স্বপ্নহীনের সাপলুডো ।। সৌমিত্র চক্রবর্তী

(৭)

জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ স্যারদাদা। গান আমার রক্তে দাদাস্যার। গান গাইতে আমি খুবই ভালোবাসি। তা আমি বসে আছি। খাচ্ছি আর গাইছি...
(জগাই গান গেয়ে ওঠে। গানের মধ্যেই মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। গান চলতে থাকে। আলো জ্বললেই দেখা যায় একটা ভাঙাচোরা বাড়ীর রোয়াকে বসে একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের বাটি হাতে সে গান গেয়ে চলেছে আর খাচ্ছে)
কথা বলতে ভার দিয়েছ
বোবা কালার এই ভুবনে।
আমিই নিছক গণ্ডমূর্খ
আর সকলে সবই জানে।।

আড্ডা দেওয়ার বেঞ্চি দিলে
তার দু পায়া নড়ন চড়ন।
ডাকলে তবু কেউ আসে না
এক এক জনের এক এক ধরন।।

সাপলুডো কি দাবার ছকে
ঘড়ির কাঁটা অবিশ্রান্ত।
সময় এখন চালচুলোহীন
আগেভাগে কে আর জানতো!

স্বপ্নহীনের বুকপকেটে

(৮)

লাল নীল সব কলম থাকে।
স্বপ্ন ছাড়াই পদ্য লেখে
রাজা তাকেই বাঁচিয়ে রাখে।।

কথা বলতে দায় চাপালে
বাচাল আমি চিরটাকাল।
দাঁড়ের ময়না আমি তো নই
কোদাল কে তাই বলি কোদাল।।

ব্যাঘ্র আজও ব্যাঘ্র এবং
শকুন আজও শকুনই আছে।
মানুষ কেবল পালটে যাচ্ছে
নিত্য নতুন বাজার ধাঁচে।।

উলটে পালটে সব দেখেছি
তন্ত্র মন্ত্র গুরুর বিধান।
নানান পথে নানান মতে
কখনো বাম কখনো ডান।।

দিন কে যারা রাত্রি বানায়

(৯)

রাত কে যারা দিন সাজালো
মহাপুরুষ তারাই নিজের
জয়ধ্বনির ঢাক বাজালো।। 

কথা বলতে দিলেন যখন
কথার কথা বলব না আর।
কথায় আগুন জ্বালিয়ে তুলি
কথায় হবে ওস্তাদী মার।।

নটে গাছটি মুড়োয় তবু
কথা আমার ফুরোয় না।
মুখোশ ছিঁড়ে মুখ না দেখে
প্রাণ যে আমার জুড়োয় না।।

(ভেতর থেকে এক মহিলা চিৎকার করতে করতে আসেন। তিনি জগাইয়ের মা। চিৎকার শুনে জগাইয়ের গান থেমে যায়)
মা – এই যে নবাবের ব্যাটা নবাব! এখনো বসে বসে কালোয়াতির আসর চলছে? এদিকে বেলা কত হলো তা খেয়াল আছে? ডিমের গুমটি কি বেলা বারোটায় খুলবে? আর লোকে অতক্ষণ তোর জন্যে দাঁড়িয়ে থাকবে? বাজারে এখন ডিমের একশোটা দোকান হয়েছে। যার যেখানে খুশি সেখানে কিনবে।
জগাই – আঃ! মা! দিলে তো এই সাত সকালে মেজাজটা চটকে!

(১০)

