ইমেল নাঈম এর কাব্যগ্রন্থঃ দুরবিন চোখ থেকে কবিতা




এভাবেও বেঁচে থাকা যায় 

প্রতিদিন কে যেন বলে কিছু লেখো, অনেকদিন নিদ্রা যাপন আর বিরতিতে কাটিয়ে দিলে অব্যক্ত ফাগুন। খুব গভীর সেই ডাক। বলে অনেক উপেক্ষা আর অপেক্ষার আবরণে বলিদানের উৎসব হচ্ছে খুব।

প্রতিদিনই ভাবি আজ কিছু লেখবো। আত্মনিমগ্ন হতেই চোখে ভাসে জ্বলে যাচ্ছে মানচিত্র। ছাই হয়ে যাওয়া বাস আর তার অবশিষ্ট নিথর কৃষ্ণ কালো সেই দেহগুলো।

একদিন আমরা সবাই বেড়িয়ে এসেছিলাম রাস্তায়। মাসটা ফেব্রুয়ারি , সাল দুই হাজার তেরো আর তারিখের ঘরে পাঁচ। আমরা এখন আর বের হই না। জাগরণের নাম কারা যেন দিয়েছিলো প্রহসন। পরিচিত নামগুলো অপ্রকাশিত থেকে যায়, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়।

নিজেকে বয়ে চলেছি এতোটা পথ। প্রতিটা দিনকে মনে হয় অতিরিক্ত জীবনের ফল্গুধারা। সবাই পুড়লে তো অন্তত আমি ভালো আছি!

এভাবেও বেঁচে থাকে মানুষ...এভাবেও বাঁচে একটা দেশ...


টক শো

লাইট, ক্যামেরা, একশন বলা মাত্র টিভির পর্দা ছিঁড়ে শুরু হয়ে গেলো সার্কাসপার্টি। হাস্যোজ্বল উপস্থাপক এগিয়ে দিলেন দাবার ঘুটি ডানে। আলোচক বলেই যাচ্ছেন টিয়া পাখির মুখস্থ করা নামতা। বাম প্রান্ত দিয়ে প্রতিউত্তরে ক্ষোভ আর শ্লেষ ভেসে আসে। মাঝের জন বারবার থামিয়ে দেন আর মিটিমিটি হাসেন।

কার আছে কতো জোর, তা নিয়ে টেবিল চাপড়ে চলেছেন ক্রমান্বয়ে। খানিকটা উত্তাপ বাড়লেই আসছে বিজ্ঞাপন বিরতি।

'দিকে বিরামহীন পুড়ছে আটষট্টি হাজার গ্রাম, ভাতের দাম বাড়ছে ক্রমান্বয়ে...না খেয়ে মরেই গেলো কোন এক রহিমুদ্দিন। ঘরছাড়া হলেন গ্রাম্য নাপিত হরি রঞ্জন। গ্রাম্য সালিশি ব্যবস্থায় বলীর পাঠা হয়ে গেলো মাত্র পেকে ওঠা কৈশোর। মাওলানারূপী ভণ্ডটা ধর্মের নামে চালিয়ে দিলো ব্যবসা। চতুর শিয়ালটা খেয়ে দিলো কৃষকের নির্মল হাসি।

এভাবেই তর্কের খাতায় বাড়ছে একেকটি পর্ব। এদিকে বিলীন হচ্ছে সোনালী অধ্যায়। তবুও অনুষ্ঠান শেষে উপস্থাপকের সহাস্যমুখে বলে বসেন আগামী দিনের অনুষ্ঠানের আগাম নিমন্ত্রণ।

অন্যরকম যাত্রা

তোর আকাশ প্রিয় বলেই পানিতে ভেসে গেলি বড্ড অসময়ে। ওই কালো চোখে কোন স্বপ্ন নেই, যেটুকু আর্দ্রতা দিয়ে ঘিরে রেখেছিলো কালো মণি তাতে ভেসে ওঠে একটি পরিবার, একটি জীবন যুদ্ধের সারসংক্ষেপ। বলেছিলি কোন মতে আকাশ পাড়ি দিলেই পেয়ে যাবি নতুন জীবন।

কেউ একজন তোর কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো, কেউ দু বাহু আলিঙ্গনে বলেছিলো কিছু কথা, আর একটা লজ্জাবতী ফুল আঁচলের ফাঁক গলে ঠিকই দেখেছিলো তুই হারিয়ে যাচ্ছিস চিরপরিচিত জায়গা ছেড়ে ভিন্ন গোলকে।

এরপর তুই নিজেই উঠে বসলি নৌকায়। তারপর অর্ধাহার কিংবা অনাহারে অন্যরকম জীবন । নৌকারোহী কঠিন চোয়ালের লোকটি মাঝে মাঝে পিঠে বসিয়ে দেয় কয়েক ঘা। হাত পায়ের এমন ব্যবহার সহ্য করে হাঁপিয়ে পাড়ি দিচ্ছিলি নীলচে ঢেউ।

খুব অভিমানী ছিলি বলেই প্রতিদিনের পরাজয়কে হারিয়ে দিলি একদিনেই। পত্রিকার পাতায় এলো তোর ছবি। বিকৃত মুখ, তরলে গিলে ফেললো সবটুকু কোমলতা। আকাশ ভালবাসতি বলেই তারাদের সাথে পেতে নিলি বন্ধুতা। চেয়ে দ্যাখ, বঙ্গোপসাগরের নীল জলে তোর মত অনেকেই আকাশ ভালবেসেছে দুবেলা আহারের খোঁজে।



এই শহরের মানুষেরা

পুড়ে যাওয়া শহরে যথা সময়ে আসে ফাগুন কিংবা ভালবাসার উৎসব। তুমিও খোলসের ভিতরেই করে চলো অনেক স্বপ্নের চাষবাস। হলুদে রাঙিয়ে ফেলো নিজেকে, আর ভরদুপুরে প্রিয় মানুষের হাতে রাখো হাত। স্বচ্ছ জীবনের দ্বিমাত্রিক অঙ্গনে আর কোন অবশিষ্ট ছায়া নেই।

পুড়ে যাওয়া শহরে কিছু মানুষ এখনো নিঃসঙ্গ। তারা সকাল সাঁঝে কবিতা লেখে, চা খায়, পাড়ার দোকানে বেনসন আর গোল্ডলিফ পোড়ায়। বন্ধুরা মিলে হৈচৈ করে, দল বেঁধে খেলতে যায় অচেনা কোন খেলা। আবার নতুন কোন মেয়ে দেখলেই আলোচনা কিংবা সমালোচনায় মেতে ওঠে। জীবন আর জীবীকার টানাপোড়নে নিষ্পেষিত হতে থাকে এই মুখগুলো।

কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখে না। শুধু লড়ে চলে অবিরাম। সকাল থেকে সাঁঝ অবধি দৌড়ে চলে মাত্রাহীন। কিছু মানুষের জীবনের হাসি ফুটিয়ে আনার জন্য বিসর্জন দিয়ে দেয় কেউ। তারা জানে না জীবনের পথে গাল বেয়ে ঝড়ে পড়া অশ্রু কণাগুলো কষ্টের নয় শিশিরের মতো মোলায়েম, আনন্দদায়ক আর অর্থহীন সুখের মতোই ঐশ্বর্য সমৃদ্ধ।



বালুঘড়ির খেলা

প্রতিদিন খবরের পাতা জুড়ে আসে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি। পাতা ভরে যায় কালো বর্ণের কালিতে। বিবর্ণ সময়ের বালুঘড়ি ছুটে চলে। সেই সাথে বাড়তে থাকে নামের সংখ্যা যাদের ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে আপন ঠিকানা। নির্দিষ্ট সময় অন্তর পালটে যায় বালু ঘড়ির মুখ।

অনেক স্বপ্ন জাগানিয়া সেই সব নাম, অনেক পরিবারের বট বৃক্ষতে পরিণত হওয়া সেই সব নাম মিলিয়ে যায় দম বদ্ধ করা সীসার বাতাসে। বিষাক্ত বাতাস আর আগুনে খেয়ে নেয়  সেই সব শরীর।

হারিয়ে যাওয়ার কারণ জানে না কেউ। কেউ নেয় না তার দায়ভার, ব্যর্থতা স্বীকারের কথা শিখে নি ভূগোল। রাষ্ট্র বিজ্ঞান সূত্র পরে থাকে অবহেলিত বইয়ের ভাজে। সামাজিক মাধ্যমগুলো মজে থাকে প্রেম আর পরকীয়ায়। বোকা বাক্সে নেই কোন আতঙ্কের খবর।

হাসপাতালে বিদগ্ধ শরীর নিয়ে কাতরাতে থাকে তারা। হয়তো মৃত্যু দূতের অপেক্ষায় পার করে বালু ঘড়ির অদ্ভুত খেলা। আত্মীয় স্বজনের বাইরে কেউ একজন দেখে যান তাদের। পাশে দাঁড়ান সাময়িকভাবে। টিভি ক্যামেরা দেখলেই কেঁদে ফেলেন অনায়েশে। অপর পাশে একের পর এক হুকুম করে যান অন্য কেউ। প্রতিটি কর্মের দায়ভার তুলে দেন বিপরীত মেরুতে।


কবি পরিচিতিঃ
ইমেল নাঈম, জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর, চট্টগ্রাম জেলা।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘
দেয়ালের ও'প্রান্ত পেরিয়ে’ – ১৫
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দুরবিন চোখ’ আসছে এবারের বই মেলায়।
প্রচ্ছদঃ দেবাশীষ মজুমদার
প্রকাশকঃ রাজীব চৌধুরী
প্রকাশনাঃ চৈতন্য
প্রাপ্তিস্থানঃ একুশে বইমেলা, স্টল নাম্বার ১৫৬ এবং বহেড়াতলার লিটল ম্যাগ চত্বরে।
জলফড়িং ভালোবাসা সংখ্যায় থাকছে দুরবিন চোখ কাব্যগ্রন্থ থেকে পাঁচটি কবিতা।


SHARE THIS

Author: