জয় - রুখসানা কাজল



কেমন আছ অদিতি ?
ভাল থাকার এই সংগ্রামে আমি বোধহয় হেরে গেলাম! ম্যমথের দল হলুদ দাঁত বের করে বার বার আমাকে ভয় দেখায় গরম নিঃশ্বাস ফেলে হায়েনেরা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চায় আমার কণ্ঠনালী তোমাদের ছেড়ে পালিয়ে এলাম কতদূর! তবু ভয় আর ভয় হেরে গেলাম না তো আমি!
প্রতিদিন নতুন করে জয়ের পতাকা উড়িয়ে দিই পাহাড়ি ঈগলের চোখে তাকিয়ে   দেখি পতাকার ঋজু উড়ান মেঘ পেরিয়ে আকাশ ছুঁয়ে উড়ছে আমার জয়ের  পতাকা জয়ের নেশায় বৈরাগ্যের বিন্দুমাত্র ছায়া আমি সহ্য করতে পারি না জয় আমার হাতের মুঠোয় তবু ভয় আমাকে ছাড়ে না শুধু তোমার কাছে হেরে গেলাম যে অদিতি !    
গেল রাতে স্বপ্ন দেখলাম লাল শাড়ি পরা একটি মেয়ে সিথানে নরম কাঁথা রেখে  বলছে, শেষ রাতে শীত পড়ে আজকাল লাগলে টেনে নিও মুখটি দেখতে পেলাম না যেন তুমি এভাবেই তো তুমি কথা বলতে অনির্দিষ্ট আবেগে অহর্নিশ কর্তব্যে অক্লান্ত ধৈর্য্যে আমার উদ্ধত অহংকারে তোমার এই আবেগ পাত্তাই পেত না কখনো 
আমি মেতে থাকতাম নিজের মত নিজের কাজে নেশায়, পেশায়, সখে প্রয়োজনে  তোমাকে টেনেছি, ভেঙ্গেছি তোমার শরীর, ইঞ্চি ইঞ্চি শ্যামল জলাভূমিতে আমার দখল কায়েম করেছি কেবল মনে হয়েছে আরো কিছু লুকানো নেই তো তোমার! কোন ডাহুক ডাকা ভালবাসা, মুগ্ধ বিকেল, অবিরাম বৃষ্টি, গোপন প্রেম! এত যে ধ্বংস করি তোমায় কে বাঁচায়, কেন হাসো, কেন বৃষ্টি দেখে গলে পড় মেঘমল্লারে, কার উষ্ণতায় চন্দ্রমল্লিকার সাহস পাও হিমঝরা ঠান্ডায়, কে তোমাকে ডেকে নেয় ছাদে হলুদ জ্যোৎস্নায় উদোম উদ্দাম হতে
তোমাকে বুঝতে চাইনি ঘরের অন্য দশটি আসবাবের মতই  মূল্য  ধরেছি তোমার বুঝতে পারিনি একটু একটু করে কখন তুমি তোমার  ভালবাসার নদী তুলে নিচ্ছিলে আমার কূল থেকে হিমবাহ হতে কত বছর লাগে অদিতি ? জমে যাচ্ছিলে তুমি আমি তো তাই চেয়েছি তোমার স্রোত কেড়ে নিয়ে তোমাকে স্থবির অচল করে উন্মত্ত সুখ চেয়েছিলাম এখন মনে হচ্ছে তুমি ঠিক বলতেভালবাসা  নিতেও জানতে হয় আমি যে দিতেও শিখিনি অদিতি
তুমি কেন ঝগড়া করোনি আমার সাথে ? জানি ঝগড়ায় তুমি খুব  অপটু ছিলে শুরুতেই শুদ্ধ উচ্চারণে কিছু চোখা চোখা কথা বলে একবোঝা কাপড়  নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যেতে তারপর কেবল জলের শব্দ! পৃথিবীর সব নদী যে তোমার  চোখে জল তুলে দিয়েছে ভাবতেই পারিনি কখনো তোমাকে তো কাঁদতে দেখিনি কোনদিন! ঘন্টারও বেশি সময় পেরিয়ে যখন বেরুতে তোমাকে খুব ফ্রেস লাগত আমি ভাবতাম আধুনিকা স্মার্ট নগর নন্দিনী এতক্ষণ ধরে রূপচর্চা  করলে বোধহয় মূহূর্তে মেজাজ জ্বলে যেত এত অবহেলা আমাকে! আমার সংগে ঝগড়াতেও তোমার এত অরুচি! এতই অগণ্য আমি! নগণ্য এক স্বামি মাত্র!    