মা – মেজাজ! তোমাদের ওই জমিদারী মেজাজ নিয়ে লালকেল্লায় গিয়ে থাকলেই তো পারো। এখানে কেন? তিনবেলা গেলার সময়ে মা কে মনে পড়ে। কিন্তু গেলার জিনিসপত্র কোত্থেকে আসবে সে খেয়াল আছে?
জগাই – উফ মা মা মা গো মা! একবার কমার্শিয়াল ব্রেক দাও মা! রুকাওট কে লিয়ে একটুও খেদ নেহী হ্যায় মা?
মা – হ্যাঁ, মা তো তোমাদের শত্রু। বাপ চিরটাকাল হাড় জ্বালিয়ে গেছে, এখন ছেলেও তাই করছে। যত কুঁড়ের বাদশা সব আমার কপালেই জোটে!
জগাই – মা! এরপরে ওই ডায়লগটা! (মায়ের নকল করে) চিতায় ওঠা পর্যন্ত আমার কপালে এই আছে। হে ভগবান! বাবা জেনেশুনে আমার কোন ঘরে বিয়ে দিল!
মা – হ্যাঁ দিলই তো। এরচেয়ে গলায় কলসি বেঁধে জলে ভাসিয়ে দিলে ভালো হত।
জগাই – কিন্তু মা, তোমার বিয়ে তো সেই কত যুগ আগের ব্যাপার। তাছাড়া দাদু বিয়েটা দিয়েছিলেন বাবার সাথে। আর বাবাও এখন ফুস। (ওপরের দিকে আঙুল দেখায়) তবে এখন আর আফসোস করে লাভ কি?
মা – না না, আফসোস করব কেন? আমি তো এখন তোমাদের বোঝা। ও রেখে গেল আমাকে এই জ্বালা সইবার জন্যে। হে ভগবান! কবে যে যেতে পারব! (কেঁদে ফেলে)
জগাই – (মা কে জড়িয়ে ধরে) আঃ মা মা আমার সোনা মা! কাঁদছ কেন? এই দেখ না এক্ষুণি বেরোব আমি। বাজারে যতই দোকান থাকুক আমার মত খাঁটি, পচা নয়, একনম্বর, এই উটপাখির ডিমের সাইজের মত এই এত্তোবড় ডিম (দু হাত দু দিকে ছড়িয়ে দিয়ে ডিমের সাইজ দেখায়) খদ্দেররা আর কোন দোকানে পাবে বল? ঘুরেফিরে সেই আমার দোকানেই আসতে হবে। (গেয়ে ওঠে) এ তো ডিম নয় গো এ যে ডিমডিমাডিমডিম ডিডিম ডিডিম ডিম... (মা হেসে ফেলে) হ্যাঁ এই তো হাসি ফুটেছে মুখে।
মা – আমারও কি ইচ্ছে করে তোকে সকাল থেকে জোর করে দোকানে পাঠাতে। সারাদিন ওই একভাবে বসে থেকে ডিম বিক্রী করা। আমি কি বুঝিনা? বুঝি সব। কিন্তু কি করব বল?

(১১)

জগাই – মা, মা গো, তোমাকে এতসব ভাবতে কি বলেছি আমি? আর তাছাড়া ডিম বিক্রী করতে আমার ভালোই লাগে। কত রকম মানুষ আসে। তাদের সঙ্গে কথা হয়। পাশের চায়ের দোকানের খবরের কাগজ পড়ি। সময়টা যে কখন সুড়ুৎ করে কেটে পড়ে বুঝতেই পারিনা।
মা – ওই দোকানটুকু করতে পেরেছিলি বলে বেঁচে গেলাম আমরা। নইলে যে কি হতো ভগবানই জানেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মরতে হত হয়তো।
জগাই – হ্যাঁ বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাদের খুবই কষ্ট হয়েছিল বল!
মা – হ্যাঁ মনে হয়েছিল যেন অথই জলে পড়েছি। কেউ কোথাও নেই। মানুষটা তো একটা টাকাও জমিয়ে যেতে পারেনি। পাড়ার লোকেরা না দেখলে কি যে হতো!
জগাই – হ্যাঁ বাবা বেঁচে থাকলে কি আর আমাদের অভাব থাকতো!
মা – অভাব? না অভাব তো আমাদের চিরকালই ছিল। তোর বাবা কখনোও মিথ্যে কথা বলতেন না আর লিখতেনও না। সে জন্যে যারা মিথ্যে দিয়ে কাগজ ভর্তি করে তাদের কাছে তোর বাবার কোনো কদর ছিল না।
জগাই – তবুও বাবা তো কাগজের রিপোর্টার ছিল। আর রিপোর্টারের মাইনে খারাপ নয়, তাহলে?
মাওই যে বললাম, তোর বাবার এক জেদ ছিল মিথ্যে খবর লিখবেন না ওই জেদের জন্যেই কাগজের মালিকদের সঙ্গে তোর বাবার বনিবনা হত না আজ এক খবরের কাগজ তো কাল আর এক মাঝেমধ্যে আবার কাজ না পেলে বাড়ীতে বসে থাকা এই করেই সঞ্চয় কোনোদিনও হয় নি আর তাছাড়া মারা যাওয়ার পরেও তো কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেল না
জগাইজানো মা, আমার মনে আছে কোন সেই ছোটবেলার কথা, তবুও এখনো মনে আছে বাবা একটা কথা আমাকে প্রায়ই বলতেন, বলতেন জগাই রে লোভ বড় সর্বনেশে প্রথমে যেটাকে অভাব মনে হয়, পরে সেটা মিটে গেলেও চাহিদা থেকেই যায় আর তখনই ওই পাঁক থেকেই জন্ম হয় লোভের বুনো আগাছার মত ওই বিষ ফলের গাছটা আমাদের মস্তিষ্কে, কোষে, দেহের প্রত্যেক কোণে শেকড় ছড়িয়ে দেয় মাকড়সার মত আঁকড়ে ধরে মানুষকে মানুষ তখন ছটপট করে, কাঁদে, চিৎকার করে কিন্তু মুক্তি পায় না আস্তে আস্তে কিনারার শেষে খাদ জেনেও মানুষকে ঐদিকেই এগিয়ে যেতে হয় মা, বাবা তো লোভ করেন নি! তবে বাবাকে শেষ হয়ে যেতে হলো কেন?

(১২)

মা – (জগাইকে জড়িয়ে ধরে) কে বললো তোর বাবা শেষ হয়ে গেছেন? ওই কথাগুলো যে এখনো সত্যি
জগাইকি জানি!
(বাইরে থেকে কথা বলতে বলতে এক কনস্টেবল ঢোকে মা বেরিয়ে যায়)
কনস্টেবল – আচ্ছা, এখানে জগাই বাবুর বাড়ী কোনটা বলতে পারেন?
জগাই – কোন জগাইয়ের কথা বলছেন দাদা? এই কাটা ফটিকের ফাটা গলিতে সতের জন জগাই থাকে।
কনস্টেবল – অ্যাঁ! এইটুকু জায়গায় সতের জন জগাই!
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ। (গড়গড় করে বলে যায়) টাকলু জগাই, রাতকানা জগাই, ভীম জগাই, প্যাঁকাটি জগাই, চুল্লু জগাই, সাট্টা জগাই, লোহা জগাই, কয়লা জগাই, ময়লা জগাই, মেম জগাই, ডিম জগাই...
কনস্টেবল – আরে থামুন...থামুন! ওরে বাপ্রে! মাথা একেবারে ভোঁ ভোঁ করছে। সকালে কি যেন খেয়েছিলাম। পেটটা কেমন যেন করছে। দাঁড়ান, দাঁড়ান... (পকেট থেকে কাগজ বার করে দেখে) হ্যাঁ পেয়েছি। এ হলো আটের বারো ফাটা গলির জগাই।
জগাই – অহ তাই বলুন। আটের বারো তো আমাদেরই বাড়ী। তা আপনি কোন জগাইকে চাইছেন?
কনস্টেবল – কোন জগাই মানে? যাচ্চলে! এ বাড়ীতেও কি ডজন ডজন জগাই থাকে নাকি অ্যাঁ!
জগাই – আজ্ঞে তা নয়। তবে কিনা জগাইয়ের রকমফের আছে।
কনস্টেবল – জগাইয়ের রকমফের!
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি হলুম চতুর্থ জগাই।
কনস্টেবল – মানে?

জগাই – আমার বাবা হলেন তৃতীয় জগাই। আমার দাদু দ্বিতীয় জগাই। আর তার বাবা ছিলেন প্রথম জগাই।

চলবে...

SHARE THIS

Author: