বিস্মরণ ।। সুমী সিকানদার


ডোর বেল বাজল, মিষ্টি ধ্বনি ছড়ালো ঘরের স্ট্যাটাসে। মিউজিক শোনা গেলো টুং টাং। ঘরের ভেতর যিনি ছিলেন তিনি এমনিতে দেরী করে ফেলেছেন ,আরো দেরী যেন না হয় ভেবে দৌড়ে গেলেন তরাসে।

দরজা খুললেন। যিনি বাইরে দাঁড়ানো তার মুখ থেকে চমকে গেলেন ভিতরের মানুষ ।তুমুল শীতে বাইরে দাঁড়ানো মানুষটি কাঁপছে। সারাশরীর জুড়ে খুব ঠেসে জ্যাকেট হুডি বুট গ্লাভসএসব পরা। শুধু সুন্দর পানপাতা মুখটা ঈষৎ লালচে ক্রিমসন।


বনজবা এসেছে।


কিছু বলার আগেই  ''আমি এসে গেছি ' ঘোষণা দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়ানো সে।

''এসে গেছি মানে?'' ঘরের ভেতর থেকে অস্থির কণ্ঠ।

''সত্যি চলে এসেছি। এই দেখো হাতে সুটকেস।''বলা বাহুল্য তার হাতে বেগুনী ট্রলি এবং কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ।

''তুমি এভাবে চলে এলে আমাকে তো বলোনি''নিরুত্তাপ কণ্ঠ ।

 ''দেখো শুভ্র, আমি সারপ্রাইজ দেবার জন্য এটা করিনি তুমি জানো। এভাবে না এলে আসা হতোনা। এখন চলো আমাকে খেতে দেবে খিদে পেয়েছে।''

 ''জবা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। তুমি কি তোমার ভাইয়ের বাসায় উঠেছ? ''বিস্ময় গোপন না করে সরাসরি প্রশ্ন শুভ্রর।

'''আমার হাতে সময়ও নেই, জব এ যেতে হবে। ''

জবা সহজ হবার চেষ্টা করছে... ''তুমি জবে যাও । আমি নিজেই সব গুছিয়ে নিচ্ছি। কোথায় কি আছে আমি সব জানি তো। প্রতিদিনের দেখা ঘর । সন্ধ্যায় সব বলবো তখন। না এসে উপায় ছিলো না ।''

'প্রশ্নই ওঠেনা। তুমি এভাবে আসতে পারোনা।' মুখের কথা শেষ করতে দেয়নি শুভ্র।

''তুমি কিভাবে ভাবলে যে আমি মেন্টালি রেডি । আমার তো সময় দরকার ছিলো।''

''এটা তো নতুন নয় শুভ্র। ,বনজবা কথা বলতে পারছেনা। তার গলা কিসে যেন চিরে গেছে। ''আজ নয় দুইদিন পর তো আসার কথাই ছিলো শুভ্র, এমন ভাব করছো যে  চিনতে পারছোনা।''

চোখে পানি জমছে জবার । এখনও বসতে বলেনি শুভ্র।

''তোমার ছেলেকে কি করেছ? ''সরাসরি চোখে তাকায় শুভ্র।

''ছেলেকে নিয়ে তো তোমার সাথে কোন মীমাংসা হয়নি। আর সে তার দাদু বাড়িতেই ভালো থাকবে।'' একটু দম নেয় জবা । ''এখন এসব কথা কেন বলছো শুভ্র?'' এগিয়ে এসে শুভ্র গালে আঙ্গুল রাখে। ''কি হয়েছে তোমার?''

'' জবা ...লিসেন,এবার আমার কথা মন দিয়ে শোনো। তোমাকে এখন যেতে হবে । ' চিবিয়ে চিবিয়ে রায় শোনাচ্ছে শুভ্র

মানে !! এখন কোথায় যাবো?

''কোথায় যাবে সেটা তো আমার ব্যাপার নয় ।  তোমার ভাইয়ের কাছেই যাও বরং । ''

জবা একদম চুপ। শতাব্দীর নিস্তব্ধতা তাকে পেয়ে বসেছে। জার্নি করে এসে মাথাটাও ধরেছে খুব। শুভ্র কি একটু বসতে বলবে না?

''আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ট্রেন ধরতে হবে।'' শুভ্র জুতো পরছে।

''আমি তোমার জন্য সংসার ফেলে এসেছি শুভ্র। '' আর কিছু শোনা যাচ্ছেনা জবা কী যেন বিড়বিড় করে।

''তোমাকে ফিরতে হবে। কারণ আমার এখানে এভাবে তোমাকে রাখা সম্ভব নয়। আর সত্যি বলতে তোমার জন্য আমার ইদানীং কোন ফিলিংস কাজ করেনা। আমি বারবার একথা বলিনি? বলেছি।  তুমি সব সময় ভার্চুয়ালি কাজ করো,বাস্তব বোঝ না।''

জবা চারপাশ দেখছে ,এই তো কোণায় নতুন বুকশেলফটা অনলাইনে সেই পছন্দ করেছিল। শুভ্র কী খুশী তখন! তুমি দূর থেকে সব সাজিয়ে দিচ্ছো বনজ। আসার আগে ভালো কিছু বই আনবে। দেশী ম্যটেরিয়াল দিয়ে পর্দা,কুশন কভার,নকশি কাঁথার ওয়ালহ্যাঙ্গিং সব বানিয়ে পাঠিয়েছে বনজবা। তাদের সম্মিলিত ঘর।

ছেলে নিয়ে বাকী জীবন কাটিয়ে দেবে মনস্থির করেছিলো।কিন্তু আচমকা শুভ্র এসেছে জীবনে। অনিবার্য শুভ্র। উথালপাথাল ক্ষণের শুভ্র । এই দুরন্ত ভাললাগাকে ঠেকাতে পারেনি ওরা কেউ। ঠেকাতে চায়ওনি।

যেন বাঁধ ছাড়া কুসুমিত প্রবল প্রবাহ।
 
''এখন এসো আমি দরজা লক করে যাবো।' শুভ্র কঠিন কন্ঠ।
জবা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে ,''কি হয়েছে সোনা ? আমি তো তোমার কাছে এসেছি , আমিই তো আসবো।'' তোতলাচ্ছে বনজবা। '' না বলে এসেছি তাই রাগ করেছো? আমি সব বলছি তোমাকে দশটা মিনিট সময় দাও। ''আমিতো' ...... থেমে গেলো বনজবা ।


নাহ ড্রইং রুমে আর কেউ নেই।

শুভ্র বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করছে। '' প্লিজ জবা। আমি পরে যোগাযোগ করবো।। এখন এসো।''

ধীরে ধীরে বেগুনী ট্রলিটা ঠেলে ঠেলে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো জবা। হাঁটার গতি শামুক বিষণ্ণ। পরাজিত পাকিস্তান। সে ঘরে মাত্র দু'পা দিয়েছিলো। সেখান থেকেই বেড়িয়ে এলো মণি মায়ায়। দরজার বাইরে এসে অবাক হয়ে শুভ্রর দিকে চেয়ে রইলো । এখনতো তাদের চা বিরতি নেবার কথা। প্রতিদিন এসময় তারা দু প্রান্তে বসে চা খায়,গল্প করে।

শুভ্রের গতি খরগোস। দ্রুততায় দরজা লক করে এবং তারও বেশী দ্রুত গতিতে টুকরো টুকরো বরফে মিলিয়ে যায়।

যেন এই মুখ যোজন অচেনা,দেখা হয়নি কখনো। হাভাতের মতো নিষ্ঠুর লগন।

ট্রলি হাতে দরজার পাশে দাঁড়ানো একা তালগাছ বনজবা। বড্ড বোকা লাগছে নিজেকে । বেশুমার পরাজিত লাগছে।

বনজবা ভাবল হয়তো একটু আগের সময়টা বাস্তব না । সিনে কুয়াশার টলটল কিছু।

**

হাসপাতালে পৌছাতেই ব্রাদার ড্রেস  চেঞ্জ করে দিলেন ।  বেড রেডি করাই আছে,আজ শুভ্রের ডায়ালোসিসের ডেট। তার একটি কিডনি পুরোপুরি অকেজো । বাকিটাও যাবার পথে। ঢিমালয়ে কাছে আসতে থাকা সাদা ফ্যাকাসে প্রকাণ্ড দিন তাকে গ্রাস করে কুমিরের মতো।


বনজবাকে এখন কাছে টেনে নেয়া সম্ভব না।


শুভ্রর একা জীবনে জবা এক উত্তাল স্রোত এক দুরন্ত ক্যানভাস। এই দুর্দানাকে সে আজ বাইরের জ্বলন্ত তুষারের মধ্যে ফেলে এসেছে। নিজেকেই আর বিশ্বাস হচ্ছেনা নিজের।

সিস্টার স্যালাইন লাগিয়ে দিলেন। চটকরে একটু সুঁইফোটার ব্যথা আজ যেন তার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল।

কষ্ট আর ধরে রাখতে না পেরে দু'চোখ বেয়ে অঝোরে লোনা গড়াচ্ছে শুভ্রর। আহা হলোনা ছাই সংসার ,তার আর বনজবার সংসার। অনুচ্চারিত শব্দে সে রুদ্ধ কণ্ঠ।

 ডাকল ফুটফুটে ডলফিনের ভাসানে,

'জবা,ঘ্রাণ ...আমার বনজবা, একলা আমার......

***

ক্রমশঃ জমতে থাকা ছেঁড়া ছেঁড়া বরফের বুকে  এলোমেলো পা ফেলছে বনজবা নি:সঙ্গ শেরপার মতো। সাথে চলে তার কাপড় ভর্তি অবাক ট্রলি।  আচ্ছা তার এই বনজবা নামটা কে রেখেছে?
মা নাকি বাবা!


ছোটবেলার একবার মার হাত ছুটে ভিড়ে হারিয়ে গেছিলো সে । আজ আবার এই কর্কট শীতলে এই বিপন্ন মানসিকতায় নিজেকে ফের হারিয়ে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে।

''মা ,শীত করছে মা।'' যদিও তুষারের সর্বোচ্চ মাইনাস তাকে শীতল করেনা ততোটা।


শুভ্রর দেয়া শূন্য ব্যালট অপমানে সে প্রবল বেগে কাঁপতে লাগলো। সে একগুঁয়ের মত ট্রলি ঠেলছে।


তার আড়াই বছরের বাবাই কি ডেকে উঠল? কিছুদিন হলো কথা শিখেছে ছেলে । সারাদিন মাম্মা ,মাম্মা।


'বাবাই কার ছেলে গো?

''মাম্মার ছেলেএএএএ।''


বাবাইয়ের ক্ষুদি ক্ষুদি দাঁত বার করা হাসি চারিদিকে ঝমঝম বাজছে। কী সুন্দর শব্দ বাবাইয়ের হাসির। বনজবা একমনে শুনছে  ছেলের ডাক..মাম্মা , মাম্মা .

শুনতে শুনতে তার হাঁটার গতি বাড়ছে।

 সে যেন ওয়াজফিয়া নাজরীন ..সে যেন শেরপা ..এভারেস্টের দিকে যাচ্ছে..

SHARE THIS

Author: