবার্য সত্য পুরণ করা জরুরি, তা খুব সাহসের সঙ্গে পুরণ করার চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে কবিতার রহস্যময়তা, দর্শন, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, মিথ ও পুরাণের নিপুন এবং যথাযথ ব্যবহার কখনো কখনো তার কবিতাকে শক্তিশালী সৃষ্টি হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে।
কবিতা লেখার সময় আধুনিক কবিতার যে দাবি, তা পুরণের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সাথে এগিয়েছেন তিনি। সেটি চেতনার দিক থেকে যেমন সত্য, ঠিক তেমনি অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও সত্য। শাকিল খুব সতর্কভাবে বাঙলা কবিতার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পরিভ্রমণ করেছেন। শাকিলের এই পর্যটনপ্রিয় পরিভ্রণে সতর্কভাবে তার সঙ্গী হয়েছেন—রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে কিংবা বিনয়ের মতো বাঙলা কবিতার রাজ পরিব্রাজকেরা।
মাহবুবুল হক শাকিলের কবিতা নিয়ে সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনার ইচ্ছে থাকলেও সময়হীনতার কারণে সেটা সম্ভব হলো না। এ নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইলো। তবে যেটুকু আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি তাতে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, মাহবুবুল হক শাকিল মলাটবদ্ধ কবি হিসেবে যখন এবং যেখান থেকেই যাত্রা শুরু করে থাকুন না কেনো, তাতে কিছুই আসে যায় না। কবিতার আলপথ যে তার জন্য ক্রমশ রাজপথ হয়ে উঠতে শুরু করেছে, এ ব্যাপারে বোদ্ধা মহলের কোনো সন্দেহ নেই। শাকিলের কবিতার রাজপথ, বাঙলা কবিতার ভিণ্নপথে কতোদূর বিস্তৃত হয় তা দেখার জন্য সম্ভবত আমাদের আরও একটি মলাটবদ্ধ প্রয়াসের জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।