গর্জে উঠতাম অনম রাগে অসভ্যের মত চীৎকার করতামকালো রঙ ঘষে ঘষে   ফর্সা করলে এত সময় নষ্ট করে আমার চা কই? দেরি কেন? কেমন স্ত্রী তুমি স্বামির চাহিদা বোঝ না? সাথির মা কেন চা বানাবে? বউ থাকতে কেন আমি বুয়ার হাতের চা খাবো ?” এই যুক্তিতে রেগে ফুলে কতবার কত কাপ ভেঙ্গেছি আমি ঘন্টায় ঘন্টায় চা না পেলে আমার মেজাজ তপ্ত হয়ে  উঠত দেরি হলেই গরম চা ছুঁড়ে ফেলে দিতাম ফ্লোরে, দেওয়ালে ঝনঝন করে কত ছবি ভেঙ্গে পড়ত আমার বাবা মা থেকে আমাদের সন্তানের ছবি তোমার সকল শক্তির উৎস প্রিয় রবীন্দ্রনাথের ছবি ভেঙ্গে কি যে আনন্দ পেতাম অদিতি! নিজেকে রাজা রাজা লাগত তখন  
আমাদের ছোট্ট ঘরের ছবি ঘেরা এই দেয়ালটির নাম দিয়েছিলে গ্যালারি মায়া   তুমি কখনো তোমার আর তোমার বাবা মার ছবি রাখোনি এই  দেওয়ালে আমি পছন্দ করতাম না মোটেই কথায় কথায় তোমাকে বিদ্ধ করতামরান্না শেখায়নি কেমন মা তোমার ? কেমন বাবা যে কেবল পড়াশুনা আর জ্ঞান শিখিয়েছে শুধুএত স্মার্ট কেন তোমার পরিবার? এত বেশি আধুনিক ? অথচ আমার আনস্মার্ট গেঁয়ো মা বাবার সাথে তোমার কি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তারা যে কোন কাজে তোমার উপর বিশ্বাস রেখে অনিন্দিত স্বস্তি পেত! আমার তাও ভাল লাগত না আমার শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে সর্বত্র আমার বাবা মায়ের কাছে আমি ছিলাম শুধু  সাইনবোর্ড এটা আমি বুঝতাম তাই জ্বলতাম সারাক্ষন অথচ কখনো  বুঝতে চাইনি আমার বাবা মা পরিবার কেন তোমাকে এত ভালবাসত! কি ছিল তোমার ? সব তো আমিই কেড়ে নিয়েছিলাম ছলে, বলে, কৌশলে
কি করে তোমাকে বুঝাই অদিতি  প্রতি মূহূর্তে  আমার মনে হত তুমি ইচ্ছা করে  আমাকে অবহেলা করছ তিরতির করে একটি রাগ আমার ঘাড় বেয়ে উঠে আসত মাথায় তোমাকে বার বার আঘাত করতাম তোমার রক্তাক্ত অসহায় মুখ দেখতে ভীষণ ভাল লাগত নিজেকে জয়ী মনে হত ইচ্ছা করত ১৪ শ স্কয়ারফুটের রাজত্বে অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে দিই তলোয়ারের ডগায় তোমাকে বিঁধিয়ে উল্লাস করি কেউ বাঁধা দিলেই কেটে ফেলব তাকে কতবার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমার হৃদপিণ্ডটাকে কুচিয়ে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছি জলে রেগে গেলে আমি বদ্ধ রাক্ষস হয়ে যেতাম কি করে  বাঁচলে তুমি অদিতি ? কোথায় ছিল তোমার প্রাণ ভ্রমরা? কতগুলো জীবন ছিল তোমার ? বল তো কি করে টুকরো টুকরো স্বপ্ন জুড়ে আবার একটি পূর্ণ স্বপ্ন বানাতে তুমি ? তোমার এই শক্তিটাকে আমার ভীষণ হিংসা হত জানো আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারতাম না তোমাকে কিছুতেই না মনে হত মায়াবিনী তুমি তোমার ব্যাংক ব্যালান্স সব তাই হাতিয়ে নিয়েছিলাম থাকো তুমি মায়াবনে একা অসহায় অচ্ছুত হাত তোলা হয়ে!   
কি নরম ছিলে তুমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে মেঘরঙের শাড়ি পরা সেই তুমি বই  ঘাটছিলে আমরা সোফায় বসে ভারিক্কি আলোচনা করছিলাম রাজনৈতিক সংস্কৃতির আগাপাশতলা ঝাড়াই বাছাই করে মেলাতে চাইছিলাম আমাদের প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের সাথে বাম রাজনীতিতে লোভের বন্যা বয়ে যাচ্ছে তখন চেনা জানা একেকটি বাম উইকেট মুখ থুবড়ে পড়ছে অর্থসম্পদ ক্ষমতার পদতলে  আমাদের সামনে পেছনে আশাহীন কালো সাগর মাঝ রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে নেতারা এখন কি করা যায় এটিই ছিল আলোচনার মুখ্য  বিষয় ঐ সময় তুমি রাজুকে ডেকে নিলেভাইয়া বইটা পেড়ে দিন না প্লিজ !” রাজু বই দিয়ে করুণ মুখে এসে বলেছিল, এই বাচ্চা মেয়েটি বাম ঘরানার কবিতা লিখে আবৃত্তি করে খারাপ লাগে ভাঙ্গন ছাড়া ওদের সামনে আমরা কোন আদর্শ রাখতে পারলাম না এই ভেবে” 
তোমার কাছে কবিতা চেয়েছিলাম লিটল ম্যাগের জন্যে সেই শুরু তারপর কত সকাল বিকেল সন্ধ্যায় তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছি কত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি মিছিলে আর্ট গ্যালারি কবিতা সন্ধ্যায় এক সাদা বৃষ্টির দিন অনেকগুলো ভেজা  কদমফুল দিয়ে বলেছিলাম, আমাকে বিয়ে করবে অদিতি ? কি সহজে তুমি আমার হাত ধরেছিলে মনে মনে বলেছিলাম, আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার পরে তখনো শুদ্ধ ছিলাম অদিতি তলোয়ারের মত ধারালো ছিল আমার আদর্শ তখনো প্রতিজ্ঞা ছিল চোয়ালে আঁকা ছিল সততার চিহ্ন তোমার ভালবাসা পেয়ে ধন্য হতাম বেঁচে থাকায় সরল আনন্দ ছিল 
সেই আমি বদলে গেলাম ভালবাসায় হিসেব করতে নেই আমি কিন্তু করেছিলাম অদিতি তোমার সর্বস্ব গ্রাস করে উদ্বাহু ক্ষুধায় আরো চাই চাই করে আমি আর  মানুষ রইলাম না গো শেষ আশ্বিনের সুখহীন পানকৌড়ির মত তোমাদের ফেলে পালিয়ে এলাম আরো আরো সুখের নেশায় আমি হাসলে এখন ধাতব শব্দ হয়, বুকের জমিনে খচমচ করে কাগুজে টাকার শব্দ, হাতের মুঠোয় ক্ষমতার রঙবেরঙের পোষা পাখি শুধু তোমাকে পেলাম না অদিতি
কেমন আছ তুমি তোমার সন্তান ? ভালবাসার এই দিনে তুমি কি এখনো ফুল কেনো ? সন্তানকে শুনাও তোমার ভালবাসার গল্প তুমি কি এখনো বিশ্বাস কর মানুষ ভুল হতে পারে মূহূর্তগুলো ভুল ছিলো না কখনো ? আমি পারিনা অদিতি  আমার কোন গল্প নাই আমার কোন অতীত নাই জয়পাহাড়ের উপর একা দাঁড়িয়ে জয়ধ্বনি শুনি আমার প্রতিদিনই ভালবাসার দিন গ্র্যান্ড ভ্যালেন্টাইন ডে তবু  মনে পড়ে যায় মাটির ফুলদানিতে সবুজপাতার ফাঁকে সেই ফুলগুলোকে
ভাল থেকো অদিতি ভাল থেকো

SHARE THIS

Author